post

মনের মিনারে জীবনের সান্নিধ্য

ইয়াসিন মাহমুদ

০৯ অক্টোবর ২০২১

মানুষের মন। সকালে একরকম। বিকালে আরেকরকম। রাতে আবার আরেকরকম। নানান সময় নানান রূপ ধারণ করে থাকে। কখনো আনন্দে আত্মহারা। কখনো দুঃখে ভারাক্রান্ত। ভালো কোনো সংবাদে কখনো আহাøদে আটখানা। আবার হঠাৎ কোন দুঃসংবাদে অস্থির হয়ে ওঠে। সত্যিই মন বড়ই বিচিত্র। সময়ে- অসময়ে রূপ বদলায়। কারণে-অকারণে বদলায়। এ প্রসঙ্গে প্রচলিত একটা প্রবাদও আছে-‘মানুষের মন আকাশের রঙের ন্যায়।’ অর্থাৎ আকাশের রঙের যেমন কোনো স্থায়িত্ব নেই। হঠাৎ কালো মেঘের ঘনঘটা- বজ্রপাত। শিলাবৃষ্টি। মুষলধারে ঝমঝমাঝম বৃষ্টির ধারা। আবার কাঠফাটা রোদে চৌচির জমিন। আবার কখনোবা রোদ-বৃষ্টির উৎসব। আর এই মনের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় বিশাল দেহের মানুষটি। একটু এদিক-সেদিক হবার সুযোগ মেলা ভার।

মানুষের মন দেখেই পড়ে নেয়া যায় তাঁর অবস্থান ও মানসিক অবস্থা। মানুষ যা ভাবে তাই তাঁর অবয়বে ভেসে ওঠে। মানুষ যদি কোনো বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে থাকে সেটাও যেমন বুঝা যায়। ঠিক তেমনি তার মনের ভেতরে উৎফুল্লতার রহস্যও সহসা অনুমান করা যায়। কখনো তাকে নীরব থাকতে দেখা যায়। এই নীরবতা তিনটি কারণে- একটি হলো কোন ভালো কাজ সম্পন্ন করবার পেরেশানি তাড়া করে ফেরে। আরেকটি হলো-কোনো কাজ না করতে পেরে ব্যর্থতার দায়ে নিজেকে লুকানোর পথ খুঁজতে থাকে। তৃতীয়টি হলো- এসব কিছুর সাথে সে নিজে জড়াতে চান না। বরং সে উল্লিখিত কোনো পক্ষেই নিজেকে না জড়িয়ে কেবল নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে ঝামেলামুক্ত জীবনের সন্ধান করতে থাকেন। আসলেই শুধুমাত্র ক্লান্তি অবসাদে মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে না। বরং অলস মস্তিষ্কের মানুষেরাই জেগেও ঘুমিয়ে থাকে। নিশ্চয় যারা কাজের মানুষ। বিপ্লবই যাদের চোখে মুখে; শত ক্লান্তি তাদেরকে ঘুম পাড়াতে পারে না। বরং ঘুমের ভেতরও মাঝে মাঝে কাজ খুঁজে পায়। সেই কাজ সমাধায় জেগে থাকে অহর্নিশ।

দুই. অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। এটি একটি প্রচলিত প্রবাদ। আমরা যদি একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করি তাহলেই আমাদের ব্যক্তিজীবনেও এর প্রভাব দেখতে পাবো। আমরা অনেক সময় বলে থাকি- ‘কাজ নেই তো খৈ ভাজ।’ মানে হলো পরিকল্পিতভাবে কোনো কাজের আঞ্জাম না দিলে যেমনটি হয়। হুটহাট করে একটি কাজ করা। এ ধরনের কাজের ফলাফল খুব বেশি ভালো হয় না। সোজাসাফটা কথা হলো- কর্মহীন মানুষকে অলসতা যেমন ভর করে তেমনি শয়তানও তাঁর সওয়ার হয়। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেছেন- মানুষ এমন এক ঘোড়া, যার পিঠ কখনো খালি থাকে না। মানুষ যখন আল্লাহমুখী হয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে নিজেকে সোপর্দ করে শয়তান তখন তাঁর কাছে ভিড়তে পারে না। বরং পরাজয় বরণ করে। অবশ্যই শয়তান সবসময় সুযোগ খোঁজে; কর্মহীন মানুষের অনুসন্ধানে থাকে। যাকে একা পায়। কর্মহীন পায় তখন শয়তান তার সঙ্গী হয়ে তাকে তার কাজে ব্যবহার করে। তার মিশন বাস্তবায়ন করে।

তিন. মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান- একটা প্রবাদ আছে। আসলেই কথাটার যথার্থতা ও বাস্তব প্রতিফলন আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট। আমরা অনেক কিছুই ভাবি। কল্পনা করি। কখনো বাস্তবে ধরা দেয়। কখনো আমাদের সে স্বপ্ন ব্যর্থও হয়। তবে সবই ব্যর্থ হয় এমনটিও নয়। কারো কারো কল্পনা, মনের অভিপ্রায়- মনোবাসনা পূরণের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই নিয়ে নেন। আমাদের জাতীয় কবি- বিদ্রোহী কবির খুবই ইচ্ছে ছিলো মৃত্যুর পরে তাঁকে যেন মসজিদেরিই পাশে কবর দেয়া হয়। তিনি লিখেছিলেন- মসজিদের-ই পাশে আমার কবর দিও ভাই যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।

আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে গোর আজাব হতে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই।

বাংলা সাহিত্যের আরেক কিংবদন্তি পুরুষ কবি আল মাহমুদ লিখেছেন- ‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ; অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে ভালো মন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’ [স্মৃতির মেঘলা ভোরে] মনের শুদ্ধতা জীবনের সফলতার এক মহা মূলমন্ত্র। একদিকে ইহজগতে সফলতা লাভের সুযোগ। অন্যদিকে সেই মহাদিনে মাবুদের সাক্ষাতের এক অনন্য আয়োজনে নিজেকে সম্পৃক্ততার সৌভাগ্য। খুলুসিয়াতপূর্ণ কথার তাৎপর্য এবং কর্মময় জীবন সফলতার সোপানে পৌঁছে দেয়। সুতরাং মনের ভেতরটা একদম নির্ভেজাল জাহিলিয়াত মুক্ত হওয়া দরকার। তৌহিদেরই রঙে রাঙানো। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও আল মাহমুদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাই আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত।

চার. আমরা মাঝে মাঝে কর্মক্লান্ত হয়ে পড়ি। ফলে নিজেকে গুটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিই। এমনকি মহৎ কাজ, ভালো কাজ, সমাজকল্যাণমূলক কাজ করতে গিয়েও হেনস্তার শিকার হতে হয়। নানান বাধার সম্মুখীন হতে হয়। হয়তো সেই কাজের জন্য আপনাকে স্যালুট করবার কথা ছিলো। প্রশংসা করার কথা। অথচ উল্টোটা ঘটে যায়। লাঞ্ছিত আর অপমানই জুটে যায় কপালে। তারপরও বসে থাকার সুযোগ কোথায়? বাধার বৃন্দাবন মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সাফল্যের পথ যতদূর হোক না কেন সে পথের শেষ মানজিলে পৌঁছে যেতে শত ক্রোশ পথ পাড়ি দিতে হবে সাহসের সাথে।

পাঁচ. জীবনে ঘটে যাওয়া নানা বিরূপ পরিস্থিতির স্মৃতিগুলো আমাদেরকে মাঝে মধ্যে নিষ্ক্রিয় করে তোলে। এই সময়টাতে আমরা অনেকটাই সঙ্গীহীন হয়ে পড়ি। নিজেকে বড্ড বেশি নগণ্য মনে করি। নিজেকে আড়াল করার জন্যই বৈরাগী মনোভাব পোষণ করি। কোন ধরনের ঝঞ্ঝাট ঝামেলায় পুনরায় না জড়াবার প্রতিজ্ঞা করি। কিন্তু ইসলামে বৈরাগ্যবাদিতার কোন স্থান নেই। নবী-রাসূলগণও তো মানুষকে বৈরাগী বানাতে আসেননি। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা: গোটা বস্তুজগৎকে তিনি মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি করেছেন। (সূরা বাকারা : ২৯) সুতরাং শত বেদনাকে বুকে নিয়ে তবুও চলতে হবে। জ¦লতে হবে। জীবন মানেই সুখ-দুঃখের সমষ্টি। সকল কিছু মেনে নিয়েই চলতে শেখাটাই সফলতা। আর সেই সফলতার পথকে চিনিয়ে দিতে কবি মোশাররফ হোসেন খান আমাদেরকে সাহস জুগিয়েছেন এভাবে- রক্ত পাথারে ভেসেছি কত জীবনের কথা ভাবিনি এসেছে ঝড় ঝঞ্ঝা বজ্র বৃষ্টি তবুও আমরা থামিনি।

ছয়. কতই না ঘটনার সাক্ষী হতে হয় আমাদের এই জীবনে তাঁর কোনো ইয়ত্তা নেই। হাসি-আনন্দ; দুঃখ-বেদনা এসব জীবনেরই অংশ। জীবনেরই সমষ্টি। জীবন মানেই সংগ্রাম। নানা ঘটনা কিংবা অঘটন সব মিলেই তো জীবন। জীবন মানেই শুধু আরাম- আয়েশ, ফুলশয্যা- এমনটি মোটেও নয়। সবকিছুকে ছাপিয়ে আপনাকে চলতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। হতাশার সব পর্দাকে ভেদ করে এই জীবনে আলোর বান ডেকে আনতে হবে। এ বিষয়কে সামনে রেখে আমাদেরকে একবুক সাহস জ¦ালিয়ে দিয়েছেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। তিনি লিখেছেন- আশাহত হয়ো নাকো তুমি না হয় হলো মন শুকনো কোনো মরুভূমি। আরো কিছু পথ চলো মরীচিকা মাড়িয়ে দেখবে সাগর আছে দুটি বাহু বাড়িয়ে বিশাল ঢেউয়ের গান হাওয়ার গতি ভেঙে হাসছে কেমন করে জানবে তুমি।

লেখক : কবি ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির