post

পলাশী প্রহসনের বিয়োগান্তক ইতিহাস : প্রেক্ষিত আজকের বাংলাদেশ

১৭ জুলাই ২০১৪

আতিকুর রহমান

Storyপলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ভাগীরথী নদীতীরে পলাশীর প্রান্তরের আম্রকাননে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের এক পক্ষে ছিলেন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবার সিরাজউদ্দৌলা। অপর পক্ষে ছিল রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ বেনিয়া দল। যুদ্ধে সিরাজের পরাজয় হয়, যদিও তার পরাজিত হবার কথা ছিল না। তিনি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও তার নিজস্ব রাজকর্মচারী এবং প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানসহ অন্য সেনাপতিদের অবিশ্বাস্য বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধে পরাজিত হন। পরবর্তীতে তাকে বন্দী করে হত্যা করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে প্রায় দু’শত বছরের জন্য অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। পলাশীর পরিণতি উপমহাদেশের ইতিহাসে তো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসেও প্রভাব বিস্তারকারী একটি ঘটনা। পলাশীর ট্র্যাজেডি শুধু সুবেবাংলার স্বাধীনতা হারানোর দিন নয়। এর মধ্য দিয়ে সমগ্র উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। অনেকে এটিকে পলাশীর বিপর্যয়ের দিন বলে অভিহিত করেন। যুদ্ধের দিন নয়। কেননা যুদ্ধে পরাজিত হওয়া এক কথা, কিন্তু যুদ্ধ না করে যে পরাজয় বরণ করতে হয় তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঐতিহাসিক তপন মোহন চট্টোপাধ্যায় তার পলাশীর যুদ্ধ গ্রন্থের ১৭৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “পলাশীর যুদ্ধকে একটা যুদ্ধের মতো যুদ্ধ বলে কেউ স্বীকার করে না। কিন্তু সেই যুদ্ধের ফলেই আস্তে আস্তে একমুঠো কারবারি লোক গজকাঠির বদলে রাজদণ্ড হাতে ধরলেন। প্রথম থেকেই তারা রাজত্ব করলেন না বটে, কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে দাঁড়ালেন।” তপন মোহন চট্টোপাধ্যায় তার বইয়ের ১৫৮ ও ১৫৯ পৃষ্ঠায় আরো খোলাখুলিই লিখেছেন যে “ষড়যন্ত্রটা আসলে হিন্দুদেরই ষড়যন্ত্র” হিন্দুদের চক্রান্ত হলেও বড় গোছের মুসলমান তো অন্তত একজন চাই। নইলে সিরাজউদ্দৌলার জায়গায় বাংলার নবাব হবেন কে? ক্লাইভ তো নিজে নবাব হতে পারেন না। হিন্দু গভর্নরও কেউ পছন্দ করবে কি না সন্দেহ? জগৎশেঠরা তাদের আশ্রিত ইয়ার লতিফ খাকে সিরাজউদ্দৌলার জায়গায় বাংলার মসনদে বসাতে মনস্থ করেছিলেন। উমিচাঁদেরও এতে সায় ছিল। কিন্তু ক্লাইভ ঠিক করলো অন্য রকম। সে এমন লোককে নবাব করতে চায় যে ইংরেজদেরই তাঁবে থেকে তাদেরই কথা শুনে নবাবী করবে। ক্লাইভ মনে মনে মীর জাফরকেই বাংলার নবাবী পদের জন্য মনোনীত করে রেখেছিলো। পলাশী শুধু নদীতীরের এক খণ্ড জমি নয়, যুদ্ধের ময়দানও নয়। এটি হচ্ছে স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষের রক্তক্ষরণের স্থান, ষড়যন্ত্রকারীদের পাহাড়সম প্রহসনের স্থান। আবার এটা দেশদ্রোহী বেঈমান চেনার স্থানও বটে। বাংলাদেশী মানুষের জন্য এই স্থান প্রেরণার বাতিঘর। যে প্রেরণা যুগিয়েছে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় সিরাজ ও তার পরিবার। অন্য দিকে পলাশী লড়াকু দেশপ্রেমিক মুসলমানদের ঈমানী পাঠশালাও বটে যারা দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে লড়াই করেছেন। পলাশী মানে অন্য একটি কারবালা, একটি ইয়াজিদ ও একজন সিপাহসালারের আপ্রাণ যুদ্ধ। ঐতিহাসিকরাই বলেছেন, পলাশীর যুদ্ধের একমাত্র নায়ক ও বীর হচ্ছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। কারণ তিনি নিজে দেশের স্বার্থেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তিনি যদি ইংরেজদের সাথে সমঝোতা করতেন তাহলে দীর্ঘসময় নবাব থেকে সুখে শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু দেশের ভালোবাসায় নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে ইতিহাসের নির্মম পরিণতিকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন। পলাশী যুদ্ধের ২৫৭ বছর পরও আজ আমাদের অনেক প্রশ্নÑ পলাশীর যুদ্ধ কেন সংঘটিত হয়েছিল? কী হয়েছিল সে যুদ্ধের পরিণাম? কেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা সে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন? পলাশী ট্র্যাজেডির জন্য কারা দায়ী? কেন যুদ্ধক্ষেত্রে সিরাজের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানসহ অন্য সেনাপতিগণ এবং রাজকর্মচারী জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, নন্দকুমার, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ প্রমুখ সিরাজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে দেশের স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছিল। দেশের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও কেন সিরাজকে জঘন্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে শোচনীয়ভাবে প্রাণ দিতে হলো? এসব প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আমাদের পলাশীর ইতিহাস থেকে আরো অনেক পেছনে যেতে হবে, যাতে স্পষ্ট অনুধাবন করা যাবে কী করে ইংরেজরা দীর্ঘ মিশন নিয়ে এ দেশে আগমন করেছিল এবং ১৫৭ বছরের প্রচেষ্টায় কিভাবে তারা সফলতা অর্জন করেছিল? কাদের অতিমাত্রায় ক্ষমতার লোভ ও দুর্বলতাকে পুঁজি করে ইংরেজরা আমাদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল? এর জন্য কি শুধু সিরাজউদ্দৌলাই দায়ী! না তিনি দীর্ঘদিনের চলে আসা ষড়যন্ত্রের বিশালতাকে মোকাবেলা করতে না পেরে ষড়যন্ত্রের যবনিকাপাতের নায়ক হতে বাধ্য হলেন। ইতিহাসের সূত্র মতে ভারতবর্ষের অতুলনীয় বৈভব ও ঐশ্বর্যের কথা জানতে পেরে প্রাচ্যে বাণিজ্য করার জন্য লন্ডনে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ নামে একটি বণিক সম্প্রদায় গঠিত হয়। তারা রানী প্রথম এলিজাবেথের নিকট থেকে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রাচ্যদেশে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ১৫ বছর মেয়াদি একটি সনদ লাভ করেন। এই সনদবলে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ কয়েকটি বাণিজ্য জাহাজ সুমাত্রা, মালাক্কা ও যবদ্বীপে প্রেরণ করে। ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের আদেশে ক্যাপ্টেন হকিংস নামক এক ব্যক্তি মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের (১৬০৫-২৭) দরবারে আগমন করেন। ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে হকিংসের আবেদনক্রমে সম্রাট জাহাঙ্গীর মুম্বাইয়ের অদূরে সুরেট বন্দরে ইংরেজদের একটি কুঠি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করেন। ১৬১৫ সালে স্যার টমাস রো নামক জনৈক ইংরেজ সম্্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন এবং ইংল্যান্ডের রাজার দূতরূপে আজমীর, মান্ডু ও আহমেদাবাদে তিন বছর অবস্থান করেন। তার চেষ্টায় ভারতের আরো কয়েকটি জায়গায় ইংরেজদের বাণিজ্য প্রসারিত হয়। সতের শতকের মাঝামাঝি (১৬৪৪-৫০) সম্রাট শাহজাহান ভারতবর্ষের সম্রাট থাকাকালীন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। একদিন তার কন্যার পরিধেয় বস্ত্রে হঠাৎ আগুন লেগে তার প্রায় সমস্ত শরীর দগ্ধ হয়ে যায়। দেশীয় চিকিৎসায় অগ্রগতি না হওয়ায় সম্রাট ইংরেজ চিকিৎসক গাব্রিয়েলকে ডেকে পাঠান। তার চিকিৎসায় সম্রাটের কন্যা আরোগ্য লাভ করেন। চিকিৎসকের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে বাউটনের অনুরোধেই সম্রাট শাহজাহান ইংরেজ কোম্পানিকে বাংলাদেশে আংশিক বাণিজ্যের অধিকারসংবলিত একটি শাহি ফরমান প্রদান করেন। অতঃপর সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহজাদা সুজা বাংলার সুবেদার থাকাকালীন বাউটন তিন বছরকাল তার পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। সেই সুবাদে পুনরায় বাউটনের অনুরোধে শাহজাদা সুজা দিল্লি প্রদত্ত শাহি ফরমানটি ভালো করে না দেখেই মাত্র ৩০০০ হাজার টাকা বার্ষিক নজরানার বিনিময়ে ইংরেজদেরকে বাংলাদেশে বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করেন। যার প্রেক্ষিতে ইংরেজরা ১৬৫০ সালে প্রথমে হুগলীতে ও পরবর্তী পর্যায়ে পাটনা ও কাশিমবাজারে কুঠি স্থাপন করে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্দরে বিনাশুল্কে অবাধ বাণিজ্য প্রসার ঘটাতে শুরু করে। বাংলায় ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে ইংরেজরা ১৬৫৭ সালে এ দেশের জন্য পৃথক এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করেন। এক দিকে পুঁজি বৃদ্ধি, অপর দিকে দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোগল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের মাধ্যমে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ কর্তৃক শুরু হয় বাংলার বাণিজ্য সম্প্রসারণ অভিযান। ১৬৫৮ সালে কুঠি স্থাপিত হয় বাংলার রেশমকেন্দ্র কাশিমবাজারে। ১৬৫৯ সালে সোরা (ঝধষঃ-ঢ়বঃৎব) সংগ্রহের জন্য কুঠি স্থাপিত হয় পাটনায়। ১৬৬৮ সালে মসলিন বস্ত্রের জন্য ঢাকায়, ১৬৭৬ সালে সুতি বস্ত্রের জন্য মালদহে। ১৬৯০ সালে কলকাতায় স্থাপিত হয় কোম্পানির প্রধান বাণিজ্য কুঠি ও স্থায়ী বাসস্থান। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬৫২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলায় বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ ছিল মাত্র সাত হাজার পাউন্ড। আর ১৬৮০-এর দশকে তার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় এক লক্ষ থেকে এক লক্ষ পনের হাজার পাউন্ডে। শায়েস্তা খান বাংলার সুবেদার থাকাকালীন সময়ে ১৬৭০ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে কোম্পানি আরো একটি ফরমান লাভ করে। এই ফরমানের শুল্ক আদায়ের ব্যাখ্যা নিয়ে কোম্পানি ও নবাব সরকারের কর্মচারীদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে কোম্পানির এজেন্টরা এই সমস্যা সমাধানের জন্য বিলাতে কোর্ট অব ডিরেক্টরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কোর্ট প্রতিকূল অবস্থায় নবাব কর্মচারীদের ঘুষদানের মাধ্যমে বিষয়টি ফয়সালা করার পরামর্শ প্রদান করে। এভাবে ইংরেজরাই প্রথম ঘুষদানের মাধ্যমে এ দেশে দুর্নীতি বিস্তারের চেষ্টা করে। তাতেও কোন ফল না হওয়ায় এবং শায়েস্তা খান কর্তৃক নতুন ফরমান প্রাপ্তির ব্যাপারে দিল্লির দরবারে কোম্পানির পক্ষে কথা বলার সুযোগ না দেয়ায় কোম্পানির অবাধ ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল, নবাব কর্মচারীগণ তাদের মতো শুল্ক আদায় করে চললো। ইব্রাহীম খান (১৬৮৯-১৬৯৭) বাংলার সুবেদার থাকাকালীন সময়ে ১৬৯৫ সালে কিছু কিছু স্থানীয় বিদ্রোহের কারণে আইন শৃঙ্খলার অবনতিতে বিচলিত হয়ে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে তাদের স্ব স্ব প্রধান কুঠিতে দুর্গ নির্মাণ করে নিজেদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করার অনুমতি দেন। এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা এ দেশে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের নিমিত্তে ১৬৯৬ সালে সুতানুটি কুঠিতে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ স্থাপন করেন, যা তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আওরঙ্গজেবের পৌত্র আজিম-উস-শান ১৬৯৭ সালে বাংলায় সুবেদার হলে ১৬৯৮ সালে ১৬ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে বার্ষিক মাত্র ১২ শ’ টাকা খাজনা প্রদানের ভিত্তিতে ইংরেজদের কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর নামক তিনটি গ্রামের জমিদারি প্রদান করেন। এ তিনটি গ্রামই পরবর্তীতে কলকাতা মহানগরীতে রূপান্তরিত হয়। আজিম-উস-শান কর্তৃক জমিদারি লাভের মধ্য দিয়ে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ প্রথম দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনুপ্রবেশ ও জমিদারি শাসনের ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ লাভ করে। এই ক্ষুদ্র জমিদারি ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়ে এক সময় সমগ্র দেশই কোম্পানির জমিদারিতে পরিণত হয়। মুর্শিদকুলি খান (১৭০৫-১৭২৭) বাংলার সুবেদার থাকাকালীন সময়ে ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ইংরেজদেরকে তার দেয়া ফরমানের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে কাশিমবাজার, রাজমহল ও পাটনায় ইংরেজকুঠি বন্ধ করে দেন। বিপরীত দিকে সম্রাট ফররুখ মিয়ার (১৭১৩-১৯) দিল্লির সিংহাসনে উপবিষ্ট থাকাকালীন ইংরেজ চিকিৎসক হ্যামিলটন দ্বারা আরোগ্য লাভ করার প্রেক্ষিতে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সম্রাট শাহজাহানের ধারবাহিকতায় কোম্পানিকে প্রায় বিনাশুল্কে সমগ্র ভারতবর্ষে বাণিজ্য করার লাইসেন্স দিয়ে দিলেন। যার ফলে কোম্পানি বাংলাদেশের স্থল ও নৌ পথে বাণিজ্যের সুযোগ পেল এবং কলকাতার নিকটবর্তী ৩৮টি গ্রামের মালিকানার অধিকারসহ নিজস্ব মুদ্রা তৈরি করার অনুমতি লাভ করে। ১৭১৭ সালের এ ফরমানকে ঐতিহাসিক ওরাম ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির’ ম্যাগনাকার্টা বা মহাসনদ নামে অভিহিত করেন। মুর্শিদকুলি খান বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ার কারণে কোম্পানিকে ভূসম্পত্তি লাভ, নিজস্ব মুদ্রা প্রচলন এবং করমুক্ত অবাধ বাণিজ্যের অনুমতি দিতে রাজি না হলেও দিল্লির আনুকূল্যের জোরে কোম্পানি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। ইংরেজদের এই সাহস জোগানোর পেছনে দেশীয় কতিপয় হিন্দু জমিদার ও রাজকর্মচারীর গোপন জোগসাজশ ছিল। এত সব ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও মুর্শিদকুলি খানের আমলে ইংরেজ বণিক সম্প্রদায় খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। এসব ঘটনাবলির দ্বারা এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মোগল সম্রাটদের উদাসীনতা, অদূরদর্শিতা ও ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধাকে অধিক প্রাধান্য দেয়া এবং বিলাসী সব চিন্তাভাবনা বাংলাদেশ তথা সমগ্র ভারত উপমহাদেশকে ধীরে ধীরে ইংরেজ শাসনের করতলগত করে ফেলে। ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে মুর্শিদকুলি খান মারা গেলে তার জামাতা সুজাউদ্দিন (১৭২৭-১৭৩৯) বাংলার নবাব হন। তখন বাংলার সাথে উড়িষ্যাও যুক্ত ছিল। পরবর্তীতে বিহার ও বাংলার সাথে যুক্ত হয়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা নামে একটি নতুন সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। সুজাউদ্দিনের সময়েও মুর্শিদকুলি খানের শাসনধারা অব্যাহত থাকায় সুবে বাংলার প্রায় অর্ধেক এলাকা নিয়ে গঠিত ৬১৫টি পরগনায় মাত্র ১৫টিতে জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৩৯ সালে সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার দুর্বল পুত্র সরফরাজ খান বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। সরফরাজ খানের দুর্বলতার সুযোগে রাজদরবারে পূর্ব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনরত আলম চাঁদ, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, যশোবন্ত রায়, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, নন্দলাল নবাব মহলের বিভেদের অজুহাতে নানা ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেরা উত্তরোত্তর অধিক ক্ষমতা লাভের নেশায় মেতে ওঠেন এবং নবাব সরফরাজ খানের বিরুদ্ধে বিহারের গভর্নর আলীবর্দী খানকে প্ররোচিত করে তাকে সক্রিয় সমর্থন দিয়ে বিদ্রোহ ঘটান। আলীবর্দী খান ১৭৪০ সালে সরফরাজ খানকে পরাজিত করে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন। আলীবর্দী খানের সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব থেকেই মোগল সম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগে মারাঠা বর্গীরা (অশ্বারোহী দস্যু) প্রায় প্রতি বছর বাংলায় হানা দিয়ে সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন করে নারী, পুরুষ ও শিশুদের নির্যাতন চালিয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে যেত। অন্য দিকে ১৬৯৮ সালে সুতানুটি কলকাতা ও গোবিন্দপুর নামক তিনটি গ্রামের জমিদারি তথা খাজনা আদায়ের অধিকার লাভ করায় কলকাতায় ইংরেজদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও মুর্শিদাবাদে রাজদরবারের ভেতরের একদল বিশ্বাসঘাতক হিন্দু রাজকর্মচারী ভারতের অন্যান্য জায়গার মতো বাংলার মুসলিম শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য গোপনে ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছিল। এক দিকে হানাদার মারাঠা বাহিনী, অন্য দিকে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ বেনিয়া এবং সর্বোপরি নিজ রাজদরবারের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা শত্রু পরিবেষ্টিত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই নবাব আলীবর্দী খানকে চালিয়ে যেতে হয়েছে তার দীর্ঘ ষোল বছরের রাজত্বকাল (১৭৪০-১৭৫৬) তার রাজত্বের শেষ দিক থেকেই বাংলার হিন্দু রাজা-মহারাজাদের প্ররোচনায় ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ নবাবকে অমান্য করতে শুরু করেছিল। ১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল আলীবর্দী খানের মৃতুর পর তার নাতি ২৩ বছর বয়সের তরুণ সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব পদে সমাসীন হলেন। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন আলীবর্দী খানের কনিষ্ঠ কন্যা আমেনা বেগমের ছেলে। আলীবর্দী খান তার দূরদৃষ্টি দিয়ে সিরাজউদ্দৌলার মধ্যে গভীর নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, বীরত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা দেখতে পেয়ে তাকে যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনে আরোহণের কাল ছিল কণ্টকাকীর্ণ। হিন্দু রাজা মহারাজা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং হিন্দু রাজকর্মচারীদের মুসলিম নবাববিরোধী ষড়যন্ত্রের মধ্যে তিনি ক্ষমতায় আরোহণ করেছেন। এই ষড়যন্ত্রের সাথে তার সিংহাসনে আরোহণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পারিবারিক কলহ যোগ হয়ে তা ষোলকলায় পূর্ণ হয়েছিল। ক্ষমতায় আরোহণের পরপরই ইংরেজদের ধারাবাহিক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ থেকে সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পেরেছিলেন যে বিদেশী ইংরেজরাই একদিন বাংলার স্বাধীনতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সিরাজের একমাত্র চিন্তা হয়ে উঠলো কী করে ভেতরের বাইরের এসব বহুমুখী চক্রান্তের মুখে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়। মুর্শিদাবাদ রাজদরবারের বিশ্বাসঘাতক কর্মচারীদের সাথে ইংরেজদের গোপন ষড়যন্ত্রের বিষয়ও সিরাজ অবহিত ছিলেন। তাই সিংহাসনে আরোহণের পরপরই সিরাজউদ্দৌলা যেকোনো মূল্যে এই দেশ থেকে ইংরেজদের বিতাড়ন করাকে তার জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। রাজদরবারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোকের ষড়যন্ত্র এবং তার নিকট-আত্মীয়রা অসহযোগিতা না করলে সিরাজ অবশ্যই তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সফলতা লাভ করতেন। সিংহাসনে আরোহণের মাত্র দেড় মাসের মধ্যে তিনি একই সাথে কৃষ্ণবল্লভকে প্রত্যার্পণ করতে গভর্নর ড্রেককে আদেশ দেন এবং ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের সংস্কার বন্ধসহ কলকাতার চতুর্পার্শ্বের পরিখা ভরাট করার আদেশ দেন। কিন্তু ইংরেজরা নবাবের আদেশ অগ্রাহ্য করার পাশাপাশি নবাবের পত্রবাহক নারায়ণ সিংকে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। এর পর নবাব ব্যবসায়ী খাজা ওয়াজিদকে একই উদ্দেশ্যে একাধিকবার কলকাতায় পাঠান। ইংরেজরা তার সাথেও সংযত আচরণ না করায় নবাব রায়দুর্লভ ও বেগকে কাশিমবাজার কুঠি অবরোধ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। মীর মোহাম্মদ রেজা খান হুগলীতে জাহাজ নির্মাণের পথ রোধ করলেন এবং এভাবে কাশিমবাজার কুঠির পতন ঘটে। কুঠি-প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস নবাবের সামনে হাজির হয়ে অঙ্গীকার করেন যে দুর্গের সম্প্রসারণ বন্ধ করা হবে এবং কলকাতার এ দেশীয় কাউকে আশ্রয় দেয়া হবে না। কিন্তু কোম্পানি প্রধান ড্রেক, কুঠি-প্রধান ওয়াটসের অঙ্গীকারের সাথে একমত না হওয়ায় ১৭৫৬ সালের ১৩ জুন নবাব ফোর্ট উইলিয়ামে পৌঁছান এবং কলকাতা অবরুদ্ধ করেন। এমতাবস্থায় ১৯ জুন তারিখে কলকাতা নাটকের অহঙ্কারী নায়ক রজার ড্রেক তার সঙ্গীদের নিয়ে পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে বাধ্য হন। সঙ্গে সংঙ্গে ইংরেজ শিবিরে পলায়নের হিড়িক পড়ে যায়। এক ঘণ্টার মধ্যে ইংরেজদের সকল জাহাজ পলাতকদের নিয়ে ভাটিপথে পাড়ি জমায়। ২০ জুন ১৭৫৬ তারিখে কলকাতার পতন ঘটে। কলকাতার পতনের পর যে সকল নর-নারী আত্মসমর্পণ করেছিল তাদের ব্যাপারে হলওয়েল নামক এক ব্যক্তি মিথ্যা কল্পকাহিনী বানিয়ে প্রচার করায় ইংরেজ শিবিরে ক্ষোভের আগুন সঞ্চার করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছিল। যেমনটি বর্তমান সময়েও পরিলক্ষিত হয়। আর সেটি হচ্ছে গভীর রাতে আত্মসমর্পণকারীদের জানালাবিহীন একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে বন্দী করে রাখা হয়। প্রকোষ্ঠটি এত ক্ষুদ্র ছিল যে তার মধ্যে নিদারুণ মর্ম যাতনায় ছটফট করতে করেতে অনেকেই মারা যায়। ইংরেজদের লিখিত ইতিহাসে যা তথাকথিত ‘অন্ধকূপ’ হত্যা নামে অভিহিত। যেটি পলাশী যুদ্ধের পটভূমি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিল। এই ঘটনা অনেক তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। অনেকে হলওয়েলের বর্ণনা সত্য বলে গ্রহণ করেছেন। আবার কেউ কেউ এই ঘটনাকে একটি ডাহা মিথ্যা ও কল্পিত কাহিনী বলে উল্লেখ করেছেন। হলওয়েল ছিলেন বন্দীদের একজন এবং অন্ধকূপ হত্যার গল্পটি তারই সৃষ্টি। সিরাজউদ্দৌলা ২১ জুন সকালে এ ঘটনা জানতে পেরে হলওয়েলকে মুক্তি দিয়ে মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেন। অন্য দিকে এ খবর মাদ্রাজ পৌঁছলে রবার্ট ক্লাইভ ইউরোপ থেকে আগত দুই হাজার সৈন্য ও আধুনিক গোলাবারুদসহ মাদ্রাজ থেকে দ্রুত কলকাতায় এসে পৌঁছান। ২ জানুয়ারি ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা কলকাতা পূর্ণ দখল করে নেয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের হুমকির মুখে পুনরায় ২০ জানুয়ারি ১৭৫৭ সালে কলকাতা দখল করেন এবং মানিক চাঁদকে কলকাতায় দায়িত্বে রেখে হুগলী অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু মানিকচাঁদ, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ ও নন্দকুমারসহ আরো অনেকে ঘুষের বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে কলকাতা ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় সিরাজ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। ঠিক এমনি সময়ে সিরাজ জানতে পারেন আফগান অধিপতি আহমদ শাহ আবদালী মধ্য-ভারতে বিভিন্ন নগর, শহর দখল করে চলছেন। এই আবদালী কর্তৃক এক পর্যায়ে মুর্শিদাবাদ আক্রমণের হুমকি তরুণ নবাব সিরাজকে বিচলিত করে তোলে। অপর দিকে ইংরেজরা নবাবের সঙ্গে বোঝাপাড়া করার জন্য এ দেশের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তিকে হাত-করার উদ্দেশ্যে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন অনুভব করে। এসব কারণে ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তির শর্তানুযায়ী ইংরেজরা কলকাতা ফিরে যায় এবং ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ মেরামত ও নির্মাণের কাজ করে। এ চুক্তিকে আলীনগর সন্ধি নামে অভিহিত করা হয়। যার শর্তানুযায়ী সিরাজউদ্দৌলা ১৭১৭ সালের মোগল বাদশাহের ফরমানের মাধ্যমে ইংরেজদের প্রদত্ত সুবিধাসমূহ মেনে নেন। এ চুক্তির পর পরই সময় ক্ষেপণের মাধ্যমে ইংরেজরা সিরাজের পরিবর্তে তাদের আজ্ঞাবহ কাউকে সিংহাসনে বসানোর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এই ষড়যন্ত্রের সাথে অনেক আগে থেকেই হিন্দু রাজকর্মচারীরা জড়িত ছিল। তাদের জোগসাজশ যাতে ধরা না পড়ে সে জন্য তারা দু’জন মুসলমান ইয়ার লতিফ ও মীর জাফর আলী খানকে নবাবীর লোভ দেখিয়ে হাত করে নেয়। অপর দিকে আলীবর্দী খান যে তার জীবিতকালেই সিরাজকে নবাব করতে চান তা জানতে পেরে আলীবর্দীর নিকট-আত্মীয় স্বজনরা আগে থেকেই সিরাজকে হিংসার চোখে দেখতে থাকেন। বিশেষ করে সিরাজের খালা ঘসেটি বেগম ও মায়মুনা বেগম শুরু থেকেই সিরাজকে মেনে নিতে পারেননি। কেননা ঘসেটি বেগমের ছেলে মোহাম্মদী বেগ এবং মায়মুনা বেগমের ছেলে শওকত জংয়েরও সিংহাসনের প্রতি লোভ ছিল। আলীবর্দী খানের পরিবারের এই অসন্তোষকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে কুচক্রী জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ, মানিকলাল, নন্দকুমার প্রমুখ সিরাজকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দেয়ার কুৎসিত ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এসব ষড়যন্ত্রকারীর সাথে ইংরেজদের যে গোপন বৈঠক হয় তাতে তারা এই মর্মে একমত হন যে সিরাজকে সরিয়ে তাদের অনুগত একজন মুসলমানকে নবাব করতে হবে, যাতে জনগণের মধ্যে কোনো সন্দেহ সৃষ্টি হতে না পারে। ২ মে ১৭৫৭ সালে জগৎশেঠের বাড়িতে বাংলা ধ্বংসের এ গোপন বৈঠকটি শুরু হয়। বৈঠকে উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ, মীর জাফর এবং আরো কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি যোগ দেন। ইংরেজ কোম্পানির এজেন্ট ওয়াটসও পর্দাঘেরা পাল্কিতে চড়ে সেদিন সে গোপন বৈঠকটিতে মিলিত হয়েছিলেন। এই বৈঠকেই সিরাজউদ্দৌলাকে সরিয়ে মীর জাফরকে বাংলার মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত হয়। সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফর ছিলেন এই ঘটনার অপরিণামদর্শী নির্বোধ ক্রীড়নক। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মীর জাফর ৪ জুন ১৭৫৭ তারিখে উক্ত চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী তিনি ইংরেজদেরকে সৈন্য দিয়ে সাহায্যের বিনিময়ে কয়েকটি বাণিজ্য সুবিধা দিতে স্বীকার করেন এবং ইংরেজ সৈন্যদের ব্যয়ভার বহনসহ কোম্পানির ক্ষতিপূরণ বাবদ ২ কোটি টাকা দিতে সম্মত হন। উমিচাঁদকেও ২০ লক্ষ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। মীর জাফর আলী খান ছিলেন আলীবর্দী খানের ভগ্নিপতি। আলীবর্দী খানের সময় থেকেই মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কুখ্যাতি ছিল। যার জন্য নবাব আলীবর্দীর নিকট তাকে কয়েকবার শাস্তি পেতে হয়। তবে ভগ্নিপতি ছিলেন বিধায় আলীবর্দী তাকে ক্ষমা করে পুনরায় প্রধান সেনাপতির পদে বহাল রাখেন। এই একই ভুল সিরাজউদ্দৌলাও করেছেন। মীর জাফরের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে সিরাজ তাকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করে জনৈক আব্দুল হাদী খানকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করেন। কিন্তু জগৎশেঠ ও অন্যান্য বিশ্বাসঘাতক আগে থেকেই ষড়যন্ত্রে অংশীদার বলে তারা সিরাজকে এই মর্মে পরামর্শ দেন যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তি সংগ্রহে মীর জাফরের প্রয়োজন হবে। বিশ্বাসঘাতকদের পরামর্শে প্রভাবিত হয়ে নবাব তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেন। আত্মীয়তার কারণে সিরাজ নিজেই মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে আলীবর্দীর নামে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্যের জন্য এবং বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় সঠিক ভূমিকা পালনের জন্য এক আবেগময় ও মর্মস্পর্শী আবেদন জানান। সিরাজের আবেগময় আবেদনে মীর জাফর পবিত্র কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের পক্ষে মরণপণ যুদ্ধ করার শপথ গ্রহণ করেন। কুরআন হাতে নিয়ে শপথ করায় সিরাজ মীর জাফরকে বিশ্বাস করেন এবং তার তরুণসুলভ ঔদার্যে তাকে ক্ষমা করে পুনরায় প্রধান সেনাপতির পদে বহাল করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এ সময় যদি মীর জাফর ও তার কুচক্রী সহচরদের আসল চরিত্র সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারতেন এবং তাদের বন্দী করে শাস্তির ব্যবস্থা করতেন তাহলে ইংরেজরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারতো না এবং বাংলার ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো, কিন্তু সমকালীন ভারতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাংলাদেশে বিদেশীদের আচরণ, নিজ দরবারের কর্মচারীদের মধ্যকার অবিশ্বাস ও চক্রান্ত এবং সিংহাসন নিয়ে পারিবারিক বিদ্বেষ ও শত্রুতা এই তরুণ নবাবকে যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। এই জটিল পরিস্থিতিতে তিনি কাকে বিশ্বাস করবেন, কাকে করবেন না তা বুঝে ওঠাও ছিল অত্যন্ত দুরূহ। অপর দিকে সাময়িক পদচ্যুতিতে অপমানিত হয়ে মীর জাফর বাংলায় অভ্যুত্থান ত্বরান্বিত করার জন্য পুনরায় ইংরেজ কাউন্সিলর ও সৈন্যদলকে ৫০ লক্ষ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এমনি একটি সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলেন সুচতুর ও কূটকৌশলী রবার্ট ক্লাইভ। মীর জাফরের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ইংরেজরা ১৭৫৭ সালের ১৩ জুন নবাবকে চরমপত্র দিয়ে কোম্পানির ব্যবসায় বাধা দানের জন্য দায়ী করেন। এই পত্র নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক এক তরুণ নবাবকে সেদিন এক করুণ ও কঠিন সত্যের সম্মুখে দাঁড় করিয়েছিল। পত্রে ক্লাইভের যে দাম্ভিকতা ও অহঙ্কার প্রকাশ পেয়েছিল তা সহ্য করা স্বাধীনচেতা সিরাজের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ১৩ জুন সমগ্র ব্রিটিশ বাহিনী গুলি গোলাবারুদ নিয়ে গঙ্গাতীরের বাদশাহী রাস্তার ওপর দিয়ে পদব্রজে অগ্রসর হতে লাগল। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ অনেক দূর পথ। পথপার্শে¦ হুগলী এবং কাটোয়ার দুর্গে, অগ্রদ্বীপ এবং পলাশীর ছাউনিতে নবাবের সিপাহি-সেনারা বসে ছিলেন। তারা স্ব স্ব জায়গায় বীরোচিত কর্তব্য সম্পাদন করলে হয়তো হুগলীর নিকটেই ইংরেজরা সসৈন্যে পশ্চাদপদ হতে বাধ্য হতো। কিন্তু ইংরেজদের গতিরোধ করা দূরে থাকুক কেউ একবার বীরের ন্যায় সম্মুখে অগ্রসর হবারও প্রয়োজন মনে করল না। ইতিহাসে কেবল এই পর্যন্তই দেখতে পাওয়া যায় যে নবাবপক্ষীয় হুগলীর ফৌজদার বা তাদের কালা সিপাহিরা ইংরেজদের যুদ্ধজাহাজ দেখে এবং ক্লাইভের তর্জন গর্জন শুনে নিতান্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কোন প্রতিরোধ না গড়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। এ দিকে বিদ্রোহের সন্ধান পেয়ে সিরাজ পুনরায় মীর জাফরকে কারারুদ্ধ করার সঙ্কল্প পরিত্যাগ করে তাকে স্বপক্ষে টেনে আনবার আয়োজন করতে লাগলেন। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ এটিকে সিরাজউদ্দৌলার দূরদর্শিতার অভাবের উৎকৃষ্ট প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেন। কারণ তিনি বারবার বিশ্বাস ভঙ্গকারী মীর জাফরের ওপর আস্থা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা সে সময় বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় এতটাই ব্যাকুল ছিলেন যে কেউ কেউ নবাবকে মীর জাফরকে কারারুদ্ধ করার জন্য উত্তেজিত করলেও সিরাজউদ্দৌলা সে কথায় কর্ণপাত করলেন না। আত্মাভিমান তুচ্ছ করে স্বয়ং সিরাজউদ্দৌলা পুনরায় ১৫ জুন মীর জাফরের বাড়িতে উপনীত হলেন। এর আগে মীর জাফরকে রাজসদনে ডাকা হলেও বিশ্বাসঘাতকতা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় সাহসের অভাবে তিনি রাজসদনে উপস্থিত হননি। সিরাজ মীর জাফরকে আবারও ক্ষমা করে দিয়ে আল্লাহর নামে, মুহাম্মদের নামে, মুসলমানদের গৌরবের নামে, আলীবর্দীর বংশমর্যাদার দোহাই দিয়ে ফিরিঙ্গির ¯েœহবন্ধন ছিন্ন করার জন্য পুনঃপুন উত্তেজিত করতে লাগলেন তখন মীর জাফরকে সব কথাই স্বীকার করতে হলো। তখন আবার ‘কুরআন’ আসলো। আবার মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মাথায় নিয়ে, মুসলমান নরপতির নিকট মুসলমান সেনাপতি জানু পেতে শপথ করলেন আল্লাহর নামে, পয়গম্বরের নামে, ধর্মশপথ করে অঙ্গীকার করছি, যতদিন বেঁচে থাকবো মুসলমানদের সিংহাসন রক্ষা করব, জীবন থাকতে বিধর্মী ফিরিঙ্গির সহায়তা করব না। সিরাজউদ্দৌলার পুনরায় মীর জাফরের প্রতি বিশ্বাস জন্মাল। তার সব সন্দেহ দূর হয়ে গেল। হিন্দু যে ব্রাহ্মণের পাদস্পর্শ করে মিথ্যা বলতে পারে, সে কথা সিরাজউদ্দৌলা বিশ্বাস করতে না পেরে একবার উমিচাঁদের ধর্মশপথে প্রতারিত হয়েছিলেন। কিন্তু একজন মুসলমান যে কুরআন মাথায় নিয়ে মিথ্যা বলতে সাহস করবে তা বিশ্বাস করতে না পেরে সিরাজউদ্দৌলা আবারও প্রতারিত হলেন। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে সিরাজউদ্দৌলা পলাশী প্রান্তরে সসৈন্যে সমবেত হবার আয়োজন করতে লাগলেন। এমতাবস্থায় বিদ্রোহীদের প্ররোচনায় সেনাদল বেতন না পেলে যুদ্ধযাত্রা করতে অসম্মত হলো। নবাব তাদের পূর্বের বেতন পরিশোধ করার পর রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মীর জাফর, মীর মদন, মোহন লাল এবং ফরাসি সেনানায়ক সিনফ্রে এক এক বিভাগের সেনা চালনার ভার গ্রহণ করে সিরাজউদ্দৌলার সহগামী হলেন। পুনরায় শুরু হলো বিশ্বাসঘাতকের অবর্ণনীয় ঘাতকতা। সিরাজউদ্দৌলার সাথে কুরআন শপথ করে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় যে প্রতিশ্রুতি মীর জাফর দিয়েছিল সেই চক্রান্তের কর্ণধার নিজেই ১৬ জুন ক্লাইভকে একটি পত্র লিখে জানিয়ে দেন যে সিরাজের সাথে মৌখিক সখ্য স্থাপন করতে তিনি বাধ্য হয়েছেন। এর কারণে ইংরেজদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনে তিনি বিন্দুমাত্রও ত্রুটি করবেন না তা-ও লিখে পাঠান। মীর জাফরের পাঠানো চিঠির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ক্লাইভ ১৮ জুন সকালবেলা ২০০ ঘোড়া এবং ৩০০ সিপাহি নিয়ে মেজর কুটকে কাটোয়া অভিমুখে অগ্রসর হতে বললেন। কাটোয়া দুর্গ বীরবিক্রমের লীলাভূমি বলে চিরবিখ্যাত। ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে এবার দুর্গদ্বারে কোন যুদ্ধ হলো না। নবাব সেনারা ইংরেজদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কিয়ৎক্ষণ যুদ্ধাভিনয়ের পর স্বহস্তে চালে চালে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দুর্গ হতে পলায়ন করল। বিনা যুদ্ধে ক্লাইভ ধীরে ধীরে সসৈন্যে কাটোয়া অধিকার করে নেন। নাগরিকগণ জীবন রক্ষায় পলায়ন করায় এত চাল সেদিন ইংরেজদের হস্তগত হলো যে তাতে দশ সহ¯্র সিপাহি বছর ধরে উদর পূরণ করতে পারত। মীর জাফরের এত সহযোগিতার পরও ক্লাইভের তার প্রতি আস্থার সঙ্কট ছিল। না জানি তিনি চূড়ান্ত সমীরণে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেন কিনা। তিনি অভিযান পরিচালনা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলেন। ক্লাইভ স্বীকার করে গেছেন তার কেবলই ভয় পেতে লাগলো যদি পরাজিত হই তবে আর একজনও সে পরাজয় কাহিনী বহন করার জন্য লন্ডনে প্রত্যাগমন করবার সময় পাবে না যখন ছিল ক্লাইভের বাস্তব অবস্থা, তখনই ২১ শে জুন বিকেলে মীর জাফরের নিকট হতে এক সঙ্গে দুইখানা পত্র এসে উপনীত হলো। একটি পত্র ক্লাইভের নামে, অপরটি উমরবেগের নামে। উমরবেগ ছিলেন মীর জাফরের বিশ্বস্ত অনুচর। উভয় পত্রে ক্লাইভের সন্দেহ অপসারিত হলো। (বাকি অংশ আগামি সংখ্যায়) লেখক : সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ক্লাইভের বিশ্বস্ত সহচর স্ক্রাফটন লিখেছেন, ২১ জুন মীর জাফরের পত্র পেয়ে ক্লাইভ ঘুরে বসে ছিলেন এবং তার আদেশে ২২ শে জুন সকাল ৫ ঘটিকার সময় ব্রিটিশ বাহিনী গঙ্গা পার হয়েছিল। ওহ ঃযরং ফড়ঁনঃভঁষ রহঃবৎাধষ ঃযব সধলড়ৎরঃু ড়ভ ড়ঁৎ ড়ভভরপবৎং বিৎব ধমধরহংঃ পৎড়ংংরহম ঃযব ৎরাবৎ ধহফ বাবৎুঃযরহম নবভড়ৎব ঃযব ভধপব ড়ভ ফরংধঢ়ঢ়ড়রহঃসবহঃ নঁঃ ড়হ ঃযব ২১ংঃ ড়ভ ঔঁহব, ঃযব পড়ষড়হবষ ৎবপবরাবফ ধ ষবঃঃবৎ ভৎড়স সববৎ ঔধভভড়ৎ, যিরপয ফবঃবৎসরহবফ যরস ঃড় যধুধৎফ ধ নধঃঃষব ধহফ যব ঢ়ধংংবফ ঃযব ৎরাবৎ ধঃ ভরাব রহ ঃযব হবীঃ সড়ৎহরহম ঝবৎধভঃরড়হ. মীর জাফরের পত্র ঞযধঃ ঃযব ঘধনধন যধফ যধষঃবফ ধঃ গঁহপধৎধ, ধ ারষষধমব ংরী গরষবং ঃড় ঃযব ংড়ঁঃয ড়ভ ঈধংংরসনধুধৎ ধহফ রহঃবহফবফ ঃড় বহঃৎবহপয ধহফ ধিরঃ ঃযব বাবহরহম ধঃ ঃযধঃ ঢ়ষধপব, যিবৎব লধভভধৎ ঢ়ৎড়ঢ়ড়ংবফ ঃযধঃ ঃযব ঊহমষরংয ংযড়ঁষফ ধঃঃধপশ যরস নু ংঁৎঢ়ৎরংব, সধৎপযরহম ৎড়ঁহফ নু ঃযব রহষধহফ ঢ়ধৎঃ ড়ভ ঃযব রংষধহফ. ক্লাইভের উত্তর ঞযধঃ যব ংযড়ঁষফ সধৎপয ঃড় চষধংংবু রিঃযড়ঁঃ ফবষধু ধহফ ড়িঁষফ ঃযধঃ ঃযব হবীঃ সড়ৎহরহম ধফাধহপব ংরী সরষবং ভঁৎঃযবৎ ঃড় ঃযব ারষষধমব ড়ভ উধঁফঢ়ড়ড়ৎ; নঁঃ রভ সববৎ লধভভড়ৎ ফরফ হড়ঃ লড়রহ যরস ঃযবৎব যব ড়িঁষফ সধশব ঢ়বধপব রিঃয ঃযব ঘধনধন. ক্লাইভের প্রত্যুত্তরে স্পষ্টই বুঝা যায় যে তিনি ২১ জুন অপরাহ্ন যুদ্ধযাত্রা করেননি, তবে পত্র পাবার পর যুদ্ধযাত্রা করতে কৃত সঙ্কল্প হয়ে মীর জাফরকে সংবাদ পাঠিয়েছেন। মীর জাফরের উপদেশ না পেয়ে, ইংরেজরা সসৈন্যে কাটোয়ায় অপেক্ষা করছিলেন এবং সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সমর সভার অধিবেশন আহবান করেছিলেন। মীর জাফরের উপদেশ পাওয়া মাত্র আবার ইংরেজ সেনাপতির শৌর্যবীর্য জাগরিত হয়ে উঠেছিল। ক্লাইভ নিজেও স্বীকার করে গেছেন যে সমর সভার অধিবেশন শেষ হলে ২৪ ঘণ্টার বিশেষ গবেষণার পরে তার মত পরিবর্তন হয় এবং ২২ জুন সকালে সেনাদল গঙ্গা পার হয়। মীর জাফরের পূর্বকথিত সঙ্কেতানুসারে ইংরেজ বাহিনী ২২ শে জুন সকালে ভাগীরথী পার হয়ে দলে দলে পলাশীর দিকে অগ্রসর হতে লাগল। নবাব সেনারা পলাশী অধিকার করে নেয় কি না এই আশঙ্কায় ইংরেজরা বৃষ্টি বাদল মাথায় করে তাড়াতাড়ি ছুটে চললো এবং রাত ১টার সময় পলাশীর আম্রবনে পৌঁছল। ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে রজনী প্রভাত হলো। যে প্রভাতে ভারত-গগনে ব্রিটিশ সৌভাগ্য-সূর্য উদিত হবার সূত্রপাত হয়েছিল। ১১৭০ হিজরি ৫ শাওয়াল, বৃহস্পতিবার পলাশী প্রান্তরে ইংরেজ ও বাঙালি শক্তি পরীক্ষার জন্য একে একে গাত্রোত্থান করতে লাগলো। ইংরেজরা আম্রকাননের পশ্চিম- উত্তর কোণে লক্ষবাগের উত্তরে উন্মুুক্ত প্রান্তরে ব্যূহ রচনা করলেন। সিরাজউদ্দৌলা প্রত্যুষেই মীর জাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভকে শিবির হতে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। তারা অর্ধচন্দ্রাকারে ব্যূহ রচনা করে ধীর মন্থরগতিতে আম্রবন বেষ্টন করার জন্য অগ্রসর হতে লাগলেন। মীর মদনের সিপাহি সেনা সম্মুখস্থ সরোবর তীরে সমবেত হয়েছিল। এক পাশে ফরাসি বীর সিনফ্রে, এক পাশে বাঙালি বীর মোহনলাল, মধ্যস্থলে বাঙালি বীর সেনাপতি মীর মদন সেনাচালনার ভার গ্রহণ করলেন। সিরাজ বাহিনীর রণহস্তী, সুশিক্ষিত অশ্বসেনা এবং সুগঠিত আগ্নেয়াস্ত্র যখন ধীরে ধীরে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগল তখন ইংরেজরা ভাবলো সিরাজ-ব্যূহ দুর্ভেদ্য। বেলা ৮ ঘটিকার সময় মীর মদন সরোবরতীরে কামানে অগ্নিসংযোগ করলেন। প্রথম গোলাতেই ইংরেজ পক্ষে একজন হত এবং একজন আহত হলো। তার পর মুহুর্মুহু কামান পরিচালনায় একের পর এক ইংরেজ সেনা ধরাশায়ী হতে লাগল। মাত্র ৩০ মিনিটের যুদ্ধে ১০ জন গোরা এবং ২০ জন কালা সিপাহির মৃত্যু হলো। ইংরেজ সেনাদের কামান পরিচালনায় নবাবের গোলন্দাজদের ক্ষতি করতে পারেনি, তারা অক্ষত দেহে বিপুল বিক্রমে ইংরেজ সেনার মধ্যে মিনিটে মিনিটে গোলাবর্ষণ করতে লাগল। এমতাবস্থায় আত্মরক্ষার জন্য ক্লাইভ আম্রবনে লুকিয়ে বৃক্ষ-অন্তরালে বসে পড়ল। নবাব সেনার ব্যূহ রচনায় এবং সমর কৌশলে ক্লাইভের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। তিনি উমিচাঁদকে ভর্ৎসনা করে বলতে লাগলেন, “তোমাদের বিশ্বাস করে বড়ই ভুল করেছি” তোমাদের সঙ্গে কথা ছিল যে যৎসামান্যই যুদ্ধাভিনয় হলেই মনস্কামনা পূর্ণ হবে; সিরাজসেনা যুদ্ধক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি প্রদর্শন করবে না। এখন যে তার সকল কথাই বিপরীত মনে হচ্ছে। উমিচাঁদ বিনীতভাবে নিবেদন করলেনÑ যারা যুদ্ধ করছে তারা মীরমদন এবং মোহনলালের সেনাদল; তারাই কেবল প্রভুভক্ত। তাদের কোনো রকমে পরাজিত করতে পারলেই হয়; অন্যান্য সেনা নায়কগণ কেউ অস্ত্র চালনা করবেন না। অন্য দিকে মীরমদন ধীরে ধীরে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বিপুল বিক্রমে গোলা চালনা করতে লাগলেন। সেই সময়ে মীর জাফরের চক্রব্যূহ যদি আর একটু অগ্রসর হয়ে কামানে অগ্নিসংযোগ করতো তাহলে আর রক্ষা ছিল না। কিন্তু মীর জাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ যেখানে সেনা সমাবেশ করেছিলেন, সেখানেই পুতুলের ন্যায় দাঁড়িয়ে রণকৌতুক দর্শন করতে লাগলেন। ঠিক মধ্যাহ্ন সময়ে বৃষ্টি শুরু হলো; মীরমদনের অনেক বারুদ ভিজে গেল কামানগুলোর ওপর ঢাকনা না থাকায় তা শিথিল হয়ে পড়ল। মীর মদন আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর ধরাধরি করে তাকে সিরাজউদ্দৌলার সম্মুখে উপনীত করলে তিনি শুধু বলতে পারলেন “শত্রুসেনা আম্রবনে পলায়ন করেছে, তথাপি নবাবের প্রধান সেনাপতিগণ কেউ যুদ্ধ করছে না, সসৈন্য চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মীর মদনের অকস্মাৎ মৃত্যুতে সিরাজের বল-ভরসা অকস্মাৎ তিরোহিত হয়ে গেল। সিরাজউদ্দৌলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কারণ দেশপ্রেমিক মীর মদনের ভরসা পেয়ে সিরাজউদ্দৌলা শত্রুদলের কুটিল কৌশলে ভ্রƒক্ষেপ করেননি। সিরাজউদ্দৌলা নিরুপায় হয়ে আবারও রাজমুকুট রেখে দিয়ে ব্যাকুল হৃদয়ে মীর জাফরকে বলে উঠলেন যা হওয়ার তা হয়েছে, তুমি ভিন্ন রাজমুকুট রক্ষা করার এমন আর কেউ নেই। মাতামহ জীবিত নেই। তুমিই এখন তার স্থান পূর্ণ কর। মীর জাফর! আলীবর্দীর পুণ্যনাম স্মরণ করে দেশের মান সম্ভ্রম এবং আমায় জীবন রক্ষায় সহায়তা কর। নবাবের অনুরোধে আবারও মীর জাফর প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে রাজমুকুটকে কুর্নিশ করে বুকের ওপর হাত রেখে বিশ্বস্তভাবে বলতে লাগলেন অবশ্যই শত্রু জয় করব। কিন্তু আজ দিবা অবসান প্রায় হয়ে পড়েছে; আজ সেনাদল শিবিরে প্রত্যাগমন করুক; প্রভাতে আবার যুদ্ধ করলেই হবে; সিরাজ বললেন নিশারণে ইংরেজ সেনাশিবিরে আক্রমণ করলেই যে সর্বনাশ হবে? মীর জাফর সগর্বে বলে উঠলেন আমরা রয়েছি কেন? মীর জাফরের প্রতারণায় নবাবের আবারও মতিভ্রম হলো। মীর জাফর যে ক্লাইভের পরামর্শে নবাবের সেনাদের যুদ্ধবিরতি করতে বলল তা তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। তিনি মীর জাফরের পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে সেনাদলকে প্রত্যাগমন করার জন্য আদেশ প্রদান করলেন। নবাবের এ সিদ্ধান্ত মোহনলাল মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি তখনও বিপুল বিক্রমে শত্রুসেনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তিনি সমস্বরে বলে উঠলেন “আর দুই চারি দণ্ডের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হবে এখন কি শিবিরে প্রত্যাগমন করার সময়? পদযাত্রা পশ্চাদগামী হলে, সিপাহিদল ছত্রভঙ্গ হয়ে সর্বনাশ হবেÑ ফিরব না যুদ্ধ করব? মীর জাফরের মৌখিক উত্তেজনায় আত্মবিস্মৃত সিরাজউদ্দৌলা পুনরায় মোহনলালকে শিবিরে প্রত্যাগমনের নির্দেশ দিলেন। রাগে ক্ষোভে মোহনলালের নয়ন যুগল হতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বহির্গত হতে লাগল। কিন্তু তিনি আর কী করবেন? গমর ক্ষেত্রে সেনাপতির আদেশ লঙ্ঘন করতে পারলেন না। মীর জাফরের মনস্কামনা পূর্ণ হলো। তিনি তাৎক্ষণাৎ ক্লাইভকে চিঠি লিখে পাঠালেন। “মীর মদন গতায়ু হয়েছে, আর লুকিয়ে থাকা নি®প্রয়োজন। ইচ্ছা হয় এখনই অথবা রাত ৩ ঘটিকার সময় শিবিরে আক্রমণ করবেন, তাহলে সহজে কার্য সিদ্ধি হবে।” মোহন লালকে শিবিরে প্রত্যাগমন করতে দেখে, ইংরেজ সেনা আম্রবন হতে বের হতে লাগল। এতদর্শনে নবাব সেনাদের অনেকই পলায়ন করতে লাগল। কিন্তু ফরাসি বীর সিনফ্রে এবং বাঙালি বীর মোহন লাল ঘুরে দাঁড়ালেন; তাদের সেনাদল হটল না। তারা অকুতোভয়ে অমিতবিক্রমে প্রাণপণে যুদ্ধ করতে লাগলেন। ইতোমধ্যে প্রহসনের অন্যতম নায়ক রায়দুর্লভ তাদের ষড়যন্ত্রের সফলতার দ্বারপ্রান্তে এসে সিপাহি সেনাকে ইতস্তত পলায়ন করতে দেখে সিরাজউদ্দৌলাকেও পলায়ন করার জন্য উত্তেজনা প্রদান করতে লাগলেন। সিরাজ সহসা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পরিত্যাগ না করতে চাইলেও বিপুল সেনা প্রবাহের অল্পলোকই তার জন্য যুদ্ধ করছে এরূপ অবস্থা তার মনে হলো, পলাশীতে পরাজিত না হয়ে রাজধানী রক্ষার জন্য মুর্শিদাবাদে গমন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। মুসলমান ইতিহাস লেখকগণও সিরাজের সমরক্ষেত্র পরিত্যাগকে সমর্থন করেননি। বোধ হয় পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং সেনাপতিদের ষড়যন্ত্র আঁচ করে শেষ পর্যন্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় সিরাজ দুই সহ¯্র অশ্বারোহী নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রাজধানী ফিরে গিয়েছিলেন। অন্য দিকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অবিশ্রান্ত যুদ্ধ করতে করতে মোহনলাল এবং সিনফ্রে বিশ্বাসঘাতক নবাব সেনানায়কদের ওপর বিরক্ত হয়ে সমরক্ষেত্র পরিত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। নবাবের পরিত্যক্ত জনশূন্য পটমণ্ডপের দিকে ইংরেজ সেনা মহাদম্ভে অগ্রসর হয়ে, পলাশী যুদ্ধের শেষ চিত্রপট উদঘাটিত করল। সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে এভাবে প্রায় বিনাযুদ্ধে পলাশী প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল। রাজধানীতে প্রত্যাগমন করতে না করতে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় কাহিনী চারদিকে বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়ল। লুণ্ঠন ভয়ে যে যেখানে পারল পলায়ন করতে আরম্ভ করল। মোগল প্রতাপ তখন ধীরে ধীরে অস্তাচলগামী। ভারতবর্ষের রতœ সিংহাসন বালকের ক্রীড়া কৌতুকে পরিণত হয়েছিল। সিরাজউদ্দৌলার রাজধানী রক্ষার জন্য পাত্র-মিত্রগণকে পুনঃপুন আহবান করতে লাগলেন। অন্যের কথা দূরে থাক এমনকি তার শ্বশুর মো: ইরিচ খান পর্যন্ত সিরাজের আহবানে কর্ণপাত না করে ধন রতœ নিয়ে প্রাণরক্ষার ভয়ে পলায়ন করলেন। সকল দিকের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় পরও ভগ্নমনোরথ না হয়ে সিরাজ নিজেই সেনা সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। গুপ্ত ধনাগার উন্মুক্ত করা হলো প্রভাত হতে সায়াহ্ন এবং সায়াহ্ন হতে প্রথম রাত্রি পর্যন্ত সেনাদলকে উত্তেজিত করার জন্য মুক্ত হস্তে অর্থদান চলতে লাগল। রাজকোষ উন্মুুক্ত পেয়ে শরীররক্ষক সেনাদল যথেষ্ট অর্থ শোষণ করল এবং প্রাণপণে সিংহাসন রক্ষা করবে বলে ধর্ম প্রতিজ্ঞা করে একে একে পলায়ন করতে আরম্ভ করল। শেষ প্রচেষ্টাও বিফল হওয়ায় মাতামহের অতিসাধের হিরাঝিলের বিচিত্র রাজপ্রাসাদ এবং বঙ্গ বিহার-উড়িষ্যার গৌরবময় মোগল রাজসিংহাসন পশ্চাদ রেখে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পথের ফকিরের ন্যায় রাজধানী হতে বের হয়ে পড়লেন। চির সহচরী লুৎফুন্নেসা বেগম ছায়ার ন্যায় পশ্চাতে পশ্চাতে অনুগমন করতে লাগলেন। সিরাজ স্থলপথে ভগবান গোলায় উপনীত হয়ে, তথা হতে নৌকারোহণে পদ্মার প্রবল তরঙ্গ অতিক্রম করে মহানন্দা নদীর ভেতর দিয়ে উজান বেয়ে উত্তরাভিমুখে চলতে আরম্ভ করলেন। সিরাজউদ্দৌলা যে আত্মপ্রাণ তুচ্ছ করে কেবল স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যই জনশূন্য রাজধানী হতে পলায়ন করেছিলেন, তার পলায়ন তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কোনোরূপে পশ্চিমাঞ্চলে পলায়ন করে মাসিয়ে লা সাহেবের সেনাসহকারে পাটনা পর্যন্ত গমন করা ও তথায় বিহারের শাসনকর্তা রামনারায়ণের সেনাবল নিয়ে সিংহাসন রক্ষার আয়োজন করাই সিরাজউদ্দৌলার উদ্দেশ্য ছিল। সিরাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে গিয়ে মহারাজ মোহন লালও কারারুদ্ধ হলেন। মীর জাফর মোহনলালকে বিদ্রোহী সেনা নায়ক রায়দুর্লভের হস্তে সমর্পণ করলেন। মোহন লালকে দীর্ঘকাল কারাক্লেশ ভোগ করতে হলো না। রায়দুর্লভ তার ধনসম্পদ ও জীবনহরণ করে মীর জাফরের আকাক্সক্ষা পূরণ করলেন। ২৯ জুন ২০০ গোরা এবং ৫০০ কালা সিপাহি সমভিব্যাহারে ইংরেজ সেনাপতি মন্সুরগঞ্জ আগমন করেন। ক্লাইভ বলে গেছেন “সে দিন যত লোক রাজ পথের পাশে সমবেত হয়েছিল তারা ইংরেজ নির্মূলে কৃতসঙ্কল্প হলে কেবল লাঠিসোটা এবং ইস্টক নিক্ষেপেই তৎকার্র্য সাধন করতে পারতো।” অতঃপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাইভ মীর জাফরকে মসনদে বসিয়ে দিয়ে, কোম্পানি বাহাদুরের প্রতিনিধিস্বরূপ স্বয়ং সর্বপ্রথমেই ‘নজর’ প্রদান করে মীর জাফরকে বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার নবাব বলে অভিবাদন করলেন। অন্য দিকে সিরাজউদ্দৌলার খোঁজে চারিদিকে সিপাহি সেনা ছুটে চলল। সিরাজের নৌকা যখন বখর বরহাল নামক পুরাতন পল্লীর নিকটবর্তী হলো, তখন সহসা তার গতিরোধ হলো। আকস্মিক দুর্ঘটনায় সিরাজউদ্দৌলার সর্বনাশের সূত্রপাত হলো। সিরাজ ভেবেছিলেন তার পরাজয়বার্তা তখন পর্যন্তও দূর-দূরান্তে পৌঁছায়নি। সে জন্য নদীতীরে অবতরণ করে খাদ্য সংগ্রহের জন্য নিকটস্থ একটি মসজিদে গমন করলেন। সেখানে দানশা নামক এক মুসলমান সাধু ছিল। মসজিদের লোকে ক্ষুদ্র পল্লীতে সিরাজউদ্দৌলার ন্যায় অতিথিপরায়ণ নৌকা দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছিল। মীর দাউদ ও মীর কাশেমের সেনাদল সেদিন সিরাজের খোঁজে নিকটেই অবস্থান করছিলেন। অর্থলোভে লোকেরা তাদেরকে সিরাজউদ্দৌলার সন্ধান বলে দিল। সিরাজ ক্ষুধার অন্ন গলাধঃকরণ করারও অবসর পেলেন না, সপরিবারে মীর কাশেমের হাতে বন্দী হলেন। নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিণতি! ‘এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা, সকালবেলা আমীর রে ভাই, ফকির সন্ধ্যাবেলা, এই তো নদীর খেলা।’ মীর কাশিমের নিকট বন্দী হওয়া অবস্থায় সিরাজ ছিলেন নিরস্ত্র, নিঃসঙ্গ। মীর কাশেম লুৎফুন্নেসা বেগমের বহুমূল্যের রতœালঙ্কারগুলো আত্মসাৎ করলেন। আত্মভৃত্যবর্গের নিষ্ঠুর নির্যাতনে জীবমৃত অবস্থায় সিরাজউদ্দৌলা বন্দীবেশে মুর্শিদাবাদে উপনীত হলেন। সিরাজউদ্দৌলার সুকুমার দেহকান্তি নিষ্ঠুর নির্যাতনে মলিন হয়ে উঠেছিল। তাকে দেখামাত্র নাগরিকদের সহানুভূতি উদ্বেলিত হয়ে উঠল। সিরাজকে তার সাধের মুর্শিদাবাদে আনা হলো। যেখান থেকে বহুবার তিনি হুঙ্কার দিয়েছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আজ স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিকের কী নিদারু

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির