বিজয়ী শব্দটি নিয়ে আমাদের অ্যানালাইসিসের শেষ নেই। বাংলা একাডেমির অভিধান অনুযায়ী- ‘প্রতিপক্ষকে পরাজিতকারী’-ই বিজয়ী। এখানে সত্য-অসত্যের সীমার কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। শক্তিশালী পক্ষ মিথ্যাকে আঁকড়ে থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারাকেই অবলম্বন ধরা হয়েছে। গোটা পৃথিবীজুড়ে এভাবেই বিজয়ীকে চিহ্নিত ও সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে। ফলাফল হিসেবে সকল মানুষ এর কুফল ভোগ করে আসছে। এটাই এখন নিয়তি মনে করা হয়। মানবিক অথবা অমানবিক, উভয় ক্ষেত্রে বিজয়ী শব্দ মিলিয়ে ফেলার সুযোগ আছে কি? আমরা যারা সত্যপন্থী, তারাও এক্ষেত্রে বাছবিচার ভুলে যাই। অনেক সময় ভুলে না গেলেও ডিলেমার মধ্যে থাকি। অতঃপর জুলুমতন্ত্রকে সঠিক বলে ফেলতে দ্বিধা করি না। এভাবেই পৃথিবীব্যাপী জুলুমবাজ শক্তিশালী গোষ্ঠী সত্যকে কোণঠাসা করে রাখে। আর আমরা যারা না বুঝে শক্তিমত্তাকে সাপোর্ট করেছিলাম, তারা আফসোসের খাতা খুলে বসি- কবে এত্থেকে পরিত্রাণ পাবো! বাস্তবে পরিত্রাণ মেলে না, মেলা সম্ভব নয়। এর একটি বিশেষ কারণ হচ্ছে- উক্ত বিজয়ী শক্তি অল্পকিছু সময়ের জন্য মানুষের মাঝে আশার সঞ্চার করার সক্ষমতা অর্জন করে মাত্র। সময় শেষ হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের অর্জিত ক্ষমতা এবং রাজত্ব গুটিয়ে নেয়ার মাধ্যমে। বিজয়ী শব্দের কুরআনিক ব্যাখ্যা একটু ভিন্নতর। এ ব্যাপারে ছোট্ট একটি আয়াত খেয়াল করা যায়। আল্লাহ বলেন- “আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে, তাঁর রসূলকে ও মুমিনদেরকে নিজের বন্ধু রূপে গ্রহণ করে তার জেনে রাখা দরকার, আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।” (সূরা মায়িদাহ : ৫৬)
ঈমানদারদের বিজয় সাধারণত চূড়ান্ত বিজয়। জীবনাবসানের পরের অনন্ত জীবনের সফলতা তাঁদের আরাধ্য। তাই তাঁরা সত্যকে শেষ পর্যন্ত আঁকড়ে থাকা যৌক্তিক মনে করেন। তাঁরা জানেন, আজকের এই মিথ্যাবাদীরা কেয়ামতের দিন পরাজিত হিসেবে আল্লাহর পক্ষ থেকে রায়প্রাপ্ত হবে এবং অনুতপ্ত হবে; যদিও তাদের সেই দিনের অনুতপ্ততা কোনোই কাজে আসবে না। আল্লাহ বলেন- “তুমি দেখতে পাচ্ছো, যাদের অন্তরে মোনাফেকির রোগ আছে তারা তাদের মধ্যেই তৎপর থাকে। তারা বলে, আমাদের ভয় হয়, আমরা কোন বিপদের কবলে না পড়ে যাই। কিন্তু অচিরেই আল্লাহ যখন তোমাদের চূড়ান্ত বিজয় দান করবেন অথবা নিজের পক্ষ থেকে অন্য কোনো কথা প্রকাশ করবেন। তখন তারা নিজেদের অন্তরে লুকিয়ে রাখা এ মোনাফেকির জন্য লজ্জিত হবে।” (সূরা মায়িদা : ৫২)
আমরা মুসলিমরা অনেকেই ইসরাইল নামক জায়নবাদী অভিশপ্ত গোষ্ঠীর শক্তিমত্তাকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জিহাদকারী মুসলিমদের বিপরীতে বিজয়ী ভেবে ফেলছি। এটা যে কত বড় মূর্খতা, তা উপরের আয়াত দুটো বিবেচনায় রাখলে বিশ্লেষণ পেয়ে যাওয়ার কথা। এবার আপনি যদি বলেন, যৌক্তিকভাবে আস্থাশীল হতে পারছেন না! আমি বলবো, আল্লাহর আয়াতের মর্মার্থ আপনি বোঝেননি। অবশ্য আপনি তখন এ-ও বলতে পারেন- আমিতো কুরআনই পড়ি না। তাহলে তো আপনাকে মূর্খদের কাতারে রেখে কুরআন পড়ার অনুরোধ করে আমার সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না! এগারো দিনের যুদ্ধ শেষে পরাজিত জায়নবাদী গোষ্ঠীর বিশ্বব্যাপী সমর্থক খ্রিষ্টান ও অন্যান্য অমুসলিমদের একটি বড় অংশ এবং দুঃখজনকভাবে কিছু মুসলিমও ফিলিস্তিন-ইসরাইল সমঝোতার কথা বলছে। এটা আসলে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। তাদের সাথে কখনো সমঝোতা হতে পারে না এবং কোনো ধরনের সমঝোতায় তারা সন্তুষ্ট বা আশ্বস্ত হবে না। এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ সুস্পষ্ট করে জানিয়েছেন। আল্লাহ বলেন- “ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা তোমার প্রতি কখনোই সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের পথে চলতে থাকো। পরিষ্কার বলে দাও, পথ মাত্র একটিই, যা আল্লাহ বাতলে দিয়েছেন। অন্যথায় তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে তারপরও যদি তুমি তাদের ইচ্ছা ও বাসনা অনুযায়ী চলতে থাকো, তাহলে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষাকারী তোমার কোনো বন্ধু ও সাহায্যকারী থাকবে না।” (সূরা বাকারা : ১২০)
ফিলিস্তিনে ইহুদি-মুসলিম যুদ্ধে যতবার যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে, তার কোনোটিই ইহুদিরা মানেনি। এর বাস্তবতা আল্লাহ উপরের আয়াতে বলে দিয়েছেন। আমাদেরকে এই বিষয়টি বুঝতে হবে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যখন জাতি-রাষ্ট্রকে আধুনিক বলে দাবি করেন, তখন তো কেউ জবরদখল করতে পারে না। অথচ ইহুদিবাদের দখলদারির বিরুদ্ধে কেউ শক্ত অবস্থানে যায় না। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বব্যাপী এই একটি পয়েন্টে (শান্তিচুক্তি) সবাই কথা বলে, অথচ জবরদখলের বিরুদ্ধে এই ১০০ বছর ধরে কেউ তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি, খোদ ফিলিস্তিনে হামাস ব্যতীত ফাতাহ ও অন্যান্য কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে একাধিকবার শান্তিচুক্তির আহ্বান করা হয় এবং মর্মান্তিকভাবে অধিকাংশ ফিলিস্তিনি মুসলিমদের হৃদয়ে আঘাত করে ইহুদিদের অযৌক্তিক দাবি ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতি মূলত ইহুদিবাদকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করার দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টায় রত তাদের অন্যতম মিত্র খ্রিষ্টশক্তি আমেরিকা ও তার অনুগতদের গোপন চক্রান্তকে সহজে সামনে আনে। আর এতে সমর্থন জানায় কিছু আরব রাষ্ট্রও; যা এক নির্মম প্রহসন। এভাবে যদি মিথ্যার সাথে আপস করা হয়, তখন বিজয়ী হিসেবে ফিলিস্তিনিদের অবস্থান অনেককেই বিব্রত করবে। আপসকামী মুসলিমদের অন্তর থেকে প্রায় মুছে যাওয়া ঈমান একেবারে নিঃশেষ হওয়া তখন আর বিবেচ্য বিষয় থাকে না। এমনকি তখন আল্লাহর পথে লড়াই করার ব্যাপারে কুরআনিক নির্দেশনাগুলো মনে দোলাচল সৃষ্টি করে এবং বিব্রতকর মনে হয়। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন- “তোমাদের যুদ্ধ করার হুকুম দেয়া হয়েছে এবং তা তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর। হতে পারে কোনো জিনিস তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর অথচ তা তোমাদের জন্য ভালো। আবার হতে পারে কোনো জিনিস তোমরা পছন্দ করো অথচ তা তোমাদের জন্য খারাপ। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।” (সূরা বাকারা : ২১৬)
আসলে অন্তরে আপসকামিতা রেখে মুখে ফাঁকা বুলি ছুড়ে কখনো সত্যপন্থী মুসলিম জাতির চূড়ান্ত সাফল্যের পথে হাঁটার সুযোগ নেই। ঠিক এই বিষয়টি অন্তরে, মুখে এবং কাজে রাখে বলেই ফিলিস্তিনি যোদ্ধা মুসলিম নর-নারীরা জায়নবাদীদের অন্তরের জ্বালা বাড়িয়ে দিতে পেরেছে। এটিই মূল বিজয়। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে চূড়ান্তভাবে অভিশপ্ত ইহুদিবাদ সারা বিশ্বে তাদের মিত্রদের সর্বময় সাপোর্টের পরও ফিলিস্তিনি মুসলিম যোদ্ধাদের আল্লাহ নির্দেশিত উপায়ে সামান্য প্রস্তুতির যুদ্ধে ভয় পায়। তাদের এই ভয় আল্লাহর সৃষ্টি করে দেয়া। বিশ্বের ২০০ কোটি মুসলমানের এখান থেকে পুনরায় শিক্ষা নেয়ার সুযোগ এসেছে। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের প্রস্তুতি যাইহোক না কেন, তাদের চক্রান্ত খুব দুর্বল। এই থিমটি ধারণ করে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথীদের অনুরূপ প্রস্তুতি নিয়ে সামনে এগুনোর বিকল্প নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠের বিপরীতে জানবাজ মুসলিমদের বিজয় তাহলেই কেবল চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে এগুতে সহযোগিতা করবে। বিজয়ের জন্য পরিবেশের আশায় বসে থাকাকে নয়। বস্তুত আল্লাহর উপর ভরসা করে প্রস্তুতির জন্য প্রত্যেক কুরআনের কর্মীর হৃদয়কে ফিলিস্তিনি বীর যোদ্ধাদের চেতনা আমাদের জাগ্রত করছে। মহান আল্লাহর ঘোষণা- “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর সে অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যা তিনি (এ সাম্প্রতিককালে) তোমাদের প্রতি করেছেন, যখন একটি দল তোমাদের ক্ষতি করার চক্রান্ত করেছিল কিন্তু আল্লাহ তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো। ঈমানদারদের আল্লাহর ওপরই ভরসা করা উচিত।” (সূরা মায়িদা : ১১)
আপনার মন্তব্য লিখুন