আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখার সময় কৈশোর। একটি জাতির গতিপথ আলোকোজ্জ্বল না-কি অন্ধকারের দিকে ধাবমান তা কিশোরদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। তাই সমৃদ্ধ জাতি গঠনে কিশোরদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কিন্তু শুধু মুখের কথায় তা সম্ভব নয়। এই সত্যের বাস্তব নমুনা দেশের কিশোর গ্যাং কালচার। ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষার অভাবে বিপথগামী কিশোররা গড়ে তুলছে কিশোর গ্যাং। কৈশোরের অমিত শক্তি নিয়ে ফুল ফোটানোর বদলে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ধ্বংস করছে নিজের ও জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন আদর্শের ঝান্ডাবাহী ছাত্ররাজনীতির ফাঁদে পড়ে অনেক সাজানো স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে। এ ধারা যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে, নাহলে অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়নই কাজে আসবে না। মানব উন্নয়ন ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। আজ যারা কিশোর, তাদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ার মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে মানব উন্নয়নের চাবিকাঠি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট এ সত্য উপলব্ধি করেই বলেছেন, “We cannot always build the future for our youth, but we can build our youth for the future.”
অর্থাৎ আমরা সবসময় কিশোর-তরুণদের জন্য ভবিষ্যৎ গড়তে পারি না। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য কিশোর-তরুণদের গড়তে পারি।’ ছোটো একটি বাক্যে তিনি জাতিকে এই বার্তাই দিয়েছেন যে, একটি দেশ ও জাতির আগামী দিনের কর্ণধার আজকের শিশু-কিশোর ও তরুণরা। তাদের চরিত্রবান ও নৈতিক গুণের অধিকারীরূপে গড়ার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়তে হবে। দেশের অবকাঠোমো যত উন্নত, অর্থনীতি যত সমৃদ্ধই করা হোক না কেন,ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়কেরা সেই সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে না পারলে সবই বৃৃথা। তাই তিনি সমৃদ্ধ দেশের দায়িত্ব নৈতিকমানসম্পন্ন নেতৃত্বের হাতে তুলে দিতে আজকের কিশোরদের আদর্শ-চরিত্রবানরূপে গড়ে তোলার ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
তিনি মনে করেন, তারা নৈতিক মানে উন্নত হলে দেশ একদিন সমৃদ্ধ হবেই। কিন্তু তারা অযোগ্য ও চরিত্রহীন হলে সমৃদ্ধি টেকসই হবে না।
তার এই উক্তির আলোকে কেমন আছে আমাদের কিশোররা একবার দেখে নেওয়া যাক। কেমন আছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ? কীভাবে গড়ে উঠছে আমাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব। সময়ের দর্পণ পত্র-পত্রিকা এবং অন্যান্য মিডিয়ার দিকে একটু চোখ রাখলে যে ভয়াবহ চিত্র প্রতিনিয়ত দেখা যায়, তা রীতিমতো ভয়াবহ। খুন, গুম, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, মাদক গ্রহণ ও বিক্রি- এমন কোনো অপরাধ নেই, যার সাথে কিশোররা জড়িত নয়। মূল্যবোধের এতটাই অবক্ষয় ঘটেছে যে, নষ্ট বা বখে যাওয়া কিশোররা রক্তের দাপটে সমাজের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের আর পরোয়া করতে চায় না। এমনকি বাবা-মা,আপন ভাই বোনরাও তাদের হাতে নিরাপদ নন। যতই দিন যাচ্ছে অবস্থার কোনো উন্নতির লক্ষণ নেই; বরং অবনতিই ঘটছে।
পুলিশের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের শেষ দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, সারা দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। রাজধানীতে রয়েছে ৬৬টি, চট্টগ্রাম শহরে ৫৭টি। অবশ্য গত এপ্রিল মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত দেড় বছরে শুধু ঢাকাতেই কিশোর গ্যাং বেড়েছে ৬১টি। এখন আছে ১২৭টি। সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৬৪টি বেড়ে হয়েছে ২৩৭। ডিএমপি সূত্রানুসারে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে, তার ২৫টির সাথে কিশোর গ্যাং কোনো না কোনোভাবে জড়িত। কিশোরদের অদম্য শক্তিকে বিপথে চালাতে অপরাধী চক্র রাজনৈতিক শক্তির অপব্যবহার করে গড়ে তুলছে এসব কিশোর গ্যাং। অর্থ, বিত্ত, শক্তি, ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে নয়তো ভয় দেখিয়ে এবং ব্ল্যাকমেইল করে গ্যাংয়ে যুক্ত হতে অনেক সহজ-সরল নিরীহ কিশোরদের বাধ্য করছে।
উদ্বেগের বিষয় হলো- কিশোর গ্যাং গঠন, লালনপালন ও বিকাশে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা-কর্মীর নাম পুলিশি তদন্তে উঠে এলেও তাদের নিয়ন্ত্রণে সরকার রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করতে পারছে না; বরং রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখতে তাদের ব্যবহার করছে। সাথে সাথে কিশোর গ্যাং-এর বেপরোয়া আচরণে অপরাধ বাড়ায় উদ্বেগও বাড়ছে। তাই বিষয়টি মন্ত্রিসভা পর্যন্ত গড়িয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীদের মোকাবিলার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, প্রথাগত অন্য অপরাধীদের সঙ্গে যেন তাদের (কিশোর অপরাধী) মিলিয়ে ফেলা না হয়। তাদের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা, কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা- এ ধরনের সুযোগ-সুবিধাগুলো যেন রাখা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি জেলা পুলিশ সুপার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তারা এ বিষয়ে সতর্ক থাকেন। তবে তিনি কিশোর গ্যাং নির্মূলে পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবাইকে এগিয়ে আসার ওপর জোর দিয়েছেন।
অপরাধবিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, রাজনৈতিক শক্তি ও পরিচয় ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ব্যতীত কিশোর গ্যাং সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কারণ, কিশোরদের সংগঠিত করে গ্যাং কালচার চালুর মাধ্যমে অনেক অসৎ প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করছে। তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে ব্যর্থ হলে কোনো উদ্যোগই কাজে লাগবে না। উদ্বেগ কাটবে না; বরং প্রতিনিয়ত আরও বাড়বে। এ সংকট উত্তরণে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নিদের্শনা দেওয়া হচ্ছে। কিশোর-কিশোরীদের খেলাধুলা, বিতর্ক, বিজ্ঞান ক্লাবের কাজ বাড়ানো এবং গান, নাটক, থিয়েটারসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত করার ওপরে বিশেষভাবে জোর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তাদের কাছে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়টি তেমন জোর পাচ্ছে না; বরং স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগ ডে উদযাপন এবং আদব-কায়দা শেখানোর নামে যেসব ছাত্র সংগঠন অশ্লীল কায়দায় শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করছে, তাদের অবাধ কার্যক্রমে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ধর্মীয় ও নৈতিক চেতনা বিকাশ এবং শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে দেশপ্রেমিক, সৎ , যোগ্য, দক্ষ ও আদর্শ নাগরিক তৈরির জন্য ইসলামী ছাত্রশিবির যখন কাজ করছে, তখন তাদের বিভিন্ন মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। ফলে দৈন্যদশা কাটছে না, বরং দিনদিন বন্যার পানির ন্যায় বাড়ছে। ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব সমাজবিজ্ঞানীরা অস্বীকার না করলেও শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিষয়টি নির্বাসনে পাঠানোর সরকারি ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তারাই মূল কুশীলবের ভূমিকা পালন করছেন। এর কারণ, তারা যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন, তা শুধু ধর্ম বর্জিতই নয়; শিকড়ের সাথেও তার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, মুসলিম শাসকদের পতনের পর ভারতবর্ষ বন্দি হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের জালে। সেই জাল আজও ছিন্ন করতে পারেনি এ ভূখণ্ডের মানুষ।
কী সেই জাল?
সুদূর ইউরোপ থেকে সাত সাগর পাড়ি দিয়ে এ দেশে ব্রিটিশরা এসেছিল বাণিজ্য করতে। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদ, হিন্দু ও ক্ষমতা লোভী মীর জাফরদের কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাঁড়িপাল্লার দণ্ড বা মানদণ্ড পরিণত হয়েছিল রাজদণ্ডে। তারা একে একে গোটা ভারতবর্ষ দখল করে প্রতিষ্ঠা করেছিল উপনিবেশ। সেই উপনিবেশিক রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে গোলাম তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ইংরেজ রাজনীতিবিদ টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলে। তিনি ১৮১৩ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের জন্য প্রণীত সর্বপ্রথম শিক্ষানীতির নামে ষড়যন্ত্রের জাল তৈরি করেছিলেন। তার প্রবর্তিত শিক্ষানীতির আগে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসক মোগলদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সেই শিক্ষায় শিক্ষিতরা প্রকৃত মানুষ হিসেবেই গড়ে উঠতেন। টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলে নিজেও এ সত্য স্বীকার করেছেন। তিনি ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক ভাষণে বলেছেন, There is a statement attributed to Lord Macaulay by some people in order to prove the evil colonialist designs behind his education policy. It is a deliberate misquotation: “I have travelled across the length and breadth of India and I have not seen one person who is a beggar, who is a thief. Such wealth I have seen in this country, such high moral values, people of such caliber, that I do not think we would ever conquer this country, unless we break the very backbone of this nation, which is her spiritual and cultural heritage, and, therefore, I propose that we replace her old and ancient education system, her culture, for if the Indians think that all that is foreign and English is good and greater than their own, they will lose their self-esteem, their native self-culture and they will become what we want them, a truly dominated nation.”
অর্থাৎ,‘আমি ভারতবর্ষে ঘুরে বেড়িয়েছি, কিন্তু কোথাও (শিক্ষিত লোকেদের মধ্যে) একজন ভিক্ষুকও আমার চোখে পড়েনি, একজন চোরও আমি দেখতে পাইনি। এ দেশে সম্পদের এত প্রাচুর্য এবং এ দেশের মানুষগুলো এতটাই যোগ্যতাসম্পন্ন ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী যে, আমরা কখনোই পদানত করতে পারব না; যদি না তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলতে পারি। এ দেশের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই হচ্ছে সেই মেরুদণ্ড। এ কারণে আমার প্রস্তাব হচ্ছে, আমরা এখানকার প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতি এমন একটি শিক্ষা ও সংস্কৃতি দিয়ে প্রতিস্থাপন করব, যাতে প্রতিটি ভারতীয় নাগরিক ভাবতে শেখে, যা কিছু বিদেশি ও ইংরেজদের তৈরি তা-ই ভালো এবং নিজেদের দেশের থেকে উৎকৃষ্টতর। এভাবে তারা নিজেদের ওপর শ্রদ্ধা হারাবে, তাদের দেশজ সংস্কৃতি হারাবে এবং এমন একটি পরাধীন জাতিতে পরিণত হবে, ঠিক যেমনটি আমরা চাই।’ ( সূত্র: https://goo.gl/g8HmDC)
যদিও ওপরে উল্লেখিত বক্তব্যটিকে অনেক গবেষক লর্ড টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলের নামে প্রচারিত একটি ভুল বিবৃতি বলে মনে করে। কিন্তু ইংরেজদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কলকাতার গভর্নর কাউন্সিলে লর্ড ম্যাকলের দেওয়া বক্তব্য, ‘...They Will be Indian in Blood and Color but Appetite and thought Will be an European’ ( সূত্র : Woodrow, Macaulay’s Minutes on Education in India-১৮৬২)। অর্থাৎ তার এই শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন একদল ভারতীয় তৈরি হবে, যারা রক্ত-মাংসে ভারতীয় হলেও চিন্তাচেতনা ও রুচির দিক থেকে হবে ইউরোপিয়ন। তার সেই উদ্দেশ্যের ষড়যন্ত্রের জাল আজও এই ভূখণ্ডের মানুষ ছিন্ন করতে পারেনি। তাই তারা সত্যিকারে মানুষ হতে পারছে না। তাদের সন্তানরাও গ্যাং কালচার ত্যাগ করে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার পরিবেশ পাচ্ছে না। এর কারণ, অক্ষর-জ্ঞান, অঙ্ক, বিজ্ঞানের ধারণা মানে যে শিক্ষা নয়, এ সত্য আজ অনেকেই ভুলে গেছেন। যদিও ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতো বিজ্ঞজনরা তাদের বোঝাতে চেয়েছেন, কারও সন্তান তিনটি ‘R’ Read (পড়া), Write (লেখা), Reckoned / Arithmetic (গণনা / পাটিগণিত) শিখল কিন্তু Religion (ধর্ম) শিখল না, তাহলে সেই সন্তান পঞ্চম R Rascal (বদমাইশ)-এ পরিণত হবে।
অভিভাবকদের অনেকেই মনে করেন, লেখাপড়া শেষ করে তাদের সন্তানরা বড়ো বড়ো চাকরি, নয়তো ব্যাবসা-বাণিজ্য করে এক একজন টাকা বানানোর মেশিনে পরিণত হবে। ইংরেজদের শিক্ষা পদ্ধতির লক্ষ্যও ছিল তাই। তাদের কাজে অর্থের বিনিময়ে সাহায্য করবে এমন একদল লোক তৈরি করা। অথচ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো একজন মানুষের সুপ্ত সুপ্রবৃত্তিগুলো জাগ্রত করা এবং কুপ্রবৃত্তিকে দমন করা। এভাবেই একজন মানুষ পরিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হয়। এ লক্ষ্য অর্জন নৈতিক শিক্ষা ছাড়া সম্ভব নয়। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে, নৈতিক শিক্ষা কী?
নৈতিক শিক্ষা কী ও কেন?
এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই, সংজ্ঞা ছাড়া নৈতিক শিক্ষা অনুষঙ্গটি কেউ বুঝতে পারছেন না; বরং যার মনে যে চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে, সংজ্ঞা দিয়ে বোঝাতে গেলে তা বরং আরও জটিল হবে। যেমন : গাছের পাতা কী এটি যদি সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়, তাহলে বলতে হবে- যা বৃক্ষের অগ্রভাগে থাকে এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য তৈরিতে বৃক্ষকে সাহায্য করে, তাই পাতা। বিষয়টি কেমন জটিল হয়ে গেল। অথচ পাতা চেনেন না এমন কেউ কি আছেন? তারপরও লেখার প্রয়োজনে উল্লেখ করা হলো- ‘যে শিক্ষাব্যবস্থায় একটি শিশু অথবা একজন কিশোর, যুবক শিক্ষার্থী ভালো আচরণ শেখার সুযোগ পায়, তার সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি পায় এবং আখিরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে, সেই শিক্ষাই নৈতিক শিক্ষা। প্রকৃত দার্শনিক স্বীকার করেন, নৈতিক শিক্ষার আদি ও আসল উৎস হলো ধর্ম। সৃষ্টিকর্তা মানব সভ্যতার লালন, বিকাশ এবং দুনিয়া ও পরকালের জীবনে সাফল্যের জন্য যুগে যুগে নবী ও রাসুল (আ.)-এর মাধ্যমে কিতাব বা গাইডবুক পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল কুরআন। সর্বশেষ নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে উল্লেখ্য করেছেন, ‘তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তাদের কাছে রাসূল পাঠিয়ে আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তিনি তাদের কাছে আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শনাবলি পাঠ করেন, তাদেরকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করেন এবং গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেন। নিশ্চয়ই এর আগে তারা প্রকাশ্য ভ্রান্তির মধ্যে ছিল।’ (৩:১৬৪) উল্লেখিত আয়াতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথমত, মানুষের পথ-নির্দেশনার জন্য নবী রাসূলগণ (আ.) হলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্ব মানবতার প্রতি শ্রেষ্ঠ উপহার। দ্বিতীয়ত, জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য আত্মসংশোধন বা পবিত্রতা অর্জন। জ্ঞানের চেয়ে আত্মসংশোধন বা পবিত্রতা বেশি জরুরি। যে জ্ঞান এ উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ, তার প্রয়োজন নেই। পবিত্র উৎসের জ্ঞানই কল্যাণকর বা উপকারী। তৃতীয়ত, পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও রাসূল (সা.)-এর আদর্শই আত্মগঠন ও আত্মসংশোধনের জন্য খুবই জরুরি। এই দুটি বাদ দিলে শিক্ষার উদ্দেশ্য কোনোদিনই সফল হবে না। এককথায় নৈতিক শিক্ষার মূল উৎস এবং মানদণ্ড হলো পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত এ বিষয়গুলো। এ কথা সর্বযুগে স্বীকৃত, আত্মশুদ্ধি ছাড়া মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের ৪২০ বছরে আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো। তাঁর শিক্ষা দর্শন আজও ব্যাপকভাবে আলোচিত। তিনি রাষ্ট্র পরিচলানার জন্য দার্শনিক রাজার কথা উল্লেখ করেছেন এবং শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক গুণের বিকাশ ঘটিয়ে তবেই এ যোগ্যতা অর্জন সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। তার শিক্ষা দর্শনের মূল বাণী- justice means excellence. Excellence is virtue. ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার যোগ্যতা অর্জন করাই শিক্ষার মূল লক্ষ্য। এক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠরাই পুণ্যবান। তাঁর গুরু সক্রেটিস মনে করেন, virtue is knowledge সৎগুণই বা পুণ্যই হলো জ্ঞান।
এ কথা সর্বজন স্বীকৃত, সৎগুণ এবং পুণ্য শব্দ দুটির সাথে ধর্মের সম্পর্ক। কিন্তু কমিউনিজমের (মার্কসবাদ, মাওবাদ, লেলিনবাদ) প্রভাবে এ দেশের পণ্ডিতরা পুণ্য শব্দ উচ্চারণ করতে চান না। তারা মানতে রাজি নন শিক্ষার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পুণ্যবান ধার্মিক মানুষ তৈরি করা। বিভ্রান্তির এই জাল ছিন্ন করতে হবে। তবেই বিপদগামী শিশু-কিশোর ও তরুণ শিক্ষার্থীরা পাবে সঠিক সহজ সরল পথ।
বিপথগামীদের সুপথে পরিচালনার দায়িত্ব কার? ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র ও বিশ্ব সম্প্রদায় কেউ এ দায়িত্বমুক্ত নন। কিন্তু যেখানে গোটা বিশ্ব ব্যবস্থাই বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দি, সেখানে এ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে সত্য ও সুন্দরের আলোয় আলোকিত মানুষদের। পবিত্র কুরআনের ভাষায়- ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ দল, মানবজাতির জন্য তোমাদের অভ্যুত্থান হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের জন্য নির্দেশ দাও, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করো এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করো।’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০) এবং ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা (লোককে) ভালোর দিকে ডাকবে, সৎ কর্মের নির্দেশ দেবে এবং অসৎ কর্ম থেকে বিরত রাখবে। আর এসব লোকই হবে সফলকাম।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৪)। গ্যাং কালচার মুক্ত করে বিপথগামী কিশোর তরুণদের সুপথে আনার দায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকা আলোকিত কিশোর তরুণদেরকেই পালন করতে হবে। তবে অবশ্যই এই বৈরী হাওয়ায় দায়িত্ব পালনকারী কিশোর ও তরুণদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে রাষ্ট্র, সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল শিক্ষক, অভিভাবক এবং সচেতন প্রত্যেক নাগরিকের। দলকানা হয়ে ন্যায়নীতি ভুলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা অন্ধের মতো স্বৈরশাসকদের আজ্ঞা পালনে ব্রতী হলে গোটা জাতি একদিন আঁধারের অতল গহ্বরে পড়ে বিলীন হয়ে যাবে। অতএব সাবধান! জেগে ওঠার এখনই সময়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক
আপনার মন্তব্য লিখুন