post

তোমরা আল্লাহর দ্বীনের কাজ থেকে পিছপা হবে না

সাইয়্যেদা হাসনা বানু

২১ সেপ্টেম্বর ২০২২

বাংলাদেশ স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকেই একদলীয় শাসনব্যবস্থা, বাকশালী স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে কেয়ারটেকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার রূপকার ও মূল প্রবক্তা ছিলেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের তৎকালীন আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম। এর পরবর্তীতে গণতন্ত্রের নবপথচলা শুরু হলেও তা শত্রুমুক্ত ছিল না; একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের দোসরদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের নীলনকশায় আঁকা এই গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তি দেশকে অকার্যকর কিংবা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইত্যাদি নেতিবাচক পরিচয়ে দেশকে উপস্থাপনের জন্য দেশে-বিদেশে নানা তৎপরতা চালায় এবং গণতন্ত্রায়নের মূলে কুঠারাঘাতের জন্য সদা সচেষ্ট থেকেছে। ২০০৭ সালের নির্বাচন বানচালের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রহীনতা কায়েমের টার্গেটে ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর ঢাকার পল্টনে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে নৈরাজ্য, রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করেছে। সেদিন বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ সমাবেশে লগি- বৈঠাধারী আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী ঘাতকদের হাতে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৬ জন নেতাকর্মীকে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করতে হয়। এসব সন্ত্রাসীর হাতে আহত হয়েছেন এক হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষ। আওয়ামী হায়েনাদের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের শিকার আমাদের প্রাণপ্রিয় আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল। শহীদ সৌদি বাদশাহ ফয়সালের নামানুসারে রাখা আমাদের ফয়সালও যে তালিকাভুক্ত হয়ে যাবে তা ছিল ভাবনাহীন। শাহাদাতের সময় তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। সংগঠনের কর্মী ও অধ্যয়নরত বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদ ফয়সালের বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার মোস্তফানগরে। ছাত্রসংবাদের কাছে শহীদ ফয়সালের মা এই সাক্ষাৎকার দেন-

ছাত্রসংবাদ : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ- আপনি কেমন আছেন?

শহীদ ফয়সাল ভাইয়ের মা : ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ- ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ।


ছাত্রসংবাদ : প্রিয় সন্তানের শাহাদাতের প্রায় ১৬ বছর অতিবাহিত হলো। সেদিনের ঘটনাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন। 

শহীদ ফয়সাল ভাইয়ের মা : সেদিনের ঘটনাটা আমার জন্য বিরাট ট্র্যাজেডি। স্বামীকে হারিয়েছি তিন বছর আগে এরপর সন্তান হারানোর ব্যথাটা আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। যে কষ্টের কথাটা মনে পড়লে আজও বুক ফেটে যায়। তবু একটা যথার্থ সান্ত¡না পাই যে আমার সন্তান দ্বীনের জন্য জীবন দিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ওদেরকে মৃত বলো না বরং ওরা জীবিত। ওরা আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজিকপ্রাপ্ত। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন আমার ফয়সালের শাহাদাত কবুল করে তাকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করেন। 


ছাত্রসংবাদ : জনসভায় যাওয়ার জন্য সেদিন আপনার সন্তানের প্রস্তুতি কেমন ছিলো? 

শহীদ ফয়সাল ভাইয়ের মা : জনসভায় যাওয়ার সময় ফয়সাল ও ফাইদ খুবই উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়ল। এর কিছুক্ষণ আগে বাজার করে নিয়ে এলো তাজা কতগুলো শসা ও অন্যান্য খরচসহ। আমি প্রশ্ন করলাম, গোশত নাই বাজার নিয়ে আসছ কেন? ফয়সাল শরীরটাকে নাড়াচাড়া দিয়ে বলল, তাজা শসা খেয়ে জিহাদে যেতে হবে, এই বলে ফয়সাল চলে গেল। আল্লাহ তায়ালা তার এবং আমার সদিচ্ছাকে কবুল করে নিয়েছেন। 


ছাত্রসংবাদ : শাহাদাতের সংবাদ কিভাবে জানতে পেরেছিলেন?

শহীদ ফয়সাল ভাইয়ের মা : প্রতিবেশী রংমিস্ত্রি খলিল মিয়া লোকটা গত বছর মারা গেছেন। উনি এসে জানালা জোরে ধাক্কা দিয়ে বললেন, খালাম্মা আপনার দুই ছেলেকেই সন্ত্রাসীরা মেরে আহত করে রেখেছে। এই কথা শুনে আমি আর স্থির থাকতে পারিনি, অমনি বোরখাটা পরে বাকী বিল্লাহ ভাইয়ের বাসার দিকে দৌড়ে যাই, সেখানে কাউকে না দেখে দৌড়িয়ে সুগন্ধা হাসপাতালের দিকে যাওয়ার সময় দেখি অনেক লোকের ভিড়। আমাদের এলাকার একটা ছেলে আমাকে সেখানে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি ফাহাদ ও ফয়সালকে গাড়িতে উঠিয়েছে। সে মুহূর্তে আমার বড়ো ছেলে ফুয়াদ কার কাছে শুনেছে ও সেখানে হাজির। ফুয়াদ আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে বললেন আমি ফাহাদের কাছে থাকি।

ফুয়াদ ফয়সালের অবস্থাটা খুবই খারাপ বুঝতে পেরেছে কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারি নাই শুধু কান্না আর কান্নাই করে যাচ্ছি। তারপর ওদেরকে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ফয়সালের অবস্থা বেশি খারাপ দেখে ওকে ইবনে সিনায় নিয়ে যাওয়া হলো। ফয়সাল পরের দিন ২ অক্টোবর দুনিয়া ছেড়ে শাহাদাত বরণ করেন। 


ছাত্রসংবাদ : এত দিনেও বিচার হয়নি, মামলাও বাতিল করে দিয়েছে খুনিদের বিচার হবে বলে মনে করেন কি? 

শহীদ ফয়সাল ভাইয়ের মা : জুলুমবাজ সরকার বিচার করেনি এবং মামলাও বাতিল করে দিয়েছে সরকার চেঞ্জ হলে ইনশাআল্লাহ বিচার হবে বলে আশা করি। আর যদি দুনিয়ার আদালতে এই জুলুমের বিচার না হয়, তাহলে আল্লাহর আদালতে আমরা এর বিচার পাবো ইনশাআল্লাহ। 


ছাত্রসংবাদ : ফয়সাল ভাইয়ের বিশেষ কোন স্মৃতি বেশি মনে পড়ে? 

শহীদ ফয়সাল ভাইয়ের মা : ফয়সাল একজন সাদাসিধে সহজ সরল ছেলে ছিল। সে বড়োদের  সাথে ছিলো বিনয়ী। ছোটদের খুব স্নেহ করত। সে একটা কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করত। ঐদিনের স্মৃতিটা আমার খুবই মনে পড়ে কিছু সমস্যার কারণে ফয়সাল ঐ স্কুল থেকে বিদায় নিলো। ফয়সালের জন্য ঐ স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকেই একটা একটা করে গিফট নিয়ে আসল। এসে আমাদের টেবিলটি ভরে ফেললো এবং সবার মুখে একই কথা, স্যার আপনি কেন স্কুল থেকে চলে এলেন। সবার মনে খুবই দুঃখ। ফয়সাল ওদেরকে আদর করে নিজের সমস্যার কথা জানালো। 


ছাত্রসংবাদ : ফয়সাল ভাইয়ের কোন গুণটি ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য অনুসরণীয় মনে করেন?

শহীদ ফয়সাল ভাইয়ের মা : ফয়সালের পরোপকার করার প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক ছিলো। মানুষের বিপদে সে সবার আগে যেত। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ে একবার লীগের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে অনেক ছেলেকে আহত করে। ফয়সাল সেদিন ভার্সিটিতে যায়নি, পরের দিন শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেয়ে ভাইদের সেবাযত্ন করে অনেক রাত্রে বাসায় ফিরে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের একজনের জন্য অন্যজন এভাবেই নিবেদিতপ্রাণ হওয়া উচিত। 


ছাত্রসংবাদ : ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য শহীদের গর্বিত মাতা হিসাবে আপনার উপদেশ কী? 

শহীদ ফয়সাল ভাইয়ের মা : আমি একজন সামান্য জ্ঞানের মানুষ হিসেবে বলবো, তোমরা আল্লাহর দ্বীনের জন্য যেভাবে কাজ করে যাচ্ছ তা থেকে পিছপা হবে না। আল্লাহ তোমাদের অবশ্যই সাহায্য করবেন। আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছি। তিনি যেন তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং তোমাদের প্রচেষ্টাকে কবুল করেন।


ছাত্রসংবাদ : ভালো থাকবেন। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।

শহীদ ফয়সাল ভাইয়ের মা : তোমাদের জন্য দোয়া ও শুভ কামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির