post

মহানবী (সা)

অধ্যাপক মফিজুর রহমান

০৬ জুন ২০২৪

সূচনা :

সমস্ত তারিফ ও প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্যে যিনি নিখিন জাহানের রব, সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, যার ক্ষমতা সবকিছুর ওপর সর্বদা প্রতিষ্ঠিত। জীবন ও মৃত্যুর বাগডোর তাঁরই হাতে। সালাত ও সালাম সে রাসূলের জন্যে আল্লাহ তায়ালা যাকে বলেছেন: وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ. “আমি তোমার সম্মান ও তোমার আলোচনার দিগন্তকে সীমাহীন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছি।” (সূরা ইনশিরাহ, ৯৪:৪)

এ জীবনে নেই কোনো কালিমা, তা নিদাগ ও নির্মল। রাসূলের জীবনে নেই কোনো ব্যর্থতার গ্লানি। পুরো জীবনটাই যেন সফলতার এক বর্ণিল পিরামিড। জাহেলিয়াতের ঘনঘোর অন্ধকারে তাঁর জন্ম। শরাব, নেশা, ব্যাভিচার, খুনাখুনি ও বর্বতার পরিবেশে বেড়ে ওঠা মুহাম্মদ যেন কয়লার খনিতে এক হীরক খণ্ড। মুহাম্মদের (সা) জীবন কোনো সাধারণ জীবন নয়, তাঁর জীবন বিস্ময়ের মহাবিস্ময়। আমার জ্ঞান বলে, লাখো পয়গম্বরের আলোকিত জীবনের সমষ্টি রাসূলুল্লাহর (সা) নবুয়তি জীবন পিরামিডের এক একটি বর্ণিল পাথর। মাহাকাশের হাজার-কোটি গ্যলাক্সির অন্তহীন রহস্য আমার কাছে মুহাম্মদ (সা)-এর মিরাজ গমনের রহস্যের সামনে নগণ্য ও তুচ্ছ বিষয়। বর্ণমালার জ্ঞান পর্ষন্ত নেই সে নবিয়্যাল উম্মীকে আল্লাহ এমন অতলান্ত জ্ঞান-সমুদ্র বখশিস করলেন, যার সামনে সকল মানব, আম্বিয়া, জিন ও মালাইকাকে যে জ্ঞান ও হেকমত দিয়েছেন তা যেন সপ্তসাগরের জলরাশির সামনে এক সুচাগ্র কাতরা। আশ্চর্য হতে হয় চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত যে মুহাম্মদ কারো নিকট হতে একটি বর্ণ, শব্দ শেখেন নি, কোনো সাহিত্যসভায় বসেন নি, কোনো বিষয়ে কোনো রায় প্রদান করেন নি। আল্লাহ বলেন:

وَمَا  كُنْتَ تَدْرِىْ  مَا الْكِتَابُ وَالْاِيْمَانُ.

“মুহাম্মদ তুমি আদৌ জানতে না কিতাব কী, ঈমান কী?” (সূরা শূরা, ৪২: ৫২)

অহি প্রাপ্ত হয়ে, এমন কোনো বিষয় নেই, জ্ঞানের এমন কোনো অধ্যায় নেই মুহাম্মদ (সা) যে বিষয়ে কথা বলেননি, নির্দেশনা দেননি।

আল্লাহ তাঁর ওপর এমন কালাম নাযিল করলেন আরবি ভাষায়, যে কিতাবের একটি আয়াতের শব্দের গঠন, অলংকার, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এতই অলৌকিক ও মোজেজাত পূর্ণ যে, সমস্ত নবীদের সকল মোজেজাও এর সামনে নির্বাক ও নিথর হয়ে যাবে। সকল মানব, নবীগণ এবং জ্ঞানীগণ ও জিনেরা মিলিত হয়ে কিয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করে এর তুল্য ছোট একটি সূরা বানাতে সমর্থ হবে না। আল্লাহ বলেন:

قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوْا بِمِثْلِ هٰذَا الْقُرْاٰنِ لَا يَأْتُوْنَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيْرًا.

“বলো যদি সব মানুষ ও জিন একত্রে প্রচেষ্টা চালায় কুরআনের মতো একটি সুরা বা দুয়েকটি আয়াত বানাতে, তবে কেয়ামত পর্যন্ত সময়ে একে অপরকে সাহায্য করেও সফল হবে না।” (সূরা বনী ইসরাইল, ১৭:৮৮)

এ কিতাব হাতে তিনি হেরাগুহা হতে সাফার পাথড়ে দাঁড়ালেন। ডানে আবু বকর ও বাঁয়ে আলী, বললেন: “হে মানবম-লী! আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহর রাসূল হয়ে এসেছি। তোমরা আমাকে আল-আমিন বলে জানো। তোমরা ঈমান আনো, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। এর মধ্যেই সব সমস্যার সমাধান রয়েছে।” দাওয়াতের জবাবে রাসূলের আপন চাচা পাথর ছুঁড়ে বলল: তাব্বাল্লাকা ইয়া মুহাম্মদ, আ-লেহাজা দাওয়াতানা? “তোমার ধ্বংস হোক, এ জন্যই কি তুমি আমাদেরকে ডেকেছো?” আল্লাহ জবাব দিয়ে বলেন:

تَبَّتْ يَدَا أَبِيْ لَهَبٍ وَّتَبَّ.

“আবু লাহাবের দুটো হাতই ধ্বংস হয়ে যাক, ধ্বংস হোক সে নিজেও।” (সূরা লাহাব, ১১১:১)

এদিন হতে লাগাতার ১৩টি বছর মুহাম্মাদ (সা) ও অল্পসংখ্যক তাঁর সাথী মুমিন নর-নারীদের ওপর অত্যাচার, জুলুম চলতে থাকে। আবু তালিব সকল জুলুম ও নিপীড়নে মুহাম্মদ (সা)-কে সাহায্য করতে এক পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আর সাথে ছিল রাসূলের দাদা আবদুল মোত্তালিবের সন্তানেরা। আবু তালিব ও নবীপত্নী খাদিজার ইন্তেকালে রাসূল (সা) মুষড়ে পড়লেন। তায়েফের ময়দানে রক্তাক্ত হলেন, এদিকে আবু জাহেলের নেতৃত্বে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে।

وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِيُثْبِتُوْكَ أَوْ يَقْتُلُوْكَ أَوْ يُخْرِجُوْكَ.

“যখন কাফেরগণ তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল যে, তারা তোমাকে বন্দী করবে বা তোমাকে হত্যা করবে কিংবা নির্বাসিত করে দেবে।” (সূরা আনফাল, ৮:৩০)

সে কঠিন সময়ে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে মদীনার আনসারদের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে হিজরতের হুকুম পৌঁছে দেন। এক যুগ ধরে অত্যাচার, জুলুম ও নিপীড়নের বিষাক্ত তীর যাঁকে আহত ও জর্জরিত করেছে। এখন আবু জাহেলের সভাপতিত্বে দারুন নওদওয়ার হত্যার নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে হায়েনার দল সশস্ত্র অবস্থায় রাসূলের গৃহ অবরোধ করে। তিনি আলীকে কাফেরদের গচ্ছিত আমানত বুঝিয়ে দিয়ে মদীনায় চলে আসার নিরর্দেশনা দিয়ে বেরিয়ে পড়েন। রাত ভোর হতে তখনও কিছু সময় বাকি। আবু বকরকে সাথে নিয়ে তার উটের পিঠে চড়ে মদীনার বিপরীত দিকে রওয়ানা করেন কৌশলে। ‘হাসুরা’ নামক স্থানে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা) ঘুরে দাঁড়ালেন কাবা শরীফের দিকে, অঝোরে কাঁদছিলেন। কাবার বিচ্ছেদ যেন সইতে পারছিলেন না। হিজরতের পথে অশ্রুসিক্ত রাসূলকে সান্ত¡না ও মোস্তাদআফীনদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের ওয়াদা নিয়ে জিবরাইল হাজির হলেন:

وَنُرِيْدُ أَنْ نَمُنَّ عَلَى الَّذِيْنَ اسْتُضْعِفُوْا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِيْنَ.

“জমিনে যাদেরকে মজলুম এবং দুর্বল করে রাখা হয়েছে, সে মোস্তাদআফীনদেরকে আমি তাদের রক্তসিক্ত জমিনের ইমাম বানাব আর তাদের হাতে উঠিয়ে দেবো এর মিরাস।” (সূরা কাসাস, ২৮:৫)

প্রিয় পাঠক, মক্কা বিজয়ের সুসংবাদ ও জালেমদের পরাজয়ের দুঃসংবাদ এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। বেশি বিস্তারিতভাবে আমার লেখা “কালের শপথ” বইতে অঙ্কিত হয়েছে।

মক্কা অভিযানের সূচনা :

৬ষ্ঠ হিজরি সনে হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদিত হয়। এ চুক্তির মেয়াদকাল ছিল ১০ বছর। এর ফলে প্রথমবার রাসূলের সাথে কুরাইশদের আক্রমণাত্মক পরিস্থিতির অবসান হলো। ইসলামী দাওয়াত সারা দুনিয়ায় সুযোগ সৃষ্টি হলো পৌঁছে যাওয়ার। চুক্তির একটি ধারা এমন ছিল যে, অন্যান্য গোত্রসমূহ তাদের ইচ্ছেমতো মুহাম্মদের সাথে অথবা কুরাইশদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হতে পারবে এবং তারাও চুক্তিবদ্ধ বলে গণ্য হবে। এ দফার অধীনে মক্কার ‘কোযায়া গোত্র’ রাসূলের সাথে এবং ‘বকর গোত্র’ কুরাইশদের সাথে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু অষ্টম হিজরিতে পূর্বের শত্রুতার জের ধরে কুরাইশদের মিত্র ‘বকর গোত্র’ সশস্ত্র হামলা করলে ‘বনু খোয়ায়া গোত্রে’র অনেকে আহত ও কিছু লোক নিহত হয়। এতে কুরাইশদের গোপন সম্পৃক্ততা ছিল- যা ছিল চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

‘বনু খোযায়া’ তাদের ওপর অন্যায় আক্রমণে আহত ও নিহতদের বিবরণসহ তাদের প্রতিনিধি আমর বিন সালেমকে রাসূলের নিকট মদীনায় পাঠাল। রাসূল ব্যথিত কণ্ঠে বললেন, ‘যাও, আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ তারা রাসূলকে এও জানালেন, ‘আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। তারা নামাজরত অবস্থায় আমাদেরকে আক্রমণ করেছে।’ রাসূল (সা) আবু সুফিয়ানের নিকট দূত পাঠিয়ে কড়াভাবে বলে দিলেন, ‘নিহত বনু খোযায়ার প্রতিজন নিহত ব্যক্তির ‘দিয়াত’ তথা রক্তপণ ১০০ উট দ্রুত মদীনায় পাঠাতে হবে। নতুবা হুদায়বিয়ার চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে।

সন্ধিচুক্তি নবায়নে ব্যর্থ :

কুরাইশ ও তাদের মিত্র ‘বনু বকর’ যা করেছে তা ছিল ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। রাসূলের (সা) দূত ‘বনি খোযায়া’র ওপর অন্যায় আক্রমণে নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ ও দিয়াত পূর্ণ করার দাবি অমান্য করার পরিণতি বুঝতে পেরে কুরাইশদের জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত হলো যে, আবু সুফিয়ান স্বয়ং মদীনায় গিয়ে রাসূলের (সা) সাথে কথা বলে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সন্ধিচুক্তি নবায়ন করে নেবে। নবী (সা) আবু সুফিয়ানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘কুরাইশদের সাথে আর কোনো চুক্তি নাই এবং রইল না।” ব্যর্থ হয়ে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান শূন্য হাতে মক্কায় ফিরে এলো এবং সবাই ঘটনার বিবরণী শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ল। মুহাম্মদের মক্কা অভিযান শুধু সময়ের ব্যাপার। যুদ্ধের দামামা আবার বেজে উঠবে।

মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি :

ইমাম তাবরানীর বর্ণনায় জানা যায়, কুরাইশদের বিশ্বাসঘাতকতার পর রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আয়েশা (রা)-কে যুদ্ধের জন্যে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বলেন ও বিষয়টি গোপন রাখার পরামর্শ দেন। একদিন মসজিদে নববীতে সাহাবীদের বললেন, ‘সবাই মক্কা অভিযানে বের হওয়ার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করো, বিষয়টি গোপন রেখো।’ তিনি দোয়ার হাত তুলে বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাদের অভিযানের খবর শত্রুদের থেকে গোপন রেখো।’

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রণকৌশলী মুহাম্মদ (সা) দশ হাজারের বিশাল বাহিনীকে প্রস্তুত করলেন এতো সংগোপনে যে, কুরাইশ ও তাদের মিত্ররা ছিল বেখবর ও অচেতন। প্রতিটি সৈনিকের হৃদয়ে ছিল শাহাদাতের পিপাসা, ছিল আল্লাহর যিকিরে জিহ্বা সিক্ত, হাতে রয়েছে ধারালো কৃপাণ। রাসূলের নির্দেশ শুনার জন্যে উৎকর্ণ ও মেনে চলছিল কঠোর শৃঙ্খলা, দৃঢ়তা এমন ছিল যেন পাহাড় তাদেরকে পথ ছেড়ে দেবে। এমন বাহিনী কেউ দেখেনি, দেখবে না কোনো দিন। ‘আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট তারাও আল্লাহতে সন্তুষ্ট।’

রাসূলের নেতৃত্বে দশ হাজার সেনাদল মক্কা অভিমুখে :

অষ্টম হিজরির ১০ই রমাদান, সকলেই রোজাদার। দশ হাজার সাহাবী অস্ত্র হাতে ইহরাম ছাড়া যুদ্ধের পোষাক পরিহিত অবস্থায় জমায়েত হলো রাসূলের নির্দেশের অপেক্ষায়। যুদ্ধের পোষাকে অস্ত্র হাতে রাসূল (সা) আসলেন। প্রথমে তিনি যুদ্ধ হতে ফিরে আসা পর্যন্ত হযরত আবু বুরহুম গেফারীকে (রা) মদীনার দায়িত্বশীল হিসেবে নিযুক্ত করলেন। আল্লাহর হামদ ও প্রশংসা করে অত্যন্ত আবেগপূর্ণভাবে সূরা ইউসুফ তিলাওয়াত করেন অশ্রুসিক্ত নয়নে। দশ হাজার বিপ্লবী সাথী সকলে ফুঁফিয়ে ক্রন্দন করল ও বলল: ‘হে আল্লাহর রাসূল স! আপনি সূরা ইউসুফ কেন তেলাওয়াত করলেন? কেন এতো কাঁদলেন ও কাঁদালেন? আপনি চাচ্ছেন ইউসুফ (আ) তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী ভাইদেরকে যেভাবে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন আমরাও যেন অত্যাচারী মক্কাবাসীকে ক্ষমা করে দেই। হে আল্লাহর রাসূল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন, আমরা আপনি যে নির্দেশ দেবেন তা-ই শুধু পালন করব, এক চুলও বাড়াবাড়ি করব না।’ অতঃপর নবী (সা) ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় ৮জন পুরুষ ও ৬জন মহিলার নাম ধরে বলেন, এদেরকে কাবার গেলাফ জড়ানো অবস্থায় পাওয়া গেলেও ক্ষমা নেই, হত্যা করা হবে। বাকিদেরকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় রাখা হলো, যারাই অস্ত্রহাতে তোমাদেরকে বাধা দিতে আসবে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।’ মাত্র আট বছর পূর্বে যে মুহাম্মদ (সা) নিঃসঙ্গ অবস্থায় জন্মভূমি মক্কা হতে রাতের শেষে বাধ্য হয়ে হিযরতের পথে বের হয়েছিলেন; আজ সে মক্কা বিজয়ের লক্ষ্যে দশ হাজার ‘আশিদ্দাউ আলাল কুফ্ফার’ উলঙ্গ তারবারি বেষ্টিত হয়ে চলছে দৃঢ় কদমে। কার সাধ্য এ বাহিনীর সামনে দাঁড়ায়, যার সেনাপতি সাইয়্যিদুল কাওনাইন।

মাররুয যাহরানে তাঁবু স্থাপন :

রাতের প্রথম প্রহরে বিশাল সেনা কাফেলা ‘মাররুয যাহরানে’র প্রান্তরে এসে পৌঁছাল। সেনপাতির নির্দেশ, প্রত্যেকে পৃথক পৃথক চুলায় খাদ্য পাকাবে- দশ হাজার চুলার আগুন যেন ভয়াল এক দৃশ্য সৃষ্টি করেছিল। ১৬ কি.মি. দূরে মক্কার পাহাড়কে পর্যন্ত আলোকিত করছিল। মক্কাবাসীর হৃদয় আসন্ন বিপদাশঙ্কায় থরথর করছিল। এ দিকে দিশেহারা আবু সুফিয়ান হাকিম বিন হেযাম ও বোদায়েল ইবনে ওয়াকাকে সাথে নিয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্যে বের হয়েছে। দৃশ্য দেখে আবু সুফিয়ান সাথীদের বলছিল, ‘আমি আজকের মতো আগুন এবং এমন সেনাদের জীবনে দেখিনি।’ হযরত আব্বাস (রা) রাসূলের খচ্চরে দুলদুলে আরোহণ করে টহল দিচ্ছিলেন। অন্ধকারে আবু সুফিয়ানের কণ্ঠস্বর শুনে বলল, ‘আবু হানযালা, তুমি কোথা হতে এসেছো?’ আবু সুুফিয়ান জানতে চাইল, ‘একি ব্যাপার? হযরত আব্বাস (রা) বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) হাজার হাজার সৈন্য বাহিনী নিয়ে মক্কার সীমান্তে; আগামীকাল মক্কায় প্রবেশ করবেন। সে বলে উঠল, ‘হায়! মক্কাবাসী কুরাইশদের কী হবে?” হযরত আব্বাস (রা) বললেন, ‘মুসলমানেরা এখনই তোমার গর্দান উড়িয়ে দেবে, তুমি হত্যার লিস্টে প্রথম। আমার খচ্চরের ওপর বসো, তোমাকে রাসূলের নিকট নিয়ে যাব। সাবধান! ঈমান আনা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।’ নবীজির চাচা বলল, ‘মুহাম্মদ, আবু সুফিয়ানকে আমি নিরাপত্ত দিয়েছি। তুমি তাকে ঈমান আনার সুযোগ দাও ও নিরাপত্তা দাও।’ রাসূল (সা) বললেন, ‘তাকে আমার নিকট হতে নিয়ে যাও, তোমার সাথে রাখো, সকালে নিয়ে এসো।’ সকালে আবু সুফিয়ানকে লক্ষ্য করে নবী (সা) কঠোরভাবে বললেন, ‘আবু সুফিয়ান, আফসোস তোমার জন্য, কী করো নাই তুমি? এখনো বোঝার সময় হয়নি- ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, আমি আল্লাহর রাসূল।’ সে বলল, ‘আমার পিতামাতা আপনার জন্যে কুরবান হোক, আপনি মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানব ও রাসূল। আপনার সাথে অসভ্য আচরণের জন্যে আমাকে ক্ষমা করুন। অনুতপ্ত হৃদয়ে কালিমায়ে শাহাদাত ঘোষণা করে ইসলামে দাখিল হলো। চাচা বললেন, ‘এখন সে মক্কায় গিয়ে কী করবে? নবী (সা) বললেন, ‘যাও, সেনাবাহিনী মক্কায় প্রবেশের আগে গলিতে গলিতে ঘোষণা দাও, ‘মুহাম্মদের বাহিনীর মোকাবেলা করা তোমাদের জন্যে অসম্ভব; যে ব্যক্তি নিজের বাড়ির দরজা বন্ধ রাখবে সে নিরাপদ, যে কাবাঘরে আশ্রয় নেবে সেও নিরাপদ। আরো বলো, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়িতে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপত্তা লাভ করবে।’ এভাবে রাসূল (সা) আবু সুফিয়ানের মাধ্যমে প্রতিরোধের সকল আয়োজন কৌশলে প্রতিহত করে দেন ও হত্যার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন। যে আবু সুফিয়ান হত্যার লিস্টে প্রথম ছিল, সে পরিণত হলো রাসূলের বিশাল বাহিনীর অগ্রদূত। নবীর রণকৌশল দেখে ঐতিহাসিকগণ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েন।

মুসলিম বাহিনী মক্কার দ্বারপ্রান্তে ‘যীতুয়ায়’ :

মক্কা এখন হতে মাত্র সাত/আট মাইল দূরত্ব। এখানে সেনাপতি মুহাম্মদ (সা) সবাইকে ২০শে রামাদানের রোজা ভেঙে ফেলার হুকুম দেন: ‘যুদ্ধ সামনে তোমরা রোজা ভেঙে ফেলো’ (তাবরানী)। নবী (সা) কসওয়ার পৃষ্ঠে সবার সামনে রোজা ভেঙে ফেললেন। দশ হাজার সাহাবী যুদ্ধের সামনে রাসূলের নির্দেশে রোজা ভাঙলেন। মক্কার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে সাহাবীদের বিশাল বাহিনী দেখে রাসূল (সা) অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর প্রভুর দয়ার কথা স্মরণ করে মথা নিচু করে রাখেন, তাঁর দাড়ি মোবারক উটের পালানের সাথে লেগে যাচ্ছিল। এখানে তিনি সেনাদলকে বিন্যাস করেন: ডানে কঠিন পথে সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা সে পথ খালিদকে নির্ধারণ করে সাবধান থাকতে বলেন। বাধা আসলে কঠিনভাবে তরবারির জবাব দেবে নতুবা কারো বদ্ধ দরজায় আঘাত না করার নির্দেশ দেন।

বামে রাখেন যুবায়ের ইবনে আওয়ামের বাহিনী। আর পদব্রজে যারা এসেছিলেন তাদের সেনাপতি করলেন, আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাকে। সবাইকে সাফা ফাহাড়ের পাদদেশে তার বাহিনীর সাথে মিলিত হওয়ার জন্যে বলে দেন। সবাইকে সাবধান করে বলেন, ‘কারো বদ্ধ দরজায় হানা দেওয়া যাবে না, প্রতিরোধ করতে না এলে এক ফোঁটা রক্ত প্রবাহিত করা যাবে না।’ বিশ্বনবীর নির্দেশ মোতাবেক সেনাপতিগণ নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে নির্দিষ্ট পথ ধরে কঠোর সতর্কতা ও দৃঢ়তার সাথে হাতিয়ার উন্মুক্ত করে আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে এগিয়ে চলল সাফা পাহাড়ের দিকে। শত্রুগণ গৃহের দরজা বন্ধ করে কাঁপছিল থরথর করে। কোনো প্রতিরোধ হয়নি শুধু খালেদের বাহিনীকে বাধা দিয়েছিল। তার হাতে ১২ জন খুন হলে শত্রুগণ পালিয়ে যায়। সকলে এসে ‘বাবুল ফাতাহ’-এর পাদদেশে জমায়েত হলো। গায়ে যুদ্ধের জামা, হাতে কৃপাণ, মাথায় লালচে রঙের পাগড়ি, চারিপাশে দশ হাজার সশস্ত্র মুজাহিদ বেষ্টিত কসওয়ায় উপবিষ্ট মুহাম্মদ (সা) ঘোষণা দিলেন, ‘আজ আমি প্রতিশোধ নেব না, ইউসুফ (আ) তাঁর ভাইদের যেভাবে ক্ষমা করেছিলেন, আমিও তোমাদের আজ সেভাবে ক্ষমা করে দিলাম, হে মক্কাবাসী!’

১৮ জন মানবতাবিরোধী চরম অপরাধীর ক্ষমা নেই :

যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বেয়াদবির সকল সীমালঙ্ঘন করেছে, মুমিনদেরকে বিনা অপরাধে হত্যা করেছে, অত্যাচার ও জুলুমের মূল হুকুমদাতা ক্ষমতার দাপটে বলেছিল, মুহাম্মদের কোনো মানবাধিকার নেই; নবী (সা) তাদেরকে আল্লাহর কাবায় থাকলেও মৃত্যুদ- কার্যকর করতে বলেছেন। এদের নাম ও শাস্তির বিবরণ আলোচনা এ প্রবন্ধে সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে প্রয়োজনে সীরাতের কিতাব ঘেঁটে দেখা যেতে পারে। এদের মধ্যে একজন বনু তামিম গোত্রের আবদুল্লাহ্ ইবনে খাতাল। সে কাবার গেলাফ জড়িয়ে ছিল। রাসূল (সা)-কে তার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘তাকে সে অবস্থায় জাহান্নামে পাঠিয়ে দাও।’  যার খুনে কাবার ভিটা রক্তাক্ত হয়েছিল। ইবনে খাতাল মোরতাদ হয়ে তার দুই দাসীসহ রাসূলের বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক গান গাইত। এদের সবাইকে এ দিনে হত্যা করা হয়েছিল। বিশেষ হেকমতের কারণে আবু সুফিয়ান, আকরামা বিন আবু জাহেলসহ কয়েকজনকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্যে সাহাবীদের কেউ কেউ অনুরোধ করলে নবী (সা) অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাফ করে দিয়েছিলেন।

প্রবন্ধ যখন লিখছি তখন বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার এক গণবিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। দীর্ঘ ১৬ বছর যারা দেশটাকে এক জাহান্নাম বানিয়ে রেখেছিল যেখানে হাজারো নিরাপরাধ আলেম, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত লোক, খুন, গুম ও আয়নাঘরে হাতে-পায়ে বেড়ি, চোখ বাঁধা অবস্থায় ৮/১০ বছর পর্যন্ত লাগাতার লোমহর্ষক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ও নিখোঁজ হয়েছে। এ খুনি হাসিনা সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থা দলীয়করণের এক নিকৃষ্ট অব্যবস্থায় পরিণত করেছিল। ১৪টি ব্যাংক দেউলিয়া, হাজার কোটি ডলার দেশ থেকে পাচার ও উন্নয়নের নামে আওয়ামী ও ছাত্রলীগ গু-া ও পুলিশি হয়রানির এক নৈরাজ্যে পরিণত করেছিল। এদের দুর্নীতি, অত্যাচার, আত্মসাৎ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দালিলিক তথ্য আজ যখন জাতির সামনে, তখন অতি দরদি কিছু বেকুব ও কা-জ্ঞানহীন সুশীল মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল (সা) সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন- এমন বয়ান দিচ্ছেন। তাদের ভুল সংশোধনের জন্যে প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি হলো বলে দুঃখিত।

মসজিদে হারামে প্রবেশ ও মূর্তি অপসারণ :

কাবার দরজায় দাঁড়িয়ে নবী (সা) বলেন, ‘উসমান বিন তালহা কোথায়?’ হযরত আলী তার থেকে কাবার চাবি নিয়ে রাসূলের হাতে দিলে তিনি কাবায় প্রবেশ করেন ও মূর্তি ভাঙার অভিযান শুরু হলো। সবার ওপরে উঁচু ছিল ‘হোবল’-এর মূর্তি। রাসূল (সা) আলীকে কাঁধে তুলে বললেন, ‘ওটিকে নামাও ও ভেঙে ফেলো।’ নবী (সা) বলেন:

- فَإِنَّمَا بُعِثْتُ لِقَصْرَةِ الْأَصْنَامِ.

“আমাকে আল্লাহ মূর্তিকে বিনাশ করতে পাঠিয়েছেন।’ (মুসলিম)

সে সময় কাবার মধ্যে ৩৬০টি মূর্তি রক্ষিত ছিল। রাসূল (সা) নিজ হাতের অস্ত্র দিয়ে মূর্তিদের আঘাত করে বলেছিলেন:

جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوْقًا.

“সত্য সমাগত অসত্য বিতাড়িত; অবশ্য মিথ্যা বিলুপ্ত হবেই।” (সূরা ইসরা, ১৭:৮৯)

কাবাকে ধুয়েমুছে পরিচ্ছন্ন করা হলো অতঃপর সবাইকে বের করে দিয়ে কাবার দরজা বন্ধ করে দেন। রাসূলের সাথে থাকল হযরত বিলাল হাবশী ও ওসমান বিন যায়েদ (রা) দুই কৃতদাস। রইলোনা আবু বকর ও ওমর (রা)। সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিতদের মহানবী (সা) কোন উচ্চতায় আসীন করলেন। আজকের যুগে মানুষ যখন চন্দ্রপৃষ্ঠে বিজয় কেতন উড়াচ্ছে, তখনও পাশ্চাত্য সভ্যতায় সাদা-কালোর বিভাজন ও বর্ণদাঙ্গা হচ্ছে। কাবাঘরে নবীজি সালাত আদায় করে, তাকবির ও হামদ উচ্চারণ করে কৃতজ্ঞতার অশ্রু বিসর্জন করেন।

বিজয় দিবসের খুতবা হতে :

কাবার দরজার দুই পাল্লা ধরে কুরাইশ ও উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে এক আবেগময় ভাষণে তিনি বলেন:

اَللهُ  اَكْبَرُ اَللهُ اَكْبَرُ. - الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِىْ صَدَقَ وَعْدَه وَنَصَرَ عَبْدَهُ.

“আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। তিনি দুর্বলদের সাথে তার ওয়াদা পূর্ণ করেছেন। তিনি একাই তাঁর বান্দাহকে নোস্রত করেছেন, তিনি সকল শত্রুকে পরাভূত করেছেন।” (বুখারী)

قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَلَا كُلِّ مَأَثَرَةٍ   اَوْ دَمٍ اَوْ مَالٍ يُدْعٰى بِهِ فَهُوَ تَحْتَ قَدَمَىَّ  هَاتَيْنِ. اِلَّا سِدٰنَتَ الْبَيْتَ الْبَيْتِ وَسِقَايَةَ الْجَاجَّ.

“কোরাইশগণ, তোমাদের কৌলিন্য, রক্ত ও সম্পদের প্রতিশোধের দাবী আমার দুই পায়ের নিচে। তবে কাবার তত্ত্বাবধান ও হাজীদের পানি পান করানো ব্যতীত।” (মুসলিম)

اَيُّهَا النَّاسُ ! اَلَا اِنَّ رَبَّكُمْ وَاحِدٌ. وَاَلَا كُلُّكُمْ اَبْنَاءُ اٰدَمَ. وَاٰدَمُ مِنْ تُرَابَ.

“হে মানবম-লি, তোমাদের রব এক আল্লাহ, তোমাদের পিতা আদম এবং তোমরা সবাই বনি আদম। আর আদমকে মাটি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে।” (মুসলিম)

وَقَالَ تَعَالٰى: - يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوْبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ.

আল্লাহ বলেন: “হে মানবসকল! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও নারী হতে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারো। আল্লাহ সবকিছু জানেন ও খবর রাখেন।” (সূরা হুজরাত, ৪৯:১৩)

يٰامَعْشَرَ قُرَيْشٍ بِئْسَ الْعَشِيْرَةُ  كُنْتُمْ لِنَبِيِّكُمْ كَذَّبْتُمُوْنِىْ وَصَلَّ قَنِىَ النَّاسُ. وَخَذَ ْتُمُوْنِىْ وَنَصَرَنِىْ النَّاسُ. وَاَخْرَجْتُمُوْنِىْ وَاٰوَانِىَ النَّاسَ.

“হে কুরাইশগণ! তোমরা নিজেদের নবীর জন্যে কতো নিকৃষ্ট গোত্র ছিলে; তোমরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিলে। অথচ মানুষেরা আমার ওপর ঈমান এনেছে; তোমরা আমাকে বঞ্চিত করেছিলে, আর মানুষেরা আমাকে সাহায্য করেছে; তোমরা আমাকে জন্মভূমি হতে বের করে দিয়েছিলে, মানুষেরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে।” (বুখারী)

তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘আজ তোমরা আমার নিকট হতে কীরূপ আচরণ আশা করো?’ লোকেরা বললো, ‘আপনার সাথে ভালো আচরণ করিনি। আপনি মানবকুলের শ্রেষ্ঠ মহামানব। আপনার নিকট ক্ষমা ও দয়ার আচরণ প্রত্যাশা করি।’

নবী (সা) বলেন :

لَا تَثْرِيْبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ.

“আজ তোমাদের ওপর আমার অভিযোগ নেই, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।” (ইউসুফ, ১২:৯২)

وَاَنْتُمُ الطَّلَقَا.

“তোমরা সবাই মুক্ত।”

অতঃপর কাবাঘরের দরজা বন্ধ করেন ও উসমান ইবনে তালহাকে ডাকেন ও কাবার চাবি হাতে দিয়ে বলেন: “কাবার চাবি সব সময়ের জন্যে গ্রহণ করো। জালেম ছাড়া তোমাদের কাছ থেকে কেউ কেড়ে নেবে না। হে ওসমান, আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর ঘরের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেছেন। কাজেই বায়তুল্লাহ থেকে যা কিছু পাবে তা বৈধ পন্থায় খাবে।”

উপসংহার :

এ ঐতিহাসিক বিজয়ে মূর্তিপূজার রাজধানীতে তাওহীদের বিজয় দামামা বাজিয়ে দিলো, তৎকালীন রোমান ও পারস্য সা¤্রাজ্যের মরণের সাইরেন ঘোষণা করে। মানুষের দৃষ্টি খুলে যায়। দলে দলে মানুষ ইসলামে দাখিল হতে শুরু করে।

إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ . وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللهِ أَفْوَاجًا . فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا .

“যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে তখন দেখবে দলে দলে লোক ইসলামে প্রবেশ করছে। হে নবী, তুমি তোমার রবের হাম্দ করো, পবিত্রতা ঘোষণা করো ও ইস্তেগফার করো। অবশ্যই তিনি তাওবা কবুলকারী।” (সূরা নসর, ১১১)

বিজয়ের পরের দিন রাসূলুল্লাহ (সা) সাফা পাহাড়ে বসে লোকদের নিকট হতে বায়াত নিতে শুরু করেন। মানুষের প্লাবন সামলানো ছিল কষ্টকর, হযরত উমার (রা) রাসূলের পায়ের কাছে বসে বায়াতের শব্দগুলো উচ্চারণ করছিলেন। পুরুষেরা রাসূলের হস্ত স্পর্শ করে ঈমান ও জিহাদের বায়াত নিচ্ছিলেন। আর নারীগণকে মুখে মুখে বায়াতের কথাগুলো হযরত উমর (রা) বলে যাচ্ছিলেন। এরপর ১৯ দিন তিনি মক্কায় অবস্থান করেন। মক্কা ত্যাগের পূর্বে বিজয়ের দিন ইসলাম কবুল মক্কার বুনিয়াদী পরিবারের বিচক্ষণ সন্তান আত্তাব ইবনে আছাদকে মক্কার গভর্নর করেন। অথচ আবু সুফিয়ান বা মুহাজির ও আনসার থেকে কাকেও দায়িত্ব দেন নি। বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন মোয়াজ বিন জাবালকে। ২০দিনের দিন রাসূল (সা) মদীনায় রওয়ানা দেন।

 লেখক : প্রখ্যাত মুফাসসির ও ইসলামিক স্কলার


আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির