post

ভারত

মো: কামরুজ্জামান বাবলু

১৪ এপ্রিল ২০২২
মাত্র সাত দশক আগের কথা। অখণ্ড ভারতবর্ষে দোর্দণ্ড দাপটের সাথে শাসন ও শোষণ চালাচ্ছিল দখলদার ব্রিটিশ বেনিয়াচক্র। ব্যবসার ছদ্মাবরণে এই ভূখণ্ডে প্রবেশ করে শুধুমাত্র ষড়যন্ত্রের নীলনকশার জোরে ক্ষমতায় জেঁকে বসে ইংরেজ বাহিনী। অপকর্মের দোসর হিসেবে ইংরেজ বেনিয়ারা তাদের সঙ্গে পায় মীরজাফর টাইপের কিছু বিশ্বাসঘাতককে। পাশাপাশি সুযোগ হিসেবে ব্রিটিশলুটেরা লুফে নেয় এই অঞ্চলের অসচেতন জনগোষ্ঠীর উদাসীনতা ও ঘুমন্ত অবস্থাকে। এভাবেই ইংরেজ শোষণের দুইশো বছর অত্যাচার নির্যাতনে নিষ্পেষিত হন এই উপমহাদেশের বাসিন্দারা। ইংরেজরা এই অঞ্চলে ঘাঁটি স্থাপনের পূর্বে এখানে সুদীর্ঘ সাড়ে ছয়শো বছর রাজত্ব করেছেন মুসলিমরা। এতদঞ্চলে মুসলিমদের আগমনের ইতিহাসটা একেবারেই বীরত্বগাথা। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয়ী বেশে আগমন ঘটেছিল মুসলমানদের। মুসলমানরা ন্যায়বিচার ও সুশাসনের মধ্য দিয়ে জয় করেছিলেন এই ভূখণ্ডের মানুষের হৃদয়। আর তারই ফলশ্রুতিতে এখানে তারা এত দীর্ঘ সময় রাজত্ব করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজও ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুসলিম সালতানাতের অসংখ্য নজির। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ভ্রমণপিয়াসী ও ইতিহাসপ্রেমীর কাছে তাইতো আজও আগ্রার তাজমহল এক অপার বিস্ময়। ইতিহাস লেখক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল হক তাঁর “ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস” গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন : “৭১২ সালে মুসলমানগণ সিন্ধুদেশ জয় করেন এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এই দেশ তাদের শাসনে থাকে। ১০২০ সালে সুলতান মাহমুদ কর্তৃক পাঞ্জাব গজনী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইবার পর প্রয়োজনবশত সেই প্রদেশে অনেক মুসলিম বসতি গড়িয়া ওঠে। মোহাম্মদ ঘোরির সময় হইতে ধারাবাহিক মুসলিম বিজয় আরম্ভ ও পতনের মধ্যবর্তী সময়ে মুসলিম নবাগতগণ অহরহ আসিতে থাকেন। ১৫২৬ সাল হইতে মুঘল সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের বিজয়সমূহের দ্বারা এই আগমন নতুন প্রেরণা লাভ করে। নবাগত মুসলমানগণ এই দেশের সহিত মিশিয়া গেলেও নিজেদের স্বকীয়তা তাহারা বজায় রাখে। ইহাদের পূর্ববর্তী শক, হুন এবং অন্যান্যদের ন্যায় ইহারা সংখ্যালঘু হিন্দুদের মধ্যে বিলীন হইয়া যায় নাই। ইহার কারণ এই ধর্মের সুনিশ্চিত স্বভাবের মধ্যে নিহিত। একটি সুপরিচিত সময়ওয়ারি ঐশ্বরিক বাণীর ওপর ভিত্তি করিয়া এই ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। এই বাণীর উদ্দেশ্য প্রধানত দুইটি : আল্লাহর একত্মতা এবং হজরত মুহাম্মদ (সা)-এর আল্লাহ প্রদত্ত বার্তার অনুকরণ।” (সূত্র : ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস : ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল হক, সাহিত্যিকা প্রকাশনী, ৬৭ প্যারীদাস রোড, ঢাকা, মার্চ-২০০৩, পৃষ্ঠা-৭) এই ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে যা বোঝা যায় তা হলোÑ ভারতে মুসলিম শাসনের সুদীর্ঘ ইতিহাস ছিল পারস্পরিক ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে, নিজ স্বকীয়তাকে বিলীন করে নয়; বরং সবাই সবার ধর্ম ও সংস্কৃতিকে স্বাধীনভাবে লালন করেও পরস্পরের সাথে মিলেমিশে এক শান্তির পরিবেশ তৈরি করেছিলেন এই উপমহাদেশে। এখানে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মুসলিমরা। কারণ তারাই ছিলেন শাসক। শাসকদের সদিচ্ছার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। অধ্যাপক হক লিখেছেন: “মুসলমানগণ যেখানেই গিয়াছে বিজিত লোকদের প্রতি ন্যায় ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়াছে। স্থানীয় অধিবাসীগণ মুসলমানদের শাসনব্যবস্থা এবং বিজিত লোকদের প্রতি তাহাদের নীতির প্রশংসা না করিয়া পারে নাই। মুহাম্মদ বিন কাশেমের দেবল নগরে প্রবেশের পর তিনি শুধু অযথা রক্তপাতেই বাধা প্রদান করেন নাই, বরং অধিবাসীদের প্রতি তিনি সৌজন্য ও উদারতামূলক আচরণ করেন। হিন্দুগণ তাহাদের পূর্ববর্তী পদে বহাল থাকে, শুধু মোটামুটি শাসনব্যবস্থাটুকু হিন্দুদের হাত হইতে মুসলমানদের হাতে চলিয়া যায়। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের আদেশ অনুযায়ী মুহাম্মদ বিন কাশেম সব অমুসলিমদিগকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেন। ব্রাহ্মণ্যবাদ, আরোর, রাওয়ার, মুলতান এবং অন্যান্য স্থানেও এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অমুসলিমদের ওপর জিযিয়া ছাড়া অন্য কোন নতুন কর ধার্য করা হয় নাই। যাহারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাহাদিগকে ‘জিযিয়া’ কর হইতে মুক্তি দেওয়া হয়। হিন্দুদিগকে বিভিন্ন উচ্চ পদে বহাল করা হয়। তবে প্রত্যেক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার করিতে আদেশ দেওয়া হয়।” (সূত্র : ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস : ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল হক, সাহিত্যিকা প্রকাশনী, ৬৭ প্যারীদাস রোড, ঢাকা, মার্চ-২০০৩, পৃষ্ঠা-২৮) তবে, মুসলিম শাসনের সাড়ে ছয়শো বছর এবং ইংরেজ শাসনের দুইশো বছরÑ এই মোট সাড়ে আটশো বছরের শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুদের অবস্থান রীতিমতো এক বিস্ময়। তারা সবসময়ই শাসকদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অক্ষুণœœ রেখে নিজেদের এগিয়ে নিয়েছেন। মুসলমানদের শাসনামল ছিল এমনিতেই সৌহার্দ, ভালোবাসা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক অনন্য নজির। তাই সে সময় হিন্দু-মুসলিম শান্তিপূর্ণ অবস্থান ছিল খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ইংরেজ শাসনামলের দুইশো বছরে অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর ব্রিটিশ বেনিয়াদের সাথে তাল মিলিয়ে সমস্ত জমিদারি ব্যবস্থাকে নিজেদের করতলগত করাসহ যেভাবে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছিলেন হিন্দুরা তা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন কালো অক্ষরে লেখা থাকবে। সুযোগ পেলেই অতীতের ইতিহাস ভুলে নিজেদের ক্ষদ্র স্বার্থে ভারতের হিন্দুদের একটি বড় অংশই যে কতটা অমানবিক হতে পারেন ইতিহাসের পাতায় তার নজির ভূরি ভূরি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মঈন উদদীন আহমেদ খান ফরায়েজি আন্দোলন নিয়ে এক নিবন্ধে লিখেছেন : “হিন্দু জমিদার শ্রেণি ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুসলমান কৃষকদের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে এমন অনেক বেআইনি কর তাদের ওপর চাপিয়ে দেয় যা সরকার কর্তৃক স্বীকৃত ছিল না। ফরিদপুরের তৎকালীন (১৮৭২ খ্রি:) ম্যাজিস্ট্রেট যখন এ ব্যাপারে তদন্ত করেন, তখন দেখা গেল যে, এই হিন্দু জমিদাররা মুসলমান কৃষকদের কাছ থেকে তেইশ প্রকারের অবৈধ কর আদায় করছে। তন্মধ্যে কালীপূজা ও দুর্গাপূজার করও রয়েছে। হাজী শরীয়তউল্লাহ সেইসব করেরই বিরোধিতা করেন। হাজী শরীয়তউল্লাহ তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দেন, তারা যেন এই সব অবৈধ কর জমিদারদের না দেয়। এ ছাড়া হিন্দু জমিদাররা ঈদুল আজহা বা কোরবানি উপলক্ষে গরু জবাইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। বাংলাদেশে চিরদিনই গরু জবাই হতো এবং গরুর গোশত মুসলমানদের প্রিয় খাদ্য ছিল। এই গোশত অত্যন্ত সস্তায় পাওয়া যেতো। এই কারণেই হাজী শরীয়তউল্লাহ হিন্দু জমিদারদের এই অত্যাচারমূলক নিষেধাজ্ঞারও বিরোধিতা করেন। (উল্লেখ্য, এই লেখার সময়ও (২০১৬ সালের অক্টোবর) ভারতের চিত্র এতটুকু বদলায়নি। শতকরা নব্বইজন মুসলমানের এই বাংলাদেশে তারা নির্ধিদ্বায় মূর্তিপূজা করলেও আজও ভারতের মুসলমানরা গরু কোরবানি করতে পারছেন না) হিন্দু জমিদাররা হাজী শরীয়তউল্লাহর এই বিরোধিতায় অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাঁর এবং অনুসারীদের বিরুদ্ধে জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। অবশেষে তারা (হিন্দু জমিদাররা) কলকাতায় হিন্দু পরিচালিত সংবাদপত্রসমূহের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করতে শুরু করে। ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। অভিযোগে তারা ফরায়েজিদের বিদ্রোহী বলে অভিহিত করে এবং এর প্রতিরোধ কামনা করে। ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তারা হাজী শরীয়তউল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করায় যে, তিনিও তিতুমীরের ন্যায় সরকার গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তারা ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলাও দায়ের করে। এ ব্যাপারে তারা ইউরোপীয় নীলকর সাহেবদেরও সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করে। কিন্তু এইসব অভিযোগ কোর্টে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। জেমস টেলরের বর্ণনা অনুসারে ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুর জেলার দাঙ্গা-হাঙ্গামার অভিযোগে পুলিশ কয়েকবার তাঁকে (হাজী শরীয়তউল্লাহকে) গ্রেফতার করে।” (সূত্র : ফরায়েজি আন্দোলন : আত্মসত্তার রাজনীতি, সম্পাদনায়: ফাহমিদ-উর-রহমান, বাংলাদেশ সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র, বনানী, ঢাকা, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১, পৃষ্ঠা-৫০-৫১) এমতাবস্থায় প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীসহ হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃব্দের যৌথ অংশগ্রহণের কী ব্যাখ্যা হতে পারে? এখানে আসলে ব্যাখ্যাটা মুখ্য বিষয় নয়। ইতিহাস সবসময়ই সত্যের পক্ষে। যখন যেখানে যেমনভাবে যা ঘটে তা হুবহু ধারণ করাই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। তাই ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকে এসে ব্রিটিশবিরোধী অহিংস আন্দোলনে হিন্দুদের ভূমিকা অবশ্যই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। নিশ্চয়ই তার অর্থ এটা নয় যে হিন্দুদের শত শত বছরের দ্বিমুখী ও সুবিধাবাদী অবস্থান ও ইংরেজ তোষণের মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছানোর ইতিহাস বদলে যাবে। এ ছাড়া, ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দুদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো তারা যখনই সুযোগ পেয়েছেন মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করার সামান্য সুযোগও হাতছাড়া করেননি। যদিও ইসলামের সুমহান শান্তির বাণী নিয়ে এদেশে আগমনকারী মুসলমানদের সাড়ে ছয়শো বছরের শাসনামলে হিন্দুরা সামান্যতমও অত্যাচারের শিকার হননি। সুযোগ পেলেই নিজেদের আধিপত্যবাদী চরিত্র নিয়ে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার হিন্দুয়ানি চরিত্রের বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। আর ভারতীয় হিন্দুদের এই চরিত্র আজও এতটুকু বদলায়নি। ভারতীয় হিন্দুদের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে অধ্যাপক হক আরো লিখেছেন : “কাশ্মিরের পর্বতরাজি প্রায়ই ইহাকে বিদেশী আক্রমণের হাত হইতে রক্ষা করে এবং এইভাবে ইহা স্বীয় বিচ্ছিন্ন স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া আসে। এতদসত্ত্বেও মৌর্য এবং কুশান উভয় বংশই এই উপত্যকার ওপর যথার্থ অধিকার চালাইয়া যায়। রাজা হর্ষবর্দ্ধন এই দেশকে তাঁহার অন্তর্ভুক্ত করিতে চেষ্টা করেন নাই। কাশ্মিরের হিন্দু শাসকগণ প্রায়ই অত্যাচারী ছিলেন। তাহাদের নীতি ছিল কৃষকদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত শোষণ করা এবং তাহাদের হাতে মাত্র সামান্য জীবিকাটুকু রাখিয়া আসা। চতুর্দশ শতকে অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ করে।” (সূত্র : ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস : ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল হক, সাহিত্যিকা প্রকাশনী, ৬৭ প্যারীদাস রোড, ঢাকা, মার্চ-২০০৩, পৃষ্ঠা-২০) যাই হোক ১৯৪৭ এ দেশ ভাগ হলো। ভারত ও পাকিস্তান নামে হিন্দু ও মুসলিমদের আলাদা ও স্বাধীন ভূখণ্ড হলো। এর পর থেকেই পাকিস্তান-ভারত যেন চিরশত্রু দেশে পরিণত হলো। দুই দেশের মধ্যে ১৯৬৫-এর যুদ্ধসহ ছোট বড় কয়েকটি যুদ্ধও সংঘটিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সবশেষ গত জুলাই-এ (২০১৬) ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের উরি অঞ্চলে ভারতীয় সেনাক্যাম্পে এক হামলায় নিহত হয় ১৯ ভারতীয় দখলদার সেনা। এরপর থেকেই শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা। অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের খেলা তো চলছেই, পাশাপাশি দুই দেশের সীমান্তে ছোটখাটো বন্দুকযুদ্ধে এ পর্যন্ত অন্তত আরো ৮ ভারতীয় ও দুই পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হবার খবর পাওয়া যায়। এছাড়া পাকিস্তানি সেনাদের হাতে এক ভারতীয় সেনা জীবিত আটক হওয়ারও খবর মেলে গণমাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হলো- যেই ভারতের হিন্দুরা সাড়ে ছয়শো বছর মুসলমানদের শাসন মেনে এদেশে বসবাস করেছেন, দুইশো বছরের ইংরেজ শাসনে শাসকগোষ্ঠীর সাথে তাল মিলিয়ে চলেছেন, তারা পাকিস্তানের সাথে এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে কেন যাচ্ছেন? স্বাধীন কাশ্মিরকে কেন দখল করে রেখেছেন ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী? মুসলিম অধ্যুষিত ছোট্ট এই অঞ্চলটিতে কেন দশকের পর দশক ধরে লাখ লাখ সেনা মোতায়েন করে রেখেছে ভারত। ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দুদের চরিত্র বিশ্লেষণে আমার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তরে যে বিষয়টি বার বার প্রতিভাত হয় তা হলো এখানকার হিন্দুরা যখন কারো ব্যাপারে উপলব্ধি করেন যে তাদের বিরুদ্ধে কিছু করার সামর্থ্য তাদের নেই, তখন তারা হয় তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রেখে চলেন অথবা তাদেরকে চরম শত্রু মনে করে নীরবে তাদের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র করে যান দশকের পর দশক ধরে। এই ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে ভারতীয় হিন্দুদের মতো ঠান্ডা মেজাজের ও ধীরস্থির চরিত্র খুব কম জাতির মধ্যেই পাওয়া যায়। পাকিস্তানের বিষয়টি একটু অন্যরকম। কারণ ভারতীয় হিন্দুরা এখনো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তাদেরই অংশ। তাদের এককালের এই দুই অংশ নিয়ে গ্রেট ভারত বা সাবেক ভারতবর্ষ গঠনের স্বপ্ন ভারতীয় হিন্দুরা এখনো তীব্রভাবে লালন করছেন। আর সে কারণেই তাদের দুই পাশে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামক দুই মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব তারা কখনই মেনে নেবেন না। তাই এই দুই দেশের সাথে ভারতের শত্রুতা বিশেষ করে যতদিন হিন্দুরা ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন থাকবেই। ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামরিক সক্ষমতাও পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তাই বাধ্য হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান মেনে নেয়াও ভারতীয় হিন্দুদের পক্ষে কখনই সম্ভব না। তারা বিগত সাড়ে ছয়শো বছর এই উপমহাদেশে মুসলিমদের শাসন কিংবা দুইশো বছর ইংরেজদের শাসন মেনে নিতে যেমন বাধ্য হয়েছিলেন সেই অবস্থান থেকে তারা এখন নিজেদের অনেক বেশি শক্তিশালী মনে করেন। পাশাপাশি পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশকে তারা ভারত শাসনকারী মুসলিম ও ব্রিটিশ বেনিয়াদের চেয়ে দুর্বল ভাবেন। এমনই বাস্তবতায় পাকিস্তান এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের শত্রুতা কোনদিনই থামবার নয়। এ ছাড়া, ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির একটি অঘোষিত নীতিমালা হলো তাদের পাশে তাদের কোনো বন্ধু নেই সবাই শত্রু, সবার সাথে শত্রুতা করে নিজেদের টিকে থাকতে হবে। এর বাস্তব উদাহরণ হলো নেপালের মতো হিন্দু অধ্যুষিত প্রতিবেশী দেশের সাথেও ভারতের চরম শত্রু ভাবাপন্ন আচরণ। এমনকি ভারতের আধিপত্যবাদী চরিত্র বুঝতে পেরে নেপাল ভারতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভারত রীতিমতো নানাভাবে নেপালে অবরোধ সৃষ্টি করে রাখলেও নেপাল এতটুকু হার মানেনি; হার মানেনি নেপালের শাসকগোষ্ঠী। তারা তাদের ভারতবিরোধী অবস্থান এখনো ধরে রেখেছেন। নেপালকে খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধসহ নানা পণ্যের জন্য ভারতের ওপর চরম নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও দেশটি ভারতের কাছে এতটুকু মাথা নত করেনি। বরং বর্তমানে ভারতের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এবার ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের দিকে আরেকবার দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ দখলদারদের কাছ থেকে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন হবার পর থেকেই ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে আসছে ভারতীয় দখলদার বাহিনী। ২০১৫ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘দি গার্ডিয়ান’ ‘ÔIndian forces in Kashmir accused of human rights abuses cover-up অর্থাৎ ‘কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সত্যতা মিলছে’-এই শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয় : ‘A report by the International Peoples’ Tribunal on Human Rights and Justice in Kashmir and the Association of Parents of Disappeared Persons (APDP) has identified more than 900 individuals whom it blames for a range of human rights abuses carried out by Indian security forces between 1990 and 2014. They include 150 officers of the rank of major or above.’ অর্থাৎ ‘কাশ্মিরে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার বিষয়ক আন্তর্জাতিক গণআদালত এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের পিতা-মাতাদের সংগঠন (এপিডিপি) এর এক প্রতিবেদনে নয় শতাধিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাদেরকে ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষীরা ধরে নিয়ে যায় এবং তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। এদের মধ্যে দেড়শো অফিসার রয়েছেন যাদের অধিকাংশ মেজর বা তারও উপরের স্তরের।’ ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে সাধারণ মানুষের ওপর দশকের পর দশক ধরে চালানো ভারতীয় বাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের তথ্য-উপাত্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে হস্তান্তর করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। গত ২১শে সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের কাছে এই দলিল হস্তান্তর করেন নওয়াজ শরীফ। বিবিসি, আলজাজিরাসহ বিশ্বের প্রায় শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়। নওয়াজ শরীফ ভারতীয় নির্মমতার যাঁতাকলে কিভাবে কাশ্মিরের মানুষ প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হচ্ছেন তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। বিশেষ করে গত ৮ই জুলাই (২০১৬) কাশ্মিরের হিজবুল মুজাহিদীন কমান্ডার ও কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের তরুণ স্বপ্নদ্রষ্টা বুরহান ওয়ানিকে হত্যার পর সৃষ্ট গণআন্দোলন ঠেকাতে ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীরা কাশ্মিরে কার্ফু জারি ও হত্যাযজ্ঞসহ যে বর্বরতা চালায় তা তুলে ধরেন নওয়াজ শরীফ। জাতিসংঘ মহাসচিবকে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৭৪ দিনে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে একশোরও বেশি মানুষ নিহত হন এবং আহত হন আরো কয়েক হাজার। নওয়াজ অভিযোগ করেন, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর মানসিকতা যে কতটা বর্বর তা বুঝা যায় তাদের পেলেট বন্দুক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যার ফলে নারী ও শিশুসহ কাশ্মিরের শত শত মানুষ অন্ধ হয়ে যান। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে গত ১৪ই জুলাই (২০১৬) দৈনিক ইনকিলাবে ‘পেলেট বন্দুকের দাপটে দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে কাশ্মিরি তরুণরাÑএই শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘গত বছরের (২০১৫) হিসাব অনুযায়ী অন্তত ৭০০ মানুষের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে এই পেলেট বন্দুকের জেরে। কারো কারো ক্ষেত্রে দু’টি চোখই। এবারেও বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার সময়ে নিরাপত্তা বাহিনী যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে পেলেট বন্দুক যার জেরে চোখে গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বহু মানুষ। শুধুমাত্র মহারাজা হরি সিং হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন শতাধিক মানুষ, যাঁদের চোখে পেলেট বন্দুকের জেরে আঘাত লেগেছে।’ গত ১৭ই আগস্ট (২০১৬) বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-শাসিত কাশ্মিরে গত প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে চলা সহিংসতার পটভূমিতে ভারতকে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে আলোচনার যে প্রস্তাব দিয়েছিলো পাকিস্তান, দিল্লি তা কার্যত নাকচ করে দিয়েছে। দিল্লিতে সরকারি সূত্রগুলো বিবিসিকে জানিয়েছে, পাকিস্তানের প্রস্তাব ছিল ‘আলোচনা হোক শুধু কাশ্মির নিয়ে। কিন্তু পাল্টা জবাবে ভারত বলেছে এই মুহূর্তে মূল আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত শুধুই ‘সন্ত্রাসবাদ’। এভাবেই দিনের পর দিন ভারতের একতরফা চলো নীতির ফলে কাশ্মিরের রক্তাক্ত ইতিহাস ক্রমেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী শুধুমাত্র ১৯৯৯ সাল থেকেই এই উপত্যকায় ৪০ হাজার প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে যাদের বেশির ভাগই সাধারণ জনগণ। বর্তমানে এই ছোট্ট অঞ্চলটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে অন্তত চার লাখ ভারতীয় সেনা সদস্য। কাশ্মির ইস্যুকে মানবিকভাবে গ্রহণ করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেই হয়তোবা সেখানে চলমান কয়েক দশকের রক্তাক্ত ইতিহাসের যবনিকাপাত সম্ভব। ভারতীয় বাহিনী সেখানে মুসলমানদের হত্যা করছে বিষয়টি এভাবে বিবেচনা না করে কাশ্মিরের মুসলমানরাও যে মানুষ, তাদেরও যে ন্যূনতম মানবিক অধিকার আছে জাতিসংঘসহ বিশ্ব মোড়লদের সংগঠনগুলোর মধ্যে সেই উপলব্ধি এলেই হয়তোবা শান্তির সুবাতাস বইবে। তবে, নিরেট বাস্তবতা হলো-এককালের ভারতবর্ষ থেকে বেরিয়ে এখন পৃথিবীর একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে কোনদিনই ভারত মেনে নেবে না। ইতিহাসসচেতন যে কেউ এটা একবাক্যে স্বীকার করে নেবেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যেখানে কাশ্মিরের মতো একটু ছোট্ট ভূখণ্ডের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারছে না ভারত, সেখানে পাকিস্তানকে মেনে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বহির্বিশ্ব থেকে যতই চেষ্টা চালানো হোক না কেন পাকিস্তান-ভারতের বিরোধ থাকবেই। তাই বিরোধ মেটানোর চেষ্টায় অযথা সময় নষ্ট না করে দুই দেশের কেউ যেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা না ঘটায় সেটাই নিশ্চিত করা দরকার সবার আগে। দুই দেশের দখলে থাকা কাশ্মিরকে ছাড়িয়ে এনে সেখানকার মানুষের ইচ্ছার আলোকে তাদেরকে স্বাধীন করে দেয়ার জন্য জাতিসংঘসহ মোড়লের ভূমিকায় আসীন সংগঠনগুলো শক্ত ভূমিকা রাখবে সেটাই সবার কামনা। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির