post

বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র নাকি কল্যাণরাষ্ট্র? । মিজানুর রহমান

২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র নাকি কল্যাণরাষ্ট্রবাংলায় ইসলামের শেকড় ‘বাংলাদেশ’ পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট্ট একটি ভূখণ্ডের নাম হলেও এর অবস্থান, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ, জনগণের মাঝে ইসলামের প্রভাব, ইসলামবিরোধী শক্তি, প্রতিবেশী দেশ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ইত্যাদি বিবেচনায় বর্তমান সময়ে অতি গুরুত্বের দাবি রাখছে। ঐতিহাসিক ধারা বর্ণনা অনুযায়ী বাংলাদেশে ইসলামের সূচনা ইসলামের স্বর্ণযুগেই। রাসূল (সা) এর সাহাবায়ে কিরামদের কেউ কেউ যেমন কিছু বর্ণনা মতে আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওহাইবের (রা) সাথে কাসেম ইবনে হুযাইফা (রা) উরওয়াহ ইবনে আছাছা (রা) ও আবু কায়েস ইবনুল হারিস (রা) চীনের পথে পাড়ি দেন। পরবর্তীতে অনেক মুজাহিদ দাওয়াতি কাজ করতে আসার বর্ণনা এই এলাকায় ইসলামের মজবুত শেকড়েরই জানান দেয়। আরব বণিকগণ ধারাবাহিকভাবে ব্যবসায় ও দাওয়াতি কাজের মাধ্যমে এই এলাকায় ইসলামের মজবুত বিশ্বাস গড়ে তুলেছেন। আর কিছু মুসলমান এ অঞ্চলে এসেছিলেন দেশজয়ের অভিযানে। তাদের বিজয়ের ফলে বাংলা অঞ্চলে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা হয়। কিছু ইতিহাসবিদের মতে, বাংলায় মুসলমানদের আগমন দূর অতীতের কোন এক সময় হয়ে থাকলেও তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার সূচনা হয় ১২০৩ সাল মোতাবেক ৬০০ হিজরি সাল থেকে। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলা অঞ্চলের সাথে আরবদের সম্পর্ক ও পরিচয় অতি পুরাতন। মালাবাবের পথ ধরে তারা বর্তমান বাংলা অঞ্চলের চট্টগ্রাম, সিলেট ও আসামের কামরূপ হয়ে সমুদ্রপথে চীনে যাতায়াত করতো। তুর্কিস্তানের ‘খালজ’ বংশোদ্ভূত মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী দিল্লির তদানীন্তন সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেকের আমলে ১১৯৮ সাল মোতাবেক ৫৯১ হিজরিতে তার সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। তিনিই ছিলেন প্রথম মুসলিম সেনাপতি যিনি বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে ইসলামের সদর্প আবির্ভাব ঘটান। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় একে একে মুসলিম বসতি ও স্থাপনার বিস্তার হতে থাকে। ১২০৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বাংলার ‘রাঢ়’ ও ‘বরেন্দ্র’ অঞ্চল অধিকার করেন। তিনি যখন বাংলায় অভিযান চালান, তখন এ অঞ্চলের শাসক ছিলেন রাজা ‘রায় লক্ষ্মণ সেন’। তার রাজধানী ছিল নদিয়া। অঞ্চলটি লাখনৌটি নামেও পরিচিত ছিল। বখতিয়ার খিলজী রাজধানী নদিয়া আক্রমণ করলে রাজা লক্ষ্মণ সেন রাজপ্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে পলায়ন করে বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন। বাংলায় মুসলিম শাসনের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ১৩৪৫ সাল থেকে ১৪১৪ এবং ১৪৩৭ সাল থেকে ১৪৮৭ সাল পর্যন্ত দুই দফায় ইলিয়াস শাহি বংশের দু’টি ধারার শাসন এই সময় বাংলায় মুসলিম শাসন ব্যবস্থায় খুবই ভালো অবস্থায় ছিল। ঐ সময় বাংলা ইসলামী চিত্রকলা, বিজ্ঞান, বস্ত্র ব্যবসা ও খাদ্যশস্যে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করে। স্বদেশী বাংলা ভাষায় সাহিত্যেরও ব্যাপক বিকাশ ঘটে। ঐ শাসকদের মধ্যে একজন গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ (১৩৯১-৯৬) চীনের সাথে কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং দূরপ্রাচ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন। মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী (১২০৩-৬), থেকে নবাব আলীবর্দী খাঁন (১৭৪০-৫৬) ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৭৫৬-৫৭)। এর পর পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের মোকাবিলায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর বাংলায় পর্যায়ক্রমে পুরোপুরি ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হওয়ার পর বাংলার মুসলমানদের ভাগ্যে নেমে আসে মহাদুর্যোগ। বাংলার মুসলমানদের এ মহাদুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করা এবং সেই সাথে স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে যেসব আলেম অবদান রেখে গেছেন তার মধ্যে আবদুল ওহাব, হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর ও ফকির মজনু শাহের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারত থেকে রক্তপাতহীন ভাগ হওয়া পাকিস্তানের পূর্বাংশে পূর্ব পাকিস্তান ও ভৌগোলিক দূরত্ব, ভিন্ন বংশগত কারণে রক্তপাতহীন বিভক্তি হতে পারত। কিন্তু ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই দুই পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা চরমভাবে প্রয়োজনবোধ করে ভারত। ভূখণ্ডগত দূরত্বের কারণে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ভাগ হলে ভারতের প্রভুত্ব কমে যায় তাই তারা একটি যুদ্ধের পরিবেশ আশা করছিল। সুযোগের অপেক্ষায় থাকা হিন্দুত্ববাদীদের উসকানি, পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা বাংলাদেশীদের ক্ষোভের আগুনে যেন তেল ঢেলে দেয়। ফলে নয় মাসের যুদ্ধ, রক্তপাত, ধ্বংসলীলার পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। শুরু হয় নবপ্রসূত দেশের পথ চলা।

বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা এ উপমহাদেশের তৎকালীন সময়ে কিছু আলেম ওলামা রাজনীতিতে থাকলেও ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা তথা ইসলামী রাজনীতির ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেন আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মাওদুদী (রহ)। ১৯৪১ সালে আল্লামা আবুল আলা মাওদুদী (রহ) জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন। অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ ও যৌক্তিক একটি আন্দোলন হিসাবে উপমহাদেশে এর গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে আজ ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসাবে এক বড় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশে এ সংগঠন কাজ করে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে একটি সুশৃঙ্খল শক্তিতে পরিণত হয়েছে। সততা, মেধা ও যোগ্যতার সাথে কাজ করে বাংলাদেশের স্থানীয় এবং জাতীয় সর্বক্ষেত্রে একটি আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছে। বলতে গেলে দুর্নীতিপরায়ণ একটি সমাজে দুর্নীতিমুক্ত মন্ত্রণালয়, দুর্নীতিমুক্ত ইউনিয়ন ও উপজেলা চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্য উপহার দিয়েছে, যা পুঁজিবাদী, সমাজবাদী এমনকি তথাকথিত আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্র খ্যাত সমাজেও অকল্পনীয়। অনৈতিকতার সয়লাবে ভেসে যাওয়া বর্তমান সমাজে কিছু দেশপ্রেমিক, যোগ্য, চরিত্রবান নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ উপহার দিয়েছে যারা দেশ পরিচালনায় অধিকতর যোগ্য। দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে যারা অপসহীন। শাসকশ্রেণী নিজেদের অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য তরুণ-যুবসমাজকে অনৈতিকতার চরম অন্ধকার গলিপথে ঠেলে দিয়েছে। তাদের আলোর পথ দেখাতে, চরিত্রের লাগাম পরিয়ে দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে হেরার আলোয় উদ্ভাসিত একঝাঁক মেধাবী তরুণ। সকল পাপের মূল হিসেবে পরিচিত মাদক যখন আধুনিক সমাজে প্রগতির চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তরুণ-তরুণীরা মাদকের নেশায় মত্ত হয়ে লাগামহীন, বল্গাহীন অবৈধ জীবনাচার, যৌনাচারে লিপ্ত হচ্ছে, ধ্বংস করছে দেশের শত সহস্র কোটি টাকা, নষ্ট করছে সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা, তখন তাদের আলোর দিশা দেখিয়ে যাচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। বর্তমান দুনিয়ায় এত সুন্দর, সুশৃঙ্খল, পরোপকারী, চরিত্রবান একটি দল অমুসলিম দুনিয়াতে তো বটেই, মুসলিম দুনিয়ায়ও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে এর অর্থ এই নয় যে আমরা দুর্বলতাহীন বা গুনাহমুক্ত একটি সংগঠন। অসংখ্য দুর্বলতা আমাদের আছে। যা পরিহার করার চেষ্টা অব্যাহত আছে আরো সংশোধন জরুরি। কোন ব্যক্তি বা দলের পতনের জন্য অহংকার নামক অপরাধই যথেষ্ট। আত্মসমালোচনা, ইহতিসাব- মোহাসাবা ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক চরিত্রকে সুন্দর রাখার এবং সংশোধন করার একমাত্র উপায়। আল্লাহ আমাদের এই মহান গুণটির সাথে অভ্যস্ত হওয়ার তাওফিক দিন। এই সংগঠনের ওপর আল্লাহর বিশেষ রহমত এই যে, জনশক্তির বৃহত্তর একটা অংশ বর্তমান ইসলাম বিরোধী সরকারের ধারাবাহিক জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়ে ও সবরের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে যাচ্ছেন। তারা আল্লাহর কোরআনের সূরা আহজাবের ২৩ নং আয়াতেরই যেন বাস্তব প্রতিচ্ছবি। আল্লাহ বলেন, “মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি।” হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতন, গুম-খুন, ফাঁসি কোন কিছুই তাদের দমাতে পারেনি। তারা বাতিলের সাথে আপসহীন শান্তিপূর্ণ লড়াইয়ে নিজেকে শামিল করেছেন। যে কোন বিপদে ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে যাচ্ছেন। তারা জান্নাতের পথিক হিসেবে শাহাদাতের প্রত্যাশা করেন। শত বিপদ মুসিবত, অভাব অনটনের মাঝেও আল্লাহর দ্বীনকে ছেড়ে যাননি। তারা হাদিসে রাসূলের সেই অংশটিরই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ‘আমার উম্মতের একটি অংশ সর্বদা আল্লাহর দ্বীনের ওপর অটল থাকবে। তাদের অপদস্থ করতে প্রয়াসী কিংবা বিরোধিতাকারী কেউই তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমনিভাবে আল্লাহর আদেশ তথা কিয়ামত এসে যাবে কিন্তু তারা ঐ অবস্থায়ই থেকে যাবে।’ তারা আমাদের বৈষয়িক সহায় সম্বল, ব্যবসা বাণিজ্য, জীবন সম্পদের ক্ষতি করলেও তা খুবই সাময়িক ও নগণ্য বলতে হবে। আমাদের ওপর তাদের করা প্রতিটি জুলুম তাদের জন্যই অন্ধকারের অতল গহবরে নিক্ষিপ্ত হবার কারণ হবে। আমরা আমাদের ঈমানের পাহারাদারি করতে পারলে, সাময়িক বিপদ- মুসিবতকে জান্নাতের আশায় ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করতে পারলে ইহ-পরকালে বিজয় আমাদেরই হবে ইনশাআল্লাহ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে জুলুম নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ায় জনশক্তির একটি অংশ সফলতা ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছেন। তারা সংগঠনের ওপর আপতিত বিপদের জন্য সংগঠনের ভুলত্রুটির মূল্যায়নকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে চান। তাই কেউ বলেন সংগঠনের নাম পরিবর্তন করা জরুরি, কেউ বলেন আগের ইস্যুতে ক্ষমা চাওয়া উচিত, কেউ বলেন সংগঠনের নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন বা সংস্কার জরুরি। এ শ্রেণীর ভাইয়েরা মুক্তির উপায় হিসেবে নানা দেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চান। তাই কেউ তুর্কি, কেউ তিউনিসিয়া, কেউবা মালয়েশিয়ার উদাহরণ সামনে এনে মুক্তির উপায় খুঁজছেন। এসব দেশের অবস্থান, পরিবেশ, রাজনীতি বাংলাদেশের পরিবেশ, রাজনীতি, বা ভৌগোলিক অবস্থানের সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার ওপর এসব দেশের ক্ষমতাসীনদের গৃহীত পদ্ধতিকে ইসলামী পদ্ধতি মনে করা সঠিক নয়। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা টিকে থাকার জন্য যা যা করা প্রয়োজন মনে করেছেন তাই করছেন। কোন কোন দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পর্দা ও যেনা দুটাকেই বৈধ করে দেয়। একদিকে মাঝে মাঝে কিছু দান-সাদাকা অন্যদিকে মদের উৎপাদন বৃদ্ধি, একদিকে দ্বীনের ওয়ায়েজ নিয়োগ অন্যদিকে আইনগতভাবে অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। যেখানে আইন করেই মানুষকে পাপাচার থেকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না, সেখানে আইনগত বৈধতা পেলে আর ইমাম সাহেবের ওয়াজ কয়জন শুনে বা শুনলে ও এর প্রভাব কি? এসব দ্বিমুখী শাসনপদ্ধতি মানুষের মনে এ ধারণাই তৈরি করে যে, এত ভাল মানুষই যেহেতু এ আইন করেছে তাই এটা বুঝি ইসলামের হিকমাত। আলেমরাও রাষ্ট্রের ভয়ে বা রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগের কারণে সরকারের কোন অন্যায়কে আর অন্যায় না বলায় বা চুপ থাকায় একটা সময় গা সওয়া হয়ে সমাজ ও এসব গোনাহকে শিথিল মনে করছে। যা বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় ইসলামী আন্দোলন নাম নিয়ে কেউ করতে পারবে কি না বা যে কোন নাম নিয়ে কারো করা উচিত কিনা সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তার বিষয়। কেউ কেউ ‘ইসলাম’ পরিভাষা বাদ দিয়ে সামাজিক সুবিচার বা কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে এসব দেশের উদাহরণ দিয়ে থাকেন যা এসব দেশের বাসিন্দার বড় একটি অংশ বা ভুক্তভোগীরা মানতে রাজি নন। কেন রাজি নন তা একটু পরে কল্যাণরাষ্ট্রের আলোচনা করলে আশা করি পরিষ্কার হবে। ইসলামী সংগঠনে সবার মতামতের যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। সবাই নিজ নিজ অধিকারের জায়গা থেকে নিজের সাংগঠনিক জীবন বা অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে মতামত পেশ করেন। তবে মতামত পেশ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির অবস্থান, জ্ঞান, যোগ্যতা, পরিবেশের প্রভাব অনেক বেশি। যিনি যে পরিবেশে আছেন বা ছিলেন সে পরিবেশ চিন্তার ক্ষেত্রে, মতামত দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে প্রভাবিত করে। এটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তবে কেউ যদি মনে করে বসেন তিনি বা তার অনুসারীরাই একমাত্র সঠিক চিন্তা করছেন, অন্যরা সঠিক চিন্তা করছেন না, সেক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ উভয় শ্রেণীর ক্ষেত্রে আমার বিবেচনায় তারাই অধিকতর শুদ্ধ হবেন যারা ওহির জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিবেন। কোরআন, ঈমানদারদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি হলে তা দ্রুত সংশোধন করে নিতে বলে। আল্লাহ সূরা হুজুরাতে বলেছেন, “মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে-যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।” আমরা নিজেদেরকে যতই যোগ্য বা জ্ঞানী মনে করি না কেন, প্রকৃত জ্ঞান আল্লাহর কোরআনে, রাসূল (সা) এর সুন্নাতে। যারা আল্লাহর দ্বীনের কাজ করবেন তারা অবশ্যই পরীক্ষিত হবেন। প্রত্যেকেই তার ঈমান অনুযায়ী পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন; এখনো হচ্ছেন; ভবিষ্যতেও হবেন। সূরা আনকাবুতে আল্লাহ বলেছেন; “লোকেরা কি মনে করে রেখেছে, আমরা ঈমান এনেছি কেবলমাত্র এ কথাটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর পরীক্ষা করা হবে না? অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদের সবাইকে পরীক্ষা করে নিয়েছি। আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যুক।’ যেমন রাসূল (সা)-এর হাদিসে এসেছে- “মানুষের মাঝে সবচাইতে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে নবীদেরকে, অতঃপর সৎকর্মশীলদেরকে, এভাবে পর্যায়ক্রমে পরবর্তীদেরকে, অতঃপর তাদের পরবর্তীদেরকে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার ঈমানের আলোকে পরীক্ষা করা হবে। যদি কোন ব্যক্তির ঈমান মজবুত হয় তার পরীক্ষাও বৃদ্ধি করা হয়।” ঈমানদারের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন, তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে প্রাণ ও ধন-সম্পদ দ্বারা জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ। (সূরা হুজুরাত: ১৫) আবার আরেক শ্রেণীর পরিচয় এভাবেই দেয়া হয়েছে, “মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে আল্লাহর এবাদত করে। যদি সে কল্যাণ প্রাপ্ত হয়, তবে এবাদতের ওপর কায়েম থাকে এবং যদি কোন পরীক্ষায় পড়ে, তবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত। এটাই প্রকাশ্য ক্ষতি।” (সূরা হজ: ১১) পৃথিবীর বর্তমান বাস্তবতায় অনেকে মনে করেন যে এই সময়ে এসে ইসলামী আন্দোলন বা ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা অকার্যকর। তারা ইসলামী আন্দোলন বা ইসলামী রাষ্ট্র পরিভাষাগুলোর মাঝেই সমস্যা খুঁজে পান। কারণ পশ্চিমারা জিহাদ, হিজাব, ইত্যাদি শব্দগুলোর মত ‘ইসলামী আন্দোলন বা ইসলামী রাষ্ট্র পরিভাষাগুলোকে টার্গেট করে সন্ত্রাসবাদ বা পশ্চাৎপদতার সাথে যুক্ত করে চলেছে। তাই কেউ কেউ ইসলামী রাষ্ট্র বা ইসলামী আন্দোলন পরিভাষাগুলো ব্যবহারে রাজি নন। তারা ‘কল্যাণরাষ্ট্র’ শব্দটির প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। ইসলাম ছাড়া বাস্তবিক অর্থে মানবকল্যাণমূলক সফল কোন ব্যবস্থা যদি থাকে বা আবিষ্কার করা যায় তাহলে সেটি গ্রহণ করতে হয়ত কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু কল্যাণরাষ্ট্র পরিভাষাটি আমাদের ভায়েরা সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে ব্যবহার করছেন বা জনপ্রিয় করে তুলতে চাইছেন তা ব্যক্তিগতভাবে আমাকেও কল্যাণরাষ্ট্রের ওপর আগ্রহী করে তুলেছে। তাই সংক্ষেপে কল্যাণরাষ্ট্রের ওপর কিছু মূল্যায়ন করতে চাই। কল্যাণরাষ্ট্রের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমি জনাব ওমর চাপরার ইসলাম ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বইটিসহ অর্থনীতি ও কল্যাণরাষ্ট্র সংক্রান্ত কিছু বইও প্রবন্ধ থেকে পাওয়া মূল কথাগুলো তুলে ধরতে চাই।

কল্যাণরাষ্ট্র যে রাষ্ট্র জনগণের দৈনন্দিন ন্যূনতম চাহিদা পূরণের জন্য কল্যাণমূলক কাজ করে তাকেই বলা হয় কল্যাণরাষ্ট্র। এ ধরনের রাষ্ট্র জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করে, বেকারভাতা প্রদান করে, বিনা খরচে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, নরওয়ে ইত্যাদি কল্যাণরাষ্ট্রের উদাহরণ।


“প্রচলিত আর্থ-সামাজিক অবস্থা শুধু দরিদ্রকে দরিদ্রই রাখছে না, বরং দারিদ্র্যকে চিরস্থায়িত্ব প্রদান করেছে। খুব নগণ্য সংখ্যক লোকই ছাড়া এ সর্বগ্রাসী কৃষ্ণবৃত্ত অনেক দেশের লক্ষ-নিযুত মানবসন্তান পুঁতিগন্ধময় বস্তির অন্ধ গলিতে বন্দী হয়ে আছে। কল্যাণরাষ্ট্রের কথিত ছত্রচ্ছায়া সত্ত্বেও তাদের অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হচ্ছে।”


সরল কথায় কল্যাণরাষ্ট্রের পরিচয় এটি হলেও কল্যাণরাষ্ট্রের ব্যাপারে ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ, পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশ এর সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। তারা কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণাকে ভয়ঙ্কর পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ইত্যাদির ভিন্ন সঙ্কলন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা ও অন্যান্য মানবরচিত মতবাদের মতোই ব্যর্থ ধারণা। পুঁজিবাদের সামাজিক-ডারউইনবাদী দর্শন হতে কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণার উত্তরণ। অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে মানবতা স্বাভাবিকভাবে পুঁজিবাদ সৃষ্ট বৈষম্যকে স্বীকার করে নিতে পারেনি। তিনশত বছরের সেক্যুলার মতবাদও বস্তুত মানবসত্তার মৌলিক মূল্যবোধ ও চেতনাকে ধ্বংস করতে পারেনি। যাই হোক, কল্যাণরাষ্ট্রের লক্ষ্য মানবতাবাদ হলেও অর্জনে কার্যকর কৌশল উদ্ভাবনে এ মতাদর্শ ব্যর্থ হয়েছে। বস্তুত পুঁজিবাদী দর্শন বা বিশ্বদৃষ্টিতে কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনয়ন করেনি। এ মতাদর্শের এমন কোনো কার্যকর কর্মসূচি বা প্রেরণা নেই, যা ইনসাফ- অভিমুখী লক্ষ্যের পরিপন্থী সম্পদের অপচয়মূলক ব্যবহার রোধ করতে পারে। কল্যাণরাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় একই পুঁজিবাদী জীবনব্যবস্থা, উৎপাদন পদ্ধতি এবং প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো বজায় রাখা হয়েছে যা ধনী দরিদ্রের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টির জন্য দায়ী। অর্থনৈতিক মৌলিক পুনর্গঠন ও কোনো সামাজিক দর্শন ব্যতিরেকেই মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বাজারব্যবস্থার সৃষ্ট বৈষম্যসমূহ সরকারের সক্রিয় ভূমিকা দ্বারা অপসারণ করা সম্ভব হবে- এ মর্মে যে ধারণা পোষণ করা হয়েছিল তা এক কল্পনাবিলাসের পর্যবসিত হয়েছে। “প্রচলিত আর্থ-সামাজিক অবস্থা শুধু দরিদ্রকে দরিদ্রই রাখছে না, বরং দারিদ্র্যকে চিরস্থায়িত্ব প্রদান করেছে। খুব নগণ্য সংখ্যক লোকই ছাড়া এ সর্বগ্রাসী কৃষ্ণবৃত্ত অনেক দেশের লক্ষ-নিযুত মানবসন্তান পুঁতিগন্ধময় বস্তির অন্ধ গলিতে বন্দী হয়ে আছে। কল্যাণরাষ্ট্রের কথিত ছত্রচ্ছায়া সত্ত্বেও তাদের অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হচ্ছে।” বর্তমান বিরাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, কল্যাণরাষ্ট্র সম্পদের দক্ষ ও সুষম বিলিবণ্টনে ব্যর্থ হয়েছে। তা সত্ত্বেও যুক্তি দেখানো হয় যে, যদি কল্যাণরাষ্ট্রের আবির্ভাব না হতো তবে নিয়ন্ত্রণহীন বাজারব্যবস্থা সামাজিক বৈষম্যকে আরো তীব্রতর করে তুলত। এ কথা স্বীকার করে নিলেও কল্যাণরাষ্ট্রকে তার বহুল স্বীকৃত ব্যর্থতার দায়ভার হতে অব্যাহতি দেয়া যায় না। কল্যাণরাষ্ট্রের কল্যাণকর সমাজের স্বপড়ব অপূর্ণ থেকে গেলেও তার সকল কর্মসূচিই নিঃশেষিত হয়ে গেছে। শক্তিশালী কায়েমি স্বার্থবাদী মহল জাতীয় স্বার্থের নামে প্রতিরক্ষা ও তাদের স্বার্থের অনুকূল অন্যান্য খাতে ব্যয় হ্রাসে বাধা প্রদান করে। ফলে বেকার ভাতা, ন্যূনতম মজুরি, চিকিৎসা ভাতা ও অন্যান্য কল্যাণসুবিধার মতো বহু সংখ্যক সামাজিক নীতি পুনর্বিবেচনার সম্মুখীন হয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতির এ দ্বন্দ্ব কল্যাণরাষ্ট্রকে সঙ্কটে নিক্ষেপ করেছে। কল্যাণরাষ্ট্র কাজ করে নৈতিক মূল্যবোধের বগ্লাহীন পুঁজিবাদী কাঠামোর আওতায়, যেখানে সামাজিক প্রয়োজন পূরণের অগ্রাধিকার নির্ণয়ের কোনো নৈতিক ঐকমত্যভিত্তিক পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া নেই। কল্যাণরাষ্ট্রের অনেক সমালোচকের মতে কল্যাণরাষ্ট্র হচ্ছে, ‘শাসকশ্রেণীর কাছ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমানুষের কাছে ক্ষমতার হাত বদল না ঘটিয়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে একটি সামাজিক ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি। পুঁজিবাদী সমাজের বিত্তশালী, ক্ষমতাশালী শ্রেণীও সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রার মুখে বিকল্প হিসেবে কল্যাণরাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাকে সমর্থন করে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে কল্যাণরাষ্ট্র যখন রাজস্ব সঙ্কটের মুখে পড়ল, তখন ব্যবসায়ী শ্রেণী রক্ষণশীল সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে বিধিবিধান শিথিলকরণের পক্ষে আওয়াজ তুলল। রাজনৈতিক হাওয়া বদলের চাপে আইনকানুন যা-ই প্রবর্তন করা হোক না কেন, সময় ও ভিন্ন পরিস্থিতিতে ক্রমশ তা তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। কল্যাণরাষ্ট্রের রাজনীতির অপর অঙ্গ প্রগতিশীল করব্যবস্থাও অধিকতর কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারেনি। বরং তা জনগণের জন্য মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে যেহেতু কল্যাণরাষ্ট্র মনে করা হয় তার ওপর ছোট্ট এতটি নজর দেয়া যাক। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৮ সালে দারিদ্র্য রেখার নিচে জনসংখ্যা ছিল ১১.৪%, যা ১৯৮৬ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৩.৬%।


আল্লাহর কোরআনে যদি অসত্য কোন বিধান না থাকে তা হলে আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহ বিজয় দেবেনই তবে শর্ত হলো আমরা ঈমানদার হিসাবে টিকে থাকি। পশ্চিমাদের দেখানো সাময়িক চোখধাঁধানো চমক লাগানো মানবগড়া নিজ দেশেই ব্যর্থ, পঁচা, দুর্গন্ধময় শাসনপদ্ধতিকে ছুড়ে ফেলে দিই


বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির শিকার আমেরিকার আর্থসামাজিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছে। ২০০৭ থেকে আবার শুরু হওয়া দারিদ্র্যের হার শুধু বাড়ছেই। ২০০৯ সাল থেকে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার বাড়ে ১%। কিন্তু পরের বছরগুলোতে তা সামষ্টিকভাবে ১৫.১% হারে বেড়েছে। ধনী দরিদ্রের মাঝে আয়ের ব্যবধানও বৃদ্ধি পেয়েছে। খোদ আমেরিকার যখন এই অবস্থা তখন বাকিদের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুইডেনের মতো দেশ যেখানে জনগণের কল্যাণমুখী সেবার জন্য অধিকতর সুনাম রয়েছে, সেখানে উচ্চমাত্রার ট্যাক্স ও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির দরুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এটা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে, অতিরিক্ত মাত্রার ট্যাক্স জনগণের কর্মসংস্থান, সঞ্চয় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করে। অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় সুইডেনে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার দ্বিগুণ। সুইডিস ক্রোনারের বিপুল অবমূল্যায়ন সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাজারে সুইডেনের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। কল্যাণরাষ্ট্রের দর্শন সম্পর্কে একই ধরনের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন পিয়িট থিয়োনেস, ‘কল্যাণরাষ্ট্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কারো পক্ষে সম্পূর্ণ ও যথার্থভাবে এর প্রচার প্রচারণায় লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। কেননা একজন সমাজতন্ত্রীর কাছে কল্যাণরাষ্ট্র অর্ধসমাজতন্ত্র ব্যতীত আর কিছু নয়। আবার লিবারেলদের নিকটও এটি অর্ধ-লিবারেলিজম মাত্র’। সিডনি হুকের মন্তব্য হচ্ছে, ‘কল্যাণরাষ্ট্রের পশ্চাতে যে সামাজিক দর্শন তা অপরিণত ও অস্পষ্ট।’ বেরিংটনের ভাষায়, কল্যাণরাষ্ট্রের প্রবক্তাগণ এমনকি মৌলিক প্রশ্নগুলোরও অসম্পূর্ণ ও নেতিবাচক জবাব ছাড়া অন্য কিছু দিতে সক্ষম নয়।

ইসলামী রাষ্ট্র নাকি কল্যাণরাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া একালের সব চাইতে বড় প্রয়োজন। কারণ মানবরচিত যত মত ও পথ আবিষ্কৃত হয়েছে তা ইতোমধ্যে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা নিজেদের রচিত একটি মতাদর্শ ব্যর্থ হলে নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে; শয়তানের পরামর্শে আরেকটি বিকল্প উপস্থাপন করছে। পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা ঢাকতেই কল্যাণরাষ্ট্রের নাম দিয়ে শোষণের আরেকটি হাতিয়ার তৈরি করতে চেয়েছে পশ্চিমারা। কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা নিজেদের দেশে ব্যর্থ হলেও হাল জামানায় কেউ কেউ মানবসেবার নামে পশ্চিমাদের ব্যর্থ পণ্যের বাজার জাতকরণে উঠে পড়ে লেগেছেন। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান, আল্লাহর পথে সম্পদ ও জীবন দিয়ে জেহাদ করাকেই আল্লাহ উত্তম ব্যবসা বলেছেন। কারো ঈমানের দুর্বলতার কারণে সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনবিধান ইসলামকে অকার্যকর মনে করা বা পশ্চিমাদের ব্যর্থ নীতি আদর্শকে মুক্তির উপায় মনে করলে তিনি খুবই বুদ্ধিমান বা বড় নেতা হয়ে যাবেন না। আল্লাহর কোরআন ও রাসূলের দেখানো পদ্ধতিতেই শুধু মুক্তি পাওয়া যাবে।

ইসলামী রাষ্ট্রের কেন প্রয়োজন? মুসলমানরা যদি মুসলমান হিসেবে জীবনযাপন করতে চায়, তবে তাদের নিজেদের গোটা জীবনকে আল্লাহর আনুগত্যের অধীন করে দিতে হবে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের সকল বিষয়ের ফয়সালা কেবলমাত্র আল্লাহর আইন ও শরিয়াহ মোতাবেক করতে হবে, এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। কেউ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি ঈমান পোষণ করার ঘোষণা করবেন আর জীবনের সামগ্রিক বিষয়াদি পরিচালনা করবেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদের আইন অনুযায়ী, ইসলাম কোনো অবস্থাতেই এমনটি বরদাশত করতে প্রস্তুত নয়। এর চাইতে বড় স্ববিরোধিতা আর কিছু হতে পারে না। এই স্ববিরোধিতাকে বরদাশত করার জন্য নয়, নির্মূল করার জন্য ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে। আমরা যে ইসলামী রাষ্ট্র ও শাসনতন্ত্র দাবি করছি, তার পেছনে এই অনুভূতিই কাজ করছে যে, মুসলমান যদি আল্লাহর আইনই মেনে না চলে, তবে তো তার মুসলমান হওয়ার দাবিই সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহর কোরআনে যদি অসত্য কোন বিধান না থাকে তা হলে আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহ বিজয় দেবেনই তবে শর্ত হলো আমরা ঈমানদার হিসাবে টিকে থাকি। পশ্চিমাদের দেখানো সাময়িক চোখধাঁধানো চমক লাগানো মানবগড়া নিজ দেশেই ব্যথর্, পঁচা, দুর্গন্ধময় শাসনপদ্ধতিকে ছুড়ে ফেলে দিই। যে আন্দোলনের নেতারা শাহাদাতের আশায় ফাঁসির রজ্জুকে হাসিমুখে গলায় পেঁচিয়ে নেন তাদের উত্তরসূরিদের জন্য নতুন পদ্ধতি আমদানি অপ্রয়োজনীয় মনে করি। আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট।

তথ্যসূত্র ১. ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ২. ইসলাম ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ , ড এম ওমর চাপরা ৩. বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ৪. রাজনীতিতে বঙ্গীয় ওলামার ভূমিকা, ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ

লেখক: পিএইচডি গবেষক, আংকারা ইউনিভার্সিটি, তুরস্ক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির