অনুবাদ : সাইফুল্লাহ বিন আহমাদ করীম
মসজিদে নববীর ইমাম ও খাতিব ফাদিলাতুশ শাইখ আবদুল মুহসিন মুহাম্মাদ আল কাসেম তাঁর জুম’আর খুতবায় বলেন, হে মুসলমানগণ! বান্দাহদের ওপর আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতের একটি হচ্ছে মাস ও বছরের আবর্তন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তিনি তোমাদের জন্য সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মিতভাবে নিয়োজিত করে দিয়েছেন, আর রাত্রি ও দিবসকে তোমাদের উপযোগী করে দিয়েছেন। আর যা তোমরা চেয়েছ তার প্রত্যেকটি বস্তু তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন, যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর তবে গুনে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয়ই মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী ও অকৃতজ্ঞ।” (সূরা ইবরাহিম : ৩৩-৩৪) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “দু’টি নেয়ামতের ব্যাপারে অনেক মানুষ ধোঁকায় নিপতিত, তা হচ্ছে সুস্থতা ও অবসর।”
এ কারণেই আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের অনেক জায়গায় সময়ের বিভিন্ন অংশের কসম বা শপথ করেছেন, যেমন রাত্রি, দিবস, ফজর, আসর ও পূর্বাহ্ন। আজ আমরা আমাদের জীবন থেকে একটি পরিপূর্ণ বছর বিদায় দিচ্ছি যাতে আমরা আমাদের আমলসমূহ সংরক্ষণ করেছি, যা হাশরের দিন আমাদের আমলে তুলে ধরা হবে। কতই না দ্রুত দিনগুলো কেটে গেছে, কত বন্ধু এতে আমরা হারিয়েছি, কত বিপদের এতে আমরা মুখোমুখি হয়েছি, কত পাপই না আমরা এতে করেছি। দিবা-রাত্রি আমাদের এসব আমলের সংরক্ষণস্থল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “সকল মানুষই সকালে উপনীত হয় নিজেকে বিক্রেতা হয়ে, হয়ত সে স্বীয় আত্মাকে আজাদকারী হয়, অথবা সে স্বীয় আত্মাকে ধ্বংসকারী হয়।” সময়ের অনেক দুঃখ-কষ্ট রয়েছে যা আনন্দ হিল্লোলে পরিবর্তন হয়ে যায়। পক্ষান্তরে অনেক আনন্দ রয়েছে যা হতাশায় পরিবর্তন হয়ে যায়। বুদ্ধিমান সে ব্যক্তি যে এ ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তিনি দিবা ও রাত্রিকে পরিবর্তন করেন, নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানবানদের জন্য শিক্ষা নিহিত।” (সূরা আন-নূর : ৪৮)
একটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, এতে যে আমল আল্লাহর বান্দাহরা করেছে তাই তাদের সামনে অচিরেই তুলে ধরা হবে। “সে দিন মানুষকে সে আগে পিছে যা করেছে তা সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হবে।” (সূরা আল-কিয়ামাহ : ১৩) সুতরাং এ দিনগুলোর আমলনামায় তুমি তোমার আখেরাতের জন্য কী সঞ্চয় করেছ? নিজেকে নির্জনে নিয়ে তা হিসাব কষে নাও।
মাইমুন ইবনে মাহরান (রা) বলেন, বান্দাহ মুত্তাকি হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে স্বীয় আত্মার সাথে নিজের পার্টনারের চেয়েও বেশি হিসাব না কষে। পথপ্রাপ্ত জ্ঞানবান সে ব্যক্তি যে নিজের আত্মার সাথে বোঝাপড়া করে নিজের আত্মার হিসাব গ্রহণ করে, দিনের কাজসমূহ রাতে এবং রাতের কাজসমূহ দিনে খতিয়ে দেখে এর মধ্যে যা প্রশংসনীয় উত্তম তা বাস্তবায়ন করে যা ঘৃণীত ও তিরস্কৃত তা পরিত্যাগ করে এবং ভবিষ্যতে তা না করার কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়।
আবু হাতেম ইবনে হিব্বান (রা) বলেন, বিবেকবানদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট সে, যে সর্বদা স্বীয় আত্মাকে সমালোচনা করে। মূলত আত্মসমালোচনার অনুপস্থিতি ব্যক্তিকে প্রবৃত্তির তাড়নায় ডুবে থাকার দিকে হাতছানি দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই তারা হিসাবের আশা করত না।” (সূরা আন-নাবা : ২৭)
স্বীয় দোষত্রুটি ও অবাঞ্ছিত কর্ম সম্পর্কে জানা মূলত বিভ্রান্তি হতে বাধা প্রদান করে থাকে। তাই বান্দাহ তার নিজের সম্পর্কে জানা, কবরের পরিণতি সম্পর্কে উপলব্ধি করা তার মাঝে আল্লাহর গোলামি ও তাঁর নিকট অবনমিত হওয়ায় বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে। এতে সে স্বীয় আমলের মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি লাভ করে না; তা যতই না বড় হোক, পাপকে তুচ্ছ মনে করে না; তা যতই না ছোট হোক। আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মানুষ আল্লাহর ব্যাপারে মানুষদেরকে অসন্তুষ্ট না করা পর্যন্ত সম্পূর্ণ দ্বীনের জ্ঞান লাভ করতে পারবে না, অতঃপর যখন সে স্বীয় আত্মার দিকে মনোনিবেশ করবে এতে সে তার প্রতি আরও কঠোরভাবে অসন্তুষ্ট হবে। সুতরাং যখন মানুষের সাথে বসবে তখন নিজেকে উপদেশ দাও যে, মানুষ তোমার বাহ্যিকে দিক লক্ষ্য করছে আর আল্লাহ তাআলা তোমার অভ্যন্তরীণ সব লক্ষ্য করছেন। যে তার গোপনীয় বিষয়কে আল্লাহর দৃষ্টি ও ইখলাসের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করে নেয়, আল্লাহ তার প্রকাশ্য বিষয়কে সফলতার মাধ্যমে সুশোভিত করে দেন।
আল্লাহর হক, তাঁর মহা অনুগ্রহ, অনুকম্পা ও অশেষ নেয়ামত সম্পর্কে জেনে তা স্মরণ করা মহিমান্বিত ক্ষমতাবান আল্লাহর জন্য মাথা অবনত করতে বাধ্য করে। আলেমগণ বলেছেন, আত্মসমালোচনার প্রথম হচ্ছে, তুমি আল্লাহর নেয়ামত এবং তোমার কৃত অপরাধের মাঝে তুলনা ও পরিমাপ করবে, তখন তোমার নিকট এ দু’য়ের মাঝে পার্থক্য প্রকৃষ্ট হয়ে উঠবে এবং তুমি উপলব্ধি করতে পারবে যে তাঁর ‘ক্ষমার ওয়াদা’ ছাড়া কিছুই তোমার জন্য নেই। অন্যথায় ধ্বংস ও অশুভ পরিণতি তোমার জন্য রয়েছে। আত্মার দোষত্রুটি সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া মূলত আত্মাকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করতে সহায়ক। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যে আত্মাকে পবিত্র করল সে সফল হল, যে তাকে কলুষিত করল সে ক্ষতিগ্রস্ত হলো।” (সূরা আশ্শামস : ১০)
মালেক ইবনে দিনার (রা) বলেন, আল্লাহ সে ব্যক্তির প্রতি দয়া করেন, যে স্বীয় আত্মাকে বলে তুমি কি এমন করনি? তুমি কি এমন করনি? অর্থাৎ, তাকে ভর্ৎসনা করে, অতঃপর তাকে তিরস্কার করে তার রবের কিতাব তার পরিচালনার জন্য বাধ্য করে দেয়, ফলে আল্লাহর কিতাবই তার পরিচালক হয়ে যায়। বান্দার জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর হচ্ছে স্বীয় আত্মার ব্যাপারে অবহেলা করা, আত্মসমালোচনা ত্যাগ করে প্রবৃত্তি তাড়িত কর্মের পেছনে আত্মাকে ছেড়ে দেয়া। আর ঐসব লোকদের অবস্থা যারা পাপ হতে নিজেদের চক্ষু বন্ধ করে রাখে আর ক্ষমা ও দয়া অনুকম্পার কথা বলে বেড়ায়; তারা যখন এসব করে তখন পাপকর্মের প্রতি তাদের অনুরাগ আরো প্রবল হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ বলেন, “হে মানুষ, কিসে তোমাকে তোমার মহিয়ান রবের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলেছে?” (সূরা আল-ইনফিতর : ৬)
হাসান বসরী (রহ) বলেন, মুমিনের একমাত্র উচিত হচ্ছে স্বীয় আত্মাকে তিরস্কার করা, এভাবে বলা যে, এ কথা দিয়ে আমি কি ইচ্ছা করেছি? এ খানা দিয়ে আমি কি চাই? আর পাপাচারী হচ্ছে সে, যে অনুতাপে সময় কাটায় অথচ স্বীয় আত্মাকে তিরস্কার করে না। মূলত মুমিন তার আত্মার ওপর ক্ষমতাবান, সে তাকে সদা সর্বদা হিসাব কষে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে, যখন শয়তানের কোনো দল তাদের স্পর্শ করে তখন তারা স্মরণ করে, আর তারা তো সুদৃষ্টিসম্পন্ন।” (সূরা আল-আ’রাফ : ২০১)
এ কারণে একদল লোকের ওপর হিসাব হালকা হবে; যারা দুনিয়াতে নিজেদের আত্মার হিসাব কষেছে। একদল লোকের ওপর এ হিসাব অত্যন্ত কঠিন হবে; যারা এ ব্যাপারে কোনো তোয়াক্কা করেনি। সুতরাং পাপে লিপ্ত হওয়ার থেকে সতর্ক থাক। জেনে রাখো, পাপকর্ম ত্যাগ করা তওবা বা ক্ষমা কামনার চেয়ে অনেক সহজতর। দিন তোমার জন্য চিরস্থায়ী হবে না, তুমি জান না কখন তুমি দুনিয়া হতে প্রস্থান করবে? সুতরাং স্বীয় আত্মাকে জিজ্ঞেস কর, গত বছরের জন্য তুমি কী পেশ করেছ? আগামী বছরের জন্য তুমি কী প্রস্তুত করেছ। উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “তোমরা তোমাদের আত্মার হিসাব নাও নিজেদের হিসাব দেয়ার পূর্বে, তাকে ওজন কর নিজেদের ওজন দেয়ার পূর্বে।” সুতরাং এ বছরের শুরুতেই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত মসজিদে জামাআতের সাথে আদায় করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হও। দ্বীনের জ্ঞান লাভ, তার প্রসার ও শিক্ষা দান এবং মিথ্যা, গিবত, পরচর্চা, অশ্লীল কথা হতে জিহ্বাকে হেফাজত করার মাধ্যমে নৈতিক পাথেয় সংগ্রহ কর। খাওয়া দাওয়া, হারাম পরিহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে সতর্কতা ও পরহেজগারি অবলম্বন কর, মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতি অনুরাগী হও। নিকটবর্তী ও দূরবর্তী সবার জন্য ন্যায় ও কল্যাণকর কাজ করতে সচেষ্ট হও, হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা হতে অন্তরকে পবিত্র রাখ।
মানুষের সম্মান হননের ক্ষেত্রে সতর্ক হও। “সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ”Ñএ নিদর্শন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা কর। সন্তান, স্ত্রীসহ সকলের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে ব্রত হও। রাস্তাঘাটে ও স্যাটেলাইট মিডিয়ায় হারাম বা নিষিদ্ধ দৃষ্টি থেকে নিজের চক্ষুকে অবনত রাখ। মনে রেখো, রাত্র-দিন দুনিয়া হতে দূরে সরে যাচ্ছে এবং আখেরাতের নিকটবর্তী হচ্ছে। সুতরাং সে বান্দার জন্য সুসংবাদ, যে নিজের জীবন থেকে উপকৃত হয়েছে এবং গত বছরের আত্মসমালো-চনার মাধ্যমে নতুন বছরকে গ্রহণ করেছে। প্রতিদিনের সূর্য অস্তমিত হয়ে তোমাকে তোমার জীবন কমে যাচ্ছে- এ সতর্ক সঙ্কেত দিচ্ছে। বিবেকবান সে, যে গত দিন থেকে উপদেশ নেয় এবং আজকের জন্য সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে, আগামীকালের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নেয়।
সুতরাং নিকটবর্তী সফরের জন্য রসদ প্রস্তুত কর। সর্র্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে যাতে আল্লাহভীতি রয়েছে তা, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদাবান সে ব্যক্তি যে তাঁকে (আল্লাহকে) সবচেয়ে বেশি ভয় করে। আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর, আগামী দিনের জন্য মানুষ কী পেশ করেছে সে যেন তা দেখে নেয়। আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমরা যা করছ তা সম্পর্কে সম্যক খবরদার।” (সূরা আল-হাশর : ১৮)
ওয়েবসাইট থেকে