শুরুর কথা
পাকিস্তান নামক তৎকালীন পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের দেড় হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত দু’টি অঞ্চলের একটি ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’ যা আজকের বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশগণ প্রায় দু’শ বছরের শাসন গুটিয়ে ‘ভারত উপমহাদেশ’ ছেড়ে নিজেদের দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এতদঞ্চলে জন্ম নেয় ‘পাকিস্তান’ ও ‘ভারত’ নামক দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ‘ভারত’ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই দ্রুত একটি ‘সংবিধান’ প্রণয়ন করে, ‘গণতন্ত্রকে’ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় এবং অল্প সময়ের মাঝেই ‘টহরঃু ধসড়হম ফরাবৎংরঃু’ নামক ঘবযৎঁ ফড়পঃৎরহব সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যার কলমের জোরে, পাকিস্তানের জন্ম হয়, সেই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষিত দছঁৎধহ রিষষ নব ড়ঁৎ পড়হংঃরঃঁঃরড়হ' অচিরেই কি বিস্মৃত হলো। পাকিস্তান না পারলো ‘কুরআনভিত্তিক সংবিধান’ প্রণয়ন করতে, না পারলো রাজনীতিতে কোনো ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ গড়ে তুলতে, আর না পারলো দেশবাসীকে কোনো ঐক্যের সূত্রে গাঁথতে। যাই হোক, অবশেষে বঞ্ছনা, নিপীড়ন, উপেক্ষার হাত থেকে বাঁচার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাস দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত হয়। আমরা লাভ করি স্বাধীনতা। একটি লাল-সবুজের পতাকা। একটি স্বাধীন জাতীয় চেতনা, একটি রাষ্ট্র।
রাষ্ট্র লাভ করেছি আমরা, এটাকে চালিয়েছি আমরা। আবার এই রাষ্ট্রটিকে ‘তলাবিহীন’ ঝুড়ি বলেছিলেন কেউ কেউ। ৫০টি বছর অতিক্রম করে বাংলাদেশ এখন অর্ধশত বছরের পরিণত রাষ্ট্র। ’৭১ এ জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, আজকে তা দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটিতে। একটি দীর্ঘ সময়ে দেশটি শাসন করেছে স্বৈরাচার। দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মদানের মধ্য দিয়ে অতঃপর ফিরে আসে গণতন্ত্র। বারবার হাত বদল হলেও রাষ্ট্র হয়নি স্থিতিশীল, অর্থনীতি হয়নি স্বয়ম্ভর, সংস্কৃতি হয়নি শেকড়কেন্দ্রিক।
জনের সাথে ধনেও বাড়ার কথা ছিল বাংলাদেশের, বাড়ার কথা ছিল মনেও। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। জনে বেড়েছি জ্যামিতিক হারে, ধনে বাড়ছি শম্বুকগতিতে, সে তুলনায় মনের দিকে থেকে পড়ে আছি যোজন যোজন দূরে। পরনিন্দা ও পরশ্রীকাতরতা ছাড়েনি আমাদের।
ঐক্য যেখানে এগিয়ে যাওয়ার শর্ত সেখানে অনৈক্য এসে বাসা বেঁধেছে। আমাদের ঘরে বাইরে অনৈক্য, অনাচার, অবিশ্বাস আর অনাবশ্যক তর্ক-বিতর্ক আমাদের জাতীয়ভাবে পিছিয়ে রেখেছে। এত ছোট দেশে এতগুলো দল, সেই সব দলের মাঝে এতসব দলাদলি! এই এক অদ্ভুত স্বদেশ। মাঝখানে একবার আমরা ঊসবৎমরহম ঃরমবৎ হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু আবার ঘুমিয়ে গেছে যেন বনের বাঘ বনের মাঝে। বিশে^র দরবারে একটি অনুন্নত, অনৈক্য পীড়িত, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা জাতি হিসেবে পরিচয় দিতেও আমাদের খারাপ লাগে। মানুষ হ্যাটট্রিক করে খেলায় আর আমরা করি দুর্নীতিতে। এর জন্য কে দায়ী? অবিমৃষ্যকারী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত আমলাগণ, অসচেতন সাধারণ জনগণ? কে? এ নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে, তবে সবাইকে ঢালাওভাবে দোষী করে লাভ নেই।
এই ছোট্ট নিবন্ধে আজ কয়েকটি অমীমাংসিত বিষয় উত্থাপন করা হচ্ছে। দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে এসব বিষয়ে সঠিক ও সম্যক ধারণা জরুরি। প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে আমরা ইতিহাস বিস্মৃত, অজ্ঞতায় নিমজ্জিত হয়ে অন্যায়ভাবে ব্যবহৃত হতে পারি না। পারি না অন্যায়ভাবে প্রতারিত হতে। ৫০ বছর পরও আমরা বিতর্কে লিপ্ত, বিগ্রহে বিধ্বস্ত, হতবুদ্ধি, আদর্শহীন একটি জাতি, কিন্তু কেন?
সংকটাবর্তে আমাদের ইতিহাস
ইতিহাস অধ্যয়ন ছাড়া কোনো জাতি সামনে যেতে পারে না। জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সে জাতির সঠিক ইতিহাস জানানোর সুষ্ঠু ও আনুষ্ঠানিক আয়োজন করা জাতীয় নেতৃবৃন্দের একটি মহান দায়িত্ব। সে জন্যই পৃথিবীর সব প্রাগ্রসর জাতি ইতিহাসসচেতন ইতিহাসসন্ধানী এবং ইতিহাসবিস্তারে আগ্রহী।
ইতিহাসকে বলা হয় জাতির দর্পণ। ঐরংঃড়ৎু রং ঃযব সরৎৎড়ৎ ড়ভ ধ হধঃরড়হ. জাতির উত্থান পতনের দলিল ইতিহাস। ছেলে-মেয়েদের ছোটবেলা থেকে ইতিহাস শোনাতে হয়। জাতীয় বীরদের কাহিনী, ইতিহাসের বিখ্যাত স্থান পরিদর্শন, পর্যায়ক্রমে ইতিহাসের সাথে তাদের পরিচয় হওয়া- তাদের মন মানস ও হৃদয়বৃত্তির বিকাশে সহায়তা করে। তবে হ্যাঁ, তাদের কাছে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার আয়োজন থাকতে হবে।
ইতিহাস কিভাবে তৈরি হয়?
হ্যাঁ, ইতিহাস নির্মিত হয় মানুষের হাতে। আবার লিখিতও হয় তাদের হাতে। ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহকে একেকজন একেকভাবে মুদ্রিত করে। কেউ কেউ ইতিহাস রচনার ও মুদ্রণের কাজ করেন। এ জন্যই সম্ভবত বলা হয় হয়. "ঐরংঃড়ৎু রং ৎিরঃঃবহ নু ঃযব ারপঃড়ৎং". সুতরাং সাধারণত ইতিহাসে অনেক বিকৃতি স্থান লাভ করে। এসব বিকৃতি প্রধানত কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন এর মতো ঘটনার অব্যবহিত পরে শাসকগোষ্ঠীর মর্জিমতো ঘটে থাকে। এরপরও, সত্যসন্ধানী ইতিহাসবিদগণ চুপ করে থাকেন না। ইতিহাসের গভীরে গিয়ে ঝিনুক কুড়ানোর মতো করে তারা সত্য বের করে আনেন। একাডেমিক প্রয়াসের মধ্য দিয়ে তারা ইতিহাসের সত্য নিংড়িয়ে জাতিকে সঠিক কাহিনীর মুখোমুখি করেন।
আমরা বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের জনগণ নয় মাস স্থায়ী একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম ভূ-খণ্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছি, ২৫ বছর ধরে যে বঞ্চনার শিকার ছিলাম সেখান থেকে মুক্তি পেয়েছি, বিশে^র বুকে একটি একটি সংগ্রামী জাতি হিসেবে ইতিহাস গড়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য হচ্ছে, আমাদের ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের কোনো শেষ নেই। একজন আমেরিকান, আফ্রিকান, ভারতীয় বা সিঙ্গাপুরবাসী তার দেশের ইতিহাস জানে, প্রত্যেকে তারা একই রকম ইতিহাস জানে, অভিন্ন উৎস থেকে জানে। কিন্তু, আমরা জানি না। এটি আমাদের জন্য একটি বেদনাদায়ক বিষয়।
এক কথায় বলা যায়- পঞ্চাশ বছরেও আমরা সর্বজনগ্রাহ্য একটি নন্দিত ইতিহাস তৈরি করতে পারিনি। এর কারণ নানাবিধ। আমার মনে হয় নিচের কারণগুলোও প্রণিধানযোগ্য।
এক. স্বাধীনতার পরপরই সরকারি উদ্যোগে একটি দলীয় প্রভাবমুক্ত, পক্ষপাতমুক্ত ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। ইতিহাসের অংশ হিসেবে যা কিছু আমাদের হাতে আছে তা পূর্ণাঙ্গ ও একাডেমিকভাবে তৈরি করা গ্রহণযোগ্য ইতিহাস নয়।
দুই. আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে ইতিহাস পাঠকে অপরিহার্যভাবে সিলেবাসভুক্ত করা হয়নি। শ্রীলঙ্কার মতো দেশেও যে কোনো বিষয়ে পড়ালেখা করতে গেলে প্রত্যেক ক্লাসে/সেমিস্টারে ১০০ নম্বরের ইতিহাস পড়তে হয়। আমাদের এখানে ইতিহাসের ছাত্র-ছাত্রীরা ব্যতীত অন্যরা ইতিহাস সচেতন নন এবং তা জানতেও আমরা আগ্রহী নই। এমনকি ইতিহাসের ছাত্ররাও সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিফহাল নন।
তিন. যা কিছু ইতিহাসের বই-পুস্তক পাওয়া যায় তাতে অনেক ক্ষেত্রেই বিকৃতির অভিযোগ রয়েছে। অতিমাত্রায় ইতিহাস বিকৃতি আমাদের ইতিহাসের মৌলিক বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। দলীয় ও সংকীর্ণ গোষ্ঠীচিন্তা দ্বারা প্রভাবিত, ইন্টারপ্রিটেশন, ইতিহাস রচনার বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই ইতিহাসের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা দরকার। আশা করি কেউ না কেউ এক্ষেত্রে সঠিক উদ্যোগ নিয়ে জাতিকে বিভ্রান্তি ও অনৈক্যের হাত থেকে রক্ষা করবেন।
মুক্তিযুদ্ধ : কে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে ?
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এটি। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সদস্যদের যে ‘ক্র্যাকডাউন’ হয় তা ছিল হঠাৎ বজ্রপাতের মতো। সে রাতে যে তাণ্ডব হয়েছে তা ছিল কল্পনাতীত। এই ঘটনার পরপরই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হয়ে যান। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এদিক সেদিক ছুটাছুটি করে অনেকেই তড়িঘড়ি করে সীমান্তের ওপারে পালিয়ে যান। বলা যায় পরদিন থেকে বিভিন্ন স্থানে জনগণ একটি প্রচণ্ড রকমের গণবিস্ফোরণ শুরু করলে তাইই পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে সংগঠিত হয়। কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের একক দাবিদার হতে পারেন না।
আমরা এখনও বিতর্ক করছি- স্বাধীনতার ঘোষক কে? বঙ্গবন্ধু না মেজর জিয়া? আদৌ কি এ বিতর্কের প্রয়োজন আছে? ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়- “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।”
বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ছাত্রনেতৃবৃন্দের চাপে পড়েই এই ঘোষণা দিয়েছিলেন অপর দিকে ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকেও তিনি চাপে ছিলেন। তিনি এই ঘোষণা দেওয়ার পর আবার ইয়াহিয়ার সাথে বৈঠকও করেছিলেন। ইতিহাসের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মাঝে একটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু কি আদৌ স্বাধীনতা চেয়েছিলেন নাকি তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন?
যা হোক মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে নয় মাস। নয় মাস যুদ্ধ চলছে মুক্তিযোদ্ধদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর। সেক্ষেত্রে অস্ত্রশস্ত্রের বড় জোগান এসেছে ভারত থেকে। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার ইন চিফ্, জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। এ যুদ্ধে অকুতোভয় সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা জীবনপণ লড়াই করেছেন। ৯ জন সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের আপামর লড়াকু মানুষ লড়াই করেছেন। এদের অন্যতম ছিলেন জিয়াউর রহমান, মেজর জলিল ও সফিউল্লাহ প্রমুখ।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের দেশে যেসব ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাগণ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অংশ নিয়েছিলেন তাদের কয়েকজন- “মেজর জেনারেল সুখবন্ত সিং, মেজর জেনারেল লছমান সিং ও মেজর জেনারেল সুজন সিং উবনেসহ বেশ কিছু সংখ্যক ভারতীয় সামরিক অফিসার ১৯৭১ এর ঘটনাবলির উপর গ্রন্থ রচনা করেন। এসব গ্রন্থে দেখানো হয়েছে যে ভারতীয় সেনাবাহিনীই পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা ‘উপহার’ দিয়েছে। প্রতিটি গ্রন্থই বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে বিরূপ ও কঠোর মন্তব্য করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আসলে ভারতীয়দেরই অবদান। তবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের নামে অনেক গল্প চালু আছে।
ভারতীয়দের এইসব কর্মকর্তার ব্যাপারে আমরা কখনো আওয়ামী লীগ বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কাছ থেকে কোনো প্রতিবাদ পাই না। এর অর্থ কি তাহলে এই যে তারা যা বলছে আমরা তা মেনে নিচ্ছি?
আমরা বিশ^াস করি, একাত্তরের অকুতোভয় দামাল ছেলেরাই মায়ের বুক ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এক মহান মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রামের চেতনায়। সেই চেতনার কোনও খাদ ছিলো না। আর ছিল না বলেই তিরানব্বই হাজার প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সৈন্যের বিশাল বহর, সশস্ত্রবাহিনী অল্প সময়ের ব্যবধানে পরাজিত হতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোথাও কিন্তু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ^াস, ইসলামী মূল্যবোধ বা দেশপ্রেমের চেতনার পরিপন্থী কিছুই ছিল না। আমাদের মায়েরা, দাদা-দাদীরা তাহাজ্জুদ পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দোয়া করতেন। সে সব আমাদের ভুলে গেছে চলবে না।
মুক্তিযোদ্ধা বলতে তাই আজ কেবল গোষ্ঠীবিশেষ বা দল বিশেষকে কোনো কৃতিত্ব দেওয়া চলবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের অসংখ্য সন্তান আজ বাংলাদেশে ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধ কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র বানানোর মতলবে সংঘটিত হয়নি।
রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মাঠের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান
১৬ই ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের দিন। সেদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অনুষ্ঠান। আনুষ্ঠানিক এই আয়োজনে ভারতীয় সেনাকর্মকর্তা মেজর জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণ করেন পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তা মেজর জেনারেল নিয়াজি। তাহলে কি এটি ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান? কেন সেদিন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীকে সে অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। কেন আত্মসমর্পণের দলিলে তাঁর স্বাক্ষর নেয়া হয়নি? কেনই বা, তাঁকে সাক্ষী হিসেবেও রাখা হয়নি।
এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়ার অধিকার রাখি আমরা। বর্তমানে যেহেতু, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে সেহেতু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ জাতির সামনে এ অমীমাংসিত বিষয়ে মীমাংসাকারী বক্তব্য প্রদান করতে পারে।
১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। মেজর আব্দুল জলিল বলেন, নবম সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত থাকলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্তৃপক্ষ আমাকে (মেজর জলিল) একরকম জোর করেই পেছনের সারিতে ঠেলে দেয়। আমার প্রতিপক্ষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল দলবীর সিংকে দিয়েই সেই আত্মসমর্পণের নেতৃত্ব বজায় রাখা হয়। এসব কী অর্থ বহন করে?
যুদ্ধবন্দী বিনিময় : সিমলা চুক্তি। কার স্বার্থে কী হলো?
“মুক্তিযুদ্ধের সময় অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে যারা বাংলাদেশে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ইত্যাদির সাথে জড়িত ছিল তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার ছিল- এ বিষয়ে দ্বিমতের কোনোই অবকাশ নেই। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৫০০ জন পাকিস্তানিকে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করেছিলেন। পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা কমিয়ে ১৯৫ জন স্থির করা হয়। শেষ পর্যন্ত এই ১৯৫ জনের একজনকেও বিচারের মুখোমুখি করা হলো না কেন? কেন বাংলাদেশের মতামতের কোনো তোয়াক্কা না করে ভারত পাকিস্তানের সাথে সিমলা চুক্তি সম্পাদিত করে এবং সে অনুযায়ী ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীসহ আত্মসমর্পণকারী ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের সকলকেই পাকিস্তানের হাতে হস্তান্তর করে এবং বিনিময়ে বন্দী ভারতীয় সৈন্যদের মুক্ত করে।
এখন প্রশ্ন হলো সিমলা চুক্তির ফলে কে লাভবান হলো? বাংলাদেশ কী পেলো? আজ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন আসে তখন মনে পড়ে দালাল আইনে আটককৃত ৩৭,৪৩১ জন বন্দীর মাঝে বিচারে অপরাধী সাব্যস্ত হয় ৭৫৬ জন। বাকিরা বেকসুর খালাস হয়। এবং বঙ্গবন্ধু সকল অভিযুক্তকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
জন্মের অর্ধশত বর্ষ অতিক্রম করলেও দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি তথা আর্থসামাজিক অবস্থার কোনো স্থিতিশীলতা তৈরি হয়নি। প্রতিটি বিষয় নিয়ে রয়েছে মত দ্বৈধতা, পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি, হিংসা-বিদ্বেষ এবং কথায় কথায় একে অন্যকে উড়িয়ে দেবার, গুঁড়িয়ে দেবার হুমকি।
জানি না আর কতদিন চলবে এই মহারণ! আর কতদিন ভাঙনের এই সুর বাজবে! আর কতদিন আমরা খোঁড়াতে খোঁড়াতে, গুমরে কেঁদে কেঁদে পার করবো এক একটি অমানিশা ঢাকা রাত। এই ঘোর অমানিশার কালো থাবা থেকে বাংলাদেশকে সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ দেওয়ার জন্য আজ চাই তারুণ্যের বোধোদয়, সিসাঢালা প্রাচীরের মতো তাদের মধ্যকার ঐক্য এবং দেশ ও জাতির প্রকৃত দুশমনদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ইস্পাতদৃঢ় এক নিরন্তর লড়াই।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আপনার মন্তব্য লিখুন