post

মহানবীর (সা) সামাজিক আন্দোলন

০১ ফেব্রুয়ারি ২০১২
মো: আবদুল লতিফ নেজামী যুগে যুগে আল্লাহর মনোনীত ধর্মের মোড় ঘুরানোর অপচেষ্টা চালানো হয়। আদি পিতা হযরত আদম (আ)-এর পর থেকেই ধর্মের মোড় ঘুরানোর এই অপপ্রয়াস চলে আসছে। শয়তানের প্ররোচনায় ধর্মের নীতি-আদর্শ বিকৃতভাবে পরিবেশন করতে দেখা যায় চিন্তার জগতে বিভ্রান্তির বেড়াজাল সৃষ্টির মাধ্যমে। ধর্মের প্রথা-পদ্ধতি এবং তরিকা বিকৃতভাবে পরিবেশিত হতে থাকে। যার সাথে  মহান আল্লাহর মনোনীত ধর্মীয় আদর্শের  কোন প্রকার সামঞ্জস্য ছিলনা।  শয়তানের অনুগত এক শ্রেণীর মানুয় বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি করে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা বিনষ্ট করার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার প্রয়াস চালাতে থাকে।  যুগে যুগে দ্বীনের বিকৃত ধারা প্রবর্তন এবং প্রচার ও বিকাশে যারা স্বচেষ্ট ছিল, তাঁদের স্বরূপ ইতিহাস হয়ে আছে। বিকৃত দ্বীনের অনুসরণ ও অনুকরনকারীদের আচার-আচরণ অনেকটাই টৌততলিক পুরোহিতদের  অনুসৃত প্রথা-পদ্ধতির অনুরুপ হওয়ায় তা ইসলামের পরিপন্থ’ হিসেবে গণ্য হয়। কারণ এসব  বাতিল তরিকার মতামত প্রবৃত্তি প্রসূত, সত্য বিচ্যুৎ। ইসলামের বিরুদ্ধবাদীরা তাদের প্রবর্তিত বিকৃত দ্বীনের মাধ্যমে তৎকালীন লোকদেরকে মূর্তী পূজারী ও প্রকৃতি পূজারী হিসেবে গড়ে তোলার অপপ্রয়াস চালায়। মূর্তীর মানত করা, সেজদা করা, প্রতিকৃতিতে মাল্যদান প্রথা চালু হয়। অথচ যে কোন মানুষ আবগত আছেন যে, মূর্তীর নিকট কিছু চাওয়া, মানত করাসহ মহান আল্লাহ ব্যতিত কারো কাছে মাথা নত করা হারাম। এ সকল হারাম কাজে যারা লিপ্ত, তারা যে ধর্মের বিরুদ্ধ শক্তি, তা বলাই বাহুল্য। এহেন পরিস্থিতিতে লোকদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজন হয় একজন হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর। কারণ সমাজের সব শ্রেণীর লোকের সাথে সম্পৃক্ততা ছিল মহানবীর (সা)-এর। আর কোনো আন্দোলন সাফল্যের দ্বার প্রান্তে উপনীত করার জন্যে সামাজিক সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। কারণ তখন আরব দেশের জনগণ  বিভিন্ন ধারা-উপধারা এবং নানা তাত্ত্বিক ও বিতর্কের সৃষ্টিতে ত্যক্ত-বিরক্ত। এসব ধারা উপধারার প্রতি জনগণের মোহমুক্তি ও অনীহ মনোভাব মহানবীর (সা)-এর ভূমিকার অনিবার্যতা ব্যাপক ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। তৎকালীন আরবে বাতিল ও বিকৃত তরিকার অনুসােিদর দ্বীনের পথে আনতে এবং তৌহিদবাদী চেতনাকে সঞ্জীবিত রাখার জন্যে যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ এসেছেন। হযরত মুহম্মদ (সা) সর্বশেষ রাসূল হিসেবে দুনিয়াতে আগমন করেন ৫৭০ খ্র্রীস্টাব্দে। এর ৫শ বছর আগে হযরত ইসা (আ) নবী হিসেবে এসেছিলেন। এ্কত্ববাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে সর্বশেষ হযরত মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত এক লাখ চব্বিশ হাজার বা দু’লাখ চব্বিশ হাজার পয়গাম্বর দুনিয়াতে আসেন। মহানবীর (সা)-এর আগমনের আগে তৎকালীন আরব দেশ ছিল আইয়্যামে জাহিলিয়্যাত বা অন্ধকার যুগ। তখন আরব দেশে চালু হয়েছিল অগ্নি পূজা, সূর্য পূজা, সূর্যোদয়, দুপূর ও সূর্যাস্তকে ইবাদতের সময় নির্ধারণ, অনৈসলামী পালা-পার্বণ ও আনন্দ উৎসব, মদ্যপান, দ্বীন ইসলামের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন, প্রকৃত ধর্মানুসারিদের নিয়ে ঠাট্রা-বিদ্রপ, মকামে নবুয়তের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন, নববী নামে আতংকবোধ ও কষ্ট অনুভব, ইসলামের রুকনসমূহের অবমাননা ইত্যাদি।  তাছাড়া হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটণা। মারামারি-কাটাকাটি, মেয়ে সন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া ছিল আরব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত। ধর্ম বিরোধী একটি স্রোতধারা সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হয়। যে ধারার লালন ও বিকাশের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে আবুলাহাবদের মতো লোকের অভাব হয়নি। তাছাড়া আধ্যাত্মবাদের প্রতিষ্ঠিত আচার-আচরণ, নিয়ম, রীতি-রেওয়াজ উৎখাত করে ইসলামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের অপতৎপরতা চালানো হয়। ইসলামী জীবনধারার সকল বৈশিষ্ট্য বিলোপের কোশেশ করা হয় এসব বিতর্কিত তরিকা ও ভণ্ডদের কর্মকাণ্ডে। এভাবে পুরোহিতবাদী চেতনা সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হয়। ইসলামের বিধি-বিধান, প্রথা-পদ্ধতি বিনাশ করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। ভক্তিবাদের আবেগ সৃষ্টির চেষ্টার অংশ হিসেবে এসব তরিকার অনুসারিরা ইসলামের বৈশিষ্ট্যকে মিসমার করে ভাববাদের আবেগ সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হয়। আবু লাহাবরা  বাতিল ও ভণ্ড মতবাদসহ বিভিন্ন তৌহিদবাদের সাথে সাংঘর্ষিক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করতো। তারা ভ্রান্ত মতবাদের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় যা তাদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মক্ষেত্রে প্রতিফলিত হচ্ছিল। ইসলাম বিরোধী নানা উদ্ভট চিন্তা-চেতনার আবর্তে তাড়িত এবং প্রবৃত্তির শিকার হয়ে বাতিল তরিকার বিকৃত চিন্তার বিলাসে মত্ত হয় তারা। শয়তানের তাবেদারদের কথা-বার্তা, আলাপ-আলোচনায় ধর্মীয় মূল্যবোধ ও তরিকা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রমাণ উপস্থাপনের প্রয়াস চালানো হয়। তাদের অর্থাৎ কাফেরদের বক্তব্যে ভ্রান্ত বিশ্বাস, চেতনা ও উপলব্ধি প্রতিবিম্বিত হয়। কাফেরদের একটি বিশেষ দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে তা হচ্ছে বাতিল তরিকা এবং একত্ববাদের পরিবর্তে মহান আল্লাহর সাথে শিরক করার প্রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠা। কাফেররা  তৌহিদ সম্পর্কে  বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। হযরত ইসা (আ) এর পর ধর্মের নামে নতুন নতুন প্রথা-পদ্ধতির উত্থান হতে থাকে। সমগ্র বিশ্ব শযতানের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজেদের শিক্ষা-সংস্কৃতি-স্বাতন্ত্র্য বিস্মৃত হয়। অপশক্তি আল্লাহর মনোনীত ধর্মের বিরুদ্ধেনানাভাবে প্রতিকূল আচরণ করতে থাকে। মানুষদের মধ্যে বিভাজন নীতি অবলম্বন করে প্রকৃত ধর্মানুসারিদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। এসব ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ইসলামী চিন্তার জগতে বিভ্রান্তির বেড়াজাল সৃষ্টির লক্ষ্যে নানা বাতিল তরিকা ও ফেরকা সৃষ্টি করে নব প্রজন্মকে ইসলামের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। এবং জনগণের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যসাদ লাগিয়ে রাখে। তখন আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকজন সামাজিক ধ্যান-ধারণা উপেক্ষা করার লড়াইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ-সংঘাত বহাল রেখে তাদেরকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার সূক্ষè কৌশল অবলম্বন করা হয়। সমাজ বিরোধী শক্তি বিভেদ সৃস্টি করে হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার ষড়যন্ত্র করে। সামাজিক বিবাদ-বিসম্বাদকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্কের অবসানে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ায় এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির অন্তর্নিহিত কারণ উপলব্ধি এবং এই সমস্যার সমাধান করার লক্ষ্যে মহানবী (সা) ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তিনি ভাবাবেগের বশবর্তী হয়ে নয় বরং সমস্যার সামগ্রিক ব্যাপকতা সম্যকভাবে উপলব্ধি করে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা চালাতেন। মহানবী (সা)-এর প্রতিবাদ পক্ষে বা বিপক্ষে ছিলনা। এই প্রতিবাদের সাথে নিজের সামান্যতম লাভ ছিলনা। এতে কোন স্বার্থ ও নিহিত ছিলনা। এই প্রতিবাদের সাথে মহানবীর(সা)-এর নেতৃত্বে যাদের সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়, তাও ন্যায়ের কারণেই। বলা যায় এ প্রতিবাদ একান্তই সামাজিক মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে। যখন আরব সমাজ নানা সংকটের মধ্যে নিক্ষিপ্ত। দেশ-জাতি ও জনগণের সামাজিক মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের চেতনাকে ধ্বংস করার জন্যে হেন অপপ্রয়াস নেই, যা করা হয়নি। পৌত্তলিকতার অশুভ থাবায় আরব দেশ আক্রান্ত। নানা উদ্ভট চিন্তা-চেতনার আবর্তে তাড়িত মানুষ নামধারী এক শ্রেণীর লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্যায়-অত্যাচারে ক্রিয়াশীল। সর্বশক্তিমান আলাহ সম্পর্কে শিরকমূলক বক্তব্য এবং বেহায়াপনা অনুশীলনের নগ্ন মহোৎসব। ধর্মীয় আদর্শে বিভ্রান্তির বেড়াজাল সৃষ্টি করে আবেগ তাড়িত লোকদের মাধ্যমে যখন মানুষের চেতনাকে ধ্বংস করার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়। গণজাগরণের বিরুদ্ধে চালানো হয় নানা চক্রান্ত। য়খন সমাজে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। সেই  প্রক্রিয়া চলাকালে  হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর আবির্ভাব ঘটে। তৎকালীন সমাজে যে চরম নৈতিক অবক্ষয় ও অশান্তি দেখা দেয় মহানবীর অক্লান্ত প্রচেস্টায় মানুষের  জীবন ব্যবস্থায় আবার ধর্মের প্রয়োগ প্রত্যাশা ক্রমশঃ জোরদার হতে থাকে। ধর্মের দিকে নবপ্রজন্মের আকর্ষণবোধ আবার বাড়তে থাকে। এতে পৌত্তলিকতাবাদী শক্তি প্রমাদ গুনতে শুরু করে, তাদের দীর্ঘ দিনের পৌত্তলিতার লালিত স্বপ্ন ভেস্তে যাবার উপক্রম হওয়ায়। মহানবী (সা) বিতর্কিত ধর্মীয় কর্মকান্ড এবং সামাজিক অনাচার, অত্যাচার ও নির্যাতন প্রতিরোধে নবুয়ত প্রাপ্তির আগেই স্বচেষ্ট হন। সংঘ-সমিতি গঠন করে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার পয়াস চালান।  সকলের কাছে তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত। অভিহিত হয়েছিলেন আলআমীন হিসেবে। তবে মহানবীর (সা) নবুয়ত প্রাপ্তির পর নতুন ধর্মমত নিয়ে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত শুরু হয়। এর কারণ হচ্ছে ইসলামী নীতি-নৈতিকতাহীন পৌত্তলিকতা বনাম ইসলামী নীতি ও আদর্শের অনুসারী হযরত মুহাম্মদ (সা)। হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর সামাজিক আন্দোলন এবং ক্ষুরধার যুক্তির ফলে মূর্তীপুজারীরা সুখ-ঐশ্বর্য্যরে, আরাম-আয়েশের, বিলাস-ভৈববের বিপরীতে জনগণ ইসলামের দিকে ঝুঁকতে থাকে। ইসলামই যে কেবল মানুষের মন-মস্তিস্ক, চিন্তাধারা, আচার-আচরণ এবং জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ করতে পারে এবং সূখ-শান্তি, সমৃদ্ধি ও জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, তা তাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে উঠে মহানবীর প্রচেস্টায়। মহানবী  ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারা  অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে নানা তন্ত্র-মন্ত্রে দিশেহারা মানুষ ইসলামের আদর্শের দিকে হন্যে হয়ে ছুটতে শুরু করে। ইসলামী বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে লোকজন।  তাদের  জীবন ব্যবস্থায় ধর্মের বাস্তব প্রয়োগের প্রত্যাশা ও ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠতে থাকে। ভ্রান্তির ভেড়াজাল ছিন্ন করে ইসলামের আদর্শ মানুষের চিন্তা জগৎকে নাড়া দিতে শুরু করে। ইসলাম বিরোধী অপশক্তির অপপ্রচার স্বত্ত্বেও মহানবীর প্রচেস্টায় নানা তন্ত্র-মন্ত্র, মতবাদ, ইজম শোষীত পীড়িত, দিশেহারা বিপর্যস্ত মানুষ আবার ধর্মীয় আদর্শের দিকে হন্যে হয়ে ছুটতে শুরু করে। কারণ মগানবী (সা) জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, ইসলামই কেবল দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ এবং মূল্যবোধ সৃষ্টি করে। তাছাড়া তিনি জনমনে সর্বশক্তিমান আল্লাহর  প্রভাব সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। আরো বুঝাতে সক্ষম হন যে, ইসলাম ধর্মই তাদের অস্তিত্ব ও রক্ষা কবজ, জাতি সত্তার মূল। ধর্ম মানুষের পৃথক আস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তি। কেননা তখন মূর্তীপূজারিরা ইসলামী আদর্শের মধ্যে বিভ্রান্তির বেড়াজাল সৃষ্টি করে ধর্মের সংস্পর্শ ও প্রভাব থেকে জনগণক সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে কাজ করতে থাকে। এবং ইসলামের অপ্রতিহত প্রভাব থেকে জনগণকে বিছিন্ন করা এবং ইসলামের প্রতি শক্র ভাবাপন্ন করে তোলাই ছিল মূর্তীপূজারিদের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) জনগণের সামনে মূর্তিপূজারিদের কর্মকাণ্ডের অসারতা তুলে ধরতে সক্ষম হন। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে মহানবীর (সা)-এর সামাজিক সম্পৃক্ততা। কারণ তিনি সত্যনিষ্ঠ হিসেবে সমাজে সমাদৃত ছিলেন। বিশ্বস্ত হিসেবে বহুল পরিচিত ছিলেন। সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাস-সমৃদ্ধ একটি নাম হযরত মুহাম্মদ (সা)। সামাজিক আন্দোলনে তাঁর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সামাজিক মূল্যবোধ, শাশ্বত নীতি, আদর্শ ও চেতনা সঞ্জীবিত করা, সকলকে সার্বজনীন একাত্মবোধে উজ্জীবিত করার প্রয়াস চালানো ছিল তাঁর মিশন। এর মাধ্যমে সামাজিক চেতনার বিকাশ ও পুনর্জাগরণ রোধের অপচেষ্টা প্রতিহত তথা মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের চিরন্তনী সংগ্রামের ধারা অব্যাহত রাখার দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন মহানবী (সা)। সামাজিক ন্যায়-নীতি, আদর্শ ও নীতিবোধে নিয়ত নিষ্ঠাবান এবং চিরকাল আপসহীন থাকতে অঙ্গীকারাবদ্ধ মহানবী (সা)  নানা সমস্যা-সংক্ষুদ্ধ আরবে আসেন এক দুর্নীবার আবেগ, প্রত্যয়ী, আকাংখা আর অনলস কর্মের প্রেরণা নিয়ে। তিনি আরব দেশের জনগণের মাঝে বিপুল আবেগ-উদ্দীপনা ও নব জাগরণের উদ্দীপ্ত চেতনা জাগ্রত এবং সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি নব সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। সকল বাধা বিপত্তির জাল ছিন্ন করে জনগণকে  নব চেতনায় উজ্জীবিত করতে সক্ষম হন। মহানবী (সা) শুধু একজন ব্যক্তির নাম নয়, বরং সামাজিক জাগরণের একজন তেজস্বী অগ্রপথিক। তাঁর আবির্ভাব ইতিহাসের পট পরিবর্তনের ধ্র“ব নক্ষত্রের মতোই অভ্রান্ত পথের দিশারী। এর প্রধান কারণ এই যে, তিনি ন্যায়ের প্রেরণা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন এবং ইসলামী আদর্শের আলোকে জীবন চেতনার গতিবান, সবল ও সাহসী প্রকাশ ঘটাবার প্রয়াস পেয়েছেন। মহানবীর (সা) কণ্ঠে ধ্বনীত হয় ইসলাম প্রতিষ্ঠার শ্লোগান, শৃংখল ভাঙ্গা বজ্র-নির্ঘোষ আর অত্যাচার নির্যাতন ও জীবনের দুর্বিসহ লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে সবল ও সাহসী প্রতিবাদ। মহানবী (সা) সবসময় অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মোকাবেলায় সামাজিকভাবে জনগণের ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা চালান। কেননা তিনি মনে করতেন যে কোন  ধরনের দ্বিধা বিভক্তি জনগণের প্রতি বৈরী আচরণকারীদের জিঘাংসার পথকে প্রশস্ত করে। তিনি মনে করতেন জনহণের মধ্যে বিভাজন অনভিপ্রেত। কারণ দুষ্ট লোকদের লক্ষ্য শুধু জনগণের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিঘিœত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। মহানবী (সা) তাঁর শানিত মেধা-মনন, মস্তিস্ক ও ক্ষুরধার যুক্তির মাধ্যমে সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে অবতীর্ণ হন। কেননা তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা, যুক্তির দীপ্তি তাঁর ব্যক্তিত্বকে সব সময় আলোকিত করে রাখতো। তিনি ছিলেন বিরল ব্যক্তিত্ব। তাঁর বক্তব্যের প্রতিটি কথাই ছিল সামাজিক ঐক্যের চেতনা থেকে উৎসারিত। আর এই উৎসারণটি ঘটতো সঠিক সময়ে, দ্বিধাহীন চিত্তে দুরন্ত সাহসিকতায়। জনগণের হৃদয়ে ইসলামের অনুরাগ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর বাগ্মীতা ছিল প্রচণ্ড এবং তাঁর বক্তৃতায়  ছিল প্রাণশক্তি ও এক আবেগময় তরঙ্গ। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে নবুয়তের আগেই সমাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা। মহানবী (সা)-এর কারিশম্যাটিক নেতৃত্বে আরব সমাজকে জেগে উঠতে দেখা যায়। মহানবীর (সা) এমন একদল সাহাবী (সঙ্গী-সাথী) তেরি করেছিলেন, যারা ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস সমৃদ্ধ এক লড়াকু গোষ্ঠীর নাম। তারা ও ছিলেন তৎকালীন আরবে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং বংশগতভাবে গৌরবান্বিত। সে কারণেই  সাহাবায়ে কেরাম  সমাজ ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয় চৈতন্যের প্রতি যে কোনো আক্রমনকে দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করতে সক্সম হতেন। এক্ষেত্রে তাঁদের সামাজিক ভূমিকা চির ভাস্বর। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁদের এ চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সাহাবায়ে কেরাম জাহিলিয়াতের কুহেলিকা ভেদ করে বা¯তবে ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে সমাজ জীবনের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নিয়োজিত হন। ইসলামের নিশান-বরদার মহানবী (সা) এর নেতৃত্বে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। মহানবী (সা) এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যার মেধা-মনন, পাণ্ডিত্য ও স্বøেস্নহ আচরণ সমাজকে আপ্লুত করতো। তাঁর বক্তব্যে মানুষের হৃদয় ছুয়ে যেতো। তিনি লোকদের ব্যাপকভাবে মুগ্ধ করতেন। এতে লোকজন বিমোহিত হতো। ফলে আরব সমাজ  মহানবীর (সা) প্রতি আকর্ষণবোধ করতে থাকে। কারণ তাঁর বক্তব্যে থাকতো সমাজের স্বার্থ চিন্তায় সিক্ত। যার আপসহীন অনিবার্য প্রকাশ তাঁর বক্তব্যকে অবিস্মরণীয়তা দিতো। যার ব্যক্তিত্বে থাকতো উজ্বল ও অনন্য দৃঢ়তা।  তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি খাঁটি সমাজ চিন্তা লালন করতেন, চেতনায় ধারণ করতেন এবং সঠিক সময়ে দ্বিধাহীন চিত্তে তা প্রকাশ করার নজির স্থাপন করতেন । মহানবী (সা) ছিলেন সমাজ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন। তাছাড়া তিনি সঠিক  সিদ্ধান্ত প্রদানের মাধ্যমে জনসাধারণের সামাজিক চেতনাকে সঞ্জীবিত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। সমাজ সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত প্রদানের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন। সমাজ সম্পর্কিত যেকোন সমস্যার উদ্ভব হলে তা সামাধানের জন্যে জনগণ তাঁর শরনাপন্ন হতো। মহানবী (সা) ইবাদত-বন্দেগী, হালাল-হারাম, ব্যবসায়-বাণিজ্য, লেন-দেন, আচার-আচরণ, রাজনীতি-সমাজনীতি, শিক্ষা নীতি, সমর নীতি, সামাজিক সুবিচারের বিধি-বিধান সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতেন। হযরত মুহাম্মদ (সা) নিছক একজন রসুল ছিলেন না। তিনি ছিলেন সামাজিক আন্দোলনের হাতিয়ার। সেই শিক্ষা তাঁর ছিল। তাঁর বিদ্যা, তার জ্ঞান, আর বোধশক্তি ঠিক একজন শ্রেষ্ঠ সমাজপতির মতো ছিল। তিনি মানুষকে, জীবনকে, সমাজ ও দেশকে বদলে দেবার লক্ষ্যে কাজ করতেন। তিনি সমাজের মানুষকে প্রকৃত শিক্ষা দেবার, শিক্ষিত করে তোলার, সামাজিক  মূল্যবোধ নির্মাণের লক্ষ্্েয কাজ করতেন। উপযুক্ত সামাজিক শিক্ষা লাভ করে ঠিক তেমনি বিরাট ও মহান ব্যক্তি হিসেবে তিনি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন। ইসলামের শ্বাশত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের চেতনাকে সঞ্জীবিত করার প্রেরণা যোগানো এবং সকল প্রকার ভয়-ভীতির মুখে ইসলামী আদর্শের পতাকাকে সমুন্নত রাখার নীতি অনুসরন করে যান। মহানবী (সা) স্পষ্টভাবে জনগণের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক-স্বাতন্ত্র্য এবং ঐতিহ্যকে উর্ধ্বে তুলে ধরে জনগণের চেতনায় ও ঐতিহ্যে ইসলামের অবদানকে সামনে আনা এবং ইসলামের বিশ্বাস ও অঙ্গীকারকে জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রকাশ রূপ দেয়ার প্রয়াস চালান। তাছাড়া সকল প্রকার ইসলাম বিরোধী অপতৎপরতা রোধ, মূর্তীপূজারিদের বিরোধীতা এবং সকল নিপীড়িত মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন এবং সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামী চেতনার আগুনকে প্রজ্জলিত করা সম্ভব হয়েছিল তাঁর সামাজিক সম্পৃক্ততার কারণে। লেখক : মহাসচিব, ইসলামী ঐক্যজোট ও নেজামে ইসলাম পার্টি

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির