post

পরিবর্তিত জনমিতি ও আমাদের করণীয়

এম আই খান

৩১ অক্টোবর ২০১৭
Pew Research Center এর প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্ব জনমিতিতে(World demography) এক বিরাট পরবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০৭০ এবং ২১০০ সালের যে জনমিতি অভিক্ষেপ (projection) করা হয়েছে তাতে ২০৭০ সালে খ্রিস্টান ও মুসলমানের সংখ্যা সমান এবং ২১০০ সালে মুসলমানের সংখ্যা খ্রিস্টান জনসংখ্যা থেকে বেশি হবে। প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, ২০১০ থেকে ২০৫০ সময়ে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৭৩%, এর বিপরীতে খ্রিস্টান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হবে ৩৫%। (http://www.telegraph.co.uk/news/2017/03/01/islam-will-largest-religion-world-2070-says-report/) ধর্মীয়ভাবে বিশ্ব জনসংখ্যাকে সকল সময়ই গুরুত্ব দেয়া হয়। খ্রিস্টানবিশ্ব সব সময়ই তাদের আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখার জন্য জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দিয়েছে। মুসলিম জনসংখ্যা কমিয়ে রাখার জন্য তারা হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপকৌশল গ্রহণ করে। কিছু কিছু অপকৌশল বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। এতে করে তাদের জনসংখ্যা কমতে থাকে আর মুসলিম জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। ধর্মীয়ভাবে বিশ্বের জনসংখ্যা বিশ্লেষণে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ১৫৯টি খ্রিস্টান প্রধান দেশ থেকে নেমে এর সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫১টিতে। যে দেশগুলো খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে সেগুলো হচ্ছে- যুক্তরাজ্য (বর্তমান-৬৪.৩%, ২০৫০ সনে হবে-৪৫.৪%) অস্ট্রেলিয়া (বর্তমান- ৬৭.৩%, ২০৫০ সনে হবে-৪৭%), বেনিন, বসনিয়া-হারজেগভিনা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড ও মেসিডোনিয়া। ভোগবাদ ও অনিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি খ্রিস্টান জনসংখ্যা হ্রাসের কারণ পশ্চিমা দেশগুলোতে খ্রিস্টানদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার মুসলমানদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেখানে মুসলিম নারীরা গড়ে ৩.১ জন সন্তান ধারণ করেন সেখানে খ্রিস্টান নারীরা সন্তান ধারণ করেন ২.৭ জন। http://www.telegraph.co. uk/news/2017/03/01/islam-will-largest-religion-world-2070-says- মূলত খ্রিস্টান জগৎ ভোগবাদী দর্শনে অভ্যস্ত হওয়ার ফলে তারা সন্তান ধারণকে নারী ভোগের অন্তরায় হিসেবে দেখে। প্রজনন স্বাস্থ্যের নামে তারা প্রজনন ক্ষমতাকে নষ্ট করে। নারীরাও তাদের প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হয়ে জীবনভোগের নতুন সংজ্ঞায় গা ভাসিয়ে দেয়। তারা এই ধারণাকে (Assumption) মুসলিম বিশ্বেও ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে এতে তিনটি দল হয় (১) প্রজনন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে, (২) প্রজনন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে কোনোভাবেই বিশ্বাসী হয়নি এবং (৩) ধর্মের বিভিন্ন ব্যাখ্যায় অনেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় থেকে অধিক সন্তান ধারণ অব্যাহত রাখে। খ্রিস্টান জগৎ ভোগবাদী দর্শন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অস্থিরতায় ভোগছে এবং একেক সময় একেক ফরমুলা উদ্ভাবন করছে। কখনো পুঁজিবাদ, উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, সেক্যুলারিজম, বস্তুবাদ, নাস্তিক্যবাদ, নারী ক্ষমতায়ন, জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশনসহ শত শত অর্থনৈতিক ফরমুলার পাশাপাশি জীবনদর্শনও তারা হাজির করে। হযরত আদম (আ) ও মা হাওয়ার পৃথিবী আগমনের