post

পড়ো কিংবা মরো

আহসান হাবীব ইমরোজ

১০ মে ২০২১

পড়ো কিংবা মরো আসলেই কি, যে পড়ে সে বড়ো? আমরা কতটুকু পড়ুয়া জাতি? স্বাধিকারের জন্য ৮,৬৬২ গুণ বড় রাষ্ট্রের সাথে লড়াই করা যায়?

এক. ড্রাগন এয়ারে করে টোকিও যাচ্ছিলাম। মনে হয় ২০০৯ সালের ডিসেম্বর। বিশ্বের ষষ্ঠ সেরা এয়ারপোর্ট হংকং থেকে সপ্তম সেরা এয়ারপোর্ট নারিতার উদ্দেশে রওনা করবো। মাঝে যাত্রাবিরতি। হংকং। চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল। আয়তনে বাংলাদেশের ১৩৪ ভাগের এক ভাগ। এমনকি টাঙ্গাইল জেলারও তিন ভাগের একভাগ। তবে জনসংখ্যা কিন্তু ৭৫ লক্ষ, বাংলাদেশের মাত্র ২২ ভাগের ১ ভাগ। সুতরাং জনঘনত্ব বাংলাদেশের চাইতে ৬ গুণ বেশি। তাহলে কি বলবো ওদের জনসংখ্যা আপদ নয় বরং মহাবিপদ। কিন্তু আসলে কী? ওদের জিডিপি পারক্যাপিটা আমাদের তুলনায় ২৭ গুণ। এখানেই যদি শেষ হতো তবু আমাদের মাথামোটা নেতাদের শেষ রক্ষা হতো, কিন্তু! তাদের মাথাপ্রতি সরকারি শিক্ষা ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে ৪৫ গুণ বেশি। শিক্ষার প্রতি এই গুরুত্বের কারণে তারা আন্তর্জাতিক পিসা প্রতিযোগিতায় বরাবর শীর্ষে থাকে। শুধু কি তাই, তারা নৈতিক শক্তিতেও বলীয়ান, ৮,৬৬২ গুণ বড় মূল রাষ্ট্র চায়নার সাথেও তারা সংগ্রামরত। যেখানে আমরা কিছুটা বড় প্রতিবেশী দেখলেই ভড়কে যাই, নিজের স্বার্থ গঙ্গা বা বুড়িগঙ্গায় দিয়ে বলি আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। পররাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে যা এক ন্যক্কারজনক উদাহরণ। তাদের শিক্ষার শক্তির কথা বলতে গিয়ে একজনের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। টেরেন্স টাও ((Terence Tao, জন্ম-১৯৭৫) বিশ্বের সর্বকালের আইকিউ স্কোরারের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান দখল করে আছেন। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ উইলিয়াম জেমস সিডিসের মতো তিনিও গণিতে বিশেষ পারদর্শী। তার আইকিউ হচ্ছে ২৫৫। একজন আধুনিক গণিতজ্ঞ হিসেবে গণিতের বিভিন্ন শাখায় তার অস্বাভাবিক রকমের পারদর্শিতা। টাওর বাবা-মা ১৯৭২ সালে হংকং থেকে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়া প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী। টাওয়ের বাবা বিলি টাও (চীনা) একজন শিশু-বিশেষজ্ঞ ছিলেন। মা গ্রেস হংকং ইউনিভার্সিটিতে অ্যাস্ট্রো ফিজিকস এবং গণিতে প্রথম শ্রেণির অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। তিনি হংকংয়ের গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। টাওর দুই ভাই নাইজেল এবং ট্র্যাভর, অস্ট্রেলিয়ায় বাস করছে। দু’জনই পূর্বে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। টাওর স্ত্রী লওরা নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী। তাদের এক পুত্র উইলিয়াম এবং কন্যা মেডেলিনে রয়েছে। টাও অল্প বয়স থেকেই অসাধারণ গাণিতিক দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চস্তরের গণিত কোর্সে অংশ নিয়েছিলেন। জন হপকিন্সের ব্যতিক্রমী প্রতিভা প্রোগ্রামের ইতিহাসে তিনি দুই শ্রেষ্ঠতমের একজন। টাও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ১৯৮৬, ১৯৮৭ এবং ১৯৮৮ সালে যথাক্রমে ব্রোঞ্জ, রৌপ্য এবং স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। তিনি অলিম্পিয়াডের ইতিহাসে তিনটি পদকের প্রত্যেকটিতে সর্বকনিষ্ঠ বিজয়ী হয়েছেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে স্বর্ণপদক জিতেছেন। ১৫ বছর বয়সে তাঁর প্রথম আর্টিকেল প্রকাশ হয়েছিল। ১৬ বছর বয়সে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর এবং মাত্র ২১ বছর বয়সে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৬ সালে, তিনি ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান এবং মাত্র ২৪ বছর বয়সে সম্পূর্ণ অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। টাও তিন শতাধিক গবেষণা নিবন্ধের লেখক বা সহ-লেখক। যাক, হংকং এবং তার সন্তান টাওকে নিয়েতো অনেক গল্প হলো। এবার ওদের প্রি-প্রাইমারির একটি মগজের মারপ্যাঁচ দেখা যাক। আপনারাও টেস্টে অংশ নিতে পারেন। তবে গুগলে নয়, দয়া করে স্ব স্ব ঘিলুতে সার্চ দিন। তাতে হলফ করে বলা যায় ১০০ বিলিয়ন নিউরনের মরচেগুলো অন্তত পরিষ্কার হবে।

দুই. ঢাকার একটি নামকরা; নজরকাড়া স্কুল। আমার মতো এক নাদানকে ডেকেছে তাদের শিক্ষক-প্রশিক্ষণের প্রধান আলোচক হিসেবে। এক কথা দুই কথা, তারপর- পড়বিতো পড় মালীর ঘাড়ে। ক্ষুদ্র অথচ খটমটে একটি প্রশ্ন করে বসলাম। অবশ্য তাদের সানুগ্রহ অনুমোদন নিয়েই। ওমা! ৫৭ জনের ভিতর মাত্র ৩ জন হাত উত্তোলন করলেন। ভাবলাম ইজ্জত বাঁচলো, হয়তো তারা পারবেন। কিন্তু না, কেউ পারলেন না। অবাক কাণ্ড! সেটি ছিল সিঙ্গাপুরের স্কুলসমূহের প্রি-প্রাইমারি বা প্রাক-প্রাইমারি শ্রেণির একটি প্রশ্ন। দিয়াশলাই কাঠির সেই মজাদার টেস্টটি আপনাদের জন্যও থাকলো। মাইন্ড না করলে উত্তর দিয়েন। দেখা যাক কার কী অবস্থা? ‘ন্যাশন অ্যাট রিস্ক’ নামে আমেরিকার জাতীয় শিক্ষা কমিশন তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের দক্ষতা বিষয়ে ১৯৮৩ সালে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। একে আধুনিক আমেরিকান শিক্ষার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এতে বলা হয়, আমেরিকান স্কুলগুলো ক্রমান্বয়ে ব্যর্থ হচ্ছে। অপর দিকে সিঙ্গাপুর, চায়না, জাপান, কোরিয়া, হংকং, তাইওয়ান বিশ্বের শীর্ষ দেশসমূহের ১৫ বছরের শিক্ষার্থীদের গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষাগত এ যৌথ পরীক্ষায় নিয়মিত শীর্ষে থাকছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) পরিচালিত এই পরীক্ষার নাম পিসা টেস্ট Programme for International Student Assessment (Pisa) অবাক করা বিষয় হচ্ছে যে, এই টেস্টে বরাবর আমেরিকা, ইংল্যান্ডের, ইতালি, স্পেনের অবস্থা সর্বদা তলানিতে। এবার এই সারণির সাথে কোভিড-১৯ মোকাবেলার সক্ষমতা আলোচনা করুন। একটি সরল সমীকরণ পাওয়া যাবে। যারা শিক্ষায় ভালো তারা মহামারী মোকাবেলায় তুলনামূলকভাবে সফল। আর শিক্ষায় যারা ব্যর্থ তারা কোভিডেও ব্যর্থ। অবশ্যই এটিই শেষ কথা নয়; আরো গবেষণার দাবি রাখে। প্রশ্ন হতেই পারে বিশ্বের শীর্ষ ৬০ বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকায়, ২০টি ইংল্যান্ডে, তাহলে? আমি বলবো, ঠিক, বিল্ডিং, কাঠামো তাদের কিন্তু ছাত্র কাদের? ওরাতো আফ্রিকা, এশিয়া কিংবা চায়নার, তাহলে? আর তাদের স্কুলের খবর কী? তাহলে কি বলা যায় পরাশক্তির ভরকেন্দ্র চেঞ্জ হতে চলেছে? তাহলে কি এটাই ঠিক পড়ো কিংবা মরো? লেখক : ক্যারিয়ার স্পেশালিস্ট এবং মোটিভেশনাল স্পিকার

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির