post

মিসরে ইসলামী আন্দোলন ও ইখওয়ানুল মুসলিমুন

১৭ নভেম্বর ২০১২

 ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম

Story(গত সংখ্যার পর) হোসনী মোবারকের পদচ্যুতি ঘটানোর ব্যাপারে ইখওয়ানুল মুসলিমুন সাধারণ মিসরীয়দের সাথে ছিল সম্পূূর্ণ ঐক্যবদ্ধ। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যকে অটুট রাখাই ছিল ইখওয়ান নেতাকর্মীদের অন্যতম কাজ। হাজারো চেষ্টা করেও হোসনী মোবারক সরকার ও সামরিক বাহিনী মিসরীয় জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারেনি। পারেনি মীরজাফর, জগৎশেঠ, লেন্দুপ দর্জি সৃষ্টি করতে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল মিসরের গ্রামে-গঞ্জে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সফল গণবিপ্লব ঘটেছে মিসরে। বিপ্লবোত্তর মিসরে প্রথমে খসড়া সংবিধান নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়। পার্লামেন্ট নির্বাচনের বৈধতা নিয়েও বিতর্ক ওঠানো হয়। নির্বাচনকে সেনাবাহিনী ভয় পায়। নির্বাচন বানচালের জন্য বা প্রলম্বিত করার জন্য মোবারকপন্থী সেনাবাহিনী বিশেষ করে সিনিয়র সামরিক এলিটরা ঘৃণ্য চক্রান্ত শুরু করে। অথচ মিসরীয়রা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই লাভ করতে চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। যাই হোক শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর মিসরে পার্লামেন্ট নির্বাচনের জটিল নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই নির্বাচনী প্রচারণা তুঙ্গে ওঠে। মোট তিনটি পর্বে নির্বাচন হয়েছে। ২০১২ সালের মার্চে নির্বাচনপ্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। সবশেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। মিসরে মোট ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি। প্রথম দফায় ২৮ নভেম্বর ৫০৮ সদস্যের পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষের তথা গণপরিষদের নির্বাচন শুরু হয়। এ নির্বাচনে অনেক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। কয়েকটি ইসলামপন্থী দল, নাসেরপন্থী দল, বামপন্থী দল, কয়েকটি উদারপন্থী দল এবং শ্রমিক দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগী পার্টি হচ্ছে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ইখওয়ানুল মুসলিমুনের রাজনৈতিক সংগঠন ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (ঋঔচ), আরবিতে হিজবুল হুররিয়াহ ওয়া আদালাহ। তাদের জনসমর্থন বিভিন্ন নির্বাচনপূর্ব যাচাইয়ে দেখা গেছে ৪০ শতাংশ বা তার বেশি। এ অবস্থায় তারা পার্লামেন্টে প্রধান গ্রুপে পরিণত হবে। তারা ১২টি দলের একটি জোট করে নির্বাচন করছে। তারা একা ক্ষমতায় যেতে চায় না। জোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়। ইসলামপন্থী দলের ব্যানারে বিভিন্ন মহলে যে এলার্জি আছে সে কারণেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, একজেপি মিসরের তৃণমূল সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের রাজনৈতিক শাখা। ১৯২৮ সাল থেকে ইখওয়ান মিসরে বিভিন্ন অসুবিধা ও অত্যাচারের মধ্য দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। মিসরের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোট হয়েছে কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, কায়ুম, লাক্সর, পোর্ট সাইদ, দামিয়েত্তা, কাফর আল শেখ ও লোহিত সাগরের প্রদেশে। ২০১১ সালে ২৮ নভেম্বর শুরু হয়ে প্রথম পর্বের ভোট চলে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ নির্বাচনে ৫০টির বেশি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, গত ৬০ বছরে মধ্যে এটি মিসরের সবচেয়ে স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন। এদিকে প্রথম পর্বের পার্লামেন্ট নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ায় মিসরকে স্বাগত জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে দেশটির সর্বোচ্চ সামরিক পরিষদ। স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে তা সন্ধ্যা ৭টায় শেষ হয়েছে। রাজধানী কায়রোর ভোটাকেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। মিসরের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফায় ইখওয়ানুল মুসলিমুনের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি সর্বাধিক আসনে বিজয়ী হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সালাফিপন্থী আল-নূর পার্টি। ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির ৪৫ জন প্রার্থী প্রথম দফা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তার মধ্যে ৩৪ জন প্রার্থীই বিজয়ী হয়েছেন। প্রথম দফার নির্বাচনে মোট ১০৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এর মধ্যে ৪৫ জন ছিলেন ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির এবং আল নূরের ২৬ জন। সালাফিপন্থী আল নূর পার্টি সবাইকে অবাক করে দিয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। তারা ৬টি আসন লাভ করে। এ ছাড়া আল ওয়াকদ পার্টি ১, লিবারেল জাস্টিস পার্টি ১ এবং ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থী জোট ইজিপশিয়ান ব্লক ১টি আসনে বিজয়ী হয়। অপর ৪টি আসনে জয় লাভ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এর মধ্যে ২ জন হচ্ছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারকের (জন্ম মে ১৯২৮) ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (ঘউচ) সদস্য। অপর ২ জন বিজয়ী স্বতন্ত্র সদস্য ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। দলটি এ পর্বে পেয়েছে মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৪৭ দশমিক ৬ ভাগ। সালাফিপন্থী আল নূর পার্টি পেয়েছে  ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট। ইসলামপন্থীরা সম্মিলিতভাবে ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পায়। দ্বিতীয় দফায় ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। এ পর্যায়ে ভোট দিয়েছেন গিজা, বনি সুয়েক, মেনুকিয়া শার্কিয়া, বহিরা, সুয়েজ, ইসমাইলিয়া, সোহাগ ও আসওয়ান। ভোট চলেছে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। মিসরের পার্লামেন্টের দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনেও সর্বাধিক ভোট পেয়েছে ইসলামপন্থী দলগুলো। এ পর্বের ফলাফলে দেখা য়ায় ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি ৩৬.৫ শতাংশ ও সালাফিদের আল নূর পার্টি ২৮.৭৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এই দুই দলের সম্মিলিত ভোট ৬৫ শতাংশ। এ ছাড়া আল ওয়াকদ পার্টি ৯.৬ শতাংশ এবং দি ইজিপশিয়ান ব্লক পেয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ ভোট। দ্বিতীয় পর্বে নির্বাচন হয়েছে ১৮০টি আসনে। শেষ ও চূড়ান্ত পর্বের ভোট শুরু হয় ২০১২ সালের ৩ জানুয়ারি। দ্বিতীয় ও শেষ দফায় নীল বদ্বীপ দক্ষিণ সিনাইয়ের পর্যটনকেন্দ্র ও দক্ষিণের পল্লী অঞ্চলসহ ৯টি প্রদেশে ভোটগ্রহণ হয়েছে। শেষ দফাতেও ইখওয়ানুল মুসলিমুনের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে। প্রথম অবাধ সাধারণ নির্বাচনে এ দলটি ক্ষমতাসীন হয়ে অন্যান্য দলের সহায়তায় মিসরের সংবিধান প্রণয়নে নেতৃত্বদানকারীর ভূমিকা পালন করছে। সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পর পাশ্চাত্য এবং খোদ মিসরে ইখওয়ানুল মুসলিমুন এবং এর রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানো হয়েছে। জাতীয় স্বার্থ ও ইসলামী শরিয়ার ব্যাপারে নিরপেক্ষ হওয়ায় পশ্চিমারা ইখওয়ানে ব্যাপারে ভীত। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বর্ণবাদী ইসরাইল। একই কারণে মিসরের সেনাবাহিনীও ইখওয়ান ও এর রাজনৈতিক দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টিকে সহ্য করতে চায় না। মিসরীয় সেনাবাহিনী শুধু পশ্চিমা সামরিক প্রশিক্ষণ ও কালচারই ধারণ করছে না, সেনাবাহিনী বিপুল পরিমাণ মার্কিন সহায়তারও ভাগীদার। এ ছাড়া মিসরীয় সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠানিকভাবে দেশের লাভজনক ব্যবসায়ী প্রকল্পেও যুক্ত। শতকরা ৯৫ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত মিসরকে ইসরাইলের বন্ধু হিসেবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করার পেছনে সেনাবাহিনীর সবিশেষ ভূমিকা আছে। মার্কিন লেজুড়বৃত্তি থেকে সেনাবাহিনী বেরিয়ে না এলে তারা ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে কখনও জনমতের প্রতিধ্বনি করতে পারবে না। ইসরাইলের কাছ থেকে হারানো সিনাই মালভূমি ফিরে পাওয়া ছাড়া মিসর শান্তিচুক্তির আর কোন বিনিময় পায়নি। তবে ইসরাইল মার্কিন অক্ষের পক্ষে স্থিতাবস্থা রক্ষা করার বিনিময়ে মিসর মার্কিন আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে। এর বিনিময়ে মিসর ইসরাইলের গ্যাস চাহিদার বৃহদাংশ মেটায় এবং ইসরাইলের পক্ষে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামীদের ওপর নজরদারিসহ নানা অন্তর্ঘাতে সহায়তা দিয়ে আসছিল। তবে নীল বিপ্লবের পর মিসর ইসরাইলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ফিলিস্তিনিদের এবং মজলুম মানবতার পক্ষ নিতে শুরু করেছে। (চলবে) লেখক : বিশিষ্ট ব্যাংকার ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির