post

বঙ্গবাজার ট্যাজেডি আমরা কতটা শিক্ষা নিচ্ছি

শাহাদত হোসেন

১১ মে ২০২৩

এ বছরের মার্চে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে বিপুল সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। এসব ঘটনায় মানুষের প্রাণহানিও ঘটেছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় মাঝে-মধ্যেই অগ্নিকাণ্ড যেমন ঘটে তেমনি ক্ষয়ক্ষতিও যথেষ্ট পরিমাণে হয়ে থাকে। এজন্যই বেশ কিছুদিন ধরে আগুনের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হচ্ছিল। কিন্তু এসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখা এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া যাদের দায়িত্ব সেই বিশিষ্টজনেরা আহ্বানের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। আর সে কারণেই দু’-চারদিন পরপরই রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে চলেছে। 

গত এপ্রিল মাসে কয়েক দিন ধরে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড ঘটছে বিভিন্ন মার্কেট আর বিপণি বিতানে। গত ৪ এপ্রিল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে যায় দেশের সব চেয়ে বৃহৎ পোশাকের পাইকারি মার্কেট ঢাকার বঙ্গবাজার। ১১ এপ্রিল চকবাজারের সিরামিক গুদামে আগুন লাগে। এরপর গত বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) পুরান ঢাকার নবাবপুর রোডে আগুন লেগে পুড়ে যায় ২০টির মত গুদাম। শনিবার ভোরে আগুন লাগে ঢাকা নিউ মার্কেটের পাশে নিউ সুপার মার্কেটে, তাতে পুড়ে যায় ছয় শতাধিক দোকান। এসব ঘটনায় প্রাণহানি না হলেও ঈদের আগে ব্যবসায়ীরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বঙ্গবাজার ট্যাজেডির ক্ষত এখনো দগদগে। টানা সাড়ে ছয় ঘন্টার আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে পুরো বঙ্গবাজার। এছাড়াও মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাশের এনেক্সকো টাওয়ার এবং আরও কিছু ভবন। পুড়ে গেছে অন্তত পাঁচ হাজার দোকান। পাশেই বাংলাদেশ পুলিশের হেড কোয়ার্টার্সের সীমানায়ও ছড়িয়ে পড়ে আগুন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে তদন্ত কমিটি। রাজনীতির মাঠ গরম করেছেন সরকার ও বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ। তবে কাজের কাজ কি হয়েছে সেটা দেখার বিষয়! 

কারণ বঙ্গবাজার ঘটনার পরে আরো তিনটি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। নিউ সুপার মার্কেট, বায়তুল মোকাররমের জুয়েলারি মার্কেটে ও উত্তরায় বিজিবি মার্কেটে আগুন লাগে।

বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাশকতার প্রমাণ পায়নি সিটি করপোরেশেনের তদন্ত কমিটি। তারা বলেছে, মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে। সিগারেটের আগুন অথবা মশার কয়েলের আগুন থেকে এই ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকার। 

ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের সাড়ে ৬ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ততক্ষণে পুড়ে যায় বঙ্গবাজারের সব দোকান। তদন্ত কমিটি আগুন লাগার কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কাজ করেছে। প্রথমত, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে কি না; দ্বিতীয়ত, এটি নাশকতা ছিল কি না; তৃতীয়ত, দুর্ঘটনা বা অন্য কারণে ঘটেছে কি না?

কমিটির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেটের কাঠামোগত অবস্থান ও নির্মাণসামগ্রী বিবেচনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পর্যবেক্ষণে অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সে কারণে মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে দোকানমালিক, ভাড়াটিয়া, কর্মচারী, নিরাপত্তা প্রহরীসহ সবার জন্য বৈদ্যুতিক হিটার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, যেকোনো রান্নার চুলা, মশার কয়েল ব্যবহার বা ধূমপানের বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তারপরও শাটার তালাবন্ধ অবস্থায় একটি দোকানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে। 

দিনে দিনে আগুন লাগার ঊর্ধ্বমুখী ঝুঁকির সঙ্গে তাল রেখে বাড়েনি আগুন প্রতিরোধের সক্ষমতা। আমাদের অজান্তে আগুন লাগানোর দায়িত্ব আমরা নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে আগুন নেভানোর দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছি ফায়ার সার্ভিস নামের প্রতিষ্ঠানকে। ফায়ার সার্ভিসের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা প্রাণ হারাচ্ছেন, পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছেন, আহত হয়ে কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে হাসপাতালে। এরপরও মানুষ তাঁদেরই দুষছে। আক্রান্ত হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস অফিস। আগুন নেভানোর গাড়ি। বঙ্গবাজারের সর্বনাশা আগুনের পর আবার ভিড়ের সেই ভিরমি খাওয়া আচরণ প্রকাশ পেয়েছে। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে। হয়তো জেলজরিমানাও হবে। কিন্তু ভিড়ের এই আচরণ বন্ধ হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, এত কাছে ফায়ার সার্ভিস অফিস, তবু কেন সব পুড়ে শেষ হলো? পাল্টা প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এত বিধ্বংসী আগুন লাগল। অনেকেই মনে করেন, আগুন না লাগাটাই ছিল অস্বাভাবিক। রাজধানীর অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতানের মধ্যে গুলিস্তানের বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি বিপণিবিতানকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হতো সব সময়। তবে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, সেখানে আগুন লাগার কোনো ঝুঁকি ছিল না। বিপণিবিতানটিতে অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থা ছিল।

অবশ্য বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন ভিন্ন কথা, বলেছেন, তাঁরা সব সময় ঝুঁকিতে ব্যবসা করেন। সবচেয়ে সস্তায় ‘ভাড়া’ করা কথিত নিরাপত্তাকর্মীদের (সিকিউরিটি গার্ড) আগুন নেভানোর কোনো প্রশিক্ষণ কি কেউ কখনো দিয়েছেন? তাঁরা কি জানতেন কীভাবে আগুন নেভানোর যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইশার) ব্যবহার করতে হয়। কোথায় লেখা থাকে সেগুলোর মেয়াদকাল?

বঙ্গবাজারে ১৯৯৫ সালের পর সর্বশেষ বড় ধরনের আগুন লাগে ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বঙ্গবাজারের গুলিস্তান ইউনিটের সেই আগুনে অনেক ক্ষতি হয়েছিল। তবে এবারের মতো সবটা শেষ হয়ে যায়নি। সব শেষ হওয়া ১৯৯৫ সালের আগুনে পুড়েছিল ৫২৫টি দোকান।

২০১৮ সালে বঙ্গবাজারে আগুনের সময় ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট প্রায় আধা ঘণ্টা চেষ্টা করে সকাল ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুন লাগার পর বিপণিবিতানটির কর্তৃপক্ষকে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দুই দফা নোটিশ দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের সেই আগুনের তদন্ত প্রতিবেদন দিতে দিতে ২০১৯ সালের মার্চ মাস এসে যায়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, বারবার সতর্ক করার পরও বঙ্গবাজার কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক কমিটির নির্দেশনা মানেনি।

বিপণিবিতানটির অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলেও কোথাও ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা (স্মোক ও হিট ডিটেক্টর), ফায়ার হোজরিল, পাম্প, ফায়ার অ্যালার্ম বা অন্য কোনো অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থা ছিল না। হতাশার সঙ্গে আশঙ্কা করা যায়, ২০২৩ সালের আগুনের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদনে একই কথা থাকবে।

এই অগ্নিকাণ্ডে এত বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি ঈদের আগে তো বটেই, আগামী কয়েক বছরেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। সেজন্য শুধু নয়, অন্য কিছু বিশেষ কারণেও অগ্নিকাণ্ডটি নিয়ে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এরকম একটি কারণ হলো সময়ের ব্যবধান। ১৯৯৫ সাল থেকে রাজধানীর অন্য কিছু এলাকার মতো বঙ্গবাজারেও দফায় দফায় আরো কয়েকবার আগুন লেগেছে এবং প্রতিবারই কয়েক কোটি টাকার কাপড় ও অন্যান্য পণ্য ভস্মীভূত হয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন ও সরকারের দেওয়া আশ্বাসের বাইরে সামান্য ক্ষতিপূরণও পায়নি ক্ষতিগ্রস্তরা। এবারও যে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে না সে বিষয়ে অনুমান করা হচ্ছে সিটি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের একটি বক্তব্যের কারণে। অনেকাংশে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার স্টাইলে তিনি বলেছেন, চার বছর আগে, ২০১৯ সালেই বঙ্গবাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। লক্ষ্যণীয় যে, কথাটুকুর মধ্য দিয়ে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করা হলেও জনগণ কিন্তু যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা তো বটেই, জনগণও বরং প্রশ্ন করতে পারে, ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানার পরও সিটি করপোরেশন বঙ্গবাজারকে কেন বাণিজ্যিক স্থাপনা হিসেবে চালু থাকতে দিয়েছিল? বলা হচ্ছে, সবকিছুর অন্তরালে ঘুষ তথা নগদ টাকার লেনদেনই প্রধান কারণ না হয়ে থাকলে বঙ্গবাজার যেমন চালু থাকতে পারতো না তেমনি এত বিপুল ক্ষয়ক্ষতিও ঘটতে পারতো না। 

এখানে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত একটি নিয়মের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। সে নিয়মটি হলো, কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা থেকে শিক্ষা নিতে এবং ভুলত্রুটি চিহ্নিত করতে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ এ ব্যাপারেও ক্ষতিকর কার্যক্রমই দেখিয়ে চলেছে। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড সে ধারাবাহিতারই নতুন একটি ঘটনা মাত্র। অথচ বিশ্বব্যাপী প্রচলিত নিয়ম হলো, একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সেটি থেকে শিক্ষা নিতে হয়। ভুলত্রুটি চিহ্নিত করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এ ব্যাপারেও ক্ষতিকর অবস্থানে রয়েছে। 

জনগণের সচেতন অংশ মনে করেন, এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডকে স্বাভাবিক বলার উপায় নেই। মূলত সে কারণেই ক্ষতিগ্রস্তরা বিশেষ গোষ্ঠীর দিকে আঙুল উঠিয়েছেন। তারা বলেছেন, এসব অগ্নিকাণ্ড মোটেও দুর্ঘটনা নয় বরং বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর লোকজন সুপরিকল্পিতভাবে মার্কেট ও বস্তিতে আগুন লাগিয়ে থাকে। বঙ্গবাজারের ক্ষেত্রে তো জায়গা দখলে নেয়া এবং সেখানে বহুতল নতুন কোনো স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনার কথা অনেক আগেই জানাজানি হয়েছে। সেখানে সুবিধাভোগী কোনো বিশেষ গোষ্ঠী মার্কেট এবং আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে চায়। বলা হচ্ছে, সে লক্ষ্যেই অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে পরিস্থিতি অনুকূলে আনা হয়েছে- যাতে সহজেই বঙ্গবাজারকে খালি করা এবং সেখানে পরিকল্পিত ফ্ল্যাট নির্মাণ করা সম্ভব হয়। 

এ ধরনের বিভিন্ন প্রশ্ন ও সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতেই অগ্নিকাণ্ডের অন্তরালের কারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে, সায়েন্স ল্যাব এবং সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটানোর পরপরই আগুন ধরানো হয়েছে বঙ্গবাজারে। এ থেকেও পরিষ্কার হয়েছে, সবকিছুর পেছনে রয়েছে বিশেষ কোনো গোষ্ঠী। একই কারণে আগে থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। 

প্রসঙ্গক্রমে অন্য দু-একটি জরুরি বিষয়েও বলা দরকার। সরু রাস্তাঘাট এবং পানির অভাব এরকম দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বঙ্গবাজারসহ সকল ঘটনাতেই দেখা গেছে, দমকল বাহিনীর ২৫ থেকে ৫০টি পর্যন্ত ইউনিট তৎপরতা চালালেও প্রধানত সরু রাস্তা এবং সব রাস্তায় আসবাবপত্র পড়ে থাকার কারণে ওই এলাকায় সহজে গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। বঙ্গবাজারেও সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি ছিল পানির জন্য প্রয়োজনীয় পুকুর না থাকার কারণ। এলাকায় পুকুর নেই বলেই দমকল বাহিনীকে অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করে আনতে এবং সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে বহু কষ্টে প্রবেশ করতে হয়েছে। একই কারণে যথেষ্ট জনবল থাকা সত্ত্বেও কম সময়ে আগুন নেভানো এবং আগুনের বিস্তার প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি। ক’দিন আগে এলিফ্যান্ট রোডের ঘটনার ক্ষেত্রেও মূলত পানির কারণেই দমকল বাহিনীর দশটি ইউনিটকে অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করে এনে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছিল। এবার তো হেলিকপ্টারযোগে হাতিরঝিল থেকে পানি আনা হয়েছে। এজন্যই জনবল এবং মানুষের চেষ্টা থাকলেও আগুনের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া যায়নি। 

ঈদের আগে সব দোকানেই লাখ লাখ টাকার পোশাক তোলা হয়েছিল। পুড়ে গেছে সব। এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, যে দেশ পদ্মা সেতুর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে সেই দেশের খোদ রাজধানীতে আগুন নিয়ন্ত্রণে কতটা মাজুল দশা বিরাজমান। এটি একটি বেদনার দিক। আরও বেশি হতাশার দিক হচ্ছে- বঙ্গবাজারের আগুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতিপয় রঙ্গের বিষয়। বঙ্গবাজারের আগুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেসব রঙ্গ হয়েছে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে- অগ্নিকাণ্ডের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সাবেক শাসক দল বিএনপি পরস্পরকে দায়ী করা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৭ এপ্রিল বলেছেন, ‘প্রকৃত নিরপেক্ষ তদন্ত যদি হয় তাহলে সম্ভাবনা আছে এটা বেরিয়ে আসার যে, এটা সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগের দ্বারাই হয়েছে।’ বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বক্তব্যকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এদিকে মির্জা ফখরুলের গায়েবি আওয়াজের আগে ৬ এপ্রিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বঙ্গবাজারসহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা কি না, আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে এ ঘটনা ঘটাচ্ছে কি না তা আমরা খতিয়ে দেখছি এবং তা তদন্ত করা দরকার।’ সেতুমন্ত্রী ৮ এপ্রিল বলেছেন, ‘আগুন নিয়ে যে নাশকতা হচ্ছে তার সঙ্গে বিএনপি যুক্ত।’ বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের বিষয় নিয়ে প্রধান দুই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এই যে বক্তব্য তা কি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে? হয়নি। হওয়ার কোনো কারণও নেই। তবু আমাদের নেতারা এ ধরনের কথা অহরহ বলে থাকেন। মানুষ কোন কথা গ্রহণ করবে, কোনটা করবে না- তা আমাদের দেশের রাজনীতিকরা সম্ভবত এখন আর তেমন ভাবেন না। ফলে রাজনীতিকদের কথাবার্তা নিছক কথামালার পর্যায় ছাড়িয়ে এখন রংতামাশার পর্যায়ে নেমেছে বলে অনেকেই মনে করেন। এই হচ্ছে পরিস্থিতি নিম্নগতির নগ্নধারা। অথচ এক সময় রাজনীতিকদের কথা শোনার জন্য মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকত। এ ধারায় অনেক ছাত্রনেতাও রাতারাতি জাতীয় নেতা হয়ে ওঠার উদাহরণ আছে। কিন্তু এখন সবকিছুই যেন চলছে উল্টো রথে। এ দশা কেবল রাজনীতিতে নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই একই দৃশ্যপট নগ্নভাবে প্রকট। সব পেশায়। সব ক্ষেত্রে। ফলে যা ছিল নদী তা এখন অনেক ক্ষেত্রে খালের মতো অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে কোনোরকম। অনেক নদী হয়ে গেছে পুকুর। কোনো কোনো নদী আবার পুকুরচুরির ধারায় অদৃশ্য। সবাই জানে, বাংলাদেশের প্রাণ হচ্ছে নদী। আর নদীর প্রাণ পানি। পানি না থাকলে নদী থাকে না। নদী না থাকলে বাংলাদেশ থাকবে না। নদী মানে বড় জলাধার। ছোট জলাধার না থাকলে কী দশা হয় তা তো বঙ্গবাজারের আগুনের ঘটনায় অকাট্যভাবে প্রমাণিত। কিন্তু শিক্ষা হয়নি। ফলে পানির প্রসঙ্গটি বেমালুম চেপে গিয়ে হেনতেন সাত-সতের বিষয় নিয়ে হা-হুতাশ করা হচ্ছে। চলছে নানা ধরনের বাগাড়ম্বর। কেউ আবার লাখ টাকার পোড়া লুঙ্গি কিনে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছেন। রংতামাশা আর কাকে বলে! এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই, বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি খুবই বেদনাদায়ক ঘটনা। এদের মধ্যে অনেকেই পুঁজি হারিয়েছেন। সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে, ‘সবাই নিঃস্ব হয়ে পথে বসে গেছেন’ তা কিন্তু নয়। কিন্তু ‘সব শেষ হয়ে গেছে’- এ রকম একটি বিষয় বেশ প্রচারণা পাচ্ছে। এর নিচে চাপা পড়ে গেছে কয়েকটি প্রশ্ন। এক. রাষ্ট্রের নানান বিধিবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাঁশ-কাঠ-টিনের তিনতলা কাঠামোতে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা গড়ে ওঠার নেপথ্যের মোড়ল কারা? বারবার নোটিস দেওয়ার পরও কোন ক্ষমতার জোরে তা অবজ্ঞা করা হয়েছে? আদালতের নিষেধাজ্ঞার পর তা ভ্যাকেট করার জন্য দক্ষিণ ঢাকা সিটি করপোরেশন কতটা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছে? কোন যুক্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অর্থ সাহায্য করা হবে? খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, ফুটপাতের হকার পুনর্বাসন নামে বিভিন্ন সময়ে এ পর্যন্ত কাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর নেপথ্যে থেকে ফায়দা লুটেছেন কারা। আরও যদি সংক্ষেপ করে প্রশ্ন তোলা যায়- বঙ্গবাজারে আগুনে যে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা আসলে কারা। তাদের প্রাপ্তির নামে আসলে কাদের প্রাপ্তি ঘটেছে। আর সরকার যদি ক্ষতিপূরণ দেয় তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দেওয়া উচিত। খামখেয়ালি করে বাঁশের ঘরে বসে আকাশছোঁয়া ব্যবসা পরিচালনাকারীদের নয়। একটু গভীরে গেলেই বোঝা যাবে বঙ্গবাজারে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা আসলে হারিয়েছেন এক সিজনের পুঁজি ও মুনাফা। সর্বস্ব হারাননি। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার নামে সরকারের তহবিল থেকে আমজনতার টাকা দেওয়া হলে তা আসলে চলে যাবে নেপথ্যের রাঘববোয়ালদের পেটে। যে পেট আগেই ঢোল হয়ে আছে। তবু তারা হা করে থাকে। এদের অনেকেই টাকার কুমির হিসেবে পরিচিত।

এবারের আগুনে প্রায় সব বাহিনী অংশ নিয়েছে। তবে দরকার ছিল সমন্বিত পূর্বপরিকল্পনা ও বোঝাপড়া। কে থাকবে নেতৃত্বে (কমান্ডে)? কার কথায় চলবে কার্যক্রম (অপারেশন), পরিচালিত হবে আগুন নেভানোর ছক? পানি আনতে আকাশে উড়ব না আশপাশের মসজিদ, ছাত্রাবাস, অফিস আর হোটেলের ট্যাংকগুলো ইস্তেমাল করব-এসব সিদ্ধান্ত কে নেবে, তা আগে থেকে ঠিক করতে হবে। ভিড় কে কীভাবে সামলাবে বা ভিড়কে কীভাবে কাজে লাগানো যাবে, সেটা নিয়েও আমাদের এখন পর্যন্ত কোনো বুদ্ধিমান চিন্তা ডানা মেলতে পারেনি।

মানুষের ভিড়কে দোষারোপ করে অনেকে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। খেয়াল করেননি আমাদের অবহেলায় বেড়ে ওঠা পথশিশুদের অনেকেই দর্শক হয়ে বসে না থেকে ছোট হাতগুলো কাজে লাগিয়েছে কারও আদেশের তোয়াক্কা না করে। ঢাকার বনানীর আগুন, বঙ্গবাজারের আগুন- সবখানেই তারা প্রস্তুত ছিল। এ ধরনের দুর্যোগে সাধারণ মানুষকে কাজে লাগানোর তরিকা আমাদের জানা থাকলেও আমরা সেটা আমল করি না। জনবিচ্ছিন্ন আমলা কালচারের (সংস্কৃতি) সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে জনগণকে বাইরে বসিয়ে রাখার রাজনৈতিক কালচার।

দোকান যাঁর, বাড়ি যাঁর-আগুন নেভানোর প্রাথমিক দায়িত্ব তাঁর; ফায়ার সার্ভিস সে কাজটা কখনই করতে পারবে না। আজ যদি বঙ্গবাজারে ‘অগ্নিপ্রতিরোধ’ কমিটি থাকত, দোকানকর্মী আর মালিকদের সমন্বয়ে সে সব কমিটি যদি তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করার সুযোগ পেত, তাহলে আগুন হয়তো লাগতই না। আর লাগলেও কাকপক্ষী টের পাওয়ার আগেই তা নিয়ন্ত্রণে চলে যেত।

আজ প্রতি ১০০ দোকান পিছু ১০ জনের একেকটা প্রশিক্ষিত দল থাকলে কমবেশি ৩০০ জনের একটা সুশিক্ষিত কর্মী দল ফায়ার সার্ভিসের সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারত। ভিড় ঠেকানো, চুরি বন্ধ, উৎস থেকে নিয়ে আসা পানির পাইপের সংযোগগুলো সুরক্ষা ইত্যাদি কাজে তাঁরা ভূমিকা রাখতে পারতেন।

ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড এড়াতে তদন্ত কমিটি ১০টি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য সুপারিশগুলো হলো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কোনো এলাকায় কাঠের/টিনের মার্কেট থাকা সমীচীন নয়। যদি থেকে থাকে, তা দ্রুত কংক্রিট বা পাকা করার ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় অবস্থিত মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা রাখা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন করে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা সচল আছে কি না, যাচাই করে সনদ দিতে হবে। সেই সনদ দৃশ্যমান স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে ওয়াটার রিজার্ভার থাকতে হবে এবং এটা থেকে পাইপের মাধ্যমে যুক্ত করে মার্কেটের চারটি স্থানে ওয়াটার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখতে হবে। মার্কেটগুলোতে বিদ্যুৎ–সংযোগ, ভোল্ট ক্যাপাসিটি ও ব্যবহারের মধ্যে সামঞ্জস্য সঠিক বা পর্যাপ্ত রয়েছে কি না, তা সব সময় পরীক্ষা করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সিটি করপোরেশন অধিভুক্ত সব জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে ইত্যাদি।

এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই মানুষের জীবন এবং অর্থ-সম্পদ রক্ষার স্বার্থে সরকারের উচিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে জরুরিভিত্তিতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া। আমরা চাই, রাজধানীর কোনো এলাকাতেই যেন আর কোনো অগ্নিকাণ্ড ঘটতে না পারে। যাতে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ করা যায় তাৎক্ষণিকভাবে এবং যাতে আগুনে পুড়ে মানুষকে অসহায়ভাবে প্রাণ ও অর্থ-সম্পদ হারাতে না হয়।

লেখক : সম্পাদক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির