post

দাম্পত্য জীবনে বিশ্বনবীর অনুপম আদর্শ মুহাদ্দিস ডক্টর এনামুল হক

০৬ অক্টোবর ২০২১

ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র হতে অন্যায়, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও বিপর্যয় থেকে মুক্ত থাকতে পুরুষ ও নারীর দাম্পত্য সম্পর্কের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। দাম্পত্যের সম্পর্ক শুধুমাত্র আইনগত বা বাহ্যিক কোনো বন্ধন নয়, বরং এ সম্পর্ক ভালোবাসা ও আন্তরিকতার। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর তাঁর নির্দেশাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে যেন তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই চিন্তাশীল লোকদের জন্য এতে বহু নিদর্শন আছে।” (সূরা রূম : ২১) মহান রাব্বুল আলামিন আল কুরআনে বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা.-এর জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আহযাব : ২১)। রাসূলুল্লাহ সা.-এর জীবনের প্রতিটি দিকই মুসলিম উম্মাহর সকল নারী-পুরুষের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। কুরআনের ভাষায় তা উসওয়াতুন্নবী বা নবীর আদর্শ। প্রিয় নবী সা.-এর ব্যক্তিগত জীবনও আনন্দে পরিপূর্ণ। তিনি তার স্ত্রীদের সঙ্গে আনন্দঘন মুহূর্ত কাটিয়েছেন, বিনোদন করেছেন। যা সকল নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবনের জন্য আদর্শ। মানবতার বন্ধু মহানবী সা. শুধু ইবাদত-বন্দেগি নয়, বরং ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেও মানবজাতির সর্বোত্তম আদর্শ। মানবীয় গুণাবলির সর্বোচ্চ স্তরে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সূরা কলম : ৬) হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি তারা, যারা তাদের স্ত্রীদের কাছে সর্বোত্তম। (তিরমিজি-১১৬২, ইবনে হিব্বান-৪১৭৬) অন্য বর্ণনায় পরিপূর্ণ ঈমানদার সেই যে তার স্ত্রী-পরিবারের নিকট চরিত্র ও ব্যবহারের দিক দিয়ে উত্তম।’ (তিরমিজি-২৬১২; ইবনে হিব্বান-৫৩১৯) ইসলামের দৃষ্টিতে একটি কল্যাণময় ও মধুময় সম্পর্ক হলো স্বামী-স্ত্রীর মাঝের সম্পর্ক। আল কুরআন বিবাহের প্রতি গুরুত্বারোপ করে এ জন্য যে, “বিবাহ দীনের (আল্লাহ প্রদর্শিত জীবনাদর্শ) অর্ধেক অংশকে পূরণ করে এবং বাকি অর্ধেক অংশ পূর্ণ করতে তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে” (বিবাহ ও তাকওয়ার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মু’মিন হওয়া যাবে)।” (মুজামুল আওসাত-৭৬৪৭; ৮৭৯৪; শুয়াবুল ঈমান-৫৪৮৭) অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, তারা তোমাদের জন্য এবং তোমরা তাদের জন্য পোশাক স্বরূপ।’ (সূরা বাকারা : ১৮৭) এর অর্থ হচ্ছে পারস্পরিক শান্তি, প্রেম-ভালোবাসা ও নিরাপত্তা লাভের জন্য এ বন্ধন করে দেয়া হয়েছে। এখানে পোশাক রূপকার্থে ব্যবহার করে বুঝানো হয়েছে যে, তাদের সম্পর্কের মাধ্যমে তাদের অন্তর ও আত্মা পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকবে। মহানবী সা.-এর স্ত্রীগণ : মহানবী সা.-এর প্রথম স্ত্রী ছিলেন খাদিজা রা.। জিবরাঈল (আ) এর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর যখন রাসূলুল্লাহ সা. কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তখন খাদিজা রা. তার সম্পর্কে ঐতিহাসিক এক সাক্ষ্য প্রদান করে বলেন, ‘আল্লাহ আপনাকে অপমান করবেন না। আপনি আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করেন, বিপদগ্রস্ত লোকদের সাহায্য করেন, মেহমানদারি করেন এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন।’ (বুখারি-৩, ৩২১২, ৪৬৭০; মুসলিম-৪২২) খাদিজার রা. জীবদ্দশায় রাসূলুল্লাহ সা. অন্য কাউকেও বিবাহ করেননি। (তিরমিজি-৩৮৭৬; আল মু’জামুল কবীর-১০৯৩) রাসূল সা.-এর সন্তানাদির মধ্যে ইবরাহীম ছাড়া পুত্র-কন্যাদের সকলেই খাদিজা রা.-এর গর্ভে জন্মলাভ করেন। পুত্রসন্তানগণের মধ্যে কেউই জীবিত ছিলেন না, কিন্তু কন্যাসন্তানগণ সকলেই জীবিত ছিলেন। তাঁদের নাম হচ্ছে যথাক্রমে যায়নাব, রুকাইয়াহ, উম্মু কুলসুম এবং ফাতিমা রা.। উম্মতের তুলনায় তাঁর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে এটি একটি যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দীনের প্রচার ও প্রসারের স্বার্থে চারটির অধিক স্ত্রী গ্রহণের জন্য তিনি আদিষ্ট হয়েছিলেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি যাদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তাঁদের সংখ্যা এগারো জন। (আর রাহীকুল মাখতুম) এঁদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সা.-এর মৃত্যু পর্যন্ত জীবিত ছিলেন ৯ জন। আর রাসূল সা.-এর জীবদ্দশায় দুইজন ইন্তিকাল করেন। তাঁরা হলেন, খাদিজা রা. ও উম্মুল মাসাকিন যায়নাব বিনত খুযাইমা রা.। রাসূল সা.-এর অন্যান্য স্ত্রীগণ হলেন, (১) সাওদাহ বিনত যামআহ রা., (২) স্ত্রীদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট ছিলেন আয়িশা রা., (৩) হাফসাহ বিনত উমার ইবন খাত্তাব রা., (৪) উম্মু সালামাহ হিন্দ বিনত আবি উমাইয়া রা., (৫) যায়নাব বিন জাহাশ রা., (৬) জুওয়াইরিয়াহ বিনত হারিস রা., (৭) উম্মু হাবিবাহ রামলাহ বিনত আবু সুফইয়ান রা., (৮) সাফিয়্যাহ বিনত হুওয়াই বিন আখতাব রা. ও (৯) মায়মুনাহ বিনত হারিস রা.। প্রকৃতার্থে মহানবী সা. এর দাম্পত্য জীবন ছিল কুরআনের সেই আয়াতের বাস্তবায়ন, যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে জীবনযাপন করো।’ (সূরা নিসা : ১৯) মানবিক ও দ্বীনি কারণে একাধিক বিবাহ : মহানবী সা. ইসলামের প্রচার ও প্রসারের স্বার্থে একাধিক বিবাহ করেছেন। মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সা. যৌবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে প্রায় সুদীর্ঘ ২৫ বছর একমাত্র স্ত্রী খাদিজার রা. এর সাহচর্যে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। এরপর তিনি বিবাহ করেন সাওদাহ বিনতে যামআহ রা.কে, যিনি ছিলেন বর্ষীয়সী মহিলা। এ কথা ধারণা করা মোটেও সমীচীন নয় যে তিনি শুধু যৌন প্রয়োজনেই পরবর্তী সময়ে ৯টি বিবাহ করেছিলেন। ব্যাপক গবেষণায় এটি প্রমাণিত যে, তিনি শুধুমাত্র নবুওয়াতি কার্যক্রমের মহান উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন কবিলা ও এলাকায় বিবাহ করেন। এ কথাও ঐতিহাসিকভাবে প্রণিধানযোগ্য সত্য যে, সে সময়ে বৈবাহিক সম্পর্কের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব ও সম্মান প্রদান করা হতো। তৎকালীন সময়ে জামাতা সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত সম্মানের এবং জামাতার সঙ্গে যুদ্ধ বিগ্রহ করা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা চরম লজ্জার ব্যাপার হিসেবে বিবেচিত হতো। তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক বড় আবার কেউ অনেক ছোট। অথচ বিভিন্ন বয়সী সব স্ত্রীর সঙ্গেই রাসূল সা. এর ছিল ভালোবাসার ও মধুর সম্পর্ক। বয়সে বড় খাদিজা রা.কে রাসূল সা. এতটাই ভালোবাসতেন যে যখনই তাঁর স্মৃতিচারণা করতেন, তিনি অশ্রুভারাক্রান্ত হতেন। (তিরমিজি-৩৮৭৫) মহানবী সা. আল্লাহর নির্দেশ ও বহুবিধ মানবিক কারণে একাধিক বিয়ে করার পরও তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পর স্ত্রীদের কেউ তার প্রতি কোনো ধরনের অভিযোগ করেননি; বরং মহানবী সা. এর স্ত্রীদের কাছে তাঁর সান্নিধ্য ও সংশ্রবের চেয়ে আনন্দ ও তৃপ্তির আর কিছু ছিল না। তার পবিত্র জীবনে আদর্শ স্বামীর বৈশিষ্ট্যগুলো সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। মধুময় দাম্পত্য জীবন : আল্লাহ তায়ালার অগণিত রহমাতের মধ্যে দাম্পত্য জীবন এক সমুজ্জ্বল মহিমায় মহিমান্বিত রহমাত। আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করলেও মানুষের জৈবিক চাহিদাকে উপেক্ষা করেননি। তিনি তাদের হৃদয়বৃত্তির কথা বিবেচনায় রেখে বৈবাহিক জীবনধারার বিধান রেখেছেন। আর দাম্পত্য জীবন সার্থক করতে সহধর্মিণী নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা অবিবাহিত তাদের বিবাহ দিয়ে দাও; যদি তারা দরিদ্র হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাদের নিজ অনুগ্রহে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ তায়ালা প্রাচুর্যময় এবং সর্বজ্ঞ। (সূরা নূর : ৩২) স্ত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে- আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা. বলেন, চারটি কারণে নারীকে বিবাহ করা হয়ে থাকে। তার সম্পদ থাকার জন্য, বংশ মর্যাদার কারণে, সৌন্দর্য ও দীনদারির জন্য। তবে তুমি দ্বীনদার নারীকে বিবাহ করে ভাগ্যবান হও। অন্যথায় তোমার হাত দু’টি ধুলোময় হবে। (বুখারি-৪৮০২; মুসলিম-৩৭০৮) সন্তান-সন্ততি আল্লাহর নিয়ামত : সন্তান-সন্ততি নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহর নিয়ামত, তা পুত্র হোক বা কন্যা। কিন্তু মানুষ আদিকাল থেকেই পুত্রকে সৌভাগ্য আর কন্যাকে দুর্ভাগ্যের প্রতীক মনে করে আসছে। জাহেলি যুগ থেকে আজকের তথাকথিত আধুনিক যুগেও কন্যাসন্তানের জন্মকে দুঃসংবাদ মনে করা হয় অথচ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা কন্যাসন্তানের জন্মকে সুসংবাদ বলেছেন। আল্লাহ বলেন, “তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তাদের চেহারা কালো হয়ে যায় এবং সে চরম মনোকষ্টে দগ্ধ হয়। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়, তার গ্লানিতে সে সমাজ থেকে আত্মগোপন করে। সে ভাবতে থাকে গ্লানি সত্ত্বেও সে কি তাকে রেখে দিবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে? সাবধান! তোমাদের সিদ্ধান্ত চরম নিকৃষ্ট!” (সূরা নাহল : ১৬) তাই অসংখ্য হাদিসে কন্যাসন্তান লালন-পালনের অপরিসীম মর্তবার কথা বর্ণনা করেছেন রাসূলুল্লাহ সা.। ইসলামে কন্যাসন্তানের প্রতিপালন জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির উপায়। রাসূল সা.-এর চার কন্যা ফাতেমা রা., যায়নব রা., উম্মু কুলসুম রা. এবং রুকাইয়া রা.। রাসূল সা. এর জীবদ্দশাতে ফাতিমা রা. ছাড়া বাকি তিন কন্যার মৃত্যু হয়। ফাতিমা রা. রাসূল সা.-এর ইন্তিকালের মাত্র ছয় মাস পর ইন্তিকাল করেন। কোনো সফরে যাওয়ার সময় মেয়ে ফাতিমা রা.-এর কাছে যেতেন সবার পরে আবার ফেরার পর প্রথমেই দেখা করতেন ফাতিমা রা.-এর সঙ্গে। ফাতিমা রা. যখনই রাসূল সা.-এর কাছে আসতেন, তিনি মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন। চুমু দিয়ে হাত ধরে তাঁকে পাশে বসাতেন। মেয়ের মাধ্যমে বংশের সিলসিলা : রাসূলুল্লাহ সা.-এর ছেলে ছোটবেলায় ইন্তিকাল করেন। সেহেতু তাঁর মেয়ের দ্বারাই বংশের সিলসিলা অব্যাহত রয়েছে। মিসওয়ার বিন মাখরামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘ফাতিমা আমার অংশ, যে ফাতিমাকে রাগান্বিত করল, সে যেন আমাকেই রাগান্বিত করল।’ (বুখারি-৮৮৪, ৩৫১০, ৩৫২৩; মুসলিম-৬৪৬১) আমরা মেয়ে সন্তান জন্ম লাভে অসন্তুষ্ট হই। অথচ বিশ^নবী সা.-এর বংশ পরম্পরা তাঁর মেয়ের বংশেই কিয়ামত পর্যন্ত স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে। পরিবারের সব বিষয়ে যত্নশীলতা : মহানবী সা. তাঁর স্ত্রীদের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সব স্ত্রীর খোঁজ নিতেন এবং সবার সঙ্গে সময় কাটাতেন। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘ফজরের সালাতের পর নবী করিম সা. সালাতের স্থানে বসে থাকতেন। সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত লোকেরাও তার চারপাশে বসে থাকত। অতঃপর তিনি তার প্রত্যেক স্ত্রীর কাছে যেতেন, তাদের সালাম দিতেন, তাদের জন্য দু’আ করতেন আর যার দিন থাকত তার কাছে গিয়ে বসতেন।’ (আল মু’জামুল কাবীর লিত তাবারানী-৮৭৬৪) আবার আসরের সালাতের পর তিনি স্ত্রীগণের ঘরে গমন করে কিছু সময় কাটান এবং তারপর যার পালা থাকত তার ঘরে যেতেন। সকল স্ত্রীগণ সেখানে জড়ো হতেন। এশার পূর্ব পর্যন্ত তাদের সান্নিধ্যেই কেটে দিতেন। মসজিদে এশার সালাতের পর পালা নির্ধারিত স্ত্রীর ঘরে গিয়ে রাত কাটাতেন। কোনো ব্যাপারেই তিনি কারো দোষ ধরতেন না। বিশ্রামের সময় বিছানার ব্যাপারেও দোষ ধরতেন না। তিনি যেভাবে বিছানা প্রস্তুত পেতেন তার ওপরই শুয়ে পড়তেন। খাবারের ব্যাপারেও তিনি দোষ ধরতেন না। পছন্দ হলে খেতেন, অপছন্দ হলে খেতেন না’ (বুখারি-৩৩৭০, ৫০৯৩; মুসলিম-৫৫০১) পারিবারিক সুস্থ বিনোদন : স্ত্রীদের মানসিক প্রশান্তির জন্য রাসূলুল্লাহ সা. তাদের সঙ্গে ক্রীড়া-কৌতুকও করতেন। আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, একবার নবী সা. এবং আয়িশা রা. একটি সফরে যান। তখন আয়িশা রা. শরীরের গঠন ভালো ছিল এবং তিনি মোটা ছিলেন না। সে সময়ে মহানবী সা. ও আয়িশা রা. একটি দৌড় প্রতিযোগিতা করেন এবং আয়িশা রা. জিতে যান। এর পরে আয়িশা রা.-এর শারীরিক গঠন যখন মোটা হয়ে যায় তখন রাসূলুল্লাহ সা. তাকে বলেন, ‘এসো আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করি’। কিন্তু আয়িশা রা. দৌড় প্রতিযোগিতা করতে রাজি হননি। তাকে মহানবী সা. জোর করেন এবং অবশেষে তারা দৌড় প্রতিযোগিতা করেন এবং আয়িশা রা. হেরে যান। তখন মহানবী সা. বলেন, এখন আমরা দুইজনই সমান সমান।’ (বাইহাক্বী; আল কুবরা-১৯৫৪৩; সুনানু আবী দাউদ-২৫৮০) পারস্পরিক সহানুভূতি : স্ত্রীরা কখনো অভিমান করলে বা মন খারাপ করলে আল্লাহর রাসূল সা. তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করতেন। এক সফরে রাসূলুল্লাহ সা. এগিয়ে যান এবং সাফিয়া রা. পিছিয়ে পড়েন। এতে তিনি কেঁদে ফেলেন। মহানবী সা. তখন নিজ হাতে তার চোখ মুছে দেন এবং কাঁদতে নিষেধ করেন।’ (সুনানুল কুবরা লিন নাসাঈ-৯১৬২) রাসূলুল্লাহ সা. কখনো তার স্ত্রীদের শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত করেননি। কোনো কারণে ক্রোধান্বিত হলে তিনি চুপ হয়ে যেতেন এবং তার চেহারা মোবারক লালবর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু তিনি কখনো কোনো কটু কথা বলতেন না। আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে খাদেম ও কোনো স্ত্রীকে প্রহার করতে দেখিনি।’ (সুনানু আবি দাউদ-৪৭৮৬) শালীনতা ও সদ্ভাবের সাথে খুনসুটি : মহানবী সা. তার আচার-আচরণে স্ত্রীদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতেন। তাদের সঙ্গে নানাভাবে শালীনতা ও সদ্ভাবের মধ্যেও খুনসুটি করতেন। আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, ‘আমি ও রাসূলুল্লাহ সা. একই পাত্র থেকে গোসল করতাম যা আমাদের মধ্যে থাকত। তিনি আমার চেয়ে অগ্রগামী হলে আমি বলতাম, আমার জন্য রাখুন! আমার জন্য রাখুন!!’ (মুসলিম-৩২১) আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, ‘আমি হাড় থেকে গোশত কামড়ে নিতাম। তারপর আমি যেখানে মুখ রাখতাম রাসূল সা. সেখানে তার মুখ রাখতেন। অথচ তখন আমি ঋতুবতী ছিলাম। আমি পাত্র থেকে পানি পান করতাম। তারপর তিনি সে স্থানে মুখ রাখতেন, যেখানে আমি মুখ রাখতাম। অথচ আমি তখন ঋতুবতী ছিলাম।’ (নাসাঈ-৭০) প্রেমময় দাম্পত্যবৎসল : প্রায় ৪৫ বছরের ছোট স্ত্রী আয়িশা রা. এর সঙ্গেও ছিল তাঁর প্রেমময় দাম্পত্য জীবন। আয়িশা রা.-এর সঙ্গে তিনি সমবয়সী স্বামীর মতোই আচরণ করেছেন। ছোট্ট আয়িশা রা.-এর সঙ্গে তিনি খেলাধুলা করেছেন, হাস্যকৌতুকে মেতেছেন। খেলাচ্ছলে কখনো দৌড়িয়েছেন, এক পাত্রে খেয়েছেন, পান করেছেন। হাদিস থেকে জানা যায়, একবার হাবসী ছেলেরা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে প্রতিযোগিতা করছিল। রাসূল সা. এর আড়ালে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ সেই খেলা দেখেন আয়িশা রা.। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন সামান্য বিরক্তি প্রকাশ না করেই। ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে’ এ হাদিস থেকে বুঝা যায় বিশ^নবী সা.-এর শিক্ষা। স্ত্রীদের সঙ্গে কখনোই প্রভুসুলভ ব্যবহার করেননি মহানবী সা. বরং বন্ধুর মতো ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তোমরা নারীদের প্রতি ভালো আচরণের উপদেশ দাও।’ (বুখারি-৫১৮৪) অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো।’ (মুসলিম- ১২১৮) অবদানের স্বীকৃতি : খাদিজা রা. সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘মানুষ যখন আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তখন সে আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে, মানুষ যখন আমাকে বঞ্চিত করেছে তখন সে তার সম্পদ দ্বারা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে, মহান আল্লাহ আমাকে তার গর্ভ থেকে সন্তান দিয়েছেন যখন আল্লাহ অন্য স্ত্রীদের সন্তান থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছেন।’ (মুসনাদু আহমাদ-২৪৮৬৪) জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও যখনই খাদিজা রা.-এর কথা স্মরণ হতো, তখনই রাসূল সা. তাঁর জন্য আবেগময় স্মৃতিচারণ করতেন। রাসূল সা.-এর বসবাসের ঘর : সাইয়্যিদুল কাউনাইন ওয়াস সাকালাইন মানবতার বন্ধু মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর স্ত্রীদের বসবাসের ঘর জাঁকজমকতা ও বিলাসিতা মুক্ত ছিলো। রাসূলুল্লাহ সা.-এর বাসাটি ছিলো খুবই ছোট। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালে তার মাথা সিলিংয়ে লেগে যেতো। আয়িশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সা.-এর সামনে ঘুমাতাম, আমার পা দু’খানা তাঁর কিবলার দিকে ছিলো। তিনি সিজদায় গেলে আমার পায়ে মৃদু চাপ দিতেন, তখন আমি পা দু’খানা গুটিয়ে নিতাম। আর তিনি দাঁড়িয়ে গেলে আমি পা দু’খানা প্রসারিত করতাম। তিনি বলেন, সে সময় ঘরগুলোতে বাতি ছিলো না। (বুখারি-৩৭৫, ৪৯১, ১১৫১; মুসলিম-১১৭৩) উরওয়া রা. হতে বর্ণিত, আয়িশা রা. তাঁকে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রাসূল সা. সালাত আদায় করতেন আর তিনি আয়িশা রা. রাসূল সা. ও তাঁর কিবলার মধ্যে পারিবারিক বিছানার ওপর জানাযার মত আড়াআড়িভাবে শুয়ে থাকতেন। (বুখারি-৩৭৬; মুসনাদু আহমাদ-২৬২৩৪) বিশ্বনবী সা.-এর বসবাসের বাসাটি ছিলো ছোট্ট এবং বাসার ভেতরে আসবাবপত্রও ছিলো খুবই সাদামাটা। আয়িশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.-এর ঘুমানোর বিছানাটি ছিলো চামড়ার তৈরি। তার ভেতরে খেজুর গাছের ছাল ভর্তি ছিল। (মুসলিম-৫৫৬৮; ইবনে হিব্বান-৬৩৬১) তবে তাতেই ছিলো সুখ, শান্তি, স্বস্তি, সমৃদ্ধি ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। পরিবারের সকলেই একসঙ্গে খাবার গ্রহণ : অভাব-অনটনের সংসারেও রাসূলুল্লাহ সা. এর দাম্পত্য জীবন ছিলো তাকওয়া ও ধৈর্যের আবহে পরিপূর্ণ। স্ত্রীদের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. একসঙ্গে খাবার খেতেন এবং একই পাত্রে পানি পান করতেন। নবী পত্নী উম্মু হাবিবাহ বলেন, একই পাত্রে আমার এবং রাসূল সা. এর হাতের মধ্যে ছোঁয়া লাগতে থাকতো (অর্থাৎ একই পাত্রে তারা খাবার খেতেন)। (আল আদাবুল মুফরাদ লিল বুখারি-১০৫৪) স্বামী-স্ত্রী, সন্তানদের একসাথে খাবার গ্রহণ ইসলামী ঐহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এতে পারস্পরিক হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়। একে অপরের রুচি, পছন্দসহ ভাব বিনিময় করার সুবর্ণ সুযোগ হয়। মহানবী সা. এর পরিবারে অভাবের সংসারে ছিলো শান্তি ও মহব্বতের ফলগুধারা। হাদিসে এসেছে, আয়িশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সা. এর পরিবার কখনো একমাস এমনভাবে কাটাতাম যে, আমাদের চুলায় আগুন জ¦লত না। শুধু খেজুর ও পানি দিয়ে ক্ষুধা মিটাতাম। (মুসলিম-৭৬৩৯; তিরমিজি-২৪৭১) আনাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা.-এর দস্তরখানে সকালে ও রাতে কখনো রুটি ও গোশত একত্র হয়নি। তবে মেহমানদের উপস্থিতিতে এর ব্যতিক্রম হতো। (মুসনাদু আহমাদ-১৩৮৫৯; শুয়াবুল ঈমান-১৪৬২) অধুনা শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারে এরকম প্রীতিময় পরিবেশ প্রায় অনুপস্থিত। পরিবারের সদস্যরা একেকজন একেক সময় খাবার খায়। যাতে পরিবারের সদস্যদের মাঝে আন্তরিকতা, মহব্বত ও হৃদ্যতার অনুপস্থিতি এবং এতে নীতি- নৈতিকতার অবলুপ্তিও ঘটে। ইবাদত-বন্দেগি : রাতের সালাত বা তাহাজ্জুদ নামাজে মহানবী সা. তাঁর স্ত্রীদের ঘুম হতে ডেকে দিতেন। (তিরমিজি-৮০৬; ইবনে খুযাইমা-২২০৬, ২২১০) এ ক্ষেত্রে সতী-সাধ্বী নেককার স্ত্রীকে সেসব গুণে গুণান্বিত করা অতীব প্রয়োজন। সেজন্যই তো বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিস উপভোগ্য। তন্মধ্যে উত্তম জিনিস হচ্ছে নেককার স্ত্রী। (মুসলিম-৩৭১৬; মুসনাদু আহমাদ-৬৫৬৭) মহানবী সা. তাঁর স্ত্রীদের সালাতের জন্য রাতে ঘুম হতে জেগে দিতেন। (বুখারি-৬৭৬) এ আমল ও অভ্যাস প্রত্যেকটা পরিবারে চালু ও অব্যাহত রাখা সময়ের অপরিহার্য দাবি। পরিবারে দ্বীনি তা’লীম : প্রতিনিয়ত তাঁদের শিক্ষা দিতেন যেন তাঁদের মাধ্যমে পারিবারিকভাবে ইসলামের শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে। আয়িশা রা. রাসূলুল্লাহ সা.-এর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন। তাই তিনি সকল সাহাবীদের মাঝে সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী মাত্র সাতজন সাহাবীর মাঝে একজন এবং মহিলা সাহাবীদের মধ্যে একমাত্র সর্বাধিক সংখ্যক দুই হাজারের বেশি হাদিস বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা. এর মৃত্যুর পর তিনি ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তারে অবদান রেখেছেন। আয়িশা রা.-কে একবার রাসূলুল্লাহ সা. বলেছিলেন, “তুমি কখন সন্তুষ্ট থাকো আর কখন আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হও, আমি বুঝতে পারি। যখন তুমি বলো ‘মুহাম্মাদের রবের শপথ!’ তখন তুমি খুশি থাকো আর যখন বলো ‘ইবরাহীমের রবের শপথ!’ তখন তুমি রেগে থাকো।” মহানবী সা. আদর করে ‘হুমাইরা’ বলে ডাকতেন আয়িশা রা. কে। সহিহ হাদিসে এসেছে মহানবী সা.-এর স্ত্রীদের নিকট মহিলা সাহাবীরা বিভিন্ন শরয়ী মাসআলা-মাসায়িল জিজ্ঞেস করতে আসতেন। তারা তাদেরকে শরয়ী মাসআলা জানিয়ে দিতেন। (মুসলিম-৭৩৬, ৭৪১; মুসনাদু আহমাদ-১২২২২) বর্তমান প্রেক্ষিতে পারিবারিক অশান্তি ও সন্তান-সন্ততিদের নীতি-নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধনের জন্য নাবিয়ানা তরিকায় পারিবারিক তালিম-তারবিয়্যাতের নিয়মিত ব্যবস্থা বাস্তবতা ও সময়ের অনিবার্য চাহিদা। পারিবারিক ও সাংসারিক কাজে সহযোগিতা : পরিবারের কাজে সহায়তা করাকে আমরা আজকাল খানিকটা লজ্জার বিষয় হিসেবে মনে করে থাকি। কিন্তু এটি সঠিক নয়। বিশ^নবী সা. পারিবারিক ও সাংসারিক কাজে স্ত্রীদের সহযোগিতা করতেন। মহানবী সা. এর স্ত্রী আয়িশা রা.কে জিজ্ঞেস করা হয়, মহানবী সা. কি পরিবারের লোকদের তাদের ঘরোয়া কাজে সহযোগিতা করতেন? তিনি বললেন হ্যাঁ, মহানবী সা. ঘরের লোকদের তাদের কাজে সহযোগিতা করতেন এবং নামাজের সময় হলে নামাজের জন্য যেতেন। (বুখারি-৬৭৬)। নিজের কাজ নিজে করতেন এবং ঘরের কাজে স্ত্রীদের সাহায্য করতেন। হাদিসে এসেছে, বিশিষ্ট সাহাবী আসওয়াদ ইবন ইয়াযিদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আয়িশা রা.-কে জিজ্ঞেস করলাম যে মহানবী সা. ঘরে কী করেন? আয়িশা রা. বলেন, ‘মহানবী সা. জুতা ঠিক করতেন, কাপড় সেলাই করতেন, উটনী ও বকরি দোহন করতেন এবং তোমরা যেমন ঘরে কাজ করো তেমনি তিনিও কাজ করতেন।’ (মুসনাদু আহমাদ-২৪৯০৩) এছাড়াও স্ত্রীদের নারীসুলভ দোষত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং সুন্দর ভাষায় সংশোধন করে দিয়েছেন। তাঁদের আচরণে কষ্ট পেলে কথা কম বলতেন বা দূরত্ব রাখতেন, তবু কাউকে বকাঝকা বা প্রহার করেননি। প্রত্যেক স্ত্রীর মধ্যে সমতা বিধান করতেন। তাঁদের কথাকে গুরুত্ব দিতেন। আমাদেরকে সুযোগ করে পারিবারিক কাজে সহায়তা করতে হবে। পরিবারকে সময় দেয়া : রাসূলুল্লাহ সা. এর সাহাবী উকবা ইবন আমির রা. বলেন, আমি একদা রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে উভয় জাহানের মুক্তির পথ কী, তা জানতে চাইলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা. তিনটি উপদেশ দিলেন; ১. কথাবার্তায় আত্মসংযমী হবে। ২. পরিবারের সঙ্গে তোমার অবস্থানকে দীর্ঘ করবে। ৩. নিজের ভুল কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হবে। (তিরমিজি-২৪০৬) পরিবারের সঙ্গে কোয়ালিটি সময় কাটানো কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা রাসূলুল্লাহ সা. এর জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পারি। একটি আদর্শ এবং মমতাপূর্ণ পরিবার গঠনে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে পরিবারের শুধুমাত্র দৈহিক উপস্থিতই না হয়। এখানে আত্মিক সম্পর্ককেই অত্যধিক জোর দেয়া হয়েছে। পরিবারের মাঝে বেশি সময় না দেয়ার কারণে আমাদের পরিবারে অশান্তি, পরকীয়া, পরস্পর সন্দেহসহ নানাবিধ দুর্ঘটনা ঘটছে এবং সন্তান-সন্ততিদের মাঝে নীতি-নৈতিকতা সেভাবে গড়ে উঠছে না। মতামত ও পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়া : পারিবারিক জীবনের যে কোনো বিষয় সঙ্গিনীর মতামতকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। সঙ্গী যদি কোনো বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করার মতো অবস্থায় থাকে তবে অবশ্যই তার পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। মহানবী সা. শুধু ঘরোয়া বিষয়ই নয় এমনকি মুসলিম উম্মাহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে স্ত্রীদের মতামত নিতেন। ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামক ইসলামী ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটে মহানবী সা. স্বীয় স্ত্রী উম্মু সালমা রা.-এর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময় যা অতি কার্যকরী বলে বিবেচিত হয়। (বুখারি-২৭৩১) সঙ্গিনীর প্রতি মুখে ভালোবাসা প্রকাশ : আমরা আমাদের সঙ্গিনীকে ভালোবাসলেও মুখে প্রকাশ করতে লজ্জা ও সংকোচ বোধ করি। অথচ আমাদের সঙ্গিনী আমাদের মুখে ভালোবাসার কথাটি শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ সা. বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীদের বিভিন্ন রোমাঞ্চকর কথায় আপ্লুত করে দিতেন। যেমন, খাদিজা রা. সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমার মনে তার প্রতি ভালোবাসা ঢেলে দেয়া হয়েছে।’ (মুসলিম-২৪৩৫) আয়িশা রা.কে বলেছেন, ‘সবার চেয়ে আয়িশা রা. আমার কাছে এমন প্রিয়, যেমন সব খাবারের মধ্যে সারিদ আমার কাছে বেশি প্রিয়।’ (বুখারি-৩৪১১) সঙ্গিনীর জন্য নিজেকে ফিট রাখা : পুরুষরা তাদের সঙ্গিনীকে সুন্দরভাবে দেখতে পছন্দ করে। ঠিক একইভাবে আমাদের সঙ্গিনী আমাদেরকেও সুন্দরভাবে দেখতে পছন্দ করে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীদের জন্য এমনই পরিপাটি থাকা পছন্দ করি, যেমন আমি তাদের ক্ষেত্রে সাজগোজ করে থাকতে পছন্দ করি।’ (বাইহাকী-১৪৭২৮) অধুনা পাইকারি হারে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণসমূহের মধ্যে এটিও একটি যে, আমরা সঙ্গিনীর জন্য যেভাবে পরিপাটি ও যথাযথ তৈরি হওয়া দরকার, ততটা থাকি না, যতবেশি বাইরে সময় দেই সে পরিমাণ সময় পরিবারে দেই না। সুবিধা-অসুবিধা শেয়ার না করার কারণেও সমূহ ক্রাইসিস হচ্ছে। স্ত্রীদের প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতা : স্ত্রীর সাথে সবসময় আন্তরিকভাবে আচরণ করতে হবে। অর্থাৎ স্ত্রীর প্রতি সব সময় সব বিষয়ে আন্তরিক ও দয়ার্দ্র থাকতে হবে। আয়িশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ভালোবেসে কখনো কখনো আমার নাম হুমাইরা বা (লাল টুকটুকে গোলাপ) বলে ডাকতেন। (ইবনে মাজাহ-২৪৭৪) তিনি আরো বলেন, পাত্রের যে অংশে আমি মুখ রেখে পানি পান করতাম তিনি সেখানেই মুখ লাগিয়ে পানি পান করতে পছন্দ করতেন। (মুসলিম-৩০০) রাসূলুল্লাহ সা. স্ত্রীদের এতটা ভালোবাসতেন যে, আয়িশা রা. পাত্রের যে স্থানে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতেন, তিনিও সে স্থানে মুখ দিয়ে পানি পান করতেন। আবার রাসূলুল্লাহ সা. হাড়ের যে জায়গা থেকে গোশত খাওয়া শুরু করতেন আশিয়া রা.ও হাড়ের ওই জায়গা থেকে গোশত খাওয়া শুরু করতেন। আবু হুরাইরা রা. তার বর্ণিত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন যে মহানবী সা. বলেছেন, একটি মু’মিন কখনো মু’মিন নারীকে (তার স্ত্রীকে) অপছন্দ করতে পারে না। তার একটি গুণ অপছন্দ হলে অন্যটি অবশ্যই পছন্দ হবে। (মুসলিম-২০৬০৫; শুয়াবুল ঈমান-৪৪৩০) আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আছ রা. বলেন, মহানবী সা. বলেছেন, সব থেকে আনন্দিত ব্যক্তি সে যার একটি উত্তম স্ত্রী আছে। (সুনানুল বাইহাকী-১৩৭৯৭) মহানবী সা. বলেছেন, কোনো মু’মিন তাকওয়ার পর উত্তম যা লাভ করে তা হলো পুণ্যময়ী স্ত্রী। স্বামী তাকে কোনো নির্দেশ দিলে সে তা পালন করে, সে তার দিকে তাকালে তাকে আনন্দিত করে এবং তাকে শপথ করে কিছু বললে সে তা পূর্ণ করে। আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে তার সম্ভ্রম ও সম্পদের হিফাজত করে। (আল মু’জামুল কবীর-৭৮৮১; ইবনে মাজাহ-১৮৫৭) রাসূলুল্লাহ সা.-এর স্ত্রীদের সঙ্গে খোশগল্প : রাসূলুল্লাহ সা. মাঝে মাঝে স্ত্রীদের সঙ্গে বসে বিভিন্ন ঘটনা, কাহিনী ও খোশগল্প করতেন। সব স্ত্রীই তাকে নতুন নতুন কাহিনী শুনাতেন। তখন রাসূলুল্লাহ সা. আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে নিজেও স্ত্রীদের কিসসা শুনাতেন। আয়িশা রা. বলেন, তিনি আমাদের মধ্যে এমনভাবে হাসতেন, কথা বলতেন ও বসে থাকতেন, আমাদের মনেই হতো না যে তিনি সাইয়্যিদুল মুরসালিন বা সকল নবী-রাসূলদের নেতা। রাসূলুল্লাহ সা.-এর স্ত্রীদের সঙ্গে ভাব-বিনিময় : রাসূলুল্লাহ সা. কখনো স্ত্রীদের ভর্ৎসনা কিংবা তিরস্কার করতেন না। তাদেরকে কোনো বিষয়ে কটাক্ষ করে কথা বলতেন না। বরং হৃদয় উজাড় করে দিয়ে মায়া ও মন জুড়ানো আকর্ষণীয় ভাবভঙ্গি ও কথা বলতেন। স্ত্রীদের কোনো কথা তাঁর মনের বিপরীত হলে তাদের সে কথা থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে অন্য চিন্তা করতেন। তিনি স্ত্রীগণকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাদের আদর, সোহাগ ও মায়া-মমতায় রাখতেন। কখনো কখনো তাদের ঊরুতে মাথা রেখে শুয়ে থাকতেন। ঈমান পূর্ণ হওয়ার একটি শর্ত হচ্ছে স্ত্রীগণের সাথে সদ্ব্যবহার করা। এ সম্পর্কে আয়িশা রা. হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, মুসলমানদের মধ্যে ঐ ব্যক্তির ঈমান পূর্ণ যার চরিত্র উত্তম এবং বিশেষ করে স্ত্রীর প্রতি অত্যধিক দয়ালু। (তিরমিজি-২৬১২; ইবনে হিব্বান-৪১৭৬) রাসূলুল্লাহ সা.-এর স্ত্রী-পরিবারে সালাম বিনিময় : রাসূলুল্লাহ সা. যখন বাহির থেকে ঘরে ফিরতেন তখন অত্যন্ত খুশি মনে মুচকি হাসতে হাসতে ঘরে প্রবেশ করতেন। দরদমাখা কণ্ঠে সালাম দিতেন। সালামের ব্যাপক প্রচলন মু’মিনের অবিচ্ছেদ্য ভূষণ। (বুখারি-২৮, ৫৮৮১; তিরমিজি-২৬৮৮) রাসূলুল্লাহ সা. এর দাম্পত্য জীবন মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। যার বাস্তবায়নে পারিবারিক জীবনে শান্তি ও সহাবস্থান ফিরে আসতে বাধ্য। মহানবী সা.-এর স্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে বুঝা যায় যে, সুখ ও শান্তিময় জীবন যাপনে স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্কের বিকল্প নেই। পারিবারিক জিন্দেগিকে সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি ও আনন্দময় করে তুলতে রাসূলুল্লাহ সা. এর দাম্পত্য জীবনের অনুপম আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণ প্রত্যেক মু’মিনের জন্য একান্ত আবশ্যক। মহান রাব্বুল আলামিন মুসলিম উম্মাহকে মহানবী সা.-এর দাম্পত্য জীবনকে অনুসরণ ও অনুকরণ করার মাধ্যমে আদর্শ স্বামী, আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ পিতা, আদর্শ মাতা, আদর্শ সন্তান ও সর্বোপরি আদর্শ মানুষ এবং পরিপূর্ণ মু’মিন হয়ে সুখ ও শান্তিময় জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক : অধ্যাপক ও ইসলামী চিন্তাবিদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির