post

ভারতবর্ষে ইসলামী দাওয়াহ ও সংস্কার আন্দোলন [ শেষ পর্ব ]

আব্দুদ্দাইয়ান মুহাম্মদ ইউনুছ

১৪ জুলাই ২০২২

কতিপয় ধর্মীয়, সামাজিক আন্দোলন এবং চিন্তাধারা

আহলে হাদিস আন্দোলন

সৈয়দ আহমদ বেরলবীর মুজাহিদুন আন্দোলনের অনেক অনুসারী ১৮৫৭ সালের পর ১৮৫৮-১৮৮০ সালের মধ্যে আহলে হাদিস আন্দোলন শুরু করেন। এই ক্ষেত্রে মাওলানা বেলায়েত আলী, মাওলানা এনায়েত আলী, নবাব সিদ্দীক হাসান খান ভুপালি ও মাওলানা নাজির হোসাইন গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। আহলে হাদিস কুরআন সুন্নাহকে বিশ্বাস এবং অনুসরণ করার নীতিতে বিশ্বাসী তবে তাঁরা কোনো মাজহাব মানে না। মাজহাবের চেয়ে হাদিসের উপর তারা বেশি জোর দেন। ইজতিহাদ ও ইজমা মানলেও কিয়াস তাঁরা মানে না। তারা নিজেদেরকে আহলে হাদিস বলে দাবি করলেও তাদের বিরোধীরা তাদেরকে লামাজহাবি, ওয়াহাবি, গায়রে মুকাল্লেদ, সালাফি আন্দোলন প্রভৃতি নামে অভিহিত করেন। 

ব্রিটিশবিরোধী আজাদি আন্দোলন ও মাওলানা খায়েরাবাদী

মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী ১২০৩ সালে বঙ্গ বিজয় করার পর থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন ছিল। মুসলিম শাসনের সময় মুসলমানেরা কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না বরং সংখ্যালঘিষ্ঠ থাকার পরও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু, বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীগণ মুসলিম শাসন মেনে নেয়। কারণ ইতঃপূর্বে হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসকদের নির্যাতনে ভারতের মানুষ অতিষ্ঠ ছিলো। যেমনিভাবে স্পেনে মুসলিম শাসনের সময় রাজা রডারিকের নির্যাতনে সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টানরা মুসলিম শাসন মেনে নেয়। মূলত জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাসহ মুসলিম শাসনামলে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়। নাগরিক সুযোগ সুবিধা অনেক বৃদ্ধি পায়। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তা-ঘাট নির্মিত হয়। এক কথায় জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির কারণে জনগণ সন্তুষ্টচিত্তে মুসলিম শাসনকে স্বাগত জানায়।

১৭৫৭ সালে মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন হয়। শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের রেঙ্গুন নির্বাসনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে শত শত বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। সিপাহি বিপ্লবোত্তর সীমাহীন নির্যাতন, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো অথবা আন্দামানে নির্বাসনে দেওয়ার মাধ্যমে মুসলমানদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস চালানো হয়। ১৮৫৭ সালে ভারতে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন তুমুল পর্যায়ে উন্নীত হয়। এই সময় দিল্লির সম্রাট বাহাদুর শাহ এক ফরমানের মাধ্যমে বিদেশী সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জনসাধারণের প্রতি আহবান জানায়। উক্ত আহবানে জনগণ বিপুলভাবে সাড়া দেওয়ায় ইংরেজদের ক্ষমতার ভিত নড়ে ওঠে। তারা স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের উপর জুলুম নির্যাতন চালায়। ১৮৫৭ সালে লালবাগের কেল্লা রক্তে রঞ্জিত হয় হাজারো মুসলমানের লহুতে। লালবাগের যেই স্থানটিতে স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের রক্ত ঝরে সেই স্থানটিকে পরবর্তীতে ইংরেজরা কারাগারে পরিণত করে। ইংরেজদের হাতে বন্দী বিপ্লবী মুসলমানদের অনেককেই বিচারের নামে প্রহসন করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। একইভাবে নিষ্ঠুরভাবে হাজার হাজার মানুষকে ফাঁসি দেওয়া হয়। সেই সময় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরবাসে দণ্ডিতদের সংখ্যাই ছিল দশ হাজারের বেশি। আন্দামানে বন্দী ফজলে হক খায়রেবাদী লিখেন,“স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিযোগ প্রমাণিত হলেই হিন্দুদেরকে আটক করা হতো; আর মুসলমানদেরকে হত্যা করা হতো।” 

১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পর মুসলমানদের রাজনৈতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ইংরেজগণ বিপ্লবের জন্য একমাত্র মুসলমানদেরকেই দায়ী করে তাদের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাতে থাকে। বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী ওলামায়ে কেরাম ও সাধারণ মুসলমানদের অনেকই ইংরেজদের রোষানলে পড়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেন। কেউ মাল্টা বা আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত হন। কেউ দীর্ঘকাল যাবৎ কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অন্তরীণ থেকে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়।১ ব্রিটিশ ঐতিহাসিক থমসন তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, ১৮৬১ সালে উপমহাদেশে ইসলামিক স্কলার, ও কুরআনবিরোধী ব্রিটিশ সরকারের নেতিবাচক পদক্ষেপ বেড়ে যায়। প্রায় তিন লক্ষাধিক কুরআন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ১৮৬৪-১৮৬৭ এই তিন বছর বিশেষভাবে জুলুম নির্যাতন পরিচালিত হয়। দিল্লি- হায়দরাবাদে প্রায় চৌদ্দ হাজারের মত স্কলারকে ফাঁসি দেয়া হয়। অনেক আলেমকে হাতির সাথে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে মারা হয়। অনেক আলেমকে উপহাস করে নদীতে ফেলা হয়। তাঁরা যখন ঢেউয়ের সাথে দুলতেন তখন বুলেট নিক্ষেপ করে মেরে উল্লাস করা হতো।

অনেক আলেম উলামাকে ব্রিটিশ আমলে আন্দামানে নির্বাসন দেয়া হয়। আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী তাঁদের একজন। ১৭৯৭ সালে তাঁর জন্ম হয়। তিনি ১৮৫৭ সালের আজাদি আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ ওয়াজিব এই ফতোয়ার কারণে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে ১৮৫৯ সালে আন্দামানে নির্বাসনে পাঠানো হয়। আন্দামানে বন্দী থাকার সময় তিনি কথিত কাফনের এক টুকরো কাপড়ে ও কতিপয় বিচ্ছিন্ন কাগজে কয়লা দ্বারা লিখেন। তা পরবর্তীতে আসসাওরাতুল হিন্দিয়া ও কাসিদাতু ফিতনাতিল হিন্দিয়া নামে প্রকাশিত হয়। মাওলানা বন্দিজীবনের প্রথমে শ্রমিকদের মত কাজ করতে হতো। তিনি যে জেলে থাকতেন ঐ জেলের জেলার সাহেব জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে ফার্সি ভাষায় লিখিত একটা পুস্তক পাঠোদ্ধারের জন্য জনৈক শিক্ষিত কয়েদিকে দেন। উক্ত কয়েদি মাওলানা খায়রাবাদীকে উক্ত পুস্তক দিলে তিনি পুস্তকটির প্রয়োজনীয় স্থানে টীকা লিখে দেন। উক্ত কয়েদি তারপর জেলার সাহেবকে উক্ত পুস্তক টীকাসহ প্রদান করলে তিনি খুব খুশি হন এবং তাৎক্ষণিকভাবে জেলখানায় ছুটে যান মাওলানা খয়েরাবাদীকে দেখতে। কিন্তু মাওলানা তখন ব্যারাকে ছিলেন না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর কাঁধে কোদাল ও বগলের নিচে টুকরি নিয়ে তিনি সাধারণ কয়েদিদের সাথে ব্যরাকে ফিরার দৃশ্য দেখে জেলার অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলে উঠেন, “যে হাতের স্পর্শে সোনার কলম ধন্য হতো আজ সে হাতে টুকরি-কোদাল উঠিয়াছে।” তার পরপরই মাওলানার মুক্তির জন্য সরকারের কাছে তিনি বিশেষভাবে সুপারিশ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে মাওলানার মুক্তির আদেশ কারাগারে পৌঁছার আগেই তিনি বন্দী অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।২ 

দেওবন্দ আন্দোলন ও দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা 

দারুল উলুম দেওবন্দ নিছক কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়; এটি উপমহাদেশে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনেরই অংশ। ইংরেজদের হাতে যখন ভারতের মুসলমানেরা ক্ষমতা হারিয়ে দিশেহারা সেই সময় মুসলমানদের মাঝে দ্বীনি চেতনা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ভারতের উত্তর প্রদেশের শাহরানপুর জেলার দেওবন্দ গ্রামে ছাত্তা মসজিদের ডালিম গাছের তলায় ১৮৬৬ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি নিছক কোনো প্রতিষ্ঠান নয় বরং দ্বীনি ইলম ও আকিদার সংরক্ষণ এবং শরিয়তের বিশুদ্ধ শিক্ষাদান ছিল এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার অন্যতম মাকসাদ। বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মাওলানা কাসেম নানতুবী, মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহী, শাহ রফিউদ্দিন, জুলফিকার আলি ও হাজী সাইয়্যেদ আবিদ হোসাইন এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সা. স্বপ্নযোগে কাসেম নানতুবীকে এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। এই মাদরাসার ছাত্ররা কুরআন, হাদিস, তাফসীর, ফিকহসহ ইসলামী জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় অবদান রাখেন এবং শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশে নয় বরং বিশ্বব্যাপী ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে অবদান রাখছেন। দেওবন্দ সহিহ আকিদার প্রচার, ইবাদত ও মুয়ামেলাতের ক্ষেত্রে পরিশুদ্ধি আনয়ন, তাফসীর, হাদিসের শরাহ, ফিকহসহ দ্বীনি কিতাব রচনায় বিরাট ভূমিকা পালন করছে। 

দেওবন্দ মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের মাধ্যমে অতীতে অনেক আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে মিথ্যা নবী হিসাবে ফাতওয়া দিয়ে তাহরিকে খতমে নবুওয়াত, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, জমিয়তে উলামায়ে ইলাম ও সিপাহি সাহাবা। এই প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ফিকহে হানাফির অনুসারী হলেও শাফেয়ি, মালেকি ও হাম্বলি মাজহাবকে বিশুদ্ধ মনে করে। তাসাউফের ক্ষেত্রে চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, কাদেরিয়াহ ও সোহরাওয়ার্দিয়া সিলসিলার অনুসারী। ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে দুই ধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে: ১. মাওলানা সাইয়েদ আহমদ মাদানির দৃষ্টিতে মুসলিম-হিন্দু, শিখ-খ্রিস্টানসহ ভারতে বসবাসরত সকল ধর্মাবলম্বী একই জাতিভুক্ত। এদের মাঝে বিভাজন ইসলামের দৃষ্টিতে ঠিক নয়। তিনি এই লক্ষ্যে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। ২. মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানীর দৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলিম এক জাতি নয়। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সমর্থন করেন।

আলীগড় আন্দোলন ও স্যার সাইয়েদ আহমদ খান

১৮৫৭ সালে ভারত সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশদের করতলগত হয়। ভারতে আলেম-উলামাদের উপর চলে জুলুম নির্যাতনের স্টিমরোলার। জেল-জুলুম ফাঁসি দেওয়া হয় অনেককেই। সেই সময় শহীদ সাইয়েদ আহমদ বেরলবীর অনুসারীরা চারভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল নিরেট দ্বীনি শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করে দেওবন্দ মাদরাসা। অরেক দল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। আরেক দল ব্রিটিশদের বিরোধিতা থেকে বিরত থেকে ঈমান রক্ষার চেষ্টা করেন। চতুর্থ দল হচ্ছে স্যার সাইয়েদ আহমদ খানের নেতৃত্বে ব্রিটিশদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে মুসলমানদের জাগতিক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। আলিগড় আন্দোলন মূলত মুসলমানদের জাগতিক উন্নয়নের আন্দোলন। সেই সময় মুসলমানদের মাঝে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। কারণ ব্রিটিশরা ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে এমন একদল ভারতীয় তৈরি করতে চেয়েছিল যারা রক্ত মাংসে ভারতীয় আর চিন্তা চেতনায় হবে ইংরেজদের মতো। ইংরেজি শিক্ষার প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের কারণে মুসলমানেরা সরকারি চাকরিতে যোগদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। সেই সময় স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) মনে করেন মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা করা উচিত এবং ব্রিটিশদের সাথে বিরোধিতার পরিবর্তে সুসম্পর্ক বজায় থাকা উচিত। তাই তিনি ব্রিটিশ সরকারের সাথে সুসম্পর্ক কায়েম করার উদ্দেশ্যে ১৮৭৫ সালে তিনি ইংরেজদের আদলে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য মোহামেডান এঙ্গলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৫ সালের ২৪ শে মে তিনি আলিগড় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে ১৯২০ সালে তা আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। তাঁর আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানেরা ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে যেন হিন্দুদের মত সরকারি অফিস আদালতে চাকরি করার সুযোগ পান। স্যার সৈয়দ আহমদ খান তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে একটি তাফসীর রচনা করেন। এই তাফসীরটি ইমাম আবদুহ ও রশীদ রেদার তাফসীর আল-মানারের মত আধুনিক তাফসীর হিসাবেই পরিচিত।

মূলত আলফেসানির একই ধারায় শাহওয়ালি উল্ল্যাহ ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের পর আবার অমানিশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় মুসলিম উম্মাহ। সেই সময় কারো কারো ধারণা জন্মে যে পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুসরণের মাঝে মুসলমানদের মুক্তি নিহিত। এই উদ্দেশ্যে ১৮৬৩ সালে নওয়াব আব্দুল লতিফ কলকাতায় মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। অপর দিকে সৈয়দ আহমদ বেরলবী ইসলামকে আবার তার সনাতনরূপে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস চালান। মূলত এই দুই আন্দোলন চলাকালেই সিপাহি বিপ্লব হয়। এই বিপ্লবে হিন্দু মুসলিম সকলেই অংশগ্রহণ করলেও পরাজয়ের সমস্ত গ্লানি মুসলিমদের ঘাড়ে এসে পড়ে। এই সময় মুসলমানদের অবস্থা এত বেশি সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে যে তারা এখানে থাকবে না কোথাও হিজরাত করবে সেই প্রশ্ন দেখা দেয়। স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলমানদের এই কঠিন সময়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে সমঝোতা করে ধর্ম পালনের অধিকার পাওয়ার চেষ্টা করেন। এই জন্য তিনি আলিগড় আন্দোলন শুরু করেন। স্যার সৈয়দ আহমদ ইংরেজদেরকে খুশি করার জন্য ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের মাঝে সাদৃশ্যসমূহ তুলে ধরেন। তিনি কুরআনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পেশ করেন। কুরআনের যেসব আয়াতের সাথে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে সংঘাত ছিল তিনি সেই ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের দর্শন গ্রহণ করেন। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন মডারেট। তিনি ইংরেজদের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য তুরস্কের সুলতানকে খলিফা বলে স্বীকার করতে সম্মত হন নাই।

তাহরিকে নাদওয়াতুল উলামা

স্যার সৈয়দ আহমদ খান একদিকে ইংরেজি শিক্ষা করা যে মুসলমানদের জন্য জরুরি এই প্রচারণা চালান অপরদিকে সেই সময় উলামায়ে কেরামের এক অংশ ইংরেজি শিক্ষা ও স্যার সৈয়দ আহমদ খানের বিরোধিতা শুরু করেন। এই উভয় গ্রুপের মাঝে দূরত্ব বৃদ্ধি হতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে উভয় গ্রুপের মাঝে দূরত্ব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে মাওলানা মুহাম্মদ আলী, মাওলানা লুতফুল্লাহ, মাওলানা আশরাফ আলী থানবী, মাওলানা ছানা উল্লাহ প্রমুখ-এর উদ্যোগে ১৮৯২ সালে নাদওয়াতুল উলামা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল: ১. ইসলামী শিক্ষার পাঠ্যসূচি নতুনভাবে করা ২. মুসলিম মিল্লাতের সকল গ্রæপের সমন্বয় সাধন করে নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও সংস্কারমূলক উন্নয়ন সাধন এবং পারস্পরিক বিরোধ দূর করে ঐক্য প্রতিষ্ঠা ৩. যুগ জিজ্ঞাসার জবাব দিতে পারেন এমন সুদক্ষ আলেম তৈরি করা ৪. ইসলামী শিক্ষার প্রসার। অল্প সময়ের ব্যবধানে এই আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৮৯৮ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে ইসলাম ও আধুনিক বিজ্ঞানের মাঝে সমন্বয় সাধন করে দেওবন্দ মাদরাসা থেকে উন্নততর শিক্ষাদানের জন্য নাদওয়াতুল উলামা গঠিত হয়। মাওলানা শিবলী নোমানীর প্রস্তাবক্রমে দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসরণে এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা’। মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবী (১৯১৪-১৯৯৯) ১৯৩৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হন এবং ১৯৮০ সালে এর প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত ‘আল বাছুল ইসলামী’ ও আর-রায়েদ নামে দুইটি আরবি পত্রিকা সারা বিশ্বে প্রেরিত হয়। আবুল হাসান আলী নদবী প্রথম পর্যায়ে মাওলানা মওদূদী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি জামায়াত ত্যাগ করেন।

দারুল মুসান্নেফিন শিবলী একাডেমি

মাওলানা শিবলী নোমানী (১৮৫৭-১৯১৪) এর নেতৃত্বে ১৯১৪ সালে দারুল মুসান্নেফিন শিবলী একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। শিবলী নোমানী আরবি, ফারসি, হিন্দি-তুর্কি ও উর্দু ভাষায় উঁচুমানের কবি ছিলেন। মক্কায় গমন করে ইসলামের বিভিন্ন শাখায় গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি মুসলিম লেখক তৈরির জন্য মূলত এই প্রতিষ্ঠান গড়েন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্য সৈয়দ সোলায়মান নদভী এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এই পর্যন্ত প্রায় তিন শতাধিক ইসলামী সাহিত্য প্রকাশিত হয়েছে।

তাবলিগ জামায়াত 

বালাকোটে ১৮৩১ সালে সাইয়েদ আহমদ বেরলবীর শাহাদাতের পর তরিকায়ে মোহাম্মদী আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন (১৮১৮) ও নিসার আলী তিতুমীরের জিহাদ আন্দোলন (১৮৩১) দুর্বল হয়ে পড়লে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব করে। ব্রিটিশদের সাথে যোগাযোগ, অফিস আদালতে কেরানিসহ আরবি-ফার্সি ভাষায় যোগাযোগের জন্য ১৭৮০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও ১৮৬৬ সালে দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইসলামের আলো কিছুটা হলেও বিচ্ছুরিত হতে থাকে। এমনি এক অবস্থায় ১৯২৭ সালে ভারতের ইলিয়াস ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন তাবলিগ জামাত। তাবলিগ জামাত অরাজনৈতিক একটি ধর্মীয় গ্লোবাল আন্দোলন বলা যায়। এই জামায়াতের ছয়টি মূলনীতি রয়েছে আর তা হচ্ছে: কালেমা, নামাজ, ইখলাস, ইকরামুল মুসলিমিন, ইলম এবং দাওয়াত ও তাবলিগ। এটা মূলত দেওবন্দ আন্দোলনেরই অনুসারী।

মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস খুব ছোটবেলায় কুরআন মজিদ হিফজ করেন। ছোটবেলা থেকে তিনি নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন। ছোটবেলায় যেসব বন্ধুরা নামাজ পড়তো না তিনি তাদেরকে নামাজ পড়তে উদ্বুদ্ধ করতেন। পরবর্তীতে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় পড়াশুনা করেন এবং তাঁর শিক্ষক মাওলানা রশীদ আহমদ গাংগুহীর কাছে বাইয়াত গ্রহণ কনে। তারপর মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর কাছে আধ্যাত্মিকতা অর্জন করেন। অতঃপর শাহরানপুরে মাজহারুল উলুম মাদরাসার শিক্ষকতা করেন। তাঁর বাবা মেওয়াত এলাকায় ক্ষেত খামারের কৃষকদেরকে নিয়ে আসতেন নামাজ পড়া ও ইসলামী জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্য। কৃষকরা সারাদিন কাজ করে যে টাকা পেতো অনুরূপ পরিমাণ টাকা তিনি ইসলামী শিক্ষা অর্জনের বিনিময়ে তাদেরকে দান করতেন। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি মেওয়াত এলাকায় যেতেন এবং তিন বছরের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬০। পরবর্তীতে তিনি দিল্লিতে এসে কিছুদিন অবস্থান করেন। এরপর আবার মেওয়াত এলাকায় গিয়ে দেখেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত ২৬০টি মাদরাসার ছাত্রদের মুখে দাড়ি নাই। পোশাকে ইসলামী ভাব নেই। এরপর তিনি হজ্জ করতে মক্কায় চলে যান। সেখানে তিনি স্বপ্ন দেখেন যে, ‘তুমি ভারতে গিয়ে ইসলামের দাওয়াতি কাজ শুরু কর।’ তারপর তিনি ভারত চলে আসেন। এক পর্যায়ে শাহরানপুরে মাজহারুল উলুম মাদরাসার শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে মুসলমানদের মাঝে ধর্মীয় সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯২৭ সালে ঈমান ও আমলের আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি ইজতিমার আয়োজন করেন এবং একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার চিন্তাধারা পেশ করেন। উক্ত সংগঠনের নাম দেন তাহরিকে ঈমান বা ঈমানের আন্দোলন। তিনি প্রস্তাব পেশ করেন যে, একটি জামায়াত এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে বা এলাকায় গিয়ে ঈমানের দাওয়াত দিবে। এইভাবে পর্যায়ক্রমে তাবলিগ জামায়াতে এর কার্যক্রম শুধু ভারত নয় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী রাহিমাহুল্লাহ ১৯৩২ সালে মাওলানা ইলিয়াস-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাবলিগ জামায়াতের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। তাবলিগের দৃষ্টিতে সমাজগঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে আত্মগঠন। তাবলিগের ¯েøাগান হচ্ছে, “হে মুসলমান আগে মুসলমান হও।” তাবলিগ জামায়াত বিভিন্ন মসজিদভিত্তিক দাওয়াতি কাজ করে। ছোট ছোট জামায়াত করে তারা দেশে-বিদেশে ছুটে বেড়ায়। দাওয়াত ও তাবলিগ প্রশংসনীয় কাজ। আল্লাহ তায়ালা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে রাসূল যা কিছু আপনার রবের পক্ষ থেকে আপনার উপর নাজিল করা হয়েছে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। যদি তা না করেন তাহলে তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের ক্ষতি থেকে বাঁচালেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা কাফিরদের সফলতার পথ দেখাবেন না।’ (সূরা মায়েদাহ : ৬৭)। ১৯৪৬ সালের পর থেকে পর্যায়ক্রমে এই সংগঠনের তাবলিগ ও দাওয়াতের কাজ সম্প্রসারিত হয়। বর্তমানে তাবলিগ জামায়াতের কার্যক্রম পৃথিবীর প্রায় ১৮০টি দেশে রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকাতেও কার্যক্রম রয়েছে। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর আমেরিকা গবেষণা করে। তার সার নির্যাস হচ্ছে তাবলিগের সাথে টেরোরিজমের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তারপরও কিছু কিছু দেশে তাবলিগের কার্যক্রমেও বিধি নিষেধ দেখা যায়।

তাবলিগ জামায়াতের ঘোষণামতে রাজনীতির সাথে এই সংগঠনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু তাবলিগের অনুসারীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনকে ভোট দেন। তারা সমাজ সংস্কারের জন্য ব্যক্তিগত আমলি জিন্দেগির সংশোধনকে প্রাধান্য দেয়। তাদের দর্শনের সমালোচনা কারো কারো পক্ষ থেকে থাকলেও তারা অনেক মানুষের ঈমান ও আমলের সংশোধনের জন্য তাদের প্রচেষ্টার প্রশংসাও অনেকেই করেছেন। যারা তাদের সমালোচনা করছেন তাদের বক্তব্য হচ্ছে সেক্যুলারিস্টদের সাথে ইসলামপন্থীদের যখন বিরোধ দেখা দেয় তাদের ভ‚মিকা কখনও কখনও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের সহযোগিতা হয়। আর কেউ কেউ মনে করেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের আমলে বিদয়াত দেখা যায়। তবে এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে তাবলিগের যারা প্রধান তাদের ব্যক্তিগত চিন্তা ও দর্শনের মাঝে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। যেমন পাকিস্তানের মাওলানা তারিক জামিল সাহেব তাবলিগের নেতা হওয়ার পরও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনেকেই পছন্দ করেন। নারীদের বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে তারা ঘরের ভিতর থেকে ইসলামী জিন্দেগি যাপন করবে। ফিকহি বিষয়ে তাদের অনুসারীরা নিজ নিজ পছন্দের ফিকহ অনুসরণ করেন।

মাওলানা ইলিয়াস ১৯৪৪ সালে ইন্তেকাল করেন। তারপর মাওলানা ইউসুফ কান্ধলবির উপর তাবলিগের দায়িত্ব অর্পিত হয়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মাওলানা ইনাম হাসান। ১৯৯২ সালে তিনি ১০ সদস্যের একটি শূরা গঠন করেন তাবলিগ পরিচালনার জন্য। তাঁরা ছিলেন: মাওলানা সাইয়েদ আহমদ খান, মুফতি জয়নুল আবদীন, মাওলানা উমর পালনপুরী, মাওলানা ইজহারুল হাসান, মাওলানা যুবায়ের আল হাসান, মিয়াজী মেহরাব, হাজী আব্দুল ওয়াহাব, হাজী ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মুকিত, হাজী আফজাল এবং মুহাম্মাদ সাদ কান্ধলবি। মুহাম্মদ সাদ কান্ধলবি বর্তমানে তাবলিগের একটি অংশের প্রধান। মূলত ২০১৫ সালের ১৬ নভেম্বর ১৩ সদস্যের নতুন শূরা কাউন্সিল নির্বাচনের পর থেকেই তাবলিগে বিরোধ দেখা দেয়। নিজামুদ্দীন মারকাজের অংশ মুহাম্মদ সাদ কান্ধলবিকে তাবলিগের প্রধান হিসাবে মানেন। কিন্তু আবার অনেকই তাঁকে তাবলিগের প্রধান হিসাবে মেনে নেন নাই। এই বিরোধের রেষ বাংলাদেশের তাবলিগ জামায়াতের উপরও পড়েছে। এমনকি তা রক্তাক্ত সংঘর্ষেও রূপ নেয়। যদিও তা মীমাংসার জন্য প্রচেষ্টা চলে। কিন্তু দৃশ্যত এখনও তা মিটেনি। যার প্রভাব বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন থেকে চলে আসা তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমার ওপরও দেখা দেয়।

খিলাফত আন্দোলন 

ইসলামী খিলাফত মুসলমানদের মৌলিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো বলে বিবেচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর খেলাফত ব্যবস্থা সংরক্ষণ ও ভারতের মুসলমানদের স্বাধীনতার জন্য এই আন্দোলন শুরু হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে হিন্দুস্তানে মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। ভারতে মুসলমানদের প্রায় সাতশত বছরের শাসনের অবসান ঘটে। ১৯১৯ সালে ভার্সিল চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কে উসমানী খেলাফত দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯১৪ সালে ব্রিটেন ও জার্মানির সাথে যুদ্ধ শুরু হলে এক পর্যায়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে ভারতীয়রা শুরুর দিকে ব্রিটেনের পক্ষে থাকলেও পরবর্তীতে ব্রিটিশদের সহযোগিতায় খুব বেশি এগিয়ে আসেনি। ১৯২০ সালে ভারতের খেলাফত নেতারা ব্রিটিশকে খেলাফত রক্ষার আবেদন জানায়। ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তুর্কি জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের দ্বারা ইসলামী খিলাফত ধ্বংস হয়ে যায়। মুস্তফা কামাল পাশা তুরস্কের উসমানী খলিফাকে উৎখাত করে সেক্যুলার তুরস্ক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩১ সালে খেলাফত কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। খেলাফত নেতা মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী মুসলিম লীগের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগদান করেন। অপর দিকে খেলাফত আন্দোলনের নেতা ড. আনসারী, হাকিম আজমল খান ও মাওলানা আযাদ কংগ্রেসে যোগদান করেন।

শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান 

শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের উপমহাদেশের একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম ও ভারত থেকে ইংরেজ খেদাও আন্দোলনের সংগ্রামী পুরুষ ছিলেন। যৌবন বয়সে মুসলমানদের কেন্দ্রীয় খেলাফত তুরস্কের সাথে পশ্চিমা শক্তির শুরু করা বলকান যুদ্ধের জন্য অর্থ ও রসদ জোগাতে ভ‚মিকা পালন করেন। আবার যখন দেওবন্দ মাদরাসার প্রধান হন সেই সময় আজাদি আন্দোলনে অগ্রসেনানীর ভ‚মিকা পালন করেন। তিনি কিছুদিন ছাত্রদের ক্লাস বন্ধ রেখেই ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেমে পড়েন।

মাওলানা মাহমুদুল হাসান ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের অনেক ঘটনাই প্রত্যক্ষ করেন। তিনি মাওলানা রশীদ আহমদের গ্রেফতারি, মাওলানা কাসেমের আত্মগোপন, হাজী ইমদাদুল্লাহর হিজরত প্রভৃতি ঘটনাসহ এ দেশের উপর ইংরেজদের লোমহর্ষক অত্যাচার অবলোকন করেছিলেন। ইংরেজরা একদিকে ভারতীয় মুসলমানদের উপর কঠোর নির্যাতন চালাচ্ছিল, অন্যদিকে তুরস্কের ইসলামী খিলাফত ধ্বংসের চক্রান্ত করছিল। এই অত্যাচার ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে মাওলানা মাহমুদুল হাসান গোপনে সাংগঠনিক তৎপরতা আরম্ভ করেন। তুরস্কের সাহার্য্যার্থে চাঁদা সংগ্রহের জন্য তিনি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। এজন্য দেওবন্দ মাদরাসা সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে তিনি ছাত্র-শিক্ষকদের চাঁদা সংগ্রহের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন। তিনি আজাদি আন্দোলনের আরেক মহাপুরুষ মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধির সাথে মিলে জমিয়াতুল আনসারের সূচনা করেন।

ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিভিন্ন গোপন কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের জোর তৎপরতা চালান। কাবুলের সমর্থন লাভের জন্য তিনি শাগরিদ উবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে তথায় প্রেরণ করেন। ইংরেজদের চক্রান্ত মুকাবিলায় দুনিয়ার অন্যান্য মুসলিম নেতাদের সাথে আলোচনার জন্য তিনি হিজায গমন করেন। হিজাযে পৌঁছে তুরস্কের গালিব পাশা ও মদিনা শরিফে আগত তুরস্কের জাতীয় নেতা আনোয়ার পাশার সাথে সাক্ষাৎ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাদের সর্বপ্রকার সমর্থনের আশ্বাস লাভ করেন। তবে মক্কার গভর্নর শরিফ হুসাইন তুর্কি খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ইংরেজদের সাথে আঁতাত করে মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীসহ কাফেলার অন্যান্যদের গ্রেফতার করে ভারতে পাঠিয়ে দেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তারা গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত-এই অজুহাতে তাদেরকে ১৯১৫ সালে মাল্টায় কারাবন্দী করা হয়। ১৯১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।

‘ইংরেজ খেদাও' আন্দোলনের অগ্রসেনানী শায়খুল হিন্দ তাঁর ব্যস্ত জীবনে কুরআন তরজমার কাজ সম্পন্ন করতে পারেননি। এই মহৎ কাজ আঞ্জাম দেওয়ার সৌভাগ্য তাঁর তখন আসে, যখন রাজনৈতিক কারণে তাঁকে মাল্টায় বন্দিজীবন-যাপন করতে হয়। বন্দিজীবনে তিনি কুরআন মাজিদের তরজমার কাজ সম্পন্ন করেন। পরে মুক্তি পেয়ে তিনি এতে জটিল শব্দের বিশ্লেষণ ও প্রয়োজনীয় স্থানে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা সংযুক্ত করার কাজে মনোনিবেশ করেন। এভাবে কুরআন মাজিদের এক মনজিল সমাপ্ত করার পর তিনি ইন্তেকাল করেন।

মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিন

১৯২৭ সালে নবাব মাহমুদ নাওয়াজ খান ভারতের হায়দরাবাদে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম জাতীয়তাবাদ, মুসলমানদের অধিকার সংরক্ষণ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল লক্ষ্য। এই আন্দোলনের আরেক নাম ছিল রাজাকার আন্দোলন। রাজাকাররা হায়দরাবাদকে ভারতের অংশ বানাতে অস্বীকার করে। তাদের দেড় লক্ষ রাজাকার কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

রেশমি রুমাল আন্দোলন

মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধিসহ অনেক আলেম শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান এর কাছে চিঠি-পত্র পাঠানোর জন্য ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে রেশমি রুমাল ব্যবহার করতেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন পরিকল্পনা রুমাল বা পাগড়ির মাধ্যমে প্রেরণ করার কারণে এই আন্দোলনের নাম হয় রেশমি রুমাল আন্দোলন। ১৯১৫ সালে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধির পক্ষ থেকে মাওলানা মাহমদুল হাসান এর কাছে লেখা এই ধরনের একটি চিঠি ব্রিটিশ গোয়েন্দারা ধরে ফেলে। এরপর ব্রিটিশ সরকার মাওলানা সিন্ধি, মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতার করে ভুমধ্যসাগরের মাল্টায় দেশান্তর ও কারারুদ্ধ করে। এরপর এই পদ্ধতিতে আর আন্দোলন না চললেও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এটা মাইলফলক হিসাবে রয়েছে।

কাদিয়ানি মতবাদ ও তাহরিকে খতমে নবুওয়াত

কাদিয়ানিবাদের উৎপত্তি হয় ব্রিটিশ ভারতে। ভারতীয় মুসলিমরা কখনোই ব্রিটিশ শাসনকে মেনে নেয়নি। ফলে নানাভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করে। মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির অংশ হিসেবেই কাদিয়ানিবাদের উদ্ভব ঘটানো হয়। তারা ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা পায়। সরকারি বড় চাকরিতে তাদেরকে নিয়োগ দেয়। তাদের সন্তানদের সরকারি বৃত্তি দিয়ে সুশিক্ষিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। কাদিয়ানি মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন মির্জা গোলাম আহমদ। মির্জা গোলাম আহমদ উত্তর ভারতের কাদিয়ান শহরের বাসিন্দা। সে নিজেকে নবী দাবি করে। শুধু তাই নয় এই ব্যক্তি নিজেকে ইমাম মাহদী এবং প্রতিশ্রুত মসিহ বলেও দাবি করে। তার অনুসারীদের কাদিয়ানি বলে অভিহিত করা হয়। মুসলিম বিশ্বের উলামারা একত্রিত হয়ে কাদিয়ানিদেরকে অমুসলিম বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

কাদিয়ানিরা মির্জা গোলাম আহমদের শিক্ষা অনুসরণ করে থাকে। মির্জা গোলাম আহমদ দাবি করে যে, তার কাছে আল্লাহ ওহি অবতীর্ণ করে থাকেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে নবুয়তের ধারাকে খতম করে দিয়েছেন এবং তার পরে আর কোনো নবী আসবেন না। মির্জা গোলাম আহমদ ১৮৩৯ সালে পাঞ্জাবের কাদিয়ান নগরীতে জন্ম নেয়। তার পরিবার স্থানীয়ভাবে ইংরেজদের দালাল ছিল। তার পিতা মুসলিমদের বিরোধিতা করে সম্মান, যশ ও অর্থ লাভ করে। মির্জা গোলাম আহমদ নিজেই তার পিতার কাজের বর্ণনা দিয়েছে, তার তোহফা কায়সারিয়াহ গ্রন্থে। তিনি বলেন, “আমার বাবা ছিলেন ইংরেজদের খুব প্রিয়ভাজন। সে সরকারি পরিষদের সদস্য ছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমন করতে সে ইংরেজ সরকারকে ৫০ জন সৈন্য, ৫০টি ঘোড়া সরবরাহ করে। যদিও তা তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত ছিল।’

কাদিয়ানিবাদ সার্বিকভাবে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। এমনকি তাদের অনেক ধর্মীয়গ্রন্থ তৈরি করে দেয় ইহুদিরা। হিন্দুরা কাদিয়ানিবাদকে স্বাগত জানায় এবং এর সমর্থনে কলম ধরে। মূলত ইসলামের বিপ্লবী ধারাকে স্তব্ধ করতেই কাদিয়ানিদের উদ্ভব ঘটানো হয় এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক। বর্তমানে কাদিয়ানিদের মূল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় লন্ডন থেকে। জাহের (১৯৮৪ : ৬) বলেন যে, ব্রিটিশরা কাদিয়ানিদেরকে বিভিন্ন উচ্চপদস্থ সরকারি পদে বসাতো। তাদেরকে এবং তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে ভালো অনুদান/বৃত্তি দেওয়া হতো। সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা তাদের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। হিন্দুরা লেখনী, কলম, প্রকাশনা এবং প্লাটফর্ম সরবরাহ করে তাদের কাজকে সহযোগিতা করেছে। ইহুদিদের কাছ থেকে তারা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পেয়েছে। তাদের বক্তব্যের পেছনে যুক্তি সরবরাহ করেছে। ইসলামের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস ও মতামতের বিপরীতে বক্তব্য দাঁড় করাতে তারা দলিল ও লেখনীও সরবরাহ করেছে। Zaher. E.E (1984) Qadiyanism. Lahore: Idara Tarjuman Al-Sunnah

সুফি চিন্তাধারার প্রভাব : ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে সুফিবাদের প্রভাব বেশি হবার কারণ একটিই আর তা হলো স্থানীয় হিন্দু ধর্মের ভাববাদের সাথে এর সম্পৃক্তি। মূলত হিন্দুদের মধ্যে ইসলামকে জনপ্রিয় করতে স্থানীয় অনেক উপকরণকে গ্রহণ করা হয়েছিল। ইসলামের সহজিয়া ভাবকেও তুলে ধরা হয়েছিল যাতে করে মানুষ ইসলামকে গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়। এর ফলে সুফিবাদ সাধকের কবর জিয়ারাতকে তার কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত করেছে। যার ফলে দেখা যায় ভারতের আজমির শরিফে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির কবরে কেবল মুসলিমরাই নয়, অমুসলিমরাও যান ব্যাপকভাবে। এমনকি অনেক রাজনৈতিক নেতা তাদের নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করেন সেখান থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশে সুফিবাদের যেমন ব্যাপকতা তেমনটি দেখা যায় না মুসলিম বিশ্বের অন্য কোথাও। মূলত এর উৎপত্তি ইরাক-ইরানে হলেও এর বিকাশ হয়েছে ভারতে। অনেক সুফি দরবেশ বিদগ্ধ আলেমও ছিলেন এখানে। তাদের অনেকে তাফসির লিখেছেন। মূলত এই উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের মুখ্য ভ‚মিকা রেখেছেন সুফি দরবেশরা। তবে ইসলামে সুফিবাদের অস্তিত্ব নিয়ে সব সময়েই বিতর্ক করা হয়েছ্।ে যদিও ইসলামের মধ্যেই এর অন্তর্নিহিত উৎস বিদ্যমান। তারপরেও সাধারণভাবে ধারণা করা হয় সুফিবাদ মূলত ইসলামে প্রবেশ করেছে একটি অচেনা আদর্শ হিসেবে এবং তা নস্টিক খ্রিষ্টবাদ ও জরথ্রুস্টবাদ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। কিন্তু সুফিবাদের প্রবক্তারা দাবি করে থাকেন যে, এটি আসলে সুফিবাদের বিরুদ্ধে একটি অপ্রচার এবং গভীর আত্মশুদ্ধির দাবি থেকেই সুফিবাদের উৎপত্তি।

সুফিবাদের মূল কথা হলো তরিকত। তবে তা শরিয়ত থেকে মোটেও আলাদা কিছু নয়। বরং শরিয়তের মহাসড়কে তরিকত হলো একটি সরু পথ। তবে শরিয়ত না থাকলে তরিকতের কোনো অস্তিত্ব হতে পারে না। আল্লাহর একত্বের প্রতি বিশ্বাস সুফিবাদের মূল কথা। তবে পরবর্তীকালে তা আরো বিস্তৃতি লাভ করে এবং জগতে আল্লাহ ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব নেই সেটি সুফিবাদের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। ফলে সব কিছুতে আল্লাহ বিরাজমান এই ধারণা সুফিবাদের মৌলিক বিশ্বাসে পরিণত হয়। যার প্রেক্ষিতে মনসুর হাল্লাজ নিজেকে একমাত্র সত্য বলে দাবি করেছিলেন। কেননা সুফিবাদের বক্তব্য হলো মানুষকে পরম স্রষ্টার সাথে একাত্ম হতে হবে। আর তার সাথে একাত্ম হবার পথ হলো স্রষ্টার সাথে নিজের অভিন্নতা দাবি করা।

আহলে কুরআন আন্দোলনের চিন্তাধারার প্রভাব : আহলে কুরআন আন্দোলন শুরু হয় বিংশ শতকের শুরুর দিকে। মৌলভী কাকরালাভী ছিলেন এই আন্দোলনের উদ্যোক্তা। মূলত ইসলামী শরিয়তের উৎস হিসেবে হাদিসকে অস্বীকার করাই ছিল এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। এ কারণে একে হাদিস অস্বীকারকারী আন্দোলনও বলা হয়। আহলে কুরআনের মূল কথা হলো ইসলামের একমাত্র আদি এবং নির্ভরযোগ্য উৎস হলো কুরআন। বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে কুরআনই যথেষ্ট এবং এজন্য হাদিসের কোনো দরকার নেই। আহলে কুরআনের অনুসারীরা বলে যে, মুহাম্মদ সা. একজন পোস্টম্যানের অধিক কিছু ছিল না এবং কুরআনের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিল তার দায়িত্ব এর অধিক কিছু না। মৌলভী আব্দুল্লাহ কাকরালাভী হাদিস এবং কুরআনের প্রাচীন তাফসীরসমূহকে প্রত্যাখ্যান করেন। কেননা এসব তাফসীর ব্যাখ্যার জন্য হাদিসের আশ্রয় নিয়েছে। কাকরালাভী এজন্য একটি নতুন তাফসীর লেখার কথা বলেন, যেখানে তার ভাষায় কথিত গালগল্প থেকে কুরআনকে মুক্ত করা যাবে।

আবদুল্লাহ কাকরালাভীর চিন্তাধারা ব্যাপকভাবে ১৯শ শতকে পাঞ্জাবে গড়ে ওঠা নানা ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বামী দয়ানন্দের (১৮২৪-১৮৮৩) আর্যসমাজ আন্দোলন। হিন্দুধর্মের সংস্কারক স্বামী দয়ানন্দ কেবলমাত্র বেদকে হিন্দু ধর্মের আদি ও অকৃত্রিম উৎস বলে প্রচার করেন। তিনি সকল ধরনের পুরাণকে অস্বীকার করেন। এ ধরনের একটি পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে কাকরালাভী একটি নতুন চিন্তাধারা তুলে ধরতে অনেকটাই উৎসাহী হয়েছেন।

কাকরালাভীর ধর্মীয় চিন্তাধারা উন্নয়ন ঘটেছে ধারাবাহিকভাবে। পাঞ্জাবের মিয়াঁওয়ালি এলাকার ছোট্ট একটি গ্রাম কাকরালাহ নামক গ্রামে তার জন্ম। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয়েছিল কাজী গোলাম নবী। তার পিতা আল্লাহ বখস তানতাভীর (১৮২৬-১৯০১) মুরিদ ছিলেন। ফলে ছেলেবেলায় কাকরালাভী বেরলভী চিন্তা ধারায় বড় হয়ে ওঠেন। পরে তিনি আহলে হাদিস আন্দোলনের সাথে যোগ দেন। নিজের বেরলভী চিন্তাধারার অনেক কিছু তিনি ইসলামের মূল বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক দেখতে পান। ফলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি আহলে হাদিস চিন্তাধারা দিয়ে এতটাই প্রভাবিত হন যে, তার আগের বিশ্বাসের সব কিছু তিনি ত্যাগ করেন। এমনকি নিজের নামও। কেননা গোলাম নবী যার অর্থ নবীর দাস এই নামকে তিনি সম্পূর্ণ ইসলামবিরোধী মনে করেন এবং সেটি বদলে তিনি নিজের নাম নেন আবদুল্লাহ। মৌলভী কাকরালাভী ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত কেবলমাত্র নির্ভরযোগ্য হাদিসের ওপরই তার সকল কর্মকাণ্ড নিবদ্ধ রাখেন। (সমাপ্ত)

লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

১. সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (১৯৭৫) ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন, পৃ৪৭-৪৮

২. তিনি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। তাঁর সান্নিধ্যে গেলে যে কেউ অনুপ্রাণিত হতো।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির