মানবজাতির মহান শিক্ষক
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১২
প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ
মানবজাতির শিক্ষকরূপে বিশ্বনবীর অবদান সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে সর্বপ্রথম ইসলামে জীবনের স্বরূপ ও জীবনদর্শন সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। এ সম্পর্কে মুহাম্মদ আসাদ যা বলেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অস্ট্রিয়ার এক ইহুদি পরিবারের লিওপোল্ড উইস পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত হয়েও ইসলামের মৌলিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ১৯২৬ সালে মুসলিম হয়েছিলেন মুহাম্মদ আসাদ। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মহান ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করে এবং ইসলামী জীবনব্যবস্থার গভীরে প্রবেশ করে সেই জ্ঞান সমুদ্রের অভ্যন্তর থেকে তিনি তুলে আনলেন এক রাশি মণিমুক্তা। ইসলামের কোন দিকটি তাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে তার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এখনো জানি না ইসলামের কোন দিক আমার নিকট সবচেয়ে বেশি আবেদনপূর্ণ ছিল। আমার মনে হয়েছে ইসলাম এক পরিপূর্ণ স্থাপত্যশিল্পের মতো। এর এক অংশ অন্য অংশের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতার সূত্রে এমন সুদৃঢ়ভাবে সুবিন্যস্ত যে, এর কোনো একটি প্রয়োজনাতিরিক্ত নয় এবং কোনো একটিরও নেই স্বল্পতা। ফলে তা হয়েছে সুসমন্বিত এবং সুঠাম, সুশান্ত।’
পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিভিন্ন সমাজে ধর্ম বলতে যা বোঝায়, ইসলাম তা থেকে স্বতন্ত্র। ইসলাম হলো এক জীবনব্যবস্থা। এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। অন্য ধর্মের মতো ইসলাম শুধুমাত্র বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিন্যাসযোগ্য আধ্যাত্মিক চেতনা নয়, তা হলো সুনির্দিষ্ট নীতিসূত্রের কাঠামোয় স্বয়ংসম্পূর্ণ সংস্কৃতি ও সামাজিক ব্যবস্থার কক্ষপথ। ইসলামের মূলমন্ত্র হলো একত্ববাদ। সমগ্র জীবন ঐক্যবদ্ধ, কারণ তা স্বর্গীয় একত্ব থেকেই উৎসারিত। পার্থিব জীবনে ব্যক্তি যা সম্পন্ন করে সেই ব্যক্তিত্বের সীমারেখায় সব কিছুর মধ্যেই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে এক ঐক্যবোধ-তার ভাবনা-চিন্তায়, কর্মে, এমনকি তার সজ্ঞান চেতনায় এক ঐক্যানুভূতি। ইসলামের সৌন্দর্য হলোÑজীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যক্তিকে পার্থিব জীবন পরিত্যাগ করতে হয় না। আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য ব্যক্তিকে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে কোনো গোপন পথের অনুসন্ধানে যেতে হয় না। চূড়ান্ত মুক্তি অথবা মোক্ষ লাভের জন্য মনের ওপর দুর্বোধ্য কোনো তত্ত্বের প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করতে হয় না। ইসলামে এমন ব্যবস্থা অনুপস্থিত। মুহাম্মদ আসাদের কথায়, ‘এটি হলো সহজ সরল জীবন কর্মসূচি, যা পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির জন্য প্রকৃতির বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত করছেন। এর শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত রয়েছে মাবন জীবনের আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক দিকের পরিপূর্ণ সমন্বয়ের মধ্যে।
সকল ধর্মের মধ্যে একমাত্র ইসলামেই ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, পার্থিব জীবনব্যবস্থার মধ্য দিয়েই ব্যক্তিগত উৎকর্ষ অর্জন সম্ভব। খ্রিষ্টধর্মে বলা হয়েছে, কেবল দৈহিক আকাক্সক্ষা দমন করেই এবং ইন্দ্রিয় নিগ্রহের মাধ্যমেই ব্যক্তি পরিপূর্ণতা অর্জনে সক্ষম। হিন্দু ধর্মের বিধান হলো, নিচু স্তর থেকে ক্রমাগত পুনর্জন্মের ধারাবাহিক আবর্তনের মধ্য দিয়ে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হয়েই ব্যক্তি লাভ করে ব্যক্তিগত উৎকর্ষ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে মোক্ষ। বৌদ্ধ ধর্মে বলা হয়েছে, ব্যক্তিসত্তা চূর্ণবিচূর্ণ করে সমগ্র বিশ্বের সাথে সম্মিলিত হওয়ার আকুতি হল নির্বাণ লাভের মাধ্যম।
ইসলাম কিন্তু বলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। আল্লাহ তা’য়ালার প্রদত্ত বিধান পালন করেই, গভীর আনুগত্যের সাথে, সচেতনভাবে, নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলেই একজন মুসলমান পরিপূর্ণ জীবনের পথে অগ্রসর হতে পারেন। একজন মুসলমানের কর্তব্য হলো সৃষ্টিকর্তা তাঁর অপার কৃপায় অত্যন্ত মূল্যবান নেয়ামত হিসেবে যে জীবন দান করেছেন তার যথার্থ সদ্ব্যবহার করা। এই সত্য মনে রেখে মানবজাতির শিক্ষকরূপে মহানবী (সা)-এর অবদান পর্যালোচনা করতে হবে।
মানবের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও ইসলামে রয়েছে এক উন্নততর বিশ্বাস। পবিত্র কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, ‘দেখো, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি।’ বিশ্বের প্রথম মানব আদম সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালার এই উক্তি। এর তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। মানব যে সবকিছুর ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করবে এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করবে, তা পূর্বনির্ধারিত। তবে বিশ্ব চরাচরে মানবের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন ও অগ্রগতি সাধনের ধারণা ইসলামে একটু ভিন্ন। পাশ্চাত্যে এই সম্পর্কিত ধারণা হলো- মানুষ উত্তরোত্তর তার আত্মিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে তার জাগতিক উন্নয়ন ও বিজ্ঞানমনস্কতা লাভের মাধ্যমে। ইসলামে কিন্তু এই বিশ্বাস রয়েছে যে, মানবগোষ্ঠী ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত এই উভয় পর্যায়ে আত্মার শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে জাগতিক এবং পারমার্থিক উন্নয়নের মধ্যে সৃষ্টি করেছে এক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্ক এবং আজও তা অব্যাহত রয়েছে।
মানবজাতির শিক্ষক হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর ভূমিকা পর্যালোচনার আগে তাঁর জীবনের পর্যায়গুলো অত্যন্ত সাবধানে অথচ সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করা খুবই প্রয়োজন। হযরত মুহাম্মদ (সা) হেরাগুহায় ধ্যানমগ্ন হতেন ঠিকই এবং উচ্ছন্নে যাওয়া মক্কা নগরীতে তার মিশন সফল করার জন্য তিনি ফিরে এসেছেন বারবার। মক্কা নগরী কিন্তু ইসলামের জন্ম নগরী হলেও ইসলাম তার পরিপূর্ণতা লাভ করে মদিনাতেই। হেরাগুহায় মহানবী (সা) ছিলেন উপবাসী, সন্ন্যাসী ও সুফি সাধক। তারপর মদিনাতে এসে তিনি হলেন ইসলামের বাণীবাহক। মদিনাতে এসে তিনি হলেন ইসলামের প্রবর্তক। মদিনাতেই ইসলামী চেতনা পূর্ণতাপ্রাপ্ত ও স্বচ্ছতর হলো। পবিত্র কুরআন শরীফেই রয়েছে, ‘আজ আমি আপনার দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম এবং আমার পক্ষ থেকে পূর্ণ রহমত আপনার ওপর নাজিল করলাম। আমি খুশি যে ইসলাম আপনার দীন। (মাদানি সূরা : কুরআন; আলিয়া ইজেতবেগোভিচ, প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও ইসলাম, ১৯৯৬, ৭৯) মক্কায় নয়, মদিনাতেই ইসলামের সার্বিক সামাজিক ব্যবস্থাপনার সূচনা হয়।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হেরাগুহায় ধ্যানমগ্নতা, তারপর বাস্তবতার জগতে প্রত্যাবর্তন, এক কথায় পারমার্থিকতা ও যুক্তির তথা আধ্যাত্মিকতা ও কর্মনিষ্ঠার সমন্বয়-এই হলো ইসলামের বৈশিষ্ট্য। মরমিবাদ দিয়ে যার শুরু, রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে তার পরিপূর্ণতা। এ যেন মানবজীবনের সারবত্তা। মনুষ্য জীবনের মতোই এর রয়েছে একদিকে ‘স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গ’ যা এক মহাকবির মহাকাব্য এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাস্তবতার সহজ, সরল ও আকর্ষণীয় গদ্য।
খ্রিস্টবাদ কখনো একেশ্বরবাদে স্থির হয়নি। খ্রিস্টান গসপেলে (Trinity) তাই দেখা যায়, তিনি সত্তার অবস্থান, ট্রিনিটি (Trinity)। খ্রিস্টীয় তত্ত্বে ঈশ্বর হলেন পিতা, কুরআন শরীফে কিন্তু আল্লাহকে শ্রদ্ধা করেন। মা মেরী ও অন্যান্য সাধু বা সেইন্টরা খ্রিস্টবাদে দেবতুল্য। মুসলমানরা কিন্তু মহানবীকে শ্রদ্ধা করেন একজন পরিপূর্ণ মানবরূপে, কোনো ফেরেশতারূপে নয়। এইভাবে ইসলামী সংস্কৃতি স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। মুসলমানদের মসজিদকে খ্রিস্টানদের গির্জা অথবা হিন্দুদের সাথে তুলনা করলেই বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। মসজিদে দেখা যায় বুদ্ধিবৃক্তিক চর্চার এক মুক্ত ও উদার আবহ। গির্জায় দেখা যায় রহস্যময়তার এক পরিবেশ। মন্দিরে পাওয়া যায় রহস্যময়তার সাথে সাথে শ্রেষ্ঠ বা বর্ণভিত্তিক কর্তৃত্ব এবং যাজকীয় প্রাধান্যের এক আবহাওয়া। মসজিদের অবস্থান সাধারণত কর্মস্থলে, কোনো বাজার বা বসতির কেন্দ্রে। মসজিদে নামাজ আদায়ের পর জাগতিক বিষয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। গির্জা কিন্তু বাস্তবতার অনুষঙ্গ থেকে দূরে থাকতে চায়। আনুষ্ঠানিক নীরবতা, অন্ধকার অথবা অতীন্দ্রিয় জগতের অনুভব নির্মাণের প্রচেষ্টা এসব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট। খ্রিস্টধর্মের মর্মবাণী অথবা গসপেলের (Trinity) লক্ষ্যশুধু ব্যক্তি, কিন্তু কুরআনের বাণী ব্যক্তিসমষ্টির জন্য। গির্জার ব্যবস্থাপনায় দেখা যায় এক ধরনের অভিজাততন্ত্র। ভাবগম্ভীর পরিবেশে যাজকীয় কর্তৃত্বের প্রকাশ। মসজিদে কিন্তু সাধারণ ও অ-সাধারণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এর ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্র মূর্ত। ইসলামী আইনব্যবস্থায় ইজমা বলতে যা বোঝায় অর্থাৎ জনগণের ঐকমত্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত, তার মাধ্যমে জনগণের অভিমতের প্রকাশ ঘটেছে ইসলামে।
ইসলামে এভাবে শুধু যে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে তাই নয়, নতুন সভ্যতার পথও প্রশস্ত হয়েছে। সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী চিত্র হলো শিক্ষা। কুরআন শরীফের প্রথম আয়াতেই এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। তা ছাড়া, কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে তাঁর প্রতিনিধিরূপে উল্লেখ করেছেন। মানুষ কিন্তু বিশ্বময় তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারে শুধুমাত্র তার বিশেষ জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে, বিজ্ঞানচর্চা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে। তাই শিক্ষা দান ও শিক্ষা গ্রহণ দুটোই ইসলামে অবশ্য করণীয়। হযরত মুহাম্মদ (সা) নিজেই বলেছেন, ‘আমি দু’জনের বিষয়ে অসন্তুষ্ট : অজ্ঞ ভক্ত এবং নাস্তিক পণ্ডিত’ (Ralph waldo emerson. The conduct of life গ্রন্থে উদ্ধৃত)।
এও উল্লেখ্য যে, ক্ষমতাহীন বিশ্বাস, বিশ্বাসহীন শাসক অনেকটা নোংরা শরীরে বিশুদ্ধ আত্মার মতো- মহানবীর বক্তব্য এমনিই ছিল। এই অর্থে ইসলাম হচ্ছে মানুষের জন্য সর্বাধিক প্রযোজ্য ব্যবস্থা। কারণ, ইসলাম মানব-প্রকৃতির দ্বৈত প্রকৃতিকে স্বীকৃতি দেয়। অন্য যে কোনো ধর্ম বিকল্প মানবজীবনের খণ্ডিত প্রেক্ষিতকে ধারণ করে মাত্র। এদিক থেকে পর্যালোচনা করে বলা যায়, বিশ্বস্রষ্টা, বিশ্ব প্রকৃতি এবং তার অন্তর্ভুক্ত সকল সৃষ্টি, সৃষ্টিকর্তার সাথে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক, মানুষের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক গঠনÑ সবই ছিল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর শিক্ষার বিষয়বস্তু। শুধু তাই নয়, এই নশ্বর পৃথিবী লয় হলেও পারত্রিক জগৎ পর্যন্ত তা পরিব্যাপ্ত।
ইসলাম শিক্ষার আদি কেন্দ্র হলো মসজিদ। বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে করীম (সা) নবুওয়ত লাভের পর কাবা শরীফকে প্রথমে শিক্ষা কেন্দ্ররূপে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। কেউ কেউ বলে থাকেন, মক্কা নগরীতে তিনি ‘দারুল আরকাম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। পরে তিনি মদিনায় হিজরত করলে প্রথমে কুবা নামক স্থানে সর্বপ্রথম একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরে তিনি মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) আসরের নামাযের পরে অধিকাংশ সময় এই মসজিদে শিক্ষাদানে রত থাকতেন। এও জানা যায়, সপ্তাহে একটি দিন তিনি মহিলাদের জন্যও নির্ধারিত করেন। তা ছাড়া, হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, দ্বিতীয় হিজরিতে মকরামহ ইবনে নাওফেল নামক আনসারের গৃহে ‘দারুল কাররাহ’ নামে একটি আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ছিল। সাহাবীগণ সেখানে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। রাসূলে করিম (সা)-এর জীবদ্দশায় মদিনায় ৯টি মসজিদ ছিল। এসব মসজিদে মদিনা ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে ছেলে-মেয়ে, মহিলা-পুরুষ সকলেই শিক্ষা লাভের সুযোগ পেতেন। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আধুনিক কালের শিক্ষাদান পদ্ধতির মতো তখন ভর্তি এবং মাসিক মাইনের দ্বারা শিক্ষাকার্যক্রম কোনোক্রমে সংকোচিত হতো না। মধ্যযুগে ইউরোপে গিল্ডের আকারের যেভাবে বিশেষ কলাকৌশল শেখানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হতো, শিক্ষককে প্রচুর পরিমাণ অর্থ দিয়ে যেভাবে সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থাকে জনসাধারণের নিকট থেকে আড়ালে রেখে সঙ্কীর্ণ এক গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষিত করার উদ্যোগ গৃহীত হতো, মদিনায় এবং পরবর্তীকালে মুসলিম বিশ্বে তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুসলিম বিশ্বে শিক্ষালয় ছিল অবাধ, মুক্ত, সম্মানীবিহীন, সবার ওপর জীবনমুখী। রাসূলুল্লাহ (সা) ছিলেন এর প্রবর্তক। সৈয়দ আমীর আলীর লিখিত History of the Saracens গ্রন্থের ১৮৭ পৃষ্ঠায় লিখিত হয়েছে, ‘মদিনার মসজিদে হযরত আলী (রা) এবং তাঁর ভ্রাতা আবদুল্লাহ (হযরত আব্বাসের পুত্র) দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আইন অলঙ্কারশাস্ত্রের ওপর প্রতি সপ্তাহে বক্তৃতা করতেন এবং অন্য শিক্ষকেরা শেখাতেন অন্য বিষয়।’ হযরত মুহাম্মদ (সা) কর্তৃক প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা ছিল সর্বজনীন। এই শিক্ষাব্যবস্থা সর্বজনীন দুই অর্থে : এক, গ্রিক পণ্ডিত এরিস্টটলের কথায়, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জীবনের প্রয়োজন এবং টিকে রয়েছে উন্নত জীবনের লক্ষ্যে। রাসূলুল্লাহ (সা) উন্নত জীবনকে যে আলোকে দেখেছেন, শিক্ষাব্যবস্থাকে সেই নিরিখে সাজিয়ে-গুছিয়ে, সুস্থ দেহে বিশুদ্ধ মনের বিকাশ ঘটাতে এবং শুধুমাত্র পার্থিব জীবনের জন্য নয়, আধ্যাত্মিক জীবনকে প্রস্ফুটিত করতে এবং শুধু ইহলৌকিক নয়, পারলৌকিক জীবনেরও সৌষ্ঠব বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত করেন যাতে কেবল ব্যক্তিজীবন নয়, সামাজিক জীবনও উন্নততর হতে পারে। এদিক থেকে বলা যায়, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। দুই, এই শিক্ষাব্যবস্থা কিন্তু শুধু মুসলমানদের জন্যই সুনির্দিষ্ট হয়নি, এর ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি ছিল সমগ্র উম্মাহর জন্য এবং মদিনা সনদের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বনু আউফের ইহুদিরা মুমিনদের সাথে একই উম্মাহ। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম আর মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম, তাদের মাওয়ালী বা আশ্রিত এবং তারা নিজেরাও। অবশ্য যে অন্যায় বা অপরাধ করবে, সে নিজের এবং তার পরিবার-পরিজনের ক্ষতিই করবে। (এই নিবন্ধে মদিনা সনদের বঙ্গানুবাদ গৃহীত হয়েছে আব্দুল ওয়াহিদ রচিত একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মদিনা সনদের গুরুত্ব প্রবন্ধ থেকে, আলোর মিছিল, ১৯৯৯, ২২-৪৫ পৃষ্ঠা) মদিনা রাষ্ট্রের উম্মাহ শুধু মুসলমানদের নয়, নয় কুরাইশদের অথবা মুহাজির ও আনসারদের। এই উম্মাহ সকলের। ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের। যে যার ধর্ম অনুসরণ করবে কিন্তু জাতি হিসেবে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সকলেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশে সকলেই কৃতসঙ্কল্প।
ইসলামের মৌল ভিত্তি যে একত্ববাদ তা যেমন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়েছে, সেই ঐক্যানুভূতির প্রতিকৃতিও রূপ পেয়েছে আল্লাহ তা’য়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানবের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য সুনির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাক্ষেত্রে বিশ্বময় আজ যে প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, বিশেষ করে তথ্য প্রবাহের অবাধ গতির প্রেক্ষাপটে, গণতান্ত্রিকতার বৈপ্লবিক সম্প্রসারণের এ কালে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা প্রতিফলন দেখা যায় বটে কিন্তু তা আংশিক। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আইন-চিকিৎসা, অর্থনীতি, পরিকল্পনা, যুক্তিবিদ্যা-প্রকৌশল প্রভৃতি ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা গতিশীল হলেও ধর্ম ও নীতিশান্ত্র, দর্শন ও সৃষ্টিতত্ত্ব, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অপরিণত ও অপূর্ণ। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর শিক্ষা এ ক্ষেত্রে এখানো পথিকৃৎ, এখনো দিশারিতুল্য, উজ্জ্বল দীপশিখার মতো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ক্ষেত্রকে নৈতিকতার আবরণমুক্ত করে অগ্রসরমান মানবগোষ্ঠী যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তা যে কোনো মুহূর্তে সমগ্র মানবসমাজকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। তখন কিন্তু বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর শিক্ষাব্যবস্থাই হতে পারে একমাত্র উজ্জ্বল আলোকরশ্মি।
লেখক : সাবেক উপাচার্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মন্তব্য লিখুন