মন নেই। আর মনে নেই। দুটি বাক্য- দুটি অর্থ। আলাদা তাৎপর্য। ভাবার্থ ও বিশ্লেষণ ভিন্ন। মাঝে- মধ্যে এই বাক্য দুটি আমরা নিজের অজান্তে বিড় বিড় করে আওড়াতে থাকি। দুটি বাক্যকে একই ফ্রেমে আটকে ফেলি কখনো কখনো। তবে বাক্যালাপ দুটির ব্যাখ্যা ভিন্নতর। মন নেই- মানেই কাজটির ব্যাপারে আন্তরিকতা নেই। আগ্রহ নেই। অভিজ্ঞতাও নেই। অনেকটাই নীরব দর্শক। আর মনে নেই- মানে হলো, স্মৃতিভ্রম, ভুলে যাওয়া। মনে করতে না পারা। প্রতিটি কর্মসৃজনের জন্য মন থাকা চাই। কারণ মন থেকেই স্বপ্নপূরণের তাগাদা অনুরণিত হয়। মহৎ কাজ- উন্নত চিন্তা কিংবা মহৎ চিন্তা সবই কেবল একটি মনের সৃজনবেদনাই বটে।
দুই সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, সভা- সমিতির নানা আহবান হাজির হয় আমাদের দপ্তরে। এ আহবান প্রতিদিনের। অবশ্য সব আহবানে আমরা সাড়া দেই না। সব অনুষ্ঠানাদিতে উপস্থিত হই না। এই সাড়া না দেয়ার কিংবা উপস্থিত না হবার কারণ হলো- বিষয়টিকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারিনি। মন থেকে বিষয়টি গুরুত্ব দেইনি। উল্লেখ্য, কোনো একটি উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য হৃদয় দিয়ে আগুন আগুন খেলতে হয়। যারপরনাই ঠোঁটের অতলান্তে বিজয়ের হাসি। এখানেই করতে হয় হৃদয়ের আদান-প্রদান। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার কবি মতিউর রহমান মল্লিকের একটি কবিতার কিয়দংশ তুলে ধরতে চাই- খুব কম লোকই হৃদয়ের মূল্য দিতে পারে মূলত হৃদয়ের মূল্য হৃদয় খুব কম লোকই হৃদয়ের দরজা খুলতে পারে হৃদয়ের কাছে অনেকেই অসহায় শিশু কিংবা শিশুর মতো (বিস্তার-আবর্তিত তৃণলতা, পৃ. ১১)
তিন মানুষ হিসাবে আমাদের সবারই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একই। তবে এই মানুষেরই কার্যক্ষমতা, দক্ষতা, কর্মস্পৃহা আলাদা আলাদা। কেউ কাজের অপেক্ষায় প্রহর গোনে। একটি কাজ শেষের আগেই আরেকটি কাজের পরিকল্পনা করে। আবার কেউ কাজ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। প্রতিটি কাজের জন্য থাকতে হয় চেতনাবোধ। কারণ যার ভেতরে কাজের তাড়না রয়েছে সে কখনো বসে থাকতে পারে না। অন্যের অপেক্ষা করে না। বরং অন্যের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। আর এই যে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ও সৃজনবেদনার হাহাকার খুলে দেয় সম্ভাবনার নতুন দুয়ার।
চার নিশ্চয়ই সবাই দিনকে ভালোবাসি। ভালোবাসি সূর্যের আলোকরশ্মি। রাতকেও ভালোবাসি। অবশ্য জোছনা চাঁদের রাত। দিন এবং রাতের এই সূক্ষ্ম পার্থক্য। কিন্তু এই পার্থক্যের বিশালতা কেবলই জ্ঞানী কিংবা অনুসন্ধানীরা বুঝতে পারেন। পথকে ভালোবাসি। যানজটমুক্ত। আমাদের প্রত্যকের চাওয়া- পাওয়ার ভেতরে মতপার্থক্য কিংবা চাহিদার ভিন্নতা থাকলেও ভালোটার প্রতি সবার দৃষ্টিপাত যে সন্দেহাতীতভাবে এক ও অভিন্ন এটা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। তবে সমস্যা হলো- এই ভালোটা অর্জনের ক্ষেত্রে লেগে থাকতে হয়। কতই না বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়। সেই ঝুঁকিটা কজনইবা নিতে জানে। নিশ্চয়ই ভালোটা উপেক্ষা করা কিংবা না পাবার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। অবশ্য বিনা পরিশ্রমে পেলে তো কোনো কথাই থাকে না। এই যে কোন কিছু পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের পরিশ্রম কিংবা নিরন্তর প্রচেষ্টার আন্তরিকতা কতটুকু তা আজ পর্যালোচনা সময়ের অনিবার্য দাবি হয়ে উঠেছে।
পাঁচ দূর সীমানার দীর্ঘপথের সফর নিশ্চয় ক্লান্তিকর। তবে সেই গন্তব্য কেউ না কেউ ছুঁতে পারে। সাহসীরাই কেবল পথের দূরত্ব কিংবা দীর্ঘ শ্রান্তির কথা না ভেবেই শুরু করে যাত্রা। কখনো যাত্রাবিরতি দেয়। তবে পথের সীমানায় ঠিকই পৌঁছে যায় কোন একসময়ে। আর যারা পথের দূরত্ব মাপে আর ভয়ে দুমড়ে মুচড়ে ঘরের কোণে বসে থাকে তারা কেবলই একটি ঘরের দৈর্ঘ্য কিংবা প্রস্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আর অজানা রয়ে যায় কেবলই অজানা দেশ কিংবা মহাদেশ। বক্তা কিংবা শ্রোতা দু’জনের ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেউ বলেন। আবার কেউ শোনেন। দুজনের দু’ ধরনের যোগ্যতা। যিনি বলেন- উনি হয়তো দীর্ঘ তপস্যা-সাধনার পর বলা শুরু করেছেন। সেই দীর্ঘপাণ্ডিত্য ও অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে চান মানুষের হৃদয় ও মননে। হয়তো এই অভিপ্রায়টি দীর্ঘদিন নিজের ভেতর পুষে থাকা চিন্তারই বিপ্লব। নিশ্চয় এটি তাঁর জীবনের একটি অর্জন। সফলতা। যেটির বীজ বপন করেছিলেন দীর্ঘসময় ধরে। আর যিনি শ্রোতা তিনিও নিশ্চয় আগামীতে কিছু বলবেন, জাতির উদ্দেশে। সেই প্রস্তুতিরই অংশ হিসাবে হয়তোবা তিনি এখন একজন শ্রোতা। মনোযোগী পাঠক। হয়তো তিলে তিলে গড়ে তুলছেন নিজেকে। বুকের ভেতরে বিপ্লবের যে ভিসুভিয়াস তোলপাড় করে সেটাকে প্রকাশের জন্য ইশতেহার তৈরিতে নিমগ্ন। হয়তো খুব শিগগিরই কোন এক সুপ্রভাতে বুকটান করে দাঁড়িয়ে যাবেন জনতার মুখোমুখি। আর কেবল নীরব দর্শকরাই ঘৃণিত হয় যুগে যুগে। তাঁদের ইতিহাস কেবলই কাপুরুষোচিত কিংবা পরাজিত নপুংসকের ন্যায়।
ছয় আমাদের চোখের সামনে প্রতিদিন অসংখ্য অন্যায় অবিচার ঘটছে অহরহ। অথচ আমরা সবাই নীরব। মাজলুম ব্যক্তিটির পাশে কেউ দাঁড়াই না। দাঁড়ানোর তাড়না যেমন নেই; তেমনি সেই ঘটনার নেপথ্যের কারণ উদঘাটনের উদ্ভাবনী শক্তিও নেই কারোর। ফলে ক্রমাগতভাবে দিন দিন বেড়েই চলেছে নানান অনাচার। কেউ কথা বলি না। কারণ বিষয়টি আমার সাথে সম্পৃক্ত না। আমি তো ভালোই আছি। এই ভাবনা থেকেই মূলত সৎ কাজের আদেশ নেই। অসৎ কাজে বাধা প্রদানের লোক নেই। অথচ তাবৎ পৃথিবীজুড়ে আজ শ্লোগান- ‘সৎ লোকের শাসন চাই।’ সেলুকাস! সৎসাহসই যেখানে অনুপস্থিত সেখানে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ভাবনা নিশ্চয়ই অবান্তর ও হাস্যকর। বড়ই কল্পনাবিলাস। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের মহান নেতা শহীদ ম্যালকম এক্স এর একটি বক্তব্য তুলে ধরতে চাই- ‘নীরবে জালেমের জুলুম সয়ে যাওয়ার কথা কুরআনের কোথাও নেই। আমাদের দ্বীন আমাদের বুদ্ধিমান হতে শেখায়, শান্তিকামী, সাহসী হতে শেখায়। আইন মেলে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু সাথে এটাও বলে যদি তোমাদের উপর জুলুম করা হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো।’
সাত আজ চারিদিক থেকে ঝড় আসছে। অথচ আশ্রয়কেন্দ্রের চরম সঙ্কট। অনেক পথ। আবার পথ নেই বললেই চলে। চারিদিক যেন আজ বন্ধ দুয়ার। এরই মাঝে ধ্বনিত হচ্ছে মাজলুমের আর্তনাদ। বাঁচাও। বাঁচাও। আমাদের মুক্ত করো। সত্যিকার অর্থে নির্যাতিত মানুষেরা আজ মুক্তিপাগল। মুক্ত হতে চায় জালিমের প্রাচীর থেকে। বারবার তারা সেই শিকল ভাঙতে উদ্ধত। তারা হন্য হয়ে খুঁজছে একজন মাহাথিরকে; যিনি মুক্ত করে আনবেন মাজলুম জনপদের প্রতিটি মানুষকে। আর সে জন্য প্রয়োজন একটি বিপ্লব। আর বিপ্লব তো এমনি এমনি আসে না। বিপ্লবকে পথ দেখিয়ে আনতে হয়। আর সেই দায়িত্ব কে কাঁধে তুলে নিবে সাহস করে তাকেই তো খুঁজছে সবাই। খুঁজছে মাজলুম মা-বোনেরা। নারী-শিশু। বৃদ্ধ-বনিতা। অবশেষে হয়তো মাজলুমদের আল্লাহ খুব শিগগিরই পাঠাবেন একজন অভিভাবক। সেই অপেক্ষায় হয়তোবা আরো কিছু পথ মাড়িয়ে যেতে হবে। এ প্রসঙ্গে মতিউর রহমান মল্লিক বলেছেন- এই তো সামান্য বাধা, ব্যথা আর অত্যল্প ক্রন্দন, কতো আরো বাকি! আমরা তো মধ্যমপন্থী লোক, চরমে বিশ^াসী নই; ধৈর্য ভালোবাসি। আজ শুধু প্রস্তুতির কাল, আজ শুধু অপেক্ষার কাল, আজ শুধু ধৈর্যের সকাল, আগামী দুপুর আমাদের, শুধু আমাদের। (সকাল/ আবর্তিত তৃণলতা, পৃ: ৪৭) লেখক : কবি ও গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন