চট্টগ্রাম বিভাগের সর্ব উত্তরের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ১৯৮৪ সালে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা হতে ভাগ হয়ে একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে পরিচিতি পায় জেলাটি। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষা এই জেলা চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হলেও দূরত্বের দিক থেকে ঢাকার নিকটবর্তী। ভৌগোলিক দিক বিবেচনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাটি হলো দেশের বৃহত্তর তিনটি বিভাগের সংযোগস্থল। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বিভাগের সাথে ঢাকা ও সিলেট বিভাগের সংযোগ ঘটিয়েছে। ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথ পাড়ি দিয়েছে এই জেলার উপর দিয়ে। এই তিন বিভাগের মধ্যকার রেলপথের দূরত্ব বিবেচনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অবস্থান অনেকটা মাঝামাঝি পর্যায়ে। তাই এই জেলাতে গড়ে উঠেছে আজমপুর ও আখাউড়া নামে দুটি রেলওয়ে জংশন। তাছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরসহ আরো প্রায় ১৩টি রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে এই জেলায়। আবার সড়কপথে ঢাকা-সিলেট ও সিলেট-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পাড়ি দিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপর দিয়ে। তাছাড়া বাংলাদেশের সাথে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের সেভেন সিস্টার্স খ্যাত ৭টি প্রদেশের সংযোগ ঘটেছে এই জেলার মাধ্যমে। রয়েছে দুই দেশের মধ্যকার মহাসড়ক। সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে রেলপথ করারও। ফলে দুই দেশের মধ্যকার ব্যবসায়িক লেনদেনের সুবিধার্থে জেলার সীমান্তবর্তী আখাউড়া উপজেলায় গড়ে উঠেছে একটি স্থলবন্দর। জলপথ হিসেব করলে দেখা যায় এ জেলায় রয়েছে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক নদী, নাম তার তিতাস। এছাড়াও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেঘনা নদীর স্রােতধারাও প্রবাহিত হয়েছে এই জেলার বুক চিরে। ফলে জেলায় প্রবাহিত নদীর কূলে অবস্থিত আশুগঞ্জ উপজেলায় গড়ে উঠেছে আরো একটি নৌবন্দর। এছাড়াও তিতাস গ্যাস ফিল্ড, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, খাদ্যগুদাম ও জিয়া সার কারখানার ন্যায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই জেলায়। আর এ সকল দিক বিবেচনায় অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে দেশের অন্যতম এই জেলাটি। প্রায় ৯২ শতাংশ মুসলমানের এই বাংলাদেশ ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ ও চর্চার দিক থেকেও অগ্রগামী এই জেলার মানুষ। এই জেলাতেই জন্ম হয়েছিল দেশের প্রথিতযশা দ্বীনি আলেম ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম, সৈয়দ আজগর আহমদ (পীর সাহেব), মাওলানা সিরাজুল ইসলাম (বড় হুজুর), মুফতি ফজলুল হক আমিনী, মুফতি নুরুল্লাহ, মাওলানা সাজিদুর রহমান, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব ও মুফতি মোবারকউল্লাহ সহ অসংখ্য আলেমে দ্বীন। জন্ম হয়েছিল অধ্যাপক গোলাম আযমের মতো দ্বীনের উপর ব্যুৎপত্তির জ্ঞানসম্পন্ন এক সংগঠকের। জন্ম হয়েছিল আল মাহমুদের ন্যায় দেশশ্রেষ্ঠ এক বিশ্বাসী কবির। ফলে এই জেলার পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। দ্বীনের সহীহ ইলম বিতরণের মাধ্যমে এদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে যুগ যুগ ধরে ভূমিকা রেখে আসছে কওমি শিক্ষাব্যবস্থা। ২০১৫ সালে করা বাংলাদেশ সরকারের জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশে প্রায় ১৩৯০১টি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। তবে বেসরকারি হিসাব মতে মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজারের অধিক। জেলাভিত্তিক হিসাব মতে যে কয়েকটি জেলায় কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা অত্যধিক তার মাঝে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্যতম। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ৩০টি, যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৫০০০ জন। অন্যান্য উপজেলাতেও মাদ্রাসা ও শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় সমান হারে। এসকল মাদ্রাসার ভেতরে রয়েছে আবার অনেক হেফজখানা। যেখানে কওমি শিক্ষাব্যবস্থার সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরা হাদীস অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা গড়ে উঠছে কুরআনের হাফেজ হিসেবেও। তারা ছড়িয়ে পড়ছে জেলার সর্বত্রসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে। প্রচার ও প্রসার করছে দ্বীনের সহীহ ইলম। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে একটি জেলাই এত সংখ্যক দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থী থাকার ফলে জেলার সাধারণ মানুষদের উপরও পড়েছে এর প্রভাব। ঈমান ও ইসলামের ব্যাপারে সদা-সর্বদা সচেতন জাগ্রত মুসলিম তৈরি হয়েছে এই জেলায়। তাই ঈমান ও ইসলামের উপর কোনো আঘাত এলে ঈমানী চেতনা নিয়ে শহীদি তামান্নায় প্রতিবারই গর্জে উঠেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুসলমানেরা। আলেমদের নেতৃত্বে রাজপথে নেমে জীবন দিয়ে রক্ষা করেছে ইসলামের সম্মান। এটিই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতীত ইতিহাস, যা মুছে যাবার নয়।
গত ২৬ শে মার্চ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বর্ষপূর্তি উদযাপনের একটি সোনালি দিন। যে দিনটি আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমে উদযাপনের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছিল সমগ্র জাতি। তবে এই উচ্ছ্বাসের ভাটা পড়ল যখন এদেশের মানুষ জানতে পারল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের জন্য মেহমান করা হচ্ছে একজন রক্তপিপাসু নরপিশাচ মুসলিমবিদ্বেষীকে। যে কিনা গুজরাটের মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত করেছিল, পরিচিতি পেয়েছে গুজরাটের কসাই নামে; মুসলমানদের শত বছরের ঐতিহ্য বাবরি মসজিদ ভেঙে তদস্থলে মন্দির নির্মাণের মাধ্যমে ধ্বংস করেছে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি; ক্রমান্বয়ে মুসলিম নিধনের লক্ষ্যে ভারতে বৃদ্ধি করেছে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ; প্রায় ৭০ বছর পূর্বে মীমাংসিত ইস্যু কাশ্মীরি জনগণের স্বাধীনতাকে করেছে কারারুদ্ধ, আইনিভাবে প্রাপ্ত কাশ্মীর পরিচালনার স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনাকে অকারণে ছিনিয়ে নিয়েছে জোরজবরদস্তি করে। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেই নরেন্দ্র মোদিকে ৯২ ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশ ও জনগণ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রধান অতিথি হিসেবে কিভাবে মেনে নিবে এদেশের মানুষ? তাইতো সুবর্ণজয়ন্তীর সেই দিনের আগে থেকেই বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে দেশপ্রেমিক তৌহিদী জনতা। ডান-বাম নির্বিশেষে সকল মতাদর্শের মানুষই অবস্থান নেয় এই কসাইয়ের আগমনের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে অসংখ্য ইস্যুতে আন্দোলন হয়। তবে এটি এমন একটি ইস্যু ছিল যেখানে বাংলাদেশের বিরাজমান প্রায় সকল ইসলামিক দলগুলো এবং বামপন্থী দলগুলো অবস্থান নেয় মোদির আগমনের বিরুদ্ধে। যে আন্দোলনে ইসলামপন্থী ও বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর উপস্থিতিও ছিল সরব। সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদেরও। মোদিবিরোধী আন্দোলনে আরো অংশগ্রহণ করেন দেশের সুশীলসমাজের নাগরিকবৃন্দ। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ব্যতীত বাংলাদেশের প্রায় সকল মতাদর্শের মানুষই অবস্থান নেয় নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সারাদেশ সভা-সমাবেশ ও মিছিল করে বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ। তদুপরি ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার দেশের প্রায় সকল জনগণের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কসাই মোদিকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। মোদির আগমনের নির্ধারিত দিন ছিল ২৬ মার্চ। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদেশেই প্রতিবাদ মিছিল ও সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এসকল কর্মসূচির অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম। কর্মসূচি বানচাল করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে বাধা সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ সরকার। গ্রেফতার করা হয় প্রায় শতাধিক দেশপ্রেমিক জনতাকে। পরের দিন ২৬ মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বর্ষপূর্তির সেই কাক্সিক্ষত দিন। পূর্বঘোষিত কোনো কর্মসূচি না থাকলেও হাজার হাজার তৌহিদী জনতার সমাগম হয়েছে বায়তুল মোকাররম মসজিদে। তবে জুমার নামাজের জন্য মুসল্লিরা সমাগত হলেও নাস্তিক্যবাদী আওয়ামী লীগের ভীতি সেই বায়তুল মোকাররমকে কেন্দ্র করেই। মোদিবিরোধী আন্দোলনের প্রকোপ ছড়ানোর আতঙ্কে অস্থির তারা। তাই সাধারণ জনগণের আন্দোলনের ভয়ে ভীত আওয়ামী লীগ পূর্ব থেকেই পরিকল্পনা গ্রহণ করে বায়তুল মোকাররমকে কেন্দ্র করে। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ক্যাডার বাহিনী সাধারণ মুসল্লি বেশে প্রবেশ করে বায়তুল মোকাররমে। যথারীতি সময়ে জুমার নামাজ শেষ হলেই সাধারণ মুসল্লিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। আহত করা হয় শত শত মুসল্লিকে। তৎক্ষণাৎ এই আক্রমণের শিকার হয় নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবার স্লোগান দিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তৌহিদী জনতা। আর তখনই পুলিশ বাহিনী বায়তুল মোকাররম অভিমুখে সাধারণ মুসল্লিদের টার্গেট করে নির্বিচারে গুলি চালায়। আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশ বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণে অশান্ত হয়ে যায় বায়তুল মোকাররমের আশপাশ। জায়নামাজের পরিবর্তে ইট পাথর আর রাবার বুলেটে পরিপূর্ণ হয়ে যায় বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণ। আহত হয় শত শত সাধারণ মুসল্লি। বায়তুল মোকাররমে অবরুদ্ধ হয়ে থাকে সহস্রাধিক তৌহিদী জনতা। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র বায়তুল মোকাররমের এহেন ন্যক্কারজনক ঘটনার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশজুড়ে। আওয়ামী সন্ত্রাসী কর্তৃক সাধারণ মুসল্লিদের ওপর এই আক্রমণের প্রতিবাদে সারাদেশেই শুরু হয় বিক্ষোভ। চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও শুরু হয় প্রতিবাদ মিছিল। সারাদেশের ন্যায় এই দুই জায়গাতেও আওয়ামী মদদপুষ্ট পুলিশ বাহিনী হামলা চালায় প্রতিবাদরত সাধারণ মুসলমানদের উপর। হাটহাজারীতে দারুল উলুম মইনুল ইসলাম কওমি মাদ্রাসায় পুলিশের সাথে আক্রমণে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসীরা। তাতে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ নিহত হয় ৪ জন মুসল্লি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উপকণ্ঠ অবস্থিত নন্দনপুর এলাকায় প্রতিবাদরত মুসল্লিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। সেখানে পুলিশের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন আশিক নামে একজন শ্রমিক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আনন্দে উচ্ছ্বসিত এক আলোকময় দিনের পরিবর্তে রক্তে পিচ্ছিল এক অন্ধকার দিনের সূচনা করে আওয়ামী লীগ। যেখানে সুবাসের পরিবর্তে ছিল বারুদের গন্ধ, স্বাধীনতার স্লোগানের পরিবর্তে ছিল সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ, স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দের পরিবর্তে ছিল আপনজন হারানোর বেদনা। একজন রক্তপিপাসু উগ্রবাদী নরেন্দ্র মোদিকে সম্মান জানাতে গিয়ে দেশের মাটিতেই দেশের সন্তানদের গুলি করে হত্যা করল আওয়ামী সরকার। স্বাধীনতার দিনে সৃষ্টি করলো এক ন্যক্কারজনক অধ্যায়ের। দেশের প্রধান কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ সারা দেশে সাধারণ মুসল্লিদের ওপর আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশ বাহিনীর আক্রমণ এবং হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যৌথ বাহিনীর আক্রমণে ৫ জন নিহতের প্রতিবাদে পরের দিন ২৭শে মার্চ রোজ শনিবার সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ও ২৮ মার্চ রবিবার সারাদেশে হরতাল কর্মসূচির আহ্বান করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
২৭ মার্চ রোজ শনিবার। ইসলামিক দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হেফাজতে ইসলামের আহবানে সাড়া দিয়ে সারা দেশেই পালন হয় বিক্ষোভ মিছিল। অসংখ্য আলেমের চারণভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরেও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন হয় বেলা ১টার দিকে। মিছিলের অংশগ্রহণকারীদের মাঝে অধিকাংশই ছিল কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া, জামিয়া দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া ও জামিয়া সিরাজিয়া উলুম মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে সেই কর্মসূচিতে। যথারীতি বিক্ষোভটি শহরের কিছু অঞ্চল প্রদক্ষিণের পর আনুমানিক ১টা ৩০ মিনিটে মিছিলের কার্যক্রম সমাপ্ত হয়। অতঃপর স্ব স্ব মাদ্রাসায় ফিরে যায় সকল শিক্ষার্থী। এ সময় শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত উন্মুক্ত মঞ্চে জেলা আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা চলছিল। যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সদর আসনের এমপি জনাব র আ ম উবায়দুল মোকতাদির। আলোচনা সভাটি আনুমানিক বিকাল সাড়ে ৪ ঘটিকায় সমাপ্ত হয়। আলোচনা সভা শেষে জনাব উবায়দুল মোকতাদিরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল বের করে এগিয়ে যায় শহরের মূল রাস্তাটি এ রোড দিয়ে। মিছিলটি জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা বরাবর গেলেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র অবস্থায় এগিয়ে যায় মাদ্রাসার দিকে। উল্লেখ্য, মাদ্রাসাটি মূল সড়ক হতে প্রায় ২৫০ গজ ভেতরে গলিপথে অবস্থিত। তখন শান্তশিষ্ট পরিবেশে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ পড়াশোনা করছে আবার কেউ কেউ বিশ্রাম নিচ্ছে। এ অবস্থায় মাদ্রাসার গেটে গিয়ে আক্রমণ করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। ইট পাথর দিয়ে ঢিল নিক্ষেপের পাশাপাশি মাদ্রাসাকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হয় ককটেল ও হাতবোমা। ফলে আহত হয় অসংখ্য শিক্ষার্থী। জীবন বাঁচাতে অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকা শিক্ষার্থীরা নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার স্লোগান দিয়ে গড়ে তোলে প্রাথমিক প্রতিরোধ। ততক্ষণে ছাত্রলীগ বাহিনীর সাথে আক্রমণে যুক্ত হয় পুলিশ ও বিজিবি। নির্বিচারে গুলি চালানো হয় নিরস্ত্র শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর। উপায় অন্তহীন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এক পর্যায়ে নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে মাইকে আহ্বান করে সাহায্যের। নির্যাতিত-নিপীড়িত অসহায়দের আর্তনাদ শুনে এক পর্যায়ে বেরিয়ে আসে এলাকার সাধারণ মানুষ। মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ছাত্রলীগ ও যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে। ফলে প্রতিরোধের এক পর্যায়ে মাদ্রাসা গেট ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারিদিক। প্রশাসনের নির্দেশে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে শহরজুড়ে। ফলে গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে যায় গোটা শহর। এদিকে মাদ্রাসা গেট থেকে বিতাড়িত ছাত্রলীগ আক্রমণের ছক পরিবর্তন করে গ্রহণ করে নতুন কৌশল। মাদ্রাসার পার্শ্ববর্তী ভবনের ওপর থেকে মাদ্রাসার ভেতরে মুহুর্মুহু গুলি চালায়। ক্রমান্বয়ে আহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেদিনের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত প্রত্যক্ষদর্শী জনাব মাহবুব বলেন, “সেদিন সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পর বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় শহরে। ফলে চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে যায়। এ সময় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মাদ্রাসার পার্শ্ববর্তী ভবনের ওপর থেকে মাদ্রাসাকে টার্গেট করে গুলিবর্ষণ করে। আর মাদ্রাসা বরাবর রাস্তায় কেউ এলেই তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় বিজিবি। আমার আহত হওয়ার ঘটনা অনেকটা এমন- আমরা কয়েকজন মিলে ঘটনাস্থলের দিকে যাচ্ছিলাম। আর তখনই হঠাৎ করে আমার কোমরের কিছুটা নিচে পায়ের উরুতে একটি গুলি এসে লাগে। অতঃপর শিক্ষার্থীরা আমাকে মাদ্রাসার ভেতরে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।” এমন লোমহর্ষক বর্ণনা হয়তো আরো অনেকের কাছ থেকে জানা যাবে। এভাবেই শিক্ষার্থী ও আন্দোলনরত তৌহিদী জনতাকে অন্ধকারে ফেলে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে নিহত ও আহত করে যৌথবাহিনী। সেদিনের ঘটনায় ৩ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ মোট ৮ জন শাহাদাত বরণ করেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিলেন প্রায় ৩০ জন। যাদের কেউ কেউ পরবর্তীতে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। সেদিনের ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, একজন সাংসদের নেতৃত্বে থাকা মিছিল থেকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করেছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ওপর। যে হামলায় সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারি। একজন সংসদ সদস্য যখন পাশে থেকে এহেন ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের নির্দেশ দিতে পারেন তখন তার অধস্তনরা কতটুকু ভয়াবহতা প্রদর্শন করতে পারে তা সকলের নিকট বোধগম্য। ইতঃপূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এরকম ঘটনা ঘটেনি, যেখানে নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছে। শতবর্ষী একটি দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর এই বর্বরোচিত হামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আবারো প্রমাণ করলো তারা এদেশের আলেমসমাজকে কখনো মন থেকে গ্রহণ করেনি। গ্রহণ করেনি ইসলামের রীতি রেওয়াজকেও। এভাবেই উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে কেটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর সেদিনের রাত। আওয়ামী লীগ চেয়েছিল ২৭ তারিখের আক্রমণের মাধ্যমে তৌহিদী জনতার কণ্ঠস্তব্ধ করতে যেন পরের দিন ২৮ মার্চ হরতাল কর্মসূচিতে কেউ সক্রিয় হতে সাহস না পায়। তবে তাদের সেই স্বপ্নকে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে ইসলামপ্রিয় ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী। ২৮ তারিখের হরতালেও শান্তিপূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৌহিদী জনতা। শহরের পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলা পর্যায়েও সফল হরতাল পালন হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে। ২৮ তারিখ সকালে আগের দিনের শহীদের জানাজার জন্য তৌহিদী জনতা সমবেত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অন্যতম দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামিয়া দারুল আরকামের সামনে। দ্বীনের জন্য জীবন দেয়া ভাইদের জন্য দোয়া করবেন সকলে মিলে, অশ্রু ঝরাবে কিছুক্ষণ। তবে সেখানেও বাধা দেয় আওয়ামী মদদপুষ্ট বিজিবি ও পুলিশের যৌথবাহিনী। হট্টগোলের একপর্যায়ে গুলিবর্ষণ করা হয় জানাজায় উপস্থিত হওয়া জনতাকে লক্ষ্য করে। জানাজায় বাধাদানের এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনের প্রকোপ আরো বৃদ্ধি পায় এবং ছড়িয়ে পড়ে পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরজুড়ে। আওয়ামী সন্ত্রাসী ও সরকারি মদদপুষ্ট যৌথবাহিনীর হামলায় সেদিন দারুল আরকামের পার্শ্ববর্তী পীরবাড়ি এলাকায় স্থানীয় ৩ জন এবং সোহিলপুরে ১ জনসহ মোট ৪ জন শাহাদাত বরণ করেন। লাশের পর লাশ দেখে রাগের রোষানলে জ্বলে পুড়ল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৌহিদী জনতা। দুই দিনে এতগুলো শহীদের কফিন দেখে আর স্থির থাকতে পারেনি ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী। ফলে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তারা। ক্ষিপ্ত হয়ে ভাঙচুর করে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারির বাসাসহ আওয়ামী নেতৃবৃন্দের কিছু বাড়িতে। তাছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অবস্থিত প্রায় সকল সরকারি স্থাপনায় আঘাত করে তারা। আর এই বিষয়গুলোকে কেন্দ্রবিন্দুতে এনে আওয়ামী মদদপুষ্ট মিডিয়া এটি বলার চেষ্টা করছে যে, তৌহিদী জনতা রাষ্ট্রীয় নীতিবহির্ভূত কাজ করেছে। তবে এই বিষয়টি নিয়ে যেকোনো সচেতন নাগরিক যদি চিন্তা করেন তবে একটি বিষয় সকলের হৃদয়ে উপলব্ধি হবে যে, যেখানে সরকারদলীয় সাংসদ-এর নেতৃত্বে সরকারদলীয় সন্ত্রাসী বাহিনী আক্রমণ করে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। আর জানাযার মাঠে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে গিয়ে যখন রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা আবারও হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়, তখন এই জালিম রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা আর কিইবা হতে পারে? আমি মনে করি সেদিনের তৌহিদী জনতার সেই প্রতিবাদের ভাষা ছিল যথার্থ। কারণ জালিম শাসকের বিরুদ্ধে যদি দুর্বলতা প্রদর্শন করা হয় তবে তার জুলুম ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। বৃদ্ধি পেতে থাকে নির্যাতিতদের সংখ্যা আর বইতে থাকে খুনের দরিয়া। তাই প্রতিবাদের মাধ্যমে এই জালিম সরকারকে চপেটাঘাতের কোনো বিকল্প সেদিন ছিল না ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর কাছে। দিন শেষে হিসাব করে দেখা যায় দুই দিনে ১২ জন তৌহিদী জনতার জীবন কেড়ে নিয়েছে এই আওয়ামী শাসনব্যবস্থা। তবে এই মৃতের সংখ্যা পরবর্তীতে ১৭ জনে পৌঁছায়। ১৭ জন শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রূপ নিলো শহিদবাড়িয়ায়। নিহত ১৭ জনের মাঝে ৩ জন ছিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। আর অবশিষ্ট ১৪ জন সাধারণ মুসলিম। যাদের অনেকেই দিনমজুর, শ্রমিক এবং একেবারেই সাধারণ জীবন যাপন করা মানুষ। আহতদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে ৬০০ জন। যাদের নামের তালিকা সংরক্ষিত হয়েছে। তবে নাম তালিকাবিহীন আহতের সংখ্যা আরো অনেক। শহীদ ও আহতদের তালিকা থেকে এটি বুঝা যায় যে শুধুমাত্র মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাই এ আন্দোলনে ভূমিকা রাখেনি বরং তাদের সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আমজনতাও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। এই সমীক্ষাটি আরো প্রমাণ বহন করে এখানকার মানুষের ইসলামপ্রিয়তা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দৃঢ়তার।
ইতঃপূর্বেও ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সরব ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৌহিদী জনতা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলেমসমাজের নেতৃত্বেই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই পতনের সূচনা হয়েছিল তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারের। আর এবারও এ মাটির মানুষেরা প্রমাণ রেখেছে কিভাবে প্রতিরোধ করতে হয় ইসলামবিদ্বেষী শক্তির। কিভাবে জীবন দিতে হয় সত্যের পক্ষে। জীবন দিয়ে আহত ও পঙ্গুত্ব বরণের মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর এই ত্যাগ ইতিহাসে হয়ে থাকবে চির অম্লান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আজ নির্যাতিত-নিপীড়িত অসহায় মানুষের জন্য এক শক্তি ও সাহসের নাম, ফ্যাসিবাদী সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠের নাম, নিরাশার মেঘে ঢাকা আশাহত মানুষের নতুন স্বপ্নের নাম, অত্যাচারী জালেম শাসকের জন্য আতঙ্কের নাম। এটিই এখন শহীদদের জনপদ শহিদবাড়িয়া। লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন