post

ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্র কখনোই হজম করেনি বাংলাদেশ

সরদার আবদুর রহমান

১১ অক্টোবর ২০২৪

ষাট আর সত্তর দশকের সামরিক সরকারের স্বেচ্ছাচারমূলক শাসনের অবসান ঘটানোর আন্দোলন করতে গিয়ে সেই সরকারের একগুঁয়েমির ধারাবাহিকতায় স্বাধীন হয় বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড। একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক, আত্মমর্যাদামূলক ও কল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থার যে স্বপ্ন দেখেছিল এদেশের মানুষ অচিরেই সে স্বপ্ন ভেঙে যায় নতুন একটি একদলীয় স্বৈরশাসক কাঁধে চেপে বসার কারণে। এর ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময় এধরনের সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা জাতিকে একটি স্থিতিশীল ও টেকসই গণতান্ত্রিক শাসন থেকে বঞ্চিত করতে থাকে। কিন্তু ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, কোনো প্রকার ফ্যাসিবাদ আর স্বৈরতন্ত্রকে কখনোই হজম করতে পারেনি এই বাংলাদেশ।

১৯৭৫ সালের একদলীয় বাকশালকে উৎখাতের প্রক্রিয়া যতই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হোক না কেন তার তো বিকল্প ছিল না। আগস্ট থেকে নভেম্বরের ঘটনাবলি একইভাবে ইতিহাসের পৃষ্ঠাকে উল্টে দিয়েছে। তেসরা নভেম্বরের প্রতিবিপ্লবকে নস্যাৎ করে দিয়েছে ৭ নভেম্বর। এরশাদীয় স্বৈরশাসনকে হটিয়ে দিয়েছে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান। আর চব্বিশের গণবিপ্লব উৎপাটিত করেছে ফ্যাসিবাদের বটবৃক্ষটিকে। এভাবে দেখা যায়, একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্থিতিশীল করার জন্য গণতান্ত্রিক এবং জনসাধারণের ভোট ও কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইকে কখনো বৃথা যেতে দেয়নি এদেশের মুক্ত মনের মানুষেরা। সর্বশেষ ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইয়ে দেশের ছাত্রসমাজ শোককে শক্তিতে পরিণত করে তারুণ্যের যে বিস্ফোরণ ঘটাল তা থেকে আগস্ট-এর প্রথম সপ্তাহে নতুন কিছু উপহার পেলো বাংলাদেশের ইতিহাস। দীর্ঘ দেড় দশকের একটি রক্তাক্ত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল আরেকটি ‘ঐতিহাসিক পলায়ন’-এর মধ্য দিয়ে।

পঁচাত্তরের পটভূমি

১৯৭২-৭৫ এ শেখ মুজিবের শাসনব্যবস্থার অধীনে জুলুমতন্ত্র পরিচালিত হওয়ার ইতিবৃত্ত বহুল আলোচিত। আর এই তন্ত্রের অবসান ঘটে একটি পরিবারের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে এই ঘটনার যে প্রবল নেতিবাচক বয়ান উপস্থিত করা হয় এবং তার ‘বিচার বিভাগীয় প্রতিশোধ’ গ্রহণ করা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এবিষয়ে রাজনীতিক ও লেখক অধ্যাপক গোলাম আযম যে ভাষ্য প্রদান করেন তা যুক্তযুক্তই মনে হয়। তিনি বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্নেল ও মেজর শেখ মুজিবের স্বৈরশাসন থেকে অসহায় দেশবাসীকে মুক্ত করার মহান উদ্দেশ্যে কোনো বিকল্প পথ না থাকায় বাধ্য হয়ে শেখ মুজিবকে হত্যা করে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বের বহু দেশে সফল সামরিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। কোথাও বিপ্লব সফল না হলে বিপ্লবীরা বিদ্রোহী হিসেবে শাস্তি পেয়েছে। সফল সামরিক বিপ্লব মানে বিপ্লবীদের বিজয়। যদি সামরিক বাহিনীর অনুগত অংশ বিপ্লব ঠেকাতে ব্যর্থ হয় এবং বিপ্লবীরা বিনা বাধায় সরকার পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়, তাহলে বোঝা গেল বিপ্লব সফল হয়েছে। যদি জনগণ এ পরিবর্তনে সন্তুষ্ট বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে এটাকে পরম সাফল্য বলা চলে। শেখ হাসিনার পিতা-মাতা ও ভাইদের নিহত হওয়ার কারণে ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত বেদনাবোধ করাই স্বাভাবিক। এদিক দিয়ে তার প্রতি সবারই সহানুভূতি বোধ করা উচিত। এটা অবশ্য মানবিক ব্যাপার। কিন্তু যারা তাকে হত্যা করেছেন, তারা তাদের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ হাসিল করার জন্য তা করেননি। ইতিহাস সাক্ষী এবং বর্তমানে যাদের বয়স ৪০-এর বেশি, এমন কোটি কোটি বাংলাদেশি দেশে ও বিদেশে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য বেঁচে আছে যে, শেখ মুজিবের পতন দেশ ও জাতির জন্য অপরিহার্য ছিল। এটাকে সাধারণ হত্যা মনে করা একেবারেই অযৌক্তিক।” (গোলাম আযম : জীবনে যা দেখলাম)। দেখা গেলো, যে প্রক্রিয়া-পদ্ধতিতেই হোক- গণবিরোধী শাসনব্যবস্থাকে এদেশের মানুষ গলাধঃকরণ করতে সমর্থ নয়।

আগস্টের পর আসে নভেম্বরের পর্ব। আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি অংশ তখন খন্দকার মোশতাক আহমেদের মন্ত্রিসভায়; বাকিরা কারাগারে কিংবা প্রাণভয়ে আত্মগোপনে। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে যারা মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবছিলেন, তাদেরই একটি অংশ ৩ নভেম্বর ভোরে ঘটনাপ্রবাহের গতিপথ পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ওই অভ্যুত্থানে বন্দী হন সেই সময়ের সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। কিন্তু তিন দিনের মাথায় পাল্টা অভ্যুত্থানে নিহত হন খালেদ মোশাররফ। সেই ঘটনাপ্রবাহ জিয়াকে নিয়ে যায় ক্ষমতার কেন্দ্রে। এখানেও দেখা যায়, সাধারণ মানুষের চেতনার বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু কবুল করতে  রাজি নয় তারা।

পার পাননি স্বৈরশাসক এরশাদও 

আশির দশকেও এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। কিন্তু পরিস্থিতির নায়ক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদও পার পাননি। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মার্চ একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলসমূহ বিভিন্ন জোট গঠন ও পৃথকভাবে এই দখলদারত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় দীর্ঘ ৯ বছরব্যাপী আন্দোলন-সংগ্রামের ধারা। যেটি ইতিহাসে ‘স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন’ নামে খ্যাত হয়ে যায়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের দু’বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই একটি কেয়ারটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রথম ফর্মুলা উপস্থাপন করে জামায়াতে ইসলামী। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ নভেম্বর ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান এই ফর্মুলা প্রদান করেন। এরপর চলে লাগাতার আন্দোলন। অতঃপর ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। শুরু হয় দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চর্চার আরেক অধ্যায়।

কী করেছিল ফ্যাসিবাদীরা?

জানুয়ারি ২০০৯ থেকে জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত দীর্ঘ টানা পনেরো বছর একাধিপত্য বজায় করে রেখেছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদীরা। তাদের মোটাদাগে যে সকল কর্মকাণ্ড থেকে গণমানবমুক্ত হয় তার মধ্যে রয়েছে, মানুষ একাধারে তার হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার পথ সুগম হয়। দেশের সার্বিক শাসনব্যবস্থা বিশেষ দলের কুক্ষিগত হওয়া থেকে পরিত্রাণ পায়। লুটপাট ও টাকা পাচারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অবসান সূচিত হয়। নির্বাচন ও ভোটব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার কবল থেকে উদ্ধার পায়। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিশেষ দেশের আনুকূল্যে গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া চলেছিল এবং একে দুর্বল করে ফেলা হয়েছিল তার অবসান হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সর্বত্র সিন্ডিকেট করে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা লুটপাট করার কৌশল বন্ধ হওয়ার পথ খুলে যায়। বিচার বিভাগকে অনুগত করে গড়ে তুলে তাকে ইচ্ছেমতো কাজে লাগানো হয়। আগামীতে হয়তো বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ বাস্তব রূপ পেতে পারবে। এভাবে শিক্ষা, সংস্কৃতি, মিডিয়া, বিনোদন-সর্বক্ষেত্রে এমন অবস্থা তৈরি করা হয় যাতে একটি গোলামি ও দাসত্বমূলক প্রজন্ম সৃষ্টি করা যায়।

আওয়ামী লীগের দেড় দশক সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে সর্বাধিক শ্রুত স্লোগানগুলোর একটি হলো ‘উন্নয়ন’। এমনকি এই উন্নয়নকে গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতেও দ্বিধান্বিত হয়নি এই সময়কালের ক্ষমতাসীন সরকারের নীতিনির্ধারকগণ। কিন্তু এই স্লোগানকে পুঁজি করে একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ (ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শেয়ারবাজার, সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি) করে। বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হতে থাকে। ব্যাংকের টাকা নির্বিঘেœ পাচার হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় দুর্নীতি যেন স্বাভাবিক ও সহনীয় বিষয়ে পরিণত হয়। আমদানি-রফতানির প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার চলে।

বিদেশে অর্থ পাচার ও মানি লন্ডারিং, আমদানি-রফতানির প্রক্রিয়ায় বিদেশে টাকা পাচার, প্রণোদনার অর্থ ভাগাভাগি, ব্যাংক দলীয়করণ ও আত্মীয়করণ, আমানতকারীদের সঙ্কট, রাজস্ব বিপর্যয়, কালো টাকা সাদা করা প্রভৃতি বিষয়সমূহ ছাড়াও ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অব্যবস্থা। এই সময়ে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় দুর্নীতি নিয়েও অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি ছিল বেশি আলোচিত। এছাড়াও সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় দুর্নীতি, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি, সড়ক ও সেতুতে প্রশ্নবিদ্ধ ব্যয়, স্থানীয় সরকারে দুর্নীতি, সরকারি সম্পত্তি দখল প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়। 

আলোচ্য সময়কালে সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থের হরিলুট চলতে দেখা যায়। নানা কৌশলে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব খাটিয়ে এই অর্থ লুণ্ঠনের মহোৎসব চলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার কবলে পড়ে এসব বিষয় ধামাচাপা পড়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে ঘটনার নায়করা একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় লুণ্ঠনকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনাও দুরূহ হয়ে পড়ে।

বিদেশে টাকা পাচারের জন্য আমদানি ও রফতানির মতো একটি বৈধ পদ্ধতিকে ব্যবহার করে অবৈধ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। মহলটি এজন্য ব্যাংকের এলসি পদ্ধতিকে টার্গেট করে। এভাবে বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচার করে থাকে মহলটি। এছাড়াও আলোচ্য সময়কালে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়ে সরকারের দেওয়া প্রণোদনার অর্থও হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠে। এই সময়কালে আর্থিক বিষয়ের অন্যান্য খাতগুলোর মতোই ব্যাংকঋণ ও শেয়ারবাজারে এক অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করে। শত শত কোটি টাকার ঋণ নিয়ে তা ব্যাংকে ফেরত দেওয়ার পরিবর্তে এর গ্রহীতারা অদৃশ্য হয়ে যায়। শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটে নিয়েও বহাল তবিয়তে থাকেন দাগাবাজরা। এমনকি কেউ কেউ পুরস্কৃতও হন। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিশেষত স্বাস্থ্য খাতে বিপুল মাত্রার দুর্নীতি ঘটে আলোচ্য সময়ে। সরকারি কেনাকাটায় বিশেষত ক্রয়কৃত পণ্যের মূল্য কয়েকগুণ বেশি দেখিয়ে বাড়তি টাকা আত্মসাৎ করা হয় বলে অভিযোগ উঠে। সরকারের দুর্নীতি প্রতিরোধকারী সংস্থাগুলোর লোকদেখানো তৎপরতা থাকলেও দুর্নীতির মাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন কুলিয়ে উঠতে পারে না। প্রভাবশালীদের সুতার টানে এসব পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদি চক্করে আবর্তিত হতে থাকে।

শেখ হাসিনার পলায়ন

ক্ষমতার মসনদে জেঁকে বসা সেই আওয়ামী ক্ষমতাধরদের অবশেষে ক্ষমতা ছাড়তে হলো। কেবল ক্ষমতা ছাড়া নয়, প্রধানমন্ত্রী‘ তার পুরো মন্ত্রিসভা, পুরো সংসদ এবং পুরো ক্যাডার বাহিনী সমেত দলীয় নেতা-কর্মী-সকলকেই পালাতে হলো। কেউ দেশ ছেড়ে কেউ আত্মগোপনে গিয়ে জনতার রুদ্র রোষ থেকে আত্মরক্ষা করলো।

এই ঐতিহাসিক পলায়নের পটভূমিতে ছিল নানান ঘটনাবলি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শেখ হাসিনা অসৎ উদ্দেশ্যে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিদের জন্য কোটাপ্রথা সৃষ্টি করেন। এই কোটার জালে আটকে পড়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল ২০১৮ সালে। সেই আন্দোলন সফল হয় স্বেচ্ছাচারী হাসিনার রাগের মাথায় পুরো কোটা বাতিল করে দেয়ার মাধ্যমে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালেও জাতি দেখলো একঝাঁক তরুণ নেতৃত্বের বিস্ফোরণ। যে বিস্ফোরণ অত্যাচারী একনায়কের সিংহাসন তছনছ করে দিয়েছে মাত্র ৩৬ দিনের আন্দোলনে!

একজন বিশ্লেষকের মতে, পতিত সরকার যখন বুঝতে পারলো যে, কোটাপ্রথা বাতিল করায় সরকারি চাকরিতে মেধার তোড়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরকে পুনর্বাসন করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন আদালতের কাঁধে ভর করে পুনরায় কোটাপ্রথা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল। এর মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয়েছিল পতিত-স্বেচ্ছাচারী শেখ হাসিনার শেষের শুরু। গত চব্বিশের জুনের ৫ তারিখে উচ্চ আদালত কোটাপ্রথা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারির পরপরই ছাত্ররা এর প্রতিবাদ শুরু করে। 

প্রেক্ষাপট: দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঢেঊ

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে দ্বিতীয় দফার টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১ জুলাই ২০২৪ থেকে। অহিংস এই আন্দোলন সহিংস হয় ১৫ জুলাই থেকে। আন্দোলনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ঘটনাবলি নিম্নরূপ: 

- ১ জুলাই, সোমবার : কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে দাবির বিষয়ে চূড়ান্ত সুরাহার আহ্বান। 

- ৩ জুলাই, বুধবার : ঢাকার শাহবাগ মোড় দেড় ঘণ্টার মতো অবরোধ। একই দাবিতে আরো ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও অবরোধ।

- ৪ জুলাই, বৃহস্পতিবার : সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার বিষয়ে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে স্থগিত হয়নি। দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক ও ঢাকায় শাহবাগ মোড় পাঁচ ঘণ্টা অবরোধ।

- ৫ জুলাই, শুক্রবার : ছুটির দিনেও বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ। 

- ৬ জুলাই, শনিবার : ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির আওতায় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ছাত্রধর্মঘট এবং সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক।

- ৭ জুলাই, রোববার : ‘বাংলা ব্লকেডে’ স্থবির রাজধানী। অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা।

- ৮ জুলাই, সোমবার : ঢাকার ১১টি স্থানে অবরোধ, ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ, ৩টি স্থানে রেলপথ অবরোধ এবং ৬টি মহাসড়ক অবরোধ। 

- ১০ জুলাই, বুধবার : প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আমি প্রথম দিনই বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন হয় না। এটা আজকে না, আমি যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছিলাম, তখন একটি মামলায় বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন করা যায় না।’

- ১১ জুলাই, বৃহস্পতিবার : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছেন। এটি অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি। সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘‘শিক্ষার্থীরা ‘লিমিট ক্রস’ করে যাচ্ছেন।’’

- ১২ জুলাই, শুক্রবার : কোটা সংস্কারের দাবিতে শুক্রবার ছুটির দিনেও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল শেষে শাহবাগ মোড় অবরোধ।

- ১৩ জুলাই, শনিবার : কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা পরিস্থিতিকে সহিংস করে তোলে।

- ১৪ জুলাই, রোববার : গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বললেন, ‘কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই।’ শেখ হাসিনা আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?’ একই দিনে পদযাত্রা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডের কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন।

- ১৫ জুলাই, সোমবার : কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাঁরা ‘আমি রাজাকার’ স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বেন বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।

- ১৬ জুলাই, মঙ্গলবার : রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটে নিহত হওয়ার সচিত্র ছবি প্রকাশ। সারা দেশে দিনভর ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। বিকেলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আন্দোলন যাবে, আন্দোলন আসবে। কিন্তু ছাত্রলীগ থাকবে। সবকিছুই মনে রাখা হবে এবং জবাব দেওয়া হবে। একটি ঘটনাও জবাব ছাড়া যাবে না।’

- ১৭ জুলাই, বুধবার : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিতাড়ন করে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা। ছুটির দিনেও ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রবিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ। রাত সাড়ে সাতটায় জাতির উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনার ভাষণ।

- ১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার : আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশ ছিল প্রায় অচল। সারা দেশে বিজিবি মোতায়েন।

- ১৯ জুলাই, শুক্রবার : কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা। রাজধানী ঢাকা কার্যত অচল, পরিস্থিতি থমথমে। রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন। ইন্টারনেট-সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ।

- ২০ জুলাই, শনিবার : দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েন। সাধারণ ছুটি ঘোষণা। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, ধাওয়া ও গুলি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় পরিস্থিতি সহিংস।

- ২১ জুলাই, রোববার : সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের রায়-কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ।

- ২৫ জুলাই, বৃহস্পতিবার : প্রধানমন্ত্রীর মেট্রোস্টেশন পরিদর্শন। বললেন, ‘আমি জনগণের কাছে বিচার চাইছি।’

- ২৬ জুলাই, শুক্রবার : এলাকা ভাগ করে চলছে ‘ব্লক রেইড’। সারা দেশে অভিযান। সারা দেশে অন্তত ৫৫৫টি মামলা। নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে ডিবির হেফাজতে। অপর দুই সমন্বয়ক হলেন আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদার। সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি দেওয়ার পর ১৯ জুলাই মধ্যরাতে খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া থেকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়।

- ২৭ জুলাই, শনিবার : কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরও দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। ১১ দিনে গ্রেফতার ৯ হাজার ১২১ জন।

- ২৮ জুলাই, রোববার : ডিবির হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলেন। মোবাইল ইন্টারনেট ১০ দিন পর সচল।

- ২৯ জুলাই, সোমবার : জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ১৪ দলের বৈঠকে। ৬ সমন্বয়ক ডিবি হেফাজতে। ‘জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না’-এক শুনানিতে এ মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।

- ৩০ জুলাই, মঙ্গলবার : হত্যার বিচার চেয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতি, স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের প্রোফাইল লাল রঙের ফ্রেমে রাঙিয়েছেন অনেকে। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের।

- ৩১ জুলাই, বুধবার : ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির পর বৃহস্পতিবারের জন্য নতুন কর্মসূচি ঘোষণা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশের। কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’।

- ১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার : জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

- ২ আগস্ট, শুক্রবার : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জুমার নামাজের পর ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি পালিত। 

- ৩ আগস্ট, শনিবার : সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে উত্তাল বাংলাদেশ। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হন শিক্ষার্থীসহ হাজারো জনতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে রাজধানীসহ দেশের ৩৩টি জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ।

- ৪ আগস্ট, রোববার : সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিনে ১৮ জেলায় ব্যাপক সংঘাত। ১১৪ জন নিহত।

- ৫ আগস্ট, সোমবার : রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা। গণভবন, সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে অসংখ্য মানুষ। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন ও আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে আগুন।

- ৮ আগস্ট, বৃহস্পতিবার : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিলেন নোবেলজয়ী ড. ইউনূস। এদিন রাতে বঙ্গভবনের দরবার হলে তাকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন। 

সবমিলিয়ে শেষ অবধি এই আন্দোলনে দেড় সহস্রাধিক ছাত্রসহ বিভিন্ন বয়স ও পেশার মানুষ এমনকি শিশুও নিহত হয়। আহত হয় পঁচিশ হাজারের বেশি মানুষ। আহতদের কেউ কেউ চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায় ফ্যাসিবাদের নির্যাতনের সাক্ষী হিসেবে।

বিশ্ব জুড়ে প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের ঘটনাবলি বিশ^ময় তোলপাড় সৃষ্টি করে। ঢাকায় বিক্ষোভ দমনে জাতিসংঘের লোগো সংবলিত ভারি যানবাহন ব্যবহার করায় এটি আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে বিশেষত জাতিসংঘের অবস্থান ছিল সমালোচনামুখর। এছাড়া আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচুর প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। এসময় ভারত সরকারের অবস্থান ছিল ধোঁয়াশায় ভরা। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এ নিয়ে চলে কিছু পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় দেশসমূহ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকে। অপরদিকে ভারত, চীন, রাশিয়া, ইরান প্রভৃতি আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কোনো প্রকার অবস্থান গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। এমনকি কোনো প্রতিক্রিয়াও তারা প্রকাশ করেনি।

এ বিষয়ে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম তার একটি কলামে বলেন, “অর্ধশতাব্দী আগে ৭ নভেম্বর যে বিপ্লব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে নতুনভাবে নিশ্চিত করেছিল, সেটি আজও প্রাসঙ্গিক। ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাইয়ের গৌরবময় বিপ্লবের সাথে রয়েছে এর চেতনা, সংযোগ ও পরম্পরা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছাত্ররা সূচনা করেছিল, জনগণের রক্তদানের মধ্য দিয়ে সফলতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল এই গণবিপ্লব। আর এই বিপ্লবকে পরিপূর্ণতা দানে এগিয়ে এসেছিল আমাদের প্রিয় সেনাবাহিনী। গণবিপ্লবের সফলতার পেছনে অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তারা বিভিন্ন সেনা আবাসিক এলাকায় যে আন্দোলন করেছেন, তা সেনা নেতৃত্বকে আন্দোলিত করেছে। আবারো সেনাপ্রধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অবদান রেখেছেন। তিনি সঠিক দায়িত্ব পালন না করলে, আরেকটি রক্তক্ষয়ের দিকে ধাবিত হতে পারত দেশ। ছাত্র-জনতা ও সেনাবাহিনীর সেই সংযোগ, ধারাবাহিকতা ও নেতৃত্ব ৩৬ জুলাইয়ের বিপ্লবকে করেছে মহিমান্বিত। এই জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে প্রত্যাশিত ইস্পাত কঠিন ঐক্য যদি বহমান থাকে তাহলে কখনোই পরাজিত হবে না বাংলাদেশ।”

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গ্রন্থপ্রণেতা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির