post

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা

আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন

০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাংলা আমাদের মুখের ভাষা, দেশের ভাষা। এটি আমাদের মায়ের মুখ থেকে শেখা ভাষা বলে আমরা একে মাতৃভাষা বলে থাকি। যে যেই দেশের নাগরিক তার জন্য সেই দেশের ভাষাটি মাতৃভাষা। কাগজে কলমে আমাদের ভাষার নাম বাংলাভাষা। এ ভাষা কালক্রমে মায়েদের কোল থেকে শেখা ভাষা। এ জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়নি, কোনো অক্ষরজ্ঞান থাকতে হয় না। প্রত্যেক শিশুই আপনা আপনি এ ভাষা শিখে ফেলে।

হাদিস শরিফে আছে “কুল্লু মাউলুন ইউলাদু আলাল ফিতরাত” প্রত্যেক শিশু ফিতরাত বা স্বাভাবিক জীবন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারপর তাকে যে জ্ঞান যে ভাষা যে ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হয় সে তাই শিখে। যে পরিবারের শিশুকে কোনো ধর্মই শিক্ষা দেয়া হয় না সেই শিশু কোন ধর্মের অধীনেই পড়ে না। তখন দেখা হয় তার মাতা-পিতার ধর্ম কী? সে অনুসারে তাকে মূল্যায়ন করা হয়। ইদানীং আমাদের দেশে বহু মানুষ পাওয়া যাবে যিনি ধর্ম কাকে বলে, পৃথিবীতে কয়টা ধর্ম আছে। ইসলাম কিসের নাম এর প্রবর্তক কে? মহানবী সা. কাকে বলে, সাহাবি কারা, কুরআন কী, হাদিস কী এসব কোনো জ্ঞানই তাদের নেই। তেমনি ভাষা কী এর গুরুত্ব কী? তাও তাদের জানার কথা নয়।

ভাষা আল্লাহর সেরা দান। যে প্রাণী শব্দ দিয়ে কথা বলতে পারে না তাকে শুধু প্রাণী বলা হয়। শুধু মানুষকে বলা হয় বাকসম্পন্ন প্রাণী। মানতিকের ভাষায় ‘হায়ওয়ানে নাতেক’ আমরা মুখে যে কথা বলি সেই কথাগুলো কোথা থেকে আসে? বর্ণ থেকে আসে। আর অনেকগুলো বর্ণ একত্র করলে তৈরি হয় শব্দ। মানুষ শব্দে শব্দে কথা বলে। শব্দ ছাড়া অর্থ প্রকাশ হয় না। আমরা যা বলি তা-ই শব্দের মিশ্রণ। বর্ণ ও শব্দের সমষ্টিই বাক্য। বাক্য পূর্ণাঙ্গ হলে মনের ভাব প্রকাশ হয়।

বাংলা ভাষাটা মিশ্রণ ভাষা। এ ভাষা আরবি ও সংস্কৃতি ভাষার পরিবর্তিত রূপ মাত্র। আর সংস্কৃতি ভাষার শুরুটার সাথে মিল রেখে চলছে বর্তমানের বাংলা ভাষা। অনেকটা খিচুড়ি ভাষাও বলা চলে। এজন্য বলা হয় আমরা ‘ইংরেজি টেবিলে’র ওপর ‘উর্দু কাগজ’ রেখে ‘আরবি কলম’ দিয়ে ‘বাংলা’ লিখি। এই ভাষার ইতিহাস খুব সংক্ষিপ্ত ও সহজ। সাল গণনার ইতিহাসে ষষ্ঠ খ্রিষ্টাব্দে একটি বই রচিত হয়েছিল, তার নাম দেওয়া হলো ‘চর্যাপদ’। আর এটিকে সেই সময়কার বড় বড় শিক্ষিতরা গুরুত্বপূর্ণ বই বলেছিলেন। এই বইটিতে চব্বিশজন কবি তাদের ৫২টি কবিতা দিয়ে সাজিয়েছেন। কবিদের নামও শুনতে মজাদার মনে হয়। তাদের প্রধান চারজন কবির নাম হলো- সুক্কুরি পা, কুক্কুরি পা, লুইপা, কাহ্নপা, এই রকম সব নাম। বইটিতে সেই সময়ের সামাজিক কথাবার্তা, অবস্থা এমনকি অনেক কার্যক্রমও প্রকাশিত হয়েছিলো। ঘরে চোর ঢুকলে কিভাবে কান্না করে তাও উল্লেখ ছিলো। ধর্মের বিভিন্ন উপাসনার কথাও বাদ পড়েনি। চর্যাপদ বইটি বাংলা ভাষার একমাত্র আদি নিদর্শন। 

ব্রিটিশরা এ দেশে এসেছিলো শাসন করতে, বহু বছর শাসনও করলো। তারা আমাদের ভাষা বোঝে না, আমাদের ভাষা বোঝার জন্য তারা উইলিয়াম কেরি নামক এক ইংরেজের মাধ্যমে ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ খুলে বসলো। তাতে বাংলা ভাষা চর্চা হবে, সেই ভাষা তারা শিখে আমাদের মনের কথা বুঝবে, বুঝে আমাদেরকে শাসন করবে। আমাদের সাথে ব্যবসা করবে, কত বড় পরিকল্পনা। আল্লাহর কী মহিমা শেষমেশ তারাই এই দেশ থেকে চিরতরে ভাগলো। আর এই কলেজের মাধ্যমে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচার প্রসার হলো। সেটাই হয়ে উঠলো আমাদের ভাষার সম্পদ। সম্প্রতি চীন আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে ব্যবসার উদ্দেশ্য নিয়ে, তারা আমাদের ভাষা শিখছে আমাদের দেশে তাদের পণ্য সরবরাহের লক্ষ্যে এক সময় তারাও আমাদের ভাষার মর্ম বুঝে আমাদের ভাষার জন্য বইও রচনা করতে পারবে।

এই বাংলা ভাষাটি ইন্দো ইউরোপীয়র পরে সংস্কৃতি দিয়ে শুরু। তারপর প্রাকৃত মাগধি, উড়িষা, অসমিয়া, বিহারি সব ভাষার শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ জন্য উৎপত্তি অনুসারে বাংলা ভাষার শব্দকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তৎসম, অর্ধ তৎসম, তদ্ভব, দেশী ও বিদেশী। তৎসম মানে তারসম, মানে সরাসরি সংস্কৃত। তাহলে আমরা কেমন শব্দ ব্যবহার করছি? আমাদের ভাষায় বিদেশী ভাষার শব্দ বেশি। এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো আমরা না পারছি আমাদের বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে কাগজপত্রে ব্যবহার করতে, না পারছি খাঁটি বাংলা ব্যবহার করতে।

আমাদের ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে রফিক জব্বার ভাইয়েরা জীবন দেওয়ার ফলে এ ভাষা আজ আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে। এই স্বীকৃতি আমরা পাই ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ঘোষণার মাধ্যমে। এই ভাষার সূত্র ধরে দেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতা আসে। স্বাধীনতার জন্য আমরা কত অনুষ্ঠানের আয়োজন করি অথচ  জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বটে কিন্তু আদৌ আমাদের ভাষাকে দাফতরিক ভাষা করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশেও নিত্য ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ দফতরেও বাংলা ভাষায় নিয়ম কানুন, ফরম বা কাগজপত্র করা হচ্ছে না। এর ফলে আমাদের মূল তদ্ভব ভাষার ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।

ভাষার উন্নয়নে একটি বড় রকমের গবেষণা বা আনুষ্ঠানিকতাও করা হয় না। মাসব্যাপী বইমেলা করে তাও শুধু কিছু সংখ্যক প্রকাশকরা। তাতে ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধির কোনো নিয়ম কানুন নির্মিত হয় না। সব ভাষার বই বিক্রি হয়। বাংলা ভাষার উন্নয়নে উচিত হলো ভাষাতত্ত্বে বেশি নাম্বারের পাঠ্য করা। আরো দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে যেসব কবি সাহিত্যিকগণ গল্প কবিতা লিখেন তাদের অধিকাংশই বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষায় নামকরণও করেন। তাতে কী স্বাদ তারা পান তারাই জানেন। তাদের লেখাগুলো জাতীয় পত্রিকায় বড় গুরুত্ব সহকারে ছাপাও হয়।

চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের উদাহরণ লক্ষ করলেই বক্তব্যটি স্পষ্ট হয়। সেসব দেশ নিজেদেরকে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে গেছে। প্রথমে ভাষার মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে উন্নত করার পরিকল্পনা, তারপর স্তরে স্তরে শির উঁচুু করে দাঁড়ানো।

আমাদের আদৌ জ্ঞান কি হবে? আমাদের ভাষার কৃতিত্ব, আমাদের শব্দ চয়ন, শব্দের মহিমা গরিমা কত উচ্চতর তা কি ভেবে দেখেছি? আমাদের বর্ণ যারা নির্মাণ করেছিলেন তারা কত গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তা আমাদের ভাষার সাথে অন্যান্য ভাষার শব্দ উচ্চারণে মিলালেই বুঝা যায়। ইদানীং আমাদের ভাষা পরিবর্তনেরও দায়িত্ব নিয়েছে কেউ কেউ। এখন আমাদের অতি উৎসাহী কিছু লোক ভিন্ন দেশের আদলে আমাদের ভাষার বর্ণমালাকে সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে মৌলিক শব্দের আর ভিনদেশী ভাষার শব্দের সঠিক উচ্চারণ ও অর্থের পার্থক্য করে ফেলেছেন। এক্ষেত্রে আমি শুধু জানতে চাই তাঁরা কি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র চেয়েও বড় পণ্ডিত হয়ে গেছেন? ভাষার জন্য এমন কিছু করা দরকার যার ফলে দুনিয়ার সর্বক্ষেত্রে আমাদের ভাষা নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হয়। ভাষার সম্মানে ও গুরুত্ব নিয়ে লিখেছেন কবি রামনিধি গুপ্ত- 

নানান দেশের নানান ভাষা

বিনে স্বদেশী ভাষা,

পুরে কি মনের আশা?


মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভাষায়- 

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন,

তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি,

পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ।

পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি,

কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি।

তিনি আরো লিখেছেন, ‘মাতৃভাষা রূপে খনি পূর্ণ মনিজালে’।

আরো পরিতাপের বিষয় আমাদের ভাইয়েরা যেদিন শহীদ হলেন সেদিন ছিলো বাংলা ৮ই ফাল্গুন ইংরেজি ২১ শে ফেব্রুয়ারি। আমরা ইংরেজি তারিখটাকেই মনে রেখেছি। এবং যা একটু পালন করছি সেই ইংরেজিতেই একুশে ফেব্রুয়ারি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়ে, ব্যাংকগুলোর ফরমে, বিমান, বা বাসের টিকিটে, আয়করের রিটার্ন, ভ্যাটের ফরম সবগুলোই ইংরেজি রয়ে গেছে, দেশী দফতরে এখনো ইংরেজির গুরুত্ব অত্যধিক। এমনকি যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ে তাদের সিলেবাসেও ইংরেজি বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে আমাদের কর্মকর্তাগণ আরো পরিকল্পিত চিন্তাশীল হওয়া জরুরি। আমাদের পরামর্শ শুধু ভাষার উন্নয়নে ভিন্ন দফতর ও গবেষণাগার খোলা আবশ্যক। সাথে সাথে দফতরগুলোতে খাঁটি বাংলা ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হোক। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে খাঁটি বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রতিযোগিতা করা হোক। খাঁটি বাংলা হোক সকলের আন্তরিক ভাষা।

লেখক : অধ্যাপক ও প্রবন্ধকার

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির