post

বামপন্থীদের কুপরামর্শ আর উদ্ভট বক্তব্য শেখ হাসিনাকে তলানিতে পৌঁছাবে

২৪ জানুয়ারি ২০১৫

 ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম#

Dr. Rezaul Karimষোড়শ শতাব্দী থেকেই মূলত কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের চিন্তা শুরু হয়। চার্লস ফ্যুরিয়ার, সেন্ট সাইমন, রবার্ট ওয়েন প্রমুখ দার্শনিকদের মাধ্যমে। প্রƒধো অবশ্য নৈরাজ্যবাদিতায় বিশ্বাস করতেন। ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি রাশিয়ায় প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর ৮০-এর দশক থেকেই শুরু হয় সমাজতন্ত্রের পতন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ আনুষ্ঠানিকভাবে সমাজতন্ত্রকে বর্জন করে তাদের মুক্তির জন্য গণতান্ত্রিক ধারা ও শাশ্বত বিধান আল-ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেখান থেকে সমাজতন্ত্রীদের আক্রোশের বস্তুতে পরিণত হয় ইসলাম ও গণতন্ত্র। সত্তরের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বামরাজনীতির অনেকটাই ছন্নছাড়া অবস্থা দেখা দেয়। বিশ্বরাজনীতিতে এ পিছিয়ে পড়া ভাব কাটিয়ে উঠতে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এর মধ্যে অনেকে তওবা করে বাম রাজনীতি ছাড়লেও বিরাট অংশ এখন অন্য দলের আড়ালে, আবডালে থেকে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও নিজেদের স্বার্থ হাসিলে সবচেয়ে বেশি তৎপর। এরই মধ্যে কেউ কেউ আবার উদ্ভট মন্তব্য করে আর বড় দলগুলোকে কুপরামর্শ দিয়েও অতীতের প্রতিশোধ কিছুটা মিটিয়ে নিচ্ছেন। সেই অভিযোগটি এখন তুঙ্গে মহাজোট সরকারের বাম ঘরানা মন্ত্রী, এমপি এবং প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনীতিতে জাসদ এখন ছাগলের বাছুর তিন নম্বরটার ভূমিকায় অবতীর্ণ। এক সময় আওয়ামী লীগের প্রচন্ড প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও এখন ক্ষমতা ভোগী আর লুটপাটের অংশীদারিত্ব নিয়ে বাঘ-সিংহ যেন এখন এক ঘাটে পানি খায়। যদিও এতে বামদের অপরাংশ বেজায় নারাজ। অপরদিকে মহাজোট সরকারের বামনির্ভরতার খবর প্রায় অনেকদিন থেকে আলোচিত হয়ে আসছে এবং এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকেই আকারে ইঙ্গিতে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ইনু সাহেবের উদ্ভট মন্তব্যের দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হচ্ছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না। সম্প্রতি ১৪ দলের বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে জাসদ কার্যকর সভাপতি মাঈনুদ্দিন খান বাদল ২০ দলের অরোধ কর্মসূচি সম্পর্কে বলেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথমে তাদের লাঠি দিয়ে মোকাবেলা করবে পরে পায়ে গুলি করবে, পায়ে গুলিতে কাজ না হলে পরিস্থিতি বুঝে বুকে গুলি করবে। (১৪.০১.২০১৫ সূত্র : মানব জমিন) বাদল সাহেবের এই বক্তব্য কতটুকু গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক তা তিনিই ভালো জানেন। একজন সাংসদ এমন বক্তব্য দিতে পারেন কি? আজ ২০ দলের এ আন্দোলন বাদল সাহেবদের কাছে অগণতান্ত্রিক হলে তাহলে আসলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কোনটি? বাদল সাহেবেরা এখন ক্ষমতা, আর হালুয়া-রুটির ভাগ নিয়ে যা ইচ্ছা তাই বলবেন? তাহলে এক সময় ইনু-বাদল-মেনন সাহেবদের সশস্ত্র বিপ্লব, লাল বাহিনীর বিপ্লব কতটুকু গণতান্ত্রিক ছিল? ইনু-মেনন আর বাদল সাহেবরা ৩০ হাজার নেতাকর্মীর রক্তের সাথে বেঈমানী করে ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী হয়ে যেন সব ভুলে গেলেন? কারণ গলাবাজি, দম্ভক্তি করে আওয়ামী লীগের দালালি করলে ভোট ছাড়াই এমপি, মন্ত্রী হওয়া যায়। ইনু- মেনন আর বাদল সাহেবরা জানেন জনগণের ভোটে তারা জীবনেও এমপি, মন্ত্রী হতে পারবে না। তাই কি এমন দালালি আর দম্ভোক্তি? রাজনৈতিক এতিমদের জন্য ক্ষমতায় থাকার এটাই সহজ পদ্ধতি? গৃহপালিত বিরোধী দল স্বৈরাচার এরশাদ আর ইনু- মেনন এবং বাদল সাহেবদের রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত উক্তি যেন এখন পাগলের প্রলাপ। বিশেষ করে বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা সম্পর্কে ইনু সাহেবের আশালীন, অশোভন, কটূক্তি, যেন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দারুণভাবে কলুষিত করছে। এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত। নতুন প্রজন্ম আপনাদের কাছে আজ কি শিখছে? এদেশের জনগণ আপনাদের ইতিহাস খুব ভালোভাবে জানে। জনগণ একদিন প্রতিটি গুলির হিসাব নেবে। যারা কথায় কথায় গুলি করার কথা বলেন, সেদিন বেশি দূরে নয় জনতার আদালতে আপনাদের সব কিছুর হিসাব দিতে হবে। কারণ ক্ষমতার গরমে অনেক জ্বালাময়ী, অশালীন, বেআইনি, অসাংবিধানিক বক্তব্য যারাই দিচ্ছেন, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এরা জনগণের শত্রু হিসেবে, জাতির কাছে, জনগণের কাছে, দেশের কাছে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। যারা ২০ দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে বিভিন্ন মন্তব্য করছেন। সেই ইনু-বাদল সাহেবদের আন্দোলনের চরিত্র এবার ইতিহাস থেকে দেখা যাক। জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি বইয়ে জনাব মহিউদ্দীন লিখেছেন- জাসদের এক প্রচারপত্রে শিরোনামে ‘এই কি সোনার বাংলাÑ শেখ মুজিব জবাব দাও’ সভা, জমায়েত, মিছিল, ধর্মঘট ইত্যাদি জনগণের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ফরমান জারি করে সেগুলোও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, যাতে জনগণ কুকুরের মতো মরতে থাকলেও আর প্রতিবাদ করতে না পারে। যত্রতত্র জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা; হয়রানি চলছে নিরীহ মানুষদের। এটাই মুজিববাদী গণতন্ত্রের স্বরূপ।’ ‘বাংলাদেশে আজ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ’ বলে উল্লেখ করা হয়। গত ২৫ মাসে গুম ও খুন হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। পুলিশের হামলা হয়েছে প্রায় ২৪ হাজার পরিবারে। জেলে রাজবন্দী আছে ১৮ হাজারের ওপর। হুলিয়া আছে প্রায় ২৫ হাজার নেতা ও কর্মীর নামে। বাড়ি পুড়েছে প্রায় আড়াই হাজার। ধর্ষণ অসংখ্য। প্রগতিশীল নেতা ও কর্মীদের গুম ও খুন করার জন্য এক ঢাকা শহরেই নামানো হয়েছে প্রায় দেড় শ’ স্কোয়াড। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আজ খুনের আড্ডা। ১৯৭৩-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যত ভোট পেয়েছে, তার শতকরা ৫২ ভাগ জাল, আর প্রায় ২০ ভাগ মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগে লোভ-লালসার মাধ্যমে ঠকিয়ে নেয়া। উপনির্বাচন এবং স্কুল-কলেজের নির্বাচনও বস্তুত ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও বুলেট ব্যবহারের নির্বাচন।’ এটি ছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আপনাদের বক্তব্য। আজ ক্ষমতার লোভে আওয়ামী লীগের সব অপকর্মই এখন ইনু-বাদল আর মেনন সাহেবদের কাছে হালাল এবং জায়েজ!! জাসদ মনে করে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে ‘কুকুরে-কুকুরে কামড়াকামড়ি’ পিকিংপন্থীরা ছয় দফাকে সিআইএর দলিল বলে প্রচার করেছিল। আইয়ুব ও ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাদের সখ্য ছিল অনেকটা প্রকাশ্য। চীনের পররাষ্ট্রনীতির অন্ধ অনুসরণ করতে গিয়ে তারা অনেক ক্ষেত্রে বাঙালির জাতীয় মুক্তির প্রশ্নটিকে শুধু পাশ কাটিয়ে যায়নি, এর বিরুদ্ধে সচেতনভাবে কাজও করেছিল। তাদের একটি অংশ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যকার লড়াইকে বলেছিল ‘কুকুরে-কুকুরে কামড়াকামড়ি’। মতিয়া চৌধুরী বলেছিল ‘শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে ডুগডুিগ বাজামু’, ‘কর্নেল তাহের সম্ভবত জানতেন না, ১৫ আগস্ট তারিখটিই অভ্যুত্থানের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে। তবে এরকম একটা ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা তার অজানা থাকার কথা নয়। কোটি টাকার প্রশ্ন ছিল, কবে, কখন? শেখ মুজিবের প্রতি তাঁর ক্ষোভ ছিল অপরিসীম। তাহের মনে করতেন, ‘মুজিব সরকার সেনাবাহিনীর উন্নয়নে চরম অবহেলা দেখিয়েছে এবং রক্ষীবাহিনীর মতো একটা কুখ্যাত আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করেছে।’ ১৯৭১ সালে নঈম ১১ নম্বর সেক্টরে তাহেরের সহযোদ্ধা ছিলেন এবং প্রায়ই তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতেন। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া। ১৫ আগস্টের পর গণবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি লিফলেট প্রচার করা হয়। লিফলেটের শিরোনাম ছিল, ‘খুনি মুজিব খুন হয়েছেÑ অত্যাচারীর পতন অনিবার্য।’ (জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি, পৃষ্ঠা নং ১৭৯) বাদল সাহেব পালানোর জন্য গর্ভবতী নারীর লাশ সেজেছেন! ১৭ মার্চ পল্টনে জাসদের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে জলিল ও রব অত্যন্ত জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সভা শেষ হতে না হতেই এক বিশাল মিছিল মিন্টো রোডের দিকে রওনা হয়। হঠাৎ কোত্থেকে কয়েক ট্রাক পুলিশ আর রক্ষীবাহিনী এলো। শুরু করল গুলি। জলিল ভাই, মমতাজ আর আমি একসঙ্গে ছিলাম। ইনু কমান্ড দিল, ‘সবাই শুয়ে পড়েন’। আমরা শুয়ে পড়লাম।” সরকারি প্রেস নোটে বলা হয়, তিনজন নিহত এবং ১৮ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে জলিল, রব, মমতাজ বেগম ও মাঈনউদ্দিন খান বাদল ছিলেন। তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। মাঈনউদ্দিন খান বাদলের বাবা আহমদউল্লাহ খান ছিলেন পুলিশের ঢাকার তেজগাঁও অঞ্চলের ডিএসপি। বাদল পরে তাঁর কাছে শুনেছিলেন, ৪০-৫০টি লাশ রক্ষীবাহিনী ট্রাকে করে নিয়ে গেছে।’ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় যাঁরা গ্রেফতার হয়েছিলেন, মাঈনউদ্দিন খান বাদল তাঁদের একজন। তাঁকে পুলিশ পাহারায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। বাদলের আশঙ্কা ছিল, তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যার অভিযোগ আনা হতে পারে। একজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছিলেন বলে কানাঘুষা চলছিল। হাসপাতালের কেবিনের বাইরে দরজার পাশে পুলিশ পাহারা থাকে। দুপুরে পনেরো মিনিটের মধ্যে ডিউটি বদল হয়। ওই সময় একদল পুলিশ তিনতলার কেবিন এলাকা থেকে নিচে নেমে যায়, আরেক দল ওপরে উঠে আসে। অর্থাৎ, পনেরো মিনিট কোনো পাহারা থাকে না। পরিকল্পনা হলো, ওই পনেরো মিনিট সময়কে কাজে লাগানো নিয়ে। একদিন দুপুরে যখন ডিউটি বদল হচ্ছে, তখন মেডিক্যালের কয়েকজন ছাত্র একটা স্ট্রেচার নিয়ে এলেন। বাদল তার ওপর শুয়ে পড়লেন। পেটের ওপর একটা বালিশ রেখে তার সারা শরীরে চাদরে ঢেকে দেয়া হলো। ছাত্ররা দ্রুত স্ট্রেচার নিয়ে করিডোর দিয়ে ছুটতে ছুটতে লিফটে ঢুকলেন। দেখলে মনে হবে, একজন গর্ভবতী নারীর লাশ যাচ্ছে। হাসপাতালের পেছনের গেট দিয়ে ‘লাশ’ বের করে একটা অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হলো। অ্যাম্বুলেন্স আজিমপুরের কাছে একটা জায়গায় থেমে ‘লাশ’ নামিয়ে দিলো। ‘লাশ’ হেঁটে চলে গেল চাদর মুড়ি দিয়ে।’ (জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি) জাসদের ওপর আওয়ামী লীগের নির্মম নির্যাতন জাসদের কর্মীদের প্রতি জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের আচরণ ছিল নির্মম। রক্ষীবাহিনীর হাতে নির্যাতিত জাসদের কর্মীদের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। ’৭৩ সালে এসব ‘সংঘর্ষে’ জাসদের ২৩ জন কর্মী নিহত হন বলে দলীয় সূত্রে জানা যায়। জাসদের কর্মী খুঁজে বের করে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগ ছিল রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে। পঁচাত্তরের ১ জানুয়ারি সিরাজ শিকদারকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ কর্মকর্তা মারুফুল হক তাঁকে গ্রেফতার করেন। তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে বিমানে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাঁকে নামানো হলে পুলিশের ইন্সপেক্টর কায়কোবাদ তাঁর বুকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেন। মালিবাগে স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে কিছুক্ষণ রাখার পর অতিরিক্ত নিরাপত্তার কারণে তাঁকে শেরেবাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকার পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমদকে জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব দেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি নিয়ে মাহবুবের তেমন ‘সুখ্যাতি’ ছিল না। ওই রাতেই তাঁকে হত্যা করা হয়। লেখা হয় ‘ক্রসফায়ারের’ চিত্রনাট্য। একটা প্রেস নোটে বলা হয়, পুলিশ তাঁকে নিয়ে অস্ত্রের সন্ধানে সাভারে গিয়েছিল। গাড়ি থেকে লাফিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে সিরাজ শিকদার নিহত হন। (জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি) এভাবে দেশে সর্বপ্রথম ‘ক্রসফায়ারের’ নামে হত্যার রাজনীতি শুরু করে আওয়ামী লীগ। ইনু-বাদল সাহেবরা এখন সেই রক্তের সাথে গাদ্দারি করছেন না? জাসদের গণতান্ত্রিক ধারার পরিসমাপ্তি! ১৭ মার্চের মিছিল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও নিয়ে জাসদের মধ্যে অনেক বিতর্ক হয়। এটা ছিল দলকে আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার একটি অংশ। পরিকল্পনাটি সফল হয়। অনেক চড়াই-উতরাই সত্ত্বেও জাসদের রাজনীতির গণতান্ত্রিক ধারাটি এত দিন বজায় ছিল। ১৭ মার্চ এ ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। এ প্রসঙ্গে জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি সম্পাদক হাবিবুল্লাহ চৌধুরীর ভাষ্য এ রকম : প্রথমে শুনলাম, গুলি করেছে হাবিবুল হক খান বেনু। পরে জানলাম, এইডা হাসানুল হক ইনুর কাম।’ ১৭ মার্চ এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলী জাসদের ‘উসকানিমূলক ও উত্তেজনা সৃষ্টির রাজনীতির’ সমালোচনা করেন। বিবৃতিতে বলা হয় : জাসদ নেতৃত্ব সঙ্কটের প্রতিবাদের নামে ‘জ্বালাও-পোড়াও’, ‘অস্ত্রের বদলে অস্ত্র’, ‘ঘেরাও’ প্রভৃতি উগ্র হিংসাত্মক কার্যপন্থা গ্রহণ করিয়া দেশকে বিশৃঙ্খলা ও রক্তপাতের দিকে ঠেলিয়া দেয়ার প্রয়াস পাইয়াছে।... আমাদের পার্টি সুস্পষ্টভাবেই মনে কওে যে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ও উহার রাজনীতি দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী। দেশের ও জনগণের স্বার্থেই এই রাজনীতির মোকাবেলা করা দরকার। তাই জাসদ নেতৃত্বের রাজনীতি, বিশেষত দেশে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য তাহাদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধভাবে রুখিয়া দাঁড়াইবার জন্য আমরা দেশের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ও অন্যান্য জনগণকে আহবান করিতেছি। (জা.উ.প : অস্থির সময়ের রাজনীতি) বর্তমান সময়ে ইনু-বাদল সাহেবরা সাধু সেজেছেন? মহাজোট সরকারে বাম-নির্ভরতা পত্রিকার এক রিপোর্টে নড়েচড়ে উঠলেন সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ। এতে বলা হয়- ‘‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায় সাবেক কমিউনিস্ট ও ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থকরাই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। কমিউনিস্ট ছাড়াও সাবেক বামধারার সমর্থকদের অদৃশ্য জোট মন্ত্রিসভায় বিশেষভাবে আলোচিত। জ্যেষ্ঠতার তালিকায়ও সাবেক কমিউনিস্টদেরই অগ্রাধিকার। মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত প্রণয়নে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছেন, তাদের প্রায় সবাই এসেছেন বামধারার রাজনীতি থেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কার্যত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সরকার চালাচ্ছে কমিউনিস্টরাই। সরকারে দলের নেতারা এখন গুরুত্বহীন। মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর পরই অর্থমন্ত্রীর গুরুত্ব। সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন সমর্থক আবুল মাল আবদুল মুহিত সেই সৌভাগ্যবান মন্ত্রী। মন্ত্রিসভায় আরেক প্রভাবশালী মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হলেও দলে মতিয়া চৌধুরী এখনো ‘কমিউনিস্ট’ হিসেবেই সমধিক পরিচিত। ছাত্রলীগের সঙ্গে যখন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনৈতিক দ্বন্দ¡ প্রকট, ঠিক সে মুহূর্তে তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী। ছিলেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদকও। আর এ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন নূরুল ইসলাম নাহিদ। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ কেবল ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলেন না, আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার আগের দিন পর্যন্ত তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। একই পত্রিকা ঐ তারিখে জাসদ-নির্ভর প্রশাসনের চিত্রটি এভাবে তুলে ধরেÑ ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের জনপ্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছেন সাবেক জাসদ ছাত্রলীগ নেতারা। শীর্ষ আমলার পদেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এক সময়ের আলোচিত জাসদ ছাত্রলীগ নেতারা। এসব দাপুটে ‘সচিব’ পদাধিকারীর নেতৃত্বেই রাষ্ট্রের প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এদের কলকাঠিতে দলনিরপেক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তারা পদায়ন এবং পদোন্নতিবঞ্চিত থেকে শুরু করে জনপ্রশাসনে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এসব আমলার ছলচাতুরীর লাগাম এখনই টেনে ধরা না হলে জনপ্রশাসনে আরো বিপত্তি দেখা দেবে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল। নির্ভরযোগ্য সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বর্তমান সচিবদের অনেকেই জাসদ সৃষ্ট গণবাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার শিকার হওয়ার পর বিষয়টিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সাবেক জাসদ ছাত্রলীগের আদর্শের অনুসারী এসব সচিব পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ঘোর বিরোধিতায় ছিলেন। একানব্বইয়ের খালেদা সরকারের সময়ও ভোল পাল্টে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। পরে ছিয়ানব্বইয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তারা জনপ্রশাসনে ভালোভাবেই প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তাদের প্রভাবের জাল বিস্তৃত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের নির্দেশেই বর্তমান মহাজোট সরকারের জনপ্রশাসনও পরিচালিত হচ্ছে। কৌশলে সরকারের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছেন জাসদ ছাত্রলীগের এসব সাবেক নেতা। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১০) মহাজোট সরকারের এত জন ক্ষমতাধর প্রভাবশালী ব্যক্তি যদি বাম ঘরানারই হয় তাহলে আওয়ামী লীগ কোথায়? এটা আওয়ামী লীগের এক প্রকার রাজনৈতিক দেউলিয়াও বটে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার পিতাকে বামরাই সবচেয়ে বেশি বিপদে ফেলেছে, এখনও আপনার চতুর্দিকে তাদেরই আনাগোনা, ইতালীয় বংশোদ্ভূত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির ‘ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরি’ গ্রন্থের ৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে বললাম, মি. প্রাইম মিনিস্টার, সমাজতন্ত্রী কি না? তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ......’। তার কণ্ঠে দ্বিধা। তাকে আবার বললাম যে, সমাজতন্ত্র বলতে তিনি কী বুঝেন? তিনি উত্তর দিলেন, ‘সমাজতন্ত্র’। তাতে আমার মনে হলো সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার যথার্থ ধারণা নেই।’ রাজনীতিতে পরিশীলিত ভাষা পরিবর্তে গালাগালি করতে অভ্যস্ত ‘জাসদ একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠেছিল এবং চরমপন্থার দিকে ধীরে ধীরে ঝুঁকছিল। এ সময় অন্য বাম দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে যারা ‘সশস্ত্র বিপ্লবে’ বিশ্বাস করে, প্রচারধর্মী বক্তব্যই বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এসব বক্তব্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল বাগাড়ম্বরে পরিপূর্ণ এবং মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও সে-তুংয়ের উদ্ধৃতিতে ভরা। যেমন কিছু একটা বলতে চাইলে যুক্তি দেয়া হতোÑ এটা করতে হবে, কেননা কমরেড লেনিন এ কথা বলেছেন..., ওভাবে যাওয়া যাবে না, কারণ চেয়ারম্যান মাও এ বিষয়ে এই কথা বলেছেন ইত্যাদি। বাম রাজনীতিতে এই পীরবাদী প্রবণতা স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে প্রায় অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল। মাওবাদী গ্রুপগুলোর অবস্থা ছিল শোচনীয়। গণবিরোধী ভূমিকার জন্য এদের অনেকের ভাবমূর্তি ছিল নেতিবাচক। তাদের কেউ কেউ ‘ভারতের দালাল-মুক্তিযোদ্ধাদের’ খতম করাকে বিপ্লবী কাজ মনে করত। রাজনীতিতে পরিশীলিত ভাষা ব্যবহার করার চেয়ে গালাগালি করতে অভ্যস্ত, জাসদকে কেউ বলত ‘জারজ সন্তানের দল’, কেউ বলত ‘ভারতের সেকেন্ড ডিফেন্স লাইন’। দলটির সমালোচনা হিসেবে সম্ভবত সবচেয়ে শোভন মন্তব্যগুলো ছিল ‘উগ্র’, ‘হঠকারী’ ও ‘বিভ্রান্ত’। এদের আরেকটি প্রবণতা হলো, নিজ দলকে একমাত্র খাঁটি বিপ্লবী দল হিসেবে দাবি করা এবং অন্য সব দলকে কুচক্রী, ষড়যন্ত্রকারী, বিশ্বাসঘাতক ও দেশি-বিদেশি শক্তির এজেন্ট হিসেবে চিত্রিত করা।’ (জা.উ.প : অস্থির সময়ের রাজনীতি) রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শেখ মুজিবুর রহমান সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন নিজ দলের চাটুকারদের মাধ্যমে। যারা পীর-মুরিদানের মত সংশোধন, সমালোচনা, না করে অতি আনুগত্য পরায়ণতার পরিচয় দিতে গিয়ে দলের বারটা বাজিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে তাদের আচরণ, আনুগত্য, ফোঁসফাঁস না মারার নীতি ভালো মনে হলেও সুদূরপ্রসারী তাদের নিকট অকল্যাণ ছাড়া কিছুই আশা করা যায় না। শেখ মুজিবুর রহমানকে এই শ্রেণীর বামরাই প্রলুব্ধ করে বাকশাল কায়েম করিয়ে ছিলেন যদিও আজ ইতিহাসের বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য এটিই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। ২৮ অক্টোবর ২০০৬ পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্য মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর নাচানাচি করে উল্লাস প্রকাশ করেছে বাম ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। অনেকেই মনে করছে ১/১১-এর আগে ও পরে নেপথ্যে বাংলাদেশের বামবুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের ভূমিকা আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে বেশি বিপথগামী করেছে। একথা সবারই জানা, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির জন্য বামরাই দায়ী, এখন আবার বামপন্থীরা কু-বুদ্ধি আর উদ্ভট বক্তব্য দিয়ে শেখ হাসিনার জনসমর্থন শূন্যের কোটায় নিয়ে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। লেখক : সহকারী-সম্পাদক সাপ্তাহিক সোনার বাংলা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির