মো: জিয়াউল হক
নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় গঠিত হয় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতি। পুরুষের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে এবং নারীকে অবহেলিত করে আদর্শ সমাজ গঠিত হতে পারে না। পুরুষের ভূমিকার পাশাপাশি নারীরও সমৃদ্ধ দেশ এবং সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়েছে। পৃথিবীতে একমাত্র ধর্ম আল ইসলাম যা নারীকে মর্যাদার শীর্ষাসনে সমাসীন করেছে। ইসলাম-পূর্ব যুগে নারীকে সবচেয়ে অবহেলা করা হতো এবং কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ অপমানের কারণ মনে করে জীবন্ত প্রোথিত করা হতো।১ তাদেরকে ভোগের পণ্য মনে করে সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো। অতঃপর ইসলাম নারীকে এ দুরবস্থা থেকে উত্তরণ করে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ইসলাম নারী-পুরুষের অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা আনয়ন করেছে। যেমন আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ২২৮ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন, “নারীর জন্য সমতার ভিত্তিতে ঠিক সেই ধরনের অধিকারসমূহ রয়েছে তাদের ওপরে উপরন্তু পুরুষের জন্য রয়েছে তাদের ওপরে দায়িত্বের একটি ঊর্ধ্বতন পর্যায়। সর্বোপরি আল্লাহ মহাশক্তিমান ও প্রজ্ঞাময়।”২ উক্ত আয়াতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, পুরুষ ও নারীর পরস্পরের উপরে অধিকারসমূহ সমান্তরাল। কুরআন ও হাদিসের অন্য কোন স্থানে এর ব্যতিক্রম কিছু বলা হয়নি। তবে এই আয়াতে আরও একটি কথা বলা হয়েছে, নারীর ওপরে পুরুষের এক ধরনের প্রাধান্য রয়েছে। ইহা আরও স্পষ্টভাবে বুঝার জন্য কুরআনুল কারিমের সূরা আন নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “পুরুষ-নারীদের ওপর কর্তৃত্বশীল। তা এই কারণে যে আল্লাহ তাদের একজনকে অন্যজনের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন এবং আরও একটি কারণ যে পুরুষ তার জন্য সম্পদ ব্যয় করে।”৩ আয়াতে স্পষ্টভাবে এ দু’টি কথা বলা হয়েছে। যেহেতু নারী আপাদমস্তক কোমলমতি সেহেতু আল্লাহ নিজেই নারীর জন্য পুরুষকে রক্ষক ঘোষণা করেছেন। দ্বিতীয়ত, নারীর যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব পুরুষকে দিয়েছেন। এছাড়া সামগ্রিকভাবে আল্লাহতায়ালা নারী-পুরুষের অধিকার সমান ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সকল ক্ষেত্রে একই সমান নয় কোন কোন ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে পুরুষকে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের চেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে উভয়ের অধিকার সমান সমান বলা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমানে কিছু জ্ঞানপাপী বু্িদ্ধজীবী ও পশ্চিমা মদদপুষ্ট প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ভারতীয় পদলেহী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নারীকে সমান অধিকারর নামে তাদের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করছে। একদিকে ইসলাম তাদেরকে ঠকিয়েছে বলছে এবং পুরুষকে নারীর সহযোগী মনে না করে প্রতিযোগী হিসেবে দাঁড় করিয়ে বিদ্বেষভাবাপন্ন করছে। এতে পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মহাবিপর্যয় ঘটছে। আবার উত্তরাধিকার বা মিরাসি আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে সরাসরি কুরআনবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে যা প্রত্যেকটি নর-নারীর জন্য অমঙ্গলজনক। তাই কুরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলামে নারীর অধিকার বা সমানাধিকার সংক্রান্ত আলোচনা করা হলো।
১. নারীর অধিকার কী?
আমাদের মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে জেনে নেয়া দরকার যে নারী অধিকার কী? ঙীভড়ৎফ উরপঃরড়হধৎু অনুযায়ী নারী অধিকার বা ডড়সবহং জরমযঃং অর্থ হলো সেই সমস্ত অধিকার যা-নারীকে আইনগত ও সামাজিক অবস্থান আদায় করে দেয় যেগুলো পুরুষ ভোগ করছে এবং তাতে পুরুষের অধিকার রয়েছে।
গড়ফবৎহরুব ঙীভড়ৎফ উরপঃরড়হধৎু অনুযায়ী ইহার অর্থ নতুন করে তৈরি করা, নতুন অবস্থার প্রেক্ষিতে ঢেলে সাজানো বা যুগের চাহিদা মতো গড়ে তোলা। ওয়েবস্টার ডিকশনারি অনুযায়ী এর অর্থ দাঁড়ায়- নবায়ন করা যা একটি নতুন কাঠামো দেয়া বা আকার আকৃতি, অবয়ব দেয়া। তাহলে আমরা এ কথা বলতে পারি যে, পুরুষেরা যে সমস্ত অধিকার ভোগ করে নারীদেরকেও অনুরূপ সুযোগ সুবিধা দেয়াকে নারী অধিকার বলে। ইসলাম নারী-পুরুষের অধিকারসমূহ সমান্তরালভাবে দিয়েছে। ইহা সমান বটে কিন্তু একই রকম নয়। ইসলামী শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। আমাদের বোঝার সহজের জন্য নারী অধিকারসমূহকে ৭টি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন -
১. ধর্মীয় অধিকার
২. সামাজিক অধিকার
৩. অর্থনৈতিক অধিকার
৪. শিক্ষার অধিকার
৫. আইনগত অধিকার
৬. রাজনৈতিক অধিকার
৭. উত্তরাধিকার বা মিরাসি অধিকার।
১. ধর্মীয় অধিকার
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বোঝা যায় যে, ইসলাম নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নির্ধারণ করেছে। ইবাদত-বন্দেগি, নামাজ, রোজা, হজ, যাকত, জিকির-আযকার, দান-খয়রাত সকল ক্ষেত্রে সমান ঘোষণা করেছে। যেমন আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবের ৩৫ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন, “নিঃসন্দেহে যে সমস্ত পুরুষ ও নারীগণ আল্লাহতে আত্মসমর্পণকারী নিশ্চিত বিশ্বাস ও দৃঢ় আস্থা স্থাপনকারী, আন্তরিক ও বিনয়ের সাথে আদেশ পালনকারী সত্যবাদী ও সত্যবাদিনী ধৈর্যশীল ও ধৈর্যশীলা আল্লাহর ভয়ে ভীত ও ভীতা দানকারী ও দানকারিনী রোজা পালনকারী ও কারিনী, লজ্জাস্থান-সমূহের হেফাজতকারী ও হেফাজতকারিনী, আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণকারী ও স্মরণকারিনী আল্লাহ তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন ক্ষমা ও সুমহান পুরস্কার।”৪ আলোচ্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা নারী ও পুরুষের ইবাদতের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি। উভয়ের জন্যই সমান পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। অথচ আধুনিক সভ্যতার দাবিদার পশ্চিমারা বলে থাকে যে জান্নাত শুধু মাত্র পুরুষের জন্য নারীদের কোন স্থান নেই। তারা এই বলে নারী জাতিকে হেয় করে। অথচ আল্লাহতায়ালা সূরা নিসার ১২৪ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন, “যে ব্যক্তি কোন ভালো কাজ করবে পুরুষ হোক বা নারী হোক সে যদি ঈমানদার হয় অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে এতে বিন্দুমাত্র বঞ্চিত করা হবে না।”৫ এখানে আল্লাহতায়ালা নারী ও পুরুষের আমলের এবং পুরস্কারের মধ্যে কমবেশি না করে সমান বলেছেন।
অনুরূপভাবে সূরা আন-নাহলের ৯৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, “ভালো কাজ যেই করবে সে পুরুষ হোক অথবা নারী হোক যদি সে ঈমানদার হয় তাহলে তাকে আমি পৃথিবীতে পবিত্র পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করার এবং পরকালে তাদেরকে উত্তম থেকে উত্তমতম কর্মের ফলাফল অনুযায়ী প্রতিদান বা পুরস্কার প্রদান করব।”৬
এ আয়াতের আল্লাহতায়ালা নারী ও পুরুষের জন্য জান্নাত লাভের ক্ষেত্রে জেন্ডার বা লিঙ্গের কোন শর্তারোপ করেননি বরং তিনি কর্মের কথা বলে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ করেছেন।
২. নারীর সামাজিক অধিকার
ইসলাম নারীকে যে সামাজিক মর্যাদা দিয়েছে তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সামাজিক ক্ষেত্রে নারীদেরকে ইসলাম শুধু পুরুষের সমান অধিকারই দেয়নি বরং অনেক অনেক বেশি অধিকার দিয়েছে। আলোচনা সহজভাবে বোঝার জন্য নারীর সামাজিক অবস্থানকে ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে :
ক. কন্যা হিসেবে মর্যাদা
খ. স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা
গ. মা হিসেবে মর্যাদা
ঘ. বোন হিসেবে মর্যাদা
ক. কন্যা হিসেবে মর্যাদা
ইসলাম কন্যাসন্তানের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। কন্যাসন্তানের অধিকারের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় তার জীবনের নিরাপত্তা। জাহেলি যুগে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ নিজের এবং বংশের জন্য লজ্জাজনক বিষয় ছিল। তাই তারা তাদেরকে জীবন্ত কবর দিয়ে হত্যা করত। আর ইসলাম এক্ষেত্রে ফুলের মত নিষ্পাপ কন্যাসন্তানকে আদরের সাথে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।
সন্তান পুত্র হোক বা কন্যা হোক উভয়ের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে এবং তাদেরকে হত্যা করা হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে সূরা আত-তাকবিরের ৮-৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করা হয়েছে, “আর যখন জীবন্ত কবর দেয়া কন্যাসন্তানকে জিজ্ঞাসা করা হবে তাকে কী অপরাধে হত্যা করা হয়েছিল।”৭ এ ছাড়া ধনী ও গরিব সকলকে উদ্দেশ করে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা আনআম ১৫১ ও সূরা বনি ইসরাইলের ৩১ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেছেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না দরিদ্রতার ভয়ে। কেননা আমি তোমাদেরকে এবং তাদেরকে রিজিক দিয়ে থাকি।”৮ ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিয়ে নিজেদেরকে গর্বিত মনে করত। জাহিলিয়াত এখনও নির্মূল হয়নি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঈড়সঢ়ঁঃবৎ-এর মাধ্যমে গর্ভে ভ্রƒণ সনাক্ত করে কন্যাসন্তান হলে তাকে পৃথিবীতে আগমনের পূর্বেই মাতৃগর্ভে হত্যা করা হয়। ইইঈ এর রিপোর্টার ঊসু ইবশবহবহ ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে “খবঃ যবৎ উরব” বা ওকে মরতে দাও নামের পরিসংখ্যান রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতেই প্রতি বছর প্রায় দশ লাখ কন্যাকে নারী হওয়ার অপরাধে হত্যা করা হয়। তামিল নাড়– ও রাজস্থানের মত রাজ্যগুলোতে বিলবোর্ড এবং পোস্টার ছাপিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হয় যে পাঁচশ টাকা খরচ করুন ৫ লাখ টাকা সেভ করুন। অর্থাৎ ৫০০ টাকা দিয়ে ঈড়সঢ়ঁঃবৎ করে গর্ভের সন্তান কন্যা হলে তাকে হত্যা করে লালন পালনের ব্যয়ভার বাবদ ৫ লক্ষ টাকা বাঁচান। এ হলো ভারতের কন্যা সন্তানের অবস্থা। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে ভারতের এজেন্ডায় আমাদের দেশে নারীনীতির নামে নারীদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার লক্ষ্যে কুরআনবিরোধী নারীনীতি বাস্তবায়নের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ইহার কিছু প্রভাব দেখা যায়। কন্যাসন্তান জন্মের সংবাদ শুনলে চাঁদের ন্যায় চেহারা মলিন হয়ে যায়। যেমন আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা নাহলের ৫৮-৫৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “যখন তাদেরকে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণের খবর দেয়া হয় তখন তাদের চেহারা কালিমা লেপে যায় এবং তখন সে যেন রক্ত বমনের ঢোক গিলতে থাকে। মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায় এই জন্য যে এ কুৎসিত সংবাদের পর সে মুখ দেখাবে কী করে এবং ভাবতে থাকে এই অপমান সহ্য করে কন্যাসন্তানটিকে রেখে দেবে না মাটিতে পুঁতে হত্যা করবে।”৯ উক্ত আয়াত থেকে বোঝা যায় ইসলাম শুধু কন্যাসন্তান হত্যা হারামই করেনি বরং পুত্রসন্তান হলে আনন্দ অনুষ্ঠান আর কন্যা সন্তান হলে মুখ কালো হওয়াকে ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে। উপরন্তু ইসলাম কন্যাসন্তানকে উত্তমভাবে লালন পালনের জন্য নির্দেশ দিয়েছে। মুসনাদে আহমদ এ-বর্র্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তির দু’টি কন্যাসন্তান জন্মলাভ করবে আর তাকে ভালোভাবে লালন পালন করবে সে ও আমি জান্নাতে এমনভাবে পাশাপাশি অবস্থান করব।”১০ এ বলে নিজের হাতের দু’টি আঙুল একত্রিত করে দেখান। এ হাদিস থেকে বোঝা যায় যে কন্যাসন্তান হলে তার পিতা, মহানবী (সা) এর সাথে জান্নাতে পাশাপাশি থাকবে।১১ পুত্রসন্তান হলে এমন নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কন্যাসন্তান পুত্র অপেক্ষা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
খ. স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা
ইসলাম নারীর অপমান ও লাঞ্ছনার অতল গহ্বর থেকে উত্তরণ করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে। ইসলাম-পূর্ব অন্যান্য ধর্মের লোকেরা নারীকে শয়তানের গুটি বা হাতের পুতুল মনে করত। অর্থাৎ তারা ধারণা করত শয়তান যত অপকর্ম করে থাকে সব নারীর মাধ্যমে। আর ইসলাম নারীকে মর্যাদা দিয়েছে মহীয়সী হিসেবে। এবং নারী-পুরুষের চরিত্রের জন্য ঢালস্বরূপ। সহীহ আল বুখারীতে বর্ণিত আছে নবী করিম (সা) বলেছেন, “মুসলমানদের মধ্যে যারা বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে।”১২ তাহলে তার জন্য নিজের দৃষ্টির সংরক্ষণ এবং চরিত্রের পবিত্রতা বজায় রাখা সহজ হবে। নারীর মর্যাদা দিতে গিয়ে রাসূল (সা) আরও বলেছেন, হাদিসটি হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেছেন, “যে বিবাহ করল সে দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করলো”১৩এবং অন্য হাদিসে পুরুষের চরিত্র সংরক্ষণকারী বলা হয়েছে। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে এমনটি বলা হয়নি।
পবিত্র কুরআনে সূরা নিসার ১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা নারীদেরকে কল্যাণের প্রতীক ঘোষণা করে বলেন, “তোমরা তাদের সাথে সুন্দর জীবন যাপন করো। যদি তোমরা তাদেরকে অপছন্দ করো তাহলে এমনও তো হতে পারে যে তোমরা তো একটি জিনিস অপছন্দ করছো কিন্তু তার মধ্যে আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখে দিয়েছেন।”১৪ ইসলামে নারীর অবস্থা দাসী বা গৃহপরিচারিকা নয় বরং স্বামী-স্ত্রীর সমপর্যায়ের মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “তারা তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরা তাদের জন্য পোশাক।”১৫ (সূরা বাকারা ১৮৭) পোশাক যেমন মানুষের সতর আবৃত করে এবং সৌন্দর্য বর্ধন করে তেমনি নারী-পুরুষ একে অপরের জন্য যাবতীয় দোষ-ক্রটি আবৃতকারী এবং প্রশান্তিদানকারী। ইসলাম নারী ও পুরুষের সামাজিক মর্যাদার মধ্যে কোনই পার্থক্য করেনি। শুধুমাত্র নেতৃত্ব ছাড়া আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “নারীদের জন্যও সঙ্গত অধিকারসমূহ রয়েছে যেমন অধিকারসমূহ রয়েছে তাদের ওপর পুরুষের।”১৬ তাহলে এখানে আমরা দেখতে পাই স্ত্রী হিসেবে নারীকে সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
গ. মা হিসেবে মর্যাদা
ইসলাম নারীকে অতুলনীয় মর্যাদা দিয়েছে মা হিসেবে, যা ইতঃপূর্বে কেহ দেয়নি। আল্লাহতায়ালার পরেই মাতা-পিতার প্রতি সম্মান ও সম্মানজনক আচরণ করতে নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, “তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ করবে। তোমাদের মাঝে যদি তাদের মধ্য থেকে দু’জন অথবা একজন জীবিত থাকেন,, বার্ধক্যাবস্থায় তাহলে তাদের সাথে এমন আচরণ করবে না যাতে তারা ‘উফ’ শব্দ উচ্চারণ করে এবং মুখ বাঁকিয়ে বা কর্কশভাবে কথা বলবে না বরং তাদের সাথে কথা বলবে বিনয় নম্র ভদ্রভাবে ও কোমল সূরে এবং তাদের সামনে গর্বের সাথে বা উভয় বাহু বা বুক উঁচু করে কথা বলবে না। আল্লাহর কাছে দোয়া করবে এই বলে হে পরম করুণাময় তুমি তাঁদের প্রতি দয়া কর সেভাবে ঠিক যেভাবে তারা শিশুকালে আমাদের প্রতি দয়া- মায়া, স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে লালন পালন করেছিলেন।”১৭ (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪)
ইসলাম মানুষকে এমন শিক্ষা দিয়েছে যে মাতা-পিতার সাথে মন্দ আচরণ তো করা যাবেই না উপরন্তু তারা মনে কষ্ট পাবে এমন বৈধ কাজও করা যাবে না। তাদের সামনে কথা বলতে হলে বিনয়ের সাথে সম্মানের সাথে এবং মমতামাখা কণ্ঠে কথা বলতে হবে। অত্র আয়াতে আল্লাহতায়ালা মাতা-পিতার সম্মান ও মর্যাদার কথা বলেছেন। কিন্তু অন্যান্য আয়াত ও হাদিসে পিতার তিন গুণ মাতার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “আমি তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছি পিতা-মাতার অধিকারগুলো আদায় করতে। তবে তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে পেটে ধারণ করেছে। আরো দুই বছর তার দুধ ছাড়াতে সময় লেগেছে। আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো।”১৮ (সূরা লোকমান-১৪)
অনুরূপভাবে আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি যে, “সে তার পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ করবে, তার মা অনেক কষ্ট সহ্য করে তাকে পেটে ধারণ করেছিল। আর অনেক ব্যথা সহ্য করে তাকে প্রসব করেছিল এবং তাকে গর্ভে ধারণ ও দুধ ছাড়াতে ত্রিশটি মাস সময় লেগেছে।”১৯ (সূরা আহকাফ : ১৫)
মুসনাদে আহমদ ও ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণিত আছে, “জান্নাত রয়েছে মায়ের পদ তলে”২০এই হাদিসের অর্থ এই নয় যে পথচলার সময় পায়ের নিচে যা পড়বে তাই জান্নাতে পরিণত হয়ে যাবে বরং এর মানে আপনার ওপর অর্পিত সকল দায় দায়িত্ব পালন করলে এবং মাতা-পিতা সন্তুষ্ট থাকে এমন আচরণ, কথা ও কাজ করলে আল্লাহ তাকে অবশ্যই জান্নাত দিয়ে দেবেন।
সহীহ আল-বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট জানতে চাইলো আমার ওপরে সবচাইতে বেশি অধিকার কার রয়েছে। উত্তরে রাসূল (সা) বললেন, তোমার মায়ের। সে আবার জিজ্ঞাসা করল তার পর। উত্তরে রাসূল (সা) বললেন, তোমার মায়ের। লোকটি তৃতীয়বার জিজ্ঞাসা করল তার পরে। জবাবে রাসূল (সা) বলেন, তোমার মায়ের। অতঃপর যখন চতুর্থবার জিজ্ঞেস করল। তার পর রাসূল (সা) জবাব দিলেন, তোমার পিতার।২১ এ হাদিসের আলোকে শতকরা ২৫ ভাগ অধিকার দেয়া হয়েছে পিতাকে আর ৭৫ ভাগ অধিকার দেয়া হয়েছে মাতাকে। যা এভাবেও বলা যায় যে ৪ ভাগের ৩ ভাগ অধিকার মায়ের আর ১ ভাগ অধিকার পিতার। কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এ ক্ষেত্রে নারী পুরুষের চেয়ে ৭৫ ভাগ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
ঘ. বোন হিসেবে অধিকার
ইসলাম নারীকে চতুর্থ ধাপে যে মর্যাদা দিয়েছে তা বোন হিসেবে। জাহেলি যুগে কোন নারীকে তার ভাই-বোন হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করত। আর ইসলাম সে অপমানের পিরামিড ভেঙে চুরমার করে ভাই ও বোন পরস্পরের সহযোগী বলে ঘোষণা করেছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “মুমিন পুরুষ ও মুমিনা নারী এরা পরস্পর সহযোগী বন্ধু বা আউলিয়া”২২ আরবি আউলিয়া শব্দের অর্থ সহযোগী বন্ধু বা অভিভাবক। মুমিন নর-নারীগণ পরস্পর ভাই বোন। যদি তাদের মাঝে অন্য কোন সম্পর্ক না থাকে। ইসলাম নারীকে সামাজিকভাবে এত অধিক মর্যাদা দিয়েছে যা পুরুষের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি।
৩. নারীর অর্থনৈতিক অধিকার
ইসলাম নারীদেরকে অর্থনৈতিক দিকে পরিপূর্ণভাবে সমতার ভিত্তিতে নয় বরং পুরুষের চেয়ে নারীকে এক ধাপ এগিয়ে অধিকার দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারার ১৮৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “আমি ব্যবসাকে হালাল করেছি এবং সুদকে হারাম করেছি।”২৩ উক্ত আয়াতে ব্যবসা হালাল হওয়া এবং সুদ হারাম হওয়া সমভাবে প্রযোজ্য। একজন পুরুষ হালাল পন্থায় যে সমস্ত ব্যবসা করতে পারবে। নারীও সে ধরনের ব্যবসা করতে পারবে। পুরুষের ন্যায় নারী জমি ক্রয় বিক্রয় ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ি-গাড়ি সকল কিছু তৈরি করতে পারবে। সে বিবাহিতা হোক অথবা অবিবাহিতা হোক সে তার সম্পদের ক্ষেত্রে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী। সে কোন বিধিনিষেধ ছাড়াই ধন সম্পদের ব্যাপারে সব ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। যা একজন পুরুষের জন্য প্রযোজ্য। কুরআন ও হাদিসের কোন স্থানে নারীর কাজ কর্মের ব্যাপারে কোন বাধা নিষেধ আরোপ করেনি। শুধুমাত্র দু’টি বিষয়ের প্রতি সঙ্গত কারণে নির্দেশ দিয়েছে। শর্ত দু’টি হলো প্রথমত, ব্যবসা হতে হবে হালাল পদ্ধতিতে এবং শরিয়ত নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে। দ্বিতীয়ত, হিজাব যা পর্দা মেইনটেইন করতে হবে। ইসলাম নারীদেরকে সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী এমন ব্যবসা বা পেশায় নিয়োজিত হতে নিষেধ করেছে। যেমন মডেলিং অভিনয়। এ ছাড়া শরিয়ত অনুমোদিত সকল ব্যবসা বা কাজ করার অনুমতি দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম নারীকে সম্পদ অর্জনের সুযোগ দিয়েছে এবং মালিকানাও তাকেই দিয়েছে কিন্তু তার ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব দিয়েছে পুরুষের ওপর। বিবাহের আগে নারীর ব্যয়ভার পিতার ওপরে বিয়ের পরে স্বামীর ওপরে আর স্বামীর অবর্তমানে ছেলে বা ভাইয়ের ওপরে। তদুপরি নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য মোহরের ব্যবস্থা করেছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “নারীদের মহরানা অবশ্য কর্তব্য হিসেবে আন্তরিক সন্তুষ্টির সাথে আদায় কর। তবে সে যদি খুশি মনে কোন কিছু অংশ তোমাকে ক্ষমা করে দেয়। তাহলে তুমি তা আনন্দের সাথে ভোগ করো।”২ (সূরা আন নিসা-৪) নারী যদি তার অর্থ দিয়ে ব্যবসা করে টাকার কুমিরও হয় তবুও তার ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর বর্তায়। তাহলে বোঝা যায় যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী পুরুষের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। যেমন একজন লোক একটি পুত্র ও একটি কন্যা রেখে মারা গেল তার সম্পদ অবশিষ্ট ছিল ১,৫০,০০০ টাকা, তাহলে শরিয়াহ মোতাবেক পুত্র পায় ১ লক্ষ আর কন্যা পায় ৫০,০০০ টাকা। ইসলাম পিতা ও স্বামীর অবর্তমানে নারীর ব্যয়ভারের দায়িত্ব দিয়েছে ভাইয়ের ওপর। এবার ভাইয়ের অভিভাবক হিসেবে বোনের বিবাহ দিতে ব্যয় হলো ৫০,০০০ টাকা। তাহলে নিট হিসাব দাঁড়ালো ভাইয়ে রইল ৫০,০০০ আর বোনের অংশ হলো ১ লক্ষ টাকা। তাহলে দেখা যায় অথনৈতিক ক্ষেত্রে বোন ভাইয়ের চেয়ে অধিক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এ থেকে বোঝা গেল যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী পুরুষের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে
৪. নারীর শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকার
ইসলাম নারী শিক্ষার প্রতি সমধিক গুরুত্বারোপ করেছে। আরবিতে একটা প্রবাদ আছে যে, জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যেতে হলে যাও। তারও আগে আল্লাহতায়ালা বলেছেন “পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাটবাঁধা রক্ত হতে। পড় তোমার রব মহোত্তম। যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে এমন কিছু যা সে জানতো না।”২৫ (সূরা আলাক ১-৫ )
উক্ত আয়াতে আল্লাহতায়ালা নারী- পুরুষ সবাইকে সমানভাবে শিক্ষার কথা নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশ সে সময়ের যখন নারী শিক্ষার কোন ধারণাও ছিল না। রাসূল (সা) এর সময়কালে উম্মুল মুমেনিন হযরত আয়শা (রা) ছিলেন সবচেয়ে বড় পণ্ডিত। বহু সাহাবী এবং বিখ্যাত তাবেয়িগণ তাঁর নিকট থেকে হাদিস, ফিকাহসহ বিভিন্ন জ্ঞান লাভ করেছে। তিনি ২২১০টি হাদিস বর্ণনা করেছেন।২৬ তাঁর সম্পর্কে হযরত আবু মূসা আশয়ারী (রা) যিনি নিজে জালিলুল কদর সাহাবী ছিলেন। তিনি বলেন, যখন আমরা সবাই মিলে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারতাম না তখন হযরত আয়শা (রা)-এর নিকট শরণাপন্ন হলে তার সঠিক জবাব পেয়ে যেতাম। তিনি ৭৭ জন সাহাবীর উস্তাদ ছিলেন। তা ছাড়া উম্মুল মুমেনীন হযরত সালমাও ছিলেন সমসাময়িক কালের শ্রেষ্ঠ আলেম। ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী বলেন, তিনি ৩২ জন সাহাবীর উস্তাদ ছিলেন।২৭ হযরত ফাতিমা বিনতে কায়েস উম্মুদ দারদা, হযরত আনাস (রা)-এর মাতা উম্মে ছালিমও অনেক বড় মাপের ইসলামী স্কলার ছিলেন। এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। উক্ত বিষয়গুলো সেই সময়ের যখন নারীকে মানুষ মনে করত ঘরের ব্যবহার্য আসবাবপত্র আর শিশুকন্যাকে জীবন্ত প্রোথিত করা হতো। অন্ধকার অমানিশার বুক চিরে ইসলামের সোনালি সূর্যোদয় পুরুষের ন্যায় নারীকেও দিয়েছে জ্ঞানের আলোকচ্ছাঁ, এতে উদ্ভাসিত হয়েছে মহীয়সী নারীরা। এখান থেকে বোঝা যায় ইসলাম নারীকে ঠকায়নি বরং দিয়েছে সমঅধিকার।
৫. আইনগত অধিকার
ইসলামী শরিয়তের মতে নারী- পুরুষ এক সমান। ইহা নারী ও পুরুষের জান, মাল ও ইজ্জতের অধিকার সমানভবে দিয়ে থাকে। ফলে আইনের অধিকারও একই রূপ। ইজ্জতের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নারী-পুরুষ সকলের জন্য ইসলামী আইন সমান। যেমন কোন পুরুষ কোন নারীকে হত্যা করলে ইসলামের যে বিধান অনুরূপ কোন নারী কোন পুরুষকে হত্যা করলেও একই বিধান। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ তোমাদের জন্য মাসয়ালাগুলোতে কিসাসের বিধান লিখে দেয়া হলো। অনুরূপ দাসের বিনিময় দাস, নারীর পরিবর্তে নারী।”২৮ (সূরা বাকারা : ১৭৮)
ইসলামী বিধিবিধানে শারীরিক ক্ষতির শাস্তি পুরুষ ও নারী নির্বিশেষে সম্পূর্ণ সমান। একই সূরা মায়েদার ৩৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন “চোর পুরুষ হোক বা মহিলা হোক যখন চুরি করবে তখন তোমরা হাত কেটে দেবে।”২৯ অনুরূপভাবে সূরা নূরের ২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “ব্যাভিচারী পুরুষ ব্যাভিচারী নারী যেই হোক তাকে একশটি বেত্রাঘাত কর।”৩০ ইসলাম শারীরিক শাস্তির বিধান পুরুষ ও নারীর জন্য সমান করে দিয়েছে। তবে মহিলাদের চরিত্রকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন রাখার লক্ষ্যে ইসলাম যুগান্তকারী বিধান কায়েম করেছে। যা পুরুষের জন্য করা হয়নি। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, “যারা পবিত্র চরিত্রের নারীদের প্রতি অপবাদ দেবে তাদেরকে প্রমাণের জন্য ৪ জন সাক্ষী উপস্থিত করতে হবে। যদি তারা তা না করে তাহলে ৮০টি বেত্রাঘাত করো এবং ভবিষ্যতে তাদের কোন সাক্ষীই গ্রহণ করা হবে না।”৩১ (সূরা আন নূর : ৪) সাধারণ ক্রাইমের শাস্তির জন্য সাক্ষী ২ জন আর বড় কোন অপরাধের শাস্তির জন্য সাক্ষী ৪ জন বাধ্যতামূলক। অনুরূপ নারীদের চরিত্রের ব্যাপারে অপবাদের জন্য ৪ জন সাক্ষী হাজির করতে বলা হয়েছে। তাহলে এক্ষেত্রে প্রমাণিত হয় যে, নারী ও পুরুষ সমান আইনের অধিকারী হলেও এ ক্ষেত্রে নারী পুরুষের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
৬. রাজনৈতিক অধিকার
ইসলাম নারীদেরকে অন্যান্য অধিকারের ন্যায় রাজনৈতিক অধিকারও বিশেষভাবে দিয়েছেন। নারী এবং পুরুষের ভোটাধিকার একই। এতে কোন পার্থক্য করা হয়নি। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীগণ এরা সবাই একে অপরের বন্ধু পৃষ্ঠপোষক। এরা একে অপরকে ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে। এ লোকেরাই তারা যাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ অবশ্যই আসবে। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা মহা পরাক্রমশালী ও মহাবিজ্ঞানী।”৩২ (সূরা তাওবা -৭১)
পুরুষ ও নারী শুধু সামাজিকভাবেই নয় বরং রাজনৈতিকভাবেও একে অপরের জন্য পরিপূরক সাহায্যকারী। ইসলাম নারী ও পুরুষের ভোটের মধ্যে কোন পার্থক্য করেনি। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে নারীদেরকে পুরুষের ন্যায় ভোটাধিকার প্রদান করেছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “আল্লাহতায়ালা তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, তোমাদের আমানতকে যোগ্য পাত্রে অর্পণ করতে।”৩৩ ইসলাম নারীকে শুধু ভোটাধিকার দেয়নি। আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও দিয়েছে। একদা হযরত ওমর (রা) বিবাহের মহর নির্ধারণ করে দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাইলে এক বৃদ্ধ মহিলা পেছন থেকে ওঠে এর প্রতিবাদ করেন এবং কুরআনের এই আয়াত পাঠ করেন। “যদি তোমরা একজন স্ত্রীর জায়গায় অন্য একজন স্ত্রী গ্রহণ করতে চাও তাহলে তোমরা যাকে তালাক দিতে চাচ্ছ তার মহরের জন্য সম্পদের একটি পর্বত যদি দিয়ে থাক, তাহলে তা থেকে একটি জিনিসও ফেরত লইতে পারবে না।”৩৪ (সূরা নিসা-২০) অতঃপর সেই বৃদ্ধা বললেন, যেখানে আল্লাহতায়ালা মহরের কোন সীমা নির্ধারণ করে দেননি, সেখানে ওমর (রা) কিভাবে মহর নির্ধারণ করে দেবেন। তখন হযরত ওমর (রা) তাঁর মত প্রত্যাহার করেন এবং বলেন নিশ্চয়ই ওমর ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যাচ্ছিল আর এই নারী তা ঠিক করে দিলেন। এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নারীদেরকে সমান অধিকার দেয়া হয়েছে।
৭. নারীর উত্তরাধিকার বা মিরাসি অধিকার
নারীর অর্থনৈতিক অধিকারের মধ্যে উত্তরাধিকার মর্যাদার ক্ষেত্রে নারীকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। বর্তমানে নারীদের সমানাধিকারের নামে ইসলামবিরোধী নীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে ইহা নারীদের জন্য কল্যাণকর মনে হলেও বাস্তবে ইহা নারীদের জন্য বঞ্চিত হওয়ার মুখ্য কারণ হবে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ইসলাম নারীদেরকে যে মর্যাদা দিয়েছে তাতে নারীদের ঠকায়নি বরং উচ্চ মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “আল্লাহতায়ালা তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে একজন ছেলের অংশ দু’জন মেয়ের সমান। মৃতের সন্তান যদি শুধু মেয়েই হয় দুই বা দুয়ের অধিক। তাহলে কন্যারা পাবে দুই-তৃতীয়াংশ। যদি কন্যা একজন হয় তাহলে পাবে অর্ধেক। মৃত বক্তির সন্তানাদি থাকলে মৃতের পিতা-মাতা উভয়ের অংশ এক ষষ্ঠাংশ। আর যদি সন্তানাদি না থাকে আর পিতা-মাতাই শুধু ওয়ারিস হয় তাহলে মাতা পাবে এক-তৃতীয়াংশ। এগুলো বণ্টন হবে মৃতের ওসিয়ত এবং দেনা পরিশোধের পর। তোমাদের জানা নেই যে, তোমাদের বাবা দাদা এবং নিচের দিকে পুত্র-পৌত্র এর মধ্যে উপকারের দিক থেকে কারা বেশি আপনজন। এই বিধান খোদ আল্লাহর নির্ধারিত। আর আল্লাহতায়ালা সবকিছু মহাবিজ্ঞ বিচারপতি।৩৫ (সূরা আন নিসা ১১-১২)। ইসলামে উত্তরাধিকার নীতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর অংশ অর্ধেক বটে তবে সর্বক্ষেত্রে নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সমান পায় যেমন মৃতের কোন সন্তান না থাকলে মাতা-পিতা দু’জনেই এক- ষষ্ঠাংশ করে পায়। মৃত ব্যক্তি যদি নারী হয় আর তার কোন সন্তান না থাকে তাহলে স্বামী পাবে অর্ধেক। মাতা এক-তৃতীয়াংশ এবং পিতা এক-ষষ্ঠাংশ পাবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, কোন কোন ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের দ্বিগুণও পেয়ে থাকে।
তদুপরি আমি আপনাদের সাথে একমত যে কোন কোন ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের দ্বিগুণ দেয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষের অর্ধেক দেয়া হয়েছে। তারপরও নারী পুরুষের চেয়ে সমান বা তার চেয়ে বেশি পেতে পারে। যেমন অর্থনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ পূর্বেই দিয়েছি। এবার একটি যুক্তি পেশ করছি। ইসলাম নারীদের যাবতীয় ব্যয়ভার পুরুষের ওপর ন্যস্ত করেছে। নারী যদি তার মহরের টাকা কাজে লাগিয়ে কোটি টাকার মালিক হয় তবুও তার ব্যয়ভার তার স্বামীকেই বহন করতে হবে। যেমন একজন নারীর মাসিক ব্যয় যদি পাঁচ হাজার টাকা হয় তাহলে এক বছরে ব্যয় হবে ষাট হাজার টাকা। কুড়ি বছর বয়সে বিবাহ করলে আর ৮০ বছর বয়সে মারা গেলে তার পেছনে স্বামীর খরচ হবে ৩ লক্ষ ষাট হাজার টাকা। আবার ধরুন এ মহিলার পিতা ১ ছেলে এবং ১ মেয়ে রেখে মারা গেল, তার দেড় লক্ষ টাকার সম্পদ আছে। মিরাসি আইন অনুযায়ী ছেলে পেল এক লক্ষ এবং মেয়ে পেল ৫০,০০০ টাকা। মহিলার বিয়েতে তার ভাই খরচ করল ৫০,০০০ টাকা। তাহলে ফলাফল দাঁড়ালো ছেলের অবশিষ্ট থাকলো ৫০,০০০ টাকা আর মেয়ের হলো ১ লক্ষ টাকা। তাহলে যোগফল দাঁড়ালো যে পিতা ও ভাইয়ের নিকট থেকে পেল আবার বিয়ের সময় স্বামীর নিকট থেকে পেল এবং তার ব্যয়ভার বহনের খরচও তার স্বামীর ওপর ন্যস্ত হলো। ইহাতে কি প্রমাণ হয় না যে নারী উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে ঠকেনি বরং সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। আমি পূর্বেই বলেছি নারী-পুরুষের অধিকার সমান তবে সকল ক্ষেত্রে একই রকম নয়। যেমন আর একটি উদাহরণ : যেমন একটা শ্রেণীতে অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছে; তার মধ্যে ছাত্র জাহিদ ৮০% নম্বর পেয়েছে আবার ছাত্রী জাকিয়া ও ৮০% নম্বর পেয়ে দু’জনই প্রথম স্থান অধিকার করেছে তারা সব ক’টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে এবং প্রতি প্রশ্নের নম্বর ছিল ১০ করে। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে জাহিদ পেয়েছে ৯ আর জাকিয়া পেয়েছে ৭। তাহলে প্রথম প্রশ্নে জাহিদ জাকিয়ার চেয়ে ২ নম্বর বেশি পেয়েছে। অনুরূপভাবে ২য় প্রশ্নে জাকিয়া পেয়েছে ৯ আর জাহিদ পেয়েছে ৭। তাহলে ২য় প্রশ্নে জাহিদ অপেক্ষা জাকিয়া ২ নম্বর বেশি পেয়েছে। আবার তৃতীয় প্রশ্নে জাহিদ ও জাকিয়া পেয়েছে ৮ নম্বর করে। এভাবে সকল প্রশ্নের নম্বর যোগ করলে ফলাফল দাঁড়ায় তারা উভয়েই ৮০% নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। তবে কোন কোন প্রশ্নে জাহিদ বেশি আবার কোন কোন ক্ষেত্রে জাকিয়া বেশি নম্বর পেয়েছে। কিন্তু তাদের প্রাপ্ত সকল নম্বর যোগ করলে ফলাফল দাঁড়ায় তারা উভয়েই সমান। ইসলামে নারী ও পুরুষের বিষয়টিও ঠিক এরকম। কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষ তো কোন কোন ক্ষেত্রে নারী। কিন্তু মোট মিলিয়ে যোগ করলে ফলাফল দাঁড়ায় একেবারে সমান।
উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনার শেষ প্রান্তে এসে বলতে পারি যে, ইসলাম নারীদেরকে ঠকায়নি। পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরকেও সমানাধিকার দিয়েছে এবং সম্মানিত করেছে। আর যারা বলেন, ইসলাম নারীদেরকে সম-অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, তারা যদি সত্যের সন্ধানী হন আর প্রকৃতই নারীর সমানাধিকার চান তাহলে ইসলামী শরিয়তের মূল উৎস কুরআন ও হাদিস ভালোভাবে অধ্যয়ন করে দেখুন ইসলাম নারীদেরকে সামগ্রিকভাবে সমান অধিকার দিয়েছে এবং ইসলাম যে ব্যাকডেটেড নয় বরং এটি একটি খধঃবংঃ গড়ফবৎহ ধর্ম তা অনুধাবন করতে পারবেন। আর যে সব নারী পশ্চিমা সভ্যতার পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে নারী অধিকারের নামে চিৎকার করে সমস্ত নারী জাতির মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করছে তাদেরও উচিত ইসলামের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করে নিজেদেরকে মহীয়সী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আত্মনিয়োগ করা এবং ইসলাম যে মর্যাদা দিয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করা।
তথ্যসূত্র
১. নারী, ড. মাহবুবা রহমান-পৃ. ২৩
২. সূরা আল-বাকারা-২২৮
৩. সূরা আন-নিসা-৩৪
৪. সূরা আল আহযাব-৩৫
৫. সূরা আন-নিসা-১২৪
৬. সূরা আন-নাহল-৯৭
৭. সূরা আত-তাকবীর ৮-৯
৮. সূরা আন আয়াম-১৫১, বনি ইস্রাইল-৩১
৯. সূরা আন- নাহল-৫৮-৫৯
১০. মুসনাদে আহমদ
১১. সহীহ আত তিরমিজি
১২. সহীহ আল-বুখারী
১৩. সহীহ আল মুসলিম
১৪. সূরা- আন নিসা ১৯
১৫. সূরা -আল বাকারা-১৮৭
১৬. আল- কুরআন
১৭. সূরা বনি ইস্রাইল-২৩,২৪
১৮. আল কুরআন, সূরা লোকমান-১৪
১৯. সূরা আহকাফ-১৫
২০. মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ
২১. সহীহ আল-বুখারী
২২. আল -কুরআন
২৩. সূরা-আল বাকারা-১৮৬
২৪. সূরা আন নিসা-০৪
২৫. সূরা -আলাক-১-৫
২৬. হায়াতে সাহাবা
২৭. সাহাবা চরিত
২৮. সূরা আল -বাকারা-১৭৮
২৯. সূরা- আল মায়েদা-২৯
৩০. সূরা -আন নূর-০২
৩১. সূরা আন নূর-০৪
৩২. সূরা -আততাওবা-৭১
৩৩. আল- কুরআন
৩৪. সূরা- আন নিসা-৩৪
৩৫. সূরা- আন নিসা-১১-১২
লেখক : প্রভাষক ও গবেষক, নাটোর সিটি কলেজ
আপনার মন্তব্য লিখুন