বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস
মতিউর রহমান আকন্দ
১১ ডিসেম্বর ২০১৬
[ পূর্ব প্রকাশের পর ]
হিন্দু-মুসলিম ঐক্য
পাক-ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বৈরিতা এক বিষাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। রাজনীতি থেকে মুসলমানদেরকে বাইরে রাখা ছিল হিন্দুদের প্রধান নীতি। মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা হয় এমন কোনো কিছুই তারা বরদাশত করতে প্রস্তুত ছিল না। বঙ্গভঙ্গ রদে তারা উঠেপড়ে লাগে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন সারা ভারত বর্ষে দু’টি জাতীয়তাবাদের ধারা সৃষ্টি করে; একটি হিন্দু অপরটি মুসলিম। বঙ্গভঙ্গ রদের পর মুসলমানদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। এ ঘোষণায় হিন্দুরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে বাংলার জনগণ শিক্ষিত হউক তা হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ চাননি। তাদের ষড়যন্ত্র ও প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে তারা বিদ্রƒপ করে ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ বলত।
সংখ্যাগুরু হিন্দুরা মুসলমানদের কোনো কল্যাণ সহ্য করতে পারেনি। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা তাদের আরো উত্তেজিত করে তোলে। এটা উপলব্ধি করে তদানীন্তন মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগকে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ কংগ্রেসের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন। ঐ প্রেক্ষাপটে ১৯১৩ সালে সৈয়দ আমির আলী ও মাওলানা মুহাম্মদ আলীর অনুরোধে কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তিনি কংগ্রেসের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। মুসলিম লীগে যোগ দিলেও তিনি কংগ্রেসে থেকে যান। কায়েদে আযম বললেন, ‘মুসলিম লীগ ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি তার আনুগত্য বৃহত্তর জাতীয় কার্যক্রমে অর্থাৎ কংগ্রেসের প্রতি তার আনুগত্য বিন্দুমাত্র ব্যাহত করবে না।’ (উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব : ইয়াসমিন আহমদ, পৃ: ২০০)
মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ভারতীয় জনগণের উন্নতি ও অগ্রগতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তারা জনকল্যাণের জন্য হিন্দু ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ের বিষয়ে কর্মপদ্ধিত খুঁজে বের করার প্রস্তাব রাখেন। ১৯১৩ সালে লক্ষেèৗতে মুসলিম লীগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে নি¤েœাক্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়:
“সর্ব-ভারতীয় মুসলিম লীগ তার দৃঢ়বিশ্বাস ব্যক্ত করতে চায় যে, ভারতীয় জনগণের ভবিষ্যৎ উন্নতি ও প্রগতি নির্ভর করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা ও সকলের ঐক্যবদ্ধ কার্যকলাপের ওপর। মুসলিম লীগ আশা করে, উভয় পক্ষের নেতারা সময়ে সময়ে একত্রে বসবেন এবং জনকল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করার একটি সম্মিলিত ও সুসংহত কর্মপদ্ধতি খুঁজে বের করবেন।”
ভারতের জন্য উপযোগী ও বিদ্যমান শাসনব্যবস্থায় সংস্কারের জন্য মুসলিম লীগ ব্রিটিশ সরকারের সমর্থনে একটি স্বশাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালায়। এ উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগের লক্ষ্যসমূহ পরিবর্তন করা হয়। ১৯১৩ সালে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের লক্ষেèৗ অধিবেশনে গৃহীত পরিবর্তনটা ছিল নি¤œরূপ:
“ব্রিটিশ সরকারের সমর্থনে এমন একটা স্বশাসনব্যবস্থা অর্জন করা যেটা হবে ভারতের জন্য উপযোগী এবং যেটা করা হবে সাংবিধানিক উপায়ে, বর্তমান শাসনব্যবস্থায় সংস্কার সাধনের মাধ্যমে। সেই সংস্কার হবে জাতীয় ঐক্য ও মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।” (পাকিস্তান আন্দোলন : ঐতিহাসিক দলিলপত্র Ñজি অ্যালানা)
১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তুরস্কের খলিফা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জার্মানির পক্ষে যোগ দেন। ভারতের মুসলমানগণ এক নতুন সমস্যায় নিপতিত হন। একদিকে তাদের শাসক ব্রিটিশকে সমর্থন করার বাস্তবতা অন্যদিকে ইসলামী বিশ্বের খলিফাকে সমর্থন করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা। অবশেষে মুসলমানদের রায় ব্রিটিশের বিপক্ষেই গেল। মুসলিম পত্রিকাগুলো ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। এ আন্দোলনের উদ্যোক্তা হিসেবে গ্রেফতার হন মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা মুহম্মদ আলী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা জাফর আলী খান, মাওলানা আকরম খান ও মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ। বন্ধ করে দেয়া হয় মুসলিম সংবাদপত্রগুলো। ইংরেজ সরকারের এ পদক্ষেপ মুসলমানদের আরো ইংরেজবিদ্বেষী করে তোলে। এই অবস্থায় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সাথে এক সমঝোতা গড়ে তোলার জন্য তীব্র তাগিদ অনুভব করেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ছিলেন কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
তার সামনে স্থির দু’টি লক্ষ্য ছিল- এক. স্বায়ত্তশাসনের অধিকার তথা স্বাধীনতা অর্জন। দুই. হিন্দু মুসলিম ঐক্য সাধন। (উপমহাদেশের রাজনীতি ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, পৃষ্ঠা-১৯৯)
কায়েদে আযমের বক্তব্য ছিল হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে হবে এবং সর্বপ্রকার শাসনতন্ত্রসম্মত ও বৈধপন্থায় যতশীঘ্র সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তর করার ব্যবস্থা করতে হবে। ত্রিশ কোটি লোকের ঐক্যবদ্ধ দাবি এমন একটা শক্তি সৃষ্টি করবে যা পৃথিবীর কোন শক্তি প্রতিরোধ করতে পারবে না।
মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস একে অপরের দিকে এগিয়ে আসার ফলে এক ঐতিহাসিক সমঝোতা সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের সম্মেলন একই শহরে একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয় এবং নেতারা একে অপরের সম্মেলনে যোগ দিতে থাকেন। এ ধরনের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বোম্বাইয়ে ১৯১৫ সালে। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের বোম্বাই সম্মেলনে কায়েদে আযম সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য একটি যৌথ পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। এর প্রস্তাব উভয় দল কর্তৃক গৃহীত হয়। ১৯১৬ সালে লক্ষ্মৌতে একই সময় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের অধিবেশন বসে। এ অধিবেশনে ঐতিহাসিক লক্ষ্মৌ প্যাক্ট সম্পাদিত হয় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে। এ চুক্তির উল্লেখযোগ্য দিক হলো, কংগ্রেস প্রত্যেক প্রদেশে মুসলিম লীগের পৃথক নির্বাচন ও পৃথক প্রতিনিধিদের দাবি স্বীকার করে নেয়। জাতি হিসেবে মুসলমানদের স্বতন্ত্র অধিকারের দাবি কংগ্রেস কর্তৃক স্বীকৃত হয়। অন্যদিকে মুসলিম লীগ তাদের বিশেষ দাবির ক্ষেত্রে নমনীয়তা প্রদর্শন করে। বাংলার ৪০ শতাংশ এবং পাঞ্জাবে ৫০ শতাংশ মুসলিম প্রতিনিধিত্বের বিষয় মুসলিম লীগ স্বীকার করে নেয় এবং সংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের দাবি পরিত্যাগ করে। মুসলমানদের ধর্ম সংস্কৃতির ওপর সংখ্যাগুরুদের হস্তক্ষেপ হতে পারে এ ভয় মুসলমানদের ছিল। এ ভয় দূরীকরণের জন্য ঠিক হলো যে, ‘কোন সস্প্রদায় সম্পর্কে কোনো প্রস্তাব সেই সম্প্রদায়ের তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের বিরোধিতা থাকলে গৃহীত হবে না।’ (ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঋৎববফড়স সড়াবসবহঃ রহ ওহফরধ- ঞধৎধপযধহফ, ঠড়ষ-ওওও, চধমব-৪১৪)
লক্ষ্মৌ চুক্তিকে অনেকে মুসলমানদের ঐতিহাসিক কূটনৈতিক বিজয় বলে অভিহিত করেছেন। (বাংলাদেশের ইতিহাস, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, পৃ: ৫৪০)
কিন্তু বাংলার মুসলমানরা এ চুক্তিতে খুব সন্তুষ্ট হতে পারেনি। বাংলার মুসলমানরা ছিল সংখ্যায় শতকরা ৫৪ ভাগ। কিন্তু চুক্তি অনুসারে তারা আসন পেল শতকরা ৪০ ভাগ। এ চুক্তির সমালোচনা হয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এবং লেখালেখিতে সমালোচনা প্রকাশিত হয়। ‘হিন্দু-মুসলিম মিলন ও দেশের ভবিষ্যৎ ও সঠিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে মুসলিম নেতৃবৃন্দ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং দীর্ঘদিন এই সম্প্রীতির প্রবাহকে সমুন্নত রাখতে চেষ্টা করেন। (বাংলাদেশের ইতিহাস, নওরোজ কিতাবিস্তান, পৃ: ৫৪১)
লক্ষ্মৌ চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে কায়েদে আযম মুসলিম লীগ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘হিন্দুদের প্রতি আমাদের শুভেচ্ছামূলক এবং ভ্রাতৃভাবাপন্ন আচরণ হতে হবে। দু’টি সহোদর প্রতিম সম্প্রদায়ের সমঝোতার মাধ্যমে ভারতের সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি সম্ভব।’ (জিন্নাহ, লেখক- হেক্টর বালিনো)
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধে জার্মানি পক্ষের পরাজয় ঘটে। পরাজিত তুরস্ককে খন্ড-বিখন্ড করার জন্য ব্রিটেন এগিয়ে আসে। এ ঘটনা মুসলমানদের বিক্ষুব্ধ করে তুলে। ব্রিটেন ভারতের মুসলমানদের প্রকাশ্যে এবং সুস্পষ্টভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিল যে, যুদ্ধ শেষে ব্রিটেন তুরস্কের প্রতি নির্দয় ব্যবহার করবে না। ব্রিটেনের কথায় বিশ্বাস করে ভারতের মুসলমানেরা যুদ্ধে ব্রিটেনকে সবদিক থেকে সাহায্য সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষে উল্টো ব্যবহার করলো ব্রিটেন। বলকান অঞ্চল আগেই কেড়ে নেয়া হয়েছিল। মুসলমানরা ইংরেজদের ব্যবহারে প্রতারিত বোধ করলো। ইংরেজের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়লো মুসলমানরা। (সূত্র : এক শ’ বছরের রাজনীতি- আবুল আসাদ)
খেলাফত আন্দোলন
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে খেলাফত আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত। খেলাফত আন্দোলন মূলত একটি ধর্মীয় আন্দোলন হলেও এটি ছিল ভারতের বৃহত্তর স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অংশ। ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডন সম্মেলনে এ আন্দোলন একটি আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। এ আন্দোলন ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার উৎখাত এবং অটোমান সা¤্রাজ্য রক্ষায় এ আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯১৮ সালের অক্টোবরে মুদ্রোস যুদ্ধবিরতি চুক্তি এবং ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে অটোমান সা¤্রাজ্যের অস্তিত্ব বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি তুর্কি খেলাফতের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। ১৯২০ সালের আগস্টে সেভার্স চুক্তির আওতায় অটোমান সা¤্রাজ্যকে খন্ড-বিখন্ড করা হলে ভারতে খেলাফত আন্দোলন জোরদার হয়।
অটোমান স¤্রাট দ্বিতীয় আবদুল হামিদ পশ্চিমা আগ্রাসন থেকে তুর্কি সা¤্রাজ্য রক্ষায় প্যান ইসলামী আন্দোলনের সূচনা ঘটান। এ উদ্দেশ্যে তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তার দূত জামালউদ্দিন আফগানীকে ভারতে প্রেরণ করেন। অটোমান স¤্রাটের আবেদন ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় আবেগ ও সহানুভূতির সৃষ্টি করে। খলিফা হিসেবে অটোমান স¤্রাট ছিলেন বিশ্বব্যাপী সকল সুন্নি মুসলমানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা। বিপুলসংখ্যক মুসলিম নেতৃবৃন্দ খেলাফত আন্দোলনের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করেন। মুসলিম ধর্মীয় নেতা শাইখুল হিন্দ মাওলানা মেহমুদ আল-হাসান অটোমান সা¤্রাজ্যের সহায়তায় ব্রিটিশবিরোধী একটি জাতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করার প্রচেষ্টা চালান। তবে ‘ইয়াং টার্ক’ নামে একটি গোপন তুর্কি জাতীয়তাবাদী গ্রুপ স¤্রাট দ্বিতীয় আবদুল হামিদকে ক্ষমতাচ্যুত করলে তার পরিকল্পনা মার খায়। পঞ্চম মেহমুদ আবদুল হামিদের স্থলাভিষিক্ত হলে খেলাফত আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। খেলাফত রক্ষায় বিশ্বব্যাপী প্রবল আলোড়ন উঠলেও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন গড়ে ওঠে ভারতে। খেলাফত আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণা চালানোর দায়ে মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহরকে চার বছর কারাগারে আটক রাখা হয়। তুরস্কে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে মুসলিম নেতৃবৃন্দ খেলাফতের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন।
মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও তার ভাই মাওলানা শওকত আলী নিখিল ভারত খেলাফত কমিটি গঠনে শেখ শওকত আলী সিদ্দিকী, কংগ্রেসের এককালীন সভাপতি ড. মোখতার আহমদ আনসারী, রোমান্টিক উর্দু কবি হাসরাত মোহানী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও বিখ্যাত ইউনানি চিকিৎসক হেকিম আজমল খাঁর মতো নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগদান করেন। লক্ষেèৗতে জমিদার শওকত আলী সিদ্দিকীর কম্পাউন্ড ছিল এ সংগঠনের প্রধান কার্যালয়। তারা মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং তুর্কি খেলাফত রক্ষায় তাদের প্রভাব কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। ১৯২০ সালে প্রকাশিত খেলাফতের ইস্তেহারে তুর্কি খেলাফত রক্ষায় ব্রিটিশদের কাছে দাবি জানানো হয় এবং খেলাফত রক্ষায় ব্যর্থ হলে ব্রিটিশদের দায়ী করার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ১৯২০ সালে খেলাফত ও ভারতীয় কংগ্রেস একটি জোট গঠন করে। কংগ্রেস নেতা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী ও খেলাফত নেতৃবৃন্দ খেলাফত রক্ষা এবং স্বরাজ প্রতিষ্ঠার দাবিতে একযোগে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। ব্রিটিশদের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ প্রয়োগে খেলাফত আন্দোলন অসহযোগ আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
অসহযোগ আন্দোলনকালে খেলাফত আন্দোলনের সমর্থন গান্ধী ও কংগ্রেসকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। ড. আনসারী, মাওলানা আজাদ ও হেকিম আজমল খাঁর মতো খেলাফত নেতৃবৃন্দ ব্যক্তিগতভাবে গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এসব নেতা মুসলমানদের জন্য পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন এবং মুসলমানদের সামাজিক উন্নয়নে ১৯২০ সালে ‘জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেন। অসহযোগ আন্দোলন প্রাথমিকভাবে সফল হয়। সারা ভারতে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ, ধর্মঘটে ও আইন অমান্য তৎপরতা ছড়িয়ে পড়ে। শান্তিপূর্ণভাবে হিন্দু ও মুসলমানরা যৌথভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ব্রিটিশ সরকার গান্ধী, আলী ভ্রাতৃদ্বয় ও অন্যদের কারারুদ্ধ করে। শিগগির কংগ্রেস-খেলাফত ঐক্যে ভাঙন ধরে। মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভার মতো রাজনৈতিক দলগুলো খেলাফত আন্দোলনের বিরোধিতা করতে থাকে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এ আন্দোলনকে একটি ‘ধর্মীয় উন্মাদনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অনেক হিন্দু ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ খেলাফত আন্দোলনকে ইসলামী মৌলবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেন। মুসলিম ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের আহ্বানে ১৯২০ সালে সিন্ধু ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ১৮ হাজার মুসলমান আফগানিস্তানে হিযরত করেন। তারা ভারতকে ‘দারুল ইসলাম’ বা মুসলিমপ্রধান ও ইসলামী শাসনাধীন একটি দেশ হিসেবে দেখছিলেন। কিন্তু আফগান সরকার এসব শরণার্থী মুসলমানকে শক্তিপ্রয়োগে ভারতে বিতাড়িত করে। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে আলী ভ্রাতৃদ্বয় গান্ধী ও কংগ্রেস থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখছিলেন। আলী ভ্রাতৃদ্বয় অহিংস আন্দোলনের প্রতি গান্ধীর প্রতিশ্রুতির সমালোচনা করেন এবং আইন অমান্য আন্দোলন স্থগিত করায় তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। মুসলমানরা কংগ্রেস, খেলাফত ও মুসলিম লীগের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় খেলাফত আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
তুরস্কে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার কায়েম হলে অটোমান খেলাফত উচ্ছেদ হয়ে যায়। অটোমান খেলাফত উচ্ছেদ ছিল ভারতে খেলাফত আন্দোলনের প্রতি একটি চূড়ান্ত আঘাত। খেলাফত নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ড. আনসারী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও হেকিম আজমল খাঁ গান্ধী ও কংগ্রেসকে বলিষ্ঠভাবে সমর্থন দিয়ে যেতে থাকেন। আলী ভ্রাতৃদ্বয় মুসলিম লীগের যোগদান করেন। এ দু’ভাই মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তুরস্কে খেলাফত বিলুপ্ত করা হলে পরবর্তী করণীয় স্থির করার বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৩১ সালে জেরুজালেমে একটি খেলাফত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসের সঙ্গে খেলাফত আন্দোলনের জোট গঠনকে কেউ কেউ ‘অসমবর্ণ বিয়ে’র সঙ্গে তুলনা করেন। তবে এ আন্দোলনের সমর্থকরা তাকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠায় একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থকরা খেলাফত আন্দোলনকে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছেন। আলী ভ্রাতৃদ্বয়কে পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যদিকে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. আনসারী ও হেকিম আজমল খাঁকে ভারতে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেয়া হয়। (সূত্র : উইকিপিডিয়া : দ্য ফ্রি এনসাইক্লোপিডিয়া)
১৯১৮ সালে দিল্লিতে মুসলিম লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন এ. কে. ফজলুল হক। এ সম্মেলনে যোগ দেন মাওলানা আব্দুল বারী, মাওলানা আজাদ সুবহানী, মাওলানা ইব্রাহীম শিয়ালকুটি, মাওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা আহমদ সাঈদ, মাওলানা কিফায়েতুল্লাহ, মাওলানা আব্দুল লতিফ প্রমুখ আলেম। এরা অনেকেই কংগ্রেসপন্থী এবং মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। খেলাফত আন্দোলনের স্বার্থে তারা মুসলিম লীগ সম্মেলনে যোগ দেন। লক্ষ্য ছিল, মুসলিম লীগকে খেলাফত আন্দোলনে নিয়ে আসা। তারা সফল হন। কায়েদে আযম খেলাফত আন্দোলন নিয়ে বাড়াবাড়ির পক্ষে ছিলেন না। সভাপতির ভাষণে এ. কে ফজলুল হক বলেন ‘আমার কাছে ভারতে ইসলামের ভবিষ্যৎ মনে হয় হতাশা ও উদ্বেগাচ্ছন্ন। দুনিয়াতে মুসলিম শক্তির পতনের যে কোন উদাহরণ ভারতে আমাদের সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক গুরুত্বের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে বাধ্য।’ (ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ভৎববফড়স গড়াবসবহঃ রহ ওহফরধ, ইু ঞধহধপযধহফ, চধমব- ৪১৬)
খেলাফত আন্দোলনের জন্য কর্মসূচির প্রস্তাব মুসলিম লীগ গ্রহণ করলেও মুসলিম লীগকে এ নিয়ে বেশি এগোতে হয়নি। খেলাফত আন্দোলন পরিচালনার জন্য আলাদা কমিটি গঠিত হয়। কংগ্রেসভুক্ত মুসলিম নেতৃবৃন্দই এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বোম্বাইয়ে সর্বভারতীয় খেলাফত কমিটি গঠিত হয়। ১৯১৯ সালের ১৭ অক্টোবর গোটা ভারতব্যাপী ‘খেলাফত দিবস’ পালিত হয়। সাড়া পড়ে যায় গোটা ভারতবর্ষে। বাংলায় এ. কে ফজলুল হক ও মাওলানা মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন গড়ে ওঠে। খেলাফত আন্দোলনে কংগ্রেসের হিন্দু নেতাদের দারুণ উৎসাহী দেখা যায়।
প্রথম খেলাফত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯১৯ সালের ২৩ নভেম্বর দিল্লিতে। এতে সভাপতিত্ব করেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। এ সম্মেলনে গান্ধী ও মতিলাল নেহরুর মত শীর্ষ কংগ্রেস নেতার পাশাপাশি ভারতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠাকামী কট্টর কংগ্রেস নেতা মদন মোহন মালব্যও যোগদান করেন। খেলাফত সম্মেলন দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিন সভাপতিত্ব করেন এ. কে. ফজলুল হক এবং দ্বিতীয় দিন সভাপতিত্ব করেন মি: গান্ধী। খেলাফত আন্দোলনের সাথে মি: গান্ধীর সংশ্লিষ্টতা খেলাফত আন্দোলনের গুণগত পরিবর্তন সাধন করে। খেলাফতের অধিকার সংক্রান্ত দাবি দাওয়া এবং তা বাস্তবায়নের চাপ ও চেষ্টার চাইতে খেলাফত আন্দোলন রাজনৈতিক চরিত্রের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ে। (চলবে)
আপনার মন্তব্য লিখুন