post

মিডিয়াপাড়ায় মৃদু ভূমিকম্প

মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান

১১ মে ২০২৩

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা কতটুকু স্বাধীন তা আজ প্রশ্নসাপেক্ষ। সাংবাদিকতায় সেন্সরশিপের কথা আমরা জানি। তবে বাংলাদেশে বর্তমান সময়কালে সেল্ফ সেন্সরশিপের মাত্রা একটু বেশিই বৈকি। এম্বেডেড জার্নালিজম সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত। যুদ্ধের ময়দানে কোনো এক পক্ষের সাথে থেকে যুদ্ধ ময়দানের সংবাদ সংগ্রহকে এম্বেডেড জার্নালিজম বলা হলেও এরও ধরন পাল্টেছে। যুদ্ধের একটি কৌশল হচ্ছে অপর পক্ষের মন ভেঙে দেওয়ার জন্য বিপরীত প্রচারণা জোরদার করা। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী ইরাক ইরান যুদ্ধ, আফগানিস্তান ম্যাসাকারসহ নানান সময়ে দেখা গিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এম্বেডেড জার্নালিজমের নাম দেওয়া হয়েছে শিকারি সাংবাদিকতা। তার মানে প্রতিপক্ষকে শিকার করা, তাকে বধ করা এবং কোনো এক পক্ষকে পার পাইয়ে দেওয়া। তার অপরাধকে আড়াল করা। শিকারি সাংবাদিকতার এক উর্বর ক্ষেত্র বাংলাদেশ। এখানে মিডিয়া যতটা না পরাধীন তার চেয়ে বেশি স্বপ্রণোদিত পরাধীনতার পথকে তারা বেছে নিয়েছে। এখানে সাংবাদিকরা মার খাওয়ার পরেও প্রতিবাদের ভাষাগুলো স্থায়িত্ব পায় না, প্রতিবাদের উচ্চৈঃস্বর এক সময় ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। কেন এমন হয়? এখানে সাংবাদিকতায় আদর্শিক দ্বন্দ্ব আছে। আদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা যখন গোষ্ঠী স্বার্থ আর ব্যক্তিস্বার্থের যূপকাষ্ঠে নৈতিকতাকে বলি দেওয়া হয় তখন সেখানে পেশিশক্তির আবির্ভাব ঘটে। 

যে কোনো দেশেই গণমাধ্যম এক বিশাল শক্তি। দেশ জাতি এবং জনগণের স্বার্থে এ শক্তির যথার্থ ব্যবহার এবং যথাযথ ভূমিকা অবশ্যই কাম্য কিন্তু সাংবাদিকগণ যথার্থ অর্থে জনগণের জন্য, জনগণের তরে হতে পারেননি। প্রতিটি মিডিয়া অবশ্যই একটি আদর্শকে লালন করবে; তাই বলে সত্যকে অস্বীকার করা, সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া, বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ পরিবশেন করা, অপরের সুনাম সুখ্যাতি নষ্ট করা, এগুলো তো সাংবাদিকতার নীতি হতে পারে না। চরম দুঃখজন সত্য হচ্ছে এগুলো বাংলাদেশে হচ্ছে। সাংবাদিক ইউনিয়ন দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে অনেক আগে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্বাচন ব্যতীতই পরিবর্তন করা হয়েছে। সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে এখন একটি শক্তিশালী সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি। জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সদস্য হওয়ার পথে নানা বিপত্তির কারণেই সেই সময়ের তরুণ এবং পেশাদার সাংবাদিকরা এ সংগঠন কায়েম করেছে। প্রবাদ বাক্য আছে ‘কাক কাকের মাংস খায় না’ কিন্তু ‘এক সাংবাদিক আর এক সাংবাদিকের মাংস খায়’ মানে তার ধ্বংস এবং বিনাশ কামনা করে। একটি তিক্ত কথা লোকমুখে প্রচলিত আছে, আগে ধনীরা কুকুর পুষতো বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্য এখন ব্যবসায়ীরা মিডিয়া পোষে ব্যবসা পাহারা দেওয়ার জন্য। এ সত্যকে অনেকেই অস্বীকার করবে বা পাশ কাটিয়ে যাবে কিন্তু বাস্তবতা এর ব্যতিক্রম নয়। সৎ এবং সত্য সাংবাদিকতা এখানে চরম নিগ্রহের শিকার। বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখন মিডিয়া টাইকুন। একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের দখলে ছয়টি মিডিয়া। ব্যবসায়িক স্বার্থ আর বাণিজ্যিক জোচ্চুরি ঢাকার জন্য এগুলো ব্যবহার হয় না, এমন কথা কে বলতে পারবে? ব্যবসায়ী সাব্বির আলম কিংবা কিশোরী মুনিয়া হত্যা কিভাবে ধামাচাপা পড়ে যায়, তা বুঝতে পারলেও অনেকেরই বলার এবং লেখার মতো স্বাধীনতা নেই। 

বাংলাদেশের অতি পুরাতন পত্রিকা দৈনিক আজাদ এখন প্রকাশিত হয় না। দৈনিক ইত্তেফাক তার প্রথম স্থান ধরে রাখতে পারেনি। এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকা অফিস জ্বালিয়ে দিয়ে এর সম্পাদক আল মাহমুদকে গ্রেফতারের পর এটি আর আলোর মুখ দেখেনি। সময়ের বিবর্তনে এক সময় দৈনিক ইত্তেফাক এবং ইনকিলাব ছিলো পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে। ৯০ এর স্বৈরাচারের পতনের পর মিডিয়া এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। অসংখ্য জাতীয় পত্রিকা প্রকাশিত হয়। দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক ভোর, দৈনিক ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ, বাংলাবাজার পত্রিকাসহ অসংখ্য নতুন পত্রিকা বাজারে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালে ট্রান্সকম গ্রুপের মালিকানায় প্রকাশিত হয় দৈনিক প্রথম আলো এবং যমুনা গ্রুপের মালিকানায় প্রকাশিত হয় দৈনিক যুগান্তর। এ পত্রিকাগুলো প্রচলিত ধারার বাইরে অনেক বৈচিত্র্য নিয়ে আসে। এরপর আসে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের যুগ। সময়ের ধারাবাহিকতায় ইন্টারনেটের অবাধ প্রবাহ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গোটা দুনিয়াকে মানুষের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকল তথ্য পাওয়া গেলেও গণমাধ্যমের অবস্থান কোনো অংশে কমেনি। স্যাটেলাইট টেলিভিশন তাদের সংবাদের নানা বৈচিত্র্য আনলেও দৈনিক পত্রিকার অবস্থা এবং অবস্থান আছে আগের মতোই। খবরের কাগজগুলোকে তুমুল প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হয়। এ প্রতিযোগিতার আছে নানান ধরন এবং নানান রঙ। প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদ আর গোষ্ঠী স্বার্থকে রক্ষা করেই অনেক পত্রিকা নিজেদের প্রভাবকে ধরে রাখে- এটা কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, এটা এক অতি তিক্ত চিরন্তন সত্য। 

বর্তমান সময়ে জাতীয় দৈনিকগুলোর মধ্যে প্রথম আলোর অবস্থান সবার শীর্ষে। দেশ এবং বিদেশে তারা সমানভাবে নিজেদের প্রভাব সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। শুধু সংবাদই নয় নানা ইভেন্ট আয়োজনে তারা পাঠক ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। গণিত অলিম্পিয়াড, প্রথম আলো- মেরিল তারকা প্রতিযোগিতা, কিশোর আলো বন্ধু সভাসহ বিভিন্ন আয়োজনে ছাত্র এবং তরুণদের ধরে রাখতে প্রথম আলো বছরব্যাপী আয়োজন করে নানা অনুষ্ঠান মালার। এ সকল আয়োজনে তারা সকল মহলের কাছে প্রথম স্থান ধরে রাখতে  চেষ্টার ত্রুটি করেন না। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অঘোষিতভাবে তারা সব সময়ই আওয়ামী লীগের প্রতি কোমল সমর্থন জানিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে আসছে। দৈনিক প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন মহলের এক ধরনের যুদ্ধংদেহী মনোভাব এবং তার বহিঃপ্রকাশ সদরে অন্দরে বেশ আলোড়ন তুলছে। পত্রিকাটির জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের করা একটি সংবাদ ফিচার ও ফটোকার্ড নিয়ে এ ঘটনার সূত্রপাত।  যে সংবাদ নিয়ে এতো আলোচনা সমালোচনা সে সংবাদটির ওপর প্রথম আলো নিজেই সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করে সংশোধিত আকারে প্রকাশ করেছে এবং অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত আলোচিত ছবিটিও নেই। সংশোধিত অবস্থায় প্রকাশিত সংবাদটির কিয়দংশ যদি আমরা তুলে আনি তাতে দেখা যায় ‘‘এসব শিশুর মতোই স্বাধীনতা দিবস নিয়ে একই ভাবনা দিনমজুর জাকির হোসেনের। গতকাল শনিবার সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’ স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন দুপুরে স্মৃতিসৌধ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সবুজ মিয়া, মো. হাসান, মো. হোসাইন, মো. লাবিবসহ ১০-১৫ জন শিশু স্মৃতিসৌধের সামনে অপেক্ষারত দর্শনার্থীদের কাছে গোলাপ ফুল বিক্রির চেষ্টা করছে। এ সময় দু-তিনজন ফুল কেনেন, বাকিরা ‘না’ বলে দেন। মো. সবুজের মা মুন্নি আক্তার বাঁশের ঝুড়িতে করে গোলাপ ফুল বিক্রি করেন। সবুজ সেখান থেকে কয়েকটি গোলাপ নিয়ে দর্শনার্থীদের কাছে গিয়ে বিক্রির বায়না ধরেন। স্বাধীনতা দিবসে তার অপেক্ষা প্রতিদিনের চেয়ে একটু বেশি ফুল বিক্রির।’ এই সংবাদটি নিয়ে ক্ষমতাসীন মহলের আপত্তি। দিনমজুর জাকির হোসের জবানীতে বলা হয়েছে পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কি করমু আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব। এই সংবাদের প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দলের সবগুলো উইং একযোগে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একই ভাষায় বিবৃতি প্রদান করেছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়লয় শিক্ষক সমিতি এবং প্রেস ক্লাব ব্যবস্থাপনা পরিষদের বিবৃতি অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তারা তাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে যে, প্রথম আলো শিশু সবুজের ছবি দিয়ে যে সংবাদ প্রকাশ করেছে তা আদৌ সবুজের বক্তব্য নয়। 

দৈনিক প্রথম আলোর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদক অতি অল্প সময়েই জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তবে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলা চলমান আছে। স্বাধীনতা দিবসের একটি সংবাদ বা ফটোকার্ড নিয়ে সরকার এবং সরকার পক্ষের লোকজন এখন খুব ভালোভাবে সরব প্রথম আলোর বিরুদ্ধে। তার গ্রেফতার নিয়ে যে নাটকীয়তা হয়েছে তা আমাদের সকলেরই জানা আছে, এ নিয়ে নতুন কিছু লিখতে চাই না। গভীর রাতে তার বাসায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তাকে তুলে আনা হয়েছে। প্রথমে অস্বীকার পরে স্বীকার করা হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এ কাজটি যে এবারেই নতুন বিষয়টি এমন নয়। বিগত দেড় দশক ধরে এ কাজ চলছে, কারো বিষয় স্বীকার করা হয়, কারো বিষয় স্বীকার করা হয় না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাবার পর কারো বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতে প্রেরণ করা হলে ঐ ব্যক্তির ভাগ্য ভালো বলতে হবে। কিন্তু যাদের বিষয়গুলো স্বীকার করা হয় না। দুর্ভাগ্য ঐ ব্যক্তির আর তার পরিবারের। তার পরিবারের সদস্যরা আর জানতে পারে না কোথায় কিভাবে তাকে রাখা হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এক ধরনের মিডিয়া ট্রায়াল এবং রাজনৈতিক অভিযান চলছে। প্রথম আলোর পক্ষেও সরব আছেন অনেকে। 

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এবং প্রেস ক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটি বিবৃতি দিয়েছে। অন্য আরো অসংখ্য ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানও বিবৃতি দিয়েছে। তবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি যে বিবৃতি দিয়েছে, তা নিয়ে বোদ্ধা মহলে অজ¯্র আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি তাদের বিবৃতিতে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছে তন্মধ্যে একটি হলো, ‘একটি শিশুকে দিয়ে প্রথম আলোর রিপোর্টার যে সংবাদ উদ্ধৃত করেছে তা শিশুটির বক্তব্য নয়।’ তারা তাদের বিবৃতিতে আরো অনেক কথাই উল্লেখ করেছেন যার কিয়দংশ পাঠকদের জন্য উদ্ধৃত করছি ‘‘এতে বলা হয়, একজনের ছবির সঙ্গে আরেকজনের উদ্ধৃতি প্রকাশ, ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিকর ছবি ও বক্তব্য প্রকাশ পাঠকের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। অথচ আলোচিত সংবাদটি প্রকাশের ক্ষেত্রে এসব রীতিনীতি ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। (ঢাবি) শিক্ষক সমিতির  নেতারা মনে করেন, পত্রিকাটিতে সংবাদ প্রকাশের নামে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা চালানো হয়েছে। শিক্ষক সমিতি এ ধরনের অপতৎপরতার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছে।’ মূলত ঢাবি শিক্ষক সমিতি তাদের বিবৃতিতে যা উল্লেখ করেছে, সে কথাগুলো প্রথম আলোর রিপোর্টের সাথে যায় না। কারণ প্রথম আলোর রিপোর্টার বেশ কয়েকজন শ্রমজীবী মানুষের বক্তব্য নিয়েছেন এবং সেই সংবাদের মাঝে একটি শিশুর ছবি ব্যবহার করেছেন। সংবাদ পরিবেশনায় এটি একটি প্রচলিত নিয়ম। অনেকের বক্তব্য নেওয়া হয় এবং তার মধ্য থেকে কোনো একজনের ছবি ছাপা হয়। নামে বেনামে আরো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান যে বিবৃতি দিয়েছে, তারা দলের প্রতি কিংবা সরকারের প্রতি নিজেদের অন্ধ সমর্থনকে জায়েজ করার জন্য বিবৃতি দিতেই পারে কিন্তু প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ কিভাবে অন্ধের মতো এ ধরনের বিবৃতি দিতে পারে? মূলত এ সকল বিবৃতি প্রমাণ করে রাষ্ট্রের সবগুলো অর্গান এখন একটি দলের ইচ্ছা অনিচ্ছার কাছে বন্দী হয়ে আছে। তারা সকলেই সরকারের শেখানো ভাষায় কথা বলছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ‘মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার’-এ যাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে তারাও কেউ কেউ প্রথম আলোর বিচারের দাবিতে রাজপথে সভা সমাবেশ করেছে। 

প্রথম আলো প্রতিষ্ঠা থেকে বর্তমান

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকারি তরফে এতো বাদ-প্রতিবাদ এবং মামলার পর কি প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বড়ো কোনো অ্যাকশনে যাবে সরকার? অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, না সরকার তেমন কোনো অ্যাকশনে যাবে না। কেন যাবে না, এটা বোঝার জন্য দৈনিক প্রথম আলো প্রতিষ্ঠার পেছনের ইতিহাস এবং এর সম্পাদক জনাব মতিউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শিক পরিচয় সম্পর্কে এক ঝলক আলোচনা দরকার। জনাব মতিউর রহমান ১৯৪৬ সালে ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল জীবন থেকেই কমিউনিজমের আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলেন। ছাত্রজীবনে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে দৈনিক ভোরের কাগজের ভূমিকা বরাবরই ছিলো এ দেশের ইসলামপন্থ’ীদের বিরুদ্ধে। ইসলাম ও ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধে ভোরের কাগজের নিন্দনীয় ভূমিকা ছিলো সত্যিই নিন্দনীয়। ১৯৯৮ সালে তিনি প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাকাল হতে এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক কাগজ ‘দেশ’ পত্রিকায় জনাব মতিউর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।১ এ সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘এক কেজি ব্যাঙ এক পাল্লায় মাপা যায়, কিন্তু বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের এক মঞ্চে আর ওঠানো সম্ভব নয়।’ এ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি কমিউনিজমের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তাই সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছি।’ জনাব মতিউর রহমানের সাংবাদিকতা শুধু একটি পেশা নয়, এর পেছনে আছে ভিশন এবং মিশন আর তা হচ্ছে কমিউনিজমকে প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা নিজেরা সরাসরি ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা এখন আর করে না। তারা অপরের মাধ্যমে নিজেদের উদ্দেশ্যকে সফল করতে চায়। এ ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের পছন্দের দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। 

প্রথম আলোর ভূমিকা বরাবর আওয়ামী লীগের পক্ষেই ছিলো। এমনকি ২০০১ সালে চারদলীয় জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ কয়েকটি প্রচারণা জোরদার করে এক. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুই. তথাকথিত হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, তিন. বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এ প্রচারণার ডালাপালা বিস্তারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে প্রথম আলো। ২০০৪ সালে দৈনিক প্রথম আলোতে বেশ কিছু সংবাদ ভাষ্য, উপসম্পাদকীয় এবং সম্পাদকীয় ছাপা হয় যার, মূল আলোচ্য বিষয় ছিলো বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে গেছে! এ প্রচারণার জেরে আসে লগি বৈঠার তাণ্ডব এবং পরবর্তীতে সেনা ব্যাক মঈন- ফখরুদ্দীনের সরকার। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে প্রথম আলোর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। এমনকি এই সরকারের প্রথম দুই টার্ম আওয়ামী লীগের পক্ষেই প্রথম আলোর ভূমিকা ছিলো। সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বে যে নতুনত্ব এবং ক্যারিশম্যাটিক উপস্থাপনা প্রথম আলো নিয়ে এসেছে  এ জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কিন্তু তারা কখনোই ষোল আনা নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেনি। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের বড়ো তিনটি রাজনৈতিক দল বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী কয়েক মাসের ব্যবধানে তিনটি বড়ো সমাবেশ করে। এ সময় প্রথম পাতা এবং দ্বিতীয় পাতা মিলিয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশের নিউজ ছিলো আটটি, বিএনপির সমাবেশের নিউজ ছিলো এর চেয়ে দু একটি কম, আর জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশের কোনো নিউজ ছিলো না, তবে তারা মালিবাগের রাস্তায় দাঁড় করানো সারিবদ্ধ গাড়ির ছবি দিয়ে তার ক্যাপশনে লিখেছিলো ‘জামায়াতের সমাবেশের গাড়ির কারণে জনদুর্ভোগ’। প্রথম আলো অবশ্যই সাংবাদিকতায় একটি নীতি মেনে চলে তবে এটাও তাদের এক ধরনের নীতি যা পাঠকদের হৃদয়ঙ্গম করা দরকার। সেনা সমর্থিত কেয়ার টেকার সরকারের আমলে আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে কার্টুন প্রকাশ করায় দেশের আপামর তৌহিদী জনতা প্রথম আলোর বিরুদ্ধে তুমুল বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো। পরবর্তীতে বায়তুল মোকাররমের খতিব মরহুম ওবায়দুল হকের হাতে হাত রেখে ক্ষমা চেয়ে সে যাত্রা তারা এ বিক্ষোভ হতে নিস্তার পেয়েছিলো। 

শিশিরের কার্টুন আগের মতো প্রকাশিত হয় না

পত্রিকায় কার্টুন ছেপে ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক ধরনের আবহ তৈরির কাজ পৃথিবীর সব দেশের মিডিয়াই করে থাকে। এ সকল কার্টুন তৈরির প্রকাশের ক্ষেত্রে সব দেশের মিডিয়াই একটি সীমা এবং নিয়ম মেনে চলতে চেষ্টা করে। যদিও কোনো কোনো দেশে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মানুষের ধর্মীয় আদর্শ আবেগে আঘাত করা হয়। কার্টুন প্রকাশ করে জনমত তৈরি কিংবা শাসকদের বিরুদ্ধে জনমতকে প্রভাবিত করার কাজ অনেক আগ থেকেই চলে আসছে। সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে মিডিয়ার ওপর সেন্সরশিপ ছিলো বেশ ভালোভাবেই, তবে সেটা বর্তমান সময়ের চেয়ে বেশি নয়। তখন সাপ্তাহিক সুগন্ধা, সাপ্তাহিক বিচিত্রা এবং সূর্যোদয়সহ বেশ কয়েকটি ম্যাগাজিনে প্রতিনিয়ত সরকারের সমালোচনা করে কার্টুন ছাপা হতো। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় সরকারের শাসনামলে প্রথম আলোর প্রথম কিংবা শেষ পাতায় শিশিরের আঁকা কার্টুন ছাপা হতো। এ সব কার্টুনে প্রধানমন্ত্রী এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করা হতো। তখনকার সরকার ঘুণাক্ষরেও এ ধরনের কার্টুন প্রকাশ কিংবা সংবাদ প্রকাশের কারণে কোনো পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বলে কোনো নজির নেই। সেই ধরনের কার্টুন প্রকাশের শক্তি সাহস কি এখনকার কোনো মিডিয়া রাখে? আসলেই না, সরকারের সমালোচনা করে এ ধরনের কার্টুন ছাপা হলে পরের দিন ঐ সম্পাদকের ঘারে মাথা থাকবে কি না সন্দেহ। 

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকার কেন ক্ষিপ্ত হলো?

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকার এবং তাদের অনুসারীরা বেশ ভালোই গোস্বা হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘প্রথম আলো আওয়ামী লীগের, গণতন্ত্রের এবং দেশের মানুষের শত্রু।’ প্রধানমন্ত্রী যেদিন এই ঘোষণা দিলেন সেই দিনই আওয়ামী লীগ পরিচয়ে কতিপয় যুবক প্রথম আলো অফিসে জোরপূর্বক ঢুকে তাদের অফিসের নিয়ন সাইনের পাশে লিখেছে ‘বয়কট প্রথম আলো।’ আওয়ামী লীগ এবারে কেন প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এতো ক্ষিপ্ত হলো? সরকার দেখেছে মিডিয়ায় এখন প্রথম অবস্থায় আছে প্রথম আলো, তারা ইদানীং অব্যাহতভাবে সরকারের বড়ো বড়ো দুর্নীতি আর দেশের বড়ো বড়ো সমস্যাগুলো তুলে ধরছে। এটাকে সরকার আর টলারেট করতে চাইছে না। প্রথম আলোকে অন্যান্য মিডিয়ার মতো বন্ধ করে দিতে গেলে সরকারকে নানামুখী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। এতো সব সমস্যার সাথে আরো বড়ো কোনো ঝামেলায় পড়ার চেয়ে এক প্রথম আলোকে চাপে রাখতে পারলে অন্যান্য সব মিডিয়া স্বেচ্ছায়ই সরকারের বশীভূত হয়ে যাবে। এমনিতে অধিকাংশ মিডিয়া সরকারের দমননীতির কারণে সেল্ফ সেন্সরশিপের নীতি আরোপ করেই নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখছে। এই সেল্ফ সেন্সরশিপের পেছনে অবশ্য বড়ো মাপের বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে। সরকার মিডিয়াপাড়ার টাইকুনকে একটু নাড়া দিয়েছে বা বলা যায় মৃদু ভূমিকম্প সৃষ্টি করে সবাইকে একটু ঝাঁকুনি দিয়েছে। এই ঝাঁকুনিতে হয় সব মিডিয়া এক বাক্যে সরকারের পক্ষে কোরাস গাইবে অথবা তাদেরকে অতীতে যারা বন্ধ হয়ে গেছে তাদের পরিণতি ভোগ করতে হবে। সরকারের এ নীতি বলে দেয় বাংলাদেশে কথা বলার স্বাধীনতা কিংবা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আসলে কতটুকু। 

সরকার সবাইকে চুপ করিয়ে দিতে চায়

বাংলাদেশে এখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এককভাবে শাসক দল এবং তাদের যারা মিত্র তাদের জন্য অবারিত। সরকারের সমালোচনাকে রাষ্ট্রের সমালোচনা হিসেবে গণ্য করা হয়। সরকারি দলের সমালোচনাকে দেশদ্রোহিতা হিসেবে গণ্য করার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের প্রয়োগে কখন কাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে তা বোঝা মুশকিল। ২০২১ সালের ২৫ জুলাই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে বলা হয় Bangladesh has at least 433 people imprisoned under the DSA as of July 2021, most of whom are held on allegations of publishing false and offensive information online. Those targeted include journalists, cartoonists, musicians, activists, entrepreneurs, students and even a farmer who cannot read or write, among others. In one case, writer Mushtaq Ahmed died in prison after languishing there for 10 months without trial on accusations under the DSA. One inmate alleged that he was subjected to torture. এই রিপোর্টের কয়েকটি লাইন বলে দিচ্ছে, শুধুমাত্র ২০২১ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে ৪৩৩ জন লোককে সরকার কারাগারে নিয়েছে। এর মধ্যে ছিলেন, সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, গায়ক, অভিনেতা, ছাত্র এবং কৃষক। এখানে ফটোসাংবাদিক মুশতাক আহমদের কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে। যার তোলা ছবি অনলাইনে প্রকাশিত হওয়ার কারণে সরকারের ক্ষতি হয়েছে বলে তারা মনে করেছে। এ কারণে মুশতাক আহমদকে দীর্ঘ দশ মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে। 

অর্থাৎ যদি তুমি কথা বলতে চাও আমার শেখানো ভাষায় কথা বলো নইলে চুপ হয়ে যাও। প্রথম আলোর সাথে সরকারের সেই আচরণ চলছে। জনগণের অধিকার রক্ষায় তারা কি এই কর্তৃত্ববাদী শাসনকে মেনে নিয়ে টিকে থাকার সংগ্রাম করবে নাকি জনতার মনের ভাষাগুলো প্রকাশ করে জনতার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শামিল হয়ে নিজের স্বাধীন সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করবে, আগামী দিনে তাদের ভূমিকাই তা বলে দেবে। এ বিষয়টি পর্যালোচনার আগে আমাদের একবার পেছনে ফেরা দরকার বলে মনে করি। এ সরকারের আমলে নানান অজুহাতে ইতঃপূর্বে বহু মিডিয়া বন্ধ হয়ে গেছে, বহু সাংবাদিককে হেনস্থা, আটক এবং দেশ ছাড়া করা হয়েছে। আজ যারা প্রথম আলোর অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করছেন, তাদের এ আন্দোলনে শতভাগ সমর্থন ব্যক্ত করে কিছু অপ্রিয় সত্য অতি সংক্ষেপে সামনে নিয়ে আসতে চাই। আমার দেশ পত্রিকার অফিসে যখন তালা লাগিয়ে এর সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়েছিলো আজ যারা চিৎকার করছেন তখন চুপ ছিলেন। যখন দিগন্ত টিভি এবং ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তখন অনেকেই চুপ ছিলেন। যখন চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয় তখন অনেকেই কথা বলেননি। শীর্ষ নিউজ যখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো তখনো অনেকেই চুপ ছিলেন। দৈনিক সংগ্রাম অফিসে হামলা করে যখন একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিককে নাজেহাল করা হয়েছিলো তখনো অনেকেই চুপ ছিলেন আর অনেকে ডুগডুগি বাজিয়েছেন। মিডিয়ার ওপর সরকারের অব্যাহত দমন নীতির বিরুদ্ধে সকল মহলের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ হলে আজ প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকার এভাবে তার অনুসারীদের উসকে দেয়ার কথা চিন্তা করতো না। 

আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমান

২০০৪ সালে  দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর এক এগারো সরকারের আমলে পত্রিকাটি তৎকালীন সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ হবার উপক্রম হয়। তখন পত্রিকাটি নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসেন দেশের বেশ কিছু চিন্তাশীল মানুষ। সম্পাদকের দায়িত্ব নেন জনাব মাহমুদুর রহমান। ২০০৮ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমার দেশ সরকারের নানান অসঙ্গতি আর দুর্নীতি-দুরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ হয়ে আবির্ভূত হয়। আওয়ামী দুর্নীতির নানান খবর প্রকাশের কারণে ২০০৯ সালেই পত্রিকাটির বিরুদ্ধে ২৫টি মামলা করা হয়। ২০১০ সালের ১ জুন মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। পত্রিকাটির অফিসে তালা লাগিয়ে প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আদালতের রায়ে পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত থাকলেও আমার দেশ সম্পাদককে কারাগারেই দিন কাটাতে হয়। এত কিছুর পরও আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী নানা সংবাদ। আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারকদের স্কাইপে কেলেঙ্কারি, গণ আদালত, শাহবাগ মঞ্চসহ বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশের কারণে সরকারের আবারো খড়গহস্ত হয় পত্রিকাটির ওপর। ২০১৭ সালে কুষ্টিয়ার আদালতে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের ওপর ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা চালায় নজিরবিহীন নির্যাতন। বন্ধ হয়ে যায় আমার দেশের প্রকাশনা। সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান এবং অলিউল্লাহ নোমানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়া হয়। অবশেষে তারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। আমার দেশ পত্রিকা অফিসে যখন এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান অবরুদ্ধ ছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আজ আমার বিরুদ্ধে সরকার যে ভূমিকা পালন করছে, ভবিষ্যতে যদি কখনো প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকার এমন আচরণ করে আমি চুপ থাকবো না, আমি প্রথম আলোর পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবো।’ স্মর্তব্য যে, আমার দেশ পত্রিকার বিরুদ্ধে সরকারের ন্যক্কারজনক আচরণ ও এটি বন্ধ করে দেওয়ার সময় প্রথম আলো রহস্যজনক কারণে সরকারের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে কোনো ভূমিকা রাখেনি অথচ তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিলো।  

দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন 

টেলিভিশন জগতে এক নতুনত্ব নিয়ে হাজির হয়েছিলো দিগন্ত টেলিভিশন। অতি অল্প সময়ে এ চ্যানেলটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শাহবাগে তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ নামক কতিপয় রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট তরুণের জমায়েতকে সরকার সমর্থক সকল মিডিয়া প্রতিদিন ফলাও করে প্রচার করতে থাকে। এর সাথে উত্থান ঘটে কিছু ধর্ম বিরোধী ব্লগারের। তারা প্রতিনিয়ত ইসলাম, ইসলামী আদর্শ, আল্লাহ, রাসূল এবং ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধে নানান কুৎসামূলক লেখা প্রকাশ করতে থাকে। এর বিরুদ্ধে উত্থান ঘটে হেফাজতে ইসলামীর। শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশ। এ সমাবেশের লাইভ টেলিকাস্ট করে দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন। লাইভ অনুষ্ঠান চলাকালেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে এ টেলিভিশন চ্যানেল দুটির প্রকাশনা সাময়িক বন্ধ করে দেয়। সাময়িক নিষেধাজ্ঞার আড়ালে এখনো বন্ধ আছে টেলিভিশন চ্যানেল দুটির প্রচার। সেদিন যারা দিগন্ত টেলিভিশন এবং ইসলামিক টেলিভিশন বন্ধে খুশি হয়েছিলো, সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণ এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে তাদেরকে করুণ কান্নার জন্য অপেক্ষ করতে হবে বৈকি। 


চ্যানেল ওয়ান এবং যায়যায়দিন

দিগন্ত টেলিভিশনকে কোনো কারণ ছাড়াই সরকার বন্ধ করে দেয়। চ্যানেল ওয়ানের মালিকানা পরিবর্তন এবং তাদের সরকারি অনুমোদনের কাগজে সমস্যা আছে এই কথা বলে জনপ্রিয় এই চ্যানেলটি সরকার বন্ধ করে দেয়। সরকারের কর্তৃত্ববাদী এ সকল আচরণের ব্যাপারে তখন প্রথম আলো কিন্তু নীরব ভূমিকা পালন করেছিলো। শুধু নীরব ভূমিকা নয়, সরকার সমর্থক অনেক মিডিয়া বরং সরকারের এ সকল ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমকে সমর্থন করেছিলো। আজ যখন প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকার খড়গহস্ত তখন প্রথম আলোকে নিজেদের অতীত ভূমিকা সম্পর্কে একবার একটু ভাবা দরকার বলে মনে করি। 

আবুল আসাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন 

দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক জনাব আবুল আসাদ একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক। ক্ষুরধার লেখনী, ইতিহাস অন্বেষা এবং জাতিসত্তার শেকড়সন্ধানী লেখক হিসেবে তার সমতুল্য সাংবাদিক বর্তমান মিডিয়া জগতে খুব কমই আছে। সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় দৈনিক সংগ্রাম অফিসে একটি ভুঁইফোঁড় সংগঠন হামলা করে আবুল আসাদকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। তাকে তার অফিস থেকে তুলে নিয়ে আসে এবং পুলিশ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করার পরিবর্তে আবুল আসাদকে গ্রেফতার করে। বর্ষীয়ান এই সাংবাদিক দুই বছর কারান্তরীণ থাকেন। একই ঘটনায় পরবর্তীতে গ্রেফতার করা হয় রুহুল আমীন গাজীকে। তিনিও দুই বছর যাবৎ কারান্তরীণ ছিলেন। এ সকল ঘটনায় প্রথম আলো কি কোনো প্রতিবাদী লেখা কিংবা সংবাদ ছেপেছিলো? একবাক্যে উত্তর হবে, ‘না’। বরং আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ হওয়ার পেছনে প্রথম আলোর প্রকাশ্য ভূমিকা তখন অনেকেরই নজর এড়ায়নি। 

মিডিয়া এবং জনগণের বাকস্বাধীনতা হরণের কালো আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

সরকার তার কর্তৃত্ববাদী আচরণ দ্বারা নানাভাবে জনগণের কণ্ঠকে রোধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মানুষ এখন কথা বলতে ভয় পায়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কতটুকু স্বাধীন, এ প্রশ্ন করাও আজ ভারী অন্যায়। জীবন নিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার এবং জীবনকে যথার্থভাবে উপভোগ করার ব্যারোমিটারে কিছু কাল্পনিক রেখা টানা হয়েছে। কর্তৃত্ববাদের জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষগুলো কথা বলে লাল নীল ব্যারোমিটারের অঙ্কিত রেখা অনুসরণ করে। কর্তৃত্ববাদের ধারক এবং বাহকরা গোটা দেশ এবং দেশের জনগণকে দেখে লাল নীল হলুদ চশমার রঙিন অবয়বে। মানুষের কষ্টগুলো মানুষ বলতে পারবে না। ‘‘আজ মন ভালো নেই’’  সোস্যাল মিডিয়ায় এ কথা লিখলেও নাকি ভারী অন্যায় হয়ে যাবে এবং যে কোনো সময় তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়ে যেতে পারে। দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় সকল জায়গায় একদল আঁতেল, মোসাহেব এবং তক্ষক তৈরি হয়েছে, যারা কর্তৃত্ববাদের ভিতকে মজবুত করার কাজে নিজেদের চেষ্টা তদবিরের অন্ত রাখে না। এর সাথে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। দেশের সকল বিবেকবান মানুষ এই আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছে। মূলত এই আইনেই বর্তমানে সাংবাদিকদের ঘায়েল করা হচ্ছে। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ

বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকারটার্ক। এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানিয়েছেন। ভলকারটার্ক বলেছেন, ‘আমি উদ্বিগ্ন যে বাংলাদেশ জুড়ে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন এবং অনলাইনে সমালোচকদের কণ্ঠ রোধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি পুনরায় কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিলম্বে এর প্রয়োগ স্থগিত এবং এই আইনকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে এর বিধানাবলিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আহ্বান জানাচ্ছি।’ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে এই আইনে দুই হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। সর্বশেষ ২৯ মার্চ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ  দৈনিক সংবাদপত্র প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান এর শিকার হয়েছেন। জাতিসংঘের এই বিবৃতিতে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বাড়িতে তল্লাশি এবং প্রথম আলোর সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলার নিন্দা জানিয়ে তা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের লাইসেন্স বাতিলের নিন্দা জানিয়ে তাদেরকে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন। 

অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব

প্রথম আলো অতীতে সরকারের অন্যায় কাজের সমালোচনা করেনি কিংবা বিভিন্ন মিডিয়া বন্ধ হওয়ার পর তারা প্রতিবাদ করেনি। এ জন্য বিবেকবান নাগরিক হিসেবে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকারের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করবো না, তা হয় না। অন্যায়, সব সময় অন্যায়, সেটা যার বিরুদ্ধে হোক, যিনি করুক। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা বিবেকবান নাগরিক হিসেবে সকলের দায়িত্ব। সেই বিবেকের তাড়না থেকে সরকারের এই আচরণের প্রতিবাদ করছি। দেশের প্রতিটি নাগরিকের এই প্রতিবাদে শামিল হওয়া উচিত। এই প্রতিবাদ প্রথম আলোর পক্ষে নয়, বরং জালিমের বিপক্ষে, অন্যায়ের বিপক্ষে, অব্যাহতভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় যে কালো পর্দা টেনে দেয়া হয়েছে সে পর্দা অপসারণের জন্য এই প্রতিবাদে শামিল হতে হবে। সরকার প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সফল হলে অন্য সকল মিডিয়াকেও একইভাবে বধ করবে। শুধু তারাই ক্ষীণ আলো নিয়ে বেঁচে থাকার কসরত করতে পারবে যারা কর্তৃত্ববাদী সরকারের সেবাদাসের ভূমিকায় নিজেদেরকে সোপর্দ করে দিতে পারবে। একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে নতজানু হয়ে হাজার বছর বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। সরকার মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যমে জনগণের মতপ্রকাশকে বন্ধ করার জন্য যে কালো আইন তৈরি করেছে তা বাতিল করতে সকলকে একযোগে সোচ্চার হওয়াই বিবেক এবং দেশপ্রেমের দাবি। একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। এক বনে বাস করতো এক সিংহ। যে ছিলো বনের রাজা। তার সহকারী হিসেবে কাজ করতো একটি বাঘ এবং একটি শিয়াল। একদিন দুই সহকারীকে সিংহ পাঠালো খাবার সংগ্রহ করে আনার জন্য। বাঘ আর শিয়াল দু’জনে মিলে একটি খরগোশ, একটি গাভী এবং একটি মোরগ শিকার করে আনলো। সিংহ জিজ্ঞেস করলো, কিভাবে খাবার ভাগ করা হবে? বাঘ উত্তর দিলো আপনি গাভীটি খাবেন, আমি খরগোশ খাবো আর শিয়াল মুরগিটি খাবে। বাঘ এই কথা বলার সাথে সাথে সিংহ বাঘের মাথায় এমন জোরে লাথি মারলো। বাঘ পাহাড়ের পাথরের ওপর পড়ে মস্তক চূর্ণ হয়ে মারা গেলো। সিংহ এবার শিয়ালকে বললো খাবার ভাগ করো। শিয়াল বললো, রাজা মশাই, আপনি মুরগি দিয়ে ব্রেক ফাস্ট করবেন, গাভী দিয়ে লাঞ্চ সারবেন আর খরগোশ দিয়ে ডিনার সমাপন করবেন। সিংহ স্মিতহাস্যে জবাব দিলো এতো সুন্দর বণ্টননামা তুমি কোথায় শিখলে? শিয়াল জবাব দিলো, একটু আগে আমার বন্ধু বাঘ মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে এ বণ্টননামা শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে। সরকার আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, চ্যানেল ওয়ান এবং দিনকাল বন্ধ করে বাংলাদেশী মিডিয়াকে শিখিয়েছে কিভাবে সেল্ফ সেন্সরশিপ আরোপ করে চলতে হয়। চলার পথে যা দু’চারটি অযাচিত সত্য বের হয়ে আসে তাও সরকারের সহ্য হচ্ছে না। একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের চরম অসহ্য ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশই এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। 

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির