মহান আল্লাহ তায়ালার সকল সৃষ্টি ইচ্ছা ও অনিচ্ছায় মহান রবের বিধান মেনে চলছে। এমনকি তাদের ছায়াগুলো সকাল ও সন্ধ্যায় সিজদায় অবনত হচ্ছে। মানুষের ক্ষেত্রে ইবাদতের বা তার সকল কর্মের স্বাধীনতা আছে। তবে সেই স্বাধীনতার সীমা নির্ধারণ করে দেয়া আছে- যেটাকে আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত সীমারেখা বলা হয়েছে। সেই সীমারেখার পর সহজ ও সাবলীল ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্যের বিষয়টি। বলা হয়েছে আনুগত্য এবং সীমারেখার মধ্যে জীবনযাপনে রয়েছে প্রতিদান। কেউ ইচ্ছে করলে সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে- কিন্তু এর জন্য রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থাও। মুমিনের সকল আমল আল্লাহ তায়ালার জন্য নিবেদিত থাকে। সেখানে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না। জাগতিক কোনো কামনা বা উদ্দেশ্যে ইবাদত হতে পারে না। পবিত্র কুরআনুল কারীমে একনিষ্ঠতার সাথে এবাদত করতে বলা হয়েছে “আর তাদেরকে এ নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে যে তারা যেন আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করে তার জন্যই দ্বৗনকে একনিষ্ঠ করে এবং সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে আর এটাই সঠিক দ্বীন।” (সূরা বাইয়্যিনাহ : ৫) দুনিয়ায় কোনো পার্থিব স্বার্থে রবের ইবাদাত করাকে নিন্দনীয় বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিরক সাব্যস্ত করা হয়েছে। নবী সা. বলেছেন যে ‘ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করল সে শিরক করল আর যে ব্যক্তি কাউকে দেখানোর উদ্দেশ্যে সিয়াম পালন করল সে শিরক করল এবং যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে দান-সাদাকাহ করল সে শিরক করলো। (মুসনাদে আহমদ) মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদাতের স্থান ইসলামে নেই। যেটাকে প্রদর্শনেচ্ছা বা রিয়া বলা হয়ে থাকে। কোনো ইবাদাতের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও একনিষ্ঠতা বাদে মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে করা হলো প্রদর্শনেচ্ছা। প্রদর্শনেচ্ছার কারণে ব্যক্তির নিজে, সংগঠিত জামায়াত বা দল এবং সামগ্রিকভাবে গোটা উম্মাহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। ব্যক্তি যখন প্রদর্শনেচ্ছার মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয় তখন কোনো কাজের চেয়ে কাজের প্রচার বিজ্ঞাপন নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এটাকেই সবচাইতে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। প্রদর্শনেচ্ছায় আক্রান্ত ব্যক্তি সকল কাজে প্রচারকে অগ্রাধিকার দেয় না বরং সে অন্যের ভালো-মন্দের অনুমানকারীতে পরিণত হয়। ইসলাম অনুমানভিত্তিক কথা বলাকে সমর্থন দেয় নি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে “হে ঈমানদারগণ, বেশি ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো কারণ কোনো কোনো ধারণা ও অনুমান গোনাহ। দোষ অন্বেষণ করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো গিবত না করে। এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ অধিক পরিমাণে তাওবা কবুলকারী এবং দয়ালু।” (আল-হুজুরাত : ১২) ইসলাম যেটাকে মস্ত-বড় অপরাধ বলছে সেখানে ব্যক্তি এই অপরাধকে সহজেই গ্রহণ করতে পারে না। বিশেষ করে একজন মুমিনের জন্য কখনো তা শোভনীয় নয়। নবী সা. বলেছেন ‘যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে তাই দেখাবে অর্থাৎ প্রদর্শনীমূলক আমল করলে তা প্রচার করে দেখানো হবে। সুনাম সুখ্যাতি অন্বেষণের উদ্দেশ্যে যে লোক আমল করবে আল্লাহ তায়ালা তার আমল (দোষ ত্রুটিগুলো) প্রচার করে দেবেন।’ (ইবনে মাজাহ-৪২০৬) ব্যক্তি যখন লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করে আল্লাহ তায়ালা তার কর্মের খারাপ বা ত্রুটি প্রচার করেন। হাদিসে বর্ণিত আছে আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন হিসাব নিকাশের জন্য যে ব্যক্তিদের সর্বপ্রথম ডাকা হবে তারা হলেন কুরআনের হাফেজ, আল্লাহ তায়ালার পথে শহীদ ও ধনী ব্যক্তি। এই তিনজনই সর্বপ্রথম জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এটাই প্রমাণিত হবে যে তারা দুনিয়াতে নিজেদেরকে বিশেষ নামে পরিচিত করতে বা বিশেষ নামে সবাই ডাকুক এইজন্য কুরআনের হাফেজ, শহীদ ও সম্পদওয়ালা হয়েছিল। ব্যক্তির উদ্দেশ্য যদি নিজের খ্যাতির, প্রচার ও প্রসারের জন্য হয় তবে সেটা ব্যক্তির জন্য ক্ষতির কারণ হবে। রাসূল সা. কুরআনের পাঠককেও সতর্ক করেছেন। আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমরা আল্লাহ তায়ালার নিকট জুব্বুল হুযন হতে আশ্রয় প্রার্থনা কর। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! জুব্বুল হুযন কী? রাসূল সা. বললেন: তা হলো জাহান্নামের মধ্যকার একটি উপত্যকা, যা থেকে স্বয়ং জাহান্নামও প্রতিদিন শতবার আশ্রয় প্রার্থনা করে। প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! তাতে কে প্রবেশ করবে? রাসূল সা. বললেন: যেসব কুরআন পাঠক লোকদেখানোর জন্য আমল করে। (ইবনু মাজাহ-২৫৬) হাদিসের মান দুর্বল হলেও অন্যান্য হাদিসে এ ধরনের প্রদর্শনেচ্ছামূলক কাজ ব্যক্তির জন্য শাস্তির কারণ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ের সকল প্রদর্শন যদি বন্ধ করা হয় তবে সেটা ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর। পবিত্র কুরআনে নামাজের মতো ইবাদতও একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্যই আদায় করতে মানুষকে সাবধান করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “কাজেই দুর্ভোগ সে সালাত আদায়কারীদের জন্য, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন। যারা লোকদেখানোর জন্য তা করে।” (সূরা মাউন : ৪-৬) প্রদর্শনেচ্ছা যেন বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পৃথিবীব্যাপী শ্রেষ্ঠ প্রদর্শনেচ্ছাস্থলে পরিণত হয়েছে। যার কারণে ব্যক্তি পরকালীন ক্ষতির পাশাপাশি দুনিয়াতেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। - ব্যক্তির আত্মমর্যাদা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অসন্তোষজনক বা ব্যক্তি ইমেজ সঙ্কটে পতিত হয়। - প্রদর্শনেচ্ছার কারণে ব্যক্তি নিজের অজান্তেই মিথ্যার লালন করেন। নিজের প্রয়োজনে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে ধোঁয়াশায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। প্রচার ও প্রসার ব্যক্তিকে অস্বাভাবিক আচরণে অভ্যস্ত করে। অধিকাংশ সময় কৃত্রিম আচরণ করে। প্রদর্শনেচ্ছা অধিক ফলপ্রাপ্তিতে উৎসাহ দেয় এবং নিজের কল্যাণই মুখ্য বিষয়ে পরিণত করে। ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত সকল ইবাদাতের মাধ্যমে অর্জিত বিশেষ যোগ্যতা ও বারাকাহ হতে বঞ্চিত হয়। কবিরা গুনাহের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। প্রদর্শনেচ্ছা যখন কোনো সংগঠিত দলের মাঝে পরিলক্ষিত হয় তখন সে জামায়াত বা দল মূল লক্ষ্য হতে ধীরে ধীরে সরে আসে। প্রদর্শনেচ্ছা যদি ইসলামী আন্দোলনরত জামায়াতের মাঝে দেখা দেয় তবে সেটা ত্বরিত সমাধান করা বাঞ্ছনীয়। নচেৎ প্রদর্শনেচ্ছার প্রভাবে ইসলাম-পরিপন্থী বিধান হয়ে যেতে পারে আদর্শ। জামায়াত বা দলের জনশক্তিদের মধ্যে মৌলিক ইবাদতের পদ্ধতি, ইবাদতের মাধ্যমে অর্জিত রূহানিয়াত ও কল্যাণবিমুখ প্রতিযোগিতা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। নিজ জনবলের মধ্যে গড়ে উঠতে পারে আদর্শচ্যুত মূল্যবোধ। পারস্পরিক অনৈক্য ও ভ্রাতৃত্বহীন জামায়াত। আর নিজেদের মাঝে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনহীন জামায়াত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারে না, সামান্যতম আঘাতে হয়ে যেতে পারে বিভাজনের মতো পরিস্থিতি। শুধুমাত্র প্রচার ও প্রসার দলের অনেক আদর্শ পুরুষ মনুষ্যত্বহীনতার সর্বনিম্ন প্রান্তে উপনীত করতে পারে। হয়ে উঠতে পারে লোভী ও স্বার্থপূজারি। সেই সাথে একেকজন ব্যক্তি মন্দ কাজের প্রতিযোগিতায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতে পারে। ইসলাম যেখানে প্রদর্শনেচ্ছাকে জঘন্য কাজ বলে সাব্যস্ত করছে সেখানে ইসলামী জামায়াতের মধ্যে প্রদর্শনেচ্ছা প্রবেশ গ্রহণীয় হতে পারে না। রাসূল সা. তাঁর সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আমরকে জিহাদ বিষয়ে অবহিত করতে গিয়ে প্রদর্শনেচ্ছাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। রাসূল সা. বলেন, যদি তুমি প্রদর্শনেচ্ছা ও সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করো তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তোমাকে রিয়াকারী ও সম্পদ লোভী করে উপস্থিত করবেন। (আবু দাউদ-২৫১৯) প্রদর্শনেচ্ছা ব্যক্তি ও জামায়াতের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। উম্মাহর হাজারও বিভক্তি হওয়ার পেছনের কারণ ব্যক্তির প্রচার ও প্রসার হতে সৃষ্ট মতভেদ ও জামায়াত বা দলের মাধ্যমে সৃষ্ট ঐক্যহীন বক্তব্য। প্রদর্শনেচ্ছার ভয়াল থাবায় তৈরি হয়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হাজার দল ও উপদল। যথাসাধ্য উপায়ে এই রোগ হতে উম্মাহকে মুক্ত করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। প্রদর্শনেচ্ছা-মুক্ত উম্মাহ গঠনের জন্য প্রয়োজন সাদামাটা জীবন যাপন ও ইবাদতে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি। রাসূল সা. তার হজ্জ পালন কালীন সময়ে যেন প্রদর্শনেচ্ছা না আসে সে ব্যাপারে তিনি সচেতন ছিলেন, আনাস ইবনে মালেক রা: থেকে বর্ণিত হাদিস হতে তার বণর্না পায়। “নবী সা. (উটের পিঠে) একটি পুরাতন জিন ও পালানে উপবিষ্ট অবস্থায় হজ্জ করেন। তাঁর পরিধানে ছিল একটি চাদর যার মূল্য চার দিরহাম বা তারও কম। অতঃপর তিনি বলেন: হে আল্লাহ! এ এমন হজ্জ, যাতে কোন প্রদর্শনেচ্ছা বা প্রচারেচ্ছা নেই। (ইবনে মাজাহ-২৮৯০) মাওলানা মওদূদী (রহ) প্রদর্শনেচ্ছা হতে রেহাই পাওয়ার জন্য ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী বইয়ে দুইটি উপায় বলেছেন- ‘ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা-ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে প্রচেষ্টা চালাতে হবে তার পদ্ধতি হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তিকে অত্যন্ত সংগোপনে চুপে চুপে কিছু না কিছু সৎকাজ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিজের মনোজগৎ বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যে, সে ঐ গোপন সৎকাজগুলোর ও জনসমক্ষে প্রকাশিত সৎকাজগুলোর মধ্যে কোনগুলোর ব্যাপারে অধিক আকর্ষণ অনুভব করে। যদি দ্বিতীয়টির সাথে অধিক আকর্ষণ অনুভূত হয়ে থাকে, তাহলে তাকে সঙ্গে সঙ্গেই সাবধান হওয়া দরকার যে, প্রদর্শনেচ্ছা তার মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। এবং এজন্য খোদার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে মনের এ অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে। সামষ্টিক প্রচেষ্টার পদ্ধতি হচ্ছে দল নিজের সীমানার মধ্যে প্রদর্শনেচ্ছাকে কোনো প্রকারে ঠাঁই দেবে না। কাজের প্রকাশ ও প্রচারকে যথার্থ প্রয়োজন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখবে। প্রদর্শনেচ্ছার সামান্যতম প্রভাবও যেখানে অনুভূত হবে সেখানে তৎক্ষণাৎ তার পথ রোধ করবে।’ দ্বীনের প্রয়োজনে বর্তমান সময়ে কিছু কাজের প্রচার গ্রহণীয় হলেও ব্যক্তি যেন এটাকে কোনভাবেই বেশি গুরুত্ব না দেয় তার দিকে খেয়াল রাখা দরকার। এক হাত দিয়ে দান করলে অন্য হাত যেন না বুঝতে পারে এই নীতি অবলম্বন করা উচিত। লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, ছাত্র সংবাদ
আপনার মন্তব্য লিখুন