post

দেশে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত

সৈয়দ খালিদ হোসেন

০৪ আগস্ট ২০১৫
cs-kalid1দেশে আইনের শাসন না থাকায় প্রতিদিনই ঘটছে পৈশাচিক ও নির্মম হত্যাকান্ড। ঘটছে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, অপহরণ, গুম, এডিস নিক্ষেপ, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই রাহাজানির মতো ঘটনা। রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। যুবলীগের চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যবসায়ীদের প্রকাশ্যে মানববন্ধনও করতে হচ্ছে। চাঁদাবাজির অপরাধে কখনো কখনো ধরা পড়ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এমনকি ছিনতাইকারী হিসেবে গ্রেফতার হচ্ছে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি না হওয়ায় তারা আরও উৎসাহিত হচ্ছে। সে কারণে ক্রমেই দেশজুড়ে বেড়ে চলছে পৈশাচিকতা ও নির্মমতা। কর্মক্ষেত্রে, বসতঘরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বাসে, মাইক্রোবাসে, ট্রেনে এমনকি নৌকায়ও নিরাপদ নন নারীরা। অপরাধের মাত্রা এতটাই ছাড়িয়ে গেছে যে, স্বামীর কাছে স্ত্রী এবং স্ত্রীর কাছে স্বামী এখন নিরাপদ নন। পিতাও হাসপাতালের ছাদ থেকে নবজাতককে ছুড়ে ফেলে হত্যা করছে। ক্ষমতাসীন দলের কাছে এ দেশের মায়ের গর্ভের শিশুরাও এখন নিরাপদ নয়। জন্মের আগেই বুলেটের আঘাত সহ্য করতে হচ্ছে নতুন প্রজন্মকে। সমাজবিজ্ঞানীরা এসব কর্মকান্ডকে শুধু সামাজিক বিপর্যয় বলেই ক্ষান্ত নন, তারা মনে করছেন বাংলাদেশে এখন আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত। তা ছাড়া জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার না থাকার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। তারা মনে করছেন যেহেতু সরকার অনেকটা পুলিশনির্ভর সেহেতু পুলিশ কোনো অপরাধ করলেও তার বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হবে না। তা ছাড়া, পুলিশ কোনো অপরাধ করলে ওই ঘটনার তদন্ত করবে পুলিশ, প্রতিবেদন দেবে পুলিশ, মামলা তৈরি করবে পুলিশ, শাস্তির সুপারিশও করবে পুলিশ। আর সে কারণেই অপরাধের প্রকাশ্য দলিল থাকার পরও এখন পর্যন্ত পুলিশের দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হয়নি। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব সদস্যদের ৭ খুনের ঘটনার নজির তো দেশবাসীর জানা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অপরাধ দমনে বর্তমান সরকারের কোনো নির্দেশনা মানছেন বলে মনে করছেন না সাধারণ মানুষ। আর বিশ্লেষকরা এসব ঘটনাকে ১৯৭৫ এর পূর্বের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করছেন। বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলার বিপর্যয় দেখে পঁচাত্তর-পূর্বের ঘটনাগুলোতে স্মরণ করিয়ে দেয় বলেও মন্তব্য বিশ্লেষকদের। কারণ হত্যা, ধর্ষণ দেশে এখন এক বড় ধরনের মহামারীতে পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিদিনই কোথায়ও না কোথায় হত্যাকান্ড ঘটছে। আর ধর্ষণের ঘটনা এভাবে বেড়েছে যে মাঝে মধ্যে মনে হয় এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের প্রভাবে বাংলাদেশের পারিবারিক বন্ধনেও সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের বিপর্যয়। ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের অভিনয়শিল্পীর পরিধানের পোশাকের জন্য এ দেশের নারী, শিশু ও কিশোরীরাই নয় শুধু, বিবাহিত নারীরাও স্বামী পরিত্যাগ করার মতো অদ্ভুুত দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। গত ৮ জুলাই প্রকাশ্যে লোহার রড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে ১৩ বছরের শিশু সামিউল আলম রাজনকে। হত্যাকারীরা নিষ্পাপ ওই শিশুটিকে হত্যা করে উল্লাসও প্রকাশ করেছে। পরে পৈশাচিক এ হত্যাকান্ডের ঘটনার ভিডিওচিত্র প্রকাশের পর মর্মান্তিক এ দৃশ্য দেখে দেশবাসী হতবাক হয়েছে। অথচ পুলিশ ঘটনার দিনই বিষয়টির সম্পর্কে অবগত থাকলেও অপরাধীদের গ্রেফতারের চেষ্টা করেনি; বরং ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। পরে ঘটনাটি দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলে শেষ পর্যন্ত সিলেটের জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) আলমগীর হোসেনকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে এবং উপপরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম ও জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ধরনের একটি পৈশাচিক ঘটনার পর বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান প্রায় এক মাস পর গত ৪ আগস্ট মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে নীতিবাক্য শুনিয়ে এসেছেন। শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যাকান্ডের ঘটনা যখন দেশজুড়ে মানবিক আবেদন তুলেছে ঠিক তখনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিশু নির্যাতনের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ আগস্ট সোমবার খুলনায় পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করা হয়েছে রাকিবকে। মোটর গ্যারেজের শ্রমিক রাকিবের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাস জানিয়েছেন, রাতে স্থানীয় মিন্টুর গ্যারেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রাকিবকে ডেকে নেয় সে। এক পর্যায়ে শিশুটিকে বিবস্ত্র করে তার মলদ্বারে টায়ারে হাওয়া দেওয়ার পাইপ ঢুকিয়ে দিয়ে তার শরীরে হাওয়া ঢুকানো হয়। এতে রাকিবের পেটসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে ফেঁপে ওঠে। এই নির্যাতনে রাকিব অসুস্থ হয়ে পড়লে মিন্টু ও তার সহযোগী শরীফ পেটে চাপ দিয়ে বাতাস বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর তারা শিশুটিকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাকিবকে নেয়া হয় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে ঢাকায় নেয়ার জন্য অ্যাম্বুল্যান্সে তোলার পরপরই রাকিব মারা যায়।cs-kalid2 চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে ওসি সুকুমার জানিয়েছেন, রাকিবের শরীরের অস্বাভাবিক পরিমাণ হাওয়া প্রবেশ করানোর কারণে তার পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে গেছে, ফুসফুস ফেটে গেছে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ অকেজো হয়ে যাওয়ায় সে মারা যায়। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘কন্ট্রোল রিস্ক’ বাংলাদেশকে অপহরণের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রেখে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নিরাপত্তা, রাজনৈতিক ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং পরামর্শ দিয়ে আসা স্বাধীন সংস্থা ‘কন্ট্রোল রিস্ক’ ২০১৪ সালের অপহরণের ঘটনাগুলোর সংখ্যা বিচারে বাংলাদেশকে সপ্তম স্থানে রেখে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে মেক্সিকো। যুদ্ধপীড়িত ইরাক চতুর্থ এবং লিবিয়া ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে, সুদান রয়েছে নবম স্থানে। দক্ষিণ এশিয়ার ভারতকে দ্বিতীয় এবং পাকিস্তানকে তৃতীয় এবং আফগানিস্তানকে অষ্টম স্থানে রেখেছে ‘কন্ট্রোল রিস্ক’। তাদের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশে অপহরণের ঘটনাগুলোর মধ্যে ৮০ শতাংশ ঘটেছে অপরাধীদের দ্বারা এবং এসব অপহরণের মূল কারণ পণবন্দী করে মুক্তিপণ আদায়। আর ২০ শতাংশ অপহরণে জড়িত জঙ্গিরা। এই তালিকায় এই প্রথম বাংলাদেশ শীর্ষ ১০-এ এসেছে উল্লেখ করে ‘কন্ট্রোল রিস্ক’ নারায়ণগঞ্জে অপহরণ করে সাতজনকে হত্যার ঘটনাটিও তুলে ধরেছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখার পর ৩ আগস্ট সোমবার বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অপহরণের যতগুলো ঘটনা ঘটে, তার ৮৪ শতাংশই প্রেমঘটিত। ফলে অন্য সব দেশের অপহরণের ঘটনার সঙ্গে এর মিল নেই। অপহরণপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ ১০ নম্বরে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক একটি সংগঠনের তালিকায় দেখানোর প্রতিক্রিয়ায় ওই প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বের নবম জনবহুল বাংলাদেশে প্রেমঘটিত কারণে পালিয়ে গেলেও অপহরণ মামলা হয়। সাধারণত প্রেমিকের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা তাৎক্ষণিকভাবে হয়ে থাকে। পরে সেগুলো মিটমাটও হয়ে যায়। বাংলাদেশ পুলিশের দাবি, ‘কন্ট্রোল রিস্ক’র প্রতিবেদনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অন্য সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানের মিল নেই। লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সতর্ককারী সংস্থা ‘হেল্প বিল্ড পিস’ এবং ‘রেড টোয়েন্টিফোর’ প্রতিবেদনে অপহরণের অপরাধ সংঘটনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই। গত ৬ মার্চ অস্ট্রেলিয়া সরকার প্রণীত ‘কিডন্যাপিং থ্রেট ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের নাম নেই। তবে ‘নেশন মাস্টার’ নামে একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নাম ৩৩ নম্বরে রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। তবে বাংলাদেশ পুলিশের এ বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছেন আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) প্রধান সুলতানা কামাল। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে যারা অপহরণের শিকার হন, তাদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। ‘অপহরণের ঘটনার শতকরা ৮৪ ভাগই প্রেমঘটিত’ পুলিশের এমন দাবির প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক একটি প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সুলতানা কামাল গত ৪ আগস্ট মঙ্গলবার এমন দাবি করেন। একইসঙ্গে অপহরণ নিয়ে পুলিশের এ ধরনের বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন মানবাধিকার সংগঠন এবং সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, এর মাধ্যমে পুলিশ তার দায় ও ব্যর্থতা এড়ানোর চেষ্টা করছে। অপহরণ নিয়ে পুলিশ সদর দফতরের এ বক্তব্য প্রসঙ্গে আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) প্রধান সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেন্ডকে বলেন, ‘পুলিশের ভাষ্য যদি সত্য হয়, তাহলে বাংলাদেশের প্রায় সব অপহরণই মনে হচ্ছে প্রেমঘটিত। আর তাই যদি হতো তাহলে আমরা আশ্বস্ত হতে পারতাম। অপহরণকারীরা প্রেমিক হলে তা তো এত খারাপ হতে পারে না। কিন্তু আসলে কি তাই?’ তিনি বলেন, ‘পুলিশ সদর দফতরের এখন উচিত হবে তাদের বক্তব্যের সমর্থনে সঠিক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা। তাহলে আমরা তা অনুসন্ধান করে দেখতে পারবো। তা ছাড়া শতকরা হিসাব দিলেও বছরে মোট অপহরণের ঘটনা কতটি তা প্রকাশ করেনি পুলিশ সদর দফতর। সেটা প্রকাশ করলে ভয়াবহতা বোঝা যেত।’ সুলতানা কামাল জানান, ‘আসক’ অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে অপহরণের ঘটনা নিয়ে কাজ করছে। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, অপহরণের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও জড়িত। এমনকি তারা অপহরণ করে মুক্তিপণও আদায় করে বলে অভিযোগ আছে। তাই সুলতানা কামাল মনে করেন, ‘পুলিশ এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে দায় এবং ব্যর্থতা এড়ানোর চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে যারা অপহরণের শিকার হন, তাদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক নেতাকর্মী।’ আসক-এর হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশে অপহৃত বা গুম হয়েছেন মোট ৩৯ জন। এ ছাড়া পাঁচ বছরে অপহরণের সংখ্যা ৩০২, যার মধ্যে ২০১০ সালে ৪৬, ২০১১ সালে ৫৯, ২০১২ সালে ৫৬, ২০১৩ সালে ৬৮ এবং ২০১৪ সালে অপহরণের সংখ্যা ৭৩ জন। অন্য দিকে ধর্ষণের রাজ্যে পরিণত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৫ থেকে ৬ বছরের শিশুকন্যাও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। দুই মাস আগে ‘মাইক্রোবাসে গারো তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন যানবাহনে ধর্ষণের ঘটনা নিয়মিত হয়ে উঠেছে। চলন্ত বাসে বাসস্টাফরা যাত্রী ধর্ষণ করছে। ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাসে গর্ভবতী নারী শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন। জন্মদিন পালনের পর স্থানীয় বখাটেরা স্বামীকে পাশের ফ্ল্যাটে আবদ্ধ করে রেখে স্ত্রীকে রাতভর ধর্ষণ করার ঘটনা ঘটেছে কয়েক সপ্তাহ আগে। এমনকি ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ওই হাসপাতালেই ধর্ষণ করেছে এক আনসার সদস্য। এসব প্রতিদিনই ঘটছে। গত ৪ আগস্ট মঙ্গলবার রাজধানীতে ফের আদিবাসী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ভাটারা থানাধীন নয়ানগর এলাকায় চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া (১০) আদিবাসী এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে তারই পরিচিত আল আমিন (২২) নামে এক যুবক। মঙ্গলবার দুপুরের পর ওই ছাত্রীর মা ভাটারা থানায় মামলা দায়ের করলে বিষয়টি জানাজানি হয়। মামলা সূত্রে জানা যায়, সকাল ১০টার দিকে স্কুল যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু স্কুলের সময় শেষ হয়ে গেলেও বাসায় না ফেরায় খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। না পেয়ে হতাশ হয়ে সবাই বাসায় ফেরার পর বিকেল ৫টার দিকে সে বাসায় ফেরে। বাসায় ফেরার পর তার মা দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে, আল আমিন নামে এক পরিচিত যুবক তাকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে বলে জানায়। একই দিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে এক কলেজছাত্রী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যাত্রাবাড়ী থানার কাজলা এলাকায় ৪ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে এ ঘটনাটি ঘটেছে। ধর্ষিত কলেজছাত্রীর মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য রাতেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টফ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঠানো হয়েছে। গত ৩ আগস্ট সোমবার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে গাড়াদহ চরপাড়া গ্রামের এক প্রতিবন্ধী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। শাহজাদপুর বিসিক বাসস্ট্যান্ডের পাশের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে অটোরিকশা চালকের সহযোগিতায় তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সোমবার রাতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পরদিন মঙ্গলবার শাহজাদপুর থানায় একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। জানা গেছে, গত সোমবার সকালে নির্যাতিত প্রতিবন্ধী সিরাজগঞ্জ জেলা সদরের এডিডি কর্তৃক আয়োজিত এক সম্মেলনে যোগদান শেষে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরছিলেন। সন্ধ্যায় তালগাছি বাসস্ট্যান্ডে নামার পর বাজার করে অটোরিকশাযোগে বাড়ি যাচ্ছিলেন। এ সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। কিছুদুর যাওয়ার পর অটোরিকশায় থাকা যাত্রী ও চালক প্রতিবন্ধীর পরনের ওড়না দিয়ে অটোরিকশার মধ্যেই হাত ও মুখ বেঁধে ফেলে। এরপর তাকে শাহজাদপুর পৌর এলাকার বিসিক বাসস্ট্যান্ডের পাশের একটি পরিত্যক্ত ঘরে নিয়ে উপর্যুপরি দু’জনেই ধর্ষণ করে। পরে রাত ১০টার দিকে ওই প্রতিবন্ধীকে জুগ্নিদহ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সড়কে ফেলে পালিয়ে যায়। ধর্ষিতা প্রতিবন্ধী মুঠোফোনে বিষয়টি স্থানীয় উৎসব প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার সভাপতি জানে আলমকে জানানোর পর ঘটনাস্থল থেকে ধর্ষিতাকে উদ্ধার করা হয়। ধর্ষিতা জানান, ‘অটোরিকশার যাত্রী নিজেকে বাবু বলে পরিচয় দেয়। তারপর সে তার হাত মুখ বেঁধে গাড়িটি ঘুরিয়ে শাহজাদপুরের দিকে রওনা হয়। পরে একটি ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করে। তবে লোকটিকে দেখলে অবশ্যই চিনবো।’ সম্প্রতি শ্রীপুরে এক গার্মেন্টসকর্মী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। স্বামীর হুকুমে এক পোশাকশ্রমিক গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ধর্ষিতা জানান, সোমবার রাতে উপজেলার তেলিহাটী ইউনিয়নের ছাতির বাজার শিশুপল্লী এলাকায় তার অটোরিকশাচালক স্বামী তাকে ৮ যুবকের হাতে তুলে দেয়। তাদের ৬ জন তাকে হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ করে। গণধর্ষণের শিকার ওই নারী জানান, তার স্বামী টঙ্গী এলাকায় ভাড়া থেকে অটোরিকশা চালায়। আর তিনি এমসি বাজার এলাকার মুন্সী বাড়িতে ভাড়া থেকে পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। সোমবার সন্ধ্যায় তিনি খবর পান তার স্বামী অপরিচিত দুই মেয়েসহ কয়েকজন যুবককে নিয়ে ছাতির বাজার এলাকার দিকে যাচ্ছে। পরে তিনি স্বামীর সন্ধানে সেখানে রওনা দেন। শিশুপল্লী এলাকায় গিয়ে তিনি স্বামীর সাক্ষাৎ পেলে সেখানে দু’জনের বাগি¦তন্ডা ও ধস্তাধস্তি হয়। এ সময় তার স্বামী কৌশলে সটকে পড়ে। এ সময় রুবেল মিয়া নামে এক অটোরিকশা চালক ওই গার্মেন্টসকর্মীকে এমসি বাজার পৌঁছে দেয়ার কথা বলে একটি ব্রিজের কাছে নিয়ে যায়। পথে রুবেল বেশ কয়েকবার মোবাইল ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলে তাদের আসতে বলে। কিক্ষুক্ষণ পর ৮ যুবক ওই স্থানে উপস্থিত হয়ে ওই নারীর হাত ও পা বেঁধে ফেলে। ধর্ষিতা নারী জানান, তিনি রুবেলকে ধর্মের বাপ ডেকেও নিস্তার পাননি। উপরন্তু সে তার মোবাইল ফোন ও গলায় থাকা স্বর্ণের চেন ছিনিয়ে নেয়। ওই নারীর অভিযোগ, তার স্বামীই রুবেলকে তার পিছে লেলিয়ে দিয়েছিল। শ্রীপুর থানার এসআই গোলাম কিবরিয়া ও এসআই দেবাশীষ সাহা জানান, এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ফারুক হোসেন নামে আরও এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য দিকে রুবেল এ ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা আংশিক স্বীকার করেছে। এসব ঘটনায় ২০ দলের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে ধর্ষণ বন্ধে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হলেও ক্ষমতাসীন দল ও তার শরিকরা মৃদু প্রতিবাদও করছেন না। ধর্ষণ বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী গত ৫ আগস্ট বুধবার সারাদেশে একযোগে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। অথচ দেশের এতো বড় বিপর্যয়ের পরও ক্ষমতাসীনরা মুখ খুলছেন না। এ দিকে গত জুলাই মাসে সারাদেশে মোট ৩৬৮ জন নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৮৩টি। গত ৪ আগস্ট মঙ্গলবার পরিষদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, ওই মাসে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৫ জন। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯ জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৯ জনকে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ১০ জন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন একজন। সংস্থাটির লিগ্যাল এইড উপপরিষদে সংরক্ষিত ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানানো হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, জুলাই মাসে ৬২ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪১ জন নারী। তাদের মধ্যে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ১৯ জনকে। এসিডদগ্ধ হয়েছেন চারজন। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ছয়টি। পাচার হয়েছে চারজন নারী ও শিশু। এর মধ্যে যৌনপল্লীতে বিক্রি করা হয়েছে দু’জনকে। গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন চারজন। এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে দু’জনকে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওই সময়ের মধ্যে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ২৪ জনকে। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ২৬ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন এবং নয়জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে ৩০ জনকে। তা ছাড়া দেশে প্রতিদিনই খুনের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে ১৩ বছরের শিশু সামিউল আলম রাজন ও ১২ বছরের শিশু রাকিব হত্যাকান্ডে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। অপরাধীদের ধরে আইনের আওতায় আনতে ব্যর্থ হওয়ায় খুনের ঘটনা বাড়ছেই। দেশের বড় ধরনের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও এখনো গুম হচ্ছেন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর একই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দু’দিনের ব্যবধানে ২ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে র‌্যাব পরিচয়ে। এখনো তাদের কোনো হদিস মিলছে না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা তারেক সাঈদের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জে ঘটেছে ৭ খুনের ঘটনা। ৩ আগস্ট সোমবার রাতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার মাহমুদপুরে বোমা ফাটিয়ে বাস থামিয়ে গুলি করে ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার দু’দিন পার হওয়ার পরও গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত কী কারণে রোমহর্ষক হত্যাকান্ডটি ঘটল, তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি। ব্যস্ত সড়কে বাসযাত্রীদের সামনে গুলি করে হত্যার পর খুনিরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবারের সদস্য ও নুরুল ইসলামের ব্যবসায়িক সহকর্মীরা। এই চরম দুরবস্থা থেকে দেশবাসীকে মুক্তির জন্য আইনের শাসনের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার না থাকার কারণেই এ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। এর থেকে উত্তরণে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তারা। লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির