post

প্রেরণার প্রতিচ্ছবি শহীদ আবদুল মালেক

৩১ জুলাই ২০১৪

শাহ মোহাম্মদ মাহফুজুল হক

Malekএকজন জ্ঞানী ও মেধাবী ছাত্রের মধ্যে যে ধরনের মেধা ও পাণ্ডিত্য থাকা দরকার একজন নেতার মধ্যে যে সাহসিকতা, দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা থাকা দরকার, একজন গবেষকের মধ্যে যে ধরনের সাধনা ও একাগ্রতা থাকা দরকার, একজন দায়ীর যে ধরনের উন্নত আমল, নিরহঙ্কারবোধ, কর্মীদের প্রতি ভালোবাসা ও দাওয়াতকে নিজের জীবনের মিশন হিসেবে নেয়া দরকার, সর্বোপরি একজন অনুকরণীয় মানুষের মধ্যে যে সুন্দর মানবীয় গুণাবলি থাকা দরকার আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন সকল গুণাবলি ঢেলে দিয়েছিলেন শহাীদ আবদুল মালেক ভাইকে। একজন মানুষের এতগুলো গুণ থাকে এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীর ইতিহাসে খুবই বিরল। শহীদ আবদুল মালেক ১৯৪৭ সালের মে মাসে বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার খোকসাবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী মুন্সি মোহাম্মদ আলী মাতার নাম মৃত ছাবিরুন্নেসা । পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। শিবিরের বর্তমান কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক মোস্তফ মনোয়ার ও রাজশাহী মহানগরী সভাপতি ডা: আনোয়ারুল ইসলাম তারই ভাতিজা। তিনি প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামের খোকসাবাড়ী স্কুলে অধ্যয়ন করেন। ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত খোকসাবাড়ী হাইস্কুলে পড়েন। এই স্কুল থেকে ১৯৬০ সালে তিনি জুনিয়র স্কলারশিপ লাভ করেন। তিনি ১৯৬৩ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে বোর্ডে একাদশ স্থানসহ এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৫ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন। পরবর্তীতে  উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ফজলুল হক মুসলিম হলের ১১২ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। রাজশাহী সরকারি কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি ইসলামী আন্দোলনের (ছাত্রসংঘ) প্রতি আকৃষ্ট হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তিনি কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি ঢাকা শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং যোগ্যতার সাথে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে তিনি ঢাকা শহর শাখার সভাপতি এবং ১৯৬৮ সালে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের কার্যকরী পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। শাহাদাতের সময় তিনি উক্ত দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুব সরকারের পতন হলে জেনারেল ইয়াহইয়া খান ক্ষমতায় আসেন। এ সময় এয়ার মার্শাল নুর খানের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। ছাত্রসংঘের নেতৃত্বে ছাত্রসমাজের একটি অংশ ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের দাবি তোলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনের (NIPA) উদ্যোগে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আয়োজিত বিতর্কে আবদুল মালেক ভাই ইসলামী শিক্ষার পক্ষে ক্ষুরধার ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরেন। তার বক্তব্যে আকৃষ্ট হয়ে উপস্থিত ছাত্রজনতা ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। ছাত্রদের এ মতামতকে বিভ্রান্ত করার জন্য ১৯৬৯ সালের ১২ আগস্ট ডাকসুর উদ্যোগে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন বামপন্থী নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষবতাদের ধ্বজাধারীরা ইসলামী শিক্ষার বিপক্ষে এবং সেকুলার শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দেয়। আলোচনা সভায় ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষের ছাত্ররা আলোচনায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেয়ার দাবি জানায়। কিন্তু তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়। উপরন্তু ইসলাম সম্পর্কে ছাত্রইউনিয়নের তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা শামসুদ্দোহা মিথ্যা ও অবমাননাকর বক্তব্য প্রদান করে। ছাত্রসংঘের তৎকালীন ঢাকা শহর সভাপতি আবদুল মালেক ভাই তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে আলোচনাসভাস্থলেই এর প্রতিবাদ জানান। এই প্রতিবাদ সংঘর্ষে রূপ লাভ করে।  শিক্ষক ও ছাত্রদের হস্তক্ষেপে সংঘর্ষ এক পর্যায়ে থেমে যায়। কিন্তু অধিকাংশ সঙ্গী সাথীদের বিদায় দিয়ে মালেক ভাই যখন ২-৩ জন ছাত্রকে নিয়ে হলের দিকে রওনা করেন তখন টিএসসি মোড়ে বাম ও সেকুলারপন্থীরা তাদের ওপর হামলা করে। রক্তপিপাসুরা মালেক ভাইকে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) তার মাথার নিচে ইট দিয়ে উপরে ইট ও লোহার রড দিয়ে মারাত্মক জখম করে মূমুর্ষূ অবস্থায় ফেলে  রেখে যায়। ছাত্রলীগ ও ছাত্রইউনিয়নের তোফায়েল, আমির হোসেন আমু, আ স ম রব, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননরা যৌথভাবে এ পরিকল্পিত হামলার নেতৃত্ব দেয়। মুমূর্ষু অবস্থায় আবদুল মালেক ভাইকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ আগস্ট ১৯৬৯ সালে তিনি শাহাদাতবরণ করেন। তার শাহাদাতের খবরে গোটা দেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ছাত্র, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আলেমসমাজসহ সকল শ্রেণীর মানুষ এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান বিবৃতি দিয়ে এ ঘটনার নিন্দা জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে আওলাদে রাসূল (সা) মাওলানা সাইয়্যেদ মোস্তফা আল মাদানীর ইমামতিতে মালেক ভাইয়ের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সাংগঠনিক পরিসরে বড় হওয়া ও স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে কর্মী হওয়ার সুবাদে মালেক ভাইয়ের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে দায়িত্বশীলদের বক্তব্য শুনে সেই ছোটবেলা থেকেই মালেক ভাইয়ের প্রতি আলাদা একটা ভক্তি জন্মাতে থাকে। কিন্তু এই ভক্তি ও ভালোবাসা একসময় প্রতিচ্ছবি হিসেবে সামনে চলে আসে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মহান প্রভুর বিশেষ কৃপায় মালেকের স্মৃতিবিজড়িত ঢাবি ক্যাম্পাসে ভর্তি হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করি। প্রতিচ্ছবি  আরও বেশি গাঢ় হয় যখন মালেক ভাইয়ের রক্ত আর স্মৃতিবিজড়িত টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ফজলুল হক মুসলিম হলের ১২২ নং কক্ষ, প্রাণরসায়ন বিভাগ, ডাকসু, মধুর ক্যান্টিনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অলি গলি ঘুরে ঘুরে আন্দোলনের কাজ শুরু করি। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন বৈঠকে দায়িত্বশীলদের আলোচনায় মালেক ভাইয়ের চরিত্রের বিভিন্ন দিক, প্রবাহের পরিচালক মাহবুবুর রহমান ভাইয়ের সুললিত কন্ঠে মালেক ভাইকে নিয়ে বিভিন্ন গান ও ‘প্রেরণার বাতিঘর’ পড়ে মালেক ভাইয়ের স্মৃতিগুলো এতবেশি প্রাণবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে ধরা দিয়েছিল আমার মানসপটে যে; যখন কার্জন হল, কলাভবন, টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতাম তখন মনে হতো যেন মালেক ভাইয়ের রক্তের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। কোন কারণে কখনো যদি সাংগঠনিক কাজে নিষ্ক্রিয়তা চলে আসতো তখন ভাবতাম মালেক ভাই যে কাজের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিলেন আমি যদি সে কাজে সময়ই দিতে না পারি তাহলে শেষ বিচারের দিন মালেক ভাই যদি অভিযোগ করেন তাহলে কী জবাব দেবো? তখন নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে আবার শুরু করতাম পথচলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়তুলমাল ও কোচিংয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতাগুলো দেখলে মনে পড়ে যেত মালেক ভাইয়ের সেই পঞ্চাশ পয়সার হিসাব মিলাতে  না পারার কারণে বারবার হিসাব করা আর রুমে পায়চারি করে নির্ঘুম রাত কাটানোর কথা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে নয় কেন্দ্রে এসে যখন দায়িত্ব পালন করছি তখনো মালেক ভাইয়ের স্মৃতি আমাকে নাড়া দেয়। সাংগঠনিক সফরে বিভিন্ন এলাকায় গেলে স্থানীয় দায়িত্বশীলদের আসতে ক্ষণিকের বিলম্ব যখন আমাকে উদগ্রীব করে তোলে তখন ময়মনসিংহ সফরে গিয়ে কামারুজ্জামান ভাইকে ঘুম থেকে না ডেকে রাত চারটা থেকে ফজরের নামাজ পর্যন্ত মালেক ভাইয়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার সেই দৃশ্য আমাদের মনে অনেক বেশি অপরাধবোধ জাগ্রত করে। একই অপরাধবোধ কাজ করে যখন সফরে লঞ্চে ভালো কেবিন বা ভালো বাসে ভালো আসন না পেয়ে মন খারাপ হয়, তখন মতিউর রহমান নিজামী ভাইয়ের স্মৃতিতে মালেক ভাইয়ের ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর বগিতে মালেক ভাইকে খুঁজে না পেয়ে তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় দাঁড়িয়ে থাকার কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও অধিক লোকের মাঝে কাজ করার সুযোগ নেয়ার সেই অনন্য দৃষ্টান্তের কথা মনে পড়ে। শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের জীবনের প্রতিটি দিক ইসলামী আন্দোলনের প্রত্যেক নেতা ও কর্মীর জন্য অনুকণীয় হতে পারে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনশক্তিদের জন্য মালেক ভাই হচ্ছেন প্রেরণার উৎস। শহীদ আবদুল মালেক ভাই নিরেট আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আন্দোলন করেছেন। আখেরাতের সফলতাই ছিল তার মূল লক্ষ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে বৈষয়িক সকল সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার নিকট আন্দোলনের জীবনই ছিল বেশি প্রিয়। তার শুভাকাক্সক্ষী ও সহপাঠীরা ভালো ফলাফল করার দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিলে মৃদু হেসে তিনি বলতেন “বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ডিগ্রি নিতে হবে যাতে আয় রোজগারের একটা পথ হয়। কিন্তু ওটাকে জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নিতে চাই না, খুব ভাল রেজাল্ট করার ধান্ধা করলে ক্যারিয়ার গড়ে তুলবার নেশা পেয়ে বসার আশঙ্কা আছে।” কিন্তু তাই বলে তিনি আবার পড়াশুনাও ছেড়ে দেননি। সারাদিন ক্লাস আর সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে তিনি আবার অধিক রাত জেগে পড়াশুনা করতেন আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখতেন যা খুব কমসংখ্যক দায়িত্বশীলদের জীবনেই দেখা যায়। মালেক ভাই তার বক্তব্যে প্রায়ই বলতেন, “সত্যিকারের মুমিন সে যে মৃত্যুকে ভয় করে না। মুমিন আগুনে পুড়তে পারে কিন্তু শাহাদাতের হক থেকে দূরে থাকতে পারে না।” তিনি আরও বলতেন “মায়ের বন্ধন ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। বৃহত্তর কল্যাণের পথে সে বন্ধনকে ছিঁড়তে হবে। কঠিন শপথ নিয়ে আমার পথে আমি চলতে চাই। আশীর্বাদ করবেন সত্য প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে যেন আমার জীবনকে আমি শহীদ করে দিতে পারি। আমার মা এবং ভাইয়েরা আশা করে আছেন আমি একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছি কিন্তু মিথ্যা সেসব আশা। আমি চাইনে বড় হতে আমি ছোট থেকেই সার্থকতা পেতে চাই।” জনশক্তির প্রতি ভালোবাসার যে দৃষ্টান্ত মালেক ভাই রেখে গেছেন তা ইট পাথর আর আত্মকেন্দ্রিক আজকের এই ডিজিটাল যুগে খুব বেশি প্রয়োজন। মালেক ভাই নিজের সিটে মেহমানকে শুয়ে দিয়ে পেপার বিছিয়ে আর ইট মাথায় দিয়ে মেঝেতে শুয়ে রাত কাটানো, টিউশনির টাকায় জনশক্তিকে নাশতা করিয়ে নিজে উপবাস থাকা, নামাজ কাজা বন্ধ করা ও মানোন্নয়নের জন্য  ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে ঢাকা কলেজ হোস্টেল  অথবা বুড়িগঙ্গা পার হয়ে কেরানীগঞ্জে গিয়ে টার্গেটকৃত জনশক্তির সাথে ফজরের নামাজ আদায়ের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা সকল যুগের সকল দায়িত্বশীলদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। মালেক ভাই ছিলেন আন্দোলনের একজন নীরব কর্মী, যশ-খ্যাতির বিন্দুমাত্র মোহ ছিল না তার অন্তরে। তাইতো জিঞ্জিরায় কর্মী টিসির সময় কাউকে কিছু না বলে ল্যাট্রিন ঠিক করতে নেমে গেলেন অথৈ পানিতে। বিভিন্ন সময় টিসির জনশক্তিদের রেখে যাওয়া থালা বাসন ধুয়ে দিতেন নিজ হাতে। একটা মাত্র পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে সারাদিন কাজ করে রাতে ধুয়ে দিতেন এবং পরের দিন আবার সেই পোশাক পরে বেরিয়ে যেতেন দ্বীনের কাজে। পরনের সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা আর স্যান্ডেল পায়ে বিমানে লাহোরে চলে যেতেন ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে যা আজ-কাল আমাদের মতো নগণ্য উত্তরসূরিদের নিকট বাস্তবতো নয়ই কল্পনারও বাইরে। সময়ের দীর্ঘসূত্রতা আর বাধার প্রাচীর দেখে আমাদের অনেক জনশক্তি ও দায়িত্বশীলদের দেখা যায় তারা কাজ করতে হবে এ জন্য করেন কিন্তু আন্দোলনের ভবিষ্যত বা সাফল্যের ব্যাপারে তারা হতাশ। কিন্তু মালেক ভাই ছিলেন খুবই আশাবাদী একজন মানুষ। তিনি বলতেন “ঝযধহমযধ রিষষ Shangha will rise, surely rise অর্থাৎ বিপ্লবের নতুন সূর্য উদিত হবেই, অবশ্যই সেটা হবে। তাছাড়া নেতৃত্বের যোগ্যতা ও দুর্বলতার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে যারা সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চেয়েছিল শহীদ আবদুল মালেক ভাই তাদের ব্যাপারে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ জান্নাতি পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে মতিউর রহমান নিজামী ভাইকে যে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন তা শত সহস্র শহীদের রক্তের বিনিময়ে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখতে সবসময়ই দিকদর্শনের ভূমিকা পালন করছে এবং করবে। শহীদ আবদুল মালেক ভাই তার মেধা, যোগ্যতা ও আন্তরিকতার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাস্তিক-মুরতাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাসে ধর্মহীনতার খোলসধারীদের কর্তৃত্ব উৎখাত করে সেখানে ইসলামী আন্দোলনের বিজয় নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি সফল ইসলামী বিপ্লবের প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করতে। কিন্তু বাতিলরা ইটের উপর তার মাথা রেখে আরেকটি ইট দিয়ে আঘাত করে নৃশংসভাবে তাকে শহীদ করে বিপ্লবের সেই স্বপ্নকেই বিনষ্ট করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু দূরদৃষ্টির অধিকারী মাওলানা মওদূদী আবদুল মালেক ভাইয়ের শাহাদাতের সংবাদ শুনার পর যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন “এক মালেকের রক্ত থেকে লক্ষ মালেক জন্ম নিবে”। কালের পরিক্রমায় সেই ভবিষ্যদ্বাণী আজ বাস্তব রূপ লাভ করেছে। মালেকের উত্তরসূরিরা তার রক্তের শপথ নিয়ে তার অসমাপ্ত কাজকে তিলে তিলে আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। শেষ করছি লজিংওয়ালাকে উদ্দেশ করে মালেক ভাইয়ের লেখা চিঠির একটি অংশ উদ্ধৃত করে, “জানি, আমার কোন দুঃসংবাদ শুনলে মা কাঁদবেন; কিন্তু উপায় কী বলুন? পৃথিবীর সমস্ত শক্তি আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে কিন্তু আমরা মুসলমান যুবকরা বেঁচে থাকতে তা হতে পারে না। হয় বাতিলের উৎখাত করে সত্য প্রতিষ্ঠা করবো নচেৎ সে চেষ্টায়  আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। আপনারা আমায় প্রাণভরে দোয়া করবেন; জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও যেন বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি। কারাগারের নিরন্ধ্র অন্ধকার, সরকারি জাঁতাকলের নিষ্পেষণ আর ফাঁসির মঞ্চ ও যেন আমায় ভড়কে দিতে  না পারে।” (আল্লাহ হাফেজ) লেখক : কেন্দ্রীয় মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির