ষড়ঋতুর বাংলাদেশ। ফাল্গুন ও চৈত্র এ দু’মাস বসন্তকাল। বসন্ত আসে আবেগঘন ও বর্ণিল আনন্দবার্তা নিয়ে আপন মহিমায়। ঋতুর পরিবর্তনে গাছের কচি ডালে নতুন পত্রপল্লব হয়ে ওঠে সুশোভিত। সুরভিত সমীরণে গানের পাখি কোকিলের মনকাড়া মধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয় সুমধুর গান; জেগে উঠে ঘুমন্ত আ¤্রকানন। এ ঋতুতে ‘বউ কথা কও’ পাখিও মধুর কণ্ঠে তার সুর তোলে। মৌ মৌ ঘ্রাণে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি। বসন্তে থাকে অজ¯্র ফুলের সমারোহ; হাজার রঙের মিলনমেলা। প্রকৃতিতে বসন্ত ছুঁয়ে যাওয়ার আগেই কিছু ফুল শুভেচ্ছাদূত হয়ে হাজির হয়। বসন্ত ঋতুর গুরুত্বপূর্ণ মাস হলো ফাল্গুন মাস। ফুল ফোটার মাস হিসেবেই এটিকে চিনে সবাই। পুষ্প কাননে জুঁই, চামেলি, রজনীগন্ধ্যা, শিমুল, হাসনাহেনা, গোলাপ, কৃষ্ণচূড়ার সবুজ ডালে শোভাবর্ধন করে রক্তের মতো লাল ফুল। দেশব্যাপী ফুলের সুরভিত শীতল সমীরণে ঢেউ তুলে যায়। কবি বলেছেন, ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’...। বসন্তকাল মানে মহাশান্তি বা প্রশান্তির কাল। এ ঋতু প্রশান্তির মহাডালি নিয়ে হাজির হয়। প্রশান্তি মানে, না আছে শীত আর না আছে গরম। বাংলার প্রবহমান নদীর স্রােতের মতো বসন্তের উল্লাস সবার জীবনে প্রবাহিত হয়ে থাকে। ফাল্গুন মাস এলে-যুগ যুগান্তরে হরেক রকম পাখি, গোধূলিময় পৃথিবী ক্রমে শীতল ছায়া, অজ¯্র রোদের অচিন্তনীয় বিস্তারে প্রাণ ভরে ওঠে। তাই বসন্তের অপরূপ সৌন্দর্যে, সুরভিত ঘ্রাণে ভরে উঠে সবার হৃদয় প্রাণ। সাধারণত প্রতি বছর পহেলা ফাল্গুন হয়ে আসছিল ইংরেজি ১৩ ফেব্রুয়ারি। গত বছর বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধন করেছে সরকার। সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে এ বছর থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন পালন হচ্ছে। এ দিনটিতে প্রকৃতির সাথে সাথে বাসন্তী সাজে সেজে ওঠে বাংলার মানুষেরা। আর শুধু এই বাংলাই নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যাসহ অন্যান্য রাজ্যেও দিনটি বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কবে কিভাবে এসেছে, এত ঘটা করে বসন্ত উৎসব পালনের রেওয়াজ? ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আর্য জাতির হাত ধরে এই উৎসবের জন্ম। খ্রিস্টের জন্মেরও বেশ কয়েকশো বছর আগে থেকে উদযাপিত হয়ে আসছে এই উৎসবটি। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে পাথরের উপর খোদাই করা এক পাথরে পাওয়া গেছে এই উৎসবের নমুনা।
দোলযাত্রার বৈষ্ণব বিশ্বাস এখন যে দোল উৎসব পালিত হয়, এর নেপথ্যে রয়েছে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের কিছু আদি বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের অন্যতম হলো, দোলপূর্ণিমার (ফাল্গুনী পূর্ণিমার অপর নাম) দিনে বৃন্দাবনে আবির ও গুলাল নিয়ে রাধা ও অন্যান্য গোপীদের সাথে রং ছোড়াছুড়ির খেলার মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আর সে কারণেই কি না, এখন দোলপূর্ণিমার দিন রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তিকে আবির-গুলালে ¯œাত করিয়ে, দোলনায় চড়িয়ে বের করা হয় শোভাযাত্রা। আর সেই সাথে চলতে থাকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এই শোভাযাত্রা শেষ হলে, ভক্তেরা এবার নিজেরাও পরস্পরের গায়ে রং মাখানোর খেলায় মেতে ওঠে।
শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্ত উৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। আরেকটি সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯০৭ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুরু করেছিলেন ঋতুরঙ্গ উৎসব। সেদিন শান্তিনিকেতনের প্রাণ কুঠিরের সামনে শুরু হয় এ উৎসব। এখন অবশ্য সেদিনের প্রাণকুঠি শমীন্দ্র পাঠাগার হিসেবে পরিচিত। সেই ঋতুরঙ্গ উৎসবই আজকের বসন্ত উৎসব। আগে বসন্তের যেকোনো দিন অনুষ্ঠিত হতো পরবর্তীকালে বসন্ত পূর্ণিমার দিনই অনুষ্ঠিত হয় এ উৎসব। এ উৎসব অবশ্য ঋতুরাজ বসন্তকে স্বাগত জানানোর উৎসব। বসন্তে প্রকৃতি যেমন নিজ রঙে রাঙিয়ে নেয় নিজেকে, তেমনি বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ বসন্তকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত হয় নানান সাজে ও সঙ্গীতে।
থাইল্যান্ডে বসন্ত উৎসব বসন্তে থাইল্যান্ডে সুক্রান বা জল ছিটানোর আয়োজন করা হয়। এটি ১৩ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে তিন দিনব্যাপী চলে। শরীর ও মনের কালিমা দূর করতে এই উৎসবে জল ছিটানোর আয়োজন করা হয়। জলে ভিজে নিজেদের হিংসা, বিদ্বেষ, গ্লানি আর না পাওয়ার বেদনা ধুয়ে নেয় তারা।
স্পেনের বসন্ত উৎসব বসন্তের সময় স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া শহরে জমকালো ফায়ারওয়ার্ক আর পরস্পরকে রঙজল দিয়ে উদযাপন করা হয় ‘লাস ফালেস’ নামে একটি উৎসব। মূলত মা মেরীর স্বামী সেইন্ট স্টিফেন জোসেফের স্মরণে এই উৎসব পালন করা হয়। কাগজ, কাঠ ও মোমের সমন্বয়ে তৈরি বড় বড় পাপেট দিয়ে সাজানো হয় শহরের অলিগলি। এ পাপেটগুলোর নামই মূলত লাস ফালেস। মেক্সিকোতে বসন্ত উৎসব বসন্তকে মেক্সিকোতে বলা হয় সান মার্কোস। তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব এটি। এই দিনে মেক্সিকোতে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের সমাগম হয়। এপ্রিলের ১৪ তারিখ শুরু হওয়া এই উৎসবে মোরগ লড়াই এবং সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। টানা তিন সপ্তাহব্যাপী এই উৎসব চলে।
চীনে বসন্ত উৎসব খুব ঘটা করে চীনে বসন্ত উৎসব পালিত হয়। চৈনিক পঞ্জিকা অনুযায়ী পিনইন মাসে প্রথম দিন যা ইংরেজি মাসের ২২ জানুয়ারি তাদের নতুন বছর শুরু হয়। ২২-২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত চুনইয়ুন নামে এই বসন্ত উৎসবটি তারা উদযাপন করে থাকে। নিয়োন নামের এক অপদেবতার গল্প থেকে এই উৎসবটি এসেছে। নিয়োন প্রায়ই শীতের শেষে গ্রামে আসতো। গরু, ছাগল, শস্য এবং ছেলেমেয়েদের ধরে খেয়ে ফেলতো। নিয়োনের হাত থেকে রক্ষা পেতে গ্রামবাসী মজার মজার খাবার তৈরি করে রেখে দিতো। একদিন গ্রামবাসী দেখলো, নিয়োন লাল রঙের পোশাক পরা এক বাচ্চাকে দেখে ভয় পাচ্ছে। পরে গ্রামবাসী আবিষ্কার করে, সে লাল রঙ ভয় পায়। এর পর থেকে শীতের শেষে গ্রাম সাজানো শুরু হয়ে যায় লাল রঙের লণ্ঠন, ব্যানার দিয়ে। পরে আর কখনো নিয়োনকে দেখা যায়নি। এই উৎসবে চীনারা ঘরে তৈরি করে মজার সব খাবার। চৈনিক নববর্ষের এই উৎসব শুধু চীনাদের পাশাপাশি অধিকাংশ মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠী উদযাপন করে থাকে।
বাংলায় যেভাবে এলো বসন্ত উৎসব বাংলায় বসন্তকালে রাসমেলা বা রাসযাত্রারও প্রচলন হয় মধ্যযুগে। নবদ্বীপ, যেটি মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের জন্য খ্যাত, সেখান থেকেই রাসমেলার উৎপত্তি। বসন্তকালে বাংলাদেশের খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে রাসমেলা হয়ে থাকে। সেখানে কীর্তনগান ও নাচের আসর বসে থাকে। এছাড়া প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ফাল্গুনী পূর্ণিমা উদযাপনের মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করে নিত। ১৫৮৫ সালে স¤্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসেবে আকবরি সন বা ফসলি সনের প্রবর্তন করেন। একইসাথে প্রবর্তিত হয় প্রতি বছর ১৪টি উৎসব পালনের রীতিও। এর মধ্যেই অন্যতম ছিল বসন্ত উৎসব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসন্ত বরণ উৎসবের ইতিহাস আজ যে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে বসন্তের প্রথম দিন তথা পহেলা ফাল্গুন অন্যতম বৃহৎ সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এর পেছনে অবদান রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের একদল শিক্ষার্থীর। ১৯৯১ সালে কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই বসন্ত বরণ উৎসব পালন করেছিল তারা। সেবার পহেলা ফাল্গুনের আগের দিন চারুকলা অনুষদের কিছু মেয়ে শাড়ি কিনে মৈত্রী হলে রাতের বেলা ব্লক প্রিন্ট করে। পরদিন তারা ওই শাড়ি পরে নিজেদের অনুষদে হাজির হয়। বরাবরের মতোই অদূরে বাংলা একাডেমিতে চলছিল অমর একুশে বইমেলা, যা তাদের মাঝে যোগ করে অতিরিক্ত উৎসবের উন্মাদনা। আনুষ্ঠানিক বসন্ত বরণ উদযাপনের সূচনা শুরুটা চারুকলার শিক্ষার্থীদের হাত ধরে হলেও, দ্রুতই বসন্ত বরণের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য অনুষদের শিক্ষার্থীরাও। তাই ১৯৯৪ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্ত উৎসব উদযাপন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়।
বসন্ত বরণ ও ভালোবাসা দিবস একই দিনে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ভালোবাসা দিবস। বাঙালির বসন্ত। দুটো এবার একই দিনে উদযাপিত হলো। দেশে প্রথমবারের মতো ঘটছে এমন ঘটনা। শুধু এবার নয়, বাংলা বর্ষপঞ্জির হিসাব বদলে যাওয়ায় ভবিষ্যতে এ নিয়মেই দিবস দু’টি উদযাপিত হবে। বসন্তের সঙ্গে আরও বেশি জুড়ে যাবে ভালোবাসা।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবস পালনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা বলতে পারি, এ দু’টি বাঙালি সংস্কৃতির কোন অংশ নয়। তাছাড়া এ উৎসব দু’টিতে যে সকল অনুষ্ঠান পালন করা হয় তার অনেক কিছুই মূর্তি পূজা ও প্রকৃতি পূজারিদের আচার-অনুষ্ঠানের সাথে মিলে যায়। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, এতে নিম্নলিখিত চারটি শ্রেণির ইসলামবিরোধী বিষয় রয়েছে : ১. শিরকপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি, চিন্তাধারা ও সঙ্গীত। ২. নগ্নতা, অশ্লীলতা, ব্যভিচারপূর্ণ অনুষ্ঠান। ৩. গান ও বাদ্যপূর্ণ অনুষ্ঠান। ৪. সময় অপচয়কারী অনর্থক ও বাজে কথা এবং কাজ। তাই তা পালন করা মুসলিমদের জন্য বৈধ নয়।
সূর্যকে স্বাগত জানানো সূর্য-পূজারি ও প্রকৃতি-পূজারি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুকরণ মাত্র, যা আধুনিক মানুষের দৃষ্টিতে শোভনীয় হয়ে উঠেছে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজের অনেকেরই ধর্মের নাম শোনামাত্র গাত্রদাহ সৃষ্টি হলেও প্রকৃতি-পূজারি আদিম ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নকল করতে তাদের অন্তরে অসাধারণ পুলক অনুভূত হয়। সূর্য ও প্রকৃতির পূজা বহু প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন জাতির লোকেরা করে এসেছে। মানুষের ভক্তি ও ভালোবাসাকে প্রকৃতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টির সাথে আবদ্ধ করে তাদেরকে শিরক বা অংশীদারিত্বে লিপ্ত করানো শয়তানের সুপ্রাচীন “ক্লাসিক্যাল ট্রিক” বলা চলে। শয়তানের এই কূটচালের বর্ণনা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা কুরআনে তুলে ধরেছেন, “আমি তাকে ও তার জাতিকে দেখেছি, তারা আল্লাহকে ছেড়ে সূর্যকে সিজদা করছে এবং শয়তান তাদের কার্যাবলীকে তাদের জন্য শোভনীয় করেছে।” (সূরা আন নামল : ২৪)
ধর্মীয় অনুভূতি, সংস্কার ও ধ্যান-ধারণার ছোঁয়া খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন তাদের বিশ্বাসমতে ¯্রষ্টার পুত্রের জন্মদিন। সকল জাতির উৎসব-উপলক্ষের মাঝেই ধর্মীয় চিন্তা-ধারা খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এজন্যই ইসলাম ধর্মে নবী মুহাম্মাদ সা. পরিষ্কারভাবে মুসলিমদের উৎসবকে নির্ধারণ করেছেন, ফলে অন্যদের উৎসব মুসলিমদের সংস্কৃতিতে প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। অমুসলিম, কাফির কিংবা মুশরিকদের উৎসবের দিনগুলো হচ্ছে তাদের জন্য উচ্ছৃঙ্খল আচরণের দিন, এদিনে তারা নৈতিকতার সকল বাঁধ ভেঙে দিয়ে অশ্লীল কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, আর এই কর্মকাণ্ডের অবধারিত রূপ হচ্ছে মদ্যপান ও ব্যভিচার। এমনকি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বহুলোক তাদের পবিত্র বড়দিনেও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে মদ্যপ হয়ে ওঠে এবং পশ্চিমা বিশ্বে এই রাত্রিতে কিছু লোক নিহত হয় মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর কারণে। অপরদিকে মুসলিমদের উৎসব হচ্ছে ইবাদতের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এই বিষয়টি বুঝতে হলে ইসলামের সার্বিকতাকে বুঝতে হবে। ইসলাম কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়, বরং তা মানুষের গোটা জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী বিন্যস্ত ও সজ্জিত করতে উদ্যোগী হয়। তাই একজন মুসলিমের জন্য জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইবাদত, যেমনটি কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা দিচ্ছেন: “আমি জিন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোন কারণে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা যারিয়াত : ৫৬) সেজন্য মুসলিম জীবনের আনন্দ-উৎসব আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ ও অশ্লীলতায় নিহিত নয়, বরং তা নিহিত হচ্ছে আল্লাহর দেয়া আদেশ পালন করতে পারার মাঝে, কেননা মুসলিমের ভোগবিলাসের স্থান ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী নয়, বরং চিরস্থায়ী জান্নাত। তাই মুসলিম জীবনের প্রতিটি কাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে থাকবে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, তাদের ঈমান, আখিরাতের প্রতি তাদের অবিচল বিশ্বাস, আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা।
বসন্তের নতুন দিন নতুন কল্যাণ বয়ে আনে বসন্তের নতুন দিনের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ধারণা আদিযুগের প্রকৃতি-পূজারি মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার অবশিষ্টাংশ। ইসলামে এ ধরনের কুসংস্কারের কোন স্থান নেই। বরং মুসলিমের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই পরম মূল্যবান হীরকখণ্ড, হয় সে এই মুহূর্তকে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করে আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করবে, নতুবা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে শাস্তির যোগ্য হয়ে উঠবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বসন্তের প্রথম দিনের কোন বিশেষ তাৎপর্য নেই। এর সাথে জীবনে কল্যাণ-অকল্যাণের গতিপ্রবাহের কোন দূরতম সম্পর্কও নেই।
নারীকে জড়িয়ে বিভিন্ন অশ্লীলতা বসন্ত বরণ বা পহেলা ফালগুন উৎসব আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নারীর সহজ-লভ্যতা। বসন্তের অনুষ্ঠানাদির মধ্যে সমাজ-বিধ্বংসী যে বিষয়গুলো পাওয়া যাবে, তার মাঝে অন্যতম হচ্ছে নারীকে জড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীলতা। বসন্ত উদযাপন আয়োজনের সর্বত্রই সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী নারীকে পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশায় লিপ্ত হতে দেখা যাবে। পৃথিবীতে আল্লাহ মানুষকে যে সকল আকর্ষণীয় বস্তু দ্বারা পরীক্ষা করে থাকেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নারী। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন : “আমি পুরুষের জন্য নারীর চেয়ে বড় কোন ফিতনা রেখে যাচ্ছি না।” (বুখারী ও মুসলিম) বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানে নারীর যে অবাধ উপস্থিতি, সৌন্দর্য প্রদর্শন এবং পুরুষের সাথে মেলামেশা তা পরিপূর্ণভাবে ইসলামবিরোধী, তা কতিপয় মানুষের কাছে যতই লোভনীয় বা আকর্ষণীয়ই হোক না কেন। এই অনুষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের ধ্বংসের পূর্বাভাস দিচ্ছে। সঙ্গীত ও বাদ্য বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকে সঙ্গীত ও বাদ্য। ইসলামে নারীকণ্ঠে সঙ্গীত নিঃসন্দেহে নিষিদ্ধ। সাধারণভাবে যে কোন বাদ্যযন্ত্রকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া, যেমন বিশেষ কিছু উপলক্ষে দফ নামক বাদ্যযন্ত্র বাজানোর অনুমতি হাদীসে এসেছে। তাই যে সকল স্থানে এসব হারাম সঙ্গীত উপস্থাপিত হয়, সে সকল স্থানে যাওয়া, এগুলোতে অংশ নেয়া, এগুলোতে কোন ধরনের সহায়তা করা কিংবা তা দেখা বা শোনা সকল মুসলিমের জন্য হারাম। কিন্তু কোন মুসলিম যদি এতে উপস্থিত থাকার ফলে সেখানে সংঘটিত এই সকল পাপাচারকে বন্ধ করতে সমর্থ হয়, তবে তার জন্য সেটা অনুমোদনযোগ্য। তাছাড়া অনর্থক কথা ও গল্প-কাহিনী যা মানুষকে জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, তা নিঃসন্দেহে মুসলিমের জন্য বর্জনীয়। অনর্থক কথা, বানোয়াট গল্প- কাহিনী এবং গান-বাজনা মানুষকে জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য শয়তানের পুরনো কূটচালের একটি, আল্লাহ এ কথা কুরআনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, “এবং তাদের মধ্যে যাদেরকে পার পর্যায়ক্রমে বোকা বানাও তোমার গলার স্বরের সাহায্যে।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৬৪) আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে মুমিনদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে ইরশাদ করেন, “আর যারা মিথ্যার সাক্ষ্য হয় না।’’ (সূরা ফুরকান : ৭২) তাফসিরে ইবনে কাসিরে এই আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘‘আবুল আলিয়া, তাউস, ইবনে সিরিন, যাহহাক, রবি ইবনে আনাসসহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বলেন, সেটা হল বিধর্মীদের উৎসবের দিন।’’ (তাফসিরে ইবনে কাসির ৫/৬১৪) ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি যার সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০৩১) সমাজে যেভাবে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে- তা যদি বন্ধ করা না যায় তাহলে এর পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। যেমনটি মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “যারা মু’মিনগণের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে পীড়াদায়ক শাস্তি। মহান আল্লাহ সবই জানেন। আর তোমরা জানো না।” (সূরা আন নূর : ১৯) মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিজাতীয় সংস্কৃতি রোধ এবং ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমের জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
আপনার মন্তব্য লিখুন