ইহুদিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় যদি বলি তাহলে বলতে হবে, বনি ইসরাঈলের লোকদের ইহুদি বলে। বনি ইসরাঈল থেকে তারা কীভাবে ইহুদি নামটা ধারণ করল তারও আছে সুদীর্ঘ এক ইতিহাস। কুরআনে বর্ণিত অসংখ্য নবী-রাসূলের স্মৃতি বিজড়িত যে নামে বনি ইসরাঈল জাতির নামকরণ সেটা ধুয়েমুছে কীভাবে তারা ইহুদি নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বভূবনে তারই হালকা ইজা টানা যাক। আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাঈলকে সত্য দ্বীনের পথে অবিচল রাখার জন্য সময়ের চাহিদার আলোকে যোগ্যতার বিচারে আলাদা আলাদা নবী-রাসূল এবং বাদশাহ মনোনয়ন করেছেন। কখনো উচ্চ বংশ থেকে কখনো আবার নিম্ন বংশ থেকে। বনি ইসরাঈল জাতি কখনো তাদের নবীকে সাদরে গ্রহণ করেছেন আবার কখনো প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রত্যাখ্যান করা নবীদের গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাদের স্বপক্ষে নানান যুক্তি দাঁড় করাতো। যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়া ছাড়া তারা সাদরে গ্রহণ করতে পারতো না। যাদেরকে পছন্দ হতো এবং বংশীয় মর্যাদায় আসীন থাকত তাদেরকে আবার বীরদর্পে মেনে নিত। তবে আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে নানাবিধ প্রশ্নে নবীদের জর্জরিত করে ফেলত।
বনি ইসরাঈলের আরেক নাম বলা যেতে পারে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি আর বিতর্কিত প্রশ্নোত্থাপনকারী জাতি। বনি ইসরাঈলের নবী দাউদ আলাইহিস সালামের পুত্র সুলাইমান আলাইহিস সালাম তাদেরকে জেরুজালেমের মালিকানা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আল্লাহর ইচ্ছায়। মাসজিদুল আকসার পুণর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করে বনি ইসরাঈলের মর্যাদা উন্নীত করেছিলেন। ইহুদিরা এখনো সুলাইমান আলাইহিস সালামের বাদশাহীর কথা কল্পনা করে পুরো পৃথিবীজুড়ে শাসনব্যবস্থা পরিচালনার স্বপ্ন দেখে। নবীপুত্র সুলাইমান আলাইহিস সালাম বনি ইসরাঈলের বনি ইয়াহুদা কবিলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর ওফাতের পর তাঁর কবিলা বনি ইয়াহুদা হুকুমত শুরু করে; কিন্তু অন্য কবিলাগুলো তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। এর ফলে ফিলিস্তিনের ভূমি দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, এক ভাগকে ইয়াহুদা কবিলার দিকে সম্পৃক্ত করে ‘বনি ইয়াহুদা’। আরেক ভাগ ‘সামারিয়া’ যা পূর্ব দিকে লেবাননে অবস্থিত পরবর্তীতে বনি ইয়াহুদা কবিলা সামারিয়া হুকুমাত দখল করে পুরো ফিলিস্তিন তাদের কব্জায় নিয়ে নেয়। যার পর থেকে বনি ইসরাঈলের নাম বনি ইয়াহুদার নামানুসারে ইহুদি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
আর খ্রিষ্টানদের কুরআন মাজিদে নাসারা বলা হয়েছে। উক্ত নামকরণের ব্যাপারে কুরআনে দুটি বর্ণনা পাওয়া যায়-
এক. আল্লাহ বলেন,
یایها الذین امنوا كونوا انصار الله كما قال عیسی ابن مریم للحواریٖن من انصاری الی الله قال الحواریون نحن انصار الله فامنت طآئفۃ من بنی اسرآءیل و كفرت طآئفۃ فایدنا الذین امنوا علی عدوهم فاصبحوا ظهرین ﴿۱۴﴾
‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হও। যেমন মারইয়াম পুত্র ঈসা হাওয়ারীদেরকে বলেছিল, আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী হবে? হাওয়ারীগণ বলল, আমরাই আল্লাহর সাহায্যকারী। তারপর বনি-ইসরাঈলের মধ্য থেকে একদল ঈমান আনল এবং অপর এক দল প্রত্যাখ্যান করল। অতঃপর যারা ঈমান আনল আমি তাদেরকে তাদের শত্রুবাহিনীর ওপর শক্তিশালী করলাম। ফলে তারা বিজয়ী হল।’’ (সূরা আস-সফ : ১৩)
যারা ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম এর প্রশ্নের জবাবে বলেছিল, نحن انصار الله ‘আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী’।
দুই. এই মতটি ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম এর জন্মের সাথে সম্পর্কিত, যা নাসারা নামে প্রসিদ্ধ।
আবার খ্রিষ্টানদেরকে ঈসা আলাইহিস সালামের নামানুসারে ‘ঈসায়ি’ এবং লকবি নাম মাসিহ থেকে ‘মাসিহি’ বলেও ডাকা হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাঈলের কাছে দাওয়াতে দ্বীন প্রচারের জন্য ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালামকে পাঠিয়েছেন। এতদা সত্বেও ইহুদি তথা বনি ইসরাঈল সম্প্রদায় ঈসা আলাইহিস সালাম থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে নাকি খ্রিষ্টানরা ঈসা আলাইহিস সালাম যে বনি ইসরাঈলের জন্য পাঠানো নবী এটা জানতেন না; প্রশ্ন থেকেই যায়। যদি জেনেও থাকেন তাহলে খ্রিষ্টান-ইহুদি তথা বনি ইসরাঈল নাম ধারণ না করে আলাদা করে নাসারা ধারণ করল কেন? কিঞ্চিৎ এই সংশয় নিরসন করে তাদের আলাদা আলাদা ম্যাকানিজম নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। ইহুদিদের দাবি অনুযায়ী পরবর্তী যিনি নবী হবেন তিনি বনি ইসরাঈল বংশ থেকেই আসবেন। ইহুদি কিতাবের ভাষ্যমতে, দাউদ আলাইহিস সালামের বংশ থেকে পরবর্তী নবী আসবেন। কিন্তু ঈসা ইবনে মারইয়াম বাবাহীন সন্তান। যাকে আল্লাহ তায়ালা আদমের সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহ বলেন,
اِنَّ مَثَلَ عِیۡسٰی عِنۡدَ اللّٰهِ كَمَثَلِ اٰدَمَ ؕ خَلَقَهٗ مِنۡ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهٗ كُنۡ فَیَكُوۡنُ
‘‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমের মতো। তাঁকে মাটি দিয়ে তৈরি করেছিলেন এবং তারপর তাঁকে বলেছিলেন, ‘হয়ে যাও’ সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেলেন।’’ (আলে ইমরান : আয়াত : ৫৯)
এই ব্যথা বনি ইসরাঈল সম্প্রদায় বয়ে বেড়াতে পারেনি। বনি ইসরাঈলের উলামায়ে সু’দের প্রপাগান্ডা আর জঘন্য মিথ্যাচারের ফলে ঈসা আলাইহিস সালামকে তারা মেনে নিতে পারেনি। পরবর্তী ঘটনা কী ঘটেছিল তা নিয়ে আলোচনায় আসার আগে খ্রিষ্টানদের অবস্থানটা ক্লিয়ার করছি। ঈসা আলাইহিস সালাম যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন, তা তাওরাতের শিক্ষা থেকে ভিন্ন ছিল না। ঈসা আলাইহিস সালাম যে দ্বীনকে উজ্জীবিত করা এবং বনি ইসরাঈল সম্প্রদায়ের হিদায়াতের জন্য এসেছেন এটা খ্রিষ্টানরাও জানত। শুধু জানত না, জানত বলে তারা কখনোই বনি ইসরাঈলের বাইরে দাওয়াতের চেষ্টা করেন নি। উপরোক্ত আলোচনা পর্যন্ত ইহুদি-খ্রিষ্টানদের সাথে মুসলিম তথা ইসলামের তেমন গুরুতর অভিযোগ ছিল না। এদের সাথে সমস্যা হচ্ছে পরবর্তী কার্যক্রমে।
ইহুদি এবং খ্রিষ্টানদের দ্বন্দ্ব শুরু কোন জায়গা থেকে?
বনি ইসরাঈল বরাবরই খবিস জাতি। তাদের কাছে সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও তারা যেটা মানবেন না সেটা মানবেনই না। যত তথ্যপ্রমাণ এদের সামনে হাজির করা হোক না কেন। দাউদ আলাইহিস সালামের বংশ থেকে পরবর্তী নবী আসার কথা ইহুদি কিতাবের উল্লেখ থাকার কারণে (ইহুদিদের আলাদা কিতাব কীভাবে আসলো তা পরবর্তী কিস্তিতে বিস্তারিত বলতে চেষ্টা করব) কেন আসলো না এটা নিয়ে তারা ঈসা ইবনে মারইয়ামকে মানতে নারাজ। এই জাতি তার নবীকে মানতে নারাজ হয়ে ক্ষান্ত হননি, উলামায়ে সু’দের কথার ওপর ভিত্তি করে ঈসা আলাইহিস সালামকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ইতোপূর্বে তারা ইয়াহিয়া আলাইহিস সালাম এবং তাঁর পিতা জাকারিয়া আলাইহিস সালামকে শহীদ করে। তাদের পরবর্তী টার্গেট ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালামকে শহীদ করা।
ঈসা আলাইহিস সালামকে হত্যার আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে ফারিসি ফিরকা। এদের বিরোধীতার মূল কারণ হচ্ছে, ঈসা আলাইহিস সালামের দাওয়াতের ভিত্তিই ছিল তালমুদের বিরোধিতা ও ফারিসি আলেমদের রদ করা। (এখানে ফিরকা এবং তালমুদ নিয়ে আলোচনা করছি না, কারণ এই বিষয়ের ওপর আলাদা কলম ধরতে হবে।) এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বনি ইসরাঈলের উলামায়ে সু রোমান বাদশাহর কাছে প্রস্তাব পেশ করে। যেন রোমান সম্রাট ঈসা আলাইহিস সালামকে শূলিতে চড়ানোর ব্যবস্থা করে। তখন আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাঈল এর সর্বশেষ নবী ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালামকে আসমানে উঠিয়ে নেন। এদিকে ইহুদিরা ভাবতে থাকে ঈসা আলাইহিস সালামকে তারা হত্যা করেছে। কারণ আল্লাহ তাদেরকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেন এবং খ্রিষ্টানরাও এই সন্দেহ করতে থাকে।
ইহুদিরা ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাহিস সালামকে হত্যা করেছে এই বিশ্বাস তৈরি হলো কীভাবে?
যখন ঈসা ইবনে মারইয়াম বনি ইসরাঈলের কাছে দাওয়াতে দ্বীনের শুরু করেন, তখন পুরো পৃথিবী রোমানদের কব্জায় ছিল। ফিলিস্তিনও তখন রোম সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ফিলিস্তিনের বাদশাহ ধর্মীয় বিশ্বাসে ইহুদি হলেও বাস্তবে রোম প্রশাসনের বাধ্যগত চাকর ছিল। ফারিসি ফিরকার আলেমদের পরামর্শে রাজনৈতিক বিরোধিতার ভয়ে রোম প্রশাসন ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালামকে হত্যার পরিকল্পনা করে। আল্লাহ তায়ালা তখন ঈসা রুহুল্লাহকে আসমানে উঠিয়ে নেন। যা ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
রোমান সৈন্যরা যখন ঈসা আলাইহিস সালামকে শূলিতে চড়ানোর জন্য ধরে আনতে তাঁর গৃহের কাছে পৌঁছায়, আল্লাহ তায়ালা তখন তাঁর এক সহকারীকে তাঁর মতো বানিয়ে দেন, যাকে রোমানরা গ্রেফতার করে শূলিতে চড়ায়। এক রেওয়ায়াতে আছে, সে ছিল সেই হাওয়ারি যে দুনিয়ার সম্পদের লোভে ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম এর খবর রোমানদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ আসমানে উঠিয়ে নেন তাঁর পরিবর্তে রোমানরা তাঁর অবয়বে দেখতে লোককে শূলিতে চড়িয়ে দেয়। সেই সময় থেকে ইহুদিরা এখনো মনে করে যে, ঈসা বা মসীহ হলো মিথ্যা নবুওয়ত দাবিদার যাকে হত্যা করা অত্যাবশ্যক।
অন্য এক রেওয়ায়াতে আছে, এই ব্যক্তি ছিল সেই হাওয়ারি যিনি আখিরাতের বিনিময়ে ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালামের জন্য কুরবান হতে প্রস্তুত ছিলেন। অন্যদিকে খ্রিষ্টানরা ঈসা আলাইহিস সালামকে মসীহুল্লাহ মনে করে এবং তিনি আবার দুনিয়াতে আসবেন তার ওপরও অগাধ বিশ্বাস রাখেন। তাদের এই মসীহকে হত্যার জন্য খ্রিষ্টানরা ইহুদিদের অপরাধী মনে করে এবং এর শাস্তি তাদের পেতে হবে মর্মে যত্রতত্র শাস্তি দিতেই থাকেন। কিন্তু এই নাসারা বা হাওয়ারি থেকে খ্রিষ্টবাদের সূচনা শুরু হয় মূলত ফিলিস্তিন ও শাম থেকে। খ্রিষ্টবাদ সেই সত্য দ্বীন নয়, যা ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম নিয়ে এসেছেন এবং যার দাওয়াহ তাঁর হাওয়ারিগণ দিয়েছিলেন। খ্রিষ্টবাদ এমন একটা জগাখিচুড়ি ধর্ম যা নেক সুরতে মানুষরূপী শয়তান দ্বারা তৈরি। যা ঈসা আলাইহিস সালামের আসমানে উঠিয়ে নেওয়ার কয়েক বছর পর থেকে ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে। যখন ঈসা আলাইহিস সালামের ১২ জন সাথী দাওয়াতে দ্বীনের কাজ শুরু করেন তখন এক ইহুদি আলেম সেন্ট পৌল ঘোষণা করে বসে যে, আমিও ঈসা আলাইহিস সালামের সত্য দ্বীন গ্রহণ করব এবং ঈসা আলাইহিস সালামের সাথীদের সাথে মিলে দ্বীন প্রচারের কাজ শুরু করে। ধীরে ধীরে সে দ্বীনি বিশ্বাসের সাথে নিজের মনগড়া ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাস মিশিয়ে প্রচার শুরু করে। একসময় খ্রিষ্ট ধর্ম সেন্ট পৌলের বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে মানুষ তার বিকৃতিগুলো গ্রহণ করে গোমরাহীর পথ বেঁচে নেয়। এদিকে ইহুদি ও খ্রিষ্টান পরস্পর শত্রুতায় নিমজ্জিত হয়ে যায়। ঈসা আলাইহিস সালামকে তাদের কথিত শূলে চড়ানোর ৭০ বছর পর তাদের ওপর নেমে আসে আরেক জালিমশাহী শাসক। রোমান সম্রাট টাইটাস ইহুদিদেরকে জেরোজালেম থেকে বের করে দেয়। ৭০খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৮সাল পর্যন্ত ইহুদিরা ইউরোপ ও মুসলিম বিশ্বে ঘুরেফিরে নিঃশেষ হতে থাকে। ইহুদিদের ইতিহাসে আরও জঘন্য সময় আসে তখন যখন রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিষ্টান হয়ে যায়। কনস্টানটাইন খ্রিষ্টান হয়ে যাওয়ার পর ইহুদিরা নাজেহাল হয়ে পড়ে। ইহুদিদের ওপর চালানো হয় অত্যাচার। কারণ খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস মতে, ইহুদিরা তাদের প্রভুর সন্তান ঈসা আলাইহিস সালামকে ঘৃণা করে রোমানদের সাথে মিশে চক্রান্ত করে ঈসা আলাইহিস সালামকে শূলিতে চড়িয়ে হত্যা করেছে।
কনস্টানটাইন বাহিনীর কাজ হচ্ছে ইহুদিদের খ্রিষ্টান হতে বাধ্য করা। আর যারা খ্রিষ্টান হতে চাইবে না তাদেরকে হত্যা করা। এভাবে ইহুদিরা তখন খুব কঠিন মূহুর্ত পার করেছিল। অপরাধ একটাই তারা মসীহকে শূলিতে চড়িয়েছে। খ্রিষ্টানদের আরও বিশ্বাস হচ্ছে, ঈসা আলাইহিস সালামের পৃথিবীতে আবার আগমন কেবল খ্রিষ্টানদের মধ্য থেকে হবে মুসলিম বা ইহুদিদের মধ্যে নয়। তাদের দাবি তিনি আবার ফিরে এসে সৎ খ্রিষ্টানদের বাছাই করে সাথে নিবেন। সারা দুনিয়াতে ভালো-মন্দের বিশাল যুদ্ধ হবে সেই যুদ্ধে কেবল তারাই বিজয়ী হবে যারা সৎ এবং ঈসা আলাইহিস সালাম আবার দুনিয়াতে ইনসাফের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধকে তাদের ভাষায় বলা হয় ‘আরমাগেডন’। ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা ইহুদিদেরকে ৩য় স্তরের নাগরিক থেকেও নিচু মনে করত। ইহুদিদের জন্য প্রশাসন ও বাহিনীর সাথে সবরকমের সম্পৃক্ততা নিষিদ্ধ ছিল। ইহুদিরা কেবল ইউরোপে ব্যবসা করার অনুমতি লাভ করে। যা ইউরোপের ৩য় স্তরের পেশা হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু ১৮৮২ বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাসের পরিক্রমায় শত্রু থেকে মিত্রতে পরিণত হয়। তারপর তাদের সাহায্যে শুধু ফিলিস্তিনেই ক্ষমতা বিস্তার করে নি, সারা দুনিয়ায় তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। পূবের্ই বলেছিলাম তারা কীভাবে শত্রু হলো এবং পরে কীভাবে মিত্র হলো। তাদের মিত্রতার সু বাতাস বয়েছে জেনেই হয়তো আল্লাহ তায়ালাও এদেরকে মুদ্রার এপিটওপিট ভেবে কুরআনে এক ও অভিন্ন শব্দে পরিচয় দিয়ে বলেছেন আহলে কিতাব এবং তাদের বিশ্বাসের জায়গাও অনেকাংশ একই ছিল।
অল্লাহ কুরআনে বলেছেন,
قَالَتِ الۡیَهُوۡدُ وَ النَّصٰرٰی نَحۡنُ اَبۡنٰٓؤُا اللّٰهِ وَ اَحِبَّآؤُهٗ
ইহুদি-খ্রিষ্টানরা বলে, ‘‘আমরা আল্লাহর সন্তান ও তাঁর প্রিয়জন।’’ (সুরা মায়েদা ১৮)
এখানে এটা বোঝানো উদ্দেশ্য যে, দুইটি ধর্মে পরস্পর এত বৈপরীত্য থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মাঝে চিন্তাগত ও আদর্শগত গভীর মিল রয়েছে। তাই তারা শত্রুতা ঝেড়ে মিত্র শক্তিতে রুপান্তরিত হয়েছেন। ইহুদি-খ্রিষ্টান শত্রু থেকে মিত্র হওয়ার আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে মার্টিন লুথারের রিফরমেশন আন্দোলন। এই আন্দোলনের একটি বিশেষ শর্ত হচ্ছে রোমান ক্যাথলিক ধর্ম বিশ্বাসের বিপরীতে তাওরাত, যাবুরসহ ওল্ড টেস্টামেন্টেপ্রাপ্ত সহিফাগুলোকে খ্রিষ্টানদের দ্বীনের উৎস হিসেবে গণ্য করা। এই মার্টিন লুথারের রিফরমেশন আন্দোলন ইহুদি চক্রান্ত বলে মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদরা। ইতিহাসবিদদের অনেকেই বলেন, মার্টিন লুথার নিজেই ইহুদি ছিলেন পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টান হয়েছেন। কেউ কেউ বলছে তার মা ইহুদি ছিল। এই আন্দোলনের ফলে খ্রিষ্টানদের মধ্যে একটা নতুন দল তৈরি হয়; যারা ইহুদিদের ধর্মীয় বড় ভাই মনে করে। তারা ওল্ড টেস্টামেন্টকে তাদের দ্বীনের মূল উৎস ভাবার পাশাপাশি ইহুদিদের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর সাথে তাদেরকে ফিলিস্তিনের অধিকারী মনে করে। এভাবেই ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মধ্যে শত্রুতা মুছে বন্ধুত্বে রূপ নেয়।
তথ্যসূত্র:
১. বাইবেল সে কুরআন তক
২. ঈসাইয়াত কিয়া হ্যায়?
৩. বিল আখির কিয়া হুগা?
৪. History of England
৫. The History of Zionism
৬. Secret Societies
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
আপনার মন্তব্য লিখুন