নবীজির জন্ম মক্কায়। বনু হাশিম বংশে। বাবা আবদুল্লাহ ও মা আমেনা। সে দিনটি ছিল ৯ রবিউল আউয়াল, সোমবার। দিন ও রাতের মধ্যবর্তী সুবেহ সাদেকের সময়ে তার জন্ম। বিবি আমেনা তার পুত্রের জন্মের খবর প্রথম পাঠান নবীজির দাদা আবদুল মোত্তালিবের কাছে। আনন্দে উদ্বেলিত দাদা সাথে সাথে তাকে কোলে নিয়ে চলে যান কাবাঘরে। সেখানে সজলনয়নে তাকিয়ে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানান। এই নবজাতকের সার্বিক কল্যাণে সাহায্য চান মহান আল্লাহর কাছে। সেখানেই স্থির করেন, তার নাম হবে মুহাম্মাদ। নবী করীম সা.-এর জন্মের দুই মাস আগেই তার বাবা আবদুল্লাহ মারা যান। আবদুল মুত্তালিব তার সন্তান আবদুল্লাহকে ব্যবসায়ের জন্য শ্যাম দেশে পাঠিয়েছিলন। সেখান থেকে তিনি এক কুরাইশ কাফেলার সাথে মক্কা ফিরছিলেন। পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের কাফেলা মদিনায় থামে। সেখানেই আবদুল্লাহ মারা যান। সেখানে নাবেগা জাদির বাড়িতে তাঁকে দাফন করা হয়। মারা যাওয়ার সময় তিনি সহায়-সম্পদ হিসেবে ৫টি উট, একপাল ছাগল ও পরিচারিকা উম্মে আয়মানকে রেখে গিয়েছিলেন। জন্মের পর কিছুটা সময় শিশু মুহাম্মাদ মায়ের কাছেই ছিলেন। তখন মক্কাবাসীদের মাঝে একটি বিশেষ প্রথা চালু ছিল। মক্কাবাসীদের ধারণা ছিল- জনাকীর্ণ শহরের তুলনায় উন্মুক্ত গ্রামীণ পরিবেশে শিশুদের লালন-পালন করলে শিশুরা সুস্থ সবল হয়। রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকে। তাই তারা দুধপানে লালন-পালনের জন্য শিশুদের বেদুইন পরিবারের ধাত্রীদের কাছে দিয়ে দিতো। সে প্রথা অনুযায়ী দাদা আবদুল মোত্তালিব শিশু মুহাম্মাদকে হালিমা নামের এক ধাত্রীর কাছে দিয়ে দেন। বিবি হালিমা ও হারিস দম্পতির আরো কয়েকটি সস্তান ছিল। শিশু মুহাম্মাদ তাদের সাথে ভাই-বোনের মতো বেড়ে উঠতে লাগলেন। এই ধরনের শিশু পালনের মাধ্যমে বেদুইন ধাত্রীরা কিছু অর্থ পেতো। সেই সাথে কিছু উপহার সামগ্রী পাওয়া ছিল বাড়তি পাওনা। সে জন্য ধাত্রীরা লালন-পালনের জন্য ধনী পরিবারের শিশুদের সন্ধানে থাকত। সে সময়ে আরবভূমিতে দুর্ভিক্ষ চলছিল। ছিল খাবারের অভাব। বিবি হালিমা ও হারিস দম্পতি এক দুধের শিশুসহ তাদের সা’দ গোত্রের একদল মহিলার সাথে লালন-পালনের শিশুর সন্ধানে মক্কা যান। তিনি একটি মাদী গাধার পিঠে করে পথ চলছিলেন। তাদের সাথে একটি উটও ছিল। কিন্তু উটের ওলান থেকে এক ফোঁটা দুধও বের হচ্ছিল না। তার নিজের শিশুটির জন্য তার বুকের দুধ ছিল না। ক্ষুধায় শিশুটি ছটফট করছিল। এমনই অবস্থায় তারা পথ চলতে থাকেন। গাধাটিও ছিল বেশ দুর্বল। এটি ধীরে ধীরে চলতে লাগল। এতে কাফেলার অন্যরা বিরক্তি বোধ করছিল। এমনই এক অস্বস্তিকর অবস্থায় তারা মক্কায় গিয়ে পৌঁছেন। তাদের কাফেলার সব মহিলার কাছেই প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল শিশু মুহাম্মাদকে দুধপানের জন্য গ্রহণ করতে। কিন্তু পিতৃহীন এই এতিম শিশুকে নিতে এদের কেউই রাজি হয়নি। তাদের ভাবনা ছিল, এই শিশুর পরিবারের কাছ থেকে উত্তম বিনিময় পাওয়া যাবে না। এদিকে কাফেলার সব মহিলার শিশু সংগ্রহ হয়ে গেছে। কিন্তু হালিমা কোনো শিশু সংগ্রহ করতে পারছিলেন না। এ দিকে কাফেলা মক্কা থেকে ফিরে যেতে প্রস্তুত। হালিমা অনন্যোপায় হয়ে অবশেষে শিশু মুহাম্মাদকেই গ্রহণ করলেন। তাকে নিয়ে আস্তানায় ফিরলেন। শিশু মুহাম্মাদ তৃপ্তির সাথে হালিমার বুকের দুধ পান করেন। হালিমার নিজের সন্তানও তাই করে। দুধপান শেষে উভয় শিশু ঘুমিয়ে পড়ে। অন্যদিকে হালিমা উট দোহন করতে গিয়ে দেখেন ওলান দুধে পরিপূর্ণ। এই দম্পতি উটের দুধ তৃপ্তির সাথে পান করেন। আরামে তাদের রাত কাটে। তাদের কাফেলা মক্কা থেকে ফিরে আসার সময় হালিমা সওয়ার হলেন সেই দুর্বল গাধার ওপর। এবার দেখা গেল, এই দুর্বল গাধাই সবাইকে পেছনে ফেলে সবার আগে আগে চলছে। কাফেলার অন্য কোনো গাধাই এত দ্রুত চলতে পারছিল না। এসব দেখে হালিমা ও কাফেলার অন্য সবাই অবাক হচ্ছিল। রহস্যময় এই অবস্থায় হালিমা ও হারিস দম্পতি শিশু মুহাম্মাদকে নিয়ে নিজ বাড়ি পৌঁছেন। হালিমার কাছে শিশু মুহাম্মাদের দুই বছর কাটে। এই সময়ে এলাকার দুর্ভিক্ষাবস্থা কেটে যায়। পশুগুলো আগের চেয়ে বেশি খেতে পায়। উট ও ছাগল আগের চেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বেশি বেশি দুধ দিতে থাকে। হালিমার সংসারের অভাব অনটন দূর হয়। দুই বছর পর হালিমা শিশু মুহাম্মাদকে নিয়ে তার মায়ের কাছে যান। তিনি মা আমেনাকে জানান, আপনার সন্তানকে নেয়ার পর থেকে আমাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসে। হালিমা মা আমেনাকে অনুরোধ করে শিশু মুহাম্মাদকে আরো কিছুদিন তাদের কাছে রাখার জন্য আবার নিয়ে যান। শিশু মুহাম্মাদ হালিমার তত্ত্বাবধানে বনু সা’দ গোত্রের সাথে বসবাস করতে থাকেন। সম্ভবত তার জন্মের চতুর্থ অথবা পঞ্চম বছরে তার বক্ষ বিদারণের ঘটনাটি ঘটে। ঘটনাটি ছিল এমন। একদিন বালক নবী তার সাথীদের নিয়ে খেলাধুলা করছিলেন। এমন সময় জিবরাইল এলেন। এরপর তাকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে চিৎ করে শুইয়ে তার বুক থেকে হৃৎপিণ্ড বের করে আনেন। এ থেকে কিছুটা জমাটবাঁধা রক্ত বের করে নিয়ে বললেন: এটি হচ্ছে শয়তানের অংশ, যা তোমার মধ্যে ছিল। এটি ফেলে দেয়া হলো। হৃৎপিণ্ডের বাকি অংশ জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে যথাস্থানে রেখে জিবরাইল বুকের কাটা অংশ জোড়া দিয়ে দেন। এ সময় তার সাথীরা দৌড়ে গিয়ে হালিমাকে এ কথা জানায়। হালিমা ও হারিস সেখানে গিয়ে এ অবস্থায় তাকে বাড়ি নিয়ে এসে সেবাযত্ন করতে থাকেন। এ ঘটনায় ভীত হয়ে হালিমা বালক নবীকে তার মায়ের কাছে ফেরত দিতে নিয়ে যান। দুধমার ঘর থেকে সন্তান ফিরে আসার পর বিবি আমেনা পরিচারিকা উম্মে আয়মানকে নিয়ে ইয়াসরিব যান স্বামীর কবর জিয়ারতের জন্য। আবদুল মোত্তালিব তার ইয়াসরিব যাবার ব্যবস্থা করে দেন। মক্কা থেকে ৫০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে তারা মদিনায় পৌঁছেন। সেখানে এক মাস থাকার পর মক্কা ফিরে আসার জন্য রওনা হন। ফেরার সময় কমবেশি প্রায় মাঝপথে আসার পর বিবি আমিনা অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুখ আরো বেড়ে যায়। আবওয়া নামের এক স্থানে তিনি ইন্তেকাল করেন। বালক নবী এবার পুরোপুরি এতিম। এবার তিনি আশ্রয় পান বৃদ্ধ দাদা আবদুল মোত্তালিবের কাছে। আবদুল মোত্তালিব তাকে খুবই ¯েœহ করতেন। কাবাঘরের ছায়ায় আবদুল মোত্তালিবের জন্য বিশেষ একটি আসন ছিল। আসনটির পাশের আসনগুলোতে তার সন্তানেরা বসতেন। কিন্তু বালক নবী এখানে এলে মোত্তালিবের সেই বিশেষ আসনে বসতেন। তখন তার চাচারা তাকে সেই আসন থেকে নামিয়ে দিতেন। কিন্তু আবদুল মোত্তালিব তাদের বলেন, ‘ওকে তোমরা এ আসন থেকে নামিয়ে আনার চেষ্ট করো না। আল্লাহর শপথ, এ শিশুকে সাধারণ শিশু মনে হয় না। ও ভিন্ন ধরনের এক শিশু, অনন্য এক ব্যক্তিত্ব।’ এর পর তিনি তাকে নিজের কাছেই বসাতেন। তার গায়ে হাত বুলিয়ে সোহাগ করতেন। তার চাল-চলন ও কাজকর্মে আনন্দ প্রকাশ করতেন। কিন্তু সেই দাদার আদর খুব বেশি চলতে পারেনি। নবীজির বয়স যখন আট বছর দুই মাস দশ দিন, তখন দাদা ইন্তেকাল করেন। এবার তার লালন-পালনের দায়িত্ব পড়ল চাচা আবু তালিবের ওপর। আবদুল মোত্তালিব মৃত্যুর আগে সে ইচ্ছাই জানিয়ে গিয়েছিলেন। আবু তালিব বালক মুহাম্মাদকে নিজের সন্তানের চেয়ে আদর করতেন। সেই সাথে মোত্তালিবের মতো তাকে সম্মানও দেখাতেন। নবীর বয়স যখন বারো বছর দুই মাস দশ দিন, তখন তিনি চাচা আবু তালিবের সঙ্গে ব্যবসা উপলক্ষে শ্যাম দেশে যান। এই সফরের এক পর্যায়ে বসরায় পৌঁছেন। বসরায় জারজিস নামের এক খ্রিষ্টান ধর্মযাজক বাস করতেন। সাধারণত তিনি গির্জার বাইরে যেতেন না। কিন্তু তিনি নিজের ইচ্ছাতেই বসরায় মক্কাবাসীদের শিবিরে আসেন কাফেলার লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করতে। তিনি কিশোর নবীর অবয়ব, আচরণ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দেখে বুঝতে পারেন, ইনিই হচ্ছেন বিশ্ব জাহানের মুক্তির দিশারি আখেরি নবী। এর পর তিনি কিশোর নবীর হাত ধরে বলেন, ‘ইনিই হচ্ছেন, বিশ্ব জাহানের সর্দার।’ আবু তালিব তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী করে তা জানলেন? তিনি বললেন, ‘গিরিপথের ওই প্রান্ত থেকে তোমাদের আসা যখন ধীরে ধীরে আমার দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল, তখন আমি দেখলাম- প্রতিটি গাছ ও প্রস্তরখণ্ড তাকে সিজদা করছে। এগুলো নবী-রাসূল ছাড়া আর কাউকে সিজদা করে না। তা ছাড়া মোহরে নবুওত দেখেও আমি তাকে চিনতে পেরেছি। বাইবেল সূত্রে আমরা এসব জেনেছি। এর পর তিনি তাদের আতিথেয়তায় আপ্যায়ন করেন। অধিকন্তু, তিনি আবু তালিবকে বলেন, ‘এ শিশুকে নিয়ে শ্যাম দেশে যাবেন না। শিগগিরই একে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান। এর পরিচয় জানতে পারলে ইহুদি ও রোমীয়রা একে হত্যা করতে পারে।’ এ কথা জানার পর চাচা আবু তালিব কয়েকজন গোলামের সাথে বালক নবীকে দেশে পাঠিয়ে দেন। মোটামুটিভাবে এই ছিল নবীজির শৈশবকাল। এরপর শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে পদার্পণ করে তিনি নানা ধরনের প্রশংসনীয় কাজের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন