post

ভাষার একুশে আশার একুশে

২৭ জানুয়ারি ২০১৪

ড. মাহফুজ পারভেজ

Vashar-jonnoঅমর একুশে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার পথ ধরে স্বাধীনতার চেতনায় পৌঁছার শিক্ষায় যে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল, সেই দীক্ষায় আজো আমরা পথ চলছি। আমরা পথ চলছি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, শান্তি ও সুশাসনপূর্ণ যুক্তিবাদী অগ্রসর-সম্মানজনক জীবনের সন্ধানে। ১৯৫২ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত অতিক্রান্ত ৬০ বছর সময়কালে জাতির সংগ্রামদীপ্ত পথচলার ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে গৌরবময় অর্জন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর গণতন্ত্রের নবযাত্রা এবং এ বসন্তে চলমান দ্রোহী আন্দোলন-সংগ্রাম-অর্জনের পটভূমিকায় আশার আলোকস্তম্ভের মতো একুশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সাহসিক প্রত্যয়ে। মায়ের ভাষার রক্তাক্ত আখরে আশার বাতিঘর অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি-ভবিষ্যৎ কি, এমন প্রশ্ন প্রায়ই উচ্চারিত হয়; মূল্যায়ন হয় ভাষার ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই। বিশ্বায়নের তোড়ে ইংরেজির বিকাশের ভয়ও দেখান কেউ কেউ। ইংরেজিকে জয় করে সে ভয় আমরা পরাজিত করতে পারছি না এখনো। আমাদের ইংরেজির মান উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে বিশেষ অগ্রসর নয়। বাংলায়ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না দেশের বৃহত্তর মানুষ। তাদের কাছে শিক্ষার আলোই এখনো পৌঁছায়নি। কথ্য ও লিখিত আকারে অফিস-আদালত থেকে গ্রাম-বাংলার শেকড় পর্যন্ত ভাষা সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়নি এখনো। কিছু শব্দের আবর্তে আক্রান্ত মানুষের চিন্তা। ভাষার দ্বারা মৌলিক ও নিজস্ব ভাব প্রকাশের পথেও রয়েছে নানা অন্তরায়। ভাষার সমান্তরালে চিন্তার মুক্তির জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে প্রায়ই উপেক্ষা করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক, বিদ্যাক্ষেত্র, সমাজ জীবন ও রাজনৈতিক অঙ্গন মনে হচ্ছে এক বা দুটি চিন্তাবৃত্ত ও ভাষা প্যাটার্নের দাসত্বের মধ্যে বন্দি। আসলে মানুষের চিন্তাপদ্ধতি যত অস্বচ্ছ হয়ে পড়ে, ঠিক ততটাই খঞ্জত্বপ্রাপ্ত হয় ভাষা। ঔপন্যাসিক ও চিন্তাবিদ জর্জ অরওয়েল তার বহুপঠিত প্রবন্ধ ‘পলিটিক্স অ্যান্ড দ্য ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ’-এ লিখেছেন : “English language becomes ugly and inaccurate because our thoughts are foolish, but the slovenliness of our language makes it easier for us to have foolish thoughts”। এমনই চিন্তার বৈকল্য দেখা দিয়েছে আমাদের মধ্যে, যা গ্রাস করেছে ভাষাকেও। একদিকে কুয়াশার বিভ্রান্তিতে ঢেকে যাচ্ছে চিন্তাশক্তি আর অন্যদিকে মিইয়ে যাচ্ছে ভাষা। শব্দ ও ভাষার অপব্যবহার চিন্তার দৈন্যের সূচক। চিন্তা যত অসংলগ্ন, উত্তেজিত, দিকভ্রান্ত হয়, ততই এলোমেলো হয় ভাষা। সৃজনশীল বা মননশীল চিন্তাচিহ্নযুক্ত কথ্য বা লিখিত উদাহরণ তখন ভাষা-ভাণ্ডার থেকে হ্রাস পেতে থাকে। বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজ, রাজনীতি, আইন, নৃতত্ত্ব, সাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে আধুনিক চিন্তা, গভীরতর বিশ্লেষণ, স্বাদু ভাষাশৈলী সম্পন্ন রচনার অভাব এ কারণেই বর্তমানে প্রাসঙ্গিক। চিন্তার দৈন্যের ছাপ নিয়ে ভাষা আশার ছাপ রাখতে পারছে না। সঙ্কটে ও সমস্যায় আশাবাদের স্বপ্ন আঁকতে পারছে না। আবেগ, আক্রমণ, তীব্র বিরোধ, উতপ্ত মগজ ও পেশি, সংঘাত ও নৃশংসতার দাবানল, পারস্পরিক অশ্রদ্ধা-কূটাভাস-মিথ্যাচার-অশ্লীলতা চিন্তারাজ্য ও সমাজ-জীবনকে দখল করলে ভাষাও সেই অপধারায় অশুচি হয়ে যায়। সেটাই আবার প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। এমন পরিস্থিতি প্রতিনিয়তই আমাদের সবেগে নাড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা একটি ইতিবাচক পথের সন্ধানে ব্যর্থ হয়ে ফিরে ফিরে আসি অনিঃশেষ দ্বৈরথের ঘোরতর কৃষ্ণ প্রহরের সংঘাতময় রক্তাপ্লুত প্রান্তরে। ভাষা ও আশার একুশে যুক্তি, তথ্য, প্রজ্ঞার আলোয় চিন্তার জগতকে যত বেশি আলোকিত করতে পারবে, তত বেশি আমরা চিন্তার স্বাধীনতা ও বুদ্ধির মুক্তির পথে এগিয়ে ভাষার জগতকে উজ্জ্বল করতে পারব; আলোকিত করতে পারব আমাদের ক্ষত-বিক্ষত চারপাশকেও। ফ্রেডারিক বডমার তার জগতবিখ্যাত ‘দ্য লুম অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে মনে করিয়ে দিয়েছেন, মানুষের চিন্তাকে, কল্পনাকে এবং নানা দিকে তার প্রচেষ্টাকে ধরে রাখে বা প্রকাশ করে, এমন মাধ্যম ভাষা ছাড়া আর কিছুই নেই। আর ভাষার চমৎকারিতা সেখানেই। বাংলা ভাষাকে আশ্রয় করে আমাদের ভাবনাচিন্তা, স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা আর চাওয়া-পাওয়ার জগতকে উন্মোচিত করার প্রেরণাও নিহিত রয়েছে একুশের অন্তহীন মহান চেতনায়।

দুই. ভাষা, আশা ও চিন্তার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদেরও ভাবনার অন্ত নেই। তেমনই একজন বডমার। ফ্রেডরিক বডমারের জন্ম সুইজারল্যান্ডে ১৮৯৪ সালে। ভাষার প্রতি তার অপার কৌতূহল অল্প বয়স থেকেই। যৌবনেই তিনি অনেক ভাষা শিখে পলিগ্লট হয়ে ওঠেন। ভাষাতত্ত্বে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৪ সালে অর্জন করেন পিএইচডি উপাধি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে যান। সেখানেই পরিচয় হয় পরবর্তী কালের বন্ধু ও সহযোগী ল্যান্সলট হুগবেনের সঙ্গে। হুগবেন প্রাণিবিজ্ঞানী ও পরিসংখ্যানবিদথ পাশাপাশি চর্চা করছেন ভাষা নিয়েও। এ সময়েই বডমার লেখেন তার বিখ্যাত ‘দ্য লুম অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থটি। লেখার আগে বইয়ের খসড়া দেখালেন বন্ধু হুগবেনকে। হুগবেন ততদিনে রীতিমতো বিখ্যাত তার দুটি বইয়ের জন্য। বস্তুতপক্ষে, একটা সময়ে বডমার বলেছিলেন, ‘দ্য লুম অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ তার একার লেখা নয়। ওতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে হুগবেনেরও। আসলে প্রকাশের আগে বডমারের অনুরোধে হুগবেন ‘দ্য লুম অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ বইটির খসড়া দেখে কিছু পরিমার্জনা করেছিলেন। বডমার আরো চেয়েছিলেন, বইটি প্রকাশিত হোক তাদের দুজনেরই নামে। হুগবেন যুগ্ম রচয়িতার কৃতিত্ব নিয়ে ভাগ বসাতে রাজি হননি। ভূমিকায় হুগবেন লিখেছেন, তিনি অতি কষ্টে বডমারকে নিরস্ত করেছেন যুগ্ম লেখকের প্রসঙ্গে। এবং এক প্রকারে বাধ্যই করেছেন বডমারের একক নামে বইটি প্রকাশে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, হুগবেন তো মূলত প্রাণিবিজ্ঞানী। তাহলে বডমারের বইটিতে তার আগ্রহ বা দায় কীসের? উত্তর মিলবে হুগবেনের জীবন ও কর্মে। এ কথা ঠিক যে হুগবেন পেশায় মূলত প্রাণিবিজ্ঞানী। পরে তিনি হয়েছিলেন প্রশাসকÑ ১৯৬৩ সালে গাইয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। তার পেশাজীবনজুড়েই তীব্র ছিল একটি বিশেষ উদ্যোগথবিজ্ঞান ও ভাষাবিষয়ক গ্রন্থাদিও প্রচার এবং পৃষ্ঠপোষকতা। তদুপরি ১৯৪৩ সালে হুগবেন ইন্টারগ্লোসা নামে একটি কৃত্রিম ভাষা উদ্ভাবন করেছিলেন। কৃত্রিম ভাষা হলো সহযোগী বা অক্সিলারি ল্যাঙ্গুয়েজ। কাজেই বডমারের বইয়ে তার ভূমিকা ও মতামত থাকা স্বাভাবিক। বডমারের মৃত্যুর (১৯৫৫) পর যেহেতু তিনি বেঁচেছিলেন আরো কুড়ি বছর (১৯৭৫), তাই পরে একাধিকবার বইটির পরিমার্জনা, পুনর্মুদ্রণ ইত্যাদি করতে পেরেছিলেন বিষয়গত যোগ্যতা ও অধিকারের কারণেই। এরই মাঝে বডমার কেপটাউনের চাকরি ছেড়ে যোগদান করেছিলেন বিশ্বখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটির ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে। আমৃত্যু তিনি সেখানেই অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৫ সালে তার মৃত্যু হলে সেই বিভাগের সেই পদেই যোগ দেন নোয়াম চমস্কি, যিনি তার সমকালের একজন শ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী। উল্লেখ্য, বডমারের বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় বিখ্যাত সংস্থা জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন থেকে। তখন একে বলা হয়েছিল বিদেশি ভাষা শিক্ষার গাইড। ১৯৮০ দশক পর্যন্ত ১২-১৩ বার সংস্করণ ও পুনর্মুদ্রিত হওয়ার পর ১৯৮৫ সালে এ বই চলে যায় একটি মার্কিন কোম্পানির হাতে, যার নাম ডবস্নু ডবস্নু নর্টন অ্যান্ড কোম্পানি। তিন. বডমারের বইটিতে আছে চারটি পর্ব। প্রথম পর্বে বর্ণমালা ও লিপির ইতিহাস, অন্বয়, ভাষার শ্রেণী বিভাজন ইত্যাদি। দ্বিতীয় পর্বের বিষয় লাতিন ও টিউটোনিক ভাষাগোষ্ঠীর যৌথ উত্তরাধিকার নিয়ে ইংরেজি ভাষার গড়ে ওঠার আখ্যান, লাতিনের উত্তরাধিকার এবং লাতিন থেকে উদ্ভূত ভাষাগুলোর কথা। তৃতীয় পর্বের বিষয় ভাষা পরিকল্পনা এবং চতুর্থ পর্বের বিষয় লাতিন, টিউটোনিক, ইন্ডিক প্রভৃতি ভাষাগোষ্ঠীর ভাষাগুলোর মধ্যে যোগসূত্র, শব্দসাদৃশ্য ইত্যাদিও আলোচনা এবং সেই সঙ্গে ল্যাঙ্গুয়েজ মিউজিয়াম নামে একটি পরিশিষ্টে ছয়-সাতটি ভাষার নির্বাচিত শব্দপঞ্জি ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। বডমার সিনট্যাক্সকে বলেছেন, ট্র্যাফিক রুল অব ল্যাঙ্গুয়েজ। বহুকাল পর্যন্ত সিনট্যাক্স বা অন্বয় বলতে বাক্যের পদক্রমকেই বোঝানো হতো। এখনকার ভাষাবিজ্ঞান সে ধারণা বদলে দিয়েছে। সিনট্যাক্স নিছক পদক্রম নয়, সিনট্যাক্স হলো বাক্যে ব্যবহৃত পদগুলোর সংস্থান ও পারস্পরিক সম্পর্ক। ভাষায় ভাষায় পদক্রমের নিয়মের পার্থক্য ঘটে যায়। বডমার পাশাপাশি শব্দ সাজিয়ে দেখিয়েছেন, ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, লাতিন প্রভৃতি ভাষার পদক্রমের নিয়ম কেমন। তিনি দেখিয়েছেন, সব ক'টি রোমান্স ভাষায় আর জার্মানিকগোষ্ঠীর ভাষায় কেবল কর্তা বা সাবজেক্ট আর ক্রিয়ার অবস্থান বদলে দিলেই নির্দেশক সদর্থক বাক্য প্রশ্নবাচক বাক্যে পরিণত হয়ে যায়। এভাবেই বডমার ভাষা পরিকল্পনা করার কথা বলেছেন। ভাষা ও চিন্তার সেতুবন্ধন রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি ভাষাবিজ্ঞানের মূল সূত্র ধরে একাদিক্রমে নানা ভাষায় পারদর্শি হওয়ার কথাও বলেছেন। বাংলাকে কেন্দ্রে রেখে আমরা উপমহাদেশের অন্য ভাষাগুলোকে আয়ত্ত করতে পারিনি। ইউরোপে একজন ফরাসি বা ডাচ বা ইংরেজ অবশ্যই সেকেন্ড বা থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে দুই-তিনটি ভাষা শিখবেই। আমরা কি হিন্দ বা উর্দু নিয়ে এমন গর্ব করতে পারি? ক'জন আছেন আমাদের মধ্যে, যারা নেপালি বা ভুটানি কিংবা উড়িয়া বা অহমিয়া জানেন? ইংরেজি প্রতিক্ষণ কানের কাছে বাজছে বটে। কিন্তু এতে আমাদের পারঙ্গমতা কতটুকু? উরাসি ভাষার মায়াময় জগতে পৌঁছা এখন এখানে দূরস্থ। ভাষার জগতে না পৌঁছে ভাববিনিময়, চিন্তার মেলবন্ধন কীভাবে সম্ভব? বিশ্বায়ন বা ডিজিটাল মহাসড়কে আমরা আর কতদিন অন্তজ্য হয়ে থাকব?

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির