post

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস

মতিউর রহমান আকন্দ

১০ ডিসেম্বর ২০১৬
[ পূর্ব প্রকাশের পর ] ১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৬৯ সালের মধ্যে সারাদেশে ব্রিটিশ-বর্ণহিন্দু শোষণের রক্তবাহী পাইপলাইনগুলোর তারাই ছিলেন অতন্দ্রপ্রহরী। তাদের সক্রিয় সহযোগিতায়ই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এ কারণে তাদেরকেও নিশ্চয়ই মরতে দেয়া হয়নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেবায় নিয়োজিত মহারাজদের গড়ে তোলা পাইক পেয়াদা বাহিনীতে, ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি অনুসরণে, মুসলমান কারিগর ও বিত্তশালীদের ঠ্যাঙ্গাবার জন্য শূদ্র সম্প্রদায়কেও তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। এমতাবস্থায় অনুমান করা কষ্টসাধ্য নয় যে, ছিয়াত্তরের কৃত্রিম মন্বন্তরে বাংলার বর্ণহিন্দু বাবুরা কেউই মারা যায়নি। শূদ্র সম্প্রদায়ের একটি অংশও তাদের চাকরিতে বহাল হয়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু মুসলমানেরা হয়েছিল দুর্ভিক্ষের পাইকারি শিকার। ...বাংলায় তখন মুসলমানেরাই ছিল সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। লাগামহীন লুটতরাজ, জুলুম-নির্যাতন ও পরিকল্পিত মন্বন্তরে তাদেরকে হত্যা করে এবং পরবর্তীকালে নানাভাবে সে ধারা বহাল রেখে সংখ্যাগুরু মুসলমানদেকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়। শুধু তা-ই নয়, বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কায়েম হবার সাথে সাথে কলকাতা নগরীতে দাস ব্যবসাও জমজমাট হয়ে ওঠে। ছিয়াত্তরের মহা মন্বন্তরে বাংলায় ১ কোটি লোকের মৃত্যু হওয়ার পর ধ্বংস হয়ে যাওয়া মুসলমান পরিবারগুলোর কোন কোনটিতে দু’একজন করে এতিম বালক-বালিকা জীবন্মৃত অবস্থায় বেঁচে ছিল। বাবু বণিকেরা সারা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তাদেরকে সংগ্রহ করে “বড় বড় নৌকা বোঝাই করে কলকাতায় নিয়ে এসে খোলা বাজারে জমায়েত করে এবং ইংরেজ সিনিয়র পার্টনারদের মাধ্যমে তাদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চালান দেয়।” এভাবে মুসলমানদের হাত থেকে শাসনদণ্ড কেড়ে নিয়ে তাদের বিত্ত বৈভব লুণ্ঠন করে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদেরকে ঝাঁকে ঝাঁকে হত্যা করে। বাংলার পুঁজি ও শিল্প একই সাথে বিলেতে পাচার করে দিয়ে সেই সঙ্গে মুসলিম সন্তানদেরকেও ক্রীতদাসরূপে চালান করে দিয়ে রাজা-মহারাজা বাবুরা তাদের অন্তর্দাহ আংশিকভাবে নিবৃত্ত করেন। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা চলে, সোনার বাংলা ছিল মুসলমান ও অনার্য শূদ্র জনসাধারণের বাংলা। তারা ছিলেন দক্ষ জনশক্তি। নিজেদের দক্ষ হাত আর পরিশীলিত মনন ও মেধার পরশেই তারা মাটির বাংলাকে সোনার বাংলায় পরিণত করেছিলেন। মুসলিম শাসন কায়েমের পূর্ববর্তী এক শতাব্দীর বাংলা ছিল ব্রাহ্মণ্য শাসনে দষ্ট-পিষ্ট বাংলা, মুসলমান শাসনের পরবর্তী ১৯০ বছর ছিল ব্রিটিশ-ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণে-নির্যাতনে নিঃশেষিত বাংলা। কাজেই ইতিহাসে পলাশীর ঘাট পেরিয়ে প্রথম বাঁকে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ই ছিল বাংলার শ্মশান হওয়ার করুণ বাস্তব চিত্র। রাজনৈতিক ক্ষমতা হারানোর পর মুসলমানদের মধ্যে সমমান ও পদমর্যাদার প্রবল আকাক্সক্ষা জন্মলাভ করে। আর অর্থনৈতিক উপায় উপকরণ থেকে বঞ্চিত হবার পর খাদ্যের জন্য তাদের জঠরে অনুভূত হয় তীব্র ক্ষুধার জ্বালা। খাদ্য ও পদমর্যাদার লোভীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশ্চাত্য শিক্ষার দিকে। মুসলমানদের বলে দেয়া হলো খাদ্য ও পদমর্যাদা পেতে হলে মুসলমানিত্ব বর্জন কর। ধর্ম, চরিত্র, বিবেক, মন, সভ্যতা, কৃষ্টি, জীবন-যাপন পদ্ধতি, সামাজিক মূল্যবোধ, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধ সবকিছু ত্যাগ কর। তাহলেই কিছু খাবার ও কিছু পদমর্যাদা তোমাদের দেয়া যাবে। মুসলমানরা লোভের বশবর্তী হয়ে এসব মর্যাদা পরিত্যাগ করে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান পার্থিব সুবিধা পাওয়ার আশায় তাদের ধ্যান ধারণা পাল্টে ফেলে। ইসলামী শিক্ষা থেকে তারা একেবারেই বঞ্চিত থেকে যায়। ইসলামী ঈমান আকিদার মধ্যে কুফর ও পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ এবং মুসলিম সংস্কৃতির ওপর হিন্দু জাতীয় প্রাধান্য মুসলমানদেরকে তাদের গোলামে পরিণত করে। তার স্বাভাবিক পরিণাম হিসাবে মুসলমানদের মাঝে বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়। শাসকগণ তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য হিন্দু জনসাধারণ জমিদার-জায়গিরদার ও ধনিক বণিক শ্রেণীর সন্তুষ্টি সাধনের আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এ সুযোগে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস ও তমদ্দুনিক ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশের সাহস পায়। এভাবে ইসলামের ঈমান আকিদার মধ্যে কুফর ও পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ এবং মুসলিম সংস্কৃতির ওপর হিন্দু জাতির প্রাধান্য মুসলমানদেরকে তাদের মানসিক গোলামে পরিণত করে। ড. এ. আর মল্লিক তাঁর গ্রন্থে মন্তব্য করেন: Thus long years of association with a non-Muslim people who far outnumbered them, cut off from original home of Islam and living with half converts from Hinduism, the Muslims had greatly deviated from the original faith and had become Indianised. This deviation from the faith apart, the Indian Muslims in adopting the caste system of the Hindus, had given a disastrous blow to the Islamic conception of brotherhood and equality in which their strength had rested in the past and presented thus in the 19th century the picture of a disrupted society, degenerate and weakened by division and sub-division to a degree, it seemed, beyond the possibility of repair. No wonder, Sir Mohammad Iqbal said, surely we have out-Hindued the Hindu himself,-We are suffering from a double caste system-religious caste system, sectarian and social caste system- Which we have either learned or inherited from the Hindus. This is one of the quiet ways in which the conquered nation revenged themselves on their conquerors.” (British Policy and the Muslims in Bengal– A. R. Mallick) “মুসলমানগণ ইসলামের মূল উৎসকেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের আধা ধর্মান্তরিত মুসলমানসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলমানদের সাথে বহু বছর যাবৎ একত্রে বসবাস করে মূল ধর্মবিশ্বাস থেকে সরে পড়েছিল এবং হয়ে পড়েছিল ভারতীয়। অধিকন্তু এই ভারতীয় মুসলমানগণ হিন্দুদের বর্ণপ্রথা অবলম্বন করে- অতীতে যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের মধ্যে তাদের শক্তি নিহিত ছিল তার প্রতি চরম আঘাত হানে। ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে তারা বহু ভাগে বিভক্ত ছিন্নভিন্ন ও অধঃপতিত জাতি হিসেবে চিত্রিত হয়, যার সংশোধনের কোনো উপায় থাকে না। তাই স্যার মুহাম্মদ ইকবালের এ উক্তিতে বিস্ময়ের কিছু নেই : নিশ্চিতরূপে আমরা হিন্দুদেরকে ছাড়িয়ে গেছি। আমরা দ্বিগুণ বর্ণপ্রথার রোগে আক্রান্ত ধর্মীয় বর্ণপ্রথা, ফেরকা-উপফেরকা এবং সামাজিক বর্ণপ্রথা, যা আমরা শিক্ষা করেছি, অথবা হিন্দুদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। যেসব নীরব পন্থায় বিজিতগণ বিজেতাদের প্রতিশোধ গ্রহণ করে থাকে, এ হলো তার একটি।” (British Policy and the Muslims in Bengal-- A.R. Mallick) স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপূজা প্রবল হয়ে ওঠার স্বাভাবিক ফলস্বরূপ মুসলমানদের জাতীয়তার অনুভূতি ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের সামষ্টিক শক্তি ধ্বংস হয়ে যায়। মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক লড়াই ও মতবিরোধ দ্বন্দ্ব-সংঘাত তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। মুসলমানদের বিশৃঙ্খলা ও শতধা বিচ্ছিন্ন অবস্থার কারণে তাদের স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তাকে স্পষ্টভাবে অস্বীকার করা হয়। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম জাতির জাতীয় সত্তা অনেকাংশে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। একটি জনগোষ্ঠীর এক জাতিতে পরিণত হতে যেসব গুণ বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন তা অনেকাংশেই ধ্বংস হয়ে যায়। সংঘবদ্ধভাবে কিছু করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে মুসলমানরা। দারিদ্র্য, অজ্ঞতা ও পরাধীনতার দরুন মুসলিম জনগণ প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ে ও সম্ভ্রমবোধ হারিয়ে ফেলে। মুসলমানদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত, লেখক, বক্তা, বিত্তশালী ও প্রভাবশালী লোকেরা ইসলাম ও তার শিক্ষার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। আকিদা, বিশ্বাস ও আমলের দিক দিয়ে ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। মুসলিম চিন্তার পরিশুদ্ধি প্রচেষ্টা আন্দোলন মুসলমানদের বিপর্যস্ত যুগে ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী। মুসলমানদের চিন্তাধারায় জাহেলিয়াতের যে জঞ্জাল স্তূপীকৃত হয়ে উঠেছিল তা তিনি কুরআন-হাদিসের বলিষ্ঠ যুক্তির দ্বারা পরিষ্কার করেন। ইসলামী চিন্তা চেতনা ও মন-মানসের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। মুসলিম সমাজে যত প্রকার বেদায়াতের সমাবেশ ঘটেছিল তা তিনি খণ্ডন করেন এবং ইসলামী জীবনব্যবস্থায় এমন যুক্তিসঙ্গত ও সুসামঞ্জস্য খসড়া পেশ করেন যা সরল প্রকৃতির ও বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তির জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে। তিনি জাহেলি রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের চিত্র সুস্পষ্টরূপে জনসমক্ষে পেশ করেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহর বিরাট অবদান এই যে, তিনি কুরআন-হাদিসের শিক্ষা ও আপন ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সৎ ও সুস্থ চিন্তাসম্পন্ন লোকদের একটি বিরাট দল তৈরি করেন। তার ও চার সুযোগ্য পুত্রের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হাজার হাজার লোক ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন যা পরবর্তীকালে একটি শক্তিশালী আন্দোলনের রূপদান করে। মুসলমানদের মুক্তি সংগ্রাম-ফকির বিদ্রোহ ১৭৫৭ সালে পলাশীতে পরাজয়ের পর রাজ্যহারা মুসলমানদের সম্বিত ফিরে আসতে বেশি বিলম্ব হয়নি। কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। নিরুপায় মুসলিম আত্মরক্ষার তাগিদে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলে। পলাশীতে মুসলমানদের পতনের পরই তাদের প্রতিরোধ ও মুক্তি-সংগ্রাম শুরু হয়। জনতার কাতার থেকেই শুরু হয় এ প্রতিরোধ আন্দোলন। ১৭৬৩ সালে ফকির বিদ্রোহীরা বাকেরগঞ্জ ইংরেজ কোম্পানির কুঠি আক্রমণ করে। পীর, ফকির, আলেমরাই এ বিদ্রোহ সংঘটিত করেন। ফকির সন্ন্যাসীরা বিদ্রোহী নবাব মীর কাশেমের বাহিনীতে যোগ দেন। মীর কাশেম স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। তার সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে। ফকির বিদ্রোহ চলে দীর্ঘ সময়ব্যাপী। ইংরেজ কোম্পানির সৈন্যের সঙ্গে ফকির বিদ্রোহীদের বহু সংঘর্ষ হয়। গোটা উত্তরবঙ্গসহ সমগ্র বাংলাদেশের বিশাল অঞ্চলজুড়ে ইংরেজ শাসনকে তারা ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। ফকির বিদ্রোহের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৃষ্ট ও আশ্রয়পুষ্ট শোষণকারী, জমিদারদের উচ্ছেদ করা ও তাদের অর্থাগার লুট করা। (কালেকদাদ চৌধুরী, ড. হাসান জামান সম্পাদিত ‘শতাব্দী পরিক্রমা’) ফকির আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মজনু শাহ, মাজু শাহ, টিপু পাগল ও গজনফর তুর্কশাহ। খালেকদাদ চৌধুরী তাঁর ময়মনসিংহে ফকির অভিযান প্রবন্ধে মজনু শাহকে মাজু শাহের বড়ো ভাই বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর সম্পর্কে এতটুকু জানা যায় যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে তিনি একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেন। ১৭৬৪ সালে মীর কাসেম আলীর পরাজয়ে এ দেশে ইংরেজ অধিকার বদ্ধমূল হয়। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীতে ঐ একই সালে মজনুর (মজনু শাহ) অনুচরদের হাতে ব্রিটিশ শক্তিকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। (‘বিপ্লব আন্দোলনে দক্ষিণবঙ্গের অবদান’- আজিজুর রহমান, হাজান জামান সম্পাদিত ‘শতাব্দী পরিক্রমা’।) পুনরায় ফকির অভিযান শুরু হয় দু’বছর পর ১৭৮৬ সালে। ময়মনসিংহকে ফকিরদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য লেফটেন্যান্ট ফিল্ডকে ঢাকা পাঠানো হয়। ময়মনসিংহের কালেক্টর রাউটনের সাহায্যের জন্য আসাম গোয়ালপাড়া থেকে ক্যাপ্টেন ক্লেটনকে পাঠানো হয়। সুসজ্জিত ইংরেজ সৈন্যদের সাথে ফকিরদের যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়, তাতে ফকির বাহিনী পরাজিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তারপর আর বহুদিন যাবৎ তাদের কোন তৎপরতার কথা জানা যায় না। ফকিরদের অভিযান বন্ধ হওয়ার পর জমিদারগণ তাদের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের নাম করে প্রজাদের নিকট থেকে বর্ধিত আকারে রাজস্ব আদায় করতে থাকে এবং নতুন কর ধার্য করতে থাকে। তাতে প্রজাদের দুর্দশা চরমে পৌঁছে। প্রজাদের নির্যাতনের অবসানকল্পে ১৮২৬ সালে টিপু পাগল নামক জনৈক প্রভাবশালী ফকির কৃষক প্রজাদের নিয়ে এক শক্তিশালী বাহিনী গঠন করেন। জমিদারেরা সকল ন্যায়নীতি ও ১৭৯৩ সালের রেগুলেশন নং-৮ অগ্রাহ্য করে প্রজাদের ওপর নানাবিধ ‘আবওয়াব’ ধার্য করতে থাকে। এসব আবওয়াব ও নতুন নতুন উৎপীড়নমূলক কর জবরদস্তি করে আদায় করা হতো। তাছাড়া জমিদারেরা আবার প্রতিপত্তিশালী লোকদের কাছে তাদের জমিদারি অস্থায়ীভাবে উচ্চমূল্যে ইজারা দিত। ইজারাদারেরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উৎপীড়নের মাধ্যমে প্রজাদের কাছ থেকে উচ্চহারে খাজনা আদায় করতো। এসব উৎপীড়ন বন্ধের জন্য টিপু প্রজাদেরকে সংগঠিত করেন। এসব অভিযানকারী ফকিরদেরকে ইতিহাসে অনেকে লুণ্ঠনকারী দস্যু বলে অভিহিত করেছেন। আসলে ব্যাপার তা নয়। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ছিলেন জনগণের শ্রদ্ধেয় অলি-দরবেশ শ্রেণীর লোক। মানুষকে ধর্ম-কর্ম শিক্ষাদান করা এসব ফকিরের কাজ ছিল। কিন্তু জনসাধারণের চরম দুর্দশা দেখে তাঁদের অন্তরাত্মা কেঁদে উঠেছিল। তার ফলে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তাঁরা মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়েছেন। এসব ফকিরের দল অসভ্য বর্বর ছিলÑতাও নয়। তাঁরা ছিলেন শিক্ষিত ও রুচিবোধসম্পন্ন। এমনকি টিপুর মাতার মধ্যেও ছিল অসাধারণ সাংগঠনিক যোগ্যতা। টিপু ও তাঁর বাহিনীকে প্রেরণা জোগাতেন টিপু জননী। ১৮২৫ সালে টিপুর নেতৃত্বে ফকির দল জমিদারদের খাজনা বন্ধের আন্দোলন করে। জমিদারদের বরকন্দাজ বাহিনী ও ফকিরদের মধ্যে এক সংঘর্ষে বরকন্দাজ বাহিনী নির্মূল হয়ে যায়। জমিদারগণ কোম্পানির শরণাপন্ন হয়। কোম্পানি টিপু ও তাঁর সহকারী গজনফর তুর্কশাহকে বন্দী করার জন্য একটি সশস্ত্র সেনাবাহিনী পাঠায়। একটি সেনাদল পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায় কিন্তু অপর একটি দল টিপুকে বন্দী করে। তুর্কশাহ তার দল নিয়ে কোম্পানির সেই সেনাদলকে আক্রমণ করে টিপুকে মুক্ত করেন। এ ঘটনার পর ম্যাজিস্ট্রেট ডেমপিয়ার একটি শক্তিশালী ও সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী নিয়ে শেরপুর আগমন করে। টিপু বাহিনীর সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধে টিপু তাঁর জননীসহ বন্দী হন। পরবর্তীকালে ১৮৩৩ সালে টিপুর দু’জন শক্তিশালী সহকর্মীর নেতৃত্বে ফকিরদল পুনরায় সংঘবদ্ধ হয় এবং শেরপুর থানা আক্রমণ করে তা জ্বালিয়ে দেয়। তারপর ক্যাপ্টেন সিল ও লেফটেন্যান্ট ইয়ংহাজবেন্ডের অধীনে একটি সেনাবাহিনী প্রেরিত হয় ফকির বাহিনী দমন করার জন্য। এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় এবং এই সংঘর্ষে ফকির বাহিনী পরাজিত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। উপরে ফকির বিদ্রোহের কিছু বিবরণ দেয়া হলো। তবে ফকিরদের সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারণা ইংরেজ লেখক ও ইতিহাসকারদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তা অনুমান করার যথেষ্ট কারণ আছে। ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁদেরকে বেদুইন বলেছেন, আর হান্টার সাহেব বলেছেন ‘ডাকাত’। তাঁদের আক্রমণ অভিযানে কয়েক দশক পর্যন্ত নব প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশরাজ এখানে টলটলায়মান হয়ে পড়েছিল, সম্ভবত সেই আক্রোশেই তাদের ইতিহাস বিকৃত করে রচনা করা হয়েছে। মজনু শাহ ও মাজু শাহকে দুই ভাই বলা হয়েছে। এর সত্যাসত্য যাচাই করার কোন ঐতিহাসিক তথ্য বা উপাদান পাওয়া যায় না। তবে কেউ কেউ বলেছেন, মজনু শাহ ভারতের গোয়ালিয়র রাজ্যের মেওয়াত এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। কানপুরের চল্লিশ মাইল দূরে অবস্থিত মাকানপুরে অবস্থিত শাহ মাদারের দরগায় মজনু শাহ বাস করতেন। সেখান থেকেই হাজার হাজার সশস্ত্র অনুচরসহ তিনি বাংলা বিহারের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজ ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। তাঁর কার্যক্ষেত্র বিহারের পূর্ণিয়া অঞ্চল এবং বাংলার রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, রাজশাহী, মালদহ, পাবনা, ময়মনসিংহ ছিল বলে বলা হয়েছে। ১৭৭২ সালের প্রথমদিকে মজনু শাহ বিপুল সংখ্যক সশস্ত্র অনুচরসহ উত্তর বঙ্গে আবির্ভূত হন। তাঁর এ আবির্ভাবের কথা জানতে পারা যায় রাজশাহীর সুপারভাইজার কর্তৃক ১৭৭২ সালের জানুয়ারি মাসে কোম্পানির কাছে লিখিত এক পত্রে। তাতে বলা হয়, তিন শ’ ফকিরের একটি দল আদায় করা খাজনার এক হাজার টাকা নিয়ে গেছে এবং আশঙ্কা করা যাচ্ছে যে, তারা হয়তো পরগণা কাচারিই দখল করে বসবে। তলোয়ার, বর্শা, গাদাবন্দুক এবং ইত্যাদি হাতিয়ারে তারা সজ্জিত। কেউ কেউ বলে তাদের কাছে নাকি ঘূর্ণায়মান কামানও আছে। ১৭৭৬ সালে মজনু শাহ বগুড়া জেলার মহাস্থান আগমন করে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। সে সময় বগুড়া জেলার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন মি. গ্লাডউইন। তিনি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে প্রাদেশিক কাউন্সিলের কাছে সৈন্য সাহায্য চেয়ে পাঠান। ১৭৮৬ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ফকির সর্দারকে (মজনু শাহ) ইংরেজদের বিরুদ্ধে পর পর দুটো সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হয়। উভয় ক্ষেত্রেই ফকিরদের পক্ষে যেমন কিছু লোক হতাহত হয়, ইংরেজদেরও অনুরূপভাবে কিছু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হয়। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে অনুমিত হয় যে, এরপর গঙ্গা পাড়ি দিয়ে মজনু শাহ দেশে চলে যান। আর কোন দিন তাঁকে বাংলাদেশে দেখা যায়নি। আনুমানিক ১৭৮৭ সালে কানপুর জেলার মাখনপুর এলাকায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে সরকারি সূত্রে জানা যায়। তাঁর মৃতদেহ সেখান থেকে তাঁর জন্মভূমি মেওয়াতে নিয়ে গিয়ে দাফন করা হয়। মজনু শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র পরাগ আলী, পালিত পুত্র চেরাগ আলী, অন্তরঙ্গ ভক্ত মুসা শাহ, সোবহান শাহ, শমশের শাহ প্রমুখ শিষ্যগণ অষ্টাদশ শতকের শেষতক ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। ফরায়েজি আন্দোলন ইংরেজ শাসনামলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনে মুসলমানরা বাধাগ্রস্ত হয়। অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের এলাকায় গো- কোরবানি এবং আজান দেওয়া নিষিদ্ধ হয়। হিন্দু জমিদারগণ মুসলমান প্রজাদের দাড়ির উপর ট্যাক্স ধার্য করে। মুসলমানদের ধুতি পরতে, দাড়ি কামিয়ে গোঁফ রাখতে বাধ্য করা হয়। হিন্দু পূজা পর্বণে মুসলমানদেরকে চাঁদা দিতে, পূজার জোগান ও বেগার দিতে বাধ্য করা হয়। এই মুহূর্তে হাজী শরীয়ত উল্লাহ হিন্দুর পূজা পার্বণে কোন প্রকার আর্থিক অথবা দৈহিক সহযোগিতা ইসলাম বিরুদ্ধ (শিরক ও হারাম) বলে অভিহিত করেন। হাজী শরীয়ত উল্লাহর আহ্বানে শোষিত, বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত মুসলমান জনসাধারণ নতুন প্রাণ সঞ্চরণ অনুভব করে এবং দলে দলে তার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে দশ-বারো হাজার মুসলমান তার দলভুক্ত হয়। এটা ছিল হিন্দু জমিদারদের পক্ষে মহা আতঙ্কের বিষয়। হাজী শরীয়ত উল্লাহকে দমন করার জন্য ঐক্যবদ্ধ ও বদ্ধপরিকর হয় হিন্দু জমিদারগণ। তাদের দলে যোগদান করে কিছুসংখ্যক স্বার্থান্বেষী আধা মুসলমান। যারা ছিল হিন্দু জমিদারদের দাসানুসাদ। অদূরদর্শী মোল্লা, মৌলভী ও পীর যারা মুসলমানদের মধ্যে শিরক, বিদায়াত প্রভৃতি কুসংস্কারের নামে দু’পয়সা কামাই করছিল তারাও ফরায়েজি আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ এবং অত্যাচারী হিন্দু জমিদার মহাজনদের উপর্যুপরি অত্যাচার, নিষ্পেষণে মুসলমানরা অনন্যোপায় হয়ে মাথানত করে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছিল। শরীয়ত উল্লাহর আহ্বানে নিপীড়িত মুসলমানগণ তার কাছে এসে জমায়েত হতে থাকে এবং ব্রিটিশ ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করে। হাজী শরীয়ত উল্লাহর আন্দোলনে হিন্দু স্বার্থে চরম আঘাত লেগেছিল বলে তারা ইংরেজ শাসকদের সহায়তায় তাকে দমন করতে সকল শক্তি প্রয়োগ করে। ১৮৪০ সালে তিনি ইন্তেকাল করার পর তার যোগ্য পুত্র দুদু মিয়া তার আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। পিতার ন্যায় দুদু মিয়াও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। জমিদারদের সঙ্গে তাকে বারবার সংঘর্ষে আসতে হয়। ১৮৬৪ সালে ইংরেজ ও জমিদাররা দুদু মিয়ার বাড়ি আক্রমণ করে দেড়-দুই লক্ষ টাকা মূল্যের অলঙ্কারাদিসহ বহু ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। তিনি বিচারপ্রার্থী হয়েও কোন ফল পাননি। জনসাধারণের মধ্যে দুদু মিয়ার অসাধারণ প্রভাব, প্রতিপত্তি লক্ষ্য করে ইংরেজ সরকার বিব্রত হয়ে পড়ে। ১৮৫৭ সালের আজাদি আন্দোলন চলাকালে দুদু মিয়া উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারেন এই অজুহাতে তাকে কারাগারে আটক করে রাখা হয়। প্রথমে অলীপুরে এবং পরে ফরিদপুর জেলে তাকে রাখা হয়। ১৮৫৯ সালে মুক্তি লাভ করে তিনি ঢাকায় আসেন এবং এখানেই তার মৃত্যু হয়। হাজী শরীয়ত উল্লাহর আন্দোলন ছিল ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। অত্যাচারী জমিদারদের প্ররোচনায় দু’একটি সংঘর্ষ ব্যতীত কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে তার আন্দোলনের সংঘর্ষ হয়নি। কিন্তু দুদু মিয়ার সময়ে আন্দোলন অনেকটা রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। সকল জমিদার ও নীলকরগণ তার আন্দোলনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়। তাই দুদু মিয়ার সারা জীবন তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই কেটে গেছে। শহীদ তিতুমীর হাজী শরীয়ত উল্লাহর মত অধঃপতিত মুসলমান সমাজের সংস্কার আন্দোলন করেন আর একজন অতীব মজলুম ব্যক্তি শহীদ তিতুমীর। তার ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনে হিন্দু জমিদারগণ শুধু প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করেনি, ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমান জাতির প্রতি তাদের অন্ধ বিদ্বেষ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইংরেজ লেখকগণ তিতুমীরের ন্যায় একজন নির্মল চরিত্রের খোদাপ্রেমিক মনীষীকে একজন দুশ্চরিত্র, দুর্বৃত্ত ও ডাকাত বলে অভিহিত করে। (British Policy and The Muslims in Bengal---by Dr. A.R. Mallick) পলাশী যুদ্ধের পঁচিশ বছর পর এবং ঊনবিংশ শতকের পঞ্চাশ দশকের সমগ্র ভারতব্যাপী আজাদি সংগ্রামের (১৮৫৭) ৭৫ বছর পূর্বে ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে সাইয়েদ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মীর (সাইয়েদ) হাসান আলী এবং মাতার নাম আবেদা রোকাইয়া খাতুন। মুসলমানদের চরম ধর্মীয় ও নৈতিক অধঃপতনের সময় সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর ধর্মীয় ও নৈতিক অনাচার এবং হিন্দু জমিদারদের অন্যায় উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করেন, যা পরবর্তীকালে মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় আজাদির পথে আলোকবর্তিকার কাজ করে। তিতুমীরের দাওয়াতের মূলকথা ছিল ইসলামে পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন এবং প্রত্যেকটি কাজ কর্মে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ পালন। হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার, উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। শহীদ তিতুমীর সরফরাজপুর নামক এলাকায় শাহি আমলের ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে এখানে একটি খানকাহ্ স্থাপন করেন। এখানে জুমার নামাজের পর তিনি সমবেত হিন্দু-মুসলমানকে আহ্বান করে যে ভাষণ দেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম। যারা মুসলমান নয় তাদের সাথে শুধু ধর্মের দিক দিয়ে পৃথক বলে বিবাদ, বিসম্বাদ করা আল্লাহ ও তার রাসূল কিছুতেই পছন্দ করেন না। তবে ইসলাম এ কথা বলে যে, যদি কোন প্রবল শক্তিশালী অমুসলমান দুর্বল মুসলমানদের ওপর অন্যায় উৎপীড়ন করে তাহলে মুসলমানরা সেই দুর্বলকে সাহায্য করতে বাধ্য।’ তিনি আরো বলেন, ‘মুসলমানদেরকে কথাবার্তায়, আচার-আচরণে প্রকৃত মুসলমান হতে হবে। তারা যদি অমুসলমানের আচার-আচরণ, চাল-চলন ও কাজ-কর্ম পছন্দ করে তাহলে শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাদেরকে অমুসলমানদের সাথে স্থান দেবেন।’ শহীদ তিতুমীর বলেন, ‘ইসলাম মুসলমানদের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান এবং এর মধ্যেই রয়েছে তাদের ইহকাল, পরকালের মুক্তি।’ এটা ছিল তার প্রাথমিক দাওয়াতের মূলকথা। তার হৃদয়গ্রাহী ভাষা ও প্রচারকার্য বিপথগামী ও সুপ্ত মুসলমানদের মধ্যে এক অভাবিতপূর্ণ জাগরণ এনে দেয়। তিতুমীর ও তার অনুসারীদের দমন করার উদ্দেশ্যে কলকাতায় জমিদারদের ষড়যন্ত্র সভায় স্থির হয় যে, যেহেতু তিতুমীরকে দমন করতে না পারলে হিন্দু জাতির পতন অনিবার্য, সে জন্য যেকোন প্রকারেই হোক তাকে শায়েস্তা করতে হবে। এ ব্যাপারে সকল জমিদার সর্বতোভাবে সাহায্য, সহযোগিতা করবেন, ইংরেজ নীলকরদেরও সাহায্য গ্রহণ করা হবে বলে স্থির হয়। কলকাতার ষড়যন্ত্র সভার পর সরফরাজপুরের লোকদের নিকট থেকে দাড়ি গোঁফের খাজনা এবং আরবি নামকরণের খারিজানা ফিস আদায়ের জন্য লোক পাঠানো হয়। কিন্তু তারা খাজনা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তিতুমীরকে ধরে আনার জন্য সশস্ত্র বরকন্দাজ পাঠানো হয়। কিন্তু তারা ধরে আনতে সাহস করেনি।  অতঃপর সহস্ররাধিক লাঠিয়াল, সড়কিওয়ালা ও ঢাল তলোয়ারধারীসহ তিতুমীরের উপর হামলার সিদ্ধান্ত হয়। শুক্রবার জুমার খুতবা শেষে মুসল্লিগণ নামাজে দাঁড়িয়েছেন এমন সময় মসজিদ ঘিরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। অল্প বিস্তর অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তিতুমীর এবং মুসল্লিগণ বাইরে এলে তাদেরকে আক্রমণ করা হয়। দুইজন সড়কিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন ও বহু আহত হয়। মুসলমানগণ মামলা দায়ের করেন। পুলিশ এজাহার গ্রহণ করে বটে ঘটনাস্থলে উপস্থিত না হয়েই লাশ দাফন করার নির্দেশ দেয়া হয়। (Colvin’s Report: British Policy & the Muslimes in Bengal) এ ঘটনার আঠারো দিন পর তিতুমীর ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে এই বলে মামলা দায়ের করা হয় যে, তার লোকজন মারপিট করেছে এবং নিজেরাই মসজিদ জ্বালিয়ে দিয়েছে। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর ইংরেজ বাহিনী তিতুমীরের বাড়িতে হামলা চালায়। ইংরেজ সৈন্যদের কামানের গোলায় শাহাদত বরণ করেন শহীদ তিতুমীর। বালাকোটের বিপর্যয় সাইয়েদ আহমদ শহীদ ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে সমগ্র ভারতব্যাপী এক বিরাট সুসংগঠিত স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল ভারতীয় মুসলমানদের দ্বারা। এ আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিলেন সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (রহ)। এ দেশের বিরাট মোগল সাম্রারাজ্য চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ধ্বংস হয়ে গেছে। তার ধ্বংসস্তূপের উপর যে দু’চারটি মুসলিম রাষ্ট্র মাথা তুলেছিল, তাও শেষ হয়ে গেছে। ইংরেজ গোটা ভারতের উপরে তার আধিপত্য বিস্তার করে থাকলেও একটি বিরাট অঞ্চলে শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত। মুসলমানরা শুধু রাজ্য হারায় নাই, আপন দ্বীন ও ‘সেরাতে মুস্তাকিম’ থেকে বহু দূরে সরে পড়েছে। তাদের আকিদাহ বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও আচার অনুষ্ঠান অনৈসলামী চিন্তাধারা ও ধর্মকর্মের দ্বারা প্রভাবিত। মুসলমান আমির-ওমরা যাঁরা অবশিষ্ট ছিলেন, তাঁরা ভোগবিলাসে লিপ্ত এবং তাদের জীবনের সুখ সম্ভোগের উপায় উপাদানগুলো যেন অক্ষুণœ থাকে। তার জাতীয় পরিণাম যা কিছুই হোক না কেন, এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার অবকাশ তাদের ছিল না। জনগণের মধ্যে অধিকাংশের অবস্থা এই ছিল যেন তাদের উপরে বজ্রপাত হয়েছে এবং তারা জ্ঞান ও সম্বিতহারা হয়ে পড়েছে, অথবা প্রবল ভূকম্পন শুরু হয়েছে এবং তারা হয়ে পড়েছে দিশাহারা। যাদের কিছু জ্ঞান বুদ্ধি ছিল, তারা কোন সমাধান খুঁজে পাচ্ছিল না। অন্ধকার ভবিষ্যৎকে তারা ভাগ্যের লিখন মনে করে চুপচাপ হাত পা গুটিয়ে বসে ছিল এটা মনে করে যে, যা হবার তা হবেই। কিন্তু তরী যখন নদীবক্ষে ঘূর্ণাবর্তে পতিত হবে, তার পাল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে, নোঙর কোন কাজে আসবে না, এবং কর্ণধারেরও কোন সন্ধান পাওয়া যাবে না তখন আরোহীদের জীবন রক্ষার কোন আশা আর বলবৎ থাকবে? মুসলমানরা তখন এমনি এক নৈরাশ্যের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল। মুসলমানদের জাতীয় জীবনের এমনি এক নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে সাইয়েদ সাহেব তাঁর জ্ঞানচক্ষু খোলেন। তিনি দেখলেন তাঁর সম্মুখে মাত্র তিনটি পথই উন্মুক্ত রয়েছে। এক. হককে পরিত্যাগ করে বাতিলের সাথে সম্পর্ক সম্বন্ধ স্থাপন করা। দুই. হককে পরিত্যাগ না করা। বরঞ্চ হকের সঙ্গে জড়িত থাকতে গিয়ে যেসব বিপদ আপদ ও দুঃখ দারিদ্র্য আসবে, তা নীরবে সহ্য করা। তিন. পুরুষোচিত সাহস ও শৌর্যবীর্য সহকারে বাতিলের মুকাবিলা করত এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করার আপ্রাণ চেষ্টা করা-যাতে করে হকের জন্য বিজয় সাফল্য সূচিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। প্রথমটি হলো মৃত্যুর পথ, জীবনের পথ নয়। দ্বিতীয়টির পরিণাম ফল এই হতে পারে যে ক্রমশ ধুঁকে ধুঁকে এবং যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার ভেতর দিয়ে জাতির জীবনপ্রদীপ নিভে যাবে। তৃতীয় পথটিই হলো জাতীয় আত্মমর্যাদার পথ, বীরত্ব ও সৎ সাহসের পথ। নবজীবন লাভ করে আত্মমর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ। সাইয়েদ সাহেব এই তৃতীয় পথটিই অবলম্বন করেছিলেন। এ পথে চলার সকল যোগ্যতা ও গুণাবলি তাঁর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। সাইয়েদ আহমদ আল্লাহর পথে জেহাদকে তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে এবং পরকালে মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে গ্রহণ করেন। শুধু নিজের জন্যই নয় জেহাদের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে তিনি দেশে ও বিদেশে বহু মুসলিম শাসক ও আমির ওমরাহর কাছে তাঁর জ্বালাময়ী ভাষায় বহু পত্র লিখেন। (চলবে)

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির