post

বিজয়ের একান্ন বছর কিছু অমীমাংসিত রহস্য

গাজী নজরুল ইসলাম

১৬ জানুয়ারি ২০২৩

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোচনা একটি বহুমুখী এবং জটিল সাবজেক্ট। বর্তমানে কোনো দেশ বা রাষ্ট্র এককভাবে একপেশে হয়ে চলতে পারে না। বর্তমান বিশ্বকে বলা হয় গ্লোবাল ভিলেজ। এক জায়গায় কিছু ঘটলে সর্বত্র তা মুহূর্তেই শুধু ছড়িয়ে পড়ে না, তাৎক্ষণিক এর আঘাত-প্রতিঘাত, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সচকিত হয়ে ওঠে, বিভিন্ন দেশের সরকার ও প্রশাসনে, জনমনে ছড়িয়ে পড়ে আশঙ্কা উদ্বিগ্নতা। এর প্রভাববলয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয় রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে এমনকি দেশের-রাষ্ট্রের ভৌগোলিক পরিমণ্ডলেও। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১৯৭১ এর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ পাকিস্তান বাংলাদেশের মধ্যে সংঘটিত হলেও এতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে ভারত, চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপের দেশসমূহসহ এশিয়া প্যাসিফিকের রাষ্ট্রসমূহ। যুদ্ধের ফলে আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে, সাধারণ জনগণও মারাত্মক আশঙ্কায় উদ্বিগ্নতায় প্রহর গুনতে থাকে। একদা রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ভৌগোলিক সীমারেখাও পুনঃ নির্ধারিত হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় নতুন দেশ, যেমন বাংলাদেশ। অনুরূপ ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত, ইরাক- আফগানকে নিয়ে বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রসমূহের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, ইসরাইলের ভৌগোলিক জবরদখল, অকাতরে  মানুষ হত্যা, শক্তিশালীদের তেলসম্পদ কুক্ষিগত করে তাদের দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখা, নেতৃত্বের প্রভাববলয় বিস্তার করা ইত্যাদি। ইদানীং স্বাধীন ইউক্রেনে আধিপত্যবাদী রাশিয়ার আগ্রাসন তারই প্রতিধ্বনি।

অনুরূপ আরো বলা যায় বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের উত্থান-পতন, সৌদি আরব, সিরিয়া, মিসর, ইয়েমেন, ইরান-তুরস্কের অভ্যন্তরীণ কিংবা দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্ব, আবার আরব বসন্তে সরকার পরিবর্তন। এখানেও শক্তিশালীদের নাক গলানো, একে অপরের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি, পক্ষে-বিপক্ষে কাছে টানার  পাঁয়তারা, জোটবদ্ধ হওয়া, আন্তর্জাতিক পানিপথ দখল, সুয়েজ খাল দখল, সাগর দখল, একক ও যৌথ মহড়া প্রদর্শন ইত্যাদি। এসব কিছু রাজনৈতিক পরিস্থিতির আবর্তন বিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের ফল। এসব কিছুর বিপর্যয়ের বলয় থেকে আমাদের বাংলাদেশও একপেশে হয়ে একাকী থাকতে পারে না, চলতে পারে না। এখানেও সময় ও কালের বিবর্তনে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এমনকি অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়। যার করাল ছোবলে আমরা এখন বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত-নিপীড়িত এবং জুলুমের শিকার। 

বাংলাদেশের অবস্থান

বিশ্বরাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে বাংলাদেশের অবস্থানকে মূলত ১৯৭১ সাল থেকে বিবেচনায় এনে বর্তমান পর্যন্ত সমগ্র সময়টাকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

প্রথমভাগ ১৯৭১ থেকে ১৯৯১-বিশ বছর। দ্বিতীয়ত: ১৯৯১ থেকে ২০০৬, পনেরো বছর। তৃতীয়ত: ২০০৬ থেকে ২০২২, ষোলো বছর, মোট একান্ন বছর। এই একান্ন বছরে অনেক চড়াই-উতরাই এবং উত্থান-পতনে বাংলাদেশের জনগণ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে নাটকীয়ভাবে বারবার আন্দোলিত হয়েছে, হয়েছে আবর্তিত এবং চমকিত।

প্রথমভাগ ১৯৭১ থেকে ১৯৯১ সাল। এই বিশ বছর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নিকটতম বছরগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্বাধীনতার স্থপতি মরহুম শেখ মুজিবের পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফেরা, প্রথমে প্রধানমন্ত্রী এবং পরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ, সংবিধানে গণতন্ত্র সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মতো চারটি মূলনীতি সংযোজন, আবার পরে একনায়কতান্ত্রিক বাকশাল কায়েম। একদিকে মারাত্মক মরণঘাতী ’৭৩-৭৪ এর দুর্ভিক্ষ, রংপুরে বাসন্তীদের কলাপাতা ও জালে জড়িয়ে কবরস্থকরণ, অপরদিকে কম্বল চোর আর চাটার দলের দুর্দান্ত আবির্ভাব। গুদামে আগুন, কারখানায় আগুন, ব্যাংকলুট আর দেশব্যাপী হরিলুটের মহোৎসব। অপরদিকে জাসদ-বাসদ বামপন্থীদের মুজিব-বিদ্বেষী বিষোদগারে দেশে অরাজক সৃষ্টির কঠিন পাঁয়তারা। আবার সুবিধাভোগী নেতা-নেত্রীদের মোসাহেবি এবং জি হুজুরের ভূমিকায় পদলেহন করে অর্থের পাহাড় সৃষ্টি, সেইসাথে সুবিধাবাদী মেনন-মতিয়াদের সর্বনাশী গলাবাজি চিৎকারে শেখ মুজিবের চামড়া খুলে ডুগডুগি বাজাবার শ্লেষাত্মক হুঙ্কার। শেখ মুজিবের দরাজ গলায় ‘তিন বছর কিছুই দেবার পারবো না’ মূলক মোহনীয় আবেদনমূলক কথামালা, অপরদিকে স্বাধীনচেতা প্রতিপক্ষ মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ সিকদারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সংসদে আরো দরাজ কণ্ঠে হুঙ্কার- ‘কোথায় সেই সিরাজ সিকদার’? একদিকে গদি রক্ষার্থে রক্ষীবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, বিরোধী দলকে নিষ্পেষণ করে ভারতীয় র, আমেরিকার সিআইএ, রাশিয়ার কেজিবি, ইসরাইলের মোশাদ, মুসলিম বিশ্বের ও আইসির টানাপড়েনের জটিল ও কুটিল আবর্তনে ’৭৫ এর রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডে ইতিহাসের কৃষ্ণ-কালো  ক্যানভাসে শেখ মুজিবের  বেদনাবিধুর জীবনাবসান। 

এর পর আবার পটপরিবর্তন। মসনদ দখলের নানামুখী চক্রান্ত। আওয়ামী নেতাদের শেখ মুজিববিরোধী ভূমিকা। শতাব্দীর নব্য ফেরাউনের পতন হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সহচর আব্দুল মালেক উকিলের গদি দখল, আওয়ামী অমাত্যদের ক্ষমতা লোভের চরম ধৃষ্টতা এবং বিশ্বস্ত মুজিব সহচরদের মীরজাফরী ভূমিকাভিনয়।

এর পরের ইতিহাস আরো রোমাঞ্চকর। সকালে খালেদ মোশাররফের উত্থান-বিকেলে পতন। মিলিটারি ব্যারাক থেকে মেজর জিয়াকে সেনাসমবিব্যাহারে দৃশ্যপটে আনায়ন, সিপাহি জনতার তুমুল উচ্ছ্বাসে গগনবিদারী আওয়াজে বাংলাদেশের পরবর্তী নেতৃত্বের সফল আবির্ভাব। গণতন্ত্রের পুনঃঅভিষেক। বাকশালীতন্ত্রের কবর রচনা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনরুত্থান, সংবিধান পরিবর্তন। প্রথম পরিচ্ছেদে বিসমিল্লাহ সংযোজন, রাষ্ট্রীয় সকল কার্যক্রমে মহান আল্লাহর প্রতি অগাধ আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন। ৮ কোটি বাংলাদেশীর ভাগ্যাকাশে নতুন সূর্যোদয়।

জামায়াতে ইসলামীসহ সকল ইসলামী দলের রাজনৈতিক শুভযাত্রা। বাম-রামদের ক্ষীণকণ্ঠ, ডানপন্থীদের অবাধ গতিবিধি। রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল বিকলতা থেকে মুক্ত হয়ে সচলায়তনে স্বাচ্ছন্দ্যে প্রবেশ। দেশে খাদ্য স্বয়ম্ভরতা অর্জনে সুদূরপ্রসারী খালকাটা প্রকল্প বাস্তবায়নে পানির আধার তৈরির যুগান্তকারী কর্মসূচি গ্রহণ। হিংসা বিভেদ ভুলে সকলে দেশমাতৃকার সার্বিক উন্নয়নে কঠোর পরিশ্রমের প্রস্তুতি। মুসলিম বিশ্বের সাথে যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দেশের সীমানা পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি তথা বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে দাঁড়াবার দৃঢ়প্রত্যয়ে মেজর জিয়ার যুগান্তকারী পদক্ষেপ (SAARC) ‘সার্ক’ প্রতিষ্ঠা। কূটনৈতিক সাফল্যে বাংলাদেশের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি, জিডিপি সূচকের প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা-সংস্কৃতি বিজ্ঞান প্রযুক্তির সকল বলয়ে সমতালে পথচলার উন্মুক্ত সোনালি দ্বার উন্মোচন, জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী শক্তির পুনর্জাগরণ, বাংলাদেশের ইমার্জিং টাইগারের শিরোপা অর্জন।

হিংসুটেরা বসে থাকলো না, প্রমাদ গুনতে লাগলো কী করে এ অপ্রতিরোধ্য জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তিকে প্রতিরোধ করা যায়। সময় ঘনিয়ে দুর্ভাগ্যের কালো কপোলে নেমে এলো অমানিশার ঘোর অন্ধকার। ১৯৮০ সালের এক কালো রাতে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজের নিভৃত কক্ষে দুষ্কৃতকারীদের বুলেটের আঘাতে জীবনপ্রদীপ নিভে গেল ইতিহাসের এক অকুতোভয় সৈনিক দক্ষিণ এশিয়ার সফল নেতৃত্বদানকারী অমিত সম্ভাবনার এক রাজনৈতিক নেতৃত্ব মেজর জিয়ার। ১৯৮১ সাল থেকে শুরু হলো আরেক পটপরিবর্তনের পথরেখা। বাংলাদেশের ক্ষমতায় পুনঃঅধিষ্ঠিত হলেন আরেক অতি-উৎসাহী সেনা অফিসার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। অতীত উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার নিয়ে শুরু হলো তার পথ চলা। গানে কবিতায় বক্তৃতায় প্রেম-ভালোবাসায় মৌজ তুললেন এই দীর্ঘদেহী সেনা অফিসার। ইসলামের সুমহান আদর্শে নিজেকে চিনিয়ে দেওয়ার প্রত্যয়ে সংবিধানে যোগ করলেন ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’। বাহবা পেলেন  বাংলাদেশের কোটি কোটি মুসলিম জনতার। প্রশংসা কুড়ালেন বিশ্বমুসলিম রাষ্ট্রপুঞ্জের। সাথে সাথে তার দ্বিমুখী চারিত্রিক আবরণে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কুটিল আবর্তে চলতে লাগলেন স্বৈরাচারী মানসিকতায়। কাউকে তোয়াক্কা না করে তার একক সিদ্ধান্তে চলতে লাগল রাষ্ট্রযন্ত্র। গড়ে তুললেন জাতীয় পার্টির ব্যানারে অদ্ভুত এক রাজনৈতিক মঞ্চ। এ মঞ্চের তিনি একক অভিনেতা, একক খলনায়ক, একক ভিলেন, একক যোদ্ধা, একক রাজন্য-প্রেমিক। চালাতে লাগলেন একক অভিসার। চারপাশে যেমন জড়ো হতে লাগল ক্ষমতালিপ্সু মোসাহেবদের আনাগোনা তেমনি বাড়তে লাগল অসংখ্য সৌন্দর্যপসারিণীদের বিকিকিনির অপ্সরীমেলা। রাষ্ট্রযন্ত্র হয়ে উঠল একক উথাল-পাথাল একনায়কতন্ত্রের অবাঞ্ছিত শাসনক্ষেত্র। দেশ এবং বিশ্বে পরিচিত হতে লাগলেন বিশ্বসৈ¦রাচার হিসাবে। গণতন্ত্র পুনঃনির্বাসিত হলো দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের সকল অবয়ব থেকে। জনতা বিক্ষুব্ধ হলো। ফুঁসে উঠলো দেশব্যাপী বিদ্রোহ। স্লোগান উঠল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক-গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। বুকেপিঠে আলপনা এঁকে যুবকেরা জড়ো হলো রাজধানীর জিরো পয়েন্টে। স্বৈরাচারের বুলেটে জীবন গেল নূর হোসেনের। জনতা আরো বিদ্রোহী হলো। একদা পতন ঘটলো এরশাদ শাহির স্বৈরশাসনের। চলে গেল স্বাধীন বাংলাদেশের জীবন থেকে বিশটি বছর।

শুরু হলো দ্বিতীয় অধ্যায়

১৯৯১ থেকে ২০০৬। চললো আরো ১৫ বছর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই অধ্যায়কে মোটামুটি বলা যেতে পারে এক সোনালি অধ্যায়। ইতোমধ্যে বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের কালপুরুষ অধ্যাপক গোলাম আযমের সুচিন্তিত ফর্মুলায় দেশব্যাপী দানা বেঁধে উঠলো কেয়ারটেকার আন্দোলনের সফল অভিযাত্রা। দলমত নির্বিশেষে সবাই ঐকমত্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো কেয়ারটেকার ফর্মুলার সরকারের নেতৃত্বে নির্বাচনে। ১৯৯১-এর সাধারণ নির্বাচন হলো ঐ ঐতিহাসিক কেয়ারটেকার ফর্মুলার গভর্নমেন্টের নেতৃত্বে। ঐ নির্বাচনে সফল বিজয় পেলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবং জামায়াতের অধীনে শরিক দলীয় জোট। জনতার অকুণ্ঠ সমর্থনে সরকার গঠিত হলো বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি চলে গেলো বিরোধী শিবিরে। যেমন শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকার তেমন শক্তিশালী বিরোধী দল। পাঁচটি বছর দেশ চললো এক অভূতপূর্ব উন্নয়নের আলোকিত সোপানে। দেশে দেশে প্রশংসা পেল কেয়ারটেকার সরকারের অভিনব ফর্মুলা-যার আবিষ্কারের একচ্ছত্র নায়ক জামায়াতে ইসলামীর নন্দিত আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম। কিন্তু বিধি হলো বাম। বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় যেয়ে শরিক দলগুলোকে তোয়াক্কা না করে প্রশংসা আর উন্নয়নের সকল বিষয়ের দাবিদার হয়ে আবার যেন স্বৈরাচারী হয়ে উঠল। দেশে শুরু হলো পুনরায় গণআন্দোলন। জনগণ নেমে এলো রাজপথে। এ আন্দোলনে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যপট পরিলক্ষিত হলো। আওয়ামী লীগ কাছে টানলো জামায়াতে ইসলামীকে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা আর জামায়াত প্রধান অধ্যাপক গোলাম আযমের পারস্পরিক পরামর্শে আন্দোলনের গতি দুর্বার হলো। বিএনপির নেতৃত্বে জোট সরকারের পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ছোট ছোট শরিক দলসমূহ।

আওয়ামী লীগ এবার ফর্মুলা দিলো কেয়ারটেকার সরকারের বিধানকে সাংবিধানিক রূপ দিতে হবে। একদিকে কেয়ারটেকার ফর্মুলার সাংবিধানিক রূপ দেওয়ার দাবি অপরদিকে এককভাবে চলা তথাকথিত জোট সরকারের প্রধান ক্ষমতাসীন বিএনপির খালেদা জিয়ার পদত্যাগ। এ দুটি দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন তুঙ্গে উঠলো। বিএনপির শেষ রক্ষা হলো না, ক্ষমতা ছেড়ে পুনরায় নির্বাচন দিতে হলো। কিন্তু ঐ নির্বাচনে কেয়ারটেকার ফর্মুলা সংবিধানে সন্নিবেশ না করায় আওয়ামী লীগ-জামায়াতের নেতৃত্বে বিরোধী দল অংশ নিলো না। বিএনপি সরকার ক্ষমতা বলে একটি প্রহসনের পাতানো নির্বাচন করলো। আন্দোলন থেমে থাকলো না। বিএনপি বাধ্য হয়ে সংবিধানে কেয়ারটেকার ফর্মুলা সন্নিবেশ করলো এবং জনদাবিতে ঐ প্রহসনের নির্বাচনের তিন মাসের মধ্যে পদত্যাগ করে ১৯৯৬ সালে পুনঃনির্বাচন দিতে বাধ্য হলো। ওই নির্বাচনে দেশের দুই প্রধান দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন পেয়েও কেউই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলো না। অপরদিকে জামায়াত এমন সংখ্যক সিট পেলো যেটাকে বলা চলে সরকার গঠনে ব্যালান্স অব পাওয়ার। আওয়ামী লীগ ধরনা দিলো আবার জামায়াতকে কাছে টানতে। জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে আবদার করতে দলের ঝানু নেতাদের পাঠানো হলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনের প্রস্তাবে। অধ্যাপক আযমকে জায়নামাজ উপহার দিয়ে কাছে টানার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। এদিকে বিএনপি জামায়াতের নির্বাচিত সদস্যদের সাথে নিয়ে সরকার গঠন করাও সম্ভব হলো না। আওয়ামী লীগ তড়িঘড়ি করে দেশের বাম ও অন্যান্য পন্থীদের সাথে নিয়ে সরকার গঠন করলো। শুরু হলো ১৯৯৬ এ আওয়ামী নেতৃত্বে জোট সরকারের রাষ্ট্রীয়কার্যক্রম। বিজয় এবং সরকার গঠন করতে পেরে আনন্দের আতিশয্যে শেখ হাসিনা বলে বসলো, যে কেয়ারটেকার ফর্মুলার মাধ্যমে ক্ষমতায় এলাম এটি এমন একটি ফর্মুলা যা বিদেশে রফতানি করা যায়। আসলে বিশ্বের অন্যান্য ছোটখাটো রাষ্ট্রপুঞ্জও ভূয়সী প্রশংসা করল বাংলাদেশের কেয়ারটেকার ফর্মুলার গভর্নমেন্টকে। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আওয়ামী লীগ পুনঃ শুরু করলো তাদের পূর্ব একনায়কতন্ত্রের স্বৈরাচারী মানসিকতা, পিতার বাকশালী চেতনায় গণতন্ত্র হত্যার দুর্দমনীয় কার্যক্রম। নিপীড়ন আর নির্যাতনের খড়গ নেমে এলো বিএনপি-জামায়াতের সংগঠন ও জনগণের উপর। প্রশাসনযন্ত্রকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা চালালো ক্ষমতার মোহে। মাতাল হয়ে যা ইচ্ছা তাই বলতে শুরু করল। হুমকি-ধমকি, ভয়-ভীতি, আর খুনখারাবির মাধ্যমে দেশে রক্তগঙ্গার প্র¯্রবণ সৃষ্টি করলো। বিভিন্ন শহরে, গঞ্জে এলাকায় মানুষ হত্যার হোলিখেলা চললো। চট্টগ্রামের এক জনসভায় শেখ হাসিনা গর্জে উঠলেন ‘আরেকটি লাশ পড়লে পাল্টা দশটি লাশ পড়বে, চট্টগ্রামের আওয়ামী নেতারা কি হাতে চুড়ি পরে বসে আছে?’ দেশে খুনোখুনি সৃষ্টি করে পাল্টা হুমকি দিলো বিরোধীদল ও গণতন্ত্রমনা জনগণকে।

বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে আবার গঠিত হলো ২০ দলীয় জোট। শক্তিশালী জোট নিয়ে বিএনপি-জামায়াত দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন গড়ে তুললো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে পুনরায় কেয়ারটেকার সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলো। অনুষ্ঠিত হলো ২০০১ এর সাধারণ নির্বাচন।

এ নির্বাচনে এবার বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠন করলো। এগিয়ে চললো দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রম। দেশে বিদেশে প্রশংসা পেল বিএনপি জামায়াতের জোট সরকারের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক তৎপরতা। আওয়ামী লীগ আবার প্রমাদ গুনলো। তৈরি করলো এককালের স্বৈরাচারী এরশাদ সাহেবের জাপাসহ অন্যান্য কয়েকটি বাম-রাম এবং কিছু বিভ্রান্ত ইসলামী দল নিয়ে এক মহাজোট। ক্ষমতায় গেলে কুরআন-সুন্œাহর বিরুদ্ধে কোনো আইন হবে না বলে প্রতারণার চুক্তি করলো দেশের কয়েকজন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন-ওলামা আল্লামাদের সাথে। বিদেশী ষড়যন্ত্র যুক্ত হলো। ভারতের ইনটেলিজেন্স ব্যুরো ‘র’ প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করলো। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে হুঙ্কার মেরে আন্দোলনের মাঠে নেমে পড়লো বহুরূপী আওয়ামী লীগ। এলো ২০০৬ এ ক্ষমতা বদলের পালা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সাংবিধানিকভাবে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জনাব ইয়াজউদ্দীনের কাছে ক্ষমতা দিয়ে পদত্যাগ করলো। পরের দিন থেকেই আওয়ামী লীগ তাদের পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী সহযোগীদের সাথে নিয়ে শুরু করলো দেশব্যাপী আগুন জ্বালানোর মহোৎসব। মারামারি ভাঙচুর লুটপাটে সমগ্র দেশ অস্থির করে তুললো। শুরু করলো কুখ্যাত লগি-বৈঠার আন্দোলন। রাজধানীসহ রাজপথে শহরে-বন্দরে, গঞ্জে সাপের মতো পিটিয়ে লগি-বৈঠার আঘাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানুষের মরণ নিশ্চিত করে দেশে এক জাহান্নামের পরিবেশ সৃষ্টি করলো। দুর্বল প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দীন সাহেব শুধু বিবশ দৃষ্টি মেলে তা দেখতে লাগলেন। বিদেশী চক্রান্তের জাল বিস্তৃত হলো। তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন উ আহমদের অন্তরাত্মা ক্ষমতার লোভে বেসামাল হয়ে উঠলো। ড. ইয়াজউদ্দীনের নিকট থেকে কী করে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া যায় সেই কুমতলবে বিভিন্ন ধরনের চক্রান্ত চালাতে লাগলেন। কিছু মুখোরোচক বুলি আওড়াবার কসরত করলেন। তার মধ্যে প্রথমত হলো- বিগত সরকারগুলোর আমলে দেশ নাকি দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, অতএব ‘দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার এখনই সময়।’ দ্বিতীয়ত- দেশে রাজনৈতিক নেতানেত্রীসহ বড় বড় আমলা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ‘সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ’ আখ্যা দিয়ে অভিযান চালানো, তৃতীয়ত-খালেদা-হাসিনার পরিবর্তে দেশে ভিন্নধারার রাজনীতি চালু করতে অভিনব ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলার প্রবর্তন করার স্লোগান দেওয়া, চতুর্থত- ‘ড. ইয়াজউদ্দীনের নেতৃত্বে কেয়ারটেকার সরকার হলে কিংবা তার পদত্যাগ নিশ্চিত করে সেনাদের হাতে ক্ষমতা না দিলে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে চাকরিরত বাংলাদেশীদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে’ বলে ভুয়া ইশতেহার প্রচার। 

একদিকে দেশে সেনাশাসনের আবহ তৈরি অপরদিকে উক্তরূপ ভণিতাভিনয়ী রাজনৈতিক কোটেশনভুক্ত স্লেøাগান প্রচারে দেশের জনগণের উপর ভীতিমূলক নৈতিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টিতে মতলব সিদ্ধির অপপ্রয়াস চালানো। শেষ পর্যন্ত ঘটলোও তাই। কালক্ষেপণ না করে উচ্চাভিলাষী সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদ একদা রাতের জমকালো আঁধারে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কতক সেনাসদস্য সমবিব্যাহারে দ্রুতপদে বঙ্গভবনে ঢুকে ভার্সিটির শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী শিক্ষক অরাজনৈতিক দুর্বল ভদ্রলোক ড. ইয়াজউদ্দীনকে চপেটাঘাতের ধাক্কায় পদচ্যুত করে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। কুশীলবদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী এককালে বিদেশ মিশনে কলম পেশায় নিয়োগ থাকা অর্থনীতিবিদ সাম্রাজ্যবাদীদের বশংবদ জনাব ফখরুদ্দীনকে ঠুঁটো জগন্নাথ সরকারপ্রধান বানিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার অভিলাষ পূরণে কার্যক্রম শুরু করলেন। আরেক অতি বাচাল সেনা অফিসার মাসুদ উদ্দীন চৌধুরীকে দুর্নীতি দমনের দায়িত্ব দিয়ে দেশের বেবাক জনগণকে দুর্নীতিবাজের তকমা পরিয়ে কারাগারে আটকের মাধ্যমে দেশকে কয়েদখানায় পরিণত করলেন। ক্ষমতা পেয়ে মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী মুহুর্মুহু ঘোষণা করতে লাগলেন ‘আমরা জাল ফেলবো দুর্নীতির সাগরে, রুই-কাতলা তো ধরবোই, চুনোপুঁটিও বাদ যাবে না। কেননা দুর্নীতি দমনের এখনই সময়।’ শুরু হলো দুর্নীতিবাজদের কালো তালিকা প্রণয়নের কার্যক্রম। গল্পকথার বনহুরের আকস্মিক ভয়াবহ অভিযানের কবলে পড়ার আশঙ্কা নিয়ে তিলে তিলে প্রহর কাটতে লাগলো হতভাগ্য দেশবাসীর। একে একে রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, পুঁজিপতি, দালাল-ফড়িয়া কেউ বাদ গেল না, এমনকি দেশের দুজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীও আটকা পড়লেন দুর্নীতিবাজ ধরার পাতানো জালে। গ্রেফতার হলেন সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা। কিন্তু গ্রেফতার হলেই বা কি হবে! শেখ হাসিনা তারস্বরে মঈন-ফখরুদ্দীনের সেনাশাসিত সরকারকে অভিবাদন জানিয়ে বলে উঠলেন ‘এরা আমাদেরই আন্দোলনের ফসল-চালিয়ে যাও, ধরো বিএনপি জামায়াতের দুর্নীতিবাজদের। তোমাদের পিছনে আমার সমর্থন থাকবে অবিরত।’ গ্রেফতারের মধ্যে শেখ হাসিনার সাথে মঈন-ফখরুদ্দীনের গোপন শলা-পরামর্শ হলো। শেখ হাসিনাকে চিকিৎসার অজুহাতে মুক্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানো হলো। বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা পুনরায় ব্যক্ত করলেন ‘মঈন-ফখরুদ্দীনের সরকার আমাদেরই আন্দোলনের ফসল, তবে তোমরা দেশে যা চালিয়ে যাচ্ছ খুশিমতো চালিয়ে যাও,  আমাদেরটা দেখ, কিছু অসামঞ্জস্য হলে আমি যদি ক্ষমতায় আসি তবে তা রেটিফাই করে দিব।’ এ বক্তব্যেই বুুঝা গেল মঈন-ফখরুদ্দীনের সাথে শেখ হাসিনার গোপন শলা-পরামর্শের আসল মর্ম। শেখ হাসিনা বিদেশ চলে গেলেন। বিদেশের মুক্ত বাতাসে ফুরফুরে মেজাজে নিজেকে নিয়ে, নিজের দলকে নিয়ে আর ১৬ কোটি জনতার দেশকে নিয়ে যা ইচ্ছে তা মন্তব্য চালিয়ে যেতে লাগলেন। বিদেশী সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান এবং কূটনীতিকদের সাথে ব্রিফিং/লবিং অব্যাহত রাখলেন। দেশে চলতে থাকলো ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীনের একচ্ছত্র সেনাশাসন এবং স্বৈরশাসনের একটানা আধিপত্য। 

কারাগার ভরে গেল বিএনপি জামায়াতের নেতা-নেত্রী সমর্থকদের ভিড়ে। খালেদা জিয়া হতাশ-হতভম্ব হয়ে দিন কাটাতে লাগলেন সেনাশাসকদের খুশিমতো নির্ধারিত কারা অভ্যন্তরে। এভাবে চলল একটানা দুটি বছর- ২০০৭ থেকে ২০০৮। দেশে ঘটে গেল অনেক বিপর্যয়। রাজনীতি নির্বাসিত হলো। গণতন্ত্র হলো ভূলুণ্ঠিত। জনাধিকার ধুলায় মিশে গেল। সাধারণ জনগণ হলো অপরিসীম নির্যাতনের শিকার। দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য উন্নয়নের সূচক তলানিতে চলে গেল। সেনাশাসিত ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দীনের সরকার ইতোমধ্যে নতুন এক অভিনব ফর্মুলার হোতা বনে গেলেন। প্রচার হলো ‘টু-মাইনাস থিওরি’ অর্থাৎ খালেদা-হাসিনা মাইনাস হবে দেশের পরবর্তী নেতৃত্বে। দেশবাসীর মধ্য থেকে অনেকেই একদিকে মহিলা নেতৃত্ব বাদ হোক এ আশায় বুক বাঁধার চেষ্টা করলেন, অপরদিকে অনেকেই দুই মহিলার একজন বাদ যাক এ প্রতীক্ষায় প্রমাদ গুনতে লাগলেন। আসলে ক্ষমতাসীনদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় মন্তব্যের দিকে। শেষ পর্যন্ত সেটাই ঘটলো। টু- মাইনাস কার্যকর হবে গাণিতিক কিংবা জ্যামিতিক- কোন ফর্মুলায় তা জনগণ বিরস অংকের কেচুগন্ডুসে প্রথম প্রহরে ঠাহর করতে না পারলেও পরবর্তীতে ২০০৯ এর নির্বাচনে তা স্পষ্ট হলো। শেখ হাসিনা বিদেশে বসে প্রমাদ গুনতে লাগলেন, কবে দেশে ফিরবেন, কবে আবার ক্ষমতার বাগডোর কুক্ষিগত করতে পারবেন। গোপন মেসেজ চালাচালি হতে লাগলো সেনাশাসিত সরকারের সাথে। যোগসূত্র স্থাপিত হলো পার্শ্ববর্তী-দূরবর্তী বিদেশী সরকার এবং তাদের ইনটেলিজেন্সিদের সাথে। একটু অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলেন ‘সেনা সরকারকে আর বেশিদিন থাকা উচিত হবে না। দ্রুত সাধারণ নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা দরকার, বেশি দেরি হলে জনগণ বিদ্রোহী হতে পারে।’ এসব বক্তব্যের ইঙ্গিতে ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিন গংদের বুঝতে বাকি থাাকলো না, শুরু হলো ২০০৮-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রক্রিয়া। অনেক আঁটসাঁট বেঁধে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হলো। প্রায় সব দল এই নির্বাচনে অংশ নিলেও সেনাশাসিত ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিন গংদের যে মনের গোপন অভিলাষ ছিল তাই পূরণ হলো। সেনারা প্রকাশ্যে অংশ নিলো শেখ হাসিনার পক্ষে। নির্বাচনে তাকে বিজয়ী বানিয়ে গদিতে বসিয়ে সালাম ঠুকে বিদায় নিলো বেঈমান প্রতারক ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দিনের বিদেশী মদদপুষ্ট ইতিহাসের জঘন্যতম মীরজাফরী সরকার।

শুরু হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের তৃতীয় অধ্যায়

এ অধ্যায়ের সূত্রপাত ২০০৭-২০০৮ থেকে এবং কার্যকর পরিণতি ২০০৯ থেকে বর্তমান ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ১৬ বছর। 

২০০৮-এর নির্বাচনে সেনাশাসিত তথাকথিত কেয়ারটেকার ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের সরকারের অধীনে নির্বাচনের  প্রসব বেদনায় ভূমিষ্ঠ শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার। ক্ষমতায় এসেই প্রথম এজেন্ডা বাস্তবায়ন পিলখানার লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একমাত্র টার্গেট দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারগণ। যে প্রতারক কতিপয় সেনাদের দ্বারা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেন তিনি ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন সেই সেনারাই ভবিষ্যতে তার কাল হতে পারে। তাই প্রথমে নজর দিলেন তাদের শিরদাঁড়া ভেঙে ধ্বংস করে দিতে। সূচনা করলেন ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। পিলখানা! দেশপ্রেমিক বিডিআর বাহিনীর পিলখানা! বাংলাদেশের হৃদপিণ্ডের একাংশ পিলখানা!- যার পূর্ব নাম ছিল ইপিআর-ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস। দেশপ্রেমিক এই বাহিনী যারা চৌকস পাক আর্মির বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে লড়াই করে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করেছে। স্বাধীনতার পর নাম রাখা হলো ইপিআর এর আদলে বিডিআর। যাদের উদ্দীপ্ত পদচারণায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী (বিএসএফ) বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স সর্বদা ছিল ভীত বিহ্বল। বলা হতো একজন বিডিআরের প্রতিপক্ষ ১০ জন বিএসএফ। বিগত দিনে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে ঐতিহাসিক রৌমারী সেক্টরের ঘটনায় তা পুনঃ প্রমাণিত হলো। সেই বিডিআর-এর পিলখানা, বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ের পিলখানা। শেখ হাসিনার নজর পড়লো সর্বপ্রথম এই পিলখানার দিকে। বিডিআরদের বাৎসরিক দরবারি প্রোগ্রামে শেখ হাসিনার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু কি এক অজ্ঞাত কারণে তিনি ঐ প্রোগ্রামে হাজির থাকলেন না। ঐদিনেই ঘটলো দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ড। একনাগাড়ে ব্রাশফায়ারে নিহত হলো দেশপ্রেমিক ঈমানদার বিডিআরের প্রধান মেজর শাকিলসহ চৌকস ৪০ জন সেনা অফিসার। সেনাবাহিনীকে থমকে রাখা হলো। বিদ্রোহ দমন অভিযানে যেতে দেওয়া হলো না। এখন শোনা যায় তৎকালীন সেনাপ্রধান নাকি অভিযানে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাননি। আবার এ পক্ষ থেকে শোনা যায় নির্দেশনা জারি করেও নাকি সেনারা অভিযানে বের হতে পারেননি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। কোনটা সঠিক আল্লাহ পাকই ভালো জানেন। নিহত সেনা অফিসার বিডিআর সদস্যদের বিদেহী আত্মা আজও ফরিয়াদ করে বলছে, হে আল্লাহ! আমাদের কী দোষ ছিল! দেশমাতৃকার স্বাধীনতা ও সীমান্ত রক্ষায় আমরা অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেছি, জনগণের সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছি, অথচ শত্রুপক্ষের সাথে যুদ্ধে দেশজাতিকে রক্ষার্থে শহীদ হতে পারলাম না অথচ পিলখানায় আমাদের নিজেদের আবাসে নিজেদেরই আত্মাহুতি ঘটলো। আজ পর্যন্ত এর কোনো সুষ্ঠু বিচার এবং প্রকৃত সত্য উৎঘাটিত হলো না। অথচ ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশের গর্বিত সেনাবাহিনীর শিরদাঁড়া। ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা হলো সেনাবাহিনীর ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে। এখন সেনাদের কাজ হলো টেন্ডারের ব্রিজ, রাস্তা, কালভার্ট করা আর আবাসন তৈরিতে ঠিকাদারদের ভূমিকায় অভিনয় করা।

দ্বিতীয় এজেন্ডা 

সংবিধান থেকে কেয়ারটেকার ফর্মুলা সমূলে বিনাশ...

আজিব বিষয় হলো যে, কেয়ারটেকার ফর্মুলা নিয়ে শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগ দেশের ঐ সময়কার সকল বিরোধী দলকে নিয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলে যে কেয়ারটেকার ফর্মুলা সংবিধানভুক্তি হলো, সে ফর্মুলা এত উত্তম যে, বিদেশে রফতানি করা যায় বলে মন্তব্য করা হলো, এবার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে সেই কেয়ারটেকার ফর্মুলা আইন করে সংবিধান থেকে চিরতরে অপসারিত করা হলো, আর তার মোসাহেবেরা তারস্বরে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে বলতে লাগলো কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে দেশে আর কোনোদিন নির্বাচন হবে না। নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। কেননা বিশ্বে কোথাও নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ব্যাস বুঝা গেল, ভিন্ন দল ক্ষমতায় থাকলে তার অধীনে নয়, তখন কেয়ারটেকারের অধীনে, আর নিজ দল ক্ষমতায় থাকলে তখন কেয়ারটেকার নয়, নিজ দলের অধীনেই নির্বাচন- এটাই শেখ হাসিনার দর্শন। এটাই তার আদর্শ। এটাই তার পলিসি। এসব তথ্য উপাত্তের কারণে বোধ হয় বর্তমানে একদল মোসাহেবি কলামিস্ট শেখ হাসিনাকে একজন আদর্শ কালজয়ী দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করে চলেছেন।

তৃতীয় এজেন্ডা

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার...

দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে হবে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যারা বিরোধিতা করেছিল তারা সব যুদ্ধাপরাধী। তাদের এদেশে থাকার অধিকার নেই। বাঁচার অধিকার নেই। রাজনীতি করারও অধিকার নেই। এটাই শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগের সাফ কথা। যেই কথা সেই কাজ। এখন কথা হলো যুদ্ধাপরাধী কারা? সাফ জওয়াব একমাত্র জামায়াত? ঠুনকো অজুহাতে ঠুকে দেওয়া হলো মামলা। একে একে গ্রেফতার করা হলো জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের। প্রহসনের ক্যাঙ্গারু ট্রায়াল বসিয়ে ফাঁসিতে ঝুলানো হলো বিনা অপরাধে। আর জামায়াতে ইসলামকে দলীয়ভাবে অঘোষিত নিষিদ্ধ করা হলো জাতীয় ও স্থানীয় সকল কার্যক্রম থেকে। কী অদ্ভুত রাজনীতি? আমরা দেখেছি ইংল্যান্ড বিশ্বের স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, তাদের একটি প্রদেশ হলো আয়ারল্যান্ড। জনগণ বারবার স্বাধীনতার দাবি করে আসছে দীর্ঘ দিন থেকে। এ নিয়ে তারা মাঠে ময়দানে বক্তব্যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বারবার। ইংল্যান্ড সরকারকে আলটিমেটামও দিয়েছে। কিন্তু ইংল্যান্ডের গণতান্ত্রিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকার কোনদিন তাদের গ্রেফতার করে নাই, তাদের আন্দোলন করার কথা বলার অধিকারও স্তব্ধ করে নাই, প্রতিষ্ঠিত একটি সরকার শুধু এতটুকুই বললো, ইংল্যান্ডের ভেতর থেকে আয়ারল্যান্ডবাসী স্বাধীনতা চাইলে তাদের এলাকার জনগণের স্বাধীন মতামতে গণভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হতে পারে। 

অনুরূপ ইন্দোনেশিয়া সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। পূর্বতিমুরের স্বাধীনচেতা জনগণ স্বাধীনতা চাইলো, কিšুÍ ইন্দো সরকার তাদের পীড়ন করে নাই। ফাঁসিতে ঝুলায় নাই। জনগণের মতামতকে সম্মান করে তাদের স্বাধীনতা দিয়ে দিলো। এমন অনেক উদাহরণ বিশ্বের রাষ্ট্রপুঞ্জের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। অথচ জামায়াতের অপরাধ কী? জামায়াত তো স্বাধীন বাংলাদেশের কোন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে নাই। কোন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নাই। বরং জামায়াতের বক্তব্য ছিল ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষ থেকে যে ত্যাগ তিতিক্ষা, আন্দোলন সংগ্রাম করে হিন্দু-মুসলিম রায়টের শিকার হয়ে ‘টু ন্যাশন থিওরির’ মাধ্যমে  দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে ঐ পাকিস্তানের দুটি অংশ একটি পূর্ব পাকিস্তান, অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। এই দুটি অংশ ভেঙে আলাদা হওয়ার সংগ্রামে কিংবা মুক্তিযুদ্ধে ঐ ভারত নাক গলিয়েছিল, জামায়াতের বক্তব্য ছিল ঐ ভারতের নাক গলানোর বিরুদ্ধে। যে ভারত থেকে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান দুটি অংশ নিয়ে স্বাধীনতা পেল ঐ দুটি অংশের একটি অংশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে তাতে কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু ভারতের মাথাব্যথা নিয়ে। কেননা সকলের স্মরণ থাকার কথা। পাকিস্তানের স্বাধীনতায় ভারতের তৎকালীন হিন্দু নেতারা কোনো মতেই মেনে নিতে পারেননি। র‌্যাডক্লিপ রোয়েদাদে পাক-ভারত সীমানা নির্ধারণের পর ভারতের হিন্দু নেতারা বিশেষ করে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, আগামী ২৫-৩০ বছরের মধ্যে পাকিস্তান টিকবে না, আবার ভারতের সাথে লীন হয়ে যাবে। অন্য কারো মাথায় না থাকলেও জামায়াত নেতৃবৃন্দ ঐ চিন্তা মাথায় রেখে বলেছিলেন, আমরা স্বাধীন হতে পারি। তবে ভারতের সহায়তায় নয়, ভারতের নেতৃত্বে নয়। বিরোধিতা শুধু এখানেই। এর অর্থ এই নয় যে, আমাদেরকে চিরদিন পাকিস্তানের সাথেই থাকতে হবে। বরং পাকিস্তান যখন আমাদের পূর্ব অংশের জনগণের উপর জুলুম নিপীড়ন চালিয়েছিল তখন জামায়াত পাকিস্তানের আচরণের ঘোর বিরোধিতা করে বক্তব্য বিবৃতি পেশ করেছিলো। ইসলামী রিপাবলিক অব পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ইসলামের নাম নিয়ে দেশ স্বাধীন করে দেশকে ইসলামিকায়ন করতে ব্যর্থ হলে জামায়াত পাকিস্তান সরকারের ঐ নীতিরও ঘোর বিরোধিতা করেছিলো। মজার বিষয় এই যে, জামায়াত যখন পাকিস্তানের এমনিতর আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল তখন আওয়ামী লীগের এবং বাম নেতারা তৎকালীন পাকিস্তানের পক্ষ সেজে জামায়াতকে পাকিস্তান বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে খোদ পাক আমলেই জামায়াতকে কোণঠাসা  শুধু নয়, তৎকালীন ‘দেশদ্রোহী’ বানানোর চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগেছিল। কী দ্বিমুখী বীভৎস শয়তানি আচরণ। সেদিন যারা পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে জামায়াতকে পাকবিরোধী কিংবা দেশদ্রোহী বলার চেষ্টা চালালো ১৯৭১  সালে তারাই আবার ভারতের পক্ষ নিয়ে জামায়াতকে বাংলাদেশবিরোধী বানিয়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাতে কসুর করলো না। এটাই কি রাজনীতি? নাকি স্বার্থ হাসিলে ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতাসীনদের লেজুরবৃত্তি করার মোসাহেবি পাঁয়তারা? বিচার্য সচেতন জনগণের কাছে।

চতুর্থ এজেন্ডা

গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার...

দেশে যাহা কিছু ঘটুক না কেন দোষ সব নন্দ ঘোষের। যেমন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিংবা তাদের সরকারের বিরুদ্ধে যদি কোনো দল, কোনো ব্যক্তি সমালোচনা-পর্যালোচনা মূলক কথা বলে, বক্তব্য-বিবৃতি দেয় সঙ্গে সঙ্গে তারা বলে ওঠে ওরা যুদ্ধাপরাধী, ওরা রাজাকার। আর যদি কেউ ইসলাম বা কুরআন-হাদিসের পক্ষে কথা বলে তারাও রাজাকার কিংবা পাকিস্তানের দোসর। তারা এটাও বলে থাকেন তোমাদের আবাস এখানে নয় পাকিস্তানে, তোমরা পিয়ারা পাকিস্তানের আশেক-মাশুক, তোমরা সেখানে চলে যাও। এদেশে থাকার কোনো অধিকার তোমাদের নেই। কী জঘন্য মূর্খতাপ্রসূত অর্বাচীন বক্তব্য। তাদের এই গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারের ফর্মুলায় বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল রাজাকার বনে যান, শহীদ জিয়া দেশদ্রোহী, যুদ্ধাপরাধী হয়ে যান। দেশের অন্যান্য ইসলামী দলগুলো যদি অনুরূপ আচরণ করে তবে তারাও হয়ে যায় যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার না হয় জঙ্গি দাঙ্গাবাজ। তাদের ইসলামী বইপুস্তক সবই বেশখ জিহাদী এবং জঙ্গিবাদে ভরা? ওদের ধরো, মারো, কাটো, জেলে ঢুকাও, না হয় গুম করো চিরতরে নিঃশব্দে সাবাড় করে দাও। এটাই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মতাদর্শ। হিটলারি কায়দায় গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার, রাজনৈতিক স্বামিত্বে বরণ করা হিন্দু ভগবানদের নেহরু ডকট্রিন বাস্তবায়নের সুদূরপ্রসারী নীলনকশা। এসব কারণেই বোধ হয় একদল কলামিস্টের কাছে আওয়ামী নেত্রী একালের সেরা দার্শনিক রাষ্ট্র্রনায়ক।

পঞ্চম এজেন্ডা

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ...

স্বাধীনতার স্থপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল কায়েম করে দেশে মাত্র ৪টি সংবাদপত্র রেখে আর সব সংবাদপত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ করেছিলেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশে অভিনব আইসিটি আইন করে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেছে। স্বাধীনচেতা ঈমানদার দেশপ্রেমিক সাংবাদিকদের কারাগারে ঢুকিয়ে বছরের পর বছর আটক রেখেছে। 

ষষ্ঠ এজেন্ডা 

বাকস্বাধীনতা হরণ...

দেশে কথা বলার অধিকার নেই। মিছিল, মিটিং সমাবেশ নিষিদ্ধ। নিজ আবাসস্থলে দুইজন আত্মীয় নিয়ে খানাপিনা করলে সেটাও হয়ে যায় দেশদ্রোহী মিটিং। তিনজন যুবক একত্রিত হলে তারা হয়ে যায় জঙ্গিবাদের দোসর।

সপ্তম এজেন্ডা

নির্বাচনে কারচুপির ভোটে বিজয় লাভের দানবীয় পদ্ধতি...

- ২০০৮-এর নির্বাচনে ফখর-মঈনদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পূর্ব পরিকল্পনার নীলনকশায় বিজয়ী হওয়া।

- ২০১৪ এর নির্বাচনে প্রতারণা করে সাংবিধানিক পদ্ধতি বজায় রাখার মিষ্টি কথা বলে, নির্ধারিত সময়ে ভোট হয়ে যাওয়ার পর আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পুনরায় নির্বাচন দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাসের অজুহাতে কূটচক্রান্তের মাধ্যমে ১৫৩ জন এমপিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করে ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার তথাকথিত দার্শনিক ফর্মুলায় বিজয়ী হওয়ার এবং অভিনব চক্রান্তের ক্ষমতারোহণে গায়ের জোরে দেশ শাসন ।

- ২০১৮-এর নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ এবং নিরপেক্ষ ভোট হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়তি মজুরির বিনিময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় কামলা বানিয়ে ভোটের পূর্বে তাবৎ বিরোধী দলের প্রার্থীদের কমান্ডো কায়দায় আটক করে জেলে পুরে ভোটের দিন মধ্য রাতে ভোট কেটে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা এবং মহা সমারোহে শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়েছে বলে ইসির মাধ্যমে গলা ফাটানো চিৎকার মেরে দেশ, জনতা, এবং বিশ^কে বোকা বানানোর রঙ্গমঞ্চীয় অভিনয়।


অষ্টম এজেন্ডা

জনগণের ট্যাক্সে বেতনভোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় ক্যাডারে এবং গৃহস্থালি কামলায় পরিণতকরণ...

নবম এজেন্ডা

বিচার বিভাগকে দলীয়করণ...

দলীয় খুনি, ধর্ষক, মাস্তান, চাঁদাবাজদের আইনের আওতায় না এনে মারাত্মক অপরাধে জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য হয়তো বা দল থেকে, কিংবা ছাত্রলীগ হলে কলেজ থেকে সাময়িক বহিষ্কার কিংবা আইনের আওতায় দু’চারটের ফাঁসি হলে কিংবা যাবজ্জীবন হলে দলীয় প্রেসিডেন্টের স্পেশাল ক্ষমতায় আবেদনের প্রেক্ষিতে ক্ষমা প্রদর্শন করে লোভনীয় চাকরি দিয়ে বিদেশে প্রেরণ। আরো বেদলীয় হলে তো রক্ষা নেই, ক্ষমা নেই এরা দেশের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু, রাষ্ট্রদ্রোহী এদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দাও, ফাঁসি দাও ইত্যাদি।

দশম এজেন্ডা

আমলা সিভিল বিভাগকে আত্তীকরণ...

সিভিল প্রশাসন কিংবা আমলাদের এমন কোনো পদ নেই যে পদে দলীয় ক্যাডার ছাড়া চাকরি পেতে পারে। আওয়ামী আমলে চাকরির নতুন বিধান হলো ইন্টারভিউতে কিংবা লাইনে দাঁড়ালে শেখানো বড় কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা কোন দল করো? উত্তর যদি হয় জামায়াত-শিবির, বিএনপি কিংবা অন্য কোনো দল, সঙ্গে সঙ্গে আউট-অযোগ্য যুদ্ধাপরাধী, দেশদ্রোহী। আর যে কোনো লীগের ক্যাডার হলে চাই সে অযোগ্য কিংবা আনফিট তার চাকরি অবশ্যম্ভাবী, এমনকি স্বদেশী মেধাবী বেকারদের বঞ্চিত রেখে বিদেশী নাগরিকত্বধারীদের সরকারি চাকরির গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের আত্মঘাতী এবং দেশদ্রোহী কার্যকলাপ।

এগারোতম এজেন্ডা

মাস্তানি রাজত্ব...

চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ সবই দলীয় ক্যাডার মাস্তানদের একচ্ছত্র দখলে। এখানে কারো কোনো কথা নেই, প্রতিবাদ নেই, বরং বাধা এলে পাল্টা আক্রমণ, মারধর, এমনকি নির্বিচারে খুন-জখম হত্যা করে হলেও টেন্ডারের প্যাকেজ কুক্ষিগত করা।

বারোতম এজেন্ডা

ধর্ষকের পতিতারাজ্য...

ধর্ষকের উৎসব চলছে বাংলাদেশে। পথে, ঘাটে, রেস্তরাঁয়, হোটেলে, স্কুলে, মাদরাসায়, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, হোস্টেলে, কেবিনে, কাননে, দিবাতে, নিশীতে ধর্ষকদের ছড়াছড়ি। কচি শিশু, কিশোরী, যুবতী, বৃদ্ধা, প্রৌঢ়া, বধূ-কন্যা-মাতা কারো রেহাই নেই। ধর্ষণের পরে আবার খুন, লাশ গুম ইত্যাদি যতসব পাশবিক এবং পৈশাচিক কারবার। এর যেন নিবৃত্তি নেই। কোন প্রতিরোধ নেই। এরা যেন অপ্রতিরোধ্য। দেশের নারীসমাজ এদের কাছে যেন চিরন্তন জিম্মি। অপরদিকে ধর্ষক দলীয় হলে জায়েজ, বেদলীয় হলে নাজায়েজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনার মানিকেরা একশত একটা ধর্ষণ করে মিলাদে মিষ্টি বিতরণ করে শিক্ষাঙ্গন কলুষিত করলে সব জায়েজ, বরং তাদের পুরস্কৃত করে লোভনীয় পদে চাকরি, আর মাওলানা মামুনুলরা সস্ত্রীক ভ্রমণে গেলে ধর্ষক বানিয়ে নাজায়েজ ফতোয়া দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ। কেননা ওরা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে। সাম্প্রতিক দেশসেরা ইডেন কলেজকে কামুক নিশাচরদের ভোগের পতিতালয় বনিয়ে দেশের মেধাবী সুন্দরীদের বিভ্রান্ত এবং প্রলুব্ধ করে নেতাকর্তা তথা চরিত্রহীন আমলা-রাজনীতিকদের শয্যাশায়িনী করার জঘন্য পাশবিক খেলার খবর তথা নির্যাতিতাদের ডকুমেন্টারি ছবি প্রকাশিত হয়েছে যা জাতির জন্য লজ্জার এবং কলঙ্কের।

তেরোতম এজেন্ডা

অরক্ষিত সীমান্ত ...

সীমান্তের পাহারাদার বিজিবি (বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) এখন সীমান্তে নপুংসক জিম্মাদার। সীমান্তের ওপার থেকে ভারতীয় বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। লাশ গুম করে কখনো বা ঠুনকো পাতানো দ্বিপাক্ষিক পতাকা বৈঠকে দু-একটি হতভাগ্য বাংলাদেশীর লাশ ফেরত দিচ্ছে ঘটনার দু’পাঁচ দিন পর। ব্রিফিং দিচ্ছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ‘বিষয়টা দুঃখজনক। এমন কাজ বন্ধ হওয়া দরকার’। কিন্তু দুঃখের বিষয় আবার তা তাৎক্ষণিক পুনঃ সংঘটিত হচ্ছে। শুধু তাই নয় হতভাগ্য কিশোরী ফেলানীর লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় দীর্ঘ সময় ঝুলন্ত রেখে ভারতীয়রা প্রতিশোধ নিয়ে অলক্ষ্যে বলতে চাচ্ছে, এ রকমই হবে। অতএব সাধু! তোমরা বাংলাদেশীরা সাবধান! ভারতের মদ গাঁজা ফেনসিডিল স্রােতের বেগে ঢুকছে বাংলাদেশে এতে কোনো বাধা নেই। অথচ দু-একটি গোবৎস ঢুকলে ভগবানের অপমান বিধায় বাঙালি মুসলমান। ওদের ভাষায় ‘ম্লেচ্ছা-যবনদের’ রক্ষা নেই। কতবার পতাকা বৈঠক হলো, কতবার রাজনৈতিক সমঝোতা হলো, কতবার ভারতীয়রা দুঃখ প্রকাশ করলো কিন্তু সব ফক-ফিকার।

চৌদ্দতম এজেন্ডা

জাতীয় প্রেম...

এত কিছুর পরেও বাংলাদেশ-ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে, হাইকমিশনার লেবেলের উচ্চপর্যায়ে কূটনীতিকদের অতি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলতে শুনি ‘ভারত-বাংলাদেশের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক।’ (নাউযুবিল্লাহ বলবো কিনা), ‘বাংলাদেশ ভারতের আত্মার সম্পর্ক’, ‘বাংলাদেশ ভারত এক মায়ের দুই সন্তান, এক বৃন্তে দুটি ফুল’ ইত্যাদি ইত্যাদি মহা বচন। এসব বচন নিয়ে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করছি না। জনগণই ব্যাখ্যা করবেন বলে আশা করছি।

পনেরোতম এজেন্ডা

বন্ধু রাষ্ট্রের দাদাগিরি...

ভারতের খারাপ আচরণের কোনো প্রতিবাদ নেই। এ প্রতিপাদ্য বিষয়ে শুধু একটি ঘটনার উল্লেখ করবো। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের বিজয়-এটা আমাদের অহঙ্কার। আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরব গাথার এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি হানাদার পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করে। এ যুদ্ধ তৎকালীন পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের সাথে পূর্বাংশের। আর এ লড়াই লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত। আমরা প্রতি বছর ২৬ শে মার্চ সগৌরবে পালন করি স্বাধীনতা দিবস। ইতিহাসের সাক্ষীকে সমুন্নত রেখে নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা বিবৃতি, সেনাদের কুচকাওয়াজ, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিষ্ঠানভিত্তিক দিবস পালন এবং বিভিন্ন মহলের উৎসবমুখর কর্মসূচি পালন  করে আমরা এ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশীদের মুক্তির সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। কিন্তু তথাকথিত বন্ধুরাষ্ট্র ভারত কী বলে?-তাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেতৃবৃন্দ কী বলে? তারা স্পষ্ট করে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের লড়াকু সংগ্রামকে ম্লান করে দিয়ে তারাই বরং যুদ্ধ করে পাকিস্তান থেকে আমাদের স্বাধীনতা পাইয়ে দিয়েছে বলে তারস্বরে চিৎকার করে তারা তাদের রেডিও-টেলিভিশন বেতার মিডিয়া টুইটারে সংবাদপত্রে প্রচার করে, প্রকাশ করে এই বলে যে, ‘একাত্তরের যুদ্ধ ছিল ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ।’-একাত্তরের আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যদি ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ হয় তাহলে আমাদের স্বকীয়তা স্বাধীনতা এবং আমাদের লড়াই-সংগ্রামের অস্তিত্ব থাকলো কোথায়? ভারতের ঐ উক্তির মধ্যে অতি সূক্ষ¥ভাবে তারা কি এই কথাটাই বলতে চাচ্ছে না যে, ‘আমরা মহাভারতবর্ষ, আধিপত্যবাদী পাকিস্তানের সাথে লড়াই সংগ্রাম করে তাদের কবল থেকে বাংলাদেশ নামক এক নতুন রাজ্য অধিকার করে নিয়েছি। আর এর কৃতিত্ব একমাত্র আমাদেরই অর্থাৎ ভারতবাসীদের।’ যদি তাই না হবে তবে কেন ভারতীয়দের ঐ মিথ্যা বচনের কোনো প্রতিবাদ আমরা করছি না। আজ স্বাধীনতার ৫১ বছরের প্রতি বছরেই ভারত একই বচন উক্তি করে বিশ্বকে বোঝাতে চায় এবং আমাদের মানাতে চায় যে বাংলাদেশ-ভারতেরই তৈরি করা ফসল। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে আমরাই যুদ্ধ করেছি আমাদের যুবকেরা- সৈনিকরাই যুদ্ধ করে নতুন বাংলাদেশ তৈরি করেছে এবং এ বিজয় সম্পূর্ণ আমাদের। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় সৈনিক মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু যোদ্ধা মরহুম মেজর জলিলের লেখা ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’ বই এ তো তারই প্রতিধ্বনি অনুরণিত হয়ে ওঠে। বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলকে নিবেদন জানাই।

লেখক :  বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সংসদ সদস্য

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির