post

মকবুল আহমাদ (রহ) অন্যতম দায়ী ইলাল্লাহ

আলী আহমাদ মাবরুর

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২

বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম দায়ী- দায়ী ইলাল্লাহ, অন্যতম সিপাহসালার, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মকবুল আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ (১৯৩৯-২০২১) গত ১৩.৪.২০২১ আমাদেরকে ছেড়ে মহান প্রভু আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন...। ইসলামী আন্দোলনের এক কঠিন সময়ে তিনি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আকর্ষণীয় জীবনের অধিকারী ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ এই দ্বীনের দায়ী সাবেক আমিরে জামায়াত মকবুল আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ। প্রায় ত্রিশ বছর তার সাহচর্যে থেকে দায়িত্ব পালন করার সুয়োগ পেয়েছি। তার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে দোয়া করি তিনি যেন তার জানা অজানা সকল গুনাহ খাতা মাফ করে দেন এবং তার নেক আমলগুলোকে কবুল করে জান্নাতুল ফিরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করেন-আমিন।
আনাস রা. থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, সাহাবায়ে কিরাম একবার এক জানাজায় গেলেন। সেখানে তারা মৃতের প্রশংসা করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ সা. তা শুনে বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেছে। এভাবে তারা আর এক জানাজায় গেলেন সেখানে তারা তার বদনাম করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ সা. তাদের কথা শুনে বললেন, ওয়াজিব হয়ে গেছে। এ কথা শুনে উমার রা. জানতে চাইলেন কী ওয়াজিব হয়ে গেছে? হে আল্লাহর রাসূল! রাসূলুল্লাহ সা. বললেন: তোমরা যে ব্যক্তির প্রশংসা করেছ, তার জন্য জান্নাতপ্রাপ্তি ওয়াজিব হয়ে গেছে। আর যার বদনাম করেছ, তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেছে। তারপর রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তোমরা জমিনে আল্লাহর সাক্ষী। (বুখারি, মুসলিম; অন্য আর এক বর্ণনার ভাষা হলো তিনি বলেছেন, মু’মিন আল্লাহ তায়ালার সাক্ষী; বুখারি-১৩৬৭, মুসলিম-৯৪৯)
এখান থেকে বুঝা যায় দুনিয়ায় মুমিনগণ আল্লাহ তায়ালার সাক্ষী। একজন মৃত ব্যক্তির ভালো গুণের আলোচনা করতে পারে। যারা দুনিয়া থেকে চলে যায় তাদের কল্যাণের জন্য তাদের ভালো আমলগুলোর উল্লেখ করলে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় তার সাক্ষী হিসেবে কবুল করেন। এই হাদিসকে সামনে রেখেই কিছু কথা বলার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
সকলের কাছে আমার আবেদন ব্যক্তির জীবিত অবস্থায় নয়, তার মৃত্যুর পর যদি কোন নেক কাজের এমন কিছু ঘটনা বা দৃশ্য আপনার জানা থাকে অথচ তা কারো কথায় বা লিখায় আসছে না- তাহলে আপনি তা লিখে অন্যের জানানোর ব্যবস্থা করলে এটা সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে কাজে লাগবে। হাদিসে এসেছে মৃত ব্যক্তির ভালো আমল উল্লেখ করে তার জন্য দোয়া করা উত্তম। এখন স্মৃতিতে যে সমস্ত ঘটনাগুলোর কথা মনে হচ্ছে সেগুলো থেকে সামান্য কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করছি- ওমা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।
এক. মরহুম মকবুল আহমাদ ভাই মানুষ হিসেবে অত্যন্ত সহজ সরল সাদা দিলের ব্যতিক্রমী একজন মানুষ ছিলেন। সকলকে অত্যন্ত আপনজন মনে করে কথা বলতেন, দাওয়াত দিতেন ও পরামর্শ দিতেন। অত্যন্ত সহজ সরল ব্যক্তিত্ব মকবুল আহমাদ ১৯৩৯ সালের ৮ই আগস্ট ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার ওমরাবাদ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ইসলামী আন্দোলনের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবন ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার এবং পরিচ্ছন্ন। অনেকটা সাদা পাঞ্জাবির মতোই ছিলো তার চারিত্রিক ভূষণ। একজন সজ্জন, পরোপকারী, বিনয়ী, সদালাপী, নিরহঙ্কারী, সবরকারী, আত্মপ্রত্যয়ী, পরম আল্লাহ-নির্ভরশীল মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন, সত্যের পথে অটল-অবিচল।
ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী বলেন, ‘যাই হোক। এ লোকটা (মকবুল আহমাদ) ভালো ছিলেন। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন। তাকে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।’ (নয়া দিগন্ত) ‘মকবুল আহমাদ আমাদের ফেনী অঞ্চলের ভদ্রলোক, ফেনীর কৃতী সন্তান ছিলেন। তিনি এক সময় জামায়াতে ইসলামীর প্রধান (আমির) ছিলেন। মকবুল সাহেব ইন্তিকাল করেছেন। তার জানাযায়ও তার জনপ্রিয়তা প্রমাণ হয়েছে।’ ‘তিনি ভদ্রলোক ছিলেন। মনে হয় জীবনে কারো সাথে কোনো দুর্ব্যবহার করেননি। পরহেজগার মানুষ ছিলেন। সৎ মানুষ ছিলেন। তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘যারা যেভাবেই নেন না কেন, আমি এই মানুষটাকে সৎ হিসেবেই বিবেচনা করি। এমনকি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও তিনি কোনো ক্ষতিকর ভূমিকায় ছিলেন না। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও ছিল না।’
বৃদ্ধ বয়সে এই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী জালিম সরকার মিথ্যা সাজানো নাশকতার মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করে। তিনি দীর্ঘদিন কারাবরণ করেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন কিন্তু দ্বীনের এই রাহবার অটল, মজবুত ছিলেন এবং বাতিলের কাছে কখনো মাথা নত করেননি।
১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর তিনি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাহী জাতীয় পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামের মালিকানা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত।
২০০৪ সাল থেকে তিনি কেন্দ্রীয় নায়েবে আমিরের দায়িত্ব পালন করেছেন। একইসাথে ২০০৪ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ ইসলামিক ইনস্টিটিউটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৃতীয় আমির হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৬ ও ’৭৯ সালে তিনি “রাবেতা আলম আল ইসলামীর” মেহমান হিসাবে দু’বার পবিত্র হজব্রত পালন করেন এবং জাপান ইসলামী সেন্টারের দাওয়াতে জাপান সফর করেন।
১৯৮৪ সালে তিনি ঢাকায় অবস্থিত জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান ‘ফালাহ-ই-আম ট্রাস্টের’ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার সহযোগিতায় সিলোনিয়া মাদরাসা সংলগ্ন মসজিদ ও ‘উম্মুল মোমেনিন মহিলা মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফেনী ইসলামিক সোসাইটির উদ্যোগে বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফেনী শাহীন একাডেমি (কেজি ও হাইস্কুল), এতিমখানা ও হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফালাহিয়া ট্রাস্টের উদ্যোগেই ফেনীর ঐতিহাসিক ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
প্রথম যে দৃশ্যগুলো মনে পড়ছে তার অন্যতম দৃশ্য হচ্ছে দাওয়াতি কাজের দৃশ্য। তিনি মগবাজার এলাকার প্রতিবেশী রমনা থানার সাবেক আমির জনাব ডাক্তার আব্দুস সালাম ভাইয়ের সাথে প্রথমদিকে বেশির ভাগ দাওয়াতি কাজ করতেন। এরপরে আমি প্রতিবেশী হিসেবে এবং সাবেক এমপি হিসেবেও কাছাকাছি হওয়ায় আমাকে সাথে নিয়ে অনেকদিন অনেক জায়গায় অনেকের কাছে দাওয়াতি কাজ করার জন্য গিয়েছিলেন। তার নিকট-আত্মীয় স্বজনের বাসায় যেতেন, বন্ধু-বান্ধবের বাসায় যেতেন এমনকি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি অনেক ব্যক্তির কাছে দাওয়াতি কাজ করতেন, বই নিয়ে যেতেন বই দিতেন এবং লিখে রাখতেন ‘এক কিতাব দো মুলাকাত’ ফরমুলায় সেই ব্যক্তির নাম টেলিফোন নাম্বার এবং বই দিলেন কত তারিখে সেটাও লিখে রাখতেন। অনেকেই আগ্রহভরে দ্বীনের দাওয়াত কবুল করতেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমালোচনা বিরূপ মন্তব্য এমনকি বাসাতে বসতে না দিলে সেখান থেকে ফিরে চলে আসতে হয়েছে। এতে তিনি মন খারাপ করতেন না। তিনি বলতেন নবী-রাসূলগণ এবং সাহাবায়ে কেরামগণ দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে কত ধরনের সমালোচনা কত ধরনের বিরোধিতা দুঃখ কষ্ট এমনকি প্রতিরোধের মুখে এ কাজ করে গেছেন। আমাদের এই একটি ছোটখাটো কাজ তার তুলনায় অনেক কম।
দাওয়াতি কাজে ইসলামী বই প্রদান করাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। নিজে সাথে বই নিয়ে যেতেন এবং কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকেও দাওয়াতি কাজের জন্য বই সরবরাহ করতেন।
দুই. তার পারিবারিক সদস্যদেরকে ইসলামী আন্দোলনের পথে সক্রিয় করার জন্য এগিয়ে নিয়ে রোকন করার জন্য আমাদেরকে তার বাসায় দাওয়াত দিতেন। তার পারিবারিক বৈঠকে মেহমান হিসেবে একাধিকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনিও আমাদের পারিবারিক বৈঠকে মেহমান হিসেবে এসেছেন।
তার বাসায় গেলে ভালোভাবে মেহমানদারি করতেন। পুরুষদেরকে ড্রইং রুমের মধ্যে এবং দরজার ওপাশে মহিলাদেরকে বসতে বলতেন এবং তিনি নিজেই বৈঠক পরিচালনা করতেন। তাদের কুরআন হাদিস পাঠ, জামাতে নামাজ আদায় করার ব্যাপারে দাওয়াতি কাজ করার ব্যাপারে খোঁজখবর নিজে নিতেন এবং আমাদেরকে দিয়েও পর্যালোচনা ও পরামর্শের কাজ সম্পন্ন করতেন। সচিবালয় ও বিভিন্ন অধিদফতরে বেশ কয়েকবার একসাথে দাওয়াতি কাজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষ করে ফেনী নোয়াখালী অঞ্চলের পরিচিত একাধিক কর্মকর্তাকে দাওয়াত দেয়ার জন্য তিনি চেষ্টা করতেন। কুরআন মাজিদের আয়াতকে সামনে রেখে সম্ভবত তিনি এসব কাজ করতেন। যেখানে আল্লাহ বলেন ‘কু আনফুসাকুম ওয়া আহলিকুম নারা’ অথবা ‘অআনজির আসিরাতাকাল আকরাবিন’, তোমরা তোমাদের নিজেকে এবং তোমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, তোমাদের নিকট আত্মীয়দের সতর্ক করো। দেখেছি, দাওয়াতি কাজের ক্ষেত্রে তার কোনো অবহেলা ছিল না। বিশ্রামের সময়গুলোকে তিনি দাওয়াতি কাজে ব্যবহার করতেন। ডায়াবেটিসের সিনিয়ার রোগী হওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় দুপুরের খাবার সেক্রিফাইস করতেন। বিকল্প কোন দোকানে রুটি কলা কিনে নিজে খেতেন সাথীকে খাওয়াতেন গাড়ির চালককেও খাওয়াতেন। একই মানের একই সাথে একই আইটেম সবাইকে নিয়ে খেতে ভালোবাসতেন।
১৪৪২ হিজরির রমাদানের শেষ দশকে ইতেকাফ করার সময় অতীতে সাবেক আমিরে জামাত মকবুল আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ এর বেশ কিছু স্মৃতি মনের আয়নায় ভেসে উঠল।
তিনি ৫০৫, মগবাজার কেন্দ্রীয় অফিস সংলগ্ন চাঁদ জামে মসজিদে এলাকার আগ্রহী জনশক্তিদের নিয়ে রমাদানের শেষ দশ দিনের এতেকাফ পালন করার লক্ষ্যে একসাথে ইফতার এবং সাহরির জন্য যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দিতেন। এ ব্যাপারে তিনি সিকান্দারসহ কেন্দ্রীয় অফিসের সহযোগিতা নিয়ে কাজগুলো করতেন। লম্বা দস্তরখান, লম্বা মশারি থালা বালতি গ্লাসসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের ব্যাপারে তখনকার কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক জনাব অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম ভাই তাকে সহযোগিতা করতেন। জনাব মকবুল আহমদ রাহিমাহুল্লাহ তদানীন্তন আমিরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আল্লাহ তায়ালা তার শাহাদাত কবুল করুন, উনাকেও এতেকাফে দাওয়াত দিতেন। তিনি ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও ইতেকাফে যোগ দিতেন। যদি পুরো সময় দিতে না পারতেন তথাপি শেষদিকে সাতাশে রমাদানের শেষের দিনগুলো এতেকাফে বসে যেতেন। মন্ত্রী থেকে নিরাপত্তা সহকারীদের নিয়েও ইতেকাফ করতেন যা ইতিহাসে বিরল। সেই সাথে মাওলানা সরদার আব্দুস সালাম, ডাক্তার আব্দুস সালামসহ আশপাশের রুকন কর্মীদের ইতেকাফে শরিক করতেন।
প্রথম আমিরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম রাহিমাহুল্লাহ পুরোপুরি নিয়মিত এতেকাফ করতেন তার মগবাজার কাজী অফিস মসজিদে। দ্বিতীয় আমিরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী রাহিমাহুল্লাহ, আল্লাহতায়ালা তার শাহাদাত কবুল করুন, নিয়মিত এতেকাফ করতেন কেন্দ্রীয় অফিস সংলগ্ন মসজিদে। যদিও মন্ত্রী হিসেবে সরকারি দায়িত্বের কারণে আংশিক সাতাশে রমাদানের শেষের দিনগুলো এতেকাফে বসতেন। তৃতীয় আমিরে জামায়াত মকবুল আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ তিনিও শারীরিক ও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে কিছু বাদ গেলেও প্রায় নিয়মিত ইতেকাফ করতেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার অসীম মেহেরবানিতে তাদের সকলের সাথে ইতেকাফ করার মতো দুর্লভ সুযোগ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাকে দান করেছেন -আল্লাহ তায়ালা কবুল করুন- আমিন।
ইতেকাফ করার সময় মকবুল ভাই যেসব ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন-
“অপচয় যাতে না হয়, অপচয়কারী শয়তানের ভাই এটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। রাতের মূল্যবান সময়গুলো কুরআন তিলাওয়াতে ও ব্যক্তিগত ইবাদাত জিকির আজকারে কাজে লাগানোর জন্য পরামর্শ দিতেন।
লাইট, ফ্যান এমনকি অজুর পানির ট্যাপ কত জোরে অথবা আস্তে ব্যবহার করছেন তাও তিনি খেয়াল করতেন। তিনি বলতেন এক মগ পানি নিয়ে অজু করলেই যথেষ্ট। দ্রুতগতিতে পানি ছাড়লে এক বালতি ভর্তি পানি নষ্ট হয়ে যায়।
কুরআন মাজিদ সম্পর্কে বিদেশীর একটি মূল্যবান কথা তিনি প্রায়ই বলতেন। একজন বিদেশী নওমুসলিম কুরআন হাদিসে বর্ণিত মুসলমান কাকে বলে তিনি বুঝতে পারতেন কিন্তু বাস্তবে মুসলমানদের দেখে তিনি কিছুতেই বুঝতে পারতেন না মুসলমানদের জন্য কি আরেকটি কুরআন আছে? তিনি একবার প্রশ্ন করলেন আপনারা যে কুরআন মানেন সেই কুরআনটি কোথায়? কারণ আপনাদের কাজের সাথে আমি যে কুরআন পড়ছি সেটা তো মিলে না। আপনাদের কুরআন অবশ্যই আলাদা আছে, না হলে আপনারা এসব কাজ কাম করেন সেগুলো কোথায় পেলেন, তা কোথায় লেখা আছে?
তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল “আপনাকে রিমান্ডে কি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে? তিনি হেসে বললেন তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আমি তাদের জিজ্ঞাসা করেছি। আমি পুলিশ অফিসারদের বলেছি আপনারাতো মুসলমান। আপনারা নামায পড়েন? কুরআন শরিফ পড়তে জানেন? আপনার বিবি পর্দা করেন? সন্তানেরা কুরআন পড়তে জানে? তারা অবাক হয়ে বলেছে, স্যার আমাদের আর কেউ এভাবে কোনদিন বলেনি! আমি বলেছি আপনারা কুরআন-হাদিস পড়ার চেষ্টা করবেন। অবাক করার বিষয় এ কঠিন সময়েও তিনি দাওয়াত দিতে ভুলে যাননি।”
তিন. ইনসাফের কাজটা অত্যন্ত মজবুতভাবে করতেন। একদিন অফিসে বসে আছি তিনি একটি ম্যাপ দেখালেন যেখানে অসংখ্য দাগ বিভিন্ন জেলার উপরে দিয়ে রেখেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম মকবুল ভাই ম্যাপের মধ্যে এত দাগ এটা দিয়ে কী বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক কাজ মসজিদ মাদরাসা এতিমখানা স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্কুল হেফজখানা যেসব জেলায় সহযোগিতা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সেখানে তিনি দাগ দিয়ে রেখেছেন। দেখা যাচ্ছে কোন কোন জেলায় অনেক দাগ আর কিছু জেলায় কোন দাগ নাই অথবা দু’ একটা দাগ। তিনি বললেন যেখানে কোন প্রতিষ্ঠান নাই সেখানে দেয়া উচিত, যেখানে আছে সেখানে না দিয়ে ঐসব জায়গায় ইনসাফ কায়েম করা উচিত। মকবুল ভাইয়ের ইনসাফের হৃদয় সেদিন ফুটে উঠেছিল তার অফিসে রক্ষিত সেই বসন্ত দাগওয়ালা বিভিন্ন জেলার মানচিত্রে। সে দৃশ্য এখনো মনে পড়ে। অনেক সময় যেসব জেলায় কোন উন্নয়নমূলক কাজ হয় নাই সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য বৈঠকে বলতেন এবং জোরালোভাবে এগুলো করার জন্য খোঁজখবর নিতেন এবং চেষ্টা করতেন। মকবুল ভাই দুস্থ অসহায় লোকদের খোঁজখবর নিতেন তাদের কাছে তাদের পরিবারে কখনো কখনো সহযোগিতা পৌঁছাতেন বস্তুর আকারে অথবা আর্থিক সহযোগিতা।
চার. বিশেষভাবে সংগঠনের অসহায় পরিবারগুলোর এবং ইয়াতিম সন্তান-সন্ততিদের খোঁজখবর নিতেন এবং সাহায্য-সহযোগিতা পৌঁছাতেন। তারিখ মনে নেই তবে একদিন আল-ফালাহ বিল্ডিংয়ে আমাদের কয়েকজনকে ডাকলেন। তিনি ডাকলেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ওই সমস্ত সদস্যদেরকে যাদের অর্থনৈতিকভাবে সংসার টানাটানির মধ্য দিয়ে চলত। সেখানে মাওলানা আবু তাহের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রাহিমাহুল্লাহ এবং মাহমুদ হোসাইন আল মামুন সাবেক কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য রাহিমাহুল্লাহসহ আমি ছিলাম। তিনি বললেন আমাদের মধ্যে কারও কারও অর্থনৈতিকভাবে সংসার পরিচালনায় সহযোগিতার জন্য আশপাশে কোন ব্যবসা বাণিজ্য অথবা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে কাজ করে সহযোগিতা পান কিন্তু যারা এসব কাজ করার কোনো অবকাশ পান না, এ সকল কাজ করার চিন্তাও তাদের মধ্যে থাকে না, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সহযোগিতার মাধ্যমে জীবনযাপন করেন তাদেরকে কিছু করার জন্য কী করা যায় সে পরামর্শ নিতেন এবং দিতেন। তার মনটাই ছিল যারা অতিরিক্ত কোনো উপার্জন করার সুযোগ পায় না সাংগঠনিক কাজেই পুরো সময়টা ব্যয় করেন তাদেরকে কিছু করে দেয়া যায় কিনা। তার এ মহৎ উদ্যোগের জন্য সেদিন আমরা তার জন্য আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি। এখনও সেই দৃশ্যগুলো মনে পড়ছে আর দোয়া করছি আল্লাহ তায়ালা তার এই মহৎ কাজকে ও কাজের চেষ্টাকে কবুল করুন আমিন।
পাঁচ. তিনি যখন বক্তব্য দিতেন তখন নরম গরম মিশিয়ে সুন্দর বক্তব্য রাখতেন। “জামায়াত আইনগত ও রাজনৈতিকভাবে সরকারের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করবে। সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই যুদ্ধাপরাধকে ইস্যু বানিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে। মূলত সরকার দেশ থেকে ইসলাম বিতাড়নের জন্যই যুদ্ধাপরাধকে ইস্যু বানিয়ে শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে হত্যা করছে। সরকার এর প্রতিবাদও করতে দিচ্ছে না। কিন্তু জনগণ কাউকে রাজপথ ইজারা দেয়নি। দেশের মানুষ সরকারের এসব দেশ ও জাতিসত্তা বিরোধী ষড়যন্ত্র মেনে নেবে না বরং ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন নিশ্চিত করে নেতৃবৃন্দকে মুক্ত করবে ইনশাআল্লাহ।”
তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সকলকে ময়দানে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে অবশ্যই আত্মগঠন, পরিবার গঠন ও এলাকা গঠনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আর নিজেকে ইসলামী আন্দোলনের উপযোগী করে তুলতে হলে বেশি বেশি করে কুরআন, হাদিস ও ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন করতে হবে। পরিবারের মধ্যে কেউ আন্দোলনের বাইরে থাকলে তাকেও আন্দোলনে শরিক করতে হবে। এলাকার লোকজনের কাছে উত্তমপন্থায় দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাতে পারলে অবশ্যই মানুষ তাতে সাড়া দিবে। আর পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে পারলেই ইসলামী আন্দোলনকে গতিশীল করা সম্ভব।”
ছয়. পরিশেষে মকবুল ভাই উৎসাহ জোগাতেন কিছু লেখার জন্য। তিনি বলতেন অনেকেই আছে সফর করে এসেই সফরকে কেন্দ্র করে কিছু লিখতে পারেন। একবার তিনি নিজে চেষ্টা করলেন তার সফরের জন্য লিখবেন। জাপান থেকে ফিরে এসে কিছু কথা লিখেছিলেন মকবুল ভাই। সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় “জাপান সফর- দেখার অনেক, শিখার অনেক” এ বিষয় তার সফর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি এবং আল্লাহর সাহায্যের উপযুক্ততা অর্জন, মোট দু’টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। (সৌজন্যে সাপ্তাহিক সোনার বাংলা।)
আল্লাহ তায়ালা তার জীবনের মহৎ কাজগুলোকে কবুল করুন এবং তার রেখে যাওয়া সদকায়ে জারিয়ার কাজ এবং কথা যেন আমরা মেনে চলতে পারি অনুসরণ করতে পারি, সংগঠনকে এগিয়ে নিতে পারি এবং ভবিষ্যৎ ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল ও কর্মীদের জন্য সদকায়ে জারিয়া হিসেবে কিছু রেখে যেতে পারি সেই তৌফিক আল্লাহতায়ালা দান করুন আমিন। নি¤েœ প্রদত্ত দোয়াটি মাঝে মধ্যে সব সময় পড়ছি সকলকে পড়ার জন্য অনুরোধ করছি-
“আল্লাহুম্মাগফির লাহু অরহামহু অফিহি অ’ফু আনহু অকরিম নুজুলাহু অ-অঅসসি মুদখালাহু অগসিলহু বিলমায়ি অসসালজি অলবারদি, অনাককিহি মিনাল খাতাইয়া কামা নাক্কাইতাস সাওবুল আবইয়াজু মিনাদ্দানাসি অবদিলহু দারান খায়রাম মিন দারিহি, অআহলান খায়রাম মিন আহলিহি, অজাওজান খাইরাম মিন জাওজিহি, অদখিলহুল জান্নাতা অয়িজহু মিনআজাবিল কাবরি অ আজাবিন নার।”
হে আল্লাহ তুমি তাকে মাফ করে দাও, তাকে রহম করো, তাকে নিরাপত্তা দাও, তাকে সম্মানিত মেহমান হিসেবে কবুল করো, তার কবরকে প্রশস্থ করে দাও, তার গোনাহসমূহকে পানি ও শিলারাশি দ্বারা ধৌত করে দাও, তার গোনাহগুলোকে ঐভাবে পরিষ্কার করে দাও যেভাবে সাদা কাপড় থেকে ময়লা পরিষ্কার করা হয়, তাকে তার বাড়ির চেয়ে উত্তম বাড়ি দান কর, তাকে তার আহলের চেয়ে উত্তম আহল দান করো, তাকে তার সঙ্গীর চেয়ে উত্তম সঙ্গী দান করো, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাও, তাকে কবরের আজাব ও জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচাও। আমিন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির