post

করোনা: বাংলাদেশ ও বাড়তি কিছু কথা

এবনে গোলাম সামাদ

০৯ এপ্রিল ২০২০

চীনা সভ্যতা বহু প্রাচীন, যাকে আমরা শ্রদ্ধা করি। সেই চীন থেকেই বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে, যাতে কোটি মানুষ আক্রান্ত ও ইতোমধ্যে মারাও গেছেন দুই লক্ষাধিক মানুষ। করোনাভাইরাস মানুষের দেহে উৎপন্ন করে ভয়াবহ ফুসফুসের ব্যাধি। সৃষ্টি হয় ফুসফুসের এক বিশেষ ধরনের নিউমোনিয়া। মাও যে ডং কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চীনের দ্বারা নির্মিত হয়েছে ভয়াবহ জীবনমারণাস্ত্র। চীনের একদলীয় কমিউনিস্ট সরকারের নেতৃত্বে যা ঘটছে তা ভয়াবহ। চীন যদি গণতন্ত্রী হতো, তবে মনে হয় এরকম কাণ্ড ঘটতে পারত না। করোনাভাইরাস ছিল বাদুড়ের পেটে। সেখান থেকে তা ছড়ায় ভাম বিড়াল বা খাটাশে (Pangolin)। করোনাভাইরাস পিপীলিকাভুকের (Viverra civetta) মাধ্যমে ছড়িয়েছে মানুষের দেহে। আর সেখান থেকে এখন তা ছড়াচ্ছে চারিদিকে। আমাদের দেশে যথেষ্ট সংখ্যক বাদুড় গাছে ঝুলতে দেখা যায়। বাদুড়ের দেহ থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায় মানুষের দেহে। জন্তুটি থেকে এসেছে মানুষের দেহে। পিপীলিকাভুক থেকেও নাকি এসেছে মানুষের দেহে। করোনাভাইরাস ওসব জন্তুর দেহে তেমন ক্ষতি করে না। কিন্তু মানুষের দেহে উৎপন্ন করে ভয়াবহ ফুসফুসের ব্যাধি। সৃষ্টি হয় ফুসফুসের এক বিশেষ ধরনের নিউমোনিয়া। শ্বাস- প্রশ্বাসের বাতাসের সঙ্গেও নাকি ছড়াতে পারে। করোনার জন্য মানুষ বাইরে কাজ করতে পারছে না। ফলে সব কিছুরই উৎপাদন মাত্রা হ্রাসপ্রাপ্ত হবে। যেমন আমাদের দেশে এখন কৃষকরা চৈতালি ফসল তুলতে যাচ্ছে। অর্থনীতির দুটো দিক আছে। সরবরাহ ও চাহিদা। সরবরাহ কমে গেলে জিনিসের দাম বাড়ে। করোনার কারণে উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ কমে যাবে। সুতরাং দ্রব্যমূল্য বাড়বে। এর মধ্যে যদি মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানো হয়, তবে দ্রব্যমূল্য আরও দ্রুত বৃদ্ধি না পেয়েই পারে না। এসব সাধারণ কথা বলতে হচ্ছে কারণ কেউ কেউ বলছেন, কাগুজে মুদ্রা বানিয়ে বর্তমানে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার একটা সমাধান করা যাবে। কিন্তু যেহেতু দ্রব্য সরবরাহ কমছে, তাই মুদ্রা সরবরাহের সাধারণ অর্থ দাঁড়াবে চাহিদা বাড়ানো। যার ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হবে। অনেকে এই অবস্থা কাটিয়ে নেয়ার জন্যে বলছেন বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে। এক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ ধারণা খাপ খাচ্ছে না। মুদ্রা সরবরাহ মানে অর্থনীতি সংকট আরও কঠিন হয়ে উঠবে। ব্রিটিশ শাসন আমলে একবার প্রাকৃতিক কারণে ধানের উৎপাদন কম হওয়ায় চালের সরবরাহ কমে। অন্য দিকে সে সময় চলছিল গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে জাপানের যুদ্ধ। যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করার জন্য ছাপানো হয়েছিল টাকা। ফল ১৩৫০ সালে সৃষ্টি হতে পেরেছিল এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। করোনার কারণে নিশ্চিতভাবেই ধানের উৎপাদন কমবে। আর এর ফলে ঘটবে অন্নাভাব। করোনার কারণে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হারাচ্ছে তাদের সাধারণ কর্মশক্তি। পত্র-পত্রিকায় করোনার প্রভাবে কত ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে যাচ্ছে তার সম্ভাব্যতার কথা বলা হচ্ছে। সেটা একটা বিরাট অংক। আমাদের দেশের অন্যতম প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ. মনসুর সাহেব বলছেন যে, চীনের করোনাভাইরাস সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভয়ানক বিপর্যয় বাড়বে। তার মতে, বাংলাদেশ সরকারের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে চীনের বিকল্প নেই। আবার চীন থেকে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এসব পণ্যের দাম বাড়বে। যাতে সরকারের রাজস্ব আয়ে বড় প্রভাব পড়বে। ঘাটতি বাড়বে। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে। কারণ এই খাতের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির প্রধান উৎস চীন। আর চীনের মতো এত সস্তায় আমাদের কেউ এত পণ্য সরবরাহ করতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, প্রয়োজন হলে দেশীয় কৃষকদের প্রণোদনা দিয়ে আদা ও রসুন চাষাবাদের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের কাছে প্রশ্ন হলো, চীনের নিজের অর্থনীতিও করোনার কারণে ভেঙে পড়তে চলেছে। চীন কি আমাদের আগের মতো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারবে? করোনাভাইরাস এখন হয়ে উঠেছে সংবাদপত্র জুড়ে আলোচ্য বিষয়। কিন্তু নিজের তৈরি করোনাভাইরাসের জন্য চীন এখন নিজের হাতে নিজের গালেই খেতে যাচ্ছে চড়। ইতোমধ্যেই চীনের নিজের মাতৃভূমে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪২০ বিলিয়ন ডলারের উপর। চীনের মানুষ বর্তমান চীন সরকারের অধীনে হতে যাচ্ছে ভয়াবহ অত্যাচারের শিকার। তাদের কোন স্বাধীন সত্তা নাই। বিশ্ব বিবেক জাগো। প্রয়োজনে গঠন করো আন্তর্জাতিক ব্রিগেড, চীনকে ঘিরে ফেলো। আমরা চীনকে ভালোবাসি আর চীন নিজের হাতেই বিপদগ্রস্ত হলো। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, তাদের হাতে আরো মারাত্মক অস্ত্র আছে। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় অধ্যাপনা করেছি। দীর্ঘদিন ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করতে হয়েছে। আমার ডিএসসি থিসিস ছিল ভাইরাস সংক্রান্ত। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আমি তাই বলব অতটা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেনি। যতটা বলা হচ্ছে। একজন গ্রামীণ কৃষক আমাকে এসে বললেন, আমরা হাত-পা নেড়ে খাই। এভাবে গৃহবন্দী হয়ে থাকলে আমরা মরব অনাহারে। জীবাণু বোমা তৈরি হচ্ছে করোনাভাইরাসের মত ভাইরাস দিয়ে। যা ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। কিন্তু করোনার পাশাপাশি আরেকটা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। একটা পাইট-খাটা লোক (যে দিন আনে দিন খায়) সে দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকলে কী করে খাবে? তার তো কোন আয় নেই। কৃষক মাঠে কাজ করতে পারছে না। তাই এদিক দিয়ে চৈতালি ফসলের ক্ষতি হতে যাচ্ছে। কৃষক বাঁচবে কী করে? করোনা সৃষ্ট এসব সঙ্কট মোকাবিলায় যথোপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আর বিশ্বাস রাখতে হবে, দুঃসময় স্থায়ী নয়, সুসময় আসবেই।

কোয়ারেন্টিন ও সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে কিছু কথা: ইতালিতে ফ্রাকাস্ত্রো নামে একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ১৫৪৬ সালে প্রথম কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। ষষ্ঠ শতাব্দীর পর থেকে কালো প্লেগের মড়ক বহুবার ইউরোপের দেশগুলোতে ছড়ায়। এ থেকে বাস্তব শিক্ষা গ্রহণ করে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইতালি ও তারপর অন্যান্য দেশে ৪০ দিনব্যাপী কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা অর্থাৎ প্লেগ আক্রান্ত দেশ থেকে জাহাজ এলে সে জাহাজকে আলাদা করে ৪০ দিনের জন্য আটক রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। বিখ্যাত ইতালীয় চিকিৎসক ফ্রাকাস্ত্রো সর্বপ্রথম দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলেন যে, সংক্রামক ব্যাধির উৎপত্তি রোগ-জীবাণু থেকে ১৫৪৬ সালে প্রকাশিত ‘De contagione et contagiosis morbis Curatione’ নামক পুস্তকে তিনি সংক্রামক রোগের সঙ্গে পচন্ত ফলের তুলনা করে বলেন যে, পচে যাওয়া ফলের মতোই মানুষের দেহেও রোগ-জীবাণু জন্মায়, যারা বংশবৃদ্ধি করে মানুষের দেহে ব্যাধির সৃষ্টি করে। এডওয়ার্ড জেনার (Edward Jenner, 1749-1823) গো-বসন্তের ভাইরাস থেকে মানুষের গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার করেন। যা গুটি বসন্ত নিয়ন্ত্রণে বিরাট অবদান রাখে। শোনা যাচ্ছে, কতকটা একই রকমভাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কার হতে যাচ্ছে। ফরাসি দেশে বিখ্যাত জীবাণুবিদ লুই পাস্তুর (Louis Pasteur, 1822-1895) তাঁর গবেষণার মাধ্যমে রোগ-জীবাণুতত্ত¡ অর্থাৎ জীবাণু দ্বারা যে আমাদের দেহে অনেক রোগ সৃষ্টি হয়, তা প্রমাণ করতে পারেন। আরম্ভ হয় মানব দেহে রোগ-জীবাণু ধ্বংস করে রোগ নিরাময় প্রথা। রোগ-জীবাণুরা খুব ছোট। দেখবার জন্য প্রয়োজন হয় মাইক্রোসকোপের। ভাইরাসরা খুবই ছোট হয়। একমাত্র গুটি বসন্তের ভাইরাস ছাড়া আর কোন ভাইরাসকে সাধারণ মাইক্রোসকোপের সাহায্যে দেখা যায় না। ভাইরাসদের দেখতে হলে প্রয়োজন হয় ইলেকট্রন মাইক্রোসকোপের, যা জার্মানিতে আবিষ্কার করেন ১৯৪০ সালে E. Ruska Ges H. Mahl। ইলেকট্রন মাইক্রোসকোপের সাহায্যে ফটো তুলে বিভিন্ন ভাইরাস সম্পর্কে অনেক কথা জ্ঞাত হওয়া সম্ভব হয়েছে। বিষয়টি আর আগের মতো রহস্য ঘেরা হয়ে নেই। প্রত্যেকটি সংক্রামক ব্যাধির শুধু যে বিশেষ বিশেষ উপসর্গ আছে, তাই নয়, তাদের রোগ বিস্তারের পদ্ধতিও বিভিন্ন। আর রোগ বিস্তারের পদ্ধতি হিসেবে মানুষের সংক্রামক ব্যাধিগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে পড়ে, যে সমস্ত রোগ সংক্রমিত হয় মলের সাহায্যে ও আক্রমণ করে মানুষের ক্ষুদ্রান্ত্র বা বৃহদান্ত্রে, সেগুলো। রোগীর মলের সাথে বেরিয়ে এসে জীবাণুগুলো মাটি ও পানি দূষিত করে। তারপর অপরিষ্কার হাত ও মাছির সাহায্যে দূষিত হয় খাদ্য। সেই দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে বা অপরিষ্কার হাতের সাহায্যে মুখ-গহ্বরের মাধ্যমে রোগের জীবাণু মানুষের অন্ত্রে প্রবেশ করে রোগের সৃষ্টি করে। যেমন: আমাশয় (অ্যামিবিক, ব্যাক্টেরিয়াল ও ভাইরাল), টাইফয়েড, কলেরা, পলিও এপিডেমিক হেপাটাইটিস প্রভৃতি। কতগুলো রোগ বায়ুর সাহায্যে ছড়িয়ে পড়ে। হাঁচি, কাশি ও কথাবার্তার মধ্য দিয়ে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস নালীর আবরণী থেকে নির্গত হয় অসংখ্য জীবাণুবাহী শ্লেষ্মারেণু। এই রোগের জীবাণুবাহী শ্লেষ্মারেণু নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের দেহে প্রবেশ করে রোগের সৃষ্টি করে। যেমন হতে পারছে করোনাভাইরাস, যার আক্রমণে ঘটছে বিশেষ ধরনের নিউমোনিয়া। যেহেতু এই রোগের জীবাণু প্রধানত মানবদেহে প্রবিষ্ট হচ্ছে নাসিকা পথে, তাই আমাদের উচিত হবে নাসিকায় খাঁটি সরিষার তেল গ্রহণ করা। সরিষার তেলে থাকে ইউরাসিক এসিড। এই এসিড অনেক ভাইরাসকেই দুর্বল করে। যেমন: সর্দি-কাশির সাধারণ ভাইরাসকে দূর করে এই এসিড। আমাদের সাধারণ সর্দি-কাশি হয় যেসব ভাইরাসের আক্রমণে, করোনাভাইরাস তাদের সমগোত্রেই পড়ে। তৃতীয় বিভাগে পড়ে সেই সমস্ত রোগ, যেগুলো সংক্রমিত হয় মানুষের দেহের বাইরের আবরণী চামড়া ও শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির মধ্য দিয়ে। চামড়া ও শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির উপর বংশবৃদ্ধি করে রোগের জীবাণুগুলো রোগের সৃষ্টি করে। যেমন চোখ ওঠা, ট্রাকোমা, গনোরিয়া, সিফিলিস ইত্যাদি। চতুর্থ বিভাগে পড়ে যেসব রোগ জীবন্ত রক্তশোষক গ্রন্থিপদীদের সাহায্যে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়, সেগুলো। এই রোগের জীবাণুগুলো মানুষের দেহ থেকে কখনও আপনা আপনি নির্গত হয় না। তারা প্রবাহিত হতে থাকে মানুষের রক্ত ও লিম্ফপ্রবাহে। তারপর মানুষের দেহ থেকে শোষিত রক্তের মাধ্যমে তারা প্রবেশ করে কিট বা এঁটুলির দেহে। সেখানে তারা বংশবৃদ্ধি করে ও সেই কিট বা এঁটুলি রোগের বাহকে পরিণত হয়। যেমন প্লেগের ব্যাকটেরিয়া, পীতজ্বরের ভাইরাস প্রভৃতি।

লেখক : বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির