তিনি সত্যিকারার্থেই একজন সংস্কৃতিজন, কাব্য-সংগীতের নির্মাণপ্রেমী। সংগীত ভালোবাসেন। ছোটোবেলা থেকেই তাঁর সংগীতের প্রতি ঝোঁক। পাড়ায়-মহল্লায় বিভিন্ন জায়গায় শিল্পী হিসেবে তাঁর ডাক পড়ত। প্রথম যৌবনেই হন সঙ্গীতের প্রেমে অধিকতর মগ্ন। নিজের আদর্শ-ভাবনা ও কর্মগুলোকে, নিজের কথাগুলোকে সঙ্গীতের আদলে সাজাতে শুরু করেন। ১৯৭৭-৭৮ এর দিকে তিনি তখন অনুকরণে (প্যারোডি সুরে) গেয়ে হলেও নিজের বাণীকে প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। বলছি মতিউর রহমান মল্লিকের কথা। বাংলাদেশের সংগীতে একটি বিশেষ ‘জনরা’য় (এবহৎব) ইসলামী গানের যে নৈর্বাদ্যিক যাত্রা, সেটি বলা যায় মল্লিকের হাত ধরেই।
গান লেখালেখিতে তাঁর অবদান বিস্ময়কর। গীতিকার হয়ে ওঠার পাশাপাশি নিজের গানে সুর দেওয়ার বিকল্প কাউকে খোঁজার চেয়ে নিজের প্রতিভাকে ঘঁষে ঘঁষেই সুর করতে লেগে গেলেন মল্লিক। হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি সুরকার। তাঁর সমসাময়িক সতীর্থদের মধ্যে শিল্পী ও সুরকার রাশিদুল হাসান তপন এবং অনুজ শিল্পী-সুরকারদের মধ্যে তারিক মুনাওয়ার, গোলাম মাওলা, আবুল হোসাইন মাহমুদ, মানজুর মোয়াজ্জাম, কামরুল ইসলাম হুমায়ূন, শিল্পী মশিউর রহমান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য; যাঁরা তাঁর একাধিক গানে সুর করেছেন। মূলত তিনি নিজের গানে নিজেই সুর করেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আর যেহেতু স্বভাবগতভাবেই তিনি সঙ্গীত অনুরাগী, শিল্পী; তাই সহজাত আনন্দেই লিখতেন এবং গাইতেন। আর শুনতেন বহুমাত্রিক গান; যেমন- রবীন্দ্র, নজরুল, দ্বিজেন্দ্র এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন গীতিকারের গান।
খোলাখুলিভাবে না গাইলেও প্রকৃত রুচিশীল গান পছন্দ করতেন তিনি। ফলে সংগীতের শাস্ত্রীয় জ্ঞান এবং এর প্রয়োজনীয়তা, এর সাথে লেগে থেকে সংগীতে কঠিন সাধনার বিষয়টি উপলব্ধি করতেন। তবে তিনি তাঁর নিজের জীবনে সে চর্চা করার সুযোগ পাননি কিংবা মিউজিকের হালাল-হারাম বিতর্ক এড়িয়ে নীরবে এ কাজকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। সুরসিক, কষ্টসহিষ্ণু, পরম ধৈর্যশীল, উদার ও নিঃস্বার্থ মানুষ হিসেবে মল্লিক ছিলেন সত্যিই এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। সহজেই মিশে যেতে পারতেন। আপন করে নিতেন বিভিন্ন বয়সী মানুষকে তাঁর আকর্ষণীয়, অহিংস ও সরল আচরণের মাধ্যমে।
চোখের সামনেই দেখতে দেখতে লিজেন্ড হয়ে উঠলেন মতিউর রহমান মল্লিক। একাধারে তিনি কবি, গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, সাংবাদিক ও সংগঠক। মানবিক সংবেদনশীলতায় এক অতি নিবিষ্ট বিশ্বাসীজন। তাঁর বিশ্বাসের অঙ্গনে পছন্দের সংঘ বা দলীয় প্রয়োজনে তিনি সংগীত, তথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের যাবতীয় দায়িত্বে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। কঠিন সাংগঠনিক দায়-দায়িত্বের বোঝা টেনে গেছেন দীর্ঘকাল। বলা চলে আমৃত্যু। প্রচারবিমুখ, অসুখ-বিসুখে ভাবনাহীন নির্লোভ এ মানুষটি শিকার হয়েছেন নানামুখী অযত্ন ও অবহেলার। বঞ্চিত মল্লিক ২০১০ সালে মাত্র ৫৬ বছর বয়সেই দুটি কিডনি হারিয়ে ধুকে ধুকে সকলের চোখের সামনেই মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন পরপারে। বাংলা সংগীত জগতে বাদ্যযন্ত্রহীন, কন্ঠ-নির্ভর, প্রধানত কোরাস পরিবেশনায় সংগীতের যে ধারা তিনি জনপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন, সেজন্যই অধিক সমাদৃত ও স্মরণযোগ্য তিনি।
১৯৭৮ সাল থেকে আমৃত্যু গান-কবিতা রচনায় অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে গেছেন মতিউর রহমান মল্লিক। তাঁর রয়েছে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থসমূহ এবং শত শত গান ও অন্যান্য রচনাসামগ্রী। ছাপ্পান্ন বছরের আয়ুতে প্রায় উন্মাদের মতোই চষে বেড়িয়েছেন সারা বাংলাদেশ। কেবল গানের জন্যেই তিনি বিলেত, ভারতসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। শিশু-কিশোর-তরুণদের যেখানে যার মধ্যে সৃষ্টিশীল প্রতিভার একটিও স্ফুলিঙ্গ দেখেছেন; তাকেই উদ্বুদ্ধ করেছেন গান-কবিতা রচনা করতে, সুরারোপ করতে কিংবা শিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন করতে।
কৈশোর উত্তীর্ণ মল্লিক নিজ শহর বাগেরহাট মুসলিম মিল্লাতের প্রয়োজনে গান লিখতে শুরু করেছিলেন। ততদিনে তিনি বেশকিছু গান লিখে ফেলেছেন। ১৯৭৮ সালের রাজধানী ঢাকায় আসার পর থেকে শুরু করলেন গঞ্জে, শহরে, বন্দরে, গাঁও-গেরামে সংগীত সংগঠন বা শিল্পীগোষ্ঠী দাঁড় করানোর অভিযান। প্রথমত বিভাগীয় ও পরবর্তীতে জেলা শহরগুলোতে স্থানীয় শিল্পীদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ছোটো বড়ো বহু শিল্পীগোষ্ঠী। তাঁর উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় সুসংগঠিত, সংঘবদ্ধ দলগুলো তাদের সক্রিয় প্রচেষ্টায় আজও অকাতরে গান তৈরি করে চলেছে। একক ও দলীয় ইসলামী সংগীতের যে অবিরল প্রবাহ, বলতে গেলে আমাদের সঙ্গীতে এখন তা বিশাল এক ভান্ডারে পরিণত হয়েছে।
ইসলামী ভাবধারার পাশাপাশি সুস্থ বিনোদনের লক্ষ্যে এসব সংগীতের বহুসংখ্যক গানই হয়তো কালের পরিক্রমায় টেকসই হবে না, হয়তো অলক্ষেই হারিয়ে যাবে। আবার এ-ও নিঃসন্দেহ যে, ইতোমধ্যেই বাংলা ভাষাভাষী ইসলামপ্রিয় এবং রুচিশীল মানুষের কাছে জনপ্রিয় ও নন্দিত হয়ে উঠেছে, এমন কালজয়ী গানের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।
কবি মতিউর রহমান মল্লিক; অনন্য এক উচ্চমাপের বড়ো মনের মানুষ। কীই-বা এমন বয়স হয়েছিল তাঁর? মাত্র তো ৫৫/৫৬ বছর! জগন্নাথ কলেজে (তৎকালীন) বাংলা অধ্যয়ন করেছেন। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল, সাহিত্য সমালোচক ও কবি মরহুম আব্দুল মান্নান সৈয়দ-এর তিনি ছিলেন প্রিয় ছাত্র, নিজ ছাত্রের প্রতি স্নেহ পরবশ হয়ে যিনি রচনা করেছেন কাব্যগ্রন্থ ‘সকল প্রশংসা তাঁর’।
আত্মপ্রতিষ্ঠা কিংবা নিজের যত্ন নেওয়ার সময় হয়নি মল্লিকের। তাই নিজের অজান্তেই শরীরটাকে নানান রোগে খেয়ে ফেলেছে অনিয়ম আর অবহেলায়। জীবন-মৃত্যুর মালিক মহান আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা অলংঘনীয়। তবু মনে হয়- মল্লিকের আরও বহুবিধ কর্ম সম্পাদনের মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সময়-সুযোগের অভাবে এবং আয়ুর ব্যপ্তিতে তিনি তার আর নাগাল পেলেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিবিষ্ট অনুসারী ও প্রেমিক মতিউর রহমান মল্লিককে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা জান্নাতের সুউচ্চ আসন নসিব করুন, এ আমাদের একান্ত ভালোবাসাময় আকুতি ও নিবিড় প্রার্থনা।
লেখক : বিশিষ্ট গীতিকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
আপনার মন্তব্য লিখুন