post

ফিরে দেখা ২০১৪ নড়বড়ে অর্থনৈতিক সূচক আস্থার সঙ্কট বিনিয়োগে

০৬ জানুয়ারি ২০১৫

মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ

16রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অস্থিরতার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ২০১৩ সাল। ২০১৪ সালের প্রথম দু’তিন মাস পর্যন্ত তার প্রভাব চলতে থাকে। নির্বাচনের ১১ মাস পরও মাথা উঁচু করে দঁভড়াতে পারেনি অর্থনীতি। এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছেÑ আশানুরূপভাবে হয়নি বিদেশী বিনিয়োগও। বিনিয়োগ বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত বিনিয়োগ সংখ্যা ছিল ১৪৬টি, অক্টোবরে তা নেমে এসেছে ৭৫টিতে। সেপ্টেম্বরে যেখানে স্থানীয় কর্মসংস্থান হয়েছিল ১৬ হাজার ৭৬৪ জনের, সেখানে অক্টোবরে তা নেমে এসেছে ৭ হাজার ১৬৪ জনে। এক মাসের ব্যবধানে স্থানীয় কর্মসংস্থান কমেছে সাড়ে ৯ হাজার বা ৫৭ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ৮৩ কোটি ডলার। গত বছর একই সময়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছিল ৯৯ কোটি ডলার। এক বছরের ব্যবধানে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ১৬ কোটি ডলার। আর বিদেশী কর্মসংস্থান ১ হাজার ৮২৯ জন থেকে নেমে এসেছে সাড়ে ৭০০ জনে। ২০১৪ সালে সব চেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। প্রত্যাশিত বিনিয়োগ না হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে জমতে থাকে অলস টাকার পাহাড়। খোদ অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে দেশে বিনিয়োগ না বাড়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তার মতে, বিনিয়োগ না বাড়াটাই দেশের প্রধান সমস্যা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক কারণে এখনও অধিকাংশ বিনিয়োগকারীই বিনিয়োগ করতে আগ্রহী না। তাদের ধারণা এমন পরিস্থিতিতে যে কোনো বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে। ফলে উদ্যোক্তাদের অর্থ ব্যাংকে জমে আছে। এ খাত সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্নীতি, আর লোপাটের কারণে ব্যাংক সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা উঠে যাচ্ছে। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাংক ডাকাতি এবং অনলাইন হ্যাকিং করে টাকা নিয়ে উধাও হওয়ার ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আর এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তা অর্থনীতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। ২০১৪ সাল রাজস্বের জন্যও সুখকর ছিল না। এ সময়ে অর্জিত হয়নি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা। যদিও রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারি এ সংস্থা কয়েক দফায় এমনকি দফায় দফায় রিটার্ন দাখিলের মেয়াদ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কৌশল নিয়েছিল, কিন্তু তবুও কোনো ফায়দা হয়নি। সর্বশেষ চার মাসের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেকটাই দূরে থাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, গত অর্থবছরের অধিকাংশ সময় প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও অক্টোবর (২০১৩) পর্যন্ত রফতানি প্রবৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল সন্তোষজনক। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। তবে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ২৭৩ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এর বিপরীতে রফতানি আয় হয়েছে ১ হাজার ২০৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১৯৬ কোটি ডলার। অন্য দিকে রেমিট্যান্স প্রবাহও গত বছরের তুলনায় তেমন একটা বাড়েনি। ২০১৪ সালের ১১ মাসে (নভেম্বর পর্যন্ত) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৩৬৫ কোটি ডলার। ২০১৩ সালে একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৬২ কোটি ডলার। এ ছাড়া মাসওয়ারি হিসেবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধ্বে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। তবে রিজার্ভ এখনও যথেষ্ট রয়েছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে এলেও গড় মূল্যস্ফীতি এখনও ৭ শতাংশের বেশি। অন্যান্যের মধ্যে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও পুঁজিবাজারের ওঠানামা বছরজুড়ে ছিল আলোচনায়। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে অর্থনৈতিক সূচকগুলোর টালমাটাল অবস্থানের কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিদায়ী ২০১৪ সালে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. এনামুল হক বলেন, ‘আসলে পুরো বছরজুড়েই অর্থনীতির আকাশজুড়ে কালো মেঘ ছিল। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বিনিয়োগকারীরা আস্থা অর্জন করতে পারেনি। ফলে তারা পিছিয়ে গেছে। অনুরূপ বিদেশীরাও। কিন্তু সরকারের উচিত ছিল রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে দেশে সুষ্ঠু বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ধীরে ধীরে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে।’ ২০১৩ সালে জুন থেকে হরতাল-অবরোধসহ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সরকারি প্রকল্পের বাস্তবায়ন নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছর এ ধরনের কোনো সমস্যা না থাকলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের চেয়ে কম হয়েছে। চলতি (২০১৪) অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এডিপি বাস্তবায়নের হার গত চার বছরের একই সময়ের তুলনায় সর্বনিম্ন। ছয়টির অধিক মন্ত্রণালয় এক টাকাও ব্যয় করতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদে আলোচনা হয়। সব মন্ত্রণালয়কে এডিপি বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ১১ শতাংশ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে সরকারের নীতি নির্ধারকেরা বিভিন্ন সময়ে উচ্চকণ্ঠ হলেও বাজেটে বেঁধে দেয়া অর্থনৈতিক সূচকগুলো অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে বলে মনে করছেন দাতারা (বিশ্বব্যাংক ও এডিবি)। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক ডেভেলপমেন্ট আপডেটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আগামী দিনের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এ কারণে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে ধস ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতো নেতিবাচক পরিস্থিতিতে পড়তে পারে অর্থনীতি। রাজনৈতিক পরিস্থিতির এ অনিশ্চয়তা বিনিয়োগে প্রভাব ফেললে অর্থনীতি ফের নেতিবাচক ধারায় চলে যেতে পারে। বেসরকারি খাতে অব্যাহত বিনিয়োগ মন্দায় বেকারত্বের পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়েছে। এ অবস্থায় সরকারি পর্যায়ে উন্নয়নমূলক কাজ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজেটের ঘাটতি অর্থায়ন তিনগুণ বেড়ে গেছে। আর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দর কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবাসীরা চরম অস্বস্তিতে পড়েছে। যা রেমিট্যান্স প্রবাহে ধস নামার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর উদ্যোক্তারা উভয়সঙ্কটে পড়েছেন। সরকার মেয়াদের পূর্ণ সময় অতিবাহিত করবেন না বিরোধী জোটের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে রাজপথ অস্থিতিশীল হবে-এমনই প্রশ্ন সবার কাছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নীতিমালা অব্যাহত না থাকায় তারা আরও ভেবেচিন্তে বিনিয়োগ করতে চান। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-অক্টোবর-১৪ সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৭১ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। যা এক মাস আগেও ছিল ২৪০ কোটি ২০ লাখ ডলার। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ১৩১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আর গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১৯৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। যা চলতি অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৭ কোটি ডলার কম। মূলত রফতানি আয় ২০২ কোটি ডলার কমে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে আরও দেখা যায়, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১২ শতাংশ, যদিও জুলাই-ডিসেম্বর-১৪ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ১৪ শতাংশ। আর গত সেপ্টেম্বরে এ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছিল ১২ দশমিক ১৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বড় দু’টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় স্থিতিশীল পরিস্থিতিতেও উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না। বৃহত্তর বিরোধী জোটের আন্দোলনের হুমকি এখনও অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং যেকোনো মুহূর্তে দেশের রাজনীতি অস্থির হয়ে উঠতে পারে এই শঙ্কা থেকে কেউ বের হয়ে আসতে পারছেন না। যা বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আমদানি ব্যয় বাড়ার সঙ্গে রফতানি আয় কমে যাওয়া এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকের বেতন-ভাতা পরিশোধে সেবামূল্য ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি হিসেবে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। যদিও গত দুই অর্থবছরজুড়ে বড় অঙ্কের অর্থ চলতি হিসেবে উদ্বৃত্ত ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে চলতি হিসাবের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক (-) ৩৫ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের একই সময়ে স্থিতি ছিল ৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়েও চলতি হিসাবের স্থিতি ছিল ৩৪ কোটি ১০ লাখ ডলার। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) এক জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের বেকারত্ব ক্রমবর্ধমান অবনতির দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা চার কোটির ওপরে। ২০১৫ সালের মধ্যেই বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছয় কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে আইএলও। বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপিসহ দেশী গবেষণা প্রতিষ্ঠানও একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। উন্নয়ন সহযোগীদের আশঙ্কা সত্য হলে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশই বেকার হয়ে যাবে। মূলত উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে নাজুক পরিস্থিতিতে এই আশঙ্কা জোরালোভাবে দেখা দিয়েছে। বেসরকারি খাতের মন্দা পরিস্থিতিতে সরকার পদ্মা সেতুর মতো উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে বাজেটে প্রস্তাবিত ঘাটতি অর্থায়ন তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ঘাটতি অর্থায়ন হয়েছে ১২ হাজার ৬০ কোটি ১৫ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪ হাজার ৪৭৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এ সময়ে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে ১০ হাজার ৯১৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ হাজার ২৬৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। সূত্র মতে, বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় ব্যাংকিং খাতে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য পড়ে আছে। নগদ অর্থের চাহিদা কমায় ব্যাংকগুলো ইতোমধ্যে আমানতের ওপর সুদহার কমিয়ে দিয়েছে। এতে আমানতকারীরা বিকল্প সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকছেন। দেশে নতুন কোনো উদ্যোগ গড়ে না ওঠায় ঋণচাহিদা অনেক কমে গেছে। এতে করে ব্যাংকগুলোও তহবিল ব্যবস্থাপনায় ভিন্ন পথ বের করার চেষ্টা করছে। এতে বেসরকারি খাতের বিদ্যমান কারখানাও চাহিদামাফিক ঋণের জোগান পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিদেশী ঋণের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে সে অর্থও যথাযথ খাতে ব্যবহার না হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার দায়ে নতুন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সূত্র আরও জানায়, দেশের ইতিহাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন সর্বাধিক। আমদানি ব্যয় সেই হারে বৃদ্ধি না পাওয়া এবং রফতানিতে স্থিতাবস্থা বিরাজ করায় রিজার্ভের এই রেকর্ড। তবে রিজার্ভের এ উচ্চতায় পৌঁছতে বড় ভূমিকা রেখেছে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স। দেশের অর্থনীতিতে অনন্য অবদান প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স হলেও তা নেতিবাচক ধারায় চলছে। তথ্যে দেখা যায়, ২০১২ সালের চেয়ে ২০১৩ সালে প্রায় দুই লাখ কম জনশক্তি রফতানি হয়েছে। জনসংখ্যা রফতানির এ নেতিবাচক চিত্র দেশের রেমিট্যান্সে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। মাত্র এক বছরেই দেশের রেমিট্যান্স আয় কমেছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের একটি অন্যতম মাধ্যম ছিল জনশক্তি রফতানি। দেশের দক্ষ ও অদক্ষ জনশক্তির ভালো বাজার ছিল বিদেশে। মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে প্রচুর জনশক্তি রফতানি করা হতো। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে খুঁজে বের করা হতো শ্রমবাজার। বাংলাদেশের জনশক্তির চাহিদা ছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে এখন পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। পর্যালোচনায় দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উৎসাহে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশী ঋণ গ্রহণের প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পায়। এতে গত পাঁচ বছরে বেসরকারি খাতে ৪৩ হাজার কোটি টাকার (৫৫৩.৬২ কোটি ডলার) বৈদেশিক ঋণ দেশে আসে। তবে এ ঋণ দেশীয় শিল্প বিকাশে ব্যয় না হয়ে ভিন্ন খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। সম্প্রতি দেশের ২১টি ব্যাংকে পরিচালিত পরিদর্শনে দেখা যায়, বৈদেশিক ঋণের বেশির ভাগ মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যবহারের কথা থাকলেও তা দিয়ে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর আগের ঋণের দায় মেটানো হয়েছে। মূলত বিদেশ থেকে ঋণ এনে দেশীয় বিভিন্ন ব্যাংকের বকেয়া ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের শ্রমবাজার মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশকেন্দ্রিক। এসব দেশের প্রধান আয় আসে জ্বালানি তেল রফতানির মাধ্যমে। বিশ্ববাজারে ব্যারেল প্রতি তেলের দর প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত প্রবাসীরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। বিশেষ করে অদক্ষ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত হলে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গত অর্থবছর থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার পেছনে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন শ্রমবাজার তৈরি না হওয়া একটি বড় কারণ। এদিকে বছরজুড়ে শেয়ার বাজারেও অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল নাজুক। স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা ও মালিকানা পৃথকীকরণের (ডিমিউচুয়ালাইজেশন) পর পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা আনতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পাশাপাশি অনেক গঠনমূলক উদ্যোগ নিয়েছে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ। এর মধ্যে কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং কিছু বাস্তবায়নাধীন। চলতি বছর এর সুফল দৃশ্যমান না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের জন্য সুফল বয়ে আনবে বলে বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিমত। বাস্তবায়নাধীন উদ্যোগগেুলো হচ্ছে- ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট জাতীয় সংসদে পাস, বিনিয়োগকারীদের মোবাইল ফোনে খুদে বার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে লেনদেন সংক্রান্ত তথ্যসেবা দেয়া, স্টক এক্সচেঞ্জের খসড়া লিস্টিং রেগুলেশন যাচাই-বাছাই ও সংশোধন, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও প্রাইভেট ইক্যুইটি সংক্রান্ত বিধি-বিধান প্রণয়ন, ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেটের (ওটিসি) কোম্পানিকে মূল মার্কটে আনার নীতিমালা প্রণয়ন, ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে নতুন আইপিও আবেদন প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে চালু, বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মিয়ানমার মিলে চীনে ‘প্যান এশিয়া স্টক এক্সচেঞ্জ’ স্টক এক্সচেঞ্জ গঠন, ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের ৯০০ কোটি টাকা বণ্টন, ডেরিভিটিভস মার্কেট, ক্লিয়ারিং করপোরেশন ও কমোডিটি মার্কেট গঠন ইত্যাদি।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির