post

মানবাধিকার আইনে সংবাদপত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সমাবেশের অধিকার

১৫ নভেম্বর ২০১১
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান বিখ্যাত আইনবিদ Louts Henkin তাঁর ''The International Bill of rights'' গ্রন্থের ভূমিকাতে মন্তব্য করেছেন যে, ''Human Rights is the idea of our time'' অর্থাৎ মানবাধিকার হল বর্তমানকালের ধারণা। মানবাধিকার সম্পর্কে পশ্চিমা প্রায় সকল আইনবিদের বিশ্বাস এ রকমই। কিন্তু সাধারণভাবে অনুসৃত মানবাধিকার সম্পর্কিত এহেন ধারণা কতটুকু সত্য? মানবাধিকার কি আসলেই বর্তমানকালের ধারণা? ম্যাগনাকার্টা, ফরাসি বিপ্লব-এ সবের পথ ধরেই কি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে মানবাধিকার সংক্রান্ত আইনের যথাযথ বিকাশ হয়? আন্তর্জাতিক বা সার্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত ধারণার ইতিহাসের সূচনা কেবল ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বরে? এর পূর্বে কি পৃথিবীর মানুষ সার্বজনীন মানবাধিকারের ধারণার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করেনি? সমাজে, রাষ্ট্রে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এর সফল বাস্তবায়ন প্রত্যক্ষ করেনি? এখন থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে তমসায় নিমজ্জিত ধরণীতে আল-কুরআনের আলোকবর্তিকা, রহমতের বার্তা নিয়ে যিনি এই নশ্বর ধরাধামে এসে পৃথিবীকে আলোকিত করে গেছেন সেই রাহমাতুল্লিল আলামীন, সাইয়েদুল মুরসালিন, খাতামুন নাবীঈন, মানবমুক্তির দূত, যাঁকে উসিলা করে সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে সেই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্মময় জীবনের ওপর যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করলে এমন সব তথ্য অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে আমাদের সামনে ভেসে উঠবে যাতে সকলেই বলতে বাধ্য হবেন যে, সার্বজনীন বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ধারণা দিয়েছেন হযরত মুহাম্মদ (সা), প্রতিটি পর্যায়ে সকলের জন্য মানবাধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনিই, নিঃসন্দেহে তিনিই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানবদরদি, সার্বজনীন মানবাধিকার ধারণা বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করেছিল তাঁর পবিত্র হাতেই। M.N. Roy বলেছেন, ''Very few Moslems of our time are aware of the great role played by Islam in the play house of history'' অর্থাৎ ইতিহাসের রঙ্গশালায় ইসলামের সুমহান অবদান সম্পর্কে আজকের খুব অল্পসংখ্যক মুসলমানই অবগত। যেখানে অধিকাংশ মুসলমানই বিশ্বসভ্যতায় তাদের ধর্ম ইসলাম এবং ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর সুমহান অবদান সম্পর্কে ওয়াকেব হাল নয়, সেখানে পশ্চিমা জগতের ধারণা কেমন হবে তা বলাই বাহুল্য। পশ্চিমা আইনবিদরা হয় ইসলাম ও এর নবী সম্পর্কে অজ্ঞ, না হয় আদর্শিকভাবে তারা ইসলামবিরোধী। আর এ জন্যই মানবাধিকার আইনকে আধুনিককালের বলে চালিয়ে দিয়ে তারা এক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর অবদানকে অস্বীকার করতে চাইছেন। মানবাধিকার আইনের ক্রমবিকাশ ম্যাগনাকার্টা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল  ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়। ইসলাম ধর্ম প্রথম স্পষ্ট সুনির্দিষ্ট আকারে সকল মৌলিক অধিকার তথা মানবাধিকার প্রদান করেছে। কিন্তু এ বক্তব্যের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ না করে যারা মানবাধিকার আইনকে বর্তমানকালের বলতে চান, তাদের বক্তব্যকে খণ্ডন করার জন্য। সত্যের উদঘাটনের জন্য পাশ্চাত্যে মানবাধিকার আইনের উৎপত্তির ওপর আলোকপাত করা জরুরি। পাশ্চাত্য আইনবিদগণ মানবাধিকারকে বর্তমানকালের ধারণা বলে মনে করেন- এ কথা আমরা ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি। তাদের বিশ্বাস মতে ১৯৪৫ সালে প্রণীত জাতিসংঘ সনদ হল প্রথম দলিল যেটা নাকি মানবাধিকারের ধারণাকে আন্তর্জাতিকরণ (Internationalised) করেছে যদিও এই সনদের কোথাও মানবাধিকার সমূহের উল্লেখ মাত্র করা হয়নি। তারপর আসে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর যে দিনটি বিশ্বমানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৪৮ সালের এ দিনে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র তৈরি করা হয়। বিশ্বের মানুষ এখন এটিই স্বীকার করে যে, সার্বজনীন মানবাধিকারের ধারণা মূলত এ সময়েরই। তবে এ কথা ঠিক যে, পাশ্চাত্যে সার্বজনীন মানবাধিকারের ধারণার জন্ম ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে নির্ধারণ করা হলেও প্রকৃত অর্থে এর পেছনেও রয়েছে পর্যায়ক্রমিক একটি ইতিহাস। তবে এ ইতিহাস কোনক্রমেই ১২১৫ ঈসায়ী সালের পূর্বের নয়। ইংল্যান্ডে মানবাধিকারের বিকাশ : যে ইংরেজ জাতি নিজেদের ‘সভ্য’ বলে দাবি করে থাকে। তারা আসলে কতটুকু সভ্য, তাদের তথাকথিত এই ‘সভ্য’ হবার ইতিহাসই ক’দিনের এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পাঠকদের জন্য আমি প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য তুলে ধরছি। ইংল্যান্ডে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ছিল রাজতন্ত্র। তখন মানুষের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। পূর্বে ইংল্যান্ডে মনে করা হত যে, মানুষকে কোন অধিকার দেয়া বা না দেয়া রাজার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী সেইসব রাজা মানুষকে মানুষ হিসেবে মনে করত না। রাজাদের নির্মম অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণ শত শত বছরের করুণ ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অবশেষে মরিয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন সময়ে জন্ম নেয় মানুষের অধিকার সংক্রান্ত কিছু বিল। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. এম এরশাদুল বারী মন্তব্য করেন : ''The idea of human rights to a great extent evolved as a result of political absolutism since rights of man became a slogan against the injustices and indignities committed by tyrannical or despotic governments'' অর্থাৎ মানবাধিকার ধারণার অনেকাংশে বিকাশ ঘটে স্বেচ্ছাচারী শাসকের স্বেচ্ছাতন্ত্রের ফল হিসেবে, যখন অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারী সরকারসমূহের সকল অবিচার ও অমর্যাদাকর ব্যবহারের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার একটি শ্লোগানে পরিণত হয়’’ ইংল্যান্ডে মানবাধিকার বিকাশের পথ পরিক্রমার চারটি পর্যায় হল ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস ১৬৮৮ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৭০১ সালের অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট। (১) ম্যাগনাকার্টা : ১২১৫ সালের জুন মাসে ইংল্যান্ডের রাজা জন এবং রাষ্ট্রের বিত্তশালীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত এ সনদটিকে ''Keystone of English Liberty'' অর্থাৎ মানবাধিকারের চাবিকাঠি বলা হয়। ইংরেজ আইনবিদ Loard chathan মন্তব্য করেন, The Petition of Right and the Bill of Rights along with the Magna Carta Constitute the Bible of the English consttuition. অর্থাৎ পিটিশন অব রাইট, বিল অব রাইট এবং ম্যাগনাকার্টা ইংলিশ সংবিধানের বাইবেল স্বরূপ।’’ ইংল্যান্ডে মানবাধিকারের বিকাশ তথা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পেছনে যে দলিলটিকে চিহ্নিত করা হয় তা হল ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা। কিন্তু এ ম্যাগনাকার্টার পেছনে রয়েছে শত শত বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস। নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের নিকট হতে যৎসামান্য অধিকার লাভের পথ খুঁজে পায়। অবশ্য যে ম্যাগনাকার্টাকে ইংল্যান্ডে মানবাধিকার আইনের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তা কোন বিচারেই জনগণের সনদ (People's Charter) হিসেবে মর্যাদা প্রাপ্তি দাবি রাখে না। প্রথমত, এটি জনগণের সঙ্গে নয়, বরং প্রভাবশালীদের সঙ্গে রাজার একটি চুক্তি ছিল। দ্বিতীয়ত, এর বিধানসমূহ ছিল রাজকীয় অফিসারদের দ্বারা স্বেচ্ছাচারভাবে কর আরোপ এবং সম্প্রতি আটক বা দখলের বিধান রহিত করা, রাজ্যের মধ্যে ব্যবসায়ীদের চলাফেরার স্বাধীনতা প্রদান, জুরি কর্তৃক বিচার প্রভৃতি। সর্বসাধারণের বিষয়টি এখানে বিবেচনায় আনা হয়নি। বলা হয় ''Although initially the objective of the Magna Carta was to compel the king to rule in a fair manner and to protect the barorns from unfair treatment by the goverment, subsequently many of the rights and guarantees granted to them were extended to the common people'' অর্থাৎ যদিও প্রথমে ম্যাগনাকার্টার লক্ষ্য ছিল রাজাকে ন্যায়পন্থায় শাসন করতে বাধ্য করানো এবং সরকারের অন্যায় আচরণ থেকে ‘ব্যারন’দের রক্ষা করা। কিন্তু তাদেরকে প্রদত্ত অধিকারসমূহের অনেকগুলোই পরবর্তীতে সাধারণ মানুষদের প্রদান করা হয়।’’ সুতরাং যে সনদটিকে ইংল্যান্ডের মানবাধিকার আইনের প্রথম মাইলফলক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, তা প্রকৃত অর্থে জনগণের সনদ ছিল না। পিটিশন অব রাইটস : ব্রিটিশ জনগণের মানবাধিকার ইতিহাসের দ্বিতীয় দলিলটি হল ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস। এই বিলের মাধ্যমে জনগণের কয়েকটি অধিকারকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু রাজা কর্তৃক এটি প্রত্যাখ্যাত হতে পারে এ ভয়ে খুব কৌশলে ‘বিল’ আকারে নয়, বরং ‘পিটিশন’ আকারে এটি পেশ করা হয়। এতে মোট ৪টি ধারা রয়েছে। ৪টি ধারায় পর্যায়ক্রমে বলা হয়েছে- ষ    পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়া কোন ব্যক্তির ওপর কর আরোপ করা যাবে না। ষ    কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তিকে জেলে আটক রাখা যাবে না। ষ    সেনাবাহিনীর কোন দল গৃহকর্তার পূর্ব অনুমতি ছাড়া গৃহে অবস্থান করতে পারবে না এবং ষ    রাজা বা রাণী কর্তৃক আইনে প্রসিডিং এর জন্য কমিশন জারি করা যাবে না। ৩. বিল অব রাটইস : ১৬৮৮ সালে প্রণীত এ বিলের মাধ্যমে রাজা বা রাণী কর্তৃক স্বেচ্ছাচারীভাবে আদালত গঠন সংক্রান্ত ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। এর দ্বারা রাজার নিকট প্রজাদের আবেদন করা, পার্লামেন্টে সদস্যদের কথা বলা এবং বিতর্কে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়। ৪. অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট : ১৭০১ সালে প্রণীত এ আইনটিতে মূলত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হয়। আমেরিকায় মানবাধিকার আইনের ক্রমবিকাশ : আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় ১৭৭৬ সালে এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয় ''All men are created equal with inalienable rights to life, liberty and the pursuit of happiness'' অর্থাৎ জন্মগতভাবে সব মানুষ সমান, আর তাদের রয়েছে জীবন ও স্বাধীনতা এবং সুখ অন্বেষণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার। আমেরিকার ইতিহাসে এটিই হল মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রথম উচ্চারণ। তবে আমেরিকার মূল সংবিধানে প্রকৃতপক্ষে বিল অব রাইটস তা অধিকার সংক্রান্ত বিল ছিল না। পরবর্তীতে ১৭৯১ সালে তাদের সংবিধানের প্রথম দশটি সংশোধনী গৃহীত হয় যেগুলো একত্রে ‘বিল অব রাইটার্স’ নামে পরিচিত। এতে যে সকল অধিকার সংযোজন করা হয়, সেগুলো হচ্ছে, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশের অধিকার অভিযোগ প্রতিকারের জন্য সরকারের নিকট আবেদন করার অধিকার, নিরপেক্ষ জুরির মাধ্যমে অনতিবিলম্বে ও প্রকাশ্যে বিচার লাভের অধিকার। সম্পত্তির অধিকার, আইন উপদেষ্টা নিয়োগের অধিকার। নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেয়ার অধিকার, একই অপরাধে দুইবার শাস্তি না পাবার অধিকার, আইনের চোখে সমান অধিকার, দাসপ্রথার বিলুপ্তি। ফ্রান্সে মানবাধিকার আইনের ক্রমবিকাশ : ১৭৮৯ সালে French declaration of rights of man and of the citizen অর্থাৎ মানুষ ও নাগরিকদের অধিকার সম্পর্কিত ফ্রান্সের ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়। ব্রিটেন এবং আমেরিকায় ঘোষিত মানবাধিকারের আলোকেই এটি প্রণীত হয়। ১৭৮৯ সালের এই ঘোষণা এবং ১৭৯১ সালের ফ্রান্সের রেনেসাঁ-উত্তর প্রথম সংবিধানে যে সকল অধিকার প্রদান করা হয় সেগুলো হল, ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, আইনের চোখে সমান অধিকার, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা মৌলিক অধিকারের গ্যারান্টি ইত্যাদি। পাশ্চাত্যের আইনব্যবস্থার ক্রমবিকাশের ওপর আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, তাদের মানবাধিকারের ইতিহাস বড়জোর ১২১৫ সাল থেকে শুরু হওয়া ইতিহাস এবং এ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা মানুষের অধিকারসমূহকে স্বীকার করেনি। এ স্বীকৃতি আদায়ের জন্য শত শত বছরব্যাপী রক্ত ঝরাতে হয়েছে। আর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মানবাধিকারের সার্বজনীনতায় তারা বিশ্বাস করতেন না, আন্তরিক ছিলেন না। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত পাশ্চাত্যে মানবাধিকার সংক্রান্ত যে সকল দলিল আমরা পাই, সেগুলোর কোনটিই আন্তর্জাতিক তথা সার্বজনীন বা বিশ্বজনীন ছিল না। বলা হয়ে থাকে, The Charter of the United Nations Organistion has Internationalised the idea of Human Rights.''  অর্থাৎ মানবাধিকারের ধারণাটির আন্তর্জাতিকরণ করেছে, জাতিসংঘ সনদ।’’ সকলেই এটি স্বীকার করেন যে,  জাতিসংঘ সনদ (১৯৪৫)-এর আগে মানবাধিকারের ধারণাটি বিশ্বজনীন ছিল না। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে সার্বজনীন, বিশ্বজনীন মানবাধিকারের ধারণা ইতঃপূর্বে আসলেই কি কেউ দেননি, কোন আইন ব্যবস্থা তা কার্যকর করেনি এসব প্রশ্নের ওপর আলোকপাত করার আগে আমরা আবার পাশ্চাত্যের মানবাধিকার আইনের ওপর নজর দেব। পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের স্বরূপ : আজকের তথাকথিত সভ্যতার ধ্বজাধারী মানবাধিকারের স্বঘোষিত ধারক হিসেবে যারা আত্মপ্রসাদ লাভ করে। আমরা দেখেছি যে, তারা মানবাধিকার সম্বন্ধে বুঝতে শিখেছে মাত্র সেদিন থেকে পাশ্চাত্য মানবাধিকারের বিকাশ পর্বে মানবাধিকারের রূপ কেমন ছিল এর ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন। ব্যক্তি মানুষের অধিকার (individual's rights) এখনও স্বীকৃত হয়নি। ‘বিশেষ কারণে’ কিছু ব্যক্তি সমষ্টির অধিকার (rights of the groups of individuals) সম্বন্ধে পাশ্চাত্য সমাজের কন্ঠ উচ্চারিত হয়। অবশ্য তাদের এ মাথাব্যথার কারণ ছিল ভিনদেশে তাদের নিজ সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা। কিন্তু তারাই নিজেদের দেশে অপর সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করত। নিম্মে এর ওপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হল : (১) ধর্মীয় স্বাধীনতা : ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে গোটা ইউরোপব্যাপী ধর্মীয় হানাহানি বিরাজ করে। এসব ধর্মযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ বিরাজমান দেশসমূহে নিজ ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য প্রভাবশালী দেশগুলো সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। জার্মানিতে রোম ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের ধর্মীয় সমঅধিকার প্রদানের জন্য ১৬৪৮ সালে Peace of westphalla স্বাক্ষরিত হয় যার মাধ্যমে জার্মানিতে ৩০ বছরের ধর্মীয় হানাহানি শেষ হয়। এ শান্তিচুক্তি সম্পর্কে ড. এম, এরশাদুল বারী মন্তব্য করেন : ''The real motive was rather to promote favoured religious creeds than to promote religious freedom for all'' অর্থাৎ উক্ত শান্তিচুক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল সকলের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানের পরিবর্তে পক্ষপাতমূলক ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করা। কোন চুক্তির আওতায় কোন রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের অংশবিশেষ অপর রাষ্ট্রের নিকট হস্তান্তরিত হলে নতুন রাষ্ট্রে তারা যেন ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা হত। উদাহরণ ১৭১৩ সালের নেদারল্যান্ড চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স হাডসন উপসাগর এবং আকাভিয়া গ্রেট ব্রিটেনের নিকট হস্তান্তর করে। উক্ত চুক্তির ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, সে এলাকার ক্যাথলিকরা এক বছরের মধ্যে ইচ্ছে করলে ফ্রান্সে চলে আসতে পারবে। আর যারা থেকে যাবে তাদেরকে গ্রেট ব্রিটেনের আইন অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এরা সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করত না, কেবল স্বধর্মের কেউ অপর কোন রাষ্ট্রে বৈষম্যের শিকার হল কিনা তা নিয়ে চিৎকার করত। ডা. এম, এরশাদুল বারী এ প্রসঙ্গে খুব সুন্দর বলেছেন : ''All the attempts to secure religious freedom were almost invariably, efforts by members of one religion or behalf of their co-religionists elsewhere Protestan powers generally tried to secure religious freedoms for Protestants in catholic countreies; but not for muslim, Baddhists or Jews'' অর্থাৎ ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার সকল প্রচেষ্টাই ছিল মূলত একই ধর্মের অনুসারীদের হয়ে তাদের সহ অনুসারীদের প্রচেষ্টা। প্রোটেস্ট্যান্টরা সাধারণত চেষ্টা করত ক্যাথলিক অধ্যুষিত দেশসমূহে প্রোটেসট্যান্টদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করা। কিন্তু মুসলমান বৌদ্ধ, ইহুদিদের ব্যাপারে এদের োন মাথাব্যথা ছিল না। দাস প্রথার উচ্ছেদ : পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রকৃতপক্ষে মানুষে মানুষে সমতা নীতিতে বিশ্বাস করে না। বর্তমানে মুখে তারা যত সুন্দর বুলি আওড়াক না কেন আসলে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করা, তাদের প্রতিপক্ষ মানব সন্তানদেরকে নির্মূল করা, দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা, এদের আজন্ম খায়েশ। পাশ্চাত্য পাণ্ডিত্যের পুরোধা প্লেটো এরস্টিটল দাসপ্রথাকে শুধু বৈধতা দান করেই ক্ষান্ত হননি, উপরন্তু মানব সমাজে দাসপ্রথার প্রয়োজন আছে বলে মন্তব্য করেছেন। হাজার হাজার বছরব্যাপী সে সমাজে দাসপ্রথা, দাস বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। দাস বাণিজ্য (Slave treade) ছিল তাদের একটি লোভনীয়(!) পেশা। নিকট অতীতে ১৮০২ সালে প্রথমে ডেনমার্কে আমরা দাস প্রথা উচ্ছেদের প্রথম পদক্ষেপ লক্ষ্য করি। পরে দাস বাণিজ্যকে রহিত করণার্থে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮০৭ সালে একটি বিল পাস করে। এ আইনটি কেবল ব্রিটেনের জন্য ছিল। ১৮৩৩ সালে অবশ্য ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যভুক্ত সকল অঞ্চলে অনুরূপ আইন প্রণয়ন করা হয়। নেপোলিয়ন ১৮১৪ সালে ফ্রান্সে দাস বাণিজ্য বন্ধকরণের জন্য আইন পাস করেন, যদিও এ আইনটি পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। সংবিধানের ১৩শ’ সংশোধনীর মাধ্যমে আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৫ সালে আমেরিকায় দাসপ্রথা রহিত করেন। আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাসপ্রথা উচ্ছেদের প্রথম পদক্ষেপ হল ১৮১৫ সালের ভিয়েনা কংগ্রেস যেখানে কেবল নীতিগতভাবে দাসপ্রথা উচ্ছেদের কথা বলা হয়, কিন্তু এ নীতি বাস্তবায়নের দিন-ক্ষণ ঠিক করা হয়নি। এক্ষেত্রে একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য : ''The Intentions of the Great five were some what less than purely humanitarion; their aims were to restablish the political balance and destroy the growing economic power of spain which thrived on slave trade in latin America! অর্থাৎ বৃহৎ পাঁচটি শক্তির অভিপ্রায় বিশুদ্ধ মানবিকতার চেয়ে অনেকটা কম ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং ল্যাটিন আমেরিকায় দাস ব্যবসা করে উন্নতি লাভ করা, স্পেনের বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তিকে ধ্বংস করা।’’ সুতরাং এটি পরিষ্কার হল যে, দাসদেরকে ভালবেসে নয়, বরং বৃহৎ শক্তিগুলো রাজনৈতিক স্বার্থের দাসপ্রথা উচ্ছেদের জন্য এগিয়ে আসে। ৩. যুদ্ধবন্দী এবং যুদ্ধাহতদের প্রতি ব্যবহার : হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর আগমনের পূর্বে পৃথিবীতে এবং তাঁর আগমনের পরও ইসলাম ভিন্ন অপর কোন ব্যবস্থায় যুদ্ধবন্দীদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হয়নি, যুদ্ধাহতদের প্রতি কেউ সহানুভূতি প্রদর্শন করেনি। অবশ্য পাশ্চাত্যের সমাজ ও আইনব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ঊনবিংশ শতকে এবং বিংশ শতকের প্রথম দিকে যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধাহতদের প্রতি সামান্য নজর দেয়া শুরু হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যারা যুদ্ধে আহত হয় তাদের জন্য ১৮৬৪ সালের জেনেভা কনভেনশনের মাধ্যমে কিছু নীতি প্রণয়ন করা হয়। ১৮৬৮ সালের সেইন্ট পেটার্সবার্গ ঘোষণার মাধ্যমে কতিপয় বিস্ফোরক ও দাহ্য বুলেটের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধাহতদের স্বার্থে পশ্চিমা বিশ্বে আরও যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, সেগুলো হলো ১৮৯৯ ও ১৯০৭ সালের হেগ কনভেনশন, ১৯৪৯ সালের ১২ আগস্ট জেনেভায় স্বাক্ষরিত ৪টি কনভেনশন ইত্যাদি। কিন্তু এতকিছুর পরও বাস্তবে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? বসনিয়া হার্জেগোভিনা, চেচনিয়া, কাশ্মীরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধবন্দী আর যুদ্ধাহত মুসলিমদের আর্তচিৎকারে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে। তাছাড়া শুধু মুসলিম বলে নয়, সকল যুদ্ধবন্দী আর যুদ্ধাহতদের প্রতিই এরা বড় নিষ্ঠুর। যুদ্ধবন্দীদের গায়ের চর্বি দিয়ে জার্মানিতে সাবান বানানোর লোমহর্ষক কাহিনী কারও অবিদিত নয়। আসলে যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধাহতদের এরা মানুষই মনে করে না। ৪. সংখ্যালঘুদের অধিকার : নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি যারা সর্বদা অমানবিক আচরণ করত, সেই সকল শক্তিধর রাষ্ট্র তার ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতির অনুসারী অপর দেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থ উদ্ধারে সবসময় সচেষ্ট থাকত। যা হোক এ রকম পক্ষপাতমূলক আচরণের পথপরিক্রমায় ১৯১৯ সালে ভার্সাই-এ অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে প্রথম সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা বলা হয়। ৫. শ্রমিকদের অধিকার : পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থায় বিশ শতকের প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠিত জাতিপুঞ্জের চুক্তির ২৩নং অনুচ্ছেদে প্রথম শ্রমিকের অধিকারের ব্যাপারে বলা হয়। ১৯১৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা গঠিত হয় যার উদ্দেশ্য হলো শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করা। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য) লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিষ্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির