ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারী বর্ষণে হু হু করে বাড়ছে নদীর পানি। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, রংপুর ও কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলাই বন্যাকবলিত। একই সঙ্গে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত থাকায় বিপদসীমার ওপরদিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে বন্যার চরম অবনতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভারতে ৩০টিরও বেশি নদীর অববাহিকা রয়েছে। ভারতের ২৯ রাজ্যের ২২টিরই নদী অববাহিকায় নির্মাণ করা হয়েছে ফারাক্কা ও তিস্তার মতো বড় বড় পাঁচ হাজার বাঁধ। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজার বাঁধ গত ৫০ বছরে নির্মিত। আর বর্ষাকালে সবগুলো নদীর বাঁধের পানি ছেড়ে দেয় ভারত, যার ফলে বাংলাদেশে এখন প্রায় প্রতিবছরই বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ভারত থেকে আসা উজানের পানির ঢলেতে দেশের ৬০ ভাগ অঞ্চল ডুবে যায়। এখন প্রতিবছরই ডুববে এবং এটার পরিধি আরও বাড়বে। ১৮ জেলায় বিস্তৃত বন্যায় আহত হয়েছেন প্রায় ৩ হাজার মানুষ, ক্ষতির শিকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। বন্যায় প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, গত ৬ বছরে যে বন্যা হয়েছে তাতে প্রতিবছর গড়ে বন্যায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমানে বন্যায় প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ জলমগ্ন হয় এবং ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি সমমূল্যের ক্ষতি হয়। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
তবে জলবায়ু বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের বন্যার ভয়াবহতা ও স্থায়িত্ব বেশি। তাই এবারের ক্ষতি আগের যে-কোনো বারের তুলনায় বেশি হবে। বাংলাদেশে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। এর মধ্যে বন্যাই সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি করে। গত ছয় বছরে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার খানার সদস্যরা দুর্যোগের কারণে গড়ে ২১ দিন কর্মহীন ছিলেন। এছাড়াও সিলেটের তৃতীয় দফায় বন্যায় ডুবেছে ৩০০ বছরের পুরনো কালীঘাট আড়ৎ; যার ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। চলতি বছর মে মাস থেকে বন্যার কবলে পড়েছিল দেশের সিলেট, সুনামগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের জন্য এ বছরের বন্যাকে বলা হচ্ছে স্মরণকালের ভয়াবহ। আবহাওয়া অফিস থেকে জানানো হয়েছে, সিলেট সংলগ্ন মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে গত জুন মাসের প্রথম দুসপ্তাহেই সিলেটের উজানের মেঘালয় বেসিনে ১৬৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। যা অতিবৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সিলেটে ১৭ জুন পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১৭০৮ মিলিমিটার। ২০২২ সালের ভয়ঙ্কর বন্যার সময়ও সিলেটে এত বৃষ্টিপাত হয়নি। তখন জুন মাসে সিলেটে বৃষ্টি হয়েছিল ১৪৫৬ মিলিমিটার।
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর ১১০টি পয়েন্টের ৫৯টিতে পানি বেড়েছে। আর ৪৯টিতে কমেছে। বাকিগুলোতে স্থির আছে। লালমনিরহাট জেলায় তিস্তার পানি বেড়েছে। এর ফলে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদী এখন বিপদসীমার কাছাকাছি উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৪৫০টি চরাঞ্চল ইতোমধ্যেই প্লাবিত হয়েছে। তবে নদীর পানিপ্রবাহ এখনো বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে। এদিকে বন্যার পানি উঠায় কুড়িগ্রাম জেলার ৯ উপজেলায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও মাদরাসাসহ প্রায় ৩৪১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান সাময়িক বন্ধ করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় জেলার নদ-নদীর অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে ৭ দিন ধরে বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ। অনেকেই ঘর-বাড়ি ছেড়ে গবাদি পশু নিয়ে উঁচু সড়ক ও বাঁধে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনো খাবার সংকটে পড়েছেন চরাঞ্চলের বন্যাকবলিত মানুষ। পাশাপাশি গবাদি পশুর খাদ্য সংকট নিয়েও বিপাকে পড়েছেন তারা। তবে বানবাসী মানুষের মাঝে সরকারিভাবে কিছু ত্রাণ সহায়তা লক্ষ্য করা গেলেও বেসরকারিভাবে তেমন ত্রাণ সহায়তা দেখা যায়নি। বাকী বন্যাকবলিত ১৭ জেলার মানুষের চিত্রও প্রায় একই রকম।
বাংলাদেশে বন্যার যত কারণ
যেহেতু বন্যার পানিপ্রবাহ শুধুমাত্র মেঘনা নদী দ্বারা বঙ্গোপসাগরে নিষ্কাশিত হয়, এতে সময় লাগে এবং বন্যার সময়কাল দীর্ঘায়িত হয়। এছাড়াও ব্রহ্মপুত্র এবং গঙ্গায় প্রবাহের সমন্বয় দেশের বন্যার পরিমাণের একটি প্রধান নির্ধারক। গত ৫০ বছরের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সাতটি বড় বন্যা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যা বড় হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা একসঙ্গে সক্রিয় হওয়ায় বড় বন্যা হয়। ১৯৮৭ সালে দেশের ৪০ শতাংশের বেশি আর ১৯৮৮ সালে ৬০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়। ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয় ১৯৯৮ সালের বন্যায়। ১৯৮৮ সালে দেশের বাইরে ও ভেতরে ভারী বৃষ্টিপাত, হিমালয় পর্বতে তুষার গলা ও হিমবাহের স্থানান্তর, প্রধান নদীগুলোয় একসঙ্গে পানি বৃদ্ধি, জোয়ার-ভাটাসহ নদীর সমুদ্রমুখী প্রবাহে ধীরগতি ছিল এবং হঠাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অন্যতম প্রধান কারণ। সাধারণত, বাংলাদেশের ভেতর ও বাইরের অতিবৃষ্টি বন্যার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে অতিবৃষ্টির কারণেই এ মাত্রার বন্যা।
বাংলাদেশে বন্যার জন্য দায়ী কয়েকটি ভৌগোলিক এবং জলবায়ু বিষয়ক কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের তিন দিকে পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত: পশ্চিমে রাজমহল পাহাড়, উত্তরে হিমালয় এবং মেঘালয় মালভূমি এবং পূর্বে ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম পাহাড়। এই বিশাল পাহাড়ি এলাকা থেকে বৃষ্টিপাতের প্রবাহ এবং হিমালয়ের তুষার গলে যাওয়া বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে জল প্রবাহ নিয়ে আসে। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৮০ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয়। বন্যার প্রধান উৎস হলো বর্ষার মৌসুমে প্রধান নদীব্যবস্থা ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা এবং মেঘনার প্রবাহ থেকে নদীবন্যা। বাংলাদেশের উচ্চ-তীব্রতা, দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টিপাতের প্রবাহের কারনে ঘন ঘন নদীবন্যা হয়। নদীর নাব্যতা হারিয়ে ফেলার কারনে পানির এই স্রোত বঙ্গোপসাগরে সরে যেতে পারে না যার ফলে স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশের অনেক জায়গায় বন্যা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো, যেমন বাঁধ, ব্যারেজ, রাস্তা এবং হাওর ও বিলের ভেতর দিয়ে রাস্তা, সেতু, কালভার্ট ইত্যাদির অপরিকল্পিত নির্মাণে প্লাবনভূমিতে পানি প্রবাহ ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে এই ধরণের বন্যার প্রভাব বাড়ছে। নদীর তীরের পলি ও নদীর তলদেশ ভরাট এবং প্লাবনভূমিতে জলাভূমি দখল অপ্রত্যাশিত বন্যার একটি প্রধান কারণ। উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো বন্যা নিয়ন্ত্রণে অপরিকল্পিত বাঁধ তৈরি।
এছাড়াও পর্যাপ্ত ড্রেনেজব্যবস্থা ছাড়াই রাস্তা নির্মাণ, পলি, ক্রস-ড্যাম বা মাছ ধরার ক্রিয়াকলাপের কারণে ড্রেনেজ চ্যানেলগুলো বন্ধ করা এবং অপর্যাপ্ত ড্রেনেজব্যবস্থা শহুরে বন্যা বৃদ্ধি করছে। সাম্প্রতিককালে, নদীর তলদেশে পলি পড়া, নদীর দখল এবং অপর্যাপ্ত নিষ্কাশন ক্ষমতার কারণে বন্যার ঘটনাগুলো আরও তীব্র হয়ে উঠছে। নগরায়নের কারণে, মানুষ জলাভূমি (পুকুর, বিল) ভরাট করছে যা পূর্বে প্লাবনভূমিতে বৃষ্টির পানির জন্য জলাধার হিসেবে কাজ করত। মানুষ জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে কঠিন বর্জ্য ফেলে। তাই নদী ও হ্রদের পানিবহন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এগুলো স্থানীয় এলাকায় বন্যার দিকে পরিচালিত করছে, যা মানুষের জীবনকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে, আরও বেশি সংখ্যক মানুষ বন্যাপ্রবণ এলাকায় বসতি স্থাপন করছে, যা তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। ২০০১ জনসংখ্যার আদমশুমারি তথ্য নিয়ে পরিচালিত একটি বিশ্লেষণে জানা গেছে যে প্রায় ৪৫.৫ মিলিয়ন মানুষ মারাত্মক এবং মাঝারি বন্যার মুখোমুখি হয়েছিল।
পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতে সিলেটের বন্যার কারণ
এখন প্রশ্ন উঠেছে, ঢলের পানি কেন সিলেট থেকে দ্রুত সরে দক্ষিণে নেমে যাচ্ছে না? পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কেন? সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যার ভয়াবহতা দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করেছে কোন কারণে? এবিষয়ে পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, ছয় কারণে এবার ভয়াবহ বন্যায় নাজেহাল অবস্থা সিলেট বিভাগের। সেগুলো হলো: ১. সুরমা-কুশিয়া ও কালনি নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা-সংকট, ২. হাওরে অপরিকল্পিত বাঁধ ও স্লুইচগেট নির্মাণ, ৩. হাওর-বিল-ঝিল ভরাট, ৪. নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কাটা। ৫. কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন সড়ক তৈরি করা, ৬. জাফলং এলাকার নদী পাথরে ভরাট হওয়া এবং পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখা।
মেঘের রাজ্য চেরাপুঞ্জি বন্যার কারণ
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিকে বলা হয় মেঘের রাজ্য। এখানে রয়েছে উঁচু পাহাড়, ঝরনা আর সবুজ প্রকৃতি। সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের জন্য বিশ্বের বিখ্যাত স্থান এটি। সিলেটের তামাবিল বর্ডার পেরোলেই মেঘালয় রাজ্য। একসময় প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড বলা হতো চেরাপুঞ্জিকে। এই পর্যটন স্থানটির রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। তৎকালীন বিট্রিশশাসিত ভারতে পাহাড়ি এলাকায় নগর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল ব্রিটিশ কর্মকর্তারা। ১৮২৪ সালে প্রথম বার্মা যুদ্ধের পর ব্রিটিশ চেয়েছিল উত্তর-পূর্ব ভারতে নিজেদের পছন্দের একটা জায়গা বেছে নিতে। ব্রিটিশ কর্মকর্তা ডেভিড স্কট সরেজমিনে পরিভ্রমণের সময় চেরাপুঞ্জিতে হাজির হন। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকার একটি চেরাপুঞ্জিসহ ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে জুন মাসে মাত্র তিন দিনে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে, যা গত ২৭ বছরের মধ্যে তিন দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে বৃষ্টির পানির ঢলের সাথে দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ি বালু-মাটি-পলি জমতে জমতে, হাওর-বিল, নদ-নদী, খাল-ডোবাগুলো প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তলদেশে পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরের খাল-বিল। এরই মধ্যে ভরাট হয়ে অস্তিত্ব হারিয়েছে অনেক খাল-বিল। তাই বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।
নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা-সংকট বন্যার বড় একটি কারণ
দেশের প্রায় সাতশ ছোট-বড় নদীতে প্রতি বছর ২ বিলিয়ন ৪০ কোটি টন পলি পরিবাহিত হয়। এ থেকে নদীগুলোতে প্রায় ৩ কোটি টন পলি জমে থাকে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থা বছরে মাত্র ২ লাখ টন পলি অপসারণ করতে পারে। বাকি পলি মাটি দেশের নদ-নদীগুলোতে জমে থাকে। ইতোমধ্যে পলি পড়ে দেশের নৌপথ অর্ধেকেরও বেশি কমে এসেছে। আর এই পলিমাটির বড় একটি অংশ আসে সিলেট, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের উজানে থাকা ভারতের রাজ্যগুলো থেকে। তাই সিলেট, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের প্রধান প্রধান নদী সুরমা, পদ্মা, তিস্তা, যমুনা, মেঘনা এবং এর শাখা নদীগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। নদীগুলোর গভীরতা কমে যাওয়ায় পানির ধারণ ক্ষমতা ও পানির প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। এছাড়াও প্রতি বছর উজানের ঢলে সীমান্তবর্তী নদীগুলোতে পানির সাথে পলি-মাটি, পাথর ও বালি চলে আসার কারণে নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এতে নদীগুলোর পানিধারণের সক্ষমতা কমে এসেছে। আর তাই প্রতি বছর বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
আইন লঙ্ঘন করে আন্তর্জাতিক নদীতে ভারতের হাজার হাজার বাঁধ-ড্রাম নির্মাণ বন্যার অন্যতম কারণ
ভারতে ৩০টিরও বেশি নদীর অববাহিকা রয়েছে। দেশটির ২৯ রাজ্যের ২২টিরই নদী অববাহিকায় নির্মাণ করা হয়েছে বড় বড় পাঁচ হাজার বাঁধ। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজার বাঁধ গত ৫০ বছরে নির্মিত। আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ম নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক নদীতে ৫ হাজারটি বাঁধ তৈরি করেছে। আর আন্তর্জাতিক নদীতে হাজার হাজার বাঁধ-ড্রাম নির্মাণই এখন বাংলাদেশে বন্যার বড় কারণ। হিমালয়ের ভাটিতে বাংলাদেশের উজানে এসব বাঁধ ছাড়াও আরো এক হাজার বাঁধের নির্মাণকাজ চলছে পুরোদমে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে চিহ্নিত। এসব নদীর উজানে কিছু করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই করতে হবে। কিন্তু ভারত এ আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। এটা তাদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। ভারত গঙ্গায় বহু বাঁধ নির্মাণ করে উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সেচপ্রকল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে পদ্মা ও তার অনেক শাখা নদীই শুকিয়ে গেছে। সেচ সঙ্কটসহ নৌপরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রবাহিত ৫৫টি নদীর উৎস ভারতে। তারা প্রত্যেকটি অভিন্ন নদীতে বাঁধ, পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প, রিজার্ভারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে পানির প্রবাহ আটকে রেখেছে। ফলে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের নদ-নদীতে পরিমাণমতো পানির প্রবাহ থাকছে না। আবার বর্ষা মওসুমে অতিরিক্ত পানিতে বন্যায় ভাসছে বাংলাদেশের মানুষ। ভারত শুধু ফারাক্কা নয়, গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ অন্তত ৩৩ ধরনের মূল অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এর সাথে রয়েছে আনুষঙ্গিক আরো বহু ছোট-বড় কাঠামো। নতুন করে উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকার ৫৩টি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের অনেক বাঁধই পুরোনো, মারাত্মক ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। এ কারণে যে-কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বিবিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ বিষয়টি উঠে এসেছে। ভারত সরকারের সাম্প্রতিক এক জরিপ সূত্রে জানা গেছে, দেশটির ৬০০টি বড় বাঁধ মারাত্মক ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। ২০১১ সালে ভূমিকম্প ও সুনামির পর জাপানে ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুকেন্দ্র মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময় ওই এলাকায় এক হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ ঘটনার পর ভারতের নদীর ওপর নির্মিত বাঁধগুলোর সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
বন্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, আমাদের গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর অববাহিকার মাত্র ১০ শতাংশ বাংলাদেশে। ৯০ শতাংশের বেশি পানি আসে ভারত থেকে। বর্ষা মৌসুমে এই পানি আসার প্রভাবে বন্যা পরিস্থিতি তীব্র হচ্ছে। বর্তমানে আটটি নদীর ২১টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা থাকবে এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। তবে আগস্ট মাসেও বন্যার ঝুঁকি রয়েছে।
বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিশিষ্ট জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, সব ক্ষতি পরিমাপ করা যায় না। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, দোকানপাট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতি হলে সেটা বলা যায়। কিন্তু এ সময়ে মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ আছে, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হয়েছে; এ ধরনের বিভিন্ন ক্ষতি আছে যেটা পরিমাপযোগ্য নয়। তবে বিবিএস কী কী ইন্ডিকেটর নিয়ে ক্ষতি হিসাব করেছে সেটা তারা জানে। তবুও এটা বলা যায়, গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর বন্যার ভয়াবহতা বেশি। তাই ক্ষতিও বেশি হওয়া স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান বলেন, এ নিয়ে দেশের মোট ১৮টি জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ল। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ৭ জুলাই রোববার আন্তমন্ত্রণালয় সভা শেষে প্রতিমন্ত্রী এ কথা জানান। এ বিষয়ে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সিলেট থেকে পানি বের করে দেওয়ার একমাত্র উপায় নদী খনন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সঠিক নকশা ও পদ্ধতিতে সিলেটের নদীগুলো খনন করে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি নির্বিচারে সিলেটে পাহাড়-টিলা কাটা, পুকুর ভরাট থামানো উচিত। বিশেষ করে সিলেট এলাকার পানি বের হওয়ার জন্য যে একটামাত্র পথ আছে, অর্থাৎ কালনী নদী; সেটাকে খনন করলেই দ্রুত বন্যার পানি সরে যেতে পারবে। প্রয়োজনে কিছু সংযোগ খাল যদি তৈরি করা যায়, তাহলেও পানি দ্রুত বের হবে।
প্রতিবছর বন্যায় বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার
বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও খারাপ হবে বলে একটি নতুন সমীক্ষায় জানানো হয়েছে। গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট এবং সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্স প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী কার্বণ নিঃসরণ অব্যাহত থাকলে এবং জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতি বাড়তে থাকলে ২০৭০ থেকে ২০৯৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের নদীপ্রবাহ সর্বনিম্ন ১৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বন্যায় প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ জলমগ্ন হয় এবং ১ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ক্ষতি হয়। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ফলে গুরুতর মানবিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত সংকটেরও আশঙ্কা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত ধরণ, আকস্মিক বন্যার তীব্রতা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে এই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে।
গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বন্যার মানবিক ও অর্থনৈতিক ব্যয়, যা ইতিমধ্যেই অনেক বেশি, তা আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বন্যার কারণে ক্রমবর্ধমান মৃত্যু এবং অর্থনৈতিক ধ্বংস ইতোমধ্যে অনুভূত হয়। ১৯৭১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে, ৭৮টি বন্যায় ৪১ হাজার ৭৮৩ জনের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে এবং মোট ১২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। ২০২২ সালের বন্যায় ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে এবং ৭.৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়েছে, প্রতিবেদনে যোগ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতের বন্যা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের জন্য কম কার্বন নিঃসরণ পথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ মতে, বিগত ছয় (২০১৫-২০২০) বছর বন্যায় দেশে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যার আর্থিক পরিমাণ এক লাখ এক হাজার ৮৮ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে তিনটির বেশি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। ওই জরিপের ফলাফল সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ ডিজাস্টার রিলেটেড স্ট্যাটিসটিকস (বিডিআরএস) ২০২১ : ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ন্যাচারাল ডিজাস্টার পারসপেক্টিভস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। জরিপে আরও ওঠে আসে, ২০২০ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে দুর্যোগে ক্ষতি ব্যাপকভাবে বাড়ে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ক্ষতি হয় ১৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। পরের ছয় বছরে তা ১০ গুণ বেড়ে যায়। তাই এবারের আর্থিক ক্ষতি আগের জরিপের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে।
জরিপ বলছে, গত ছয় বছরে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার খানার সদস্যরা দুর্যোগের কারণে গড়ে ২১ দিন কর্মহীন ছিলেন। আগের ছয় বছরে তা ছিল গড়ে ১২ দিন। দুর্যোগের কারণে শিক্ষাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জরিপে দেখা যায়, ২০২০ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে শিশুদের স্কুলে অনুপস্থিতির প্রধান কারণ ছিল অসুস্থতা ও আহত হওয়া। এর হার ছিল ৭২ শতাংশ। এর বাইরে যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি ও বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণেও শিশুরা স্কুলে যেতে পারেনি। ২০১৫-২০ সালের দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে জরিপ করা হয়েছিল। সেখানে গত ছয় বছরে দুর্যোগে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির তথ্য উঠে এসেছিল, যা বছরে গড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা পড়ে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশই ছিল বন্যায় ক্ষতি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড হাওরের উন্নয়নে ব্যয় করেছে প্রায় হাজার কোটি টাকা, তারপরও বন্যা কেন?
হাওর অধিদপ্তরের লক্ষ্য হলো হাওর ও জলাভূমি অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, বন্যা ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা। কিন্তু তারা সেই কাজের পরিকল্পনা অনুযায়ী ১ শতাংশও করতে পারেনি। সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডও (পাউবো) বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করে থাকে। সুনামগঞ্জসহ পাঁচটি জেলার ২৯টি হাওরে প্রায় ৯৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হাওর অঞ্চলের বন্যা ব্যবস্থাপনা ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পাউবো। তারপরও কেন বন্যা এই সেই প্রশ্ন সিলেট বিভাগের মানুষের। সেই টাকা গেল কোথায়? যদি এলাকার উন্নয়নে সেই টাকা ব্যয় হতো তবে তো বন্যা হওয়ার কথা না!
এছাড়াও হাওর উন্নয়নে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। আবারও একই প্রশ্ন- হাওরাঞ্চলের উন্নয়নে এতো টাকা ব্যয় হলে সেই অঞ্চলে বন্যা হবে কেন? স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘হাওর এলাকায় উড়াল সড়ক ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন’ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি ২০২১ সালে ২৩ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়, যা নভেম্বর ২০২১ থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদে বাস্তবায়ন হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর। এতে সুনামগঞ্জে বর্ষার সময়ও জেলার প্রতিটি উপজেলার সঙ্গে যেমন সংযোগ স্থাপন সম্ভব হবে, তেমনি নেত্রকোনার সঙ্গেও সুনামগঞ্জের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। দেশের হাওর, বাওড় ও জলাভূমি উন্নয়নে সরকার ২০১২ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ২০ বছরের একটি মাস্টারপ্ল্যান করেছে। সেটির আলোকে বর্তমান ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১২ বছরে মাত্র এক শতাংশ কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে। অন্যদিকে হাওরের উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১২টি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের নিয়ে ২৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি জাতীয় কমিটিও করা আছে। কমিটিকে প্রতি ৩ মাস অন্তর একটি মিটিং করে কাজের অগ্রগতি জানানোর কথা। কিন্তু সেই কমিটি ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মাত্র একটি মিটিং করেছে। এতে হাওর, বাওড় ও জলাভূমি উন্নয়নের লক্ষ্যে যে কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছিল তা বেশি অগ্রসর হয়নি। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এসব তথ্য জানা গেছে।
বন্যা থেকে বাঁচার বা প্রতিকারের উপায় কী কী? বন্যার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে সংকটাপন্ন। দেশের কতগুলো অঞ্চল প্রায় ৪ মাসের মতো প্লাবিত হয়ে আছে বন্যার কারণে। সবকিছু হারিয়ে তারা হয়ে পড়েছে বড়ই অসহায়। চতুর্থ মেয়াদে বাড়ছে দেশের বন্যার সময়কাল। মানুষের সাধারণ জীবন পরিণত হচ্ছে কষ্ট আর যন্ত্রণাময়। বন্যার কারণে চারদিকে দেখা যায় হাহাকার। খাদ্য ও পানির অভাব সব থেকে বেশি দেখা যায়।
১. বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত বেশকিছু ভাঙনরোধী উন্নয়ন প্রকল্প বর্তমানে ভাঙনের কবলে পড়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : পাবনা সেচ পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প, ভোলা সেচ প্রকল্প, কোস্টাল অ্যামব্যাঙ্কমেন্ট প্রজেক্ট (সিইপি), চাঁদপুর সেচ প্রকল্প এবং ব্রহ্মপুত্র ডান তীর বাঁধ। বাঁধ রক্ষার্থে কার্যকর প্রদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
২. বাংলাদেশের অসংখ্য নদী-নালায় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রবল বর্ষা এবং হিমালয় পর্বতের বরফ গলা পানি ও তার অববাহিকার নদ-নদীসমূহের পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নদীর অনাব্য ও উজানের পানি বন্যা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। বন্যা সৃষ্টির পিছে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুই কারণই বিরাজমান। অবিরাম বৃষ্টিপাত, ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া, গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রতিক্রিয়া, জোয়ার ভাটার বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া ছাড়াও আরো অনেক প্রাকৃতিক কারণ আছে। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি রয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট কিছু কারণ যেখানে মানুষের অবাধ অনিয়ম ও বর্বরতার কারণে বন্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রতি বছর নদীর পানি নিষ্কাশন পথ ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়। নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে রাস্তা বা বসতবাড়ি নির্মাণ, বনভূমি ধ্বংস করা ইত্যাদি।
৩. উপকূলীয় এলাকার বাঁধগুলোর উচ্চতা বৃদ্ধি বর্তমানে অত্যাবশ্যক।
৪. বাঁধ থেকে মাটি কাটা বন্ধ ও রক্ষায় প্রশাসনকে আইনগতভাবে শক্ত হতে হবে।
৫. নদীর তীর ঘেঁষে বেড়িবাঁধ (Dyke বা ডাইক), বন্যাপ্রাচীর (Floodwall বা ফ্লাডওয়াল), উপকূলীয় প্লাবন প্রতিরোধের জন্য সমুদ্রপ্রাচীর (Seawall বা সি-ওয়াল), বাঁধ (Dam বা ড্যাম), নদীবক্ষ বাঁধ (Weir বা উইয়ার) ও জলাধার (Reservoir বা রিজার্ভয়ার) নির্মাণ এবং জনবহুল এলাকা থেকে বন্যার পানির গতিপথ ঘোরানোর জন্য ভাটিতে কৃত্রিম প্লাবনপথ (Floodway বা ফ্লাডওয়ে) ও নিষ্কাশন খাল (Drainage canal) নির্মাণ। সমুদ্রতট পুষ্টকরণ (Beach nourishment) ও প্রতিবন্ধক দ্বীপপুঞ্জ (Barrier islands) ব্যবহার করা হয়। এছাড়া নদীর খাতের উন্নতিসাধন (Channel improvement) আরেক শ্রেণীর সমাধান, অগভীর নদীর তলদেশের পলিকাটা-র (Dredging বা ড্রেজিং) মাধ্যমে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি, নদীর প্রশস্ততা বর্ধন, আঁকা-বাঁকা প্যাঁচানো নদীর প্যাঁচ বন্ধ করে দিয়ে পানির গতিপথ সরলরেখায় নিয়ে আসা ইত্যাদি কাজ করে নদীর ভেতর দিয়ে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা যায়। এছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ন হ্রাস এবং জলাভূমি, তৃণভূমি ও বনভূমি সংরক্ষণ করার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পানি শোষণের সুবন্দোবস্ত করে বন্যার পৃষ্ঠগড়ানো পানির (run-off water) প্রবাহ হ্রাস করা যায়। এইসব পদ্ধতির মূলত তিনটি লক্ষ্য থাকে- ক.বন্যাপ্লাবিত ভূমির আয়তন হ্রাস করা খ.বন্যার স্থায়িত্বকাল হ্রাস করা এবং গ.বন্যার পানির প্রবাহের সর্বোচ্চ নির্গমহার হ্রাস করা।
৬. সর্বোপরি আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ এমন একটি বদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত যা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার মতো তিনটি শক্তিশালী নদীর সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে। এ তিনটি নদীর সম্মিলিত ক্যাচমেন্ট ১৭ লাখ ৫৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত; যা বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ১২ গুণ। প্রতি বছর প্রায় দুই বিলিয়ন টন বালুকণা এ নদীগুলোর মধ্য দিয়ে এসে বঙ্গোপসাগরে পড়ে, যার পরিমাণ পৃথিবীর অন্য যে কোনো নদীর থেকে অনেক বেশি। এই পলিমাটি অপসারণ করে সাগরে দ্বীপপুঞ্জ সৃষ্টি করতে পারলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটাই সম্ভব হবে।
৭. এছাড়াও ভবিষ্যতে বন্যা থেকে রেহাই পেতে সিলেট বিভাগ এবং সিলেট মহানগরকে বন্যার কবল থেকে বাঁচাতে হলে কার্যকরভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে- ক. সুরমা, কালনী এবং কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদ-নদী খনন করা জরুরি। খ. এছাড়া সিলেট নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছড়াগুলো (প্রাকৃতিক) দখলমুক্ত করে খনন করে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ নিশ্চিত করা দরকার। গ. দ্রুত পানি নেমে যাবার জন্য কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন সড়কে অন্তত আরো ২০টি ছোট-বড় সেতু নির্মাণ করতে হবে। ঘ. জাফলং এলাকার নদীগুলো থেকে সনাতন পদ্ধতি পাথর উত্তোলন শুরু করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। ঙ. নদীর তীরে অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজ বন্ধ এবং নদীশাসনের নামে নদী-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। চ. অকারণে যত্রতত্র স্লুইসগেট ও অবকাঠামো নির্মাণ করে হাওর ও নদীর পানি প্রবাহপথ বন্ধ করা যাবে না। ছ. নদী দখলমুক্ত করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। জ. ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাত হলে যেন পানির বাড়তি চাপ ধারণ করতে পারে, এ জন্য বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড় ও জলাধার খনন করতে হবে। ঝ. বেশি পরিমাণে পানিধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন গভীর লেক-জলাধার খনন করতে হবে। ঞ.কিছু সংযোগ খাল তৈরি করা। তাহলেও পানি দ্রুত বের হবে।
পরিশেষে, দেশের সাত জেলায় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে। এই সাত জেলায় ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর জায়গাজুড়ে মোট ৩৭৩টি হাওর অবস্থিত। আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি হাওর রয়েছে সুনামগঞ্জে। এই জেলায় ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩১ হেক্টর ভূমিতে ৯৫টি হাওর রয়েছে। এছাড়া সিলেটে ১০৫, হবিগঞ্জে ১৪, মৌলভীবাজারে ৩, নেত্রকোনায় ৫২, কিশোরগঞ্জে ৯৭ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭টি হাওর রয়েছে। এই সবগুলো হাওরেরই তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে এই হাওরগুলো খনন করা জরুরি বন্যার পানি ধরে রাখার জন্য। ফসল রক্ষায় হাওরের চারপাশে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। হাওরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করতে হবে এবং এইসব নদীগুলো খনন করতে হবে। ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানির প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হওয়ায় এইভাবে সিলেট অঞ্চলে অসংখ্য বাধেঁর কারণে এখন বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যা হওয়াটা এখন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দেশে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি বন্যায় কোটি কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাহাড়ি ঢল, আন্তসীমান্ত নদীর পানি, অপরিকল্পিত অবকাঠামো, নদী দখল ও টেকসই বাঁধের অভাবে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। বন্যার মধ্যেই মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে শুরু হয়েছে তীব্র নদীভাঙন। বন্যার পূর্বাভাসে শুধু নদ-নদীর পানি বাড়া-কমা ও বিপদসীমার ওপর প্রবাহিত হবে কি না এটাই বলে। কিন্তু কোন এলাকায় কোন ফসলের ক্ষেত ভাসবে, কোন গ্রাম তলিয়ে যাবে, এগুলোর তথ্য আমাদের কাছে নেই। অথচ আমরা জানি প্রতি বছর দেশে বন্যা হবে। জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসাইন খান বলেন, ‘বর্ষায় বন্যা এখন দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে। বন্যা কখন আসবে, কী পরিমাণে পানি আসবে, কোন চ্যানেল দিয়ে আসবে- এ তথ্যটা আমরা যথাযথভাবে পাচ্ছি না। ভারত কোন সময় পানি ছাড়বে, আবার কোন সময় আটকাচ্ছে, সেটা নিয়ে আমাদের যৌথ নদী কমিশন কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখে না। তাই আমরা বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে পারছি না। বন্যায় প্রাণহানির পাশাপাশি বাড়িঘর ধসে পড়া, রাস্তাঘাট বন্ধ, গবাদি পশুর ক্ষতি এবং ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য সব ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
লেখক : সাংবাদিক
আপনার মন্তব্য লিখুন