post

বিবর্তনবাদ

মূল : হারুন ইয়াহিয়া অনুবাদ : অধ্যাপক খোন্দকার রোকনুজ্জামান

১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬
[গত সংখ্যার পর] ‘পৃথিবীর বাইরে’ তত্ত্বের পেছনে কী আছে? আমরা যেমনটি দেখলাম, পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সূত্রপাত- এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটাকে নিশ্চয়তা দেয়ার বা সমর্থন করার মত কোনো আবিষ্কার হয়নি। যাহোক, যখন এই ধারণা প্রদানকারী বিজ্ঞানীরা ঐদিকে লক্ষ্য দিতে শুরু করেন, তখন তার পেছনে কারণ ছিল এই যে, তাঁরা এক গুরুত্বপূর্ণ সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। সত্যটি হলো এই যে, আকস্মিকতার ফল হিসেবে ভূপৃষ্ঠে প্রাণের উদ্ভব সমর্থনযোগ্য নয়। এটি উপলব্ধিতে এসেছে, ভূপৃষ্ঠে প্রাণের কাঠামোয় যে জটিলতা প্রকাশ পেয়েছে, তা কেবল বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ পরিকল্পনার ফসল হতে পারে। আসলে, মহাশূন্যে প্রাণের অস্তিত্ব সন্ধানকারী বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীগণ বিবর্তনবাদের যুক্তি প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। উভয়েই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী : ফ্রেড হোয়েল একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জীব-গণিতবিদ, এবং ফ্রান্সিস ক্রিক হলেন আণবিক জীববিজ্ঞানী। একটি বিবেচ্য বিষয় হলো, যেসব বিজ্ঞানী মহাশূন্যে প্রাণের উৎস খুঁজছেন, তাঁরা আসলে বিষয়টির কোনো নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন না। হোয়েল, বিক্রম সিংঘে, ক্রিকের মত বিজ্ঞানীরা এই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে আরম্ভ করেছেন যে, প্রাণ এসেছে মহাশূন্য থেকে। কারণ, তাঁরা উপলব্ধি করেছেন, প্রাণের উদ্ভব আকস্মিকভাবে ঘটা সম্ভব ছিল না। যেহেতু দৈবক্রমে পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা হওয়া অসম্ভব ছিল, সেহেতু তাঁদেরকে মহাশূন্যের একটি বুদ্ধিমান পরিকল্পনার উৎসকে মেনে নিতে হয়েছে। যাহোক, এই বুদ্ধিমান পরিকল্পনার উৎসের ব্যাপারে তাঁদের পেশ করা মতবাদ পরস্পরবিরোধী এবং অর্থহীন। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এবং  জ্যোতির্বিজ্ঞান এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি ঘটে এক বিপুল বিস্ফোরণের ফলে ১২-১৫ বিলিয়ন বছর আগে; এটা মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং নামে পরিচিত। মহাবিশ্বের সকল বস্তু অস্তিত্বে এসেছিল সেই বিস্ফোরণ থেকে। এই কারণে, ভূপৃষ্ঠে প্রাণের উৎস খুঁজতে মহাবিশ্বের অন্য বস্তুভিত্তিক জীবনকাঠামোয় অনুসন্ধান করতে চাইলে ব্যাখ্যা করতে হবে, কিভাবে সেই জীবনকাঠামো অস্তিত্ব¡ লাভ করল। এটার অর্থ হলো এই যে, এ রকম ধারণা আসলে সমস্যার সমাধান করে না, বরং এটাকে আরো এক ধাপ পেছনে নিয়ে যায়। (বিস্তারিত জানতে দেখুন হারুন ইয়াহিয়া লিখিত The Creation of the Universe  কিংবা Timelessness and the Reality of Fate গ্রন্থ) আমরা লক্ষ্য করেছি, পৃথিবীর বাইরে থেকে প্রাণের আগমন তত্ত্ব বিবর্তনবাদকে সমর্থন করে না। বরং এটা এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি, যা বিবর্তনবাদকে অসম্ভব বলে প্রকাশ করে, এবং এই ধারণা পোষণ করে যে, বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ পরিকল্পনা ছাড়া প্রাণের আর কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না। যেসব বিজ্ঞানী এই ধারণা প্রদান করেছিলেন, তাঁরা শুরুটা করেছিলেন সঠিক বিশ্লেষণ দিয়ে, কিন্তু ভুল পথে অগ্রসর হয়েছেন এবং বোকামি করে পৃথিবীর বাইরে প্রাণের উৎপত্তি সন্ধান করেছেন। এটা স্পষ্ট যে, ‘পৃথিবীর বাইরে’ ধারণা প্রাণের উৎপত্তির কারণ দর্শাতে পারে না। এমনকি আমরা যদি কয়েক দন্ডের জন্য মেনেও নিই যে, ‘পৃথিবীর বাইরে’ প্রাণ আছে, তাহলেও এটা স্পষ্ট যে, তারা আকস্মিকভাবে অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না। তাদেরকেও অবশ্যই বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ পরিকল্পনার ফসল হতে হবে। (এর কারণ হলো, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন বিজ্ঞানের নিয়ম-কানুন মহাবিশ্বের সর্বত্র একই রকম, এবং এরা প্রাণকে আকস্মিকভাবে আবির্ভূত হওয়া অসম্ভব করে তোলে)। এর থেকে এটাই দেখা যায় যে, স্রষ্টা যিনি বস্তু ও সময়ের ঊর্ধ্বে, এবং অসীম ক্ষমতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী, তিনি এই মহাবিশ্ব এবং এর মধ্যকার সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। ১১.    পৃথিবীর বয়স যে চার শ’ কোটি বছর- এই বাস্তবতা কেন বিবর্তনবাদকে সমর্থন করে না? বিবর্তনবাদীরা তাদের দৃশ্যপটের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন প্রকৃতির প্রভাব এবং আকস্মিকতাকে। এটা করতে গিয়ে তারা যে ধারণার আড়ালে সবচেয়ে বেশি আশ্রয় গ্রহণ করেন, তা হলো ‘প্রয়োজীয় সময়’। উদাহরণস্বরূপ, ডারউইনের সমর্থক জার্মান বিজ্ঞানী আর্নস্ট হিকেল দাবি করেন যে, সাধারণ কাদা থেকে জীবন্ত কোষের উদ্ভব ঘটতে পারে। জীবন্ত কোষ আসলে কতটা জটিল বিংশ শতাব্দীতে এসে এটা উপলব্ধির সাথে সাথে এই দাবির বোকামি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু বিবর্তনবাদীরা এই সত্যটি আড়াল করে চলেন ‘প্রয়োজনীয় সময়’ নামক ধারণা দিয়ে। এটা করার মাধ্যমে তারা সমস্যাটি থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে চেষ্টা করছেন। প্রাণ কিভাবে আকস্মিকতার ফলে উদ্ভব হলো- এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পরিবর্তে তারা এটাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেন। তারা এই ধারণা দেন যে, সুদীর্ঘ সময়ের পরিক্রমা প্রাণের উদ্ভব ও বৈচিত্র্যের জন্য সহায়ক। এটা করতে গিয়ে তারা সময়কে সদা-উপকারী হিসেবে উপস্থাপন করেন। উদাহরণস্বরূপ, তুর্কি বিবর্তনবাদী অধ্যাপক ইয়ামান ওরস বলেন: “আপনি যদি বিবর্তনবাদকে পরীক্ষা করতে চান, তাহলে পানিতে যথাযথ মাত্রায় মিশ্রণ রাখুন, কয়েক মিলিয়ন বছর অপেক্ষা করুন। আপনি দেখবেন, কিছু কোষের উদ্ভব ঘটেছে।” (Conference on the Theory of Evolution. June 3, 1998) এই দাবি অত্যন্ত অযৌক্তিক। এ-রকম কিছু ঘটতে পারে- তার কোনো প্রমাণ নেই। জড়বস্তু থেকে জীবের উদ্ভবের ধারণা আসলে এক কুসংস্কার যা মধ্যযুগে প্রচলিত ছিল। সেই সময় মানুষ ধারণা করত, কিছু প্রাণীর হঠাৎ আবির্ভাব ছিল ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভব’ ঘটার ফল। এই বিশ্বাস অনুসারে, মানুষ মনে করত, রাজহাঁস উদ্ভূত হয় বৃক্ষ থেকে, মেষশাবক তরমুজ থেকে, এমনকি ব্যাঙাচি মেঘখন্ডে জমা পানি থেকে বৃষ্টি হিসেবে মাটিতে পড়ে। ১৬০০ সালের দিকে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, গম ও নোংরা কাপড়ের টুকরার মিশ্রণ থেকে ইঁদুর জন্মাতে পারে, এবং মৃত মৌমাছিকে মধুর সাথে মিশ্রিত করলে জীবন্ত মৌমাছির উদ্ভব হবে। যাহোক, ইতালীয় বিজ্ঞানী ফ্রান্সেসকো রেডি প্রমাণ করেন, গম ও নোংরা কাপড়ের মিশ্রণ থেকে ইঁদুর জন্মাতে পারে না, আর না মরা মৌমাছির সাথে মধুর মিশ্রণে জীবন্ত মৌমাছি পাওয়া যেতে পারে। এসব জীবের সৃষ্টি ঐসব প্রাণহীন বস্তু থেকে হয়নি, তারা কেবল ওগুলোকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছে। উদাহরণস্বরূপ, এক জীবন্ত মাছির ডিম মৃত মাছির গায়ে থাকতে পারে যা থেকে অল্পকাল পরে কিছু নতুন মাছি বেরিয়ে আসতে পারে। অন্য কথায়, প্রাণ থেকেই প্রাণ আসে, জড়বস্তু থেকে নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তু‘র প্রমাণ করেন যে, জীবাণুরাও জড়বস্তু থেকে আসে না। “প্রাণ থেকেই কেবল প্রাণ আসে”- এই সূত্র আধুনিক জীববিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি। উপরে আমরা যে অদ্ভুত দাবি নিয়ে আলোচনা করলাম (এক সময় মানুষ এটা আসলেই বিশ্বাস করত) সে সময়কার বাস্তবতা মাথায় রেখে সেটাকে ক্ষমা করা যেতে পারে এই অজুহাতে যে, সপ্তদশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীদের জানা-শোনায় ঘাটতি ছিল। তবে আজকের দিনে যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, এবং জড় থেকে জীবের উৎপত্তি সম্ভব নয়- এটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত হয়েছে, তখন এটা আসলেই বিস্ময়কর যে, ইয়ামান ওরস এর মতো বিবর্তনবাদী এ-রকম এক দাবির প্রতি সমর্থন দেবেন। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বহুবার দেখিয়ে দিয়েছেন যে, ঐ দাবি অনুযায়ী কিছু ঘটা অসম্ভব। তারা নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা চালিয়েছেন সবচেয়ে উন্নত গবেষণাগারে, প্রাণের উদ্ভব ঘটার সময়কার পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু এ-সবই নিষ্ফল হয়েছে। যখন ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, অক্সিজেন, আয়রন এবং কার্বন পরমাণু, যার সব ক’টি প্রাণের জন্য অত্যাবশ্যক- এগুলোকে একত্র করা হয়, তখন এর থেকে যা উদ্ভূত হয়, তা হলো একগাদা জড়পদার্থ। অথচ বিবর্তনবাদীরা দাবি করেন যে, একগাদা পরমাণু একত্র হলো এবং নিজেদেরকে সংগঠিত করল সময়ের সাথে সাথে ঠিক যথাযথ অনুপাতে, যথার্থ স্থান ও কালে, এবং তাদের মধ্যকার প্রয়োজনীয় সংযোগ সহকারে। তারা আরো দাবি করেন যে, এসব জড় পরমাণুর নিখুঁত সংগঠনের ফলে এসব প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছিল নির্ঝঞ্ঝাটে। যথাসময়ে আবির্ভূত হয়েছিল মানুষ, যে দেখতে, শুনতে, বলতে, অনুভব করতে, হাসতে, আনন্দ করতে ও কষ্ট পেতে পারে। সহানুভূতিশীল হতে পারে, সঙ্গীতের সুর-তাল উপলব্ধি করতে পারে, খাদ্যের স্বাদ উপভোগ করতে পারে, সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে, এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা করতে পারে। যাহোক, এটা একেবারেই স্পষ্ট যে, এমনকি যদি বিবর্তনবাদীরা যেসব শর্তের জন্য পীড়াপীড়ি করেন, তার সবগুলো পূরণ করা হয়, এবং যদি লক্ষ লক্ষ বছর অতিক্রান্ত হতে দেয়া হয়, তবুও এ রকম এক পরীক্ষণের পরিণতি হবে ব্যর্থতা। বিবর্তনবাদীরা প্রতারণাপূর্ণ ব্যাখ্যার সাহায্যে এই বাস্তবতাকে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন, যেমন ‘সব কিছুই সময়ের পরিক্রমায় সম্ভব’। এই দাবি বিজ্ঞানের মধ্যে প্রতারণার উপাদান চালু করার ওপর ভিত্তিশীল; এটার অকার্যকারিতা এখন সুস্পষ্ট। এই অকার্যকারিতা খুব স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যেতে পারে যখন বিষয়টি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়। একটি সহজ উদাহরণের সাহায্যে আসুন বিবেচনা করি, কখন সময়ের পরিক্রমা উপকারী এবং কখন এটা ক্ষতিকর। আপনি যদি চান তো কল্পনা করুন, সমুদ্রতটে এক কাঠের নৌকা এবং একজন মাঝি রয়েছে। সে নৌকাটির দেখাশোনা করে, মেরামত করে, ধোয়ামোছা এবং রঙ করে। যতক্ষণ মাঝির এটার প্রতি আগ্রহ আছে, ততক্ষণ নৌকাটি আকর্ষণীয়, নিরাপদ ও যত্নে থাকবে। তারপর, আসুন ধরে নিই যে, নৌকাটি পরিত্যক্ত হয়ে গেল। এ-সময় রোদ, বৃষ্টি, বায়ু, ঝড় ও বালি নৌকাটিকে ক্ষয় করে পুরাতন করে দিতে থাকবে। পরিশেষে এটা ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। এই দুই দৃশ্যকল্পের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হলো, প্রথমটায় একজন বুদ্ধিমান, বিজ্ঞ এবং সক্ষম ব্যক্তির মধ্যস্থতা আছে। সময়ের পরিক্রমা কেবল তখনই এটার জন্য উপকার বয়ে আনতে পারে, যখন এটার নিয়ন্ত্রণ হয় কোনো বুদ্ধিমান শক্তির দ্বারা। যদি তা না হয়, তাহলে সময়ের প্রভাব হয় ধ্বংসাত্মক, গঠনমূলক নয়। আসলে এটা বিজ্ঞানের এক সূত্র। ‘এনট্রপি সূত্র বা তাপগতি বিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র’ উল্লেখ করে যে, মহাবিশ্বের সব ব্যবস্থাপনা ধাবিত হয় সরাসরি বিশৃঙ্খলা, ছড়িয়ে পড়া ও ক্ষয়ের দিকে যখন তাদেরকে নিজেদের ওপর ও প্রাকৃতিক অবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। এই বাস্তÍবতা থেকে দেখা যায় যে, পৃথিবীর সুদীর্ঘ বয়স-কাল হলো এমন এক ব্যাপার যা জ্ঞান ও শৃঙ্খলা ধ্বংস করে এবং বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি করে- এটা বিবর্তনবাদীদের দাবির ঠিক বিপরীত। জ্ঞানভিত্তিক সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার উদ্ভব কেবল বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ মধ্যস্থতারই ফল হতে পারে। যখন বিবর্তনবাদের প্রবক্তারা এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতির রূপান্তরের রূপকথা শোনান, তখন তারা ‘অতি দীর্ঘ সময়’-এর আশ্রয় গ্রহণ করেন। তারা ধারণা দেন যে, ঐ পন্থায় অতীতে কোনোভাবে যে ঘটনা ঘটেছিল, তা পরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণে কখনোই প্রমাণিত হয়নি। যাহোক, পৃথিবী এবং মহাবিশ্বের সবকিছুই নির্ধারিত নিয়ম বা সূত্র অনুযায়ী ঘটে। এগুলো সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তন হয় না। উদাহরণস্বরূপ, কোনো কিছু ভূপৃষ্ঠে পতিত হয় মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে। সময়ের পরিক্রমায় তারা ঊর্ধ্বে ওঠা শুরু করে না। এমনটি কখনো ঘটবেও না এমনকি লক্ষ-কোটি বছর অতিক্রান্ত হলেও। টিকটিকির বাচ্চা সব সময় টিকটিকিই হয়। এর কারণ হলো, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত জিনগত তথ্য টিকটিকিরই হয়ে থাকে; প্রাকৃতিক কারণে কোনো বাড়তি তথ্য এর সাথে যোগ হতে পারে না। তথ্য হ্রাস পেতে পারে, এমনকি ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে, কিন্তু এর সাথে কিছু যুক্ত হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। এর কারণ হলো, কোন ব্যবস্থাপনায় তথ্য সংযুক্ত করার জন্য বিজ্ঞতাপূর্ণ, বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ বাহ্যিক হস্তক্ষেপ এবং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। প্রকৃতির নিজের এরকম কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। পুনরাবৃত্তি সময়ের সাথে সাথে এবং প্রায়শ সংঘটিত হয়- এই ব্যাপারটা কোনো কিছুকে পরিবর্তন করে না। এমনকি যদি লক্ষ-কোটি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার সুযোগও পায়, তবুও কোনো পাখি গিরগিটির ডিম পাড়বে না। গিরগিটি লম্বা কিংবা খাটো হতে পারে, শক্তিশালী বা দুর্বল হতে পারে- কিন্তু এটা সব সময় গিরগিটিই হবে; ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভব কখনোই হবে না। ‘বিপুল সময়কালের ধারণা’ হলো এক প্রতারণা; এটা অবলম্বন করা হয়েছে বিষয়টাকে পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের জগৎ থেকে দূরে রাখার উদ্দেশ্যে। ৪ বিলিয়ন বছর, কি ৪০, ৪০০ বিলিয়ন বছর- এটা কোনো ব্যাপার না। এর কারণ হলো, এমন কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম বা প্রবণতা নেই যা বিবর্তনবাদে বর্ণিত অসম্ভবগুলোকে সম্ভব করতে পারে। ১২.    আক্কেল দাঁত কেন বিবর্তনবাদের প্রমাণ নয়? বিবর্তনবাদের বড় প্রতারণাগুলোর মধ্যে একটা হল, এটার লুপ্তপ্রায় অঙ্গ সম্পর্কিত দাবি। বিবর্তনবাদীরা দাবি করেন যে, জীবের কিছু অঙ্গ সময়ের পরিক্রমায় তাদের প্রকৃত কাজ ত্যাগ করে; এরকম অঙ্গ তখন লোপ পায়। এটাকে সূচনাবিন্দু হিসেবে ধরে নিয়ে তারা তখন এই বার্তা প্রদান করতে চেষ্টা করেন: “যদি জীব সত্যি সত্যিই সৃজিত হতো, তাহলে তার কোনো অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ থাকত না।” বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিবর্তনবাদীদের প্রকাশনা ঘোষণা করে যে, মানবদেহে শতেক অঙ্গ ছিল যা আর কোনো উদ্দেশ্য সাধন করত না। এর মধ্যে ছিল অ্যাপেন্ডিক্স, ককিক্স, টনসিল, পিনিয়াল গ্রন্থি, বহিঃকর্ণ, থাইমাস এবং আক্কেল দাঁত। যাহোক, পরবর্তী দশকগুলোতে চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেক অগ্রগতি সাধন করে। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং বিভিন্ন তন্ত্র সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দেখা গেছে যে, লুপ্তপ্রায় অঙ্গের ধারণা ছিল স্রেফ কুসংস্কার। বিবর্তনবাদীদের তৈরি করা লম্বা তালিকা খুব দ্রুত সঙ্কুচিত হয়ে আসে। আবিষ্কার হয়ে গেছে যে, থাইমাস হলো এমন এক অঙ্গ যা রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ কোষ তৈরি করে, পিনিয়াল গ্রন্থি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন তৈরির দায়িত্ব পালন করে। এটাও জানা গেছে যে, ককিক্স শ্রোণিচক্রের চারিদিকে অস্থিকে ধারণ করে, আর বহিঃকর্ণ শব্দের উৎস নির্ণয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এটা প্রকাশ পেয়েছে যে, লুপ্তপ্রায় অঙ্গেও ধারণা গড়ে উঠেছে একমাত্র অজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে। আধুনিক বিজ্ঞান বহুবার এসব অঙ্গ সম্পর্কে ধারণাগত ভুল ধরিয়ে দিয়েছে। তবুও কিছু বিবর্তনবাদী এখনও এই দাবি পেশ করার চেষ্টা করেন। যদিও চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, বিবর্তনবাদীরা যেসব অঙ্গকে লুপ্তপ্রায় বলে দাবি করেন তার প্রায় সবগুলোই আসলে কোনো উদ্দেশ্য সাধন করে, তবুও এখনো দু-একটি অঙ্গ নিয়ে বিবর্তনবাদী ধ্যান-ধারণা ঘুরপাক খাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো আমাদের আক্কেল দাঁত। এই দাঁত মানবদেহের এমন এক অংশ যা উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছে- এই দাবি এখনো বিবর্তনবাদীদের প্রকাশনায় দেখা যায়। এটার প্রমাণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, এই দাঁত অসংখ্য মানুষকে অনেক যন্ত্রণা দেয়; অপারেশন করে এটা উঠিয়ে ফেললে চিবাতে কোনো সমস্যা হয় না। আক্কেল দাঁতের কোনো কাজ নেই- বিবর্তনবাদীদের এই দাবি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক দন্তচিকিৎসক এগুলি উঠিয়ে ফেলাকে দৈনন্দিন কাজে পরিণত করেছেন। তাঁরা অন্য দাঁত রক্ষায় যত যতœবান, এগুলো রক্ষায় তেমন চেষ্টা করেন না। (Leonard.1992. p-77) অথচ, সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, আক্কেল দাঁত অন্য দাঁতের মতোই চিবানোর কাজ করে। আরো গবেষণা পরিচালিত হয়েছে এটা দেখানোর জন্য যে, অক্কেল দাঁত অন্যান্য দাঁতের অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে- এই ধারণা ভিত্তিহীন। (Leff.1993. p-85)। আক্কেল দাঁত নিয়ে সমস্যার সমাধান না করে তা উপড়ে ফেলার যে নীতি, তা নিয়ে এখন ব্যাপক বৈজ্ঞানিক সমালোচনা হচ্ছে (General Dentistry. p-310-320) আসলে বৈজ্ঞানিক গণরায় হলো, অন্যসব দাঁতের মতই আক্কেল দাঁতের চিবানোতে ভূমিকা রয়েছে। এরা কোনো কাজের নয়- এই বিশ্বাসের কোনো বৈজ্ঞানিক গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাহলে কেন আক্কেল দাঁত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের সমস্যা সৃষ্টি করে? যেসব বিজ্ঞানী বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁরা আবিষ্কার করেছেন যে, আক্কেল দাঁত নিয়ে জটিলতা মানব-সম্প্রদায়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পন্থায় প্রকাশ পেয়েছে। এটা এখন বোধগম্য হয়েছে যে, শিল্পপূর্ব সমাজে সমস্যাটি কদাচিৎ দেখা যেত। আবিষ্কৃত হয়েছে  যে, বিগত দু-এক শতাব্দীতে যেভাবে শক্ত খাবারের পরিবর্তে নরম খাদ্য উপাদান বেছে নেওয়া হচ্ছে, তাতে মানুষের চোয়ালের গঠনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এভাবে এটা উপলব্ধি করা হচ্ছে যে, আক্কেল দাঁত নিয়ে অধিকাংশ সমস্যার উদ্ভব হয় চোয়ালের গঠনগত সমস্যার ফলে; যা খাদ্যাভ্যাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এটাও জানা গেছে যে, সমাজের পুষ্টি সংক্রান্ত অভ্যাসের নেতিবাচক প্রভাব আমাদের অন্যান্য দাঁতের উপরেও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অতিরিক্ত শর্করা এবং অম্লযুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে দাঁতের ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। যাহোক, এই ব্যাপারটা আমাদের মনে এই চিন্তা জাগায় না যে, আমাদের সব দাঁত কোন না কোনোভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। এই একই নীতি আক্কেল দাঁতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এসব দাঁত নিয়ে সমস্যা দেখা দেয় সমসাময়িক খাদ্যগ্রহণের রীতি থেকে, কোনো বিবর্তনমূলক ক্ষয় থেকে নয়। ১৩.    সবচেয়ে প্রাচীন প্রাণীর জটিল দেহকাঠামো কিভাবে বিবর্তনবাদকে বাতিল করে দেয়? জীবাশ্ম রেকর্ডে প্রাণীদেরকে একটা শিকলের আকারে দেখা যায়। যখন প্রাচীনতম থেকে সাম্প্রতিকতমের দিকে এগুলো আমরা দেখি, তখন তাদের ধারাবাহিকতা হয় এ রকম: আণুবীক্ষণিক জীব, অমেরুদন্ডী সামুদ্রিক প্রাণী, মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি এবং স্তন্যপায়ী। বিবর্তনবাদের প্রবক্তারা এই শিকলকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন পন্থায় বর্ণনা করেন। তারা চেষ্টা করেন এটাকে বিবর্তনবাদের প্রমাণ হিসাবে পেশ করতে। তারা দাবি করেন যে, জীবের বিকাশ ঘটেছে সরল থেকে জটিল আকারে এবং এই প্রক্রিয়ায় বহু প্রজাতির জীবের উদ্ভব ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিবর্তনবাদীরা ধারণা দেন যে, ৩০০ মিলিয়ন বছরের প্রাচীন জীবাশ্ম স্তরে কোন মানবজীবাশ্ম না পাওয়াটা বিবর্তনবাদের এক প্রমাণ। তুর্কি বিবর্তনবাদী অধ্যাপক আইকুত কেন্স বলেন : “আপনি বিবর্তনবাদ বাতিল করে দিতে চান? তাহলে কেম্ব্রিয়ান যুগে গিয়ে কোনো মানব জীবাশ্ম খুঁজে বের করুন! যিনি এটা করবেন, তিনি বিবর্তনবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করবেন। এমনকি তার আবিষ্কারের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতে পারেন। (Conference on the Theory of Evolution,1998) আদিম থেকে জটিলের দিকে বিকাশ হলো এক কাল্পনিক ধারণা আসুন বিবর্তনবাদীদের যুক্তি পরীক্ষা করে দেখি যা অধ্যাপক কেন্সের বক্তব্যকে পরিব্যাপ্ত করে। জীব আদিম থেকে জটিলের দিকে বিবর্তিত হয়- এই বক্তব্য বিবর্তনবাদীদের এক কুসংস্কার; এটা কোনোভাবেই সত্যকে প্রতিফলিত করে না। জীববিজ্ঞানের মার্কিন অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক এল মার্শ (ইনি বিবর্তনবাদীদের এই দাবি নিয়ে গবেষণা করেন) তাঁর Zuvi Variation and Fixity in Nature গ্রন্থে উল্লেখ করেন, জীবকে চলমান, অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতায় সরল থেকে জটিল- এভাবে সাজানো যেতে পারে না। (www.icr.org) প্রায় সকল জ্ঞাত প্রাণী-পর্ব ক্যাম্ব্রিয়ান যুগে হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়- এই ব্যাপারটা বিবর্তনবাদীদের এ-সম্পর্কিত দাবির বিরুদ্ধে জোরালো প্রমাণ। তাছাড়া যেসব জীব হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়েছিল, তাদের দেহ-কাঠামো সরল ছিল না, ছিল জটিল; এটা বিবর্তনবাদীদের ধারণার ঠিক বিপরীত। ট্রাইলোবাইট ছিল আর্থ্রােপোডা পর্বভুক্ত। এরা খুবই জটিল প্রাণী, যাদের শক্ত খোলস, গ্রন্থি দ্বারা যুক্ত দেহ এবং জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে। ট্রাইলোবাইটের জীবাশ্ম রেকর্ড থেকে এটার চোখ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করা সম্ভব হয়েছে। এটার চোখে অসংখ্য ছোট ছোট ভাগ রয়েছে। এদের প্রত্যেকটির রয়েছে দু’টি লেন্স-স্তর। এই চোখের গঠন-কাঠামো হলো সত্যিকার অর্থে বিস্ময়কর নকশা। হার্ভার্ড, রচেষ্টার ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্বের অধ্যাপক ডেভিড রাউপ বলেন, “ট্রাইলোবাইট ৪৫০ মিলিয়ন বছর আগে এক অনুপম নকশা ব্যবহার করত যা আজকের দিনে করতে একজন সুপ্রশিক্ষিত, কল্পনাশক্তির অধিকারী আলোক প্রকৌশলীর প্রয়োজন।” (Raup. 1979. p-24) এই ব্যাপারটির আরেকটি মজার দিক হল, আমাদের সময়কালের মাছির  চোখের গঠনও একই রকম। অন্য কথায়, একই কাঠামো বিদ্যমান রয়েছে বিগত ৫২০ মিলিয়ন বছর। যখন চার্লস ডারউইন The Origin of Species লিখেছিলেন, তখন ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের এই অসাধারণ অবস্থা সম্পর্কে খুব কমই জানা ছিল। ডারউইনের সময়কালে জীবাশ্ম রেকর্ড কেবল প্রকাশ করেছিল যে, প্রাণের আবির্ভাব হঠাৎ করে ক্যাম্ব্রিয়ান যুগে হয়েছিল। সেসময় ট্রাইলোবাইট এবং অন্যান্য অমেরুদন্ডীরা সহসা অস্তিত্বে আসে। এই কারণে ডারউইন তাঁর গ্রন্থে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে পারেননি। তবে তিনি বিষয়টি কিঞ্চিৎ আলোচনা করেন এই শিরোনামে : “জ্ঞাতানুসারে, সবচেয়ে নিচু জীবাশ্মস্তরে আকস্মিকভাবে দলে দলে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত প্রজাতির আবির্ভাব।” এখানে তিনি সিলুরীয় যুগ (এই নামটি সেই সময় যে যুগকে বুঝাতে ব্যবহার করা হতো, এখন তাকে ক্যাম্ব্রিয়ান যুগ বলা হয়) সম্পর্কে লেখেন : “উদাহরণস্বরূপ, আমি সন্দেহ করতে পারি না যে, সব সিলুরীয় ট্রাইলোবাইট এসেছে একটি সন্ধিপদী প্রাণী থেকে। এটার অস্তিত্ব নিশ্চয় সিলুরীয় যুগের অনেক আগেও ছিল এবং সম্ভবত যেকোনো জ্ঞাত প্রাণী থেকে সম্ভবত অনেক ভিন্ন্ ছিল।  ...ফলত যদি আমার মতবাদ সত্য হয়, তাহলে এটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই যে, সর্বনিম্ন সিলুরীয় স্তর জমার আগে দীর্ঘ সময়কাল অতিক্রান্ত হয়েছে, এত দীর্ঘ যে, সম্ভবত অনেক বেশি দীর্ঘ, সিলুরীয় যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়কালের মতো দীর্ঘ। এই সুদীর্ঘ এবং সম্পূর্ণ অজ্ঞাত সময়ে পৃথিবী জীবে পরিপূর্ণ ছিল। এই অতিদীর্ঘ আদিম কালের কোনো রেকর্ড আমরা কেন পাই না- এই প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক উত্তর আমার কাছে নেই (Darwin.1859, p. 313-314) ডারউইন বলেন, “আমার মতবাদ সত্য হলে বিতর্কের কোনো অবকাশ থাকবে না যে, সিলুরীয় যুগের আগে পৃথিবী জীবে পরিপূর্ণ ছিল।” কেন এসব জীবের জীবাশ্ম রেকর্ড পাওয়া যায় না- এই প্রশ্নেব উত্তর তাঁর গ্রন্থব্যাপী দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি অজুহাত দেখিয়েছেন যে, “জীবাশ্ম রেকর্ড খুবই অপর্যাপ্ত”। কিন্তু আজ জীবাশ্ম রেকর্ড পূর্ণতা পেয়েছে এবং এটা স্পষ্টত প্রকাশ করে দিচ্ছে যে, ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের প্রাণীদের কোনো পূর্বপুরুষ ছিল না। এর অর্থ হলো, আমাদেরকে ডারউইনের সেই বাক্যটি প্রত্যাখ্যান করতে হবে, যেটা শুরু হয়েছে “যদি আমার মতবাদ সত্য হয়” দিয়ে। ডারউইনের যুক্তিধারা ছিল বাতিলযোগ্য, আর সেই কারণে, তাঁর মতবাদ ভুল। প্রাণের বিকাশ আদিম আকার থেকে জটিলের দিকে ঘটেনি; উদ্ভবের মুহূর্ত থেকেই জীবের কাঠামো যে অত্যন্ত জটিল- এটা দেখিয়ে দেয়ার মতো আরেকটি উদাহরণ হলো হাঙ্গর। জীবাশ্ম রেকর্ড থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এটার উদ্ভব হয়েছে ৪০০ মিলিয়ন বছর আগে। এই প্রাণীর মধ্যে এমন উন্নততর বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এমনকি এর লক্ষ লক্ষ বছর পরে সৃষ্ট প্রাণীর মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় না। এটার হারানো দাঁত পুনরায় গজানো এমনই এক বৈশিষ্ট্য। আরেকটি উদাহরণ হলো, স্তন্যপায়ীদের চোখের সাথে অক্টোপাসের চোখের বিস্ময়কর সাদৃশ্য। অথচ এরা স্তন্যপায়ীদের লক্ষ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে বাস করত। এসব উদাহরণ স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, জীবের প্রজাতিসমূহকে আদিম থেকে জটিলের দিকে সুচারুরূপে সজ্জিত করা যায় না। এই বাস্তবতাও দৃশ্যপটে এসেছে জীবের আকার, ভূমিকা এবং জিনের গবেষণা বিশ্লেষণ করার ফলে। উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা আকার-আকৃতি বিবেচনায় নিয়ে জীবাশ্ম রেকর্ডের খুব নিম্ন পর্যায় পরীক্ষা করি, তখন আমরা এমন অনেক জীব দেখি, যারা পরবর্তীকালে আসা জীবের তুলনায় অনেক বড় (যেমন ডাইনোসর)। যখন আমরা জীবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভূমিকার দিকে লক্ষ্য করি, তখন আমরা ঠিক একই বিষয় লক্ষ্য করি। কাঠামোগত বিকাশের প্রশ্নে কান হলো এক উদাহরণ যা এই দাবিকে ভুল প্রমাণ করে যে, “সরল থেকে জটিলের দিকে বিকাশ ঘটেছে”। উভচর প্রাণীর রয়েছে মধ্যকর্ণ-স্থান, অথচ সরীসৃপের আবির্ভাব আরো পরে হলেও তাদের কানের গঠন অনেক সরল; এটা কেবল এক ছোট অস্থির ওপর নির্ভরশীল এবং কোনো মধ্যকর্ণ নেই। জিনগত গবেষণাতেও একই রকম ফল পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ক্রোমোজমের সংখ্যার সাথে প্রাণীর জটিলতার কোনো সম্পর্ক নেই। উদাহরণস্বরূপ, মানুষের ক্রোমোজম সংখ্যা ৪৬, একটি বিশেষ জুপ্লাঙ্কটনের ৬টি এবং আণুবীক্ষণিক জীব রেডিওলারিয়ার ঠিক ৮০০টি। জীব সৃষ্টি করা হয়েছে তাদের জন্য সবচেয়ে ‘উপযুক্ত’ সময়ে জীবাশ্ম রেকর্ডের পরীক্ষা থেকে একটি সত্য বেরিয়ে এসেছে; সেটা হলো, জীবের আবির্ভাব ঘটেছে এমন সময়ে, যা ছিল তাদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। স্রষ্টাটা সকল জীবের পরিকল্পনা করেছেন চমৎকারভাবে। পৃথিবীতে আবির্ভাবের কালে তারা যেন আপনাপন প্রয়োজন মেটাতে পারে, সে যোগ্যতা তিনি তাদেরকে দিয়েছেন। এরকম একটি উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে সবচেয়ে পুরাতন ব্যাকটেরিয়ার আবির্ভাব ঘটেছিল। সেই সময়ের বায়ুমন্ডল ও তাপমাত্রার অবস্থা মোটেই জটিল দেহধারী প্রাণী বা মানুষের উপযুক্ত ছিল না। একথা ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য; বিবর্তনবাদী কেন্স-এর মতে এই সময়কালে মানব-জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। ব্যাপারটা বিবর্তনবাদকে বাতিল করে দেয়ার মতো। প্রায় ৫৩০ মিলিয়ন বছর আগের এই যুগ নিঃসন্দেহে মানবজীবনের জন্য অনুপযুক্ত ছিল (সে-সময় মাটিতে বিচরণকারী কোনো প্রাণী আদৌ ছিল না)। পরবর্তী যুগগুলোর প্রায় প্রতিটার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ছিল একই রকম। জীবাশ্ম রেকর্ডের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, মানবজীবনের অনুকূল অবস্থ’া বিদ্যমান ছিল কেবল গত কয়েক মিলিয়ন বছর। এই একই কথা অন্য সকল জীবের ক্ষেত্রে সত্য। প্রতিটি প্রাণীর দল আবির্ভূত হয়েছিল তখন, যখন তাদের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল- অন্য কথায় ‘যখন সময়টা ছিল সঠিক’। বিবর্তনবাদীরা এই বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে বিপুল পরস্পর বিরোধিতার অবতারণা করেন। তারা এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতে চান, যেন এই উপযুক্ত পরিবেশ নিজেই প্রাণীদের সৃষ্টি করেছে। অথচ, ‘যথাযথ পরিবেশ-পরিস্থিতি’-এর অর্থ কেবল এই যে, সঠিক সময় এসেছে। জীবের উদ্ভব হতে পারে কেবল সচেতন মধ্যস্থতার দ্বারা- অন্য কথায় অতিপ্রাকৃতিক সৃষ্টি। এই কারণে, ধাপে ধাপে জীবের আবির্ভাব বিবর্তনবাদের প্রমাণ নয়, বরং আল্লাহ্র অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রমাণ, যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টজীবের প্রত্যেকটা দল পরবর্তী দলের উদ্ভবের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এবং সুদীর্ঘ সময়কালব্যাপী উদ্ভিদ-প্রাণী মিলে আমাদের জন্য বস্তুগত ভারসাম্য নির্মাণ করেছে। পক্ষান্তরে, আমাদের সচেতন থাকতে হবে যে, এই দীর্ঘ সময়কাল কেবল আমাদের কাছেই দীর্ঘ। আল্লাহর কাছে এটা এক মুহূর্তের বেশি নয়। সময় নামক ধারণা কেবল সৃষ্টজীবের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। খোদ্ সময়ের যিনি স্রষ্টা, তিনি সময়ের বন্ধনে আবদ্ধ নন (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন হারুন ইয়াহিয়ার লেখা Timelessness and the Reality of Fate [চলবে]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির