“আর আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি অতঃপর তাকে শিক্ষা দিয়েছি ভাষা।” (সূরা আর রহমান : ৩-৪)
মানুষের বাসযোগ্য সৌরজগতের একটি গ্রহ পৃথিবী নামক বাগান নির্মাণ করার পর বাগানের মালিক সৃৃষ্টিকর্তা তার শোভা বর্ধনের জন্য সৃষ্টি করলেন হাজার হাজার জীবন্ত প্রাণী। বাগানের সৌন্দর্য রক্ষার নিমিত্তে সৃষ্টজীবদের মধ্য থেকে মানুষকে দিলেন তিনি শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা। বাকসর্বস্ব জীবন্ত মাখলুকাত হওয়ার সুবাদে মানুষকে দেয়া হলো সর্বচূড়ার এই স্থানটি। সৃষ্টির সেরাজীব হিসেবে অন্য সকল প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সেই থেকে মানুষের অধিকারে। শ্রেষ্ঠত্বের এই তকমা তিনি মানুষকে দিলেন শুধুমাত্র তার ভাষার কারণে। যা পৃথিবীর অন্য কোন প্রাণীকে দেয়া হয় নাই। সুতরাং ভাষা মানুষের সৃষ্টিগত এক মৌলিক অধিকার, যা সে অর্জন করেছে স্বয়ং তার সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে এক অমূল্য উপহারস্বরূপ। খোদায়ী শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ডে ভাষা ব্যবহারের বিচারে এই মানুষের মধ্যে দুই স্তরের মানব প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায় তাবৎ পৃথিবীর মনুষ্যসমাজে। যাকে উচ্চস্তর আর নিম্নস্তরের পার্থক্যে বিভাজন করেছেন বিজ্ঞ মানবপ্রকৃতি নির্ণয়কারী বোদ্ধামহল। সমাজে বসবাসকারী মানুষের জীবনাচারের প্রতি যদি আমরা সামান্য দৃষ্টি বুলাই তাহলে চোখের রেটিনায় সহজেই ভেসে উঠবে মানুষের এই স্তরসমূহ। সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের কারণে মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে পরিগণিত। পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে যুগে কালে কালে দেশে দেশে সমাজবদ্ধ এসকল মানুষের জীবনাচার পর্যবেক্ষণ করে গবেষকগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, মানুষের ভাষাই তাকে উচ্চ অথবা নিম্ন স্তরে ওঠানামা করিয়েছে। যার ভাষা সুন্দর সুশ্রাব্য, উন্নত, অর্থপূর্ণ, যিনি সদালাপী, মিষ্টভাষী, উন্নতভাষী, তিনি পৌঁছে যান মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে। আরোহণ করেন সমাজের শীর্ষে। অবস্থান করেন আকাশচুম্বী পাহাড় চূড়ায়, সমাজের, দেশের, রাষ্ট্রের, এমনকি পৃথিবীর তাবৎ মানুষের চোখের কোণায়, হৃদয়ের গভীরে, অন্তরের দহলিজে, স্মৃতির মজলিসে।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মহান স্রষ্টা আল্লাহ পাকের অমিয় ঘোষণা : তুমি কি লক্ষ্য করোনি, আল্লাহ তায়ালা ‘কালেমায়ে তাইয়েবা’র কি ( সুন্দর) উপমা পেশ করেছেন (এবং সেটি হচ্ছে- এ কালেমা) যেন একটি উৎকৃষ্ট (জাতের) গাছ, যার মূল (যমিনে) সুদৃঢ়, যার শাখা প্রশাখা আসমানে ( বিস্তৃত), প্রত্যেক সময়ই তা তার মালিকের আদেশে ফল দান করে; আল্লাহ তায়ালা মানুষদের জন্যে (এভাবেই) উপমা পেশ করেন, আশা করা যায় তারা (তার থেকে) শিক্ষা গ্রহণ করবে। (সূরা ইবরাহিম : ২৪-২৫) সুতরাং আমাদের সুন্দর কথার অভ্যাস করতে হবে। অনুশীলন করতে হবে মিষ্টি কথার। তবেই শ্রেষ্ঠজীব হিসেবে আল্লাহ প্রদত্ত পুরস্কারের যথাযথ হক আদায় করা সম্ভব হবে। মানুষ হিসেবে নিজেকে পৌঁছানো যাবে এক অনন্য উচ্চতায়। সাদা আর কাল যেমন সমান হতে পারে না, রাত এবং দিন যেমন এক হতে পারে না, হিমশীতল ছায়া এবং প্রখর রৌদ্র যেমন পারে না একই মেরুতে অবস্থান করতে, উঁচু আর নিচু যেমন চলতে পারে না একই সমান্তরালে, অন্ধ এবং চক্ষুষ্মান মানুষ যেমন কখনও হয় না একই মর্যাদাপূর্ণ, বাকসম্পূর্ণ এবং বাকপ্রতিবদ্ধী যেমন সমান নয়, মূর্খ এবং জ্ঞানী যেমন এক হয় না, মন্দ যেমন পারে না ভালোকে অতিক্রম করতে ঠিক তেমনি ভালোকথা এবং মন্দকথা কখনও সমান হতে পারে না। মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের অমোঘ ঘোষণাÑ “ভালোকথা এবং মন্দকথা, সুকথা এবং কুকথা কখনও সমান নয়। তুমি কু-কথাকে সেই সুকথা দিয়ে নিবৃত্ত করো যা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। তাহলে দেখবে তোমার প্রাণের শত্রু, জীবন হন্তারক, অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে।” (সূরা হা মিম আস সাজদা : ৩৪) অপর দিকে মন্দ কথা, খারাপ কথা, বাজে কথা, অসংলগ্ন কথা, অপ্রয়োজনীয় কথা, অবিবেচনাপ্রসূত কথা, অর্থহীন কথা মানুষকে নামিয়ে দেয় সর্বনিম্ন স্তরে। সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব হিসেবে সে পরিগণিত হয়। ঘৃণা, ধিক্কার, অসম্মান, অশ্রদ্ধায় লানতের জিঞ্জির আটকে যায় তার ললাটে। জমিনের মাটিতে ধূলিমলিন হয় তার মস্তক। নড়বড়ে হয়ে যায় বাসযোগ্য পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব। জীবিত থেকেও সে তখন সামাজিক জাহান্নামের আজাব ভোগ করতে থাকে। এ ব্যাপারে মহান প্রভু আল্লাহ পাকের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা : “আর একটি মন্দকথা তথা একটি কুকথা সেই গাছের মতো যার শাখা-প্রশাখা নির্জীব, শুকনো ঠনঠনে। যাকে ভূপৃষ্ঠ থেকে সহজেই উপড়ে দূরে নিক্ষেপ করা হয়, যার কোনো স্থায়িত্ব নেই।” (সূরা ইবরাহিম : ২৬) মন্দ কথা বর্জন করার জন্যে মহান মালিকের পক্ষ থেকে ঐশী কিতাবের মাধ্যমে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে যা নিম্নরূপ : ক) একটি মিষ্টি কথা এবং কোন অপ্রীতিকর ব্যাপারে সামান্য উদারতা ও ক্ষমাপ্রদর্শন এমনি দানের চেয়ে ভালো, যার পেছনে আসে দুঃখ ও মর্মজ্বালা। (সূরা বাকারা : ২৬৩) খ) মানুষ মন্দ কথা তথা কুকথা বলে বেড়াক এটা আল্লাহ পছন্দ করেন না। তবে কারোও প্রতি অন্যায় করা হলে তার কথা স্বতন্ত্র হিসেবে ধর্তব্য। (সূরা নিসা : ১৪৮) গ) পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ কর। যদি তোমাদের কাছে তাদের কোন একজনও বিদ্যমান থাকে বা বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে তাহলে তাদেরকে ‘উহ’ পর্যন্ত বল না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিও না বরং তাদের সাথে মর্যাদাপূর্ণ কথা বল। (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩) ঘ) তোমরা মিথ্যা কথা বলা থেকে যোজন যোজন দূরে থাক। (সূরা হজ্জ : ৩০) ঙ) আর যারা মুমিন পুরুষ ও মহিলাদের কোন অপরাধ ছাড়াই কষ্ট দেয় (কুকথা বলে) তারা একটি বড় অপবাদ ও সুস্পষ্ট গোনাহের বোঝা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়েছে। (সূরা আহজাব আয়াত : ৫৮) চ) তোমরা একে অপরকে বিদ্রুপ কর না এবং কাউকে খারাপ বা মন্দ নামে ডেকো না। (সূরা হুজুরাত : ১১) ছ) তোমরা বেশি বেশি ধারণা এবং আন্দাজ অনুমান করা থেকে বিরত থাক। কারো দোষ বা ছিদ্রান্বেষণ কর না। আর তোমাদের কেউ যেনো কারো গিবত না করে। (সূরা হুজুরাত : ১২) জ) এমন কোন শব্দ মানুষের মুখ থেকে বের হয় না যা সংরক্ষণ করার জন্য একজন সদা প্রস্তুত রক্ষক উপস্থিত থাকে না। (সূরা ক্বফ : ১৮) ঝ) তুমি অবদমিত হয়ো না তার দ্বারা, যে কথায় কথায় শপথ করে, গিবত করে এবং চোগলখোরি করে বেড়ায়, কল্যাণের কাজে বাধা দেয় এবং জুলুম ও বাড়াবাড়িতে সীমালঙ্ঘন করে। (সূরা কলম : ১০,১১,১২) মানবতার মহান শিক্ষক, চির অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শের বার্তাবাহক, নবী মোহাম্মদ (সা)-এর পবিত্র মুুখ নিঃসৃত কিছু অমর বাণীও আছে যেখানে অপ্রয়োজনীয় বেহুদা কথাবার্তা সম্পর্কে কারফিউ জারি করা হয়েছে। ক) আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়, মেহমানের সম্মান করে এবং কথা বলার সময় উত্তম কথা বলে অথবা চুপ করে থাকে। (সহিহ বুখারি কিতাবুল আদাব অধ্যায় ৩১ হাদিস নং ৬০১৮) খ) আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, মুনাফিক চেনার লক্ষণ হলো চারটি, ১, যে কথায় কথায় মিথ্যা কথা বলে ২. যে ওয়াদা করলে তার খেলাপ করে অর্থাৎ ভঙ্গ করে, ৩. তার কাছে কোন জিনিস আমানত রাখলে খেয়ানত করে এবং ৪. যে ঝগড়া বিবাদে অশ্লীল গালিগালাজপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করে। (সহিহ বুখারি ঈমান পর্ব অধ্যায় ২৪ হাদিস ৩৪) গ) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা) এরশাদ করেন, কোন মানুষকে গালি দেয়া ফাসিকি। (সহীহ বুখারি পর্ব ঈমান অধ্যায় ৩৬ হাদিস নং ৪৮) ঘ) হযরত হুজায়ফা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সা)কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, চোগলখোর ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহ বুখারী কিতাবুল আদাব অধ্যায় ৫০ হাদিস নং ৬০৫৬) ঙ) আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আল্লাহর রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, তোমরা একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ কর না, পরস্পর হিংসা কর না, পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ কর না। (সহিহ বুখারি পর্ব আদব অধ্যায় ৫৭ হাদিস ৬০৬৫) চ) উম্মে কুলসুম (রা) বর্ণনা করেন, তিনি আল্লাহর রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছেন, সে ব্যক্তি মিথ্যাচারী নয়, যে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য উত্তম কথা পৌঁছে দেয় অথব সুন্দর কথা বলে। (সহিহ বুখারি পর্ব বিবাদ মীমাংসা অধ্যায় ২ হাদিস ২৬৯২) ছ) সাহল বিন সাদ (রা) বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার জিহবা (ভাষা) এবং লজ্জাস্থানের জামানত আমাকে দিবে আমি তার জন্য জান্নাতের জামিনদার হবো। (সহিহ বুখারি হাদিস নং ৬৪৭৪) জ) সুফিয়ান বিন আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর নবী (সা)কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার দৃষ্টিতে আমার জন্য সবচাইতে আশঙ্কাজনক বস্তু কোনটি? তিনি তার জিহবা ধরে বললেন, এই যে এটি। (সহীহ ইবনে মাযাহ ৫ম খন্ড হাদিস নং ৩৯৭২) ঝ) সেই ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন নয়, যে উপহাস করে, মানুষকে অভিশাপ দেয়, অশ্লীল কথা বলে এবং যে বাচাল। (তিরমিজি) সুতরাং আসুন আমরা কথার বাণে মানুষকে আহত না করি। বরং ভালোবাসার সুবাস ছড়িয়ে জয় করি পৃথিবী ও মানুষের মন। প্রসঙ্গ ক্রমেই কবি জাকির আবু জাফরের একটি গানের কিছু কথা তুলে ধরলাম- অমায়িক ব্যবহার যার মুখে আছে/ পৃথিবীও ঋণী হয় ঠিক তাঁর কাছে । ব্যবহার জয় করে মানুষের মন/ পরাজিত হয়ে যায় অস্ত্র তখন বিনয়ের অফুরান শক্তি আছে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
আপনার মন্তব্য লিখুন