post

মতিউর রহমান মল্লিকের কাব্য

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

০২ এপ্রিল ২০২২

কবিতা মানুষকে জাগায়, মানুষও জাগিয়ে রাখে কবিতাকে। জাগিয়ে দেবার পিছনে সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল থাকে মানবিক মূল্যবোধ এবং চেতনার নান্দনিকতা। তাইতো ‘একজন কবিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে যুতসই একটি কবিতাই যথেষ্ট; যেমনটি ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই’ কবিতাটিই যথেষ্ট কবি যতীন্দ্র মোহন বাগচীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য; কবি আল মাহমুদ অত্যন্ত দৃঢ়ভাষায় বলেছিলেন কথাগুলো। যদিও সৈয়দ মুজতুবা আলী কবি ওমর খৈয়ামের একটি প্রবাদের অনুবাদ উল্লেখ করেছেন- ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়।’ একেকজন কবির জন্য এ রকম একটা দুটো সৃষ্টি তাকে জনসম্মুখে অমর করে রাখে। কারণ এ ধরনের লেখার মধ্যে থাকে আধুনিকতা ও মানবিকতার অনুরণন। অমর হয়ে থাকার মতো এমন অনেকগুলো পঙক্তির নির্মাতা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কবি মতিউর রহমান মল্লিক। স্বদেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা পুরুষ। পঙক্তির ভাঁজে ভাঁজে তিনি নির্মাণ করেছেন দেশ-জাতি ও মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতার শৈল্পিক চেতনা। তাঁর কাব্যভাষার আধুনিকতা এবং কবিতার পরতে পরতে মানবিক মূল্যবোধ এবং নান্দনিকতার উচ্চারণ তাঁকে মানব হৃদয়ে অমরত্বের আসন পেতে দিয়েছে। দেশপ্রেম ও মানবতাবাদের আদর্শে উজ্জীবিত বাংলাসাহিত্যের শক্তিমান কবি মতিউর রহমান মল্লিকের লেখায় উঠে এসেছে জীবনের হাজারো চিত্র। কবিতা, ছড়া এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধেও তিনি দেশ-জাতির জন্য বলিষ্ঠ ভাষায় সাহসী উচ্চারণ করেছেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সফল উত্তরসূরি হিসেবে সঙ্গীতের জগতেও ঢেউ তুলেছেন সফলভাবে। বিশ্বাসী ধারায় তিনি এক সফল স্রোত বিনির্মাণেও সফল হয়েছেন পুরোপুরি। সুরে সুরে গেয়েছেন মানবতার জয়গান। তিনি স্বদেশকে ভালোবেসেছেন হৃদয় দিয়ে; মমত্ববোধের রজ্জু দিয়ে স্বদেশকে বেঁধেছেন বিশ্বাসের আবহে। তাইতো দেশের বুকে যে কোন ক্ষতচিহ্ন তাঁকে ব্যথিত করে, করে তোলে বিচলিত। ‘তোমার কিশোরকালের/ মত এতো পুকুরও তুমি কোথাও পাবে না/ এবং তোমার প্রগাঢ় পল্লবের মত এমন/ যৌবনও তুমি কোথাও পাবে না’। (বিলের দিকে: অনবরত বৃক্ষের গান, পৃ. ৪২)। নদীদখল আর পুকুর ভরাটের চিত্র আঁকতে গিয়ে এমন বিচলিত মনের আধুনিক পঙক্তি নির্মাণ করেছেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। বৈশ্বিক উষ্ণতায় বদলে যাচ্ছে ভূ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য এবং মানবীয় ভূগোল। জলশূন্যতা শুধু বৃক্ষের ঘরে নয় মানুষের আত্মায়ও। তাই কবিতার মতো বাঁচার আকুতি পরিবেশ বৃক্ষ এবং জৈব সমাজে। এই আকুতির সহমর্মিতায় কবিদের কাব্যচর্চা; পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলনে নিজেকে সরবকর্মী হিসেবে জানান দেয়ার প্রয়াস। সেই কাতারের একজন নিবেদিত কবিপুরুষ মতিউর রহমান মল্লিক। বিশ্বাসের শেকড় থেকে শরীরের লোমকূপ পর্যন্ত তিনি ছুঁয়ে দিয়েছেন কবিতার পরশ পাথর; নির্মাণ করেছেন উর্বর পলিমাটির ফসলি আস্তরণ- ফলিয়েছেন কবিতার সোনালি ফসল। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত শব্দদ্যোতনার ভাঁজে ভাঁজে মানবিক উচ্চারণ; বৃক্ষ বাঁচাও, পরিবেশ বাঁচাও, বাঁচাও প্রাণের স্পন্দন- মনুষ্যসমাজ। কারণ বৃক্ষ শুধু বৃক্ষই নয়- জীবন্ত প্রাণী; মানুষও শুধু প্রাণী নয়, জীবন্ত বৃক্ষ। বৃক্ষের শেকড় ছুঁয়েই উঠে আসে সবুজাভ প্রেম- নির্মিত হয় শান্তিময় আবাস। তাইতো বৃক্ষের বাকল ছুঁয়েই তিনি নির্মাণ করেছেন বিশ্বাসের নতুন ক্যানভাস, কবিতার মানবিক শব্দকলা। তাঁর এ শব্দ-দর্শনে জন্ম নিয়েছে নতুন চেতনা, আবিষ্কৃত হয়েছে বিশ্বাসের পতাকা। বৃক্ষের সাথে মানবাত্মার উপমা টানতে গিয়ে তিনি বলেন- ‘একটি হৃদয় লতার মত, লজ্জাবতীর পাতার মত/ অনেক কথকতার মত।/ একটি হৃদয় ফুলের মত, সুরমা নদীর কুলের মত/ বট পাকুরের মূলের মত।’ [একটি হৃদয়, আবর্তিত তৃণলতা, পৃ.১৮]। বৃক্ষের মতোই মানুষকে বিস্তারিত হওয়ার আহ্বানে তিনি বলেন, ‘বৃক্ষের বিস্তার আছে/ হৃদয়েরও বিস্তার আছে/ খুব কম লোকই বিস্তারিত হতে পারে।’ [বিস্তার, আবর্তিত তৃণলতা, পৃ.১১] বৃক্ষকে প্রেরণার নদীর মতো দেখেছেন তিনি। বৃক্ষের হৃদয়ের গভীরতা অতল সাগরের মতো। নিখাদ ভালোবাসার সবক পাওয়া যায় বৃক্ষের কাছেই। তাইতো তিনি বলে ওঠেন- ‘এই গাছের নীচেয় একটু দাঁড়াও/ হৃদয় হৃদয় হোক/ শরীরে সান্নিধ্য দিক মাতাল হাওয়া/... এসো এ গাছের নীচেয় একটু দাঁড়াই/ তারপর/ ভালবাসি পৃথিবীর সকল মানুষ।’ [গাছ সম্পর্কিত, আবর্তিত তৃণলতা, পৃ. ৩২] বৃক্ষ ধ্বংস মানে পরিবেশ ধ্বংস আর পরিবেশ বিপর্যয় মানেই প্রাণিজগতের বিপর্যয়, ভয়াবহ দুর্যোগ। তাইতো কবির তীব্র প্রতিবাদ- ‘পাখিদের নীড় কারা ভেঙ্গে দেয়/ আর্থিক অজগর/ উজাড় বনের সবুজাভ প্রেম/ বাতাসের দাপাপি/ যত দ্রুত কমে বৃক্ষ এবং/ বৃক্ষের সমারোহ/ ধসে দ্রুত তত হৃদয়ের রং/ জীবনের হিমালয়।’ [ক্রমাগত, আবর্তিত তৃণলতা, পৃ.৪৬] উপমা-উৎপ্রেক্ষার অসাধারণ ব্যবহারে কবি যেমন আধুনিকতার শেকড় ছুঁয়েছেন তেমনি জীবন-সবুজের মালা গেঁথে তিনি মানবতাবোধকে ধারণ করেছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সৌকর্যে। তাঁর বেশির ভাগ কবিতায় এমনতরো ছোঁয়া লেগেছে নানা রকম নান্দনিক ঢঙে। ‘অরণ্যের গভীর থেকে নেমে এলো কোকিলের নদী :/ তারপর ভেসে গেল পত্রাবলীর পাহাড়/ ভেসে গেল ডাল-পালার পথঘাট/ ভেসে গেল কুুঁড়ি ও কাঁটার ঘরবাড়ী/ অথবা বৃক্ষের তীরে তীরে ডেকে গেল শিল্পকলার হাওয়া/ বসন্তের ছায়া বুঝি মৃত্তিকার গান/ তাছাড়া ঘাসের ঘটনা থেকে রটে যায়/ নিচোলিত হরিতের ঝাঁক/ বসন্তের চোখ বুঝি নীলিমার ঢেউ/ তাছাড়া শুকনো লতার মত উড়ে উড়ে দূরে যায়/ হতাশার চুল।’ [কবিতার ধ্রুব, অনবরত বৃক্ষের গান, পৃ. ১৬]। জীবনের সমস্ত রুক্ষতা, বক্রতা এবং স্বার্থান্ধতাকে পদদলিত করে তাপময় মরুভূমিতে শান্তিময় স্বদেশ গড়তে তিনি নির্মাণ করেছেন এমন সব মানবিক কাব্যকলার আধুনিক পঙক্তিমালা। মানুষ্যপ্রকৃতি কিংবা সবুজমানব তৈরির জন্য শুধু বাংলাদেশ নয়; সারা বিশ্বের রক্তাক্ত জনপদ তাঁর কাব্য-ক্যানভাসের অংশীদার। বিশ্বমানচিত্রের যেখানেই ছোপ ছোপ রক্তের দাগ সেখানেই প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে তাঁর কাব্যপঙক্তি। মিয়ানমারের আরাকানে বুকের তাজা খুনের উপর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পরাধীনতার কলঙ্কিত ইতিহাস। হাজার হাজার মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে নাফ নদের পানি। রোহিঙ্গা মুসলমান জনপদ জুড়ে আগুনের লেলিহান শিখা। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা আজ দেশছাড়া। নারী শিশু বৃদ্ধের অমানবিক জীবন বিশ্বের অসভ্যতার ইতিহাসকে ম্লান করে দিচ্ছে। বিশ্ব মোড়লরা আজ যেন নীরব দর্শক। তাইতো কবি মতিউর রহমান মল্লিকের আক্ষেপ- ‘রোহিঙ্গাদের বুকের উপরে স্বাধীনতা বিরোধীরা/ আরাকানীদের মাথার উপরে গৃধ্নের কালো ছায়া’ (তবু আকাশে চাঁদ: তোমার ভাষায় তীক্ষè ছোরা, পৃ. ২৯)। রোহিঙ্গাদের এ দৃশ্য যেমন আমাদের কষ্ট দেয় তেমনি কসোভো, কাশ্মীর, ইরাক, ফিলিস্তিন ফিরে ফিরে আসে কষ্টের অবর্ণনীয় ইতিহাস নিয়ে। কবিদের হৃদয়ও কেঁদে ওঠে বারবার। কবি মতিউর রহমান মল্লিক তাইতো লিখেন- ‘কসোভোয় নামে সার্বীয় বর্বর/ দাঁতাল শুয়োর/ কাশ্মীরে নড়েচড়ে/ দাঁতাল শুয়োর ঝিলাম নদীতে নামে/ শিরি নগরের অলিতে-গলিতে/ দাঁতাল শুয়োর নামে’ (তবুও আকাশে চাঁদ: তোমার ভাষায় তীক্ষè ছোরা, পৃ. ২৯)। কবি মল্লিক আরো বলেন- ‘কী চমৎকার গেলো’র মতো পেন্টাগনের/ ভূগোলখেকো জঠর থেকে বেরিয়ে আসে ইরাকের কঙ্কাল/ ফিলিস্তিনীদের খুলি এবং হাড়গোড়’ [পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের ভেতরে: চিত্রল প্রজাপতি, পৃ. ২৪]। এমন অসংখ্য মানিবক পঙক্তিমালা ঝুলে আছে তাঁর কাব্যসম্ভার জুড়ে। কবিতা শব্দের খেলা। ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, বিষয়ের গভীরতা এবং ইঙ্গিতময়তাকে কবিতার প্রাণ বলা হয়। অন্যদিকে যুতসই অন্ত্যমিলও কবিতাকে পাঠকপ্রিয়তা দান করে। কবি মতিউর রহমান মল্লিক এসব বিষয়ে অত্যন্ত যত্নশীল ও পরিচ্ছন্ন কবি। ‘জ্বলতে জ্বলতে আরো জ্বলে যেতে চাই’ এমন অসংখ্য অনুপ্রাস, ‘মনের মধ্যে মন পাখির মতন’ কিংবা ‘প্রতিটি পাতাই লালিত সিঁথির নদী/ প্রতিটি পাতাই প্রজাপতি পাল তোলা’ এমন অসাধারণ সব উপমা, ‘তুমি নির্জন, নীরবতা যেন রহস্যঘেরা সুদূরিকা’র মতো অসংখ্য মনোমুগ্ধকর উৎপ্রেক্ষা মল্লিকের কবিতাকে করেছে সমৃদ্ধ। সেইসাথে ‘হৃদয়ে উঠেছে চাঁদের অধিক চাঁদ/ চাঁদের ভেতরে সাম্যের মতবাদ’ এমন অৎস্র রূপকের ব্যবহার, ‘সাত সাগরের ঢেউ থামানোর জন্যে বালুর বাঁধ’ এর মতো অগণিত শ্লেষ এবং অসাধারণ সব চিত্রকল্প মল্লিকের কবিতাকে যেমন আধুনিকতার উচ্চতায় নিয়ে গেছে তেমনি জীবন্ত এবং প্রাণবন্ত করে তুলেছে তাঁর কাব্যময়তা। বহুমাতৃক ছন্দের ব্যবহার কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কাব্যসম্ভারকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। স্বরবৃত্ত ছন্দের পাশাপাশি অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, মাত্রাবৃত্ত ছন্দসহ নানাবিধ ছন্দের পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাঁর কবিতাকে পাঠক হৃদয়ে বিশ্বাসের বীজ বুনতে সহায়তা করেছে। এমনকি অষ্টক ও ষটকে লেখা অক্ষরবৃত্তের অসংখ্য সনেট তাঁকে কবিতার জগতে স্থায়ী আসন গাড়তে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। সত্যিকার অর্থে, আধুনিক বাংলাসাহিত্যে মতিউর রহমান মল্লিক এক স্বতন্ত্র ধারার কবি। আবর্তিত তৃণলতা, অনবরত বৃক্ষের গান, চিত্রল প্রজাপতি, তোমার ভাষায় তীক্ষœ ছোরা, নিষন্ন পাখির নীড়ে’ কাব্যগ্রন্থসমূহে তিনি যেমন নিজেকে মেলে ধরেছেন আধুনিকতা এবং মানবিকতার মায়ার চাদরে তেমনি ছড়াগ্রন্থ ‘রঙিন মেঘের পালকি’তে তিনি উড়িয়েছেন স্বপ্নযাদু। গীতলতাকে ধারণ করে আধুনিক শব্দচয়ন, উপমায় শেকড়ের ডাক, ঐতিহ্যের অনুসন্ধান এবং বিষয়বস্তু নির্বাচনে বিশ্বাস ও মানবতাকে অবলীলায় ঠাঁই দিয়েছেন তাঁর কবিতায়। শিল্পের জন্য শিল্পচর্চা, যৌনতা বা অশ্লীলতা কিংবা নারীদেহের রসালো বর্ণনা ছাড়াই মননশীল কবিতা রচনার মাধ্যমে যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় মতিউর রহমান মল্লিক তা প্রমাণ করে গেছেন। কবিতার প্রতিটি শব্দ-বাক্য উপমা-উৎপ্রেক্ষা আঙ্গিক নির্মাণে তিনি মননশীলতার পথে হেঁটেছেন। তৈরি করেছেন স্বকীয়ঢঙে আধুনিক কাব্যভাষা- যা একজন কবির জন্য অপরিহার্য বিষয়। তাঁর কাব্যভাষার যে আধুনিকতা, শব্দের তৎসমতা ব্যবহাররীতি, নন্দিত শব্দের উৎসারণ সবকিছু তাঁর নিজস্ব ঢঙে। ঐতিহ্যের ব্যবহার ও দেশজ অনুষঙ্গের দ্যোতনা তাঁর কবিতাকে হৃদয়গ্রাহ্য করে তুলেছে। সেইসাথে কবিদের কাজ স্বপ্ন দেখানো। কাজী নজরুল ইসলামও বলেছেন, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’; কবি ফররুখ আহমদ তাই ডাক দিয়েছেন- ‘ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল অবসাদ/ নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দবাদ’। পূর্বসূরিদের এমন আহ্বানে সর্বান্তকরণে জেগে উঠেছিলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। জেগে উঠেছিলেন শুধু লেখনীতে নয়; বাস্তব জীবনের পদে পদে তা বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা সাধনাও করে গেছেন। তাইতো তিনি মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত সকল পাঠকের হৃদয়ের কবি, ভালোবাসার কবি, স্বপ্ন-প্রেরণার কবি। গানের ভুবনেও মানবিক মূল্যবোধ এবং মানবতাবাদের নজির উপস্থাপনে সক্ষম হয়েছেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। মূলত জীবন পরিক্রমার ভাঁজে ভাঁজে আবেগ অনুভূতির স্ফুরণই গান। ফুল-পাখিদের উচ্ছ্বাস, নদীর ছলাৎ ছলাৎ বয়ে চলা এবং প্রকৃতির মনোহর রূপময়তার ছন্দই সঙ্গীতের আবহ। এককথায় সমকালের সমগীতই সঙ্গীত; যা খেয়ালে কিংবা বেখেয়ালে সকল মানুষের হৃদয়বাঁশির সুরের মূর্চ্ছনায় উচ্চকিত হয়। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই এর পথ চলা। পরিবেশ ও পরিপ্রেক্ষিত এর মায়াবী দেহে রঙ-রূপের বৈচিত্র্যময়তা এনে দেয়। ফলে সঙ্গীত হয়ে ওঠে পবিত্রময়তার অপরূপ সৌন্দর্য কিংবা রুচিহীনতার নোংরা ফানুস। শিল্পী ও গীতিকার মতিউর রহমান মল্লিকের গানে সে পবিত্রময়তার অপরূপ সৌন্দর্যই প্রকাশ পেয়েছে; রুচিহীনতার নোংরা ফানুস নয়। কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গানের পরিসংখ্যান এখনো পুরোপুরিভাবে হয়নি। হাজার গানের মধ্যকার মাত্র ১০-২০টি গানের যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করে মল্লিকের গানের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন সম্ভব না হলেও এটাকে প্রতীকী হিসেবে গণ্য করেও বলা যায়- কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গান বহুমাতৃকতায় বিভাজিত। বিশ্বাসী ধারা তথা ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে নির্মিত গানের ভুবনে মতিউর রহমান মল্লিক নিঃসন্দেহে একটি স্বতন্ত্র ধারার স্রষ্টা। কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে আধুনিক ধারার প্রবর্তন করে গেছেন কবি মতিউর রহমান মল্লিকের হাতে তা ফুলে ফলে সুশোভিত ও বিকশিত হয়ে উঠেছে। কবি মতিউর রহমান মল্লিক সম্পাদিত গ্রন্থ ‘সুর শিহরণ’ থেকে শুরু হয়েছে গানগুলো মলাটবদ্ধ হওয়া। তাঁর মাত্র কিছুদিন পর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে শতাব্দী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় মল্লিকের একক গানের বই ‘ঝংকার’। প্রায় অর্ধশতকের বেশি গান নিয়ে বইটি প্রকাশিত হয়। কবি মতিউর রহমান মল্লিকের বড় ভাই কবি মল্লিক আহমদ আলী, ক্বারী রুহুল আমিন এবং কবিবন্ধু মতিয়ার রহমানকে উৎসর্গ করে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গানগুলো সারাদেশের ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠীর খোরাক হিসেবে অতিদ্রুত ছড়িয়ে যায়। আর ঝংকার এক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলের মাদরাসা, স্কুল, কলেজ-এ পড়–য়া ইসলামী ভাবাদর্শে উজ্জীবিত ছাত্র/ছাত্রী কিংবা মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক, মাহফিলের বক্তা ও ওয়ায়েজিন মহোদয়গণ তাঁর এ গ্রন্থকে পুঁজি করেই গান গেয়েছেন। সুরের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে কবির স্বকণ্ঠে গাওয়া একক অ্যালবাম ‘প্রতীতি-১’ এবং ‘প্রতীতি-২’। গ্রামীণ জনপদে রেকর্ড প্লেয়ার কম থাকলেও গানগুলো মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল। বিশেষত ঈদগাহে, ওয়াজ মাহফিলে, মিলাদ মাহফিলে, ইসলামী দিবস পালন অনুষ্ঠানে এমনকি মাদরাসা-মক্তব ও স্কুল কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতায় কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গানগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যে প্রেক্ষিতেই ‘ঝংকার’ এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে এবং ১৯৯৬ সালেই প্রকাশিত হয় তৃতীয় সংস্করণ। এরপর কবির একক গান নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘যত গান গেয়েছি।’ এটি ইসলামী গানের এক বৃহৎ সঙ্কলন। মূলত এ সঙ্কলনটি প্রকাশিত হবার পরপরই মতিউর রহমান মল্লিক একজন সেরা গীতিকার হিসেবে জনন্দিত হয়ে ওঠেন। সেই সাথে ২০১১ সালের মার্চ মাসে বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর গীতিকাব্য ‘প্রাণের ভেতরে প্রাণ’। শিল্পী হামিদুল ইসলামের ঝকঝকে প্রচ্ছদের এ গ্রন্থটির স্বত্ব যথাযথভাবে সাবিনা মল্লিককে দেয়া হয়েছে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও শিল্পী আব্বাস উদ্দীনকে। চার ফর্মার অফসেট কাগজে ছাপা এ বইটির মূল্য রাখা হয়েছে একশত টাকা। এখানেও ঊনপঞ্চাশটি গীতি কবিতা ঠাঁই পেয়েছে যার প্রায় সবগুলোই নতুন গান। কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গানগুলো সর্বমহলে বিশেষত আদর্শিক চেতনাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে সামান্য সময়ের ব্যবধানে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর বিবিধ কারণ ছিল-

প্রথমত, মানুষ স্বভাবগতভাবেই আদর্শিক বিষয়ের প্রতি স্পর্শকাতর। আল্লাহ-রাসূল, ইসলামের সুমহান আদর্শিক কথা সংবলিত বাণীর প্রতি প্রত্যেক বিশ্বাসী মানুষের হৃদয়ের টান থাকে বিশ্বাসের কারণেই। সে কথাগুলো যদি সুরেলা কণ্ঠে, উন্নত ভাষায় ও আকর্ষণীয় ঢঙে পরিবেশন করা হয় তাহলে মানুষের হৃদয় কাড়বে অবলীলায়। কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গান সে কাজটিই করতে সক্ষম হয়েছে। কেননা মল্লিকের গানে আল্লাহর প্রশংসা, রাসূলের প্রশংসা, স্বদেশের কথা, মানবতার কথা, দুনিয়া ও আখিরাতের কথা উঠে এসেছে একেবারে আধুনিক ভাষায়, হৃদয়গ্রাহী সুরে। তাঁর বিশ্বাস অত্যন্ত প্রগাঢ় এবং ইসলামের সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকার কারণে তাঁর কোন গানেই শির্কের মিশ্রণ ঘটেনি। সেইসাথে শব্দ চয়নে কবি মল্লিক ভীষণ সুকৌশলী ছিলেন। যে গানে যেমন ভাষা দরকার সে গানে তেমন ভাষাই ব্যবহার করেছেন তিনি। অত্যন্ত সময়োপযোগী ও সহজ-প্রাঞ্জল ভাব-ভাষা তাঁর গানকে মানুষের কাছে অতিদ্রুত সমাদৃত করেছে।

দ্বিতীয়ত, মতিউর রহমান মল্লিক একজন সফল গীতিকবি। গ্রামীণ জনপদে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পরিণত বয়সে রাজধানী শহরের জীবনযাত্রা তাকে বৈচিত্র্যময় জ্ঞানের অধিকারী করে তুলেছে। তাঁর গানের পরতে পরতে বৈচিত্র্যময় উপমার সমাবেশ ঘটেছে। যে গানে যে ধরনের উপমার প্রয়োজন সে গানে সে ধরনের যুতসই উপমাই তিনি ব্যবহার করেছেন। গ্রামীণ ঐতিহ্য, ফুল-পাখি প্রকৃতি, বৃক্ষের সজীবতা, নদীর কলতান, উদার আকাশ, ঝর্ণার গান, শহুরে জৌসুল-খরা, মানবতার জীবনবোধ, জাহিলিয়াতের রক্তচক্ষু, মুমিনের রহম দিল সবকিছুই তাঁর গানে সাবলীলভাবে এসেছে। সে কারণে মল্লিকের হামদ-নাত, ইসলামী গান ও জীবনমুখী গানগুলো ভীষণভাবে হৃদয়গ্রাহ্য হয়ে উঠেছে। তৃতীয়ত, বিষয়বস্তুর সাথে কালকে ধারণ করা একজন বড় কবির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। বর্তমানের উপযোগিতাকে পুরোপুরিভাবে ধারণ করে তা ভাষা ও উপমার লালিত্যে কালজয়ী করে তোলা একজন প্রতিষ্ঠিত কবির পক্ষেই সম্ভব। কবি মতিউর রহমান মল্লিøক তা সার্থকভাবেই করেছেন। সময়ের সব বড় বড় বাধাগুলো- যা জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে তা ফিরে আসে আবার ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। কবি মল্লিক আঙ্গিকগুলো ভালোভাবে রপ্ত করে সুকৌশলে তা গানে প্রয়োগ করেছেন। যে কারণে তাঁর গান হয়ে উঠেছে কালজয়ী ও হৃদয়গ্রাহী।

চতুর্থত, সুর হচ্ছে গানের প্রাণ। কথার সাথে সুরের সঠিক সমন্বয় হলেই গান হৃদয়গ্রাহী হয়- গানটি হয়ে ওঠে কালজয়ী। মতিউর রহমান মল্লিক নিজে যেমন লিরিক লিখেছেন তেমনি সুরও করেছেন অধিকাংশ গানে। এছাড়া যেগুলো তিনি সুর করেননি তাঁর একটি বৃহত্তম অংশের গানে সুর দিয়েছেন বিশিষ্ট সুরকার ও শিল্পী মশিউর রহমান। এ ছাড়া অনেক তরুণ প্রবীণ সুরকারগণ তাঁর গান নিয়ে কাজ করেছেন। ফলে তাঁর গানগুলো নানা আঙ্গিকে বৈচিত্র্যময়তার সাথে সাথে মাধুর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

পঞ্চমত, কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কণ্ঠ ছিল অসাধারণ সুরেলা। তিনি নিজে গান লিখতেন, সুর করতেন এবং স্বকণ্ঠে তা ছড়িয়ে দিতেন। হৃদয়ের মাধুরী মিশিয়ে গাওয়া তাঁর দরদভরা কণ্ঠের গান শুনে সমস্ত জনপদের মানুষ স্তব্ধ হয়ে যেতেন, আল্লাহ-রাসূলের প্রেমে গদগদ হয়ে উঠতেন। দুনিয়া ও আখিরাতের এক অসাধারণ সমন্বয়ের আহ্বানে মুমিন হৃদয় আলোড়িত হয়ে ওঠে তাঁর গানে। তাঁর কণ্ঠও ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। এ প্রসঙ্গে তাঁর সংস্কৃতি জীবনের নিকটতম সহযাত্রী অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মানছুর মন্তব্য করেন- ‘যিনি গান লেখেন তিনি নিজে সুর সাধারণত কমই দেন আর নিজ কণ্ঠে তার ধারণ খুব কম দেখা যায়। কবি মল্লিক এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কলম যেমন ছিলো শাণিত ঠিক তেমনি মহান আল্লাহ তাঁকে মধুর একটা কণ্ঠ দিয়েছিলেন। মিডিয়াতে যে ধরনের কণ্ঠ আমরা সবাই সাধারণভাবে শুনে অভ্যস্ত তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কণ্ঠ ছিলো তাঁর। এক ধরনের মায়াময় পরিবেশ তৈরি করতো। শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যেতো তাঁর কণ্ঠ। তিনি নিজে খুব যে বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তা নয় তবে যে কয়টি অ্যালবাম আছে তার ব্যাপক কাটতি সে সত্যতারই প্রমাণ বহন করে।’

ষষ্ঠত, বহু ভাষাবিদ না হলেও বিভিন্ন ভাষার উপর দখল ছিল কবি মতিউর রহমান মল্লিকের। মাতৃভাষা ও কবি পরিবারের প্রিয় ভাষা হিসেবে বাংলার উপর তাঁর যেমন দখল ছিল তেমনি আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষার উপরও ছিল তাঁর আধিপত্য। ইংরেজি ভাষা চর্চাও তিনি পছন্দ করতেন। সে দৃষ্টিতে তাঁর কবিতা ও গানে অন্যান্য ভাষার প্রভাব কম থাকলেও সেসব ভাষার সাহিত্যকে তিনি হজম করে খুব সহজে বাংলা ভাষায় উপস্থাপন করতেন। গান নির্মাণের ক্ষেত্রেও তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদে আগ্রহী ছিলেন। যে কোন দেশের ও ভাষার গান তিনি শুনতে পছন্দ করতেন। যেসব গান তাঁর হৃদয় কাড়তো, সেসব গান তিনি কখনো হুবহু আবার ভাবগতভাবে অনুবাদও করতেন। অনেক উর্দু, আরবি ও ফার্সি গানের অনুবাদ তিনি সফলভাবে করেছেন। ছন্দের হাত ছিল তাঁর ভীষণ দক্ষ। যে কারণে তাঁর প্রতিটি গান যেন এক একটি কবিতা। ছন্দ, মাত্রা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও বিষয়বস্তুর অসাধারণ সমন্বয়ে গানগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

সপ্তমত, মতিউর রহমান মল্লিক তাঁর গানের একটি বৃহত্তম বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষ করে নিজের কণ্ঠে তিনি সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গান শুনিয়েছেন। সেইসাথে সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠীর মতো অসংখ্য শিল্পীগোষ্ঠী তিনি সারাদেশে তৈরি করেছিলেন যারা তাঁর গানগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে সারাদেশে। এছাড়াও বিভিন্ন অডিও-ভিজুয়্যাল ক্যাসেট, সিডি-ভিসিডি তাঁর গানকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। যে কারণে দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় মাহফিলসহ প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিযোগিতাসমূহে অদ্যাবধি কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গান সবচেয়ে বেশি গাওয়া হয়ে থাকে।

পরিশেষে বলা যায়, আমাদের দেশে প্রচলিত হামদ-নাত ও ইসলামী গান মানেই ভক্তিমূলক গানকেই বুঝানো হতো। জাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোতেও এ ধরনের গানকে ভক্তিমূলক গান হিসেবে প্রচার করা হয়ে থাকে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতার স্বাদ ছড়ালেও কবি মতিউর রহমান মল্লিক এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের ক্ষেত্রে অনেকাংশে সফল হয়েছেন। ইসলামের পরিপূর্ণ উপস্থাপনা ও শিক্ষাকে তিনি গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তিনি কখনো মানবতার দুর্গতি থেকে উত্তরণের জন্য, সামাজিক সম্প্রতি ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠার জন্য, মানবিকতার বিকাশের জন্য, নৈতিকতা গঠনের জন্য; সর্বোপরি দীন প্রতিষ্ঠার ফরজিয়াতকে তিনি গানের মাধ্যমে উপস্থাপিত করে মুমিন হৃদয়ে সর্বোচ্চ ও স্থায়ী আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী আকরাম ওজায়ের বলেন- ‘ব্যক্তি নজরুলকে আমি তেমন জানি না। কিন্তু আমি ব্যক্তি মল্লিককে জানি। তাঁর গানে বা কবিতায় যে বিষয়গুলো আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে তা হচ্ছে মানুষের জীবনোদ্দেশ্য, মানুষের কর্ম, আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, পৃথিবীতে আল্লাহর সৃষ্টির সৌন্দর্যের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর গানে ও কবিতায় এবং ইসলামী আন্দোলন আর ইসলামী আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর যে চিত্র তিনি আঁকতেন তাঁর কবিতা বা গানে যা শুধু মানুষকে উৎসাহিতই করতো না, মানুষকে পাগল করে তুলতো। হৃদয়ে তুলতো ঝড়।’ কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গানে যেমন আলিম-উলামা শ্রেণি মেতে উঠেছেন তেমনি তাঁর গানকে উল্লসিত হৃদয়ে কণ্ঠে ধারণ করেছেন বিশ্বাসী ঘরানার সাধারণ ছাত্র/ছাত্রীরা। এমনকি কৃষক-শ্রমিকসহ সাধারণ জনতাও তাঁর গানে মুগ্ধ হয়েছেন এ কথাও বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তো কবি হারুন ইবনে শাহাদত তাঁর কবিতার একটি পঙক্তিতে উল্লেখ করেন- ‘তোমার গানে জেগেছে কৃষক, জেগেছে শ্রমিক, জেগেছে ছাত্র জনতা।’ কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গান-কবিতা ও প্রবন্ধেও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথা উঠে এসেছে মমতার আদরে মেখে। গড়তে গড়তে একদিন সে গান আলোকিত করবে গোটা সমাজ, সারাদেশ এমনকি সারা পৃথিবী- এ প্রত্যাশা কোন উচ্চাভিলাষ নয়, বাস্তবতার নিরিখেই এ কথা বলা যায়। তাইতো তার অনুপস্থিতিতে আমাদেরকেই ধরতে হবে সাংস্কৃতিক পরিশুদ্ধতার হাল। কবির ভাষায়- ‘এখানে এখনও জাহেলী তমুদ্দন/ শিকড় গাড়ার প্রয়াসে যে তৎপর/ সজাগ সান্ত্রী প্রস্তুতি নাও নাও/ প্রতিটি শিকড় উপড়াতে পরপর।’

লেখক: কবি ও গবেষক; প্রফেসর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির