post

দুনিয়ার প্রতি সীমাহীন আসক্তি ও তার পরিণাম

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

یٰۤاَیُّہَا  الَّذِیۡنَ  اٰمَنُوۡا لَا تُلۡہِکُمۡ اَمۡوَالُکُمۡ وَ لَاۤ اَوۡلَادُکُمۡ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰہِ ۚ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ  ذٰلِکَ  فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿۹﴾ وَ اَنۡفِقُوۡا مِنۡ مَّا رَزَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَ اَحَدَکُمُ الۡمَوۡتُ فَیَقُوۡلَ رَبِّ لَوۡ لَاۤ اَخَّرۡتَنِیۡۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیۡبٍ ۙ فَاَصَّدَّقَ وَ اَکُنۡ مِّنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۱۰﴾ وَ لَنۡ  یُّؤَخِّرَ اللّٰہُ نَفۡسًا اِذَا جَآءَ اَجَلُہَا ؕ وَ اللّٰہُ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿٪۱۱﴾

৯. হে মু’মিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন করে না দেয়। যারা এরূপ করবে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত। ১০. আমি তোমাদেরকে যে রিজিক দান করেছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই (আল্লাহর পথে) ব্যয় করো। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি দান-সদকা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। ১১. প্রত্যেক ব্যক্তির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকে এক মুহূর্ত সময় দেন না। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন। (সূরা আল-মুনাফিকুন, ৬৩ : ০৯-১১)

১. সূরা আল-মুনাফিকুন-এর পরিচয় ও নামকরণ

সূরা আল-মুনাফিকুন মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ৬৩তম সূরা। এতে ১১টি আয়াত ও ২টি রুকু রয়েছে। এ সূরার প্রথম আয়াতে বর্ণিত (إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ) ‘আল-মুনাফিকুন’ শব্দ দ্বারা এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

আল-মুনাফিকুন (المنافقون) শব্দটি বহুবচন, একবচন আল-মুনাফিক (المنافق)। এ শব্দটি একটি কুরআনি পরিভাষা। এর অর্থ মৌখিক ও কর্মের মাধ্যমে নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেওয়া কিন্তু অন্তরে ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্বাস পোষণ করা। এটি ‘নিফাক’ শব্দ থেকে উৎকলিত। নাফাকাহ (نَفْقَةٌ) শব্দের অর্থ সুড়ঙ্গ বা মাটির মধ্যে গর্ত, যার রয়েছে একটি প্রবেশ পথ ও একটি বহির্গমন পথ। কুরআনি পরিভাষায় ‘নিফাক’ ও ‘মুনাফিকী’ও একই ধরনের দুমুখো নীতির নাম। মুখে সে মুমিন হওয়ার কথা স্বীকার করে এবং লোক দেখানো সালাত, সাওম, হজ্জও আদায় করে; কিন্তু সে আন্তরিকভাবে কুফরির প্রতি আকৃষ্ট থাকে। ইসলামবিরোধী আকীদা-বিশ্বাস অন্তরে লালন করে। এমন দুমুখো নীতির মানুষকে ইসলামী শরীয়াহ মুনাফিক নামে অভিহিত করেছে। এ শ্রেণীর লোক কাফির-বেঈমানের চেয়ে মুসলমানদের জন্যে বেশি ভয়ংকর।

২. নাজিলের সময়কাল

মুফাসসিরগণের সর্বসম্মত মতে সূরাটি মাদানি। বনু মুস্তালিক (মুরাইসি) যুদ্ধ হতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ফিরার পথে অথবা যুদ্ধ শেষে মদিনায় পৌঁছার পর এ সূরাটি নাজিল হয়। উল্লেখ্য যে, ৫ম অথবা ৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাসে বনু মুস্তালিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

৩. সূরা আল-মুনাফিকূনের আলোচ্য বিষয়

এ সূরার প্রথম রুকু তথা প্রথম আটটি আয়াতে মুনাফিকদের আচরণ ও কাজ-কর্মের সমালোচনা ও পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, মুনাফিকরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে আসে তখন তাঁকে আল্লাহর রাসূল বলে স্বীকার করে; কিন্তু তারা এটা আসলে অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে না। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীগণের বিরুদ্ধে মুনাফিকদের অশালীন আচরণ, যেমন- ‘রাসূলের দাওয়াত তথা দ্বীন ইসলাম অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং বনু মুস্তালিক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুহাজিরদেরকে মদিনা থেকে বের করে দেওয়া হবে।’ ইত্যাদি প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।

মদিনার সবচেয়ে বড় দুটি গোত্র আউস ও খাযরাজের মধ্যে গোত্রীয় লড়াই লেগেই থাকত। উভয়পক্ষ দীর্ঘ লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে শান্তি ও নিরাপদে বসবাসের উদ্দেশ্যে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে বাদশাহ মেনে নিয়ে মিলেমিশে থাকার ফায়সালা করেছিল। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বেই উভয় গোত্রের নেতারা মুসলমান হয়ে যাওয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নেতৃত্বে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়ে গেল। বাদশাহ হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখ নিয়েই আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নিজের নেতৃত্ব রক্ষার আশায় ইসলাম গ্রহণ করল। যখন সে বুঝতে পারল যে, তার বাদশাহী পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই, তখন সে ইসলামের দুশমনদের পক্ষে মুনাফিকদের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাদের এ ভূমিকাই এ সূরার প্রথম রুকুর আলোচ্য বিষয়।

দ্বিতীয় রুকু তথা ০৯ থেকে ১১তম আয়াতে মুসলমানদেরকে মুনাফিকির রোগ থেকে বেঁচে থাকার জন্য সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদের চেয়ে আল্লাহর সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার এবং আল্লাহর মর্জি মতো ধন-সম্পদ খরচ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে।

৪. নাযিলের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

৫ম অথবা ৬ষ্ঠ হিজরীতে বনু মুস্তালিক যুদ্ধের পর একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরা আল-মুনাফিকুন নাজিল হয়। ঘটনাটি ছিল এই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ পান যে, মুস্তালিক গোত্রের সর্দার হারিস ইবনে যিরার মুসলানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ পেয়ে একদল মুজাহিদসহ তাদের মোকাবিলা করার জন্য রওনা দেন। এই যুদ্ধে মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাইসহ একদল মুনাফিক গণিমতের মালের আশায় অংশ নেয়।

‘মুরাইসি’ নামক এক প্রসিদ্ধ কূপের কাছে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুস্তালিক গোত্রের বহুলোক নিহত ও আহত হয়। কিছু নারী ও পুরুষ মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। বন্দীদের মধ্যে সর্দার হারিস ইবনে যিরারের কন্যা হযরত জুয়ায়রিয়াও (রা) ছিলেন। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিবিদের অন্তর্ভুক্ত হন। এভাবে মুসলমানদের বিজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়।

যুদ্ধ শেষে মুসলিম বাহিনী যখন মুরাইসি কূপের কাছে অবস্থান করছিল তখন একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল। জাহজাহ ইবনে মাসউদ নামক একজন মুহাজির এবং সিনান ইবনে ওয়াবার নামক একজন আনসারীর মধ্যে পানি নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে হাতাহাতির সীমা অতিক্রম করে সংঘর্ষের মধ্যে জড়িয়ে পড়ল। মুহাজির ব্যক্তি মুহাজিরদের এবং আনসারী ব্যক্তি আনসারদের ডাক দিলো। উভয়ের সাহায্যে কিছু লোক এগিয়ে গেল। এভাবে ব্যাপারটি নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি সেখানে গেলেন এবং ভীষণভাবে রেগে গিয়ে বললেন, একি জাহেলি যুগের ডাক, এই জাহেলি ডাক বন্ধ করো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপদেশবাণী শোনামাত্রই ঝগড়া মিটে গেল।

মুনাফিকদের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যখন মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে সংঘর্ষের খবর পেল, তখন সে একে মুসলমানদের মধ্যে ফাটল ধরাবার সুবর্ণ সুযোগ মনে করে নিলো। মুনাফিকদের যে দলটি গণিমতের মালের লোভে মুসলমানদের সাথে এসেছিল তাদেরকে ডেকে সে এক বৈঠক করল। তাদের এ বৈঠকে মুমিনদের মধ্যে কেবল যায়িদ ইবনে আরকাম উপস্থিত ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বলল, তোমরা মুহাজিরদেরকে নিজের দেশে ডেকে এনে মাথায় চড়িয়েছো। নিজেদের সহায় সম্পত্তি তাদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছো। তারা তোমাদের খেয়ে লালিত পালিত হয়ে এখন তোমাদেরই ঘাড় মটকাচ্ছে। যদি তোমাদের এখনও জ্ঞান ফিরে না আসে, তবে পরিণামে এরা তোমাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলবে। কাজেই তোমরা ভবিষ্যতে টাকা-পয়সা দিয়ে তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা কোরো না। এতে তারা আপনা আপনি ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যাবে। এখন তোমাদের দায়িত্ব হলো, মদিনায় ফিরে গিয়ে সম্মানিতরা বহিরাগত এসব বাজে অসম্মানিত লোকদেরকে বের করে দেবে।

সম্মানিত বলে বোঝাচ্ছিল তার নিজের মুনাফিক দল ও আনসারদেরকে এবং বাজে এবং অসম্মানিত লোক বলে বোঝাচ্ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুহাজির সাহাবীদের। হযরত যায়িদ ইবনে আরকাম (রা) একথা শোনা মাত্রই বলে উঠলেন, আল্লাহর কসম, তুই-ই বাজে অসম্মানিত ও ঘৃণিত লোক। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর শক্তির বলে এবং মুসলমানদের ভালোবাসার জোরে মহাসম্মানিত।

হযরত যায়িদ ইবনে আরকাম (রা) মুনাফিকদের মজলিশ থেকে উঠে সোজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে গিয়ে সব ঘটনা বিস্তারিতভাবে বলে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে সংবাদটি খুবই গুরুতর মনে হলো। তাঁর চেহারার পরিবর্তন দেখা দিলো। যায়িদ ইবনে আরকাম বয়সে ছোট থাকায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, দেখো তুমি আবার মিথ্যা বলছো না তো? যায়িদ কসম খেয়ে বললেন, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি মিথ্যা বলছি না, আমি নিজ কানে এসব কথা শুনেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবারও জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কোনো রকম বিভ্রান্তি হয়নি তো? যায়িদ উত্তরে আগের কথাই বললেন। এরপর মুনাফিক নেতার এই কথা গোটা মুসলিম বাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল।

হযরত উমর (রা) ব্যাপারটি জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে এসে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে অনুমতি দিন আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এ কথায় বললেন, এটা হয় না। এতে লোকেরা বলবে, দেখো মুহাম্মদ নিজেই তার সঙ্গী সাথীদের হত্যা করছে। উমর (রা)-এর এ কথা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর পুত্র জানতে পারলেন। তার নামও আবদুল্লাহ ছিল। তিনি খাঁটি মুসলমান ছিলেন। তিনি সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে হাজির হয়ে আরজ করলেন, যদি আপনি আমার পিতাকে এসব আপত্তিকর কথাবর্তার জন্য হত্যা করার ইচ্ছা রাখেন, তাহলে আমাকেই আদেশ করুন, আমি তার মাথা কেটে আপনার কাছে এ মজলিশ ত্যাগ করার আগেই হাজির করে দেবো। তিনি আরও বললেন, গোটা খাযরাজ গোত্র সাক্ষী, তাদের কেউ আমার চেয়ে বেশী বাপ-মার সেবা ও আনুগত্যকারী নেই। কিন্তু আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে তাদেরও কোনো বিষয় সহ্য করতে পারব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আবদুল্লাহ! তাকে হত্যা করার ইচ্ছা আমার নেই এবং কাউকে এ বিষয়ে আদেশও করিনি।

ইতোমধ্যে সাহাবী উবাদা ইবনে সামিত (রা) মুনাফিক নেতা ইবনে উবাইকে উপদেশ দিলেন, তুমি এক কাজ করো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে হাজির হয়ে অপরাধ স্বীকার করে নাও। তিনি তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। এতে তোমার মুক্তি হয়ে যেতে পারে। ইবনে উবাই এই উপদেশ শুনে মাথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলে হযরত উবাদা (রা) তখনই বললেন, আমার মনে হয়, তোমার এই অবজ্ঞা সম্পর্কে অবশ্যই কুরআনের আয়াত নাজিল হবে।

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে একাকী ডেকে এনে বললেন, তুমি কি বাস্তবিকই এরূপ কথা বলেছো? সে অনেক কসম খেয়ে বলল, আমি কখনও এমন কথা বলিনি। এই ছেলেটি মিথ্যা বলেছে, মোটকথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে উবাইয়ের কসম ও ওযরকে গ্রহণ করে নিলেন। কাফেলার মধ্যে যায়িদ ইবনে আরকাম (রা)-এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও তিরস্কার সৃষ্টি হলো। যায়িদ ইবনে আরকাম (রা)-এর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এ মুনাফিক লোকটি আমাকে মিথ্যাবাদী বলে গোটা জাতির চোখে আমাকে হেয় করেছে। অতএব আমার সত্যায়ন ও এই লোকের মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন সম্পর্কে অবশ্যই কুরআনের আয়াত নাজিল হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি অহি নাযিলের আলামত ফুটে উঠল। যায়িদ (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পার্শ্বেই ছিলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়িদ (রা)-কে বললেন, হে বালক! মহান আল্লাহ তোমার কথার সত্যায়ন করেছেন এবং সম্পূর্ণ সূরা আল-মুনাফিকুন ইবনে উবাইয়ের ঘটনা সম্পর্কে নাজিল হয়েছে।

এই বর্ণনা থেকে জানা গেল যে, সূরা মুনাফিকুন বনু মুস্তালিক যুদ্ধ শেষে ফেরার পথেই নাজিল হয়েছে। তবে ইমাম বাগাভী (রহ)-এর বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় পৌঁছে যান তখন এ সূরাটি নাজিল হয়েছে।  

নির্বাচিত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা

৯ম আয়াত : দুনিয়ার প্রতি সীমাহীন আসক্তি ও তার পরিণাম 

یٰۤاَیُّہَا  الَّذِیۡنَ  اٰمَنُوۡا  لَا تُلۡہِکُمۡ اَمۡوَالُکُمۡ  وَ لَاۤ  اَوۡلَادُکُمۡ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰہِ ۚ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ  ذٰلِکَ  فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿۹﴾  

‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ধন-স¤পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স¥রণ থেকে উদাসীন করে না দেয়। যারা এরূপ করবে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত।’ 

পূর্বের আয়াতসমূহে মুনাফিকদের কথা, কাজ এবং বিশ্বাসের মধ্যে বৈপরিত্য সম্পর্কে আলোচনা করার পর এ আয়াতে মুমিনদেরকে সতর্ক করা হয়েছে যে, তারা যেন মুনাফিকদের মতো দুনিয়ার মহব্বতে মগ্ন হয়ে আল্লাহ থেকে গাফিল হয়ে না যায়। কেননা যেসব জিনিস দুনিয়াতে মানুষকে আল্লাহর যিকির বা স্মরণ থেকে গাফিল করে দেয় তন্মধ্যে প্রধান দুটো জিনিস হলো ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি। তাই এ দুটো এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

অনুরূপ কথা সূরা আলে-ইমরানের ১৪ নং আয়াতে মানুষের জন্য দুনিয়ার আকর্ষণীয় ছয়টি প্রিয় বস্তু উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,

زُیِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّہَوٰتِ مِنَ النِّسَآءِ وَ الۡبَنِیۡنَ وَ الۡقَنَاطِیۡرِ الۡمُقَنۡطَرَۃِ مِنَ الذَّہَبِ وَ الۡفِضَّۃِ وَ الۡخَیۡلِ الۡمُسَوَّمَۃِ وَ الۡاَنۡعَامِ وَ الۡحَرۡثِ ؕ ذٰلِکَ مَتَاعُ  الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ اللّٰہُ عِنۡدَہٗ حُسۡنُ الۡمَاٰبِ

‘মানুষের নিকট মনোরম করা হয়েছে আকর্ষণীয় বস্তুর আসক্তি- নারী, সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত অশ্ব, গবাদি পশুরাজি এবং ক্ষেত-খামারের মতো আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আল্লাহর নিকটই হলো উত্তম আশ্রয়।’

অনুরূপভাবে সূরা আত-তাওবার ২৪তম আয়াতে মানুষের কাছে খুবই প্রিয় ও আকর্ষণীয় মোট ৮টি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যথা- বাপ-মা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্ত্রী-পরিজন, অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বাসগৃহ।

আমাদের মনে রাখতে হবে, মহান আল্লাহ দুনিয়াকে মানুষের পরীক্ষার জন্য অতি আকর্ষণীয় করে দিয়েছেন। কে এগুলোর আকর্ষণে মশগুল হয়ে পরকালকে ভুলে যায় এবং কে এসবের আসল স্বরূপ ও ধ্বংসশীল হওয়ার বিষয় অবগত হয়ে শুধু যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু অর্জনে সচেষ্ট হয় ও পরকালীন কল্যাণ আহরণের লক্ষ্যে ব্যবহার করে। তাই সূরা আল-কাহাফের ৭ম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,

‘আমি পৃথিবীস্থ সব কিছুকে পৃথিবীর জন্যে শোভা করেছি, যেন লোকদের পরীক্ষা করি যে, তাদের মধ্যে কে ভাল কাজ করে।’ 

অনুরূপভাবে মুসআব ইবনে সাদ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দুনিয়ার ব্যাপারে সাবধান হও, তার রূপ হলো মনোহর সবুজ উদ্যানের ন্যায়। যা মানুষকে সহজে আকৃষ্ট করে।’ (কিতাবুয যুহদ, হা. ৬২, ১৮৩, ২৩৩)

দুনিয়া এক রহস্য ঘেরা জায়গা। মানুষ এখানে আসে। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের সিঁড়ি বেয়ে বার্ধক্যে পৌঁছে। তারপর হঠাৎ একদিন চলে যায়। কোত্থেকে এলো, কেন  এলো, কোথায় গেল- এসব প্রশ্ন প্রত্যেক মানুষের মনে বারবার উঁকি দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা দুনিয়ার মোহ ও সুখ-ভোগের নেশার নিচে চাপা পড়ে থাকে। দুনিয়ার সাথে মানুষের সম্পর্ক কী? মানুষ এখানে কেন আসে, আবার কেনই বা এখান থেকে চলে যায়? এখানে তার করণীয় কী? দুনিয়ার কতটুকু অংশ গ্রহণীয়, আর কতটুকু বর্জনীয়? এসব প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহ মানুষের সূচনালগ্ন থেকেই নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। পক্ষান্তরে, কতিপয় দার্শনিকও নানাভাবে এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে, দার্শনিকদের এসব জবাবের ভিত্তি হলো আন্দাজ-অনুমান (ঝঢ়বপঁষধঃরড়হ)। বিপরীত দিকে, নবী-রাসূলদের জবাবের ভিত্তি হলো ওহি; যা নির্ভুলতম জ্ঞান। 

দুনিয়া সম্পর্কে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এ দুনিয়ার সাথে আমার দৃষ্টান্ত হলো এক অশ্বারোহীর ন্যায়, যে প্রচ- গরমে একদিন একটি গাছের ছায়ায় কিছু সময়ের জন্য নিদ্রা গেল, তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।’ (মুসনাদু আহমদ)

গর্তে পড়ে থাকা একটি মৃত ভেড়া দেখিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ফেলে দেওয়ার সময় মালিকের নিকট এ ভেড়াটি যতো তুচ্ছ মনে হয়েছে, আল্লাহ তায়ালার নিকট দুনিয়া তার চেয়েও অধিক তুচ্ছ।’ (কিতাবুয যুহদ, হা. ১১৯)

সূরা আন-নিসার ৭৭তম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘পার্থিব ভোগবিলাস সামান্য, আর মুত্তাকীদের জন্য আখিরাতই উত্তম।’  

মহান আল্লাহ সূরা আত-তাগাবুনের ১৫শ আয়াতে আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের সম্পদ ও সন্তানাদি তোমাদের জন্য ফেতনা, আর আল্লাহর নিকটে রয়েছে উত্তম প্রতিদান।’ 

মানুষ দুনিয়ার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পরকালকে ভুলে যায়। সূরা আত-তাওবার ৩৮তম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের উপকরণ অতি অল্প।

সূরা তাকাছুরের প্রথমে মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে গাফেল রাখে। এমনকি, তোমরা কবরস্থানে পৌঁছে যাও।’ ধন-সম্পদের প্রতি লোভ বা মোহ মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

لَوْ أَنَّ لِابْنِ اٰدَمَ وَادِيَيْنِ مِنْ مَالٍ لَابْتَغَى وَادِيًا ثَالِثًا وَّلَا يَمْلَأُ جَوْفَ ابْنِ اٰدَمَ إِلَّا التُّرَابُ

‘মানুষকে যদি স্বর্ণে পরিপূর্ণ দু’টি উপত্যকা দেওয়া হয়, তখন সে অপর একটির প্রত্যাশা করবে। মাটি ব্যতীত আর কোন দ্রব্যই মানব হৃদয়কে পরিতৃপ্ত করতে পারে না।’ (সহীহুল বুখারী; সহীহ মুসলিম)

দুনিয়ার প্রতি মহব্বত যাবতীয় অসৎ কর্মের মূল। আনাস (রা) হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘দুনিয়ার মহব্বত সব অনিষ্টের মূল।’ 

মানুষ যখন লোভের বশীভূত হয়, তখন সে ইহকালে অপমানিত ও পরকালে লজ্জিত হয়। তাই ইমাম গাযালী বলেন, ‘লিপ্সু ও লোভী ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক মানসিক যাতনা আর কেউ সহ্য করে না। অল্পে তুষ্ট ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক শান্তি কেউ লাভ করে না। ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক মনঃকষ্ট আর কেউ পায় না। সংসারবিরাগী অপেক্ষা অধিক ভারশূন্য আর কেউ নহে এবং যে আলিম ‘ইলম অনুযায়ী কাজ করে না, তার অপেক্ষা অধিক লজ্জিত আর কেউ হবে না।’ (এহইয়া ‘উলূমিদ্দীন, ২য় খ-, পৃ. ৪৭)

সুতরাং আমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ এবং জিহাদ অপেক্ষা দুনিয়াবি বস্তুকে প্রাধান্য দেবে তাদের পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে মহান আল্লাহ বলেন, 

اَحَبَّ  اِلَیۡکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ  وَ جِہَادٍ فِیۡ سَبِیۡلِہٖ فَتَرَبَّصُوۡا حَتّٰی یَاۡتِیَ اللّٰہُ بِاَمۡرِہٖ

‘আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে (দুনিয়াবি বস্তু) অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত।’ (সূরা আত-তাওবাহ, ০৯ : ২৪)

মোটকথা, যারা দুনিয়ার লোভে ও মহব্বতে ডুবে গিয়ে আল্লাহ এবং রাসূলের ভালোবাসা ও মহব্বতকে উপেক্ষা করে এবং জিহাদ তথা দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে বিরত থাকে, তাদের জন্যে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জীবনে কঠিন লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও ভয়াবহ আযাব নিহিত রয়েছে।

১০ম আয়াত : আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়

وَ اَنۡفِقُوۡا مِنۡ مَّا  رَزَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ  قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَ  اَحَدَکُمُ  الۡمَوۡتُ فَیَقُوۡلَ  رَبِّ لَوۡ لَاۤ  اَخَّرۡتَنِیۡۤ  اِلٰۤی  اَجَلٍ قَرِیۡبٍ ۙ فَاَصَّدَّقَ وَ  اَکُنۡ  مِّنَ  الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۱۰﴾  

‘আমি তোমাদেরকে যে রিজিক দান করেছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই (আল্লাহর পথে) ব্যয় করো। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি দান-সদকা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’

আমাদের মৃত্যুর সময়কাল কেউ জানি না। এ আয়াতে মৃত্যুর পূর্বে মুক্তহস্তে আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ ব্যয় করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, মানুষের নিকট সবচেয়ে প্রিয় দুটি বস্তু হলো মাল ও জান। মাল বা ধন-সম্পদ রক্ষায় মানুষ জীবন দিয়ে দেয়, আবার জীবন রক্ষার জন্য সব মাল ত্যাগ করতেও দ্বিধা করে না। মহান আল্লাহ এ প্রিয় দুটি বস্তুই বান্দার নিকট চান। বিনিময়ে জান্নাত দিতে চান। (সূরা আত-তাওবাহ, ০৯ : ১১১)

‘আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়’ করাকে আরবিতে ‘ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ’ বলা হয়। ‘ইনফাক’ শব্দের অর্থ ‘সুড়ঙ্গ’। যে সুড়ঙ্গের উভয় মুখ খোলা অর্থাৎ যার একদিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে বের হওয়া যায়। মুসলমানদের ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে থাকার জন্যে নয়; বরং একদিকে বৈধ পথে আয় হবে অন্যদিকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে তা ব্যয় হতে থাকবে। ইসলামী সমাজ বিনির্মানের জন্য অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা প্রয়োজন। মহান আল্লাহ আল-কুরআনে যেখানেই ‘জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ’-এর কথা বলেছেন সেখানেই সম্পদ ও জীবন উৎসর্গের কথা বলেছেন। এ দুটির উৎসর্গ ছাড়া আল্লাহর দ্বীন সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া গরিব, মিসকিন, আত্মীয় স্বজন, অসহায় ইয়াতিমদের প্রতিও দান খায়রাতের যথেষ্ট তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। আল-কুরআনে ৬৯ বারেরও অধিক স্থানে ‘ইনফাক’ বা অর্থ ব্যয় সম্পর্কে বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল সর্বাবস্থায় দান করার নির্দেশ দিয়ে বলেন,

الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ

‘যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুুত: আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান, ০৩ : ১৩৪)

যার ওপর যাকাত প্রদান করা ফরয নয় তার জন্য স্বীয় প্রাপ্ত রিযিক থেকে হলেও দান করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সূরা ইব্রাহীমের ৩১তম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দাদেরকে বলে দিন যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তারা নামায কায়েম রাখুক এবং আমার দেওয়া রিযিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করুক ঐদিন আসার আগে, যেদিন কোনো বেচা কেনা নেই এবং বন্ধুত্বও নেই।’ 

ইসলাম অসহায় মানবতার সেবায় অর্থ ব্যয়ের উৎসাহ দিয়েছে। ‘আবূ মূসা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, কষ্টে পতিতকে উদ্ধার করো এবং রোগীদের সেবা করো।’ (সুনানু আবি দাউদ; শু‘আবুল ঈমান)

আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করাকে আল্লাহ ‘উত্তম ঋণ’ (কর্যে হাসানা) বলে অভিহিত করেছেন এবং তা বহুগুণ বাড়িয়ে ফেরত দেবেন, মহান আল্লাহ বলেন, ‘কে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহকে উত্তম ধার দেবে, এরপর তিনি তার জন্যে তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্যে রয়েছে সম্মানিত পুরস্কার।’ (সূরা আল-হাদীদ, ৫৭ : ১১) 

সূরা আল-বাকারার ২৬১তম আয়াতে মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন স¤পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মতো, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে।’ তাফসীর রুহুল মায়ানী ও আনোয়ারুত তানযীল গ্রন্থে উল্লেখ আছে, জাবির (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জিহাদে খরচ করে, আর জিহাদে অংশগ্রহণ না করে তখন এক দিরহাম সাতশত দিরহামের সওয়াব পাওয়া যাবে, আর যদি দানকারী জিহাদেও অংশগ্রহণ করে, তখন এক দিরহামে সাত লক্ষ দিরহামের সাওয়াব পাবে।’

যার যে পরিমাণ সামর্থ্য সে অনুযায়ী অর্থ দানের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘বিত্তশালী ব্যক্তি তার বিত্ত অনুযায়ী ব্যয় করবে। যে ব্যক্তি সীমিত পরিমাণে রিযিকপ্রাপ্ত, সে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তা থেকে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যা দিয়েছেন, তদপেক্ষা বেশী ব্যয় করার আদেশ কাউকে করেন না। আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দেবেন।’ (সূরা আত-তালাক, ৬৫ : ০৭)

আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় জাহান্নাম থেকে রক্ষা করে জান্নাতে পৌঁছায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘দানশীলতা জান্নাতের একটি গাছ, যার ডাল-পালা পৃথিবী পর্যন্ত ঝুলন্ত। যে ব্যক্তি এক একটি ডাল ধরবে, সে ডাল তাকে জান্নাতে টেনে নেবে। আর কার্পণ্য জাহান্নামের একটি গাছ, যার ডাল-পালা পৃথিবী পর্যন্ত ঝুলান। যে কেউ তার একটি ডাল ধরবে, সে ডাল তাকে জাহান্নামে টেনে নেবে।’ (দারা কুতনী; বায়হাকী; তাফসীরে মাযহারী, ২য় খ-, পৃ. ৪৬৪)

আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় না করার পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘শুনো, তোমরাই তো তারা, যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার আহবান করা হচ্ছে, অতঃপর তোমাদের কেউ কেউ কৃপণতা করছে। যারা কৃপণতা করছে, তারা নিজেদের প্রতিই কৃপণতা করছে। আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরা অভাবগ্রস্থ। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এরপর তারা তোমাদের মতো হবে না।’ (সূরা মুহাম্মদ, ৪৭ : ৩৮)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীগণের কুরবানি 

* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যসায়ী ছিলেন। তিনি যাবতীয় সম্পদ আল্লাহর পথে বিলিয়ে দেন। একদিন মসজিদে নববীতে ভাষণ দেওয়ার সময় সহসাই এমনভাবে লোকদের ভেদ করে বাড়ীর ভেতর প্রবেশ করলেন তাতে মনে হলো কোনো ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। তিনি ফিরে এসে বললেন এক রতি সোনা ছিল তা বিলিয়ে না দিয়ে আমি স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।

* খাদিজাতুল কুবরা (রা) প্রচুর সম্পদের মালিক ছিলেন। তাঁর সমস্ত সম্পদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাতে সমর্পন করেন।

* আবু বকর (রা) একজন বড় ব্যসায়ী ছিলেন। দাসমুক্তিসহ দীনের পথে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। মক্কায় চল্লিশ হাজার দিরহামের মালিক ছিলেন। যখন মদিনায় হিজরত করলেন তখন আড়াই হাজার দিরহাম ছিল। তাবুক অভিযানের সময় সমস্ত সম্পদ আল্লাহর পথে দান করেন।

* উমর (রা) তাবুক অভিযানে মোট সম্পদের অর্ধেক দান করেন।

* উসমান (রা) সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য ছিলেন। বীরে রুমা কূপ খরিদ করে মুসলমানদের ওয়াকফ করে দেন। তাবুক যুদ্ধে তিনি সবচেয়ে বেশি দান করেন। নগদ এক হাজার দিনার, ৯৫০টি উট, ৫০টি ঘোড়া দান করেন এবং এক তৃতীয়াংশ সৈন্যের যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নেন। 

* আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা) মদিনায় প্রচুর সম্পদের মালিক ছিলেন। তাবুক অভিযানে আট হাজার দিনার নগদ দান করে রেকর্ড করেন। আল্লাহ বলেন, এ তো সেই ব্যক্তি যার উপর রহমত নাজিল হতে থাকবে।

* অনেক সাহাবী ঘরবাড়ি সব ত্যাগ করে মদিনায় পাড়ি দেন।

* আনসারগণ মুহাজিরগণকে নিজের ভাই হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সম্পদে অংশীদার বানান।

* সুহাইব (রা) কাফেরদের হাতে সব সম্পদ ছেড়ে দিয়ে খালি হাতে দ্বীনের খাতিরে মক্কায় হিজরত করেন।

* আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর নিকট যে দাস-দাসী উত্তম বলে মনে হত তাকেই স্বাধীন করে দিতেন।

১১তম আয়াত : প্রত্যেক প্রাণী আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে মৃত্যুবরণ করবে 

وَ لَنۡ  یُّؤَخِّرَ اللّٰہُ  نَفۡسًا  اِذَا جَآءَ اَجَلُہَا ؕ وَ اللّٰہُ  خَبِیۡرٌۢ  بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿٪۱۱﴾

‘প্রত্যেক ব্যক্তির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকে এক মুহূর্ত সময় দেন না। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন।’ 

নির্দিষ্ট সময়ে মানুষের নিশ্চিত মৃত্যু হওয়া প্রসঙ্গে এখানে বলা হয়েছে। দিনের পর যেমন রাত আসে এবং অন্ধকারের পর আলো আসে, তেমনি জীবনের পরে মৃত্যু আসবেই। মৃত্যু শাশ্বত ও চিরন্তন সত্য। এটাকে প্রতিরোধ করা যায় না। মৃত্যুর সামনে সবাই অসহায়। কোনো শক্তি ও সম্পদের বিনিময়ে তাকে পেছানো যায় না। শক্তিহীন ও শক্তিধর সবাইকে এর সামনে আত্মসমর্পণ করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ের এক সেকেন্ডও বিলম্ব না করে তা উপস্থিত হবে। কে কোথায় আছে, তার কোনো পরোয়া নেই। তাই মহান আল্লাহ বলেন, 

اَیۡنَ مَا تَکُوۡنُوۡا یُدۡرِکۡکُّمُ الۡمَوۡتُ وَ لَوۡ کُنۡتُمۡ  فِیۡ  بُرُوۡجٍ مُّشَیَّدَۃٍ

‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন; মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও।’ (সূরাতুন নিসা, ০৪: ৭৮)

একমাত্র আল্লাহ ছাড়া মৃত্যু সবার জন্য প্রযোজ্য। তাই মহান আল্লাহ বলেন, ‘ভূপৃষ্টে যা কিছু আছে, সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। একমাত্র তোমার রবের পবিত্র চেহারাই (সত্তা) অবশিষ্ট থাকবে।’ (সূরা আর-রহমান, ৫৫ : ২৬-২৭)

মহান আল্লাহ অন্যত্রে বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’ (সূরা আলে ইমরান , ৩ : ১৮৫)

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

     لِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ إِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ فَلَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ 

‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট জীবন বা হায়াত। যখন তাদের সেই সুনির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হবে, তখন তারা সেই সময়কে মুহূর্তের জন্যও আগে-পিছে করতে পারবে না।’ (সূরাতু ইউনুস, ১০: ৪৯)

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক লোককে লক্ষ্য করে বলেন, ‘তুমি পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে গুরুত্ব দাও। ১. বার্ধক্যের আগে তোমার যৌবন ২. অসুস্থতার আগে তোমার স্বাস্থ্য ৩. অভাবের আগে তোমার সম্পদ ৪. ব্যস্ততার আগে তোমার অবসর সময় এবং ৫. মৃত্যুর আগে তোমার জীবন।’ (মুসতাদারাক)

নির্বাচিত আয়াতসমূহের মৌলিক শিক্ষা

১। অনুকুল-প্রতিকুল সকল অবস্থাতেই আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলাই হলো প্রকৃত আল্লাহর যিকির বা স্মরণ। সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণকে অন্তরে জাগরুক রাখাই মু’মিনের কর্তব্য। 

২। দুনিয়ার প্রতি সীমাহীন মোহ যাবতীয় অসৎ কর্মের মূল। প্রকৃত মু’মিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মোহে আল্লাহকে কখনও ভুলে যেতে পারে না।

৩। ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহ-ই দান করেন। সুতরাং ধন-সম্পদ আল্লাহর নির্দেশিত পথে খরচ করতে হবে।

ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিকে মহব্বত করা যাবে। তবে তাদের মহব্বতকে আল্লাহ ও রাসূলের মহববতের উপর প্রধান্য দেওয়া যাবে না। 

৪। পৃথিবীতে স্বাভাবিকভাবে চলার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু হালাল উপায়ে ধন-সম্পদ অর্জনের চেষ্টা করা যাবে। কিন্তু ধন-সম্পদের প্রাচুর্য গড়ার জন্য আল্লাহর স্বরণ অর্থাৎ তাঁর আইন-কানুন বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে হালাল-হারামের বাচ-বিচার না করে ধন-সম্পদের পেছনে ছুটে দুনিয়াতে ডুবে যাওয়া যাবে না।

৫। অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে এবং বৃদ্ধ হবার পূর্বে যৌবনকালকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী এবং তাঁর বিধান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে।

৬। আল্লাহর স্বরণ থেকে কোনো সময়ে গাফিল না হবার জন্য সব সময় মৃত্যুকে স্মরণ রাখতে হবে।

কখন কার কোথায় মৃত্যু হবে আমরা তা কেউ জানি না। তাই মুসলিম তথা আত্মসমর্পিত ব্যক্তি হিসেবে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। ‘মালাকুল মাউত’ যখনই আসবেন তখনই যেন আমাকে খাঁটি মুসলিম হিসেবে পায়।

লেখক : প্রফেসর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির