আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা সাইয়্যিদিল মুরসালিন ওয়া আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহি আজমাইন। মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে মানুষকে মহান আল্লাহর দিকে আহবান করেছেন। এ আহবানের পদ্ধতি সবসময় এক রকম ছিল না। মহান আল্লাহর নির্দেশের আলোকেই দ্বীনের দিকে আহবানের নানা পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। রাসূল সা.-এর ওপর আল কুরআন অবতীর্ণ হওয়া থেকে শুরু করে মক্কার তেরো বছরকে কয়েকটি অংশে ভাগ করা যায়। নবী করিম সা. মহান আল্লাহ প্রদত্ত এ কঠিন দায়িত্ব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালন করেছেন। এজন্য অসংখ্যবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন কিন্তু মহান আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব থেকে সামান্যতম পিছু হটেননি। গবেষণা ও অনুসন্ধানের পদ্ধতি অনুসরণ করে রাসূল সা.-এর ইসলাম প্রচার-প্রসার ও দ্বীনি আন্দোলনের তেরো বছরের এ সময়কে প্রধানত চারটি স্তরে ভাগ করা যায় । যেমন- (ওহারংরনষব উধধিয: ১-৩ বছর) নবুওয়াত প্রাপ্তির সূচনা থেকে শুরু করে নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষণা পর্যন্ত প্রায় তিন বছর। এ সময় গোপন দাওয়াত দেয়ার কাজ চলে। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদেরকে দাওয়াত দেয়া হয়। মক্কার সাধারণ লোকেরা এ সম্পর্কে তখনো কিছুই জানতো না। (ঙঢ়বহ উধধিয: ৪-৫ বছর) নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষণার পর থেকে জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন ও উৎপীড়নের সূচনাকাল পর্যন্ত প্রায় দু-বছর। এ সময় প্রথমে বিরোধিতা শুরু হয়। তারপর তা প্রতিরোধের রূপ নেয়। এরপর ঠাট্টা, বিদ্রƒপ, উপহাস, দোষারোপ, গালিগালাজ, মিথ্যা প্রচারণা এবং জোটবদ্ধভাবে বিরোধিতা করার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এমনকি শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতন শুরু হয়ে যায়। যারা তুলনামূলকভাবে বেশি গরিব, দুর্বল ও আত্মীয় বান্ধবহীন ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে তারাই হয় সর্বাধিক নির্যাতনের শিকার। (ঞযব নবমরহহরহম ড়ভ বীঃৎবসব ঢ়বৎংবপঁঃরড়হ: ৬-১০ বছর) চরম উৎপীড়নের সূচনা অর্থাৎ নবুওয়াতের পঞ্চম বছর থেকে নিয়ে আবু তালিব ও হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার ইন্তিকাল তথা দশম বছর পর্যন্ত পাঁচ বছর সময়কাল পর্যন্ত এ পর্যায়টি বিস্তৃত। এ সময়ে বিরোধিতা চরম আকার ধারণ করতে থাকে। মক্কার কাফেরদেরকে জুলুম-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক মুসলমান আবিসিনিয়া বা হাবশা বা ইথিওপিয়ায় হিজরত করে। নবী সা. তাঁর পরিবারবর্গ ও অবশিষ্ট মুসলমানদেরকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কট করা হয়। রাসূল সা. তাঁর সমর্থক ও সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে আবু তালিব গিরিবর্তে অবরুদ্ধ হন। (ঞযব সড়ংঃ ফরভভরপঁষঃ ধহফ ফধহমবৎড়ঁং ঃরসব : ১১-১৩ বছর) নবুওয়াতের দশম বছর থেকে ত্রয়োদশ বছর পর্যন্ত প্রায় তিন বছর। এটি ছিল নবী সা. ও তাঁর সাথীদের জন্য সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক সময়। তাঁর জন্য মক্কায় জীবন যাপন করা কঠিন করে দেয়া হয়েছিল। তায়েফে গেলেন। সেখানেও আশ্রয় পেলেন না। হজের সময়ে আরবের প্রতিটি গোত্রকে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ ও তাঁকে সাহায্য করার আবেদন জানালেন। কিন্তু কোথাও সাড়া পেলেন না। এদিকে মক্কাবাসীরা তাঁকে হত্যা করার, বন্দী করার বা নগর থেকে বিতাড়িত করার জন্য সলা-পরামর্শ করেই চলছিল। অবশেষে আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আনসারদের হৃদয় দুয়ার ইসলামের জন্য খুলে গেলো। তাদের আহবানে তিনি মদিনায় হিজরত করলেন।১ মক্কায় দ্বীনের দাওয়াতের এ তেরো বছরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন ড. রউফ শালবী। তিনি বলেছেন- অর্থাৎ মাক্কি জীবনে দাওয়াতের যে পর্যায় পাওয়া যায়, তা হচ্ছে- দাওয়াতের গোপন পর্যায় দাওয়াতের প্রকাশ্য পর্যায়২
মক্কার জীবনে দাওয়াতি কাজের স্তরবিন্যাসের ব্যাপারে আল্লামা সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহ.) বলেন: মক্কার জীবনের সময়কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- গোপন দাওয়াত : প্রথম বছর থেকে তৃতীয় বছর; প্রকাশ্য দাওয়াত : চতুর্থ বছর থেকে দশম বছর; মক্কার বাইরে দাওয়াত: দশম বছরের শেষ থেকে মদিনায় হিজরত পর্যন্ত।৩
মক্কার জীবনের তেরো বছরের দাওয়াতি কাজের এ বিন্যাস জানতে হবে বহুবিদ কারণে। কেননা বর্তমানে অনেক মানুষ দাওয়াতি কাজ করে খুব দ্রুত ফলাফল পাওয়ার আশা করেন। তাদের এ প্রত্যাশা আসলে কী যৌক্তিক? না। কারণ রাসূল সা.-এর মত সর্বদিক থেকে সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠ মানুষ নিজে এবং সরাসরি মহান আল্লাহর গাইডলাইন পেয়ে সুদীর্ঘ তেরো বছর মানুষের দ্বারে দ্বারে দ্বীনের আলো বহন করেছেন। তিনি দীর্ঘ তেরো বছর চেষ্টা করে মদিনায় হিজরতের পূর্বে মাত্র একশত পঞ্চাশ জনের মতো মানুষকে তাঁর সাথে পেয়েছিলেন। ভাবনার বিষয় হচ্ছে স্বয়ং রাসূল সা. যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং মহান আল্লাহ সরাসরি কালামে হাকিম অবতীর্ণ করে নির্দেশনা দিয়েছেন। তথাপি তেরো বছরে মাত্র একশত পঞ্চাশ জন ব্যক্তিকে দ্বীনের পথে আহবান করতে সক্ষম হলেন। ভাবা যায়! তাহলে যা করতে হবে- ক. দাওয়াতের মাধ্যমে কতজন দ্বীন কবুল কলল বা না করলো তা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা না করা, খ. দ্বীনের পথে মানুষের আসার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করা যাবে না, গ. ঐ সংগঠন এত দিন প্রতিষ্ঠা হয়েছে কিন্তু পাওয়ারে যেতে পারছে না, সুতরাং এটা পরিবর্তন করে ঐ দল খুব আধুনিক কাজ করে সেদিকে চলে যেতে হবে, এ ধরনের মনোভাব পোষণ না করা, ঘ. সর্বোচ্চ ইখলাস সহকারে ধৈর্য ধরে মহান আল্লাহর পথে মানুষকে আহবান করতে হবে, কতজন কবুল করলেন, কবে কে রাষ্ট্রীয় পর্যায় যাবে তা নিয়ে চিন্তা করা দায়ীদের কর্মের মধ্যে পড়ে না, ঙ. যেহেতু ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার কোনো দিন বা বছর বেঁধে দেওয়া হয়নি, সেজন্য দ্বীনের আহবানে সবসময় নিজকে সম্পৃক্ত রাখা, চ. দায়ীর জীবদ্দশায় ইসলামকে যদি কাক্সিক্ষত স্থানে দেখতে না পান, তবে মন খারাপ করার কিছু নেই। তিনি মহান আল্লাহর নিকট থেকে জাজা পাবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কোনোভাবেই দ্বীনের দাওয়াতের অংশ মনে করে কোনো মানুষকে কষ্ট দেওয়া বা ক্ষতি করা ইসলাম কখনই সমর্থন করে না। এ বিষয়টি খুব ভালো করে ধারণ করা।
মাক্কি জীবনে গোপন সময়ে রাসূল সা.-এর দাওয়াতি কর্মকৌশল ও আজকের প্রেক্ষাপট গোপনে দাওয়াত প্রদানের সময়টি আল কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। রাসূল সা.কে মহান আল্লাহ বলেন: কাজেই হে নবী! তোমাকে যে বিষয়ের হুকুম দেয়া হচ্ছে তা সরবে প্রকাশ্যে ঘোষণা করো এবং শিরককারীদের মোটেই পরোয়া করো না। মহান আল্লাহর এ কথায় গোপন সময়ের দাওয়াতি কাজের বেড়া ভেঙে প্রকাশ্যে আসার আহবান করা হচ্ছে। আবু যার রা. ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসূল সা. তাকে বললেন: আবু জার ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি গোপন রাখো, তোমার দেশে ফিরে যাও, যখন আমাদের প্রকাশ হওয়ার খবর তোমার নিকট পৌঁছাবে তখন চলে এসো।৪
গোপনে দাওয়াত প্রদানের সময় তৎকালীন পরিবেশ মহান আল্লাহ যখন আদেশ করলেন ‘হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী, ওঠো এবং সাবধান করে দাও (সূরা মুদ্দাসসির : ১-২) তখনও দাওয়াত প্রকশ্যে শুরু হয়নি বরং গোপনেই চলছিল। গোপন দাওয়াতের সময়েই কিছু সাহাবী ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় লাভ করে ধন্য হয়েছিলেন। সে সময় নির্দিষ্ট কোনো বাসা বা স্থান ছিল না। অর্থাৎ দারুল আরকাম নির্ধারিত হওয়ার আগে বিক্ষিপ্ত ভাবে গোপনে দাওয়াতের কাজ চলছিল। এ ব্যাপারে ইবন সাদ (১৬৮-২৩০ হি./ ৭৮৪-৮৪৫ খ্রি.) বলেন: ‘দারুল আরকামে প্রবেশের আগেই একদল মানুষ ইসলাম কবুল করেছিল।’৫ যখন ইসলামে আগমন করা নতুন মানুষেরা কাফির মুশরিকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আযাব ও শাস্তির মুখোমুখি হলেন তখন রাসূল সা. তাদেরকে রক্ষা করার জন্য আলাদা গোপন বাসা নেয়ার মনস্থ করলেন। বিশেষত দু’টি ঘটনার কারণে- ক. ইবন ইসহাক (৮০-১৫১ হি. /৬৯৯- ৭৬৯ খ্রি.) বলেন: যখন কোনো সাহাবী সালাত আদায়ের ইচ্ছা করতেন তখন কোনো এক গিরিপথে বা প্রাচীরঘেরা স্থানে গোপনে সালাত আদায় করতেন যাতে মুশরিকরা দেখতে না পায়। একদিন সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাস এবং কিছু সাহাবী মক্কার এক প্রাচীরে সালাত আদায় করছিলেন। এমতাবস্থায় মুশরিকদের একটা দল জানতে পারলো যে তারা সালাত আদায় করছে। সাহাবাগণ যা করছিলেন তা অস্বীকার করলেন, মুশরিকরা সাহাবীদের ভর্ৎসনা করল, নিন্দা করল এবং একপর্যায়ে তাদেরকে হত্যা করল। তখন সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাস তাদের একজনকে উটের দড়ি এবং মাথা দ্বারা আঘাত করলেন তারপর সে মারা গেল, এটাই দ্বীনর জন্য প্রথম রক্ত।৬ খ. আহমাদ বিন ইয়াহইয়া বিন জাবির বিন দাউদ আল বালাজুরী (মৃ. ২৭৯ হি./৮৯২ খ্রি.) বলেন: মক্কার একটি গিরিতে দুজন ব্যক্তি সালাত আদায় করছিলেন, তখন মুশরিকদের দুজন ব্যক্তি আক্রমণ করলো। তারা বাদানুবাদ করলো অনেক সময় ধরে পাথর নিক্ষেপ করলো এবং চলে গেলো।৭ এ দুটি ঘটনার পর ইসলামে নতুন প্রবেশকারীদের ওপর এবং দাওয়াতি কাজের ওপর বেশ প্রভাব পড়ল। এ জন্য নবী করিম সা. অনুসারীদের গোপনে কাজ করলে বললেন যতদিন না এ অবস্থার উত্তরণ ঘটে। সে জন্য নাবী সা. এবং সাহাবাগণ আগে ইসলাম কবুলকারী সাহাবী আল আরকাম ইবন আবুল আরকামের বাসাকে দাওয়াতি কাজের গোপন কার্যালয় হিসেবে নির্ধারণ করেন।
দারুল আরকামকে বেছে নেয়ার হিকমা কী রাসূল সা.-এর প্রতিটা কাজ বুদ্ধিমত্তা ও হিকমতে পরিপূর্ণ। তিনি অপ্রকাশ্যভাবে দাওয়াতি কাজের জন্য কেন দারুল আরকামকে বেছে নিলেন তার কিছু বিশেষ কারণ রয়েছে। যেমন- সাহাবী আরকামের ইসলাম কবুল করার খবর কেউ জানত না, সেজন্য আরকামের বাসায় রাসূল সা.-এর সাথে মিলিত হতে কারো মনে কোনো বিপদের আশঙ্কা থাকতো না। সাহাবী আরকাম রা. বনি মাখজুমের অধিবাসী যারা সবসময় বানু হাশিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও শত্রুতার পতাকা বহন করত, সুতরাং মুশরিকরা কোনোভাবেই মনে করতো না যে মুহাম্মদ সা. ও তাঁর সাথীরা সেখানে মিলিত হতে পারে। আরকাম রা. সতেরো বছরের যুবক, যদিও কাফির মুশরিকরা রাসূল সা.-এর একত্রিত হওয়ার স্থান সম্পর্কে চিন্তা করত তবে কখনও তাদের মাথায় এ রকম অল্প বয়সী সাহাবীর কথা মনে আসতো না বরং বড়দের বাসার কথাই মনে পড়ত এবং খোঁজ করত অথবা রাসূল সা. যে বাড়িতে থাকেন সেটাই তালাশ করত। রাসূল সা.-এর এ কৌশলে অত্যন্ত সফলভাবে দাওয়াতি কাজ অব্যাহত থাকে এবং এ কথা শোনা যায়নি যে, কুরাইশরা কখনও ঐ মারকাজে আক্রমণ করেছে অথবা কখনও সে স্থান খুঁজে পেয়েছে।৮
দারুল আরকামে যে সকল কাজ করা হতো যারা রাসূল সা.-এর আহবানে সাড়া দিয়েছে দারুল আরকামে বসে আরো ভালো করে দ্বীনের দিকে আহবান করা হতো। আর ইসলামের প্রতি যে সব মানুষের আগ্রহ ছিল তাদেরকে সরাসরি দাওয়াত প্রদান করা। ইবনে সা‘দ তার তাবাকাত-এর মধ্যে উসমান ইবনুল আরকাম এর সনদে বর্ণনা করেন: মক্কার সাফার নিকটে আল আরকামের বাসা ছিল। ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় রাসূল সা. সেখানে ছিলেন, সেখানেই মানুষদের ইসলামের পথে আহবান করেছেন এবং অনেক গোত্র ইসলাম কবুল করেছে।৯
দাওয়াতি কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করা দারুল আরকামে রাসূল সা.-এর বিশেষ কাজ ছিল দাওয়াতি ময়দান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। কোন পদ্ধতিতে দাওয়াত ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে গবেষণা করা। দ্বীন কিভাবে শক্তিশালী হবে সে ব্যাপারে চিন্তা করা। আর যারা ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে তাদের রক্ষা করা পরিকল্পনা করা। এ কাজের অংশ হিসেবে এবং দ্বীনকে শক্তিশালী করার জন্য রাসূল সা. দোয়া করতেন। যেমন: ‘আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: হে আল্লাহ তুমি বিশেষ করে উমার ইবনুল খাত্তাবকে দিয়ে ইসলামকে সাহায্য কর।’১০ এ দোয়াটি অন্যভাবেও এসেছে। যেমন- ইবন উমার রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: হে আল্লাহ আবু জাহল অথবা উমার ইবুল খাত্তাব দুই ব্যক্তির মাঝে যাকে ভালোবাস তার দ্বারা ইসলামকে সাহায্য কর। রাবী বললেন: দুজনের মাঝে উমারই বেশি পছেেন্দর।১১ বর্ণিত আছে রাসূল সা. এ দোয়া করেছিলেন বুধবারে এবং উমার ইবুল খাত্তাব ইসলাম কবুল করেন বৃহস্পতিবার।১২ দাওয়াত প্রাপ্তদেরকে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করে দেওয়া দারুল আরকামের বিশেষ কাজ ছিল নবী করিম সা. মহান আল্লাহর সাথে ইসলাম গ্রহণকারীদের সম্পর্ক সুদৃঢ় করার জন্যে খুব ইতমিনানের সাথে সালাত আদায়ের ব্যবস্থা করতেন।
গোপন দাওয়াতের স্তরে দাওয়াতের বিষয়বস্তু নবী করিম সা. নবুওয়াতের প্রথম তিন বছরে অর্থাৎ গোপন দাওয়াতের স্তরে যে সকল বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দাওয়াত দিতেন তা তিন প্রকার। সে ব্যাপারে হাদিসে এসেছে: ‘আমর ইবন আল আবাসা হতে বর্ণিত তিনি বলেন, (যখন রাসূল সা.কে জিজ্ঞাসা করা হলো কিসের জন্য আপনাকে প্রেরণ করা হয়েছে?) রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন আমাকে পাঠানো হয়েছে ১. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে; ২. মূর্তি ধ্বংস করতে ৩. আল্লাহকে এক বলে মানতে ও তার সাথে কাউকে শরিক না করতে।১৩
এ হাদিসের আলোকে জানা যায় গোপন দাওয়াতের সময় রাসূল সা.-এর মূল কাজ ছিল তিনটি- তাওহিদ বা মহান আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত। অর্থাৎ নবী করিম সা.-এর দাওয়াতের মূলমন্ত্রই ছিল মহান আল্লাহকে একক সত্তা বলে মেনে নেয়া এবং একমাত্র তারই ইবাদত করা। আল কুরআনে সূরা যারিয়াতের ৫৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে। রাসূল সা. যখন আলী রা.কে দাওয়াত দিয়েছিলেন তখন বলেছিলেন: ‘আমি তোমাকে একক আল্লাহ ও তাঁর ইবাদতের দিকে আহবান করছি এবং লাত ও উজ্জাকে অস্বীকার করতে আহবান করছি’।১৪ ইবাদত (সালাত আদায়)। প্রথমদিকে যে হুকুম অবতীর্ণ হয়েছে সেটা সালাত আদায়। তবে সেটার ধরন কেমন ছিল কত ওয়াক্ত ছিল তা নিয়ে কিছু কথা আছে। যেমন ইবন হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন: মি’রাজের পূর্বে রাসূল সা. এবং সাহাবাগণ অবশ্যই সালাত আদায় করতেন। তবে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের আগে আর কোন সালাত ফরজ ছিল? বলা হয়: হ্যাঁ, তখন সূর্য ওঠার আগে এবং সূর্যাস্তের পর সালাত আদায় করা ফরজ ছিল। আরেক দল বলেন, মিরাজের আগে সালাত ফরজ ছিল না তবে রাতে সালাত ছিল তবে কোনো নিয়ম বা নির্ধারিত কিছু ছিল না। পরিশেষে ইবন হাজার আসকালানি বলেন: বিভিন্ন দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে এটা প্রমাণ হয় যে, মিরাজের রাতেই সালাত ফরজ হয়েছে এবং রাসূল সা. ও খাদিজা রা. গোপনে সালাত আদায় করেছেন।১৫ ইবনে হিশাম বলেন: যখন সালাতের সময় হতো তখন নবী সা. ও সাহাবাগণ কোনো এক গুহায় চলে যেতেন, যাতে তাদের জাতির লোকেরা দেখতে না পায়। রাসূল সা. ও আলী রা.-এর সালাত আদায়ের সময় চাচা আবু তালিব পাহারা দিতেন।১৬ এ ব্যাপারে সাইদ বিন যাইদ বলেন: আমরা এক বছর গোপনে ইসলাম পালন করেছি। আমরা বদ্ধঘরে ছাড়া নামাজ পড়িনি। (দারুল আরকামের দিকে ইঙ্গিত করে) অথবা খালি কোনো উপত্যকায় একে অপরকে পাহারায় রেখে নামায পড়েছি।১৭ আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা : সাহাবী আরকাম রা.-এর বাড়িতে যখন থাকতেন তখন মহান আল্লাহর প্রতি আস্থা বিশ^াস স্থাপন করা এবং মানুষকে দ্বীনের দিকে আহবান করাই কাজ ছিল। এর পাশাপাশি আরেকটি মৌলিক কাজ ছিল আত্ময়তার সম্পর্ক রক্ষা করা। উন্নত চরিত্র গঠন : নবী করিম সা. অত্যন্ত উন্নত চরিত্রের মানুষ ছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁকে আল কুরআনে সে কথা ঘোষণা করেছেন। আর রাসূল সা. নিজেই বলেছেন ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দেওয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি’।১৮ বায়তুল আরকামে নবী করিম সা. উন্নত চরিত্র গঠনের জন্য খুব গুরুত্ব আরোপ করতেন।
এ ছাড়াও দারুল আরকামে থাকা অবস্থায় আরও যে সকল ব্যাপারে নবী করিম সা. সাহাবাদের শিক্ষা প্রদান করেছেন তা হচ্ছে- আল কুরআন যতটুকু অবতীর্ণ হতো সে আলোকে তাদের চরিত্র, মন-মানস গঠন। এবং একমাত্র আল কুরআনুল কারিমের পঠন-পাঠন চর্চা এবং সে আলোকে জীবন গঠনই ছিল একমাত্র কাজ। আর এর মাধ্যমে রাসূল সা. গড়ে তুলেছিলেন ক. এমন এক প্রজন্ম যার দৃষ্টান্ত পৃথিবী কখনও দেখেনি আর ভবিষ্যতেও দেখবে না। খ. গড়েছিলেন এমন এক জাতি যারা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। গ. যারা প্রতিষ্ঠা করেছে ন্যায়, ইনসাফ ও শান্তির সমাজ ঘ. যাদের অন্তর এবং জ্ঞানগত পরিচর্যা হয়েছে অতি উত্তম রূপে, ঙ. তাদের মাঝে তৈরি হয়েছে মহান আল্লাহর একত্ববাদের ওপর আস্থা , বিশ^াস ও শ্রদ্ধা এবং তার ওপরে ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে উন্নত চরিত্র, চ. সর্বোপরি এমন একটা দল যারা সমগ্র মানুষের মাঝে এবং সমগ্র ক্ষেত্রে বিশ^াসে, আধ্যাত্মিকতায়, চরিত্রে, সামাজিকতায়, রাজনীতিতে এবং যুদ্ধ-বিগ্রহে সর্বাধিক পারদর্শী।১৯
আল কুরআনের আলোকে আকিদার ভিত বিনির্মাণ তখন যা অবতীর্ণ হতো সে সব মজবুতভাবে মুখস্থ করা, সে আলোকে নিজকে এবং ইসলামে প্রবেশকারীদের গঠন করা।
আমাদের কর্মকৌশল ও করণীয় নবী করিম সা.-এর মাক্কি জীবনের গোপন সময়ে দাওয়াতি কাজের ধরন চিন্তা করলে বর্তমান যুগে যে সকল কাজ করা অত্যাবশ্যক হয় তা হচ্ছে- - নিজ পরিবারের মানুষ, বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনদের কাছে টার্গেট করে দাওয়াত প্রদান। - যিনি দাওয়াত প্রদান করবেন, তিনি সমাজের সামনে নিজকে মৌলিক মানবীয় গুণের অনুশীলনকারী হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা। - নিজ পরিবারকে দাওয়াতের মূল ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা । - আল কুরআন ও আল হাদিসের মূল বক্তব্য ধারণ করা ও তা মানুষের কাছে পৌঁছানো। - আত্মীয়-স্বজনের সাথে সর্বোচ্চ সদাচরণ করা এবং তাদের কাছে দ্বীনের আহবান পৌঁছানো - দ্বীনের দাওয়াত যার কাছে দেওয়া হচ্ছে তার জন্য খুব দোয়া করা। - তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের সঠিক ধারণা হৃদয়ে গেঁথে দেয়া। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
তথ্যসূত্র :
১. ০১ থেকে ০৪ নং পয়েন্টগুলো মক্কায় দাওয়াতি জীবনের সময়কে যে ভাগ করা হয়েছে তা মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ‘লা মওদুদী (রহ.) রচিত তাফহীমুল কুরআনের সুরা আল আন’আম এর ভূমিকা থেকে নেয়া হয়েছে। ২. ড. রউফ শালবী, আদ দাওয়াতুল ইসলামিয়্যা ফি আহদিহা আল মাক্কি (কুয়েত : দার-আল কলাম), মুদ্রণ ১, পৃ. ২৯৮। ৩. সফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতুম (কায়রো: মাকতাবাতুল ঈমান, ১৯৯৩ খ্রি.), মুদ্রণ ১, পৃ ৬৯। ৪. সহিহ আল বুখারি, কিতাব আল মানাকিব, বাব: কিসসাতু জমজম, হাদিস নং ৩৫২২। ৫. আলী বিন বুরহান উদ্দীন আল হালবী, আস সিরাহ আল হালবিয়্যাহ ফী নিরাতিল আমিন আল মামুন (বৈরুত: দার আল জাবাল, ১৪১২ হি.), মুদ্রণ ১, খ ১, পৃ. ৪৫৬। ৬. আলী বিন বুরহান উদ্দীন আল হালবী, আস সিরাহ আল হালবিয়্যাহ ফি নিরাতিল আমিন আল মামুন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৬। ৭. ড. আলী বিন আহমাদ আল আহমাদ, দাওয়াতুন নাবী ফি মারহালাতিল ইসতিখফা ফিল ‘আহদিল মাক্কি, মাজাল্লাতুর বুহুস আল ইসলামিয়্যা, পৃ. ২৭৩ ৮. ড. আলী মুহাম্মদ আস সাল্লাবী, আস সিরাহ আন নাবাবিয়্যাহ ‘আরদ ওয়াকায়ি‘ তাহলীল ওয়া আহদাস, পৃ. ৮১। ৯. ইবন সা‘দ, ত্ববতকাত আল কুবরা (বৈরুত : দারু সদর), মুদ্রণ ১, খ ৩, পৃ.২৪৩। ১০. ইবনু মাজা, ‘উমার ইবনুল খাত্তাব এর মর্যাদা অধ্যায়, হাদিস নং : ১০২ ১১. জামিআত তিরমিজি, হাদিস নং: ৩৭৬৪। ১২. ইমাম ইবনু তাইম্যিাহ, আল জাওয়াব আস সাহীহ (রিয়াদ: দারুল আসিমাহ, ১৪১৪ হি.), মুদ্রণ ১, খ ৬, পৃ. ৩১২। ১৩. সহিহ মুসলিম, অধ্যায় সালাতুল মুসাফিরীনা ওয়া কাসরিহা, বাব ইসলামু আমর ইব আবাসা, হাদিস নং: ৮৩২। ১৪. সিরাতে ইবনে ইসহাক, খ ২, পৃ. ১৮। ১৫. সিরাতে ইবন ইসহাক , খ ২, পৃ. ১১৭ ১৬. ড. আলী বিন আহমাদ আল আহমাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮৩। ১৭. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮৩ ১৮. ইমাম আহমাদ ১৯. ড. আলী মুহাম্মদ আস সাল্লাবী ‘আস সিরাহ আন নাবাবিয়্যাহ’ পৃ. ৮১।
আপনার মন্তব্য লিখুন