post

ভূমিকম্প, বাংলাদেশ ও আমাদের করণীয় কাজী মো: বরকত আলী

ভূ-পৃষ্ঠে সংঘটিত আকস্মিক ও অস্থায়ী কম্পনের নাম ভূমিকম্প “An earthquake is a shaking of the earth crust of the earth.” ভূ-অভ্যন্তরস্থ শিলারাশিতে সঞ্চিত শক্তির আকস্মিক অবমুক্তির কারণে সৃষ্ট এই স্পন্দনের মাত্রা মৃদু কম্পন থেকে প্রচণ্ড ঘূর্ণনের মধ্যে হতে পারে। ভূমিকম্প হচ্ছে তরঙ্গ গতির এক ধরনের শক্তি, যা সীমিত পরিসরে উদ্ভূত হয়ে ঘটনার উৎস থেকে সকল দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট পর্যন্ত ভূমিকম্প স্থায়ী হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে ভূমিকম্প নতুন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। স্মরণাতীত কাল থেকেই ভূমিকম্প হচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ কালেও হবে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে মানুষ সম্পূর্ণরূপে অসহায়। এ কারণেই আজ বিশ্বব্যাপী চলছে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার চিন্তাভাবনা। বাড়ানো হচ্ছে ভূমিকম্প সম্পর্কে জনসচেতনতা। নগর সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছে ভূমিকম্পরোধী বিল্ডিং কোড বা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, অব্যাহত রাখা হয়েছে ভূমিকম্প সংগঠনের আগামবার্তা পাওয়ার প্রচেষ্টা। ভূমিকম্প ও বাংলাদেশ বাংলাদেশ ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল হলেও এই কম্পনের গতি, প্রকৃতি ও মাত্রা সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা খুবই অপ্রতুল। পৃথিবী কতগুলো প্লেট বা পাত দ্বারা সংঘটিত ইন্ডিয়ান প্লেট তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ ইন্ডিয়ান প্লেটের একটি অংশ। ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এর আগে বার্মিজ প্লেট এবং উত্তরে তিব্বতিয়ান প্লেট; যা ইউরেশিয়ান প্লেটের অংশ। ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ায় কৌণিকভাবে বার্মিজ এবং তিব্বতিয়ান প্লেটকে ধাক্কা দিচ্ছে। ফলে পূর্ব দিকে ইন্ডিয়ান প্লেট দেবে যাচ্ছে বার্মিজ প্লেটের নিচে এবং বার্মিজ প্লেট ওপরে ওঠায় আরাকান ইয়োমা পর্বতশ্রেণীর সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-সিলেট পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকা আরাকান-ইয়োমা পর্বতশ্রেণীরই অংশ। আবার উত্তর দিকে ইন্ডিয়ান প্লেটকে ধাক্কা দেয়ায় হিমালয় পর্বতশ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ ভূমিকম্পের উৎপত্তি দু’টি প্লেটের সংযোগস্থলে। বাংলাদেশের পূর্বে ইন্ডিয়ান ও বার্মিজ প্লেটের সীমানা বরাবর এবং উত্তরে ইন্ডিয়ান ও তিব্বতিয়ান প্লেটের সীমানা বরাবর ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলগুলোর (এপি সেন্টার) অবস্থান। ইন্ডিয়ান প্লেট অন্য দু’টি প্লেটকে ধাক্কা দেয়ায় প্লেটগুলোর সীমানা বরাবর শক্তি সঞ্চয় হতে থাকে। এই জমাকৃত শক্তির যখন ভারসাম্য নষ্ট হয় তখন ধাক্কা-ধাক্কির ফলে ইন্ডিয়ান প্লেট বার্মিজ বা তিব্বতিয়ান প্লেটের নিচে দেবে যায় এবং অবমুক্ত শক্তির দ্বারা ভূ-কম্পন শুরু হয়। (মানচিত্র- ৩) এই কম্পন তরঙ্গ মাটির ভেতর দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়। মাটি শক্ত হলে ভূমিকম্পের তরঙ্গ অতিদ্রুত সঞ্চালিত হয় এবং ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। অন্য দিকে মাটি নরম হলে ভূ-কম্পনের তরঙ্গেও গতিমন্থর হয়, কম্পন দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়। সুতরাং বাংলাদেশ উচ্চ ভূ-কম্পনশীল অঞ্চলসমূহ দ্বারা পরিবেষ্টিত, যার মধ্যে রয়েছে উত্তরের হিমালয়ান আর্ক ও শিলং মালভূমি, পূর্বে জটিল নাগা সিডাং হাফলং ঘাত অঞ্চল। এটি অসংখ্য অন্তর্ভূ-পৃষ্ঠ সক্রিয় চ্যুতি ও হিনজ জোন নামে পরিচিত একটি ভগ্ন অঞ্চলসহ বৃহৎ ডাউকি চ্যুতি ব্যবস্থার-স্থল। ভূ-গাঠনিক দিক থেকে দুর্বল এসব অঞ্চল অববাহিকার এলাকার মধ্যে শিলা চলাচলের প্রয়োজনীয় স্থান সঙ্কুলান করে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশের সাধারণীকৃত ভূ-গাঠনিক মানচিত্রে মূল কেন্দ্রসমূহের বণ্টন ডাউকি চ্যুতি ব্যবস্থা বরাবর এক রেখায় এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে দেখতে পাওয়া যায়। (মানচিত্র -১) মানচিত্রের (মানচিত্র-১) অনুসন্ধানে দেখা যায়, মূল কেন্দ্রগুলো পৃষ্ঠা অন্তর্ভূ-পৃষ্ঠ চ্যুতিতে গঠিত দুর্বল অঞ্চলে অবস্থিত। কম্পনগুলোর মাঝারি মানের (m=4-6) এবং কম গভীরতায় অবস্থিত যা ভিত্তি শিলায় অধিশায়িত অবক্ষেপে সাম্প্রতিক বিচলনের ইঙ্গিতবাহী। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অংশে (সুরমা বেসিন) গুরুত্বপূর্ণ কম্পনগুলো ডাউকি চ্যুতিব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মধুপুর সোপানস্তূপের ভেতরে ও আশপাশে সংঘটিত কম্পনসমূহ পলল থেকে স্তূপকে পৃথককারী চ্যুতির অগভীর স্থানান্তরের ইঙ্গিতবাহী। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব এবং উত্তরের এলাকাগুলো ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের নিকটবর্তী হওয়ায় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের ভূমিকম্প অঞ্চল বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূ-কম্পন বলয়ে অবস্থিত। ফলশ্র“তিতে বাংলাদেশে প্রায়শ ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। তবে এই কম্পনের মাত্রা দেশের সর্বত্র সমভাবে অনুভূত হয় না। এই প্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালে বিশেষজ্ঞরা সংশোধিত ভূ-কম্পন মানচিত্রে বাংলাদেশকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেছেন। (মানচিত্র-২) যথাÑ অঞ্চল-১: এটি দেশের ভূমিকম্পের দিক থেকে কম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। এ অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে- দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো। অঞ্চল-২: এটি ভূমিকম্পের দিক থেকে মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ। এই অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে- চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা, টাঙ্গাইল ও দিনাজপুর অঞ্চল। অঞ্চল-৩: এটি দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্পনপ্রবণ এলাকা বলে বিবেচিত। এই এলাকার মধ্যে রয়েছে- রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশ। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ২০০৯ সালের ২১ ও ২৩ সেপ্টেম্বর রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানী ঢাকা শহর এটির উৎপত্তি ছিল মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায়, যা ঢাকা শহর থেকে ৫৫২ কিলোমিটার দূরে ছিল। ১০ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে পরপর (রাত ১০টা ৪০ মিনিট ও রাত ১১টা ৪৪ মিনিট) দুইবার ৪.৬-৪.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা শহর কেঁপে ওঠে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ঢাকা শহরের মানুষ। যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা শহরের খুবই কাছে। প্রথমটি চাঁদপুর এবং দ্বিতীয়টি ছিল গোপালগঞ্জে। সম্প্রতি ভূমিকম্পে শুধু ঢাকা শহর নয়, যা দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় কম্পনে সৃষ্টি করে নারায়ণগঞ্জের দু’টি বহুতলবিশিষ্ট ভবনে ফাটল সৃষ্টি করে। শঙ্কার বিষয় হলো অতীতের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। কেউ কেউ বলছেন ঢাকার নিকটবর্তী মধুপুরে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল (এপি সেন্টার) আছে। অন্য দিকে এপি সেন্টারের কাছাকাছি হওয়ায় সিলেট ও চট্টগ্রাম আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ। ১০ সেপ্টেম্বর ও ১২ সেপ্টেম্বর ২০১০-এ সারা দেশব্যাপী যে ভূমিকম্প হয় তার উৎপত্তি ছিল কিন্তু ডাউকি চ্যুতি বা মধুপুরে ছিল না, সম্পূর্ণ আলাদা জোনে এর উৎপত্তিস্থল ছিল। এর থেকে এটাই উপলব্ধি করা যায় যে, পুরো বাংলাদেশটায় কমবেশি ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে অবস্থিত। তবে এ ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের তীব্রতা ভিন্ন হতে পারে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তরের এলাকাগুলো ভূমিকম্পের কেন্দ্রের কাছাকাছি হওয়ায় এই এলাকা সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চল অপেক্ষাকৃত দূরে থাকায় অন্য দু’টি এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ। রাজধানী ঢাকার কাছাকাছি কোন এপিসেন্টার না থাকায় (মধুপুর এপিসেন্টারের কথা বলা হলেও সেটা নিয়ে মতভেদ আছে) স্বল্পমাত্রার ভূ-কম্পনে ঢাকার তেমন কোন ঝুঁকি নেই। এদিক থেকে সিলেট ও চট্টগ্রাম শহর এপি সেন্টারের সন্নিকটে হওয়ায় ঝুঁকির মাত্রা বেশি। অনেকের অভিমত রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার অধিক ভূমিক¤প ৩০ সেকেন্ডের অধিক স্থায়ী হলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। প্রত্যেকটি শহরই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। তবে এ কথা অবলীলায় বলা যায়, যদি বাংলাদেশের কোথাও ৬ মাত্রায় অধিক ভূমিকম্প হয় তবে ক্ষয়ক্ষতি হবে ব্যাপক। ভূমিকম্প যেহেতু সম্পূর্ণ অনিশ্চিত একটি বিষয় সেহেতু সুনির্দিষ্টভাবে বলার কোন উপায় নেই যে কোন এলাকা বেশি ঝুঁকিতে আছে এবং কোন এলাকা কম ঝুঁকিতে আছে। যেমন বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল ঝুঁকিমুক্ত এলাকা বলা হলেও সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, মাগুরা, গোপালগঞ্জসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় মাঝারি মাত্রার ভূ-কম্পন অনুভূত হয়েছে এবং যায় উৎপত্তিস্থল ছিল উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বাইরে চাঁদপুর ও গোপালগঞ্জ জেলায়। সুতরাং এটা প্রতীয়মান হয় যে ভূমিকম্প একটা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত বিষয় যা মানুষের সম্পূর্ণ এখতিয়ারের বাইরে। ঢাকা শহর কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ রাজধানী শহর ঢাকা বিপুল জনসংখ্যা আর অপরিকল্পিত ঘরবাড়ির এক জীর্ণ নগরী। ভূ-তাত্ত্বিক গঠনের দিক থেকে কাছাকাছি ভূ-কম্পনের কেন্দ্রস্থল না থাকায় ঢাকা শহর তেমন ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তা ছাড়া অতীতেও ঢাকায় কোনো বড় ভূমিকম্পের নজির নেই তবে একথা সত্য ভূমিকম্প একটি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত বিষয়। যেহেতু পরপর দুই বছর একই সময়ে (সেপ্টেম্বর মাসে) ঢাকা শহরে ভূমিকম্প হয়েছে সেই প্রেক্ষাপটে এটিকে গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। অপরিকল্পিতভাবে এবং বিল্ডিংকোড না মেনে বহুতল ভবনের মাধ্যমে শহরটিকে বিল্ডিং করে ফেলায় ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরের অপূরণীয় ক্ষয় ক্ষতি হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে মারাত্মক ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে বারবার মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো জানান দিচ্ছে খুব শিগগিরই উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প হবে এই অঞ্চলে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-কম্পনবিষয়ক গবেষণা ও ভূ-তত্ত্ববিদদের মত অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূ-কম্পন বলয়ে অবস্থিত। ইরানের তেহরান শহরের পরই ঢাকার অবস্থান। ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের দুর্যোগ মোকাবেলা বিভাগ “বিশ্বের ২০টি ভূমিকম্পপ্রবণ শহরের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। তার মধ্যেও ঢাকা ছিল অন্যতম। ভূ-মন্ডলীয় আঞ্চলিক সিসমিক জোনের পূর্ব প্রান্তীয় রেখাটি ঢাকার পাশ দিয়ে চলে গেছে। রাজধানীর খুব কাছাকাছি রয়েছে দু’টি শক্তিশালী ভূ-কম্পন কেন্দ্র। এগুলো হলো টাঙ্গাইলের মধুপুর ও বংশী চ্যুতি এলাকা, যা থেকে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। অন্য দিকে মহানগর ও আশপাশ এলাকার ভূমির গঠন অস্থিতিশীল ভূ-তাত্ত্বিক অঞ্চল। ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন অংশে চ্যুতি এবং দীর্ঘ ও সঙ্কীর্ণ প্রান্তরেখা রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো টঙ্গী চ্যুতি, বুড়িগঙ্গা প্রান্তরেখা, খিলক্ষেত ও যাত্রাবাড়ী প্রান্তরেখা এবং মোহাম্মদপুর প্রান্তরেখা। এই সকল প্রান্তরেখা বরাবর ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও বাড়বে আনুপাতিক হারে। পৃথিবীর ছয়টি ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে একটি হলো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, যা রাজধানী ঢাকার অতি নিকটে অবস্থিত। গত ২ শ’ বছরে এই এলাকায় আশপাশে কয়েক শ’ কিলোমিটারের মধ্যে রিখটার স্কেলে ৫ বা তার অধিক মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে শতাধিক বার। এর মধ্যে গত এক শ’ বছরে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে ১৭ বা তার অধিকবার। বিভিন্ন সময়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আসাম, বাংলাদেশের সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রামে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ায় প্রভাবে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ, সুরমা অববাহিকা, বুড়িগঙ্গা, মেঘনা মোহনা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া উপকূল এবং কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ও মহেশখালী চ্যানেলে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে আবার উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট নগরী বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি মানববিপর্যয় দেখা দেবে। আগেই বলেছি রাজধানী ঢাকা শহর বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ও অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ঘরবাড়ির শহর। ফলশ্র“তিতে ভূমিকম্পের জন্য এই শহর মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোর একটি। যেভাবে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট আর অপরিষ্কার ঘরবাড়িতে পরিপূর্ণ হয়েছে ঢাকা। তাতে এখানে ৭ মাত্রার বা তার অধিক মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা এক ভয়ানক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে যেটাতে কোন সন্দেহ নেই। ১৯৯৭ সালে ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর জরিপ চালিয়ে ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকাকে ভূমিকম্পপ্রবণ বলে চিহ্নিত করে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার পূর্বাঞ্চল, রামপুরা, বেগুনবাড়ি, পাগলা খালের দক্ষিণ দিক, বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ দিক, তুরাগ নদী, বাউনিয়া খালের পশ্চিমাঞ্চল এবং টঙ্গীখালের উত্তর দিকের এলাকা। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয় ভূ-তাত্ত্বিক কাঠামো অনুযায়ী ঢাকায় পশ্চিমে বংশী ও বুড়িগঙ্গা নদী। মাঝা-মাঝি অবস্থানে ধলেশ্বরী নদী ও মেঘনা বরাবর লিনিয়ামেন্ট রয়েছে। একটি লিনিয়ামেন্টর অবস্থান হজরত শাহজালাল (প্রাক্তন জিয়া আন্তর্জাতিক) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ঠিক নিচেই ভূমিকম্প হলে এসব লিনিয়ামেন্ট এলাকায় ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি। কমপ্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের (সিডিএমপি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রিখটার স্কেলে ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরের ৪৪ ভাগ ভবন ধসে পড়বে। এই তিনটি শহরের ৫ লাখ ৫৮ হাজার ভবনের মধ্যে ২ লাখ ৪৪ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমানে ঢাকায় ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে প্রায় ৯০ হাজার, এর মধ্যে সরকারি ভবন প্রায় ৫ হাজার। গবেষণায় বলা হয়, টাঙ্গাইলের মধুপুরের ‘ব্লাইন্ড ফল্ট’ এ ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রথম অবস্থায় লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। গবেষণায় আরও বলা হয়, ভূমিকম্প দিনের বেলায় আঘাত হানলে প্রাণহানি হবে প্রায় ১ লক্ষ ৩১ হাজার মানুষ। চিকিৎসা দিতে হবে হাজার হাজার মানুষকে। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা শহরে সরাসরি উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। আসাম সীমান্তের ডাউকি ফল্ট, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্ট ও চট্টগ্রামের বাউন্ডারি প্লেটে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হলেই ঢাকায় এর প্রভাব পড়বে ব্যাপক মাত্রায়। অন্য দিকে ঢাকায় মাটির গঠন সাম্প্রতিক হওয়ায় বহুতল ভবন নির্মাণ অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ, অন্য দিকে রাজধানীতে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো যে হারে নরম ও নিচু এলাকায় যেভাবে মাটি ভরাট করে বাড়িঘর তৈরি করছে তাতে এই ঝুঁকির মাত্রা বেড়েই চলেছে। অধিকাংশ কোম্পানিগুলোর ডিজাইনে ভূমিকম্প বিষয়টি প্রাধান্য পেলেও কার্যক্ষেত্রে কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া অন্যরা ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থা না রেখেই বিল্ডিং তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ ভবনেই মূল নকশার সাথে ভবনের কোন মিল নেই। একই সাথে মানা হচ্ছে না সরকার প্রদত্ত বিল্ডিং কোড। অন্য দিকে ঢাকা শহরের বড় বড় ইমারতগুলো যেভাবে নিচে চার পাশে গ্রিল দিয়ে ঘিরে দেয়া হচ্ছে এবং গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নিচতলায় ফাঁকা রাখা হচ্ছে তাতে ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো অধিক বৃদ্ধি পাবে। কোন নগরীর রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পানি ও গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, টেলিফোন ও অন্যান্য অপটিক্যাল ফাইবার লাইন, ব্রিজ, ওভারপাস আন্ডারপাস ও পরিবহনব্যবস্থাকে বলা হয় নগরীর ‘লাইফ লাইন’। ভূমিকম্প হলে প্রধান সমস্যা হলো লাইফ লাইন নিয়ে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায় রাজধানী ঢাকার আবাসিক চুলা অধিকাংশই সব সময় জ্বালিয়ে রাখা হয় যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আশঙ্কা করা হচ্ছে ভূমিকম্প হলে রাজধানীর ৩০-৪০ ভাগ এলাকায় আগুন ধরে যেতে পারে। টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার কারণে দমকল বাহিনীকে ও দ্রুত খবর দেয়া সম্ভব হবে না। সম্ভব হলেও শুরু ও বিধ্বস্ত রাস্তার কারণে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারবে না দমকল বাহিনীর উদ্ধারকর্মীরা অন্য দিকে নগরীর সব জলাশয় ভরাট করে ফেলার কারণে আগুন নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যাবে না এমতাবস্থায় মানুষ বাড়ি থেকে বাহির হয়ে নেবে কোথায়? ঢাকা শহরের অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে এক চিলতে ফাঁকা জায়গাও নেই যেখানে মানুষ ভূমিকম্পের সময় আশ্রয় নেবে। এর অন্যতম উদাহরণ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, দেখা দেবে খাবার পানি সঙ্কটসহ পয়ঃব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা। দেখা দেবে স্বাস্থ্য সঙ্কট এমনকি হাসপাতাল ব্লাড ব্যাংক বা দমকল বিভাগ ভূমিকম্পে টিকে থাকবে কিনা সেটা নিয়েও রয়েছে সংশয়। ঢাকা শহরে যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস লাইন সঞ্চালন করা হয়েছে মোটেও বাস্তবভিত্তিক নয়, অন্য দিকে যত্রতত্র বিস্তার লাভ করেছে বিদ্যুৎ লাইন। ভূমিকম্পের ফলে যদি গ্যাস লাইন ফেটে যায় এবং বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে যায়, তাহলে ঢাকা শহর এক অগ্নিকান্ডের শহরে পরিণত হবে। ভবন ধসে বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইনের দুর্ঘটনায় অগ্নিকান্ডে লাখো মানুষ নিহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯২৩ সালে জাপানের গ্রেট কান্তো ভূমিকম্পের কথা, যে ভূমিকম্পে দেড় লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। যার মধ্যে শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ মারা যায় অগ্নিকান্ডে। ২০০৬ সালে দেশের বিদ্যুৎ স্থাপনাগুলোকে ভূমিকম্পের আঘাত থেকে বাঁচাতে ১৪ দফা সুপারিশ করেছিল সরকার গঠিত জাতীয় কমিটি কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য এসব বিষয়ে এখনও পরবর্তী কোনো সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলশ্র“তিতে অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি আর রাস্তাঘাট অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, হাসপাতাল আর ঔষধ সরবরাহ ব্যবস্থা ইত্যাদির ওপর দাঁড়িয়ে ঢাকা শহর। এই শহরে যদি উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে তাহলে তাহলে ১৪ এপ্রিল ২০১০ সালে হাইতিতে ঘটে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের ক্ষয়-ক্ষতির চেয়েও ঢাকা শহরে ঢের বেশি ক্ষয়-ক্ষতি হবে এবং পুরো শহরটাও পরিণত হতে পারে মৃত্যুপুরীতে। সুতরাং এখন থেকেই জরুরি প্রয়োজন ভূমিকম্প ও তার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা এবং সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কে অবহিত করা যেটা সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায় থেকেই হতে পারে। ভূমিকম্প : সিলেট, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহর ভূমিকম্পে ঢাকার চেয়েও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহসহ উত্তর ও উত্তর-পূর্ব এলাকায় অন্যান্য শহর। ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত উর্বর ক্ষেত্র হচ্ছে ভারতের আসাম বেল্ট। এরই প্রেক্ষিতে সিলেট শহরে ভয়াবহ ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ১৮৯৭ সালে ঘটে যাওয়া দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে সিলেট মহানগরী অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অতীতে সিলেটকে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া হতো না। সম্প্রতি সিডিএমপির গবেষণার তথ্য মতে সিলেটের ৬০ হাজার ভবনের মধ্যে ২৬ হাজার ভবনই ভয়াবহ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম বেল্টে রিখটার স্কেলে ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে সিলেট, যার কারণে ৯৫ ভাগ বাসাবাড়ি এবং বাণিজ্যিক ভবন ধ্বংস হতে পারে, প্রাণ হারাতে পারে ১২ লাখ মানুষ। একই ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম শহরও। সিডিএমপির তথ্য মতে, চট্টগ্রামের ১ লাখ ৮০ হাজার বিল্ডিংয়ের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার বিল্ডিং ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প চট্টগ্রামের বাউন্ডারি বেল্টে আঘাত হানলেই মহানগরী চট্টগ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। মৃত্যুবরণ করবে লক্ষাধিক মানুষ। অন্যদিকে আসাম বেল্টে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হলে ময়মনসিংহ শহরসহ বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব এলাকার অন্যান্য শহর এলাকায়ও ঘটতে পারে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। ভূমিকম্পের আগে, ভূমিকম্পের সময় ও ভূমিকম্পের পরে করণীয়: গত ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে ঢাকা শহরসহ সারা দেশে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পর মানুষের মনে এই ভীতি সঞ্চার হয়েছে যে, যে কোন সময়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। এর ফলে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি। এমতাবস্থায় প্রলয়ঙ্করী এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়ার জন্য কতিপয় ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ভূমিকম্পের আগে করণীয় : # শক্ত মাটিতে ঘরবাড়ি বানাতে হবে এর জন্য যাথাযথ পাইলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে; # বিল্ডিং কোড সম্পূর্ণ অনুসরণ করে বাড়িঘর নির্মাণ করতে হবে; # বাড়িতে একাধিক দরজা রাখতে হবে, যেন যে কোন প্রয়োজনে ঘর থেকে তাড়াতাড়ি সবাই বের হতে পারে; # বাড়ি নির্মাণের সময় এম-এস রড ব্যবহার করা উচিত। ইটের বদলে ব্যবহার করতে হবে আরসিসি কলাম। এগুলো বাড়ির নিরাপত্তা বাড়িয়ে দিবে; # বাড়ি নির্মাণের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন পাশের বাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় ও নিরাপদ দূরত্ব বজায় থাকে; # বাড়ির নিচ তলায় অধিক পরিমাণে ফাঁকা রাখা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে ভূমিকম্পের সময় বাড়িটি ধসে পড়ায় ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়; # বাড়ি নির্মাণের সময় বিদ্যুৎ লাইনের ব্যাপারে বিশেষ নিরাপত্তা অবলম্বন করা দরকার; # অগ্নিকান্ডের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সর্বদা অগ্নিনির্বাপক বাহিনী সরকারিভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে; # বাড়িতে একাধিক বালিশ, কুশন ও হেলমেট রাখা উচিত এবং সম্ভব হলে শক্ত কাঠের মজবুত টেবিল ও ডেস্ক রাখা দরকার যা ভূমিকম্পের সময় আত্মরক্ষার্থে ব্যবহৃত হতে পারে; # সহজেই ভূমিকম্প অনুধাবনের জন্য ঘরের কোন স্থানে পানি ভর্তি বালতি রাখা যেতে পারে। ভূমিকম্পের সময় করণীয়: # আপনি যদি বুঝতে পারেন ভূমিকম্প হচ্ছে তাহলে দ্রুত বাড়ির সব বৈদ্যুতিক সুইচ বন্ধ ও চুলার গ্যাস নিভিয়ে দেবেন; # সম্ভব হলে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গায় আশ্রয় নেবেন; # ঘরে থাকা কুশন, হেলমেট মাথায় দেবেন এবং পরিবারের সবাইকে দিতে বলবেন; # আতঙ্কিত হয়ে ওপর থেকে লাফ না দিয়ে বসে থাকা বা সম্ভব হলে সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করবেন; # স্টিলের আলমারি শোকেস ইত্যাদি থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকবেন; # ভূমিকম্পের সময় ঘরের জিনিসের মায়া না করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বাইরে চলে আসবেন। ভূমিকম্পের পর করণীয় : # ধারণা করা হচ্ছে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঢাকা শহর। এমতাবস্থায় প্রথম কাজ হবে- # আহত মানুষ উদ্ধার করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। # জীবিত বা আহত অন্যান্য প্রাণীকে ও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। # সুস্থ মানুষ যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করতে এগিয়ে আসবেন তাদের সঙ্গে উদ্ধারকারী অন্য সংস্থাগুলো কাজের সমন্বয় করতে হবে; # অপেক্ষাকৃত কম দুর্গত এলাকায় শিশু ও আহতদের যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে নিতে হবে; # অবস্থা গুরুতর হলে সাহায্যের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে আবেদন করা যেতে পারে; # ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যত দ্রুত সম্ভব বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হবে; # সরকারি- বেসরকারি পর্যায় থেকে যত দ্রুত সম্ভব জীবিতদের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছাতে হবে; # দ্রুত শিশুখাদ্য ও ঔষধ সরবরাহ করতে হবে; # মৃত ব্যক্তি বা প্রাণীর শব দ্রুত সৎকার করতে হবে। তা সম্ভব না হলে পচন শুরু হওয়ার আগেই মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে; # যত দ্রুত সম্ভব যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে হবে। প্রয়োজনে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা যেতে পারে; # মানুষকে ধৈর্য ধারণ করার জন্য মিডিয়ার মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব প্রচার চালাতে হবে; # আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দুর্গত এলাকায় বাইরে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দুর্গত এলাকায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ভূমিকম্প হলে উদ্ধারকাজে প্রয়োজন : ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেখানে মানুষ সম্পূর্ণরূপ অসহায়। সর্বগ্রাসী ভূমিকম্পের পরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভেঙে পড়া ভবনের নিচে চাপা পড়া মানুষ উদ্ধার করা। যার জন্য প্রয়োজন কতিপয় যন্ত্রপাতি যা সরকারের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুদ থাকা জরুরি। যন্ত্রপাতিগুলো হলো ক্রেন, বুলডোজার, ফর্ক লিফট, ট্রাক্টর, চেইনপুলি, পাওয়ার শোভেল ব্রেক ডাউন ভ্যান, প্রাইমওভার, মোবাইল জেনারেটর, হেভিজ্যাক, ওয়েটবল, পানিবাহী গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি হেলিকপ্টার। এ ছাড়া ছুরি, দা, কাঁচি, দড়ি, শাবল খুরপি ইত্যাদি প্রয়োজন। জাতীয় বিল্ডিং কোডের প্রধান নীতিমালা : ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় শুধুমাত্র সচেতনতার মাধ্যমেই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়-ক্ষতি কিছুটা লাঘব করা সম্ভব। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমিকম্প প্রতিরোধক নকশা ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা এড়ানো সম্ভব। ১৯৯১ সালে পরিকল্পনা কমিশনের উদ্যোগে বিল্ডিং কোড প্রণয়নের কাজ হাতে নেয়া হয় এবং ১৯৯৩ সালে ১২৫টি সংস্থার ১৮৫ জন বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোডে (বিএনবিসি’ ৯৩) ভূ-কম্পন হতে ভবনকে রক্ষার জন্য কার্যকর নকশার কথা বলা হলেও তা কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোডের উল্লেখযোগ্য দিক- ষ ভবনের কাঠামো লোডের অনুপাত অনুসারে হওয়া উচিত। রেইনফোর্সমেন্ট ব্যতীত ভারবহন করা ভবন ছয় তলার ওপরে করা যাবে না। ষ উচ্চতা ও লোডের হিসাব অনুসারে ভবনের ভিত্তি দিতে হবে। নরম মাটিতে ভবন নির্মাণ না করাই শ্রেয়। যদি একান্তই করতে হয় তাহলে লক্ষ্য রাখতে হবে ভিত্তি যেন শক্ত মাটি পর্যন্ত হয়। ষ এম-এস রড ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন বাঞ্ছনীয়। ষ শুধু দরজা-জানলার ওপর দিয়ে দেয়ালের আগাগোড়া লিন্টেল দেয়াই শ্রেয়। ষ ভবনের নকশা এবং কলাম ও বিম ডিজাইনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ভবনটি সিসমিক লোড ও উইন্ড লোডের জন্য সহনীয় হয়। ষ কংক্রিট প্রস্তুত করার সময় খোয়া, সিমেন্ট, বালির উপযুক্ত অনুপাত বজায় রাখতে হবে। ষ পাহাড়ি এলাকায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আগেই মাটির বোরিং টেস্ট করে নিতে হবে। ভবনের পাশে পাহাড় বা পানি থাকলে মাটির সমান্তরাল লোড বিবেচনায় নেয়া আবশ্যক। ষ জনবহুল এলাকায় এক ভবন থেকে অন্য ভবনের দূরত্ব কমপক্ষে ছয় ফুট দূরে থাকবে। একান্তই সম্ভব না হলে দুই ভবনের মাঝখানের মাটিকে কংক্রিট সামগ্রী দিয়ে শক্ত করতে হবে। ষ মাঝারি কিংবা বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ব্যাপক ধ্বংস লাঘবে ও ভবনের ভূ-কম্পন সহনশীলতা বাড়াতে বিল্ডিং কোড মেনে চলা জরুরি। বিশেষ করে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামের মত ভূমিকম্পপ্রবণ শহরগুলোতে। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূ-কম্পন বলয়ে অবস্থিত। ইরানের তেহরান শহরের পরেই ঢাকা শহরের অবস্থান। তা ছাড়া মধুপুর ফল্টে ভূমিকম্প হওয়ায় পর ১২৫ বছর পেরিয়ে গেছে। কাজেই ১ শ’ বছরের ভূমিকম্পের সাইকেল অনুযায়ী ঢাকায় আরও একটি উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। আবার কেউ কেউ ভূমিকম্প সাইকেলের কথা মেনে না নিতে চাইলেও বাংলাদেশ যে একটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত এতে কোন সন্দেহ নেই। যেভাবে ঢাকা সিলেট ও চট্টগ্রামসহ অন্যান্য শহরে অপরিকল্পিতভাবে বিল্ডিং কোড না মেনে ঘরবাড়ি তৈরি করা হচ্ছে তাতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও একটু অধিক সময় স্থায়ী হলে ঘটে যেতে পারে ধ্বংসলীলা। অথচ ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি খুবই অপ্রতুল। সুতরাং সরকারের উচিত হবে এখনই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের সাথে সাথে জনগণের মধ্যে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ও ভূমিকম্পের করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা। এর জন্য এনজিওগুলোকে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, মাদরাসার শিক্ষক এবং মসজিদের ইমামদেরকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। গঠন করা যেতে পারে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোতে আগে থেকেই ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে রাখতে হবে এবং প্রশিক্ষণ দিতে হবে কিভাবে দ্রুত উদ্ধারকার্য পরিচালনা করা যেতে পারে এবং সাথে শহর এলাকায় বিল্ডিং কোড মেনে ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে বাধ্য করতে হবে। প্রস্তুত রাখতে হবে অগ্নিনির্বাপক গাড়ি, পানি সরবরাহ গাড়ি, ঔষধসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। তবেই ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া সম্ভব। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির