post

বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের সন্ত্রাসনীতি অপরিবর্তিত

১১ মার্চ ২০১২
সাদেক খান ২০১২ সাল ২৪ মার্চ তারিখের সংবাদপত্রে স্বাধীনতা দিবসের দু’দিন আগে একটি মফস্বল সংবাদ : সীমান্তে এক বাংলাদেশীকে আবার নিয়ে গেছে বিএসএফ। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার পানবাড়ী সীমান্ত থেকে আবদুল গফুর (৪৫) নামে এক বাংলাদেশীকে ধরে নিয়ে গেছে ভারতের সীমান্তরক্ষীবাহিনী বিএসএফ। ২৩ মার্চ বাংলাদেশে প্রবেশের সময় পানবাড়ী সীমান্তের ৮১৫ নম্বর মেইন পিলারের কাছে ভারতীয় অংশ থেকে বিএসএফ তাকে ধরে নিয়ে যায়। আবদুল গফুর উপজেলার কুচলীবাড়ী ইউনিয়নের নিমর উদ্দিন ফকিরের ছেলে। গফুরের পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে প্রকাশ, ৮ মার্চ ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি এলাকায় এক আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যান গফুর। ২৩ মার্চ ভোরে বাংলাদেশে ফেরার সময় ১২৭ ভোটবাড়ী ডাঙ্গারহাট এলাকার ১৭ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের বাগডোগরা ক্যাম্পের টহলরত সদস্যরা ওই স্থান থেকে গফুরকে ধরে নিয়ে যায়। গফুরের স্ত্রী আকলিমা বেগম (৪০) বলেন, গফুর ভারতের এক দালালকে টাকা দিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যান। সেখানে কয়েক দিন থাকার পর ২৩ মার্চ বাড়ি ফেরার পথে বিএসএফের সদস্যরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। আব্দুল গফুর কৃষিজীবী গৃহস্থ। প্রত্যন্ত যে এলাকায় তার বসবাস সেখানে চোরাচালানের কোনো তাগিদ বা সুযোগ নেই। অজপাড়াগাঁয়ে আম-কাঁঠাল মাছ-ভাত দুধ-কলা খেয়ে সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত সেখানে সীমান্তের দুই পারেরই স্বল্পবিত্ত মানুষ। কোনো অপরাধবৃত্তের সঙ্গে আব্দুল গফুরের কোনো সংশ্লিষ্টতার কোনো কারণ বা সুযোগ নেই। এলাকাবাসী তাকে সজ্জন বলেই জানেন। সীমান্তের দুই পারেরই এলাকাবাসীর মধ্যে বিবাহবন্ধন আত্মীয়তা রয়েছে। দুই দিকের এলাকাবাসী সামাজিকতার তাগিদ মেটান বিএসএফের কৃপায়; অনিয়মিত কিছু সেলামি দিয়ে সীমান্ত পারাপারের রেওয়াজ কাঁটাতারের বেড়ার প্রহরী বিএসএফ-ই চালু করেছে। মুস্কিল হলো, বিএসএফ-এর সিপাই বদলি হয়, কমান্ডার বদলি হয়। নতুন লোক এলেই নতুন করে উপরি-আদায়ের পাঁয়তারা শুরু হয়, আর যতই দিন যাচ্ছে বিএসএফ-এর সেলামির চাহিদা বেড়েই চলেছে। এলাকাবাসীর ধারণা, দালালের কাছ থেকে খবর জেনেই বিএসএফ-এর টহল আব্দুল গফুরকে আটক করেছে অতিরিক্ত খেসারত আদায়ের জন্য। আর ঐ অনিয়মিত ‘জরিমানা’ না দিতে পারলে বিএসএফ আব্দুল গফুরকে মারধর করে ঠ্যাং ভেঙে দিয়ে সীমান্তের এপারে ফেলে যাবে ‘অবাধ্যতা’র বিচারবহির্ভূত শাস্তির দৃষ্টান্ত হিসেবে। বিএসএফ-এর সেলামির বাড়তি দাবি না মেটাতে পারলে শুধু সীমান্ত পারাপার বন্ধ করা নয়, সীমান্তের এপারের নোম্যানস ল্যান্ড বা গ্রাম থেকেও একা-পাওয়া বাংলাদেশীকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে পিটিয়ে আধমরা বা লাশ করে ফেরত দেয়া বা ফেলে দেয়া হচ্ছে। আর দস্তুরমাফিক সেলামি পেলে চোরাচালান মাদকচালান অস্ত্রচালান দুর্ধর্ষ অপরাধীদের বাংলাদেশে পুশ্-ইন সমানে চালিয়ে যেতে দিচ্ছে ভারতীয় সীমান্ত-রক্ষীরা। অথচ আবার বাংলাদেশী আটকের উক্ত ঘটনার পাঁচদিন আগে সপ্তাহের শুরুতে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবি-প্রধানের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে বিএসএফ প্রধান ইউকে বানসাল ঘোষণা করলেন : বাংলাদেশের নিরপরাধ সীমান্তবাসীদের যাতে হয়রানি-নির্যাতন না করা হয় সে জন্য বিশেষ নির্দেশ তিনি প্রেরণ করেছেন, আইন মেনে সীমান্তে অবাধ চলাফেরার নাগরিক অধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার একটা ত্রিমুখী কর্মসূচি উভয়পক্ষ গ্রহণ করেছে। ঐ সংবাদ সম্মেলন থেকেই অবশ্য বোঝা গেল, বাংলাদেশের স্থলসীমান্তে ভারতশক্তি আরোপিত ‘বধ্যভূমি’-র সন্ত্রাস, নির্যাতন আর হত্যাকাণ্ড থেকে সহসা মুক্তির কোনো লক্ষণ নেই। দ্বিচারণপটু ভারতীয় শীর্ষ নেতৃত্ব একমুখ দিয়ে তিন বছর ধরেই বারবার বলছে, সীমান্তে নির্বিচার গুলিচালনা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্য মুখ দিয়ে ভারতীয় সীমান্ত প্রহরায় সরেজমিনে নিয়োজিত বিএসএফ-এর প্রধান ইউ কে বানসালকে দিয়ে বলিয়েছে, বাংলাদেশ সীমান্তে অপরাধ তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে গুলিচালনা বন্ধ করা যাবে না। অজুহাত : “পূর্ব সীমান্তে (বাংলাদেশ) পরিস্থিতিটাই ব্যতিক্রমী। একই বিএসএফ সদস্য পাকিস্তান সীমান্তে অনেক দিন কাজ করেও গুলি চালান না। কিন্তু যখন তিনি বাংলাদেশ সীমান্তে আসেন, তখন তাকে গুলি চালাতে হয় বা বলপ্রয়োগ করতে হয়। পরিস্থিতির জন্যই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। গুলি চালনা পুরোপুরি বন্ধ করা কখনোই সম্ভব নয়; যতক্ষণ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অপরাধমূলক কাজ হতে থাকবে, ততক্ষণ সেই অপরাধ আটকাতেই হবে বিএসএফকে। সেটিই বাহিনীর দায়িত্ব।’ (বিবিসির সঙ্গে বানসালের সাক্ষাৎকার, ৯ ফেব্র“য়ারি ২০১২) বাংলাদেশের নিরস্ত্র সীমান্তবাসীরা কাঁটাতারের কাছ দিয়ে যাওয়া-আসা করলে সন্দেহভাজনদের আটক বা ধাওয়া না করে দেখামাত্র গুলি করা হয় কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বিকার চিত্তে বানসাল বলেছেন, ‘রাতে সীমান্তে ১৪৪ ধারা অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকে এবং কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির সেই সময়ে সীমান্ত পেরোনোর কথা নয়। ওই সময় যদি কাউকে সীমান্ত পেরোতে দেখা যায়, তাহলে ধরেই নেয়া হবে যে তিনি অপরাধমূলক কাজ অথবা দেশদ্রোহী কোনো কাজ করতে গেছেন। তখনই বিএসএফের দায়িত্ব এসে যায়। বাহিনীর সদস্যরা সেই দায়িত্বটাই পালন করছে।’ বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লি গেছেন, আবারও ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাস সম্বল করে ঢাকায় ফিরেছেন। ভারত সরকার সীমান্তে নির্বিচার গুলি চালনা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, এ কথায় তিনি আস্থা ও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কার্যত সীমান্তসন্ত্রাস বন্ধ হয়নি। গুলিচালনার রাশ কিছুটা টেনে ধরা হয়ে থাকলেও বাংলাদেশী অপহরণ, নির্যাতন, পিটিয়ে হত্যা আর লাশ ফেলে যাওয়া সমানে চলেছে। এই প্রেক্ষিতে বিএসএফ-বিজিবি প্রধান পর্যায়ে দিল্লিতে ১৬ থেকে ১৯ মার্চ দ্বিপাক্ষিক সীমান্ত বৈঠকে অন্তত নীতিগতভাবে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড বাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন যে কিছু শক্ত ‘আপত্তি’ ভারতকে গেলাতে পেরেছেন, সেটা সুখের কথা। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ ও ভারতের নোম্যানস ল্যান্ডসহ ভারতের অভ্যন্তরের সীমান্ত এলাকায় রাতের বেলা কারফিউ জারির প্রস্তাব বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছে। কারফিউ জারি করে অস্বাভাবিক অবস্থা আর ত্রাস সৃষ্টি না করে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারীদের অপরাধ-বিষয়ে সচেতন করে তোলার ওপর জোর দিয়েছে ঢাকা। বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা কারফিউতে বিশ্বাস করি না। আমরা মনে করি, সীমান্তে বসবাসকারীদের স্ব স্ব দেশের ভূমিতে অবাধ চলাফেরার অধিকার রয়েছে। কারফিউ একটি সাময়িক ব্যবস্থামাত্র। এর মধ্য দিয়ে সমস্যার স্থায়ী সমাধান আসবে না।’ বিজিবি প্রধান আরও বলেন, (‘সীমান্তসহ) স্বদেশে অবাধ চলাফেরার ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার থাকলেও সীমান্ত এলাকায় চলাফেরার ক্ষেত্রে (সাবধানতার জন্য) এবং বৈধ কাগজপত্র ছাড়া সীমান্ত অতিক্রম না করার জন্য আমরা জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করব। গত ফেব্র“য়ারিতে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের মধ্যে বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিয়ে গত চার দিনের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে এবং আমরা বিভিন্ন সমঝোতায় পৌঁছেছি। স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েনে সম্মত হয়েছে উভয় পক্ষ। এ ছাড়া অবৈধ অনুপ্রবেশের ঝুঁকি সম্পর্কে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের সচেতন করা এবং রাতের বেলা সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানি ও অন্যান্য অপরাধীদের চলাচলের বিষয়ে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য আদান-প্রদান করা হবে। দুই দেশের সীমান্তের ২৩টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্থানে অপরাধ দমনে যৌথ টহল জোরদারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যু এড়াতেও দু’পক্ষ একমত হয়েছে।’ কিন্তু গুলি চালনা বন্ধের প্রশ্নে বিএসএফ প্রধান ইউ কে বানসাল তার বিবিসিতে প্রচারিত অবস্থানেই একরকম অনড় রয়েছেন বলতে হবে। অগ্রগতি এইটুকু যে তিনি ক্রমান্বয়ে গুলিচালনার অভ্যাস কমিয়ে আনতে রাজি হয়েছেন। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে সীমান্তে বিএসএফের নির্যাতনের বিষয়ে কথা তুলে মেজর জেনারেল আনোয়ার বলেছেন, ‘সীমান্তে হত্যার বিষয়ে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। আমরা মনে করি, সীমান্তে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের উভয় পক্ষের। সীমান্তে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার বিষয়টি আমরা প্রত্যাশা করি না।’ জবাবে বানসাল বলেছেন, ‘নিরস্ত্র মানুষ ও ভুলবশত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ওপর আমরা অস্ত্রের ব্যবহার করব না।’ বৈঠক শেষে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন ও বিএসএফের প্রধান ইউ কে বানসাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘সীমান্তে মারণাস্ত্রের ব্যবহার আরও কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে আমরা সম্মত। সীমান্তে গুলি চালনার মাত্রা আরো নিচে নামিয়ে আনতে একটি ত্রিমুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষীবাহিনী।’ তথা, সীমান্তে অস্ত্রের ব্যবহার কমাতে দিল্লির আশ্বাসনির্ভর নাক-কান দিয়ে তার বদলে কাগুজে মতৈক্যের নরুন পেলাম আমরা। লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির