সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। পৃথিবী সৃষ্টি থেকে শুরু করে আবহমান কাল ধরে সত্য-মিথ্যার এ দ্বন্দ্ব বিশ্বব্যাপী পরিচিত। যখনই কোথাও সত্যের উত্থান ঘটেছে সেখানেই অসত্যের কালো থাবা ভয়ানকভাবে আক্রমণ করেছে। ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রও এর বিপরীত নয়। যেখানেই দায়ী ইলাল্লাহগণ আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত মানুষের কাছে পেশ করেছে সেখানেই ইসলামবিরোধী শক্তি আল্লাহর দ্বীনের এ আলোকে মুছে দেয়ার চেষ্টা করেছে। আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেন, يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ “ইসলামবিরোধী শক্তি তাদের মুখের ফুৎকার দিয়ে আল্লাহ তায়ালার আলোকে মুছে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর আলোকে জ্বালিয়ে রাখবেন এতে কাফেরদের মনে যত কষ্টই হোক না কেন।” বিরোধী শক্তির মুকাবিলায় রাসূল সা. ইসলামী দাওয়াতের কাজ আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ ‘‘হে রাসূল! তোমার প্রভুর পক্ষ হতে তোমার ওপর যা কিছু নাযিল করা হয়েছে, তা লোকদের কাছে পৌঁছে দাও। তুমি যদি তা না কর, তাহলে তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলে না। লোকদের অনিষ্ট হতে আল্লাহই তোমাকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।” নিম্নে রাসূল সা.-এর দাওয়াতি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ও কর্মকৌশলগুলো তুলে ধরা হলো:
তাগুতি শক্তির বিরোধিতা পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম থেকেই ইসলামকে মুছে দেয়ার জন্য তাগুতি শক্তি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সকল নবী-রাসূলগণই এর শিকার হয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ “যারা কাফের তারা তাগুতের রাস্তায় যুদ্ধ করে।” আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ قَدْ ضَلُّوا ضَلَالًا بَعِيدًا “নিশ্চয় যারা কাফের তারা আল্লাহর পথ হতে অপর লোকদেরকে ফিরিয়ে রাখে তারা পথভ্রষ্ট, সত্য হতে বহুদূরে চলে গিয়েছে।” এ বিরোধিতা মুহাম্মদ সা.-এর সময় সবচেয়ে বেশি হয়েছিলো, তিনি অত্যন্ত ধৈর্য ও কৌশলে মুকাবিলা করে ইসলামের দাওয়াত সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
সামাজিক কুসংস্কার ও পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে সামাজিক কুসংস্কার ও পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। যখনই তাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত নিয়ে রাসূল সা. গেছেন তখনই তারা বলেছে, আমাদের পূর্বপুরুষরা এইভাবে এইভাবে করত তুমি আবার কোথা থেকে নতুন জিনিস নিয়ে এলে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ قَالُوا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آَبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آَبَاؤُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ “যখন তাদেরকে বলা হয়, এসো সেই বিধানের দিকে যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং এসো রাসূলের দিকে, তখন তারা বলে, আমাদের বাপ-দাদাকে যে পথে পেয়েছি সে পথই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তারা কি নিজেদের বাপ-দাদারই অনুসরণ করে চলবে, যদিও তারা কিছুই জানতো না এবং সঠিক পথও তাদের জানা ছিলো না।” বর্তমান সময়েও এ প্রতিবন্ধকতা আমাদের সমাজে বিরাজমান রয়েছে। এখনও দায়ীরা আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের সঠিক দাওয়াত উপস্থাপন করলে তারা অনুরূপ কথাই বলবে। এটা দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা।
ধর্মহীনদের বিরোধিতা পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই ধর্মহীনরা ইসলামকে সমাজ থেকে মুছে দেয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। সমাজে এমন কিছু মতাদর্শ রয়েছে যারা ইসলামী দাওয়াহ এর মহান শিক্ষা ও মহান লক্ষ্যকে পশ্চাতে রেখে বুদ্ধি বিবেকের প্রাচুর্যে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা, খোদাদ্রোহিতা এবং ফিতরাত বিরুদ্ধ বাসনাকে আকর্ষণীয় চিন্তাধারার প্রলেপে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে। তাদের মোহনীয় ভ্রান্ত মতবাদ ও দর্শনে সম্মোহিত হয়ে বিশ্বের কোটি কোটি মানবসন্তান আল্লাহ প্রদত্ত সহজ সরল জীবনগতি হারিয়ে চরম দুর্গতি যন্ত্রণা ও ধ্বংসে নিপতিত হয়েছে।
শয়তানের ষড়যন্ত্র হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব যেখানে চলমান শয়তানের ষড়যন্ত্র সেখানে বিদ্যমান। শয়তান মানুষের চিরশত্রু, সে সদা-সর্বদা ইসলামী দাওয়াতের পথে বাধা সৃষ্টি করে। আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেন, وَلَا يَصُدَّنَّكُمُ الشَّيْطَانُ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ “শয়তান যেন তোমাদের নিবৃত্ত না করে। সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” শয়তান বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ তৈরি করে মানুষকে আল্লাহর দ্বীন থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে। আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ “শয়তানের অভিপ্রায় হলো যে, সে তোমাদের মাঝে শত্রুতা বিদ্বেষ ঘটিয়ে দেবে।”
রাসূল সা.-এর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া, সন্দেহ ও অভিযোগ সৃষ্টি করা : ইসলাম বিরোধী শক্তির পক্ষ থেকে রাসূল সা.-এর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া, সন্দেহ ও অভিযোগ সৃষ্টি করা দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটি সমস্যা। এ সমস্যা আজকের নয় বরং পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে এ পর্যন্ত চলে আসছে। যেমন- (ক) নবী সা. ও তার অনুসারীরা বোকা লোক : অর্থাৎ জীবন-যাপনে তারা সুচতুর বা বুদ্ধিমান নয়। যারা স্বাদ আহলাদ ভোগ বিলাস বোঝে না। মহানবী সা.-এর যুগেও কাফেররা তার দাওয়াতের বিরোধিতায় তাই বলত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آَمِنُوا كَمَا آَمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا آَمَنَ السُّفَهَاءُ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاءُ وَلَكِنْ لَا يَعْلَمُونَ “আর যখন তাদেরকে বলা হয়, অন্যান্যরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন, তখন তারা বলে, আমরাও কি ঈমান আনব বোকাদের মত। মনে রেখ প্রকৃতপক্ষে তারা বোকা, কিন্তু তারা তা বোঝে না।”
(খ) দায়ীরা পথভ্রষ্ট : অর্থাৎ তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট এবং তারা সাধারণ মানুষকে পথভ্রষ্ট করে উন্নতি, প্রগতি ও সুসভ্যতা থেকে দূরে রেখেছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ قَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلَّذِينَ آَمَنُوا أَنُطْعِمُ مَنْ لَوْ يَشَاءُ اللَّهُ أَطْعَمَهُ إِنْ أَنْتُمْ إِلَّا فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ “যখন তাদেরকে বলা হলো আল্লাহ যা দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় কর। তখন কাফেররা মুমিনদেরকে বলে, ইচ্ছা করলে আল্লাহ যাকে খাওয়াতে পারতেন, আমরা তাকে কেন খাওয়াব? তোমরা তো স্পষ্ট ভ্রান্তিতে পতিত রয়েছ।”
(গ) রাসূল সা. ও তাঁর অনুসারীরা পাগল যাদুকর : যখনই রাসূল সা. ও দায়ী ইলাল্লাহগণ আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন তখনই তাদেরকে পাগল যাদুকর বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,كَذَلِكَ مَا أَتَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ “এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের মাঝে যখনই কোন রাসূল আগমন করেছে, তারা বলেছে, যাদুকর, না হয় উন্মাদ।”
(ঘ) তারা নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও সন্ত্রাসী : ইসলামের বিরোধী শক্তিরা রাসূল সা. ও দায়ীদেরকে সন্ত্রাসী, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী বলে অপবাদ দেয়। যেমন- হযরত মূসা (আ) ও তার সহযোগীদেরকে ফেরাউনের সভাসদবর্গ তার দরবারে গিয়ে বলেছিল, মূসা ও তার জাতিকে কি আপনি পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে সুযোগ দিবেন? আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেন, وَقَالَ الْمَلَأُ مِنْ قَوْمِ فِرْعَوْنَ أَتَذَرُ مُوسَى وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ “আপনি কি মূসা ও তার জাতিকে পৃথিবীতে ফাসাদ (নৈরাজ্য) সৃষ্টি করতে সুযোগ দিবেন।” বর্তমান সময়েও যারা ইসলামী দাওয়াতের কাজ করে তাদেরকেও সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদ, প্রতিক্রিয়াশীল ইত্যাদি অপবাদ দেয়া হচ্ছে।
দায়ীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের উপকরণ ব্যবহার ইসলামবিরোধী শক্তি নবী রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে রকমারি ধরনের উপকরণ নিয়ে বিরোধিতা করে থাকে। আর এ উপকরণগুলোর মাধ্যমে মানুষদেরকে আকর্ষণ করে ইসলাম ও ইসলামী আদর্শের দাওয়াত থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। আল-কুরআন তাদের এ কাজকে কঠিনভাবে নিন্দা করে বলেছে, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ “এক শ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং একে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রƒপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।”
ইসলামবিরোধী শক্তির ধন-সম্পদের ব্যবহার : ইসলামবিরোধী শক্তি ইসলামী দাওয়াতকে মুছে দেয়ার জন্য তাদের সমুদয় ধন সম্পদ ব্যবহার করে থাকে। আল্লাহ তাআলা ফিরাউনকে বিশাল ধনসম্পদ দান করেছিলেন, সেই সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা তো দূরের কথা সে আল্লাহর নবীকে হত্যা করতে উদ্যত হলো। তখন মূসা (আ) আল্লাহর নিকট দোয়া করে বলেছিলেন, وَقَالَ مُوسَى رَبَّنَا إِنَّكَ آَتَيْتَ فِرْعَوْنَ وَمَلَأَهُ زِينَةً وَأَمْوَالًا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا رَبَّنَا لِيُضِلُّوا عَنْ سَبِيلِكَ رَبَّنَا اطْمِسْ عَلَى أَمْوَالِهِمْ وَاشْدُدْ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُوا حَتَّى يَرَوُا الْعَذَابَ الْأَلِيمَ “মূসা বললো, হে আমার প্রতিপালক! তুমি ফেরাউনকে এবং তার সরদারদেরকে পার্থিব জীবনে আড়ম্বর দান করেছো এবং সম্পদ দান করেছ, হে আমার প্রভু! যে জন্য তারা তোমার পথ থেকে বিপথগামী করেছে। হে আমার পরওয়ারদিগার! তাদের ধন-সম্পদ তুমি ধ্বংস করে দাও। এবং তাদের অন্তরগুলোকে কঠোর করে দাও, যাতে করে ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান না আনে, যতক্ষণ না বেদনাদায়ক আযাব প্রত্যক্ষ করে নেয়।” রাসূল সা.-এর সময়ও আবু জাহল, আবু লাহাব তাদের সকল সম্পদ ইসলামী দাওয়াতের বিরোধিতায় ব্যয় করেছে, এমনকি তারা রাসূল সা.কে হত্যা করার জন্য একশতটা উট পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
সমস্যা উত্তরণের রাসূল সা.-এর কর্মকৌশল দাওয়াতি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত করতে ও সমস্যা উত্তরণের জন্য রাসূল সা. বিভিন্ন কর্মকৌশল ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। যেগুলো আজও অবলম্বন করতে পারলে দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে সমস্যাসমূহ অনেকাংশেই সমাধান করা সম্ভব হবে। নিম্নে রাসূল সা. ও সাহাবীদের দাওয়াতি ক্ষেত্রে সমস্যা উত্তরণের উপায়সমূহ তুলে ধরা হলো :
মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ সকল আ¤ি¦য়া-ই-কিরাম ও পরবর্তী সমকালীন দায়ীগণ দাওয়াতি কাজে আত্মনিয়োগের পূর্বে কতিপয় শর্ত বা বিষয় অত্যাবশ্যকীয়ভাবে পালন করেছেন। যেমন- (ক) দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে দায়ীর মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। কোন বিশেষ টার্গেটকৃত ব্যক্তি অথবা জনসমক্ষে বিশেষ বিষয়ের ওপর প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করলে তা মাদউ বা আহ্বানকৃতদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। মানসিক প্রস্তুতির ব্যাপারে রাসূল সা.-এর হাদিস এ পাওয়া যায়। যেমন- إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى ‘‘প্রতিটি কর্মই তার নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেকের জন্য তাই রয়েছে যা সে নিয়ত করেছে।’’ (খ) দাওয়াত দানকারী যে বিষয়ের দিকে অন্যকে দাওয়াত দিতে চাইবে সর্বপ্রথম নিজেই সেগুলোর প্রতি ঈমান আনতে হবে, মনে প্রাণে মেনে নিতে হবে। রাসূল সা. যে বিষয়ে দাওয়াত দিতে চাইতেন, প্রথমে তিনি নিজেই সেগুলোর ওপর ঈমান আনতেন। তাই কুরআনুল কারীমে মহানবী সা.কে বলতে বলা হয়েছে, وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ ‘‘এ বিষয়ে আমি আদিষ্ট হয়েছি এবং তা আমিই প্রথম মান্যকারী তথা মুসলিম।’’ (গ) পরিবেশ পরিস্থিতির অজুহাতে সব সময় সত্যকে পাশ কাটিয়ে চলা অনুচিত। বরং নিজের ঈমানের বিষয়কে বাস্তব প্রেক্ষাপটে স্বীকৃতি দিতে হবে, অন্যথায় কিয়ামতের দিন তিনি সত্য গোপন করার অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবেন। আল কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ ‘‘আর স¥রণ কর, যখন আল্লাহ তায়ালা আহ্লি কিতাবদের নিকট হতে ওয়াদা গ্রহণ করেছিলেন, তোমরা এ কিতাবের শিক্ষা লোকদের মধ্যে প্রচার করতে থাকবে এবং তা গোপন রাখতে পারবে না। কিন্তু তারা এ কিতাবকে পিছনে ফেলে রেখেছে এবং সামান্য অর্থের বিনিময়ে তা বিক্রি করেছে। অতএব তারা যা ক্রয় করে, তা কতই না মন্দ!’’ রাসূল সা. দাওয়াত দানের পূর্বে এসকল প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। বর্তমান সময়ের দায়ী ইলাল্লাহকে দাওয়াত দানের পূর্বে এ সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে যাতে দাওয়াতি কাজের ক্ষেত্রে সকল প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে মানুষের কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে।
কথা ও কাজে মিল রাখা রাসূল সা. ও সাহাবীগণ যে দাওয়াত দিতেন সেটা তারা বাস্তব জীবনে আমল করতেন। কথা ও কাজের মধ্যে মিল না থাকলে সে দায়ীর দাওয়াত মানুষের নিকট হৃদয়াগ্রাহী হবে না এবং মানুষ সেটা গ্রহণও করবে না। এ মর্মে আল-কুরআনের ঘোষণা, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ ‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা তোমরা কর না? তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর নিকট বড়ই ক্রোধের বিষয়।’’ তাই দায়ী ইলাল্লাহকে বাস্তব সাক্ষী হিসেবে নিজেকে পেশ করতে হবে। নিজে যে বিষয়ের প্রতি মানুষদেরকে আহ্বান করবে, নিজে সে বিষয়টি তাঁর বাস্তব আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে দেখাবে।
জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও পা-িত্য অর্জন করা প-িত এবং প্রজ্ঞাবানরাই দাওয়াতের প্রকৃত ধারক-বাহক এ জন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মহানবী সা.কে ইসলামী দাওয়াত দানের উপযোগী উন্নত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছিলেন। মহানবীও সা. প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদেরকেই তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাই একজন দায়ীকে অবশ্যই প্রজ্ঞা এবং পা-িত্যের অধিকারী হতে হবে। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي “বলো, এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও।”
সুস্পষ্ট সাবলীল প্রাঞ্জল ও মার্জিত বক্তব্যের মাধ্যমে দাওয়াত উপস্থাপন দাওয়াতি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূরকরণে এটা একটা উত্তম মাধ্যম। দায়ী তার বক্তব্য আকর্ষণীয় ও বোধগম্য করে তুলতে সাবলীল, প্রাঞ্জল ও হৃদয় নিংড়ানো দরদি ভাষায় কথা বলবে। এ সম্পর্কিত বর্ণনা আল-কুরআনে পাওয়া যায়। হযরত মূসা (আ) এর মুখের কথায় জড়তা ছিল বিধায় তিনি ইসলামের বিধান সঠিকভাবে বনি ইসরাইলদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য হযরত হারুন (আ)কে তাঁর সাথী হিসেবে চেয়ে বলেছিলেন, وَأَخِي هَارُونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْءًا يُصَدِّقُنِي “আর আমার ভাই হারূন, সে আমার চেয়ে স্পষ্টভাষী, তাই তাকে আমার সাথে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে।”
আমানতদারিতা রাসূল সা. ছিলেন সকলের কাছে বিশ^স্ত ও আমানতদারি। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, إِنِّي لَكُمْ رَسُولٌ أَمِينٌ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ “নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং আমার আনুগত্য কর।” আল্লাহর পথে দাওয়াত দানকারীকে অবশ্যই আমানতদার হতে হবে কারণ আমানত প্রবণতা মু’মিন জীবনের বৈশিষ্ট্য। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ ‘‘যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।’’ কাজেই একজন ইসলামী দায়ীর এ গুণটি অর্জন করা অপরিহার্য। আল্লাহ এই পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন তারা সবাই নিজেদেরকে আমানতদার হিসেবে পেশ করেছেন। উত্তম নৈতিক চরিত্র ও মহৎ গুণাবলীর অধিকারী রাসূল সা. ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। আল্লাহ নিজেই মহানবী সা. সম্পর্কে বলেছেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ ‘‘নিশ্চয়ই আপনি অতীব মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত।’’ ইসলামী দাওয়াহ প্রচারে যারা ভূমিকা রাখবেন তাদেরকে অবশ্যই উত্তম নৈতিক চরিত্র ও মহৎ গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। সুতরাং রাসূল সা.-এর ওয়ারিস হিসেবে যারা দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করবেন তাদেরকে অবশ্যই উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। কারণ দায়ীর উন্নত নৈতিক চরিত্র না থাকলে সে অন্যকে সেদিকে ডাকতে ইতস্তত বোধ করবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ ‘‘তোমরা কি মানুষকে সৎকাজের নির্দেশ দাও আর নিজেরা বিস্মৃত হও? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত কর। তোমরা কি বুঝ না?’’
ধৈর্য ও সংযমের অধিকারী রাসূল সা.-এর দাওয়াতি জিন্দেগিতে অসংখ্য বাধা-বিপত্তি এসেছে তিনি সবকিছুকে ধৈর্য ও সংযমের মাধ্যমে মুকাবিলা করেছেন। এটা দায়ীর অপরিহার্য একটি গুণ যাকে দাওয়াতের মেরুদ- বলা হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে ধৈর্য ও সংযম ছাড়া বাতিল শক্তির মুকাবিলা করা আদৌ সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ “অবশ্যই তোমাদেরকে তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের নিজ জীবন সম্পর্কে পরীক্ষা করা হবে। আর অবশ্যই তোমরা শুনবে তোমাদের পূর্বে যাদের কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে এবং মুশরিকদের পক্ষ থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর তবে নিশ্চয় তা হবে দৃঢ় সংকল্পের কাজ।” রাসূলগণ যেভাবে ধৈর্যধারণ করেছিলেন দায়ী ইলাল্লাহকে সেভাবে ধৈর্যধারণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِلْ لَهُمْ “অতএব তুমি ধৈর্যধারণ কর, যেমন ধৈর্যধারণ করেছিল সুদৃঢ় সংকল্পের অধিকারী রাসূলগণ। আর তাদের জন্য তাড়াহুড়া করো না।’’
উত্তম ব্যবহার এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দায়ী হযরত মুহাম্মদ সা. তাঁর মন-মানসিকতা, আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। তিনি মন্দের জবাব মন্দের মাধ্যমে না দিয়ে উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেছেন, وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ “আর ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে প্রতিহত কর তা দ্বারা যা উৎকৃষ্টতর, ফলে তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা রয়েছে সে যেন হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু।” রাসূল সা. তায়েফে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার সময় কঠিন অত্যাচার-নির্যাতনের পরেও তায়েফবাসীর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন। এ জন্য মন্দ আচরণকারীকে ক্ষমা করে দিয়ে তাকে সংশোধনের চেষ্টা অব্যাহত রাখলে আল্লাহ তায়ালা খুশি হন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِثْلُهَا فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ “আর মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ। অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপস নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ যালিমদের পছন্দ করেন না।”
ক্ষমাকারী রাসূল সা. ছিলেন এই পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাশীল মানুষ। তিনি বড় অপরাধীকেও ক্ষমা করে দিতেন। তাই দায়ীকে ক্ষমা করে দেয়ার মত মহৎ গুণের অধিকারী হতে হবে। এতে শ্রোতার মনের বিদ্বেষভাব দূরীভূত হয় এবং দায়ীর সাথে সুসম্পর্ক ও ভালোবাসা গড়ে ওঠে। আল্লাহ বলেন, فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ ‘‘যার সাথে তোমার শত্রুতা আছে সেও হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু।’’ ক্ষমার মধ্যে এ বিশেষ আকর্ষণ থাকার কারণেই ক্ষমার প্রতি বিশেষ তাগিদ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ ‘‘তুমি পরম সৌজন্যের সাথে তাদেরকে ক্ষমা করে দাও।’’ দুষ্ট চরিত্র ব্যক্তির সাথে সুন্দর ব্যবহার করা এবং আখলাকের মাধ্যমে তাকে দ্বীন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা একজন সার্থক দায়ীর কাজ। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا “আর অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদেরকে সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’।”
বিনয়ী বিনয়ী লোকের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তি বেড়ে যায়। এ জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মহানবী সা.কে আদেশ করেছিলেন, وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ ‘‘আর আপনার অনুসারী মু’মিনদের প্রতি সদয় হোন।’’ অন্য আয়াতে মহানবী সা. কে বলা হয়েছে, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ‘‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। পক্ষান্তরে, আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয় হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে ভেগে যেত।’’
সত্যবাদী রাসূল সা. ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সত্যবাদী কারণ এই সত্যবাদিতা সম্পর্কে আল্লাহ কিয়ামতের দিন জিজ্ঞেস করবেন। যেমন- আল্লাহ বলেন, لِيَسْأَلَ الصَّادِقِينَ عَنْ صِدْقِهِمْ وَأَعَدَّ لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا أَلِيمًا “সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার জন্য। আর তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন কাফিরদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক আযাব।” এজন্য মহানবী সা. বলেছেন, عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ ‘‘সত্য কথা বলা তোমাদের উপর কর্তব্য। কেননা সত্যবাদিতা মানুষকে নেক কাজের পথ উম¥ুক্ত করে। আর নেক কাজ মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করায়।”
দয়াপরবশ ও মমতাময়ী দায়ী হিসেবে মহানবী সা.-এর গুণাগুণ উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই ঘোষণা দেন, لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ ‘‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল, তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী মু’মিনদের প্রতি স্নেহশীল দয়াময়।” মহানবী সা. তাঁর জবানীতে এ সম্পর্কে বলেছেন, الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمْ الرَّحْمَنُ‘‘যারা দয়ালু, তাদেরকে পরম দয়ালু আল্লাহ রহম করেন।’’ শুধু মানুষের সাথে নয়, বরং সকলের সাথে দয়াবান হওয়া উচিত। জীবে দয়া করার জন্য মহানবী সা. নিম্নোক্ত বাণীতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, ارْحَمُوا مَنْ فِي الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ ‘‘জমিনে যারা আছে তাদেরকে তোমরা দয়া কর, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনি তোমাদের উপর দয়া করবেন।’’
বিপদ-মুসিবতে সবরকারী আল্লাহ তায়ালার নিয়ম হলো হকপন্থীদেরকে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা। আর এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই তারা সফলকাম হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آَمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ“মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী।” রাসূল সা.-এর জীবনেও এমন অনেক পরীক্ষা এসেছিলো তিনি সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। দায়ী ইলাল্লাহকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ক্রমাগত পরীক্ষাসমূহের মুকাবিলা তাকে করতেই হবে। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া ঈমানদারদের দ্বিতীয় কোন পথ নেই।
দাওয়াতের ক্ষেত্রে হিকমত অবলম্বন করা রাসূল সা. দাওয়াতি ক্ষেত্রে হিকমত অবলম্বন করে ইসলামের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ‘‘আপনার প্রভুর প্রদত্ত জীবনপদ্ধতির দিকে দাওয়াত দিন হেকমত ও মাউইযা হাসানার দ্বারা আর সর্বোত্তম পন্থার যুক্তি-তর্ক করুন।’’
সময়, স্থান ও পরিবেশ বুঝে দাওয়াত উপস্থাপন উপযুক্ত অবস্থা অনুধাবন করে দাওয়াত উপস্থাপন করতে হবে। মহানবী সা. মক্কায় তিন বছর গোপনে দাওয়াত দেন, এভাবে প্রাথমিক শক্তি সঞ্চয়ের পর প্রকাশ্যে দাওয়াত দেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ “সুতরাং তোমাকে যে আদেশ দেয়া হয়েছে, তা প্রকাশ্যে প্রচার কর এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।”
মাওইযাতুল হাসানাহ এর অনুসরণ ইসলামী দাওয়াতের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো মাওইযাতুল হাসানাহ। এ পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে দাওয়াহ দ্রুত সম্প্রসারণ সম্ভব। আল্লাহ তায়ালা এ পদ্ধতি অবলম্বন সম্পর্কে বলেন, ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ “তোমার রবের পথের দিকে মানুষকে দাওয়াত দাও হিকমত ও মাউইযা হাসানার দ্বারা আর সর্বোত্তম পন্থার যুক্তি-তর্ক করুন।’’
যদি ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে উত্তম পন্থা অবলম্বন রাসূল সা. দাওয়াতের ক্ষেত্রে মুজাদালাহ প্রয়োগ করেছেন। কারণ দাওয়াত প্রচারের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। বিরোধী শক্তির মোকাবেলায় এটা ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এ পদ্ধতি অবল¤¦নে পবিত্র কুরআনের প্রত্যক্ষ নির্দেশ রয়েছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ‘‘তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্ক করবে না।’’ অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ “তোমরা ঝগড়া-বিবাদের সময় উত্তম পন্থা অবলম্বন করবে।”
অযথা তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়া রাসূল সা. সব অযথা তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে চলতেন। কারণ তর্ক-বিতর্ক হিকমতের পরিপন্থী। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آَيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ “আর যখন তুমি তাদেরকে দেখ, যারা আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে উপহাসমূলক সমালোচনায় রত আছে, তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, যতক্ষণ না তারা অন্য কথাবার্তায় লিপ্ত হয়। আর যদি শয়তান তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণের পর যালিম সম্প্রদায়ের সাথে বসো না।” তাই দায়ী ইলাল্লাহ সব সময় অযথা তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে চলবে। কারণ এতে বাদ-প্রতিবাদ সৃষ্টি হয়, সম্মানবোধের ক্ষেত্রে প্রকৃত সম্পর্ক নষ্ট হয়। পরিশেষে বলা যায়, ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূল সা.-এর জীবদ্দশায় অসংখ্য সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, আজো যারা ইসলামী দাওয়াতের কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের ষড়যন্ত্র ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে। এসকল প্রতিবন্ধকতার মুকাবিলায় রাসূল সা. প্রণীত কর্মকৌশল অবলম্বন করে ইসলামের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে ইনশাআল্লাহ। লেখক : গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ
আপনার মন্তব্য লিখুন