পর থেকেই প্রজননপ্রক্রিয়ায় জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। তার সন্তানদের মধ্যেই তৈরি হয় ‘অবিশ্বাসী’। এই ‘অবিশ্বাসীদেরকে’ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয় কিন্তু ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ লেখক George Jacob Holyoake এদেরকে "secularist" নামে চিহ্নিত করেন আর এই মতবাদকে secularism"" নাম দেন। সেক্যুলারিজম (ধর্মবিযুক্তবাদ) পশ্চিমা জগৎকে এতটাই প্রভাবিত করে যে, এটা মানুষকে নাস্তিক্যবাদের দিকে নিয়ে আসে। তাই আজ নাস্তিক্যবাদ ধর্মীয় মর্যাদা লাভ করে এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে তৃতীয় স্থান দখল করে। এর সাথে যুক্ত হয় Corporate Business,, যার মূল টার্গেট থাকে মুনাফা। এরা গবেষণা করে বের করেছে যে, মহিলারা পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি জড়বাদী ও ভোগবাদী। যে কোন দ্রব্যের দাম মহিলাগণ বেশি দিয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোন একক দ্রব্যের দামের ক্ষেত্রে ৪২% মহিলা পুরুষদের থেকে বেশি মূল্য দেয়, সমান দাম দেয় ৪০% মহিলা আর ১৮% পুরুষ মহিলাদের থেকে বেশি দাম দিয়ে থাকে। নারী পুরুষের সামগ্রীর দামের ক্ষেত্রেও মহিলাদের জিনিসের দাম বেশি হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পোশাকের চেয়ে নারীদের পোশাকের মূল্য গড়ে ৮% বেশি হয়। https://consumerist.com/2015/12/23/study-shows-woman-pay-significantly-more-than-man-for-virtually-the-same-products/ এই বিবেচনায় Corporate Business-গুলো নারীদের কর্মক্ষেত্র থেকে বের করে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদেরকে পুরুষদের কর্মক্ষেত্রে এনে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ফেলে। নারীদের বিভিন্ন সামগ্রী উৎপাদনের মাধ্যমে সেগুলো ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে এবং প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি করে। এতে করে তাদের সামগ্রীর কাটতি বাড়ে, জ্যামিতিক হারে উৎপাদন বাড়ে। সেক্যুলার দর্শন আর ভোগবাদী চেতনা সবচেয়ে বড় আঘাত হানে মানুষের নৈতিকতায়। এই পৃথিবীতে আগমন আর প্রস্থান নিয়ে ধর্মীয় দর্শনের বিপরীতে নতুন মতবাদ অনেকটা স্থান করে নেয়। “হাতের কাছে যা পাও, দু’হাত ভরে লুটে নাও” মতবাদ একদিকে অর্থনীতিতে নীতিহীনতা আর যৌনাচারে স্বেচ্ছাচারিতা মাঠ দখল করে। খ্রিস্টান জগৎ এই অবস্থায় বহুবিধ সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে। তাদের বড় একটি অংশ নাস্তিক্য জীবন গ্রহণ করে যাকে তারা Unaffiliated নাম দেয়ার চেষ্টা করে। আর একটা অংশ ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, একটি ছোট অংশ হিন্দুত্ববাদ গ্রহণ করছে। কেবল ২০১১ সনেই যুক্তরাজ্যে এক লক্ষ জনের ওপর মানুষ ইসলামী জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যাদের প্রায় ৬৬% হচ্ছেন নারী। ধর্মান্তরিত হওয়ার দুইটি কারণ তারা বের করেছে। তাদের একটি দল হচ্ছে যশস্বী ব্যক্তি (celebrities) যাদেরকে পুলিশ মনে করে জিহাদী কর্মকান্ড জড়িত থাকতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশই পাশ্চাত্য জগতের সকল কিছুর স্বাদ গ্রহণ করে হতাশ হয়েছেন। ‘এরপর কী’ খুঁজতে গিয়ে তারা মুসলিম হয়েছেন। খ্রিস্টান বিশ্বের জন্য সামনে আরো বিপদ আসছে। জনমিতি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, তাদের দেশগুলোতে বয়স্ক জনসংখ্যার হার অনেক বেশি। যুব বয়সী জনসংখ্যার হার কাম্য হারের চেয়ে কম। বিবাহবন্ধনের পরিবর্তে ‘লিভ টুগেদার’ অপসংস্কৃতি একটি নারী-পুরুষের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি করেছে; অন্যদিকে নতুন প্রজন্ম উৎপাদনে অনীহা দেখা দিয়েছে। প্রবাহিত রক্তের অভাব এখনই খ্রিস্টান বিশ্বে দেখা দিয়েছে। আমাদের করণীয় এই পৃথিবী গত সহস্রাব্দী ছিল খ্রিস্টান বিশ্বে নিয়ন্ত্রণে এবং তাদের বিভিন্নমুখী অবদানকে অস্বীকার কোন সুযোগ নেই। তাদের বিশাল জনশক্তিকে তারা বিভিন্ন সেক্টর তথা- শিক্ষা, গবেষণা, আবিষ্কার, দেশ বিজয়, গোয়েন্দা, ইসলামসহ অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে তৎপরতা, তাদের নিজের মত করে বিশ্বসভ্যতার ইতিহাস লেখাসহ হাজার হাজার বিশাল কর্মকান্ডে নিয়োজিত করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের কিছু কিছু নিম্ন পর্যায়ের কাজের জন্য লোক না পাওয়া গেলে তারা মুসলিম দেশগুলো থেকে বিভিন্ন নামে লোক নিয়ে সেই অভাব পূরণ করে। ২০৭০ সালে বিশ্ব জনমিতিতে খ্রিস্টান আর মুসলিম সমান হলেই কি যোগ্যতার নিরিখে এই দুই ধর্মীয় জনগোষ্ঠী সমান হবে? অথবা ২১০০ সালে মুসলিমরা পৃথিবীর জনসংখ্যার দিক থেকে প্রথম হলেই কি তারা এক নম্বর যোগ্য ও দক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিগণিত হবে? “কুনতুম খায়রা উম্মাতি” হয়ে “উখরিজাত লিননাস”-এর দায়িত্ব পালনে তার প্রস্তুত কি না? দ্বিতীয়ত অন্যান্য দেশ প্রস্তুত থাকলেও আমরা বাংলাদেশের মুসলমানগণ কতটুকু প্রস্তুত। আবারও বলছি আমাদের সামনে দুইটিই চ্যালেঞ্জÑ ১. “কুনতুম খায়রা উম্মাতি” হওয়া এবং ২. “উখরিজাত লিননাস” এর প্রস্তুতি। চ্যালেঞ্জ দুইটিই যদি বিশ্লেষণ করে বলা যায় তা হলে দাঁড়ায়Ñ ১. “কুনতুম খায়রা উম্মাতি” অর্থাৎ মুসলিমগণকে হতে হবে শ্রেষ্ঠ জাতি আর এর নেতারা হবেন সমকালীন বিশ্বে বা দেশে সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন নেতা। মুসলিম ও তাদের নেতাদেরকে অনুধাবন করতে হবে প্রতিজন নবী-রাসূল তাঁদের সময়ে শ্রেষ্ঠ মানুষ ও নেতা ছিলেন। দেশ বা বিশ্বের নেতৃত্ব নিতে হলে তাদেরকে দেশ বা বিশ্বের সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন লোক হতে হবে। এবং ২. “উখরিজাত লিননাস” অর্থাৎ মানুষের (শুধু মুসলমানের নয়) কল্যাণে মুসলিম ও তাদের নেতাগণ নিয়োজিত হবেন। এই ক্ষেত্রে তারা প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবেন, ধর্মকে নয়। সূরা তওবায় ৬০ নম্বর আয়াতে জাকাতের যে আটটি ব্যয়ের খাত বলা হয়েছে তাতে একটি অমুসলিমদের জন্য নির্ধারিত আর একটি ইসলামী আন্দোলনের জন্য নির্ধারিত; বাকি ছয়টি খাত সকল মানুষের জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে কুরআন নাজিলের সিলসিলায় প্রথম আয়াত “ইকরা বিসমি রাব্বিকাল লাজি খালাক” এর আমল করা। দ্বিতীয়ত জনশক্তিকে বিভিন্ন কাজে বিভাজন করে কাজে নিয়োজিত করা। বিভাজিত জনশক্তিকে যে সব কাজে লাগানো যেতে পারেÑ ১. তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে খ্রিস্টান বিশ্ব নতুন ইতিহাস প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, মুসলিম বিশ্বের সকল গোপনীয় তথ্য তাদের দখলে নেয়াসহ বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে সম্পদ লুণ্ঠন করছে। তাই, মুসলিম বিশ্বের জন্য আলাদা operating system, search engine, security system , browserসহ অন্যান্য Device I Software তৈরি করতে হবে। ২. জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় লোক নিয়োগ করতে হবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন শাখা প্রশাখা আবিষ্কার করতে হবে। ৩. মানুষের কল্যাণমুখী কাজ করার জন্য এখন থেকেই পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ করতে হবে। ৪. খ্রিস্টান বিশ্ব অপপ্রচারের মাধ্যমে মানুষকে যতটুকু বিভ্রান্ত করছে, তার রিপেয়ার করার কাজ করতে হবে। ৫. মুসলিমদের মধ্যে কওমি-আলিয়া, মাজহাবি-লা মাজহাবি,political Islam-religious Islam, সালাফি-দেওবন্দি এবং আন্তর্জাতিকভাবে সুন্নি-শিয়ার মধ্যে যেসব দ্বন্দ্ব আছে সেগুলো negotiation point of view কমন পয়েন্টে এসে একমত হতে হবে। হ লেখক : সাহিত্যিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির