post

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মনীষীদের দৃষ্টিতে আল

মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্

১৬ মে ২০২২

বিশ্বমানবতার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য আল্লাহ তায়ালা সময়ে সময়ে তাঁর প্রত্যাদেশ সংবলিত বিভিন্ন সহিফা এবং ধর্মগ্রন্থ পৃথিবীতে নাজিল করেছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই কালের বিবর্তনে এখন আর অবশিষ্ট নেই, কিংবা বিকৃতির আবর্তে হারিয়ে গেছে। একমাত্র ইহ ও পারলৌকিক জ্ঞানের উৎস আল-কুরআনই সকল পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সম্ভাবনার প্রাচীর ডিঙিয়ে বিগত সাড়ে চৌদ্দশত বছরের ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে আমাদের সময় পর্যন্ত এসেছে। আল্লাহ্ পাকের বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষিত হয়ে স্বীয় বৈশিষ্ট্য ও সর্বজনীন আদর্শের আবেদন নিয়ে অনন্তকাল বহাল থাকবে।
আল-কুরআনকে সকল আসমানি কিতাবের সামষ্টিক রূপ বলা চলে। কেননা, এখানে যাবুরের মত দোয়ার ভাণ্ডার রয়েছে। ইঞ্জিলে বর্ণিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলির মত এখানে রয়েছে শাসক-স¤্রাটদের কাহিনী, নবী-রাসূলগণের ঘটনাবলি এবং নানা ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তের বিরাট সব অধ্যায়। মানবজাতির জীবন পরিচালনার জন্য এতে রয়েছে তাওরাতের মত শরিয়ত বা জীবনবিধান। অনাগত ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও আল-কুরআনে বহু ভবিষ্যদ্বাণী ও তথ্যবহুল আলোচনা আমরা পাই।
আল-কুরআন এমন অলৌকিক অপ্রতিদ্বন্দ্বী গ্রন্থ, যা সর্বপ্রথম যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির সাথে ধর্মের সামঞ্জস্য বিধান করেছে। যুক্তি-তর্ক, দর্শন এবং বিজ্ঞানের জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়গুলোর অত্যন্ত সহজ-সরল ব্যাখ্যা আমাদের সামনে পেশ করেছে।
দি হিস্ট্রি অব অ্যারাবস গ্রন্থের ভূমিকায় বলা হয়েছে- The Quran is the most widely read book ever written.
অর্থাৎ- কুরআনের মত এত বেশি ব্যাপকভাবে অন্য কোন লিখিত গ্রন্থ পঠিত হয়নি।
বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানই এটা আবশ্যিকভাবে পড়ে থাকে। একজন খাঁটি মুসলমানের নিকট কুরআন পাঠের ঊর্ধ্বে আর কোনো পাঠই নেই।
কুরআন সর্বজ্ঞানের আকর। কুরআন মুসলমানদের জীবনপথের দিশারি। ইসলামী আদর্শের চূড়ান্ত লক্ষ্য কুরআনে সন্নিবিষ্ট। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও জীবন দর্শনের মহামূল্য তথ্যে ও সত্যে এটা ভরপুর।
‘মহাজ্ঞান ভাণ্ডার কুরআন’ প্রসঙ্গে একজন ফরাসি দার্শনিক বলেছেন, "The Quran may well be regarded as an Academy of Science for the scientists, a lexicon for the etymologists, a grammar book for the grammarians, a book of prosody for poets and encyclopedia of laws and legislation. Indeed, no other book anterior to Quran could be held equal to a single chapter thereof."
অর্থাৎ- পবিত্র কুরআনকে ভালোভাবেই বলা যায় যে এটি বিজ্ঞানীদের জন্য বিজ্ঞানের একটি বিদ্যায়তন, শব্দ ব্যুৎপত্তিতে দক্ষ পণ্ডিতদের জন্য একটি অভিধান, ব্যাকরণবিদদের জন্য একটি ব্যাকরণের বই, কবিদের জন্য ছন্দালঙ্কার বই এবং এই কুরআন আইন প্রণয়নের একটি বিশাল বিধিমালার তথ্যকোষ। প্রকৃতপক্ষে, পূর্ববর্তী কোন গ্রন্থ এই কুরআনের শুধুমাত্র একটি সূরারও সমতুল্য বলে ধরা যাবে না।
কুরআন শুধু ধর্মীয় জ্ঞান বা আধ্যাত্মিক শিক্ষার ভাণ্ডারই নয়, এতে রয়েছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ-রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মানবজাতির সকল কর্মকাণ্ডের জন্য সুস্পষ্ট ও সর্বজনীন আদর্শ বা দিকনির্দেশনা। এই মহাসত্যকে উপলব্ধি করেই প্রাচ্য-প্রতীচ্যের অমুসলিম মনীষী এবং চিন্তাবিদগণ আল-কুরআন সম্বন্ধে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন, যা বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন ভাষায় লিপিবদ্ধ আছে।
১. মহাত্মা গান্ধী তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া গ্রন্থে লেখেন : আল-কুরআন একটি ঐশী গ্রন্থ। আমি আল-কুরআনের শিক্ষা ও দর্শনের ওপর পড়াশোনা করেছি। একে ঐশী গ্রন্থ বলে গ্রহণ করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। আমার কাছে এ গ্রন্থের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে এ দিকটাকেই বেশি প্রতীয়মান হয়েছে যে, মানব প্রকৃতির সঙ্গে এর বিধানাবলির আশ্চর্য মিল পাওয়া যায়।
২. বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন : আল-কুরআন মানবজগতের সংস্কারক, আধ্যাত্মিক নির্দেশনা এবং জ্ঞানগর্ভ তথ্যে সমৃদ্ধ এক মহাগ্রন্থ; মানব সভ্যতায় এক বিস্ময়কর সংস্কার সাধন করেছে। যে সকল মনীষী এর মর্ম এবং অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের সন্ধান পেয়েছেন, তাঁরাই এ সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন যে, কুরআন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন। মানবজীবনের যে কোন সমস্যাই এর কাছে নিয়ে যাওয়া হোক না কেন, কুরআন তার সমাধান বের করবেই।
৩. মি. ভূপেন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন : কুরআন একটি আদর্শ। দীর্ঘ ১৪০০ বছর পরও কুরআনি শিক্ষার প্রভাব এত বেশি শক্তিশালী যে, নিচবংশের একজন নগণ্য লোকও ইসলাম গ্রহণ করার পর বড় বড় খান্দানি মুসলমানের সমপর্যায়ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
৪. খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক বাবু চন্দ্রলাল লিখেছেন : আল-কুরআন সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের পতাকাবাহী। কুরআনের শিক্ষায় হিন্দুদের মতো জাতপাতের ব্যবধান নেই, যেখানে কাউকে শুধু কুলীন বা উচ্চ বংশীয় হওয়ার কারণে শ্রেষ্ঠ মনে করা হয়।
৫. ভারতীয় গবেষক লালা লাজপত রায় বলেছেন : আল-কুরআন আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক শিক্ষক। আমি ইসলমাকে ভালোবাসি এবং ইসলামের নবীকে মহাপুরুষ বলে জানি। আমি আন্তরিকভাবে কুরআনের চারিত্রিক, সামাজিক রাজনৈতিক আচরণগত এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রশংসা করি এবং ইসলামের ঐ নৈতিক-বৈশিষ্ট্যকেই সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করি, যা হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর যুগে ছিল।
৬. স্যার উইলিয়াম মূর বলেছেন : আল-কুরআন অপরিবর্তনীয়। এর কোনো অংশ, কোনো পরিচ্ছেদ, এমনকি কোনো শব্দ বা অক্ষরও এমন শোনা যায়নি যে, কোনো সঙ্কলক একে বাদ দিয়েছেন কিংবা কেউ এর মধ্যে কোনো নতুন শব্দ বা বাক্য ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এমন নজির কোথাও পাওয়া যাবে না। যদি এমন কোনো ঘটনা হতো, তাহলে অবশ্যই তা হাদিসের কোনো গ্রন্থে পাওয়া যেত। যেখানে ইসলামের নবীর ছোট ছোট উক্তি ও সামান্য ঘটনার কথা সংরক্ষিত।
৭. বিশিষ্ট গবেষক জর্জ বিল লিখেছেন : আল-কুরআন অলৌকিক গ্রন্থ। নিঃসন্দেহে আল-কুরআন আরবি ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। কোনো মহামানবের জ্ঞান ও মেধা এই ধরনের গ্রন্থ রচনা করতে সক্ষম নয়। মৃত প্রাণীকে জীবিত করার চেয়েও কঠিন, দুঃসাধ্য ও অলৌকিক এই গ্রন্থ।
৮. খ্রিস্টান ঐতিহাসিক মি. বাড়লে বলেন : আল-কুরআন বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এটাই একমাত্র গ্রন্থ, যার মধ্যে তেরশো বছরেও কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন সংঘটিত হয়নি। আল-কুরআনের সামনে উপস্থাপন করার মতো কোনো জ্ঞান ইহুদি এবং খ্রিস্টধর্মে নেই।
৯. জার্মান গবেষক আইকম কি বল্ভ লিখেন : আল-কুরআন পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা এবং সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের শিক্ষা দেয়। এর উপর আমল করলে যাবতীয় রোগ-ব্যাধি এবং জীবাণু সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
১০. টমাস কারলাইল লিখেছেন : আমার নিকট এ বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার যে, কুরআনের মধ্যে সত্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতার গুণাবলি সর্বযুগেই সমভাবে বিদ্যমান। এ কথাটি দিবালোকের মত সত্য যে, পৃথিবীতে যদি সুন্দর এবং কল্যাণকর কিছু সৃষ্টি হয়, তবে তা কুরআন থেকেই হতে পারে।
১১. ড. আরনল্ড টোয়াইন তাঁর প্রিচিং অব ইসলাম গ্রন্থে লিখেছেন : আল-কুরআন পূর্ণাঙ্গ বিধানের সমষ্টি। যে বিধানসমূহ কুরআনে বিদ্যমান রয়েছে, যেগুলো আপন আপন জায়গায় সার্থক ও পূর্ণাঙ্গ।
১২. পাদ্রি রেভারেণ্ড জি এম এডওয়েন লিখেন : আল-কুরআনের শিক্ষা মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ করেছে। বস্তুতান্ত্রিকতার রাহু থেকে মানুষকে দিয়েছে মুক্তি। একমাত্র আল্লাহ্র জন্য ইবাদত এবং তাঁর দাসত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। মানুষকে রেহাই দিয়েছে শিশুহত্যার মত নৃশংস ও অমানবিক প্রথার কালো অধ্যায় থেকে, মাদকদ্রব্যকে করেছে হারাম। চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবি, ব্যভিচার ইত্যাদি দমনে এমন শাস্তির বিধান দিয়েছে যে, কোনো লোক এসব অপরাধ করার মত সাহসই খুঁজে পায় না।
১৩. দি উইজডম অব দ্য কুরআন : প্রাচীন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ আল কুরআন সৌন্দর্য ও হৃদয়গ্রাহিতার এক মনোরম ক্ষেত্র। এর বর্ণনাশৈলী অত্যন্ত নিখুঁত এবং মনোমুগ্ধকর। ছোট ছোট বাক্যগুলোতে যেন ছন্দ ও কবিতার বিচিত্র সব উদাহরণের সমাহার। পাশাপাশি রয়েছে গজব বা শাস্তির ভয়াবহ ঘোষণা; পাশাপাশি রয়েছে সৎকর্মশীলদের জন্য স্বর্গের সুসংবাদ। মোটকথা কুরআনের সঠিক মর্ম ও তাৎপর্যকে কোন ভাষার গণ্ডিতে ধারণা করা সত্যই কঠিন।
১৪. ‘বোনাপার্ট ও ইসলাম’ গ্রন্থ থেকে নেপোলিয়নের উক্তি : আল-কুরআন অদ্বিতীয় জীবনবিধান। আমার ইচ্ছা হয় যে, আমি পৃথিবীর সকল জ্ঞানী, চিন্তাবিদ ও প্রতিভাধর ব্যক্তিকে একত্র করে কুরআনি শিক্ষার আলোকে একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবো। কারণ শুধু এই শিক্ষাই মানবজাতিকে সন্তোষজনক ও চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।
১৫. ফরাসি গবেষক ড. মোরেন্স বলেন : আল-কুরআন শ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, মহাপরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তা বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্য যে সকল গ্রন্থ এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, তার মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদা ও তাৎপর্যপূর্ণ হলো আল-কুরআন। মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য এর বাণীসমূহ গ্রিক দর্শনের চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। এর প্রতিটি অক্ষর ও শব্দ মহান আল্লাহ্র বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও স্তুতি বর্ণনায় সত্যই বাঙময়।
কুরআন একদিকে যেমন জ্ঞানীদের জন্য শব্দভাণ্ডার আর কবিদের জন্য বাক্যালঙ্কারের সমারোহ। তেমনি ঐতিহাসিক, শাসক ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে এর গুরুত্ব ও সমাদর এনসাইক্লোপেডিয়ার চেয়েও লক্ষগুণ বেশি।
১৬. জি. এম. রাডউইন তাঁর ‘দি কুরআন’ গ্রন্থে লিখেছেন : আল-কুরআন জ্ঞান ও অনুপ্রেরণার উৎস। এ কথা মানতেই হবে যে আল্লাহ্র একত্ব, শক্তি, জ্ঞান এবং সত্যতার যে বর্ণনা আমরা কুরআনে পাই, এ ছাড়া বেহেশত, দোযখ, আকাশ ও পৃথিবী সম্পর্কে অনবদ্য ও সুস্পষ্ট আলোচনার জন্য আমরা কুরআনের যে প্রশংসা করি- তা খুবই কিঞ্চিৎ এবং অসম্পূর্ণ। আল-কুরআন উন্নত ও উৎকৃষ্ট চরিত্র-শিক্ষার অফুরন্ত ভাণ্ডার। এতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে সূত্রগুলো বিধৃত রয়েছে। তাতে এ কথা দৃঢ়ভাবেই বলা যায় যে, এগুলোর ওপর ভিত্তি করে শক্তিশালী রাষ্ট্র এমনকি একটি বিশাল সা¤্রাজ্যও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
চার্লস ফ্রান্স বোড লিখেছেন : কুরআন বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। দুনিয়ার তাবৎ গ্রন্থরাজির মধ্যে কোনো গ্রন্থকেই কুরআনের সমান অধ্যয়ন করা হয় না। হতে পারে বাইবেলের কপি অধিক বিক্রি হয়। কিন্তু উম্মতে মুহাম্মদীর অগণিত লোক কুরআনের দীর্ঘ আয়াতগুলো দৈনিক অন্তত পাঁচবার তিলাওয়াত করা ঐ সময় থেকে শুরু করেছে, যখন থেকে তারা কথা বলতে (নামাজ পড়তে) শিখেছে।
১৭. মিসরের ‘আখতারুল ওয়াতান’ পত্রিকায় কর্মরত একজন খ্রিস্টান সাংবাদিক বলেন : আল-কুরআন ইহ ও পরকালীন দিগদর্শন। মুসলমানরা যদি শুধু কুরআন ও হাদিস নিয়ে গভীর চিন্তা ও গবেষণা করে, তাহলে এতে তারা ইহ ও পরকালীন মুক্তির পথ অবশ্যই খুঁজে পাবে।
১৮. ড. স্যামুয়েল জন্স বলেন : আল-কুরআনের মর্ম ও আবেদন এতই ব্যাপক, সর্বজনীন ও কালজয়ী যে, প্রতি যুগের যাবতীয় স্লোগান অবলীলায় এর সামনে অনুজ্জ্বল ও নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আর বিজন বন, প্রাণহীন মরু, সুসভ্য নগর এবং বিশাল সা¤্রাজ্য সর্বত্রই এর আওয়াজ সোচ্চার কণ্ঠে ঘোষিত হয়।
১৯. ডেভিন রপোর্ট ‘মুহাম্মদ অ্যান্ড কুরআন’ গ্রন্থে লিখেছেন : আল-কুরআন মুসলিম জাতির সামগ্রিক জীবনবিধান। পরিবার-সমাজ, রাজনীতি অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, বিচার ও প্রশাসনসহ সকল ক্ষেত্রে উপযোগী, উন্নত, সর্বজনীন ও কল্যাণকর বিধানাবলি এতে বিদ্যমান। পাশাপাশি এটি একটি ধর্মীয় গ্রন্থও বটে।
২০. ফরাসি দার্শনিক লিভার জোন বলেন : আল-কুরআন উজ্জ্বল ও বিজ্ঞানময় এক অসাধারণ গ্রন্থ। এতে কোন সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই। কেননা এটা এমন এক ব্যক্তির উপর অবতীর্ণ হয়েছে, যিনি সত্য নবী এবং আল্লাহ্র প্রেরিত পুরুষ।
২১. ফরাসি গবেষক মসিয়ে লুমিয়ার বলেছেন : আল-কুরআন একটি যুগ-সংস্কারক আদর্শ। যারা ইসলামকে বর্বর ধর্ম বলে থাকে তারা কুরআন মজিদের শিক্ষা ও দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। কুরআনের শিক্ষার আলোকেই বর্বর আরবদের জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছিল। তারা একেকটি সোনালি মানুষে পরিণত হয়েছিল।
২২. জার্মান কবি ও দার্শনিক গেটে বলেছেন : আল-কুরআন বিস্ময়কর ও চিত্তাকর্ষক। পবিত্র কুরআনের গুণ হলো এই যে, এর আকর্ষণী শক্তি পর্যায়ক্রমে চিত্তাকর্ষণ করতে থাকে। এক সময় মানুষকে বিস্মিত করে, এরপর সম্মোহিত করে এবং সবশেষে অদ্ভুত এক মনোতরঙ্গ তাকে সন্তরণ করায়।
২৩. দার্শনিক জন জেকরেলিক লিখেছেন : পবিত্র কুরআন একটি সুমহান সভ্যতা ও উন্নত আদর্শবাদের প্রবর্তন করেছে।
২৪. বহু চেষ্টা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত সারা পৃথিবীর কেউই ভাষা মাধুর্যে অপূর্ব এই গ্রন্থের সমমানের কোন কিছুই রচনা করতে সক্ষম হয়নি।
-এফ.এফ. আরবাল নট : The Construction of the Bible and Koran.
২৫. কুরআন মানবজীবনে চলবার সত্যিকার পাথেয় এবং ভবিষ্যতের আশার প্রতীক।
আর্থার এন, ওলেস্টন- The Religion of the Koran.
২৬. এটা ভাবতেই আশ্চর্য লাগে যে, এই নিরক্ষর মানুষটির মাধ্যমেই অবতীর্ণ হয়েছে ভাষা জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল কুরআন। -বসন্ত কুমার বোস : Mohamedanism.
২৭. কুরআন এমন একটি গ্রন্থ, যার সাহায্যে আরবীয়গণ মহামহিম আলেকজান্ডারের রাজ্য ও রোম সাম্রাজ্যের অপেক্ষাও বড় ভূখণ্ড জয় করেছিলেন। -ডিউক অব ব্রিটেন
২৮. কুরআন সৎ জীবনের দিশারি ও নাগরিক আইনের নীতিমালা ইসলামের প্রচার তরবারির জোরে হয়নি।
-ই. ডেনিসন বস : Introduction to the Koran.
২৯. কুরআনের গঠনশৈলী এতই উন্নত যে, কোনো ভাষার অনুবাদের মাধ্যমে এর সঠিক স্বরূপ অনুধাবন করা যায় না।
-এডওয়ার্ড মোমটেট : Introduction frameaise du Koran.
৩০. পৃথিবীতে কুরআন সর্বাপেক্ষা অধিক পঠিত এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সর্বাধিক প্রভাবিত গ্রন্থ। কুরআন মানুষের মহান জীবন গড়ে তুলবার জন্য পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইন-কানুনগুলো যদি কুরআন সমর্থিত হয়, তবেই রাষ্ট্র সুষ্ঠুরূপে পরিচালিত হবে।
-জেমস এ. মিচেনার : Islam the misunderstood Religion.
৩১. কুরআন শরিফ মূল্যবান নৈতিক আদেশ ও উপদেশ পরিপূর্ণ। জন উইলিয়াম ড্রাপার : History of the Intellectual Development of Europe.
৩২. কুরআন এক চিরস্থায়ী অলৌকিক অবদান।
-হ্যারি গ্যালর্ড ডরম্যান : Towards Understanding Islam.
৩৩. কুরআনের এমন প্রজ্ঞার সমাহার দেখি, যা সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান ব্যক্তি, সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক এবং সর্বাপেক্ষা দক্ষ রাজনীতিজ্ঞের নিকট গ্রহণযোগ্য। কুরআন যে আল্লাহ্র বাণী, তার প্রমাণ- অবতীর্ণ হবার সময় হতে আজও এটি সুরক্ষিত। ইসলামের দ্রুত বিস্তৃত কোন অস্ত্রের দাপটে হয়নি।
লোরা বেভিসয়া ভ্যাগলাইরি : Apologic de I'Islamism.
৩৪. এটা অনস্বীকার্য যে, কুরআন সর্বোচ্চ প্রশংসার যোগ্যতা রাখে। এতে এমন উপাদান আছে, যেগুলোর উপর নির্ভর করে শক্তিশালী ও বিজয়ী জাতি এবং রাষ্ট্রসমূহ গড়ে তোলা যায়। -রেড ডে.এম. রডওয়েল-The Koran

৩৫. “আমরা যখনই এ মহাগ্রন্থ অধ্যয়ন করি প্রথমে খানিকটা বিরক্ত করলেও মুহূর্তেই তা আমাদের আকৃষ্ট ও অভিভূত করে। তারপর তা আমাদের অন্তরে গহিন থেকে টেনে তুলে আনে অনাবিল অকৃত্রিম ভক্তি। কুরআনের লক্ষ্য ও আলোচ্য বিষয় অনুযায়ী এর রচনাশৈলী অনমনীয়, পূর্ণাঙ্গ ও চমকপ্রদ যা চিরকালই মহিমান্বিত। ভবিষ্যতের প্রতিটি কালেই এ গ্রন্থ অভাবনীয় প্রভাব বিস্তার করবে মানব সমাজে।” -Goethe, quoted T.P. Hughe's Dictionary of Islam,p.-526.
৩৬. “কুরআন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। যদিও পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে দেয়া ধর্মগ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি সর্বকনিষ্ঠ কিন্তু তা যে বিশাল মানবগোষ্ঠীর উপর আশ্চর্য প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে তা আর কোন ধর্মগ্রন্থের পক্ষে সম্ভব হয়নি। মানুষের চিন্তা ও চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে কুরআন এক অনাবিল আদর্শ। এ কুরআনই আরব-উপদ্বীপের বিভিন্ন মরু উপজাতিকে একটি বীর জাতিতে পরিণত করেছে। অতঃপর প্রতিষ্ঠা করেছে মুসলিম বিশ্বে এক বিশাল ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠন, যা সবচেয়ে শক্তিশালী জাতিসমূহের একটি এবং আজকের ইউরোপ ও প্রাচ্যকে যা ভাবিয়ে তুলেছে।” --G Margoliouth, Introduction to J.M. Rodwell's The Koran. New York : Everyman's Library, 1977, P.-VII

৩৭. “মুহাম্মদকে যারা কুরআনের রচয়িতা হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বক্তব্য অযৌক্তিক এবং অমূলক। একজন নিরক্ষর ব্যক্তি কিভাবে আরবি সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় লেখক হতে পারে? কিভাবে বা তিনি শাশ্বত বৈজ্ঞানিক সত্যসমূহ বর্ণনা করলেন, যা সে সময় অপর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি? এমনকি আজও এর মধ্যে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতির সন্ধান লাভ করা সম্ভব হয়নি।” -Maurice Baucaille. The Bible. The Quran and Science, 1978, p. 125
ফলে এ বিশ্বাস আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয় যে, মুহাম্মদের সা. সমসাময়িক কালের জ্ঞানের অবস্থা এবং পরিপ্রেক্ষিতের বিবেচনায়, ঐ সময়কার কোন মানুষের পক্ষে এ ধরনের গ্রন্থের লেখক হওয়া সম্পূর্ণ অচিন্তনীয়। এ বিবেচনায় কুরআনকে অনন্য স্থান প্রদান করেছে। বস্তুগত বিজ্ঞানের সাহায্যে কুরআনের ব্যাখ্যা এ কারণেই যেকোন নিরপেক্ষ বিজ্ঞানীর পক্ষে অসম্ভব।” -Maurice Bucaille, The Quran and Modern Science, 1981, P-18.
৩৮. “মৃন্ময় ও সাধারণ সৌন্দর্যতাত্ত্বিক আদর্শের বিচারে এ গ্রন্থের সাহিত্যিক উৎকর্ষ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। বরং এর মূল্যায়ন হতে পারে মুহাম্মদ সা.-এর সমসাময়িক ও স্বদেশীয় জনসাধারণের উপর এর প্রভাবের সাহায্যে। এ গ্রন্থ তার শ্রোতার হৃদয়ে এমন নিমগ্ন-নিবিড় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে, তাদের পরস্পরবিরোধী মানসিকতা ও বৈশিষ্ট্য সুসংবদ্ধ ও সুসংহত হয়ে একটি অনুপম আদর্শ জীবন-কাঠামো নির্মিত হয়েছিল। ফলে তারা আরবদের তৎকালীন মানসিকতার ঊর্ধ্বে এক বৃহত্তর মানব চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল। আর এর পরিপূর্ণ আবেদন একটি অসভ্য বর্বর জাতিকে পরিণত করেছিল এক সুসভ্য উন্নত জাতিতে।” -Dr. Steingass, quoted in Hughes' Dictionary of Islam P-528
৩৯. “পূর্ববর্তী প্রজন্মের কর্মকে সমৃদ্ধ করতে আমার এ প্রচেষ্টা। আমি এমন কিছু করতে চাই যাতে প্রতিধ্বনিত হবে কুরআনের আশ্চর্য সমৃদ্ধ ছন্দমালা। প্রগাঢ় অভিনিবেশ সহকারে এর জটিল ও পরিবর্তমান ছন্দ সম্পর্কে আমাকে অধ্যয়ন করতে হয়েছে। বাণীর সৌকর্য ও অসামান্যতাকে বাদ দিলেও কেবল ছন্দের ঐশ্বর্যের কারণেই এ গ্রন্থ মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের রচনাসমূহের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।”- Arthur J. Arberry, The Koran Interpreted London : Oxford University Press. 1964, P.X.
৪০. “বর্তমান বিশ্ব সভ্যতার শীর্ষে অবস্থানকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (আমেরিকা) তার অতীব উন্নত মানের কম্পিউটার যন্ত্রের সাহায্যে পবিত্র কুরআনের সমমানের একটি গ্রন্থ পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালালে যন্ত্রটি তাদের জানিয়ে দেয়- ৬২৬ এর সঙ্গে চব্বিশটি শূন্য পাশে যোগ করে যত কোটি কোটি বছর হবে (৬২৬,০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০) তত বছরেও তামাম মানুষের পক্ষে প্রচেষ্টা চালিয়েও অনুরূপ একটি গ্রন্থ পাওয়া সম্ভব নয়।”
সূত্র :
১. কুরআন শরিফ (বঙ্গানুবাদ) এর পরিশিষ্ট, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, প. বঙ্গ, ভারত।
২. মাসিক দ্বীন দুনিয়া রমজান সংখ্যা, ১৯৯৬
৩. মাসিক মদীনা, আল কুরআন সংখ্যা, ১৯৯২
৪. বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা।
লেখক : সম্পাদক, মাসিক দ্বীন দুনিয়া

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